আলবার্ট চিনুয়ালুমোগু আচেবে প্রয়াণে প্রাসঙ্গিক চিন্তা : বাংলাদেশে

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশ্ব গণমাধ্যমে সাহিত্য-সংক্রান্ত সর্বশেষ টাটকা খবর : চিনুয়া আচেবে আর নেই। অনেক ফোন পেলাম। সচরাচর এমন ঘটে না। ঢাকার আচেবে-উৎসাহীদের একজন হিসেবে ২০০৮ সালে দিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সে-সম্মেলন। আরো নানাভাবে বন্ধুরা, ছাত্রছাত্রী আমার আচেবে-উৎসাহ সম্পর্কে জানেন। আচেবের দেশবাসী-
লেখক ওলে সোয়িংকার নাটক নিয়ে গবেষণা করার সুযোগও পেয়েছিলাম
আমি। তবে এ-মুহূর্তে যা ভাবনা-অনুভূতি, শ্রদ্ধেয় সম্পাদক আবুল হাসনাতের তাগিদেও তা গুছিয়ে লিখতে পারবো কি-না জানি না।

দুই
চিনুয়া আচেবের জীবনের অন্যতম-শেষ প্রবন্ধ সংকলন হোম অ্যান্ড একজাইল। ততোদিনে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসে কেটে গেছে তাঁর জীবনের দশটি বছর। ভেবেছিলেন, দেশে ফিরতে পারবেন অল্পদিনের মধ্যে। কিন্তু শরীরটা কিছুতেই ঠিক হয়ে উঠছিল না, স্বদেশে ফিরতে পারছিলেন না। হৃদয়ে এক গভীর অতৃপ্তি নিয়ে প্রবাসে থাকা। বলা যায়, ঘরে ফেরার সেই আকুতির প্রকাশ এই সংকলনের নামকরণেও। সংকলনের প্রথম প্রবন্ধে আচেবের শৈশবের স্মৃতিচারণ, ইগবোভূমির গ্রাম ওগিডির কথা। নাইজেরিয়ার ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ে আচেবে প্রথমে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মেডিসিন ছেড়ে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে নাম লেখান তিনি। ভবিষ্যৎ লেখক-জীবনের সূত্র পেয়ে যান সেখান থেকেই।
এই সংকলনের দ্বিতীয় প্রবন্ধ আচেবের লেখক-হয়ে-ওঠার কাহিনি। ইংরেজি বিভাগে তাঁদের পাঠ্য ছিল (অ্যাংলো-আইরিশ লেখক) জয়েস ক্যারির নাইজেরিয়ার পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস মিস্টার জনসন। ১৯৫২ সালে টাইম পত্রিকায় এ-উপন্যাসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে একে বলা হয়েছিল ‘আফ্রিকা সম্পর্কে লেখা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস’। উপন্যাসে মিস্টার জনসন নামে একজন নাইজেরীয়কে হাবাগোবা আর নির্বোধ ভাঁড় হিসেবে এমনভাবে হাজির করা হয়েছে, কোনো নিরপেক্ষ মানুষ তাকে মেনে নিতে পারবে না। আচেবে লিখেছেন, এই লেখকের আপাত-হাস্যকর এবং নির্দয় বর্ণনার নিচে ছিল ঘৃণা আর অসহিষ্ণুতার মনোভাবের এক চোরা স্রোত। জনসনের ভাঁড়ামির মধ্য দিয়ে জয়েস ক্যারি সকল নাইজেরীয়কেই বিদ্রƒপ করছিলেন। আচেবে লিখেছেন : ‘মিস্টার জনসন আমার চোখ খুলে দিলো। আমার ঘর আক্রান্ত।’
আচেবের ছাত্রবয়সের এই উপলব্ধির ফসলই হলো ১৯৫৮-তে প্রকাশিত বিখ্যাত উপন্যাস  থিংস ফল অ্যাপার্ট। প্রকৃতপক্ষে মিস্টার জনসন কোনো একক বা বিচ্ছিন্ন রচনা নয়, আফ্রিকা নিয়ে পশ্চিমা লেখকদের লেখা অনেক বইয়ের একটি তা। এসব লেখায় আফ্রিকার মানুষের যে-ছবি আঁকা হয়েছে, তা লেখালেখির পক্ষে রীতিমতো কলঙ্ক, নির্লজ্জ মিথ্যাচার। পরবর্তীকালে আচেবে বলেছেন, আফ্রিকার বঞ্চিত মানুষের ‘পুনর্গল্পায়ন’ শুরু হয়েছে, এই প্রক্রিয়া একুশ শতকেও চলবে। তবে, আফ্রিকার মানুষ শুধু নয়, সারা পৃথিবীর মানুষই তাদের নিজেদের গল্প নিজেরা বলবে। এইভাবে পৃথিবীতে তৈরি হবে গল্পের ভারসাম্য। বিয়োদান জেয়িফোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও আচেবে অত্যন্ত অর্থপূর্ণভাবে বলেছিলেন, ‘আমার মনে পড়ে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র অলুমাইডে বলেছিল যে, Joyce Cary-i Mister Johnson-এর যে একমাত্র অংশটি তার ভালো লাগে, তা হলো Johnson-কে যখন গুলি করা হয়। অলুমাইডের কথা আমাদের শিক্ষককে আতঙ্কিত করেছিল। কিন্তু, আমরা তখন
যে-সঙ্কুচিত অবস্থানে ছিলাম, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করছিলাম। এবং তখন যদি কেউ অত্যুক্তি করে থাকে, তার কারণও বোঝা উচিত ছিল।’
চিনুয়া আচেবে এবং তাঁর থিংসের গুরুত্ব আফ্রিকায় এই পুনর্গল্পায়নের ধারাটির সূচনা ঘটানোর ক্ষেত্রেই। প্রথমত তিনি তাঁর নিজের বেলায় গল্প এমনভাবে বলেছিলেন যে, তা একই সঙ্গে আরো অনেকের গল্প হয়ে উঠেছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন : ‘আমার গল্প ঠিক কীভাবে অন্য মানুষের গল্প হয়ে উঠল তা বুঝতে পারলাম যখন দক্ষিণ কোরিয়ার এক মহিলা কলেজের কোনো একটি ক্লাসের সব ছাত্রী আমাকে চিঠি লিখে থিংস ফল অ্যাপার্ট সম্পর্কে তাদের নিজস্ব মতামত জানাল। আমি বুঝতে পারলাম, ওদের ইতিহাসও থিংস ফল অ্যাপার্টের মতন, ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস। ওদের ঔপনিবেশিক দেশ প্রতিবেশী জাপান।’ বাকিটা হচ্ছে একটি সফল দৃষ্টান্ত এবং তার চেতনার যে-সুফল ফলতে দেখা যায়। বলা হয় যে, থিংসের সড়ক ধরেই এগিয়েছে আফ্রিকার সাহিত্যকৃতির পরবর্তী ইতিহাস। এমনকি তার পরোক্ষ সুফল ফলেছে রাজনীতির ক্ষেত্রেও : আচেবের সত্তরতম জন্মদিনের বক্তব্যে নেলসন ম্যান্ডেলার মতো জননেতা বলেছিলেন, ‘আচেবের (রচনার) সাহচর্যে জেলখানার আগল খসে পড়তো।’ ম্যান্ডেলা আরো জানান, ২৭ বছরের কারাজীবনে তাঁকে অনেক প্রেরণা এবং মনোবল জোগান দিয়েছিল চিনুয়া আচেবের লেখা। ম্যান্ডেলার মতে, আচেবেই আফ্রিকার প্রথম লেখক যিনি নিজের শেকড় আফ্রিকার জমির গভীরে প্রোথিত রেখে এ-মহাদেশকে বিশ্বের দরবারে সঠিকভাবে উপস্থিত করতে পেরেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তাই, ক্ষেত্র স্বতন্ত্র হলেও আমাদের মহাদেশে শ্বেত আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুক্তির যুদ্ধে এক অর্থে আমরা দুজনে সহযোদ্ধা।’ এরকম একটি বোধ থেকেই বোধহয় বলা যায়, বাংলাভাষার বড় লেখক-শিল্পীরাও তাঁদের ভাষা ও ভূখণ্ডের জন্যে যাবতীয় মুক্তিযুদ্ধের বড় সংগ্রামী, বড় বীর।
যার গল্প, তার বলার গুরুত্ব অনেক। সেখানে সে প্রথমে দেখছে, তারপরে বিবরণ, বাচন উপস্থিত করছে Ñ যে-দুয়ের মধ্যেই রয়েছে তার মুক্তিলাভের প্রয়াস। আচেবে উপন্যাস লিখতে এসেছিলেন আফ্রিকার পক্ষ থেকে এভাবে একটি প্রতিবিবরণ হাজির করার জন্যেই। আর তা তিনি যুগপৎ এমন বলিষ্ঠতা আর ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে করেছিলেন যে, শুধু ঔপনিবেশিক ভাষ্যের মিথ্যাটাই ধরা পড়েনি, সেইসঙ্গে আফ্রিকার পক্ষভুক্ত বিবরণের শ্রেয়তাও বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে থিংসও দ্রত হয়ে উঠলো এক আধুনিক ক্ল্যাসিক। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো এই যে, এজন্যে প্রয়োজনীয় আত্মজ্ঞান, আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মসমালোচনার পরীক্ষিত পথে চলার বিস্ময়কর প্রস্তুতি প্রমাণ করলেন যাদেরকে অসভ্য, বর্বর ইত্যাদি বলা হয়েছিল তাদের দিককার একজন লেখকই। থিংসের ব্যক্তিনায়ক ওকোনকোর শুধু নয়, ইবো সমাজ/ সম্প্রদায়ের ত্র“টি-দুর্বলতা নির্দেশ করতেও আচেবে এ-উপন্যাসে সমান দ্বিধাহীনতাই প্রমাণ করেন। আর এ-ধারাটি শুধু আচেবেকে নয়, সোয়িংকা, ওকিবোর মতো অন্য আফ্রিকীয় লেখককেও নিয়ে গেছে পশ্চিমা লেখকদের তুলনায় স্পষ্টভাবে অধিকতর এক উচ্চতায়। এক কথায়, আফ্রিকার এক মানবিক পরিচয়কে উপস্থিত করেছেন আচেবে। সেজন্যে উপস্থিত করেছেন আফ্রিকার বৈচিত্র্য, জটিলতা এবং বৈপরীত্যের সত্যও Ñ তার আলো আর অন্ধকারের। আফ্রিকায়ও যে যুক্তিতর্ক, অলোচনা-বিশ্লেষণ, সমষ্টির মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত-গ্রহণের চর্চা, ইত্যাদি বিশ্বজনীনভাবে উজ্জ্বল সব ব্যাপার দূর-অতীত থেকেই ছিল, আবার ছিল যমজ শিশুকে হত্যা কিংবা ইকেমেফুনাকে হত্যার মতো প্রথা কিংবা ঘটনা, নির্দ্বিধায় আচেবে তা হাজির করেছেন। আর, এটাই তো স্বাভাবিক জটিল, এটাই মানবিক বৈচিত্র্য। নাইজেরিয়ার দুর্দশার জন্যে আচেবে যে শুধু উপনিবেশবাদীদের সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হননি, তা পাওয়া যায় তাঁর অনেক পরের লেখা দ্য ট্রাবল উইথ নাইজেরিয়া (১৯৮৩) পুস্তিকায়ও। সেখানে তিনি নাইজেরিয়ার সামরিক শাসক সানি আবাচার তীব্র সমালোচনা করেছেন, স্বদেশের প্রায়-কোনো কিছুই তার কলমের হাত থেকে রেহাই পায়নি; লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর সব চেয়ে বিশৃঙ্খল দেশগুলোর অন্যতম হলো নাইজেরিয়া। এরকম দুর্নীতিপরায়ণ, অসমর্থ, অপদার্থ দেশের জুুড়ি মেলা ভার।… এই দেশটা নোংরা, হট্টগোলে, ভণ্ড, অসৎ, ইতর মানুষে ভরা। এক কথায়, পৃথিবীর সবচেয়ে অপ্রীতিকর দেশ।’ অন্ধ দেশপ্রেম এতোটুকু ছুঁতে পারেনি আচেবেকে। শুধু প্রবন্ধে নয়, পরবর্তী উপন্যাসগুলোতেও আচেবের শান্ত কিন্তু নিরাপস সমালোচনার মনোভাব সমান বিস্তৃত। তিনি যেমন বাস্তববাদী, তেমনি ন্যায়পরায়ণ। মর্নিং ইয়েট অন ক্রিয়েশন ডের  ‘দ্য নভেলিস্ট অ্যাজ টিচার’ প্রবন্ধে তাঁর প্রজন্মের লেখক হিসেবে তিনি নিজেকে একজন শিক্ষকের ভূমিকায় দেখেছিলেন; বলেছিলেন তাঁর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল যুগপৎ আফ্রিকা ও ইউরোপের মানুষকে আফ্রিকীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত ও শিক্ষিত করে তোলা। আর তাঁর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল : ‘… সমাজের মানুষকে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করা, যাতে তারা মর্যাদাহীন জীবনযাপনের দীর্ঘ গ্লানি থেকে মুক্ত হতে পারে।’ শুধু উপনিবেশবাদ নয়, কণ্ঠরোধের অন্য অনেক বাস্তবতা সম্পর্কেও আচেবের ছিল আওয়াজ-তোলার প্রয়োজনের প্রখর বোধ। ২০০০ সালের ২ আগস্ট এক সাক্ষাৎকারে আচেবে জানাচ্ছেন : ‘আমি যখন থিংস ফল অ্যাপার্ট লিখেছিলাম তখন জানতাম না ব্যাপারটা কতদূর যাবে। আমরা আমাদের গল্পটাই শুধু বলেছিলাম। কিন্তু আমার গল্পটা অন্যান্য গল্পের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হয়ে যাবে সেটা বুঝতে সময় লাগলো। এই গড়িয়ে-গড়িয়ে যাওয়াটা আরো বড়ো একটা গল্প। আমরা বুঝতে পারলাম, এমন নয় যে ঔপনিবেশিকদের গল্পটাই শুধু থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, গল্প বলা হয়নি দুনিয়ার আরো অনেক মানুষের। এমন নয় যে, তাদের কোনো গল্প নেই, বরং ক্ষমতার বিভাজনই হলো তাদের নৈঃশব্দ্যের কারণ। জেতে যারা, তারাই এতদিন গল্প বলেছে; বিজিত যারা, তাদের গল্পটা আর বলতে দেওয়া হয়নি। দিন বদলেছে। বিজয়ীকে এখন বিজিতের গল্পটাও শুনতে হবে।’ নিজেদের গল্প নিজেদের বলা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ এবং রেনেসাঁস ইত্যাদি সম্পর্কেও এক সামগ্রিক চেতনা ছিল আচেবের। ১৯৬০ সালে নাইজেরিয়ার স্বাধীনতা-লাভের ঘটনা সম্পর্কে একবার বিয়োদান জেয়িফো প্রশ্ন করেছিলেন, তা কি ছিল ‘অনেকটা রেনেসাঁসের মতো Ñ রাজনৈতিক মুক্তি ছাড়াও এটা ছিল সাংস্কৃতিক পুনর্জীবনও?’ উত্তরে আচেবে বলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। আমরা আমাদেরকে পুনরায় জানতে শুরু করেছিলাম, আমরা আমাদের জীবনকে আবার নিজেদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছিলাম। দেখুন, আমরা আবার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছিলাম: কারণ, ঔপনিবেশিক শাসনামলে যা হয়, তা হলো আপনি নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলেন। ফলে, আপনি কে ছিলেন, বা  আত্ম-উন্নতি বা এরকম কিছু সম্পর্কে আপনার বলার কিছুই থাকে না। এখন এরকম একটা অনুভূতি ছিল যে, অবশেষে উপনিবেশের সবকিছু শেষ হতে যাচ্ছে, আর  এ-ব্যাপারটা যে-কাউকে মোহিত করতো, এক অনাবিল আনন্দের সৃষ্টি করতো। আমাদের বলার মতো গল্প ছিল, আমরা ছিলাম অন্যরকম মানুষ; আমাদের অবশ্যই এ-গল্প বলতে হবে, আমাদের এ-গল্প অন্যকে শোনাতে হবে।’
অর্থাৎ, উপনিবেশবাদী জয়েস ক্যারির প্রতি প্রবল এক প্রত্যাখ্যান জানানোটাই যে আচেবের লেখালেখির মূল ব্যাপার ছিল না, তা বোঝা গিয়েছিল দ্রুত। তাঁর দ্বিতীয় আর তৃতীয় উপন্যাস, যথাক্রমে নো লংগার অ্যাট ইজ (No Longer at Ease) এবং অ্যারো অব গড (Arrow of God) প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৬০ এবং  ১৯৬৪ সালে। কিছুটা ব্যবধানে সমকালীন নাইজেরিয়ার পটভূমিতে উপস্থাপিত এই উপন্যাস দুটো লিখে আচেবে সবমিলিয়ে একটি ট্রিলোজি রচনার গৌরবে পৌঁছে গিয়েছেন বলেই বলা হয়। থিংস ফল অ্যাপার্টে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের উত্তাল উচ্ছ্বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে জনগোষ্ঠীর নায়ক ওকোনকো যখন আত্মহত্যা করে, তাতে নিহিত প্রবল আত্মজিজ্ঞাসা একধরনের জাতীয় ট্র্যাজেডির জন্ম দেয়নি কি? নো লংগার অ্যাট ইজের মুখ্য চরিত্র ওবি ওকোনকো কিন্তু থিংস ফল অ্যাপার্টের নায়ক ওকোনকোর পৌত্র। এই ওকোনকো নোওইয়ের পুত্র, যে-নোওইয়ে, আমাদের মনে পড়বে, ইবো সমাজ ত্যাগ করেছিল তার বাবার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে।  খ্রিষ্টীয় পরিবেশে বসবাস এবং ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছে ওবি। ইংল্যান্ড থেকে এসে রাজধানী লাগোসে সরকারি কাজে যোগ দিয়েছে, তার গোষ্ঠীর আরো অনেক তরুণের মতো। কিন্তু, ততোদিনে কৌম কিংবা গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে তার অনেক দূরত্ব আর সংঘাত। এক সমালোচক বলেছেন, ওবি যখন বুঝল যে তার শিক্ষাদীক্ষা কোনো নতুন পথের দিশারী নয়, অথচ নিজের সমাজের সঙ্গে তার যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে, তখন সে পা বাড়াল দুর্নীতির পথে। আর এটাও একধরনের আত্মহনন। তবে, মনস্তত্ত্বের পর্যায়ে গিয়ে দেখলে দুজন ওকোনকোই মনে হবে অতি-প্রবল এবং অতি-উচ্চকিত এক আত্মতার বোধের বলি, সমষ্টির সঙ্গে সংযাগ হারিয়েই তারা বিপন্ন হয়। অর্থাৎ, রাষ্ট্রিক-সামাজিক তাৎপর্যের পাশাপাশি আচেবের রচনায় এভাবে থেকে গেছে ব্যক্তিজীবনের জটিল-গভীর অঞ্চলগুলোতে আলোকপাত, অনুসন্ধান। এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে কোনো দেশাভিমান, জাত্যাভিমান আচেবের পথে বাধা হতে পারেনি।
আমরা কিছু ধারণা দিচ্ছিলাম; কিন্তু, চিনুয়া আচেবের রচনা-ভাণ্ডার এতোই বড় যে, বর্তমান রচনার পরিসরে তার সব নিয়ে এমন আলোচনা সম্ভব নয়। পরবর্তীকালে, ১৯৬৬ এবং ১৯৮৭ সালে, প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর আরো দুটো উপন্যাস Ñ অ্যা ম্যান অব দ্য পিপল এবং অ্যান্টহিলস অব দ্য সাভান্না। স্বাধীনতা নিয়ে নাইজেরিয়ার মানুষের আবগী স্বপ্ন কী করুণভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল, ভয়ঙ্কর দুর্নীতিবাজ এক সংসদ-সদস্যকে নিয়ে লেখা অ্যা ম্যান অব দ্য পিপল উপন্যাসের নিরেট নামটিই তা যথেষ্ট ঝাঁঝালোভাবে জানায়। ইতোমধ্যে ১৯৬২ সালে আচেবের একটি গল্প-সংকলন, দ্য স্যাক্রিফিসিয়াল এগ অ্যান্ড আদার স্টোরিস প্রকাশিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত স্মরণ করি যে, আচেবে তাঁর প্রথম উপন্যাসের নামকরণে ইয়েটসের ‘সেকেন্ড কামিং’ কবিতার একটা শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন। আর টি. এস. এলিয়টের ‘জার্নি অফ দ্য ম্যাজাই’ কবিতার একটা পঙ্ক্তি-অংশ তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসের নামকরণে। নামের অমন দূর আর অপ্রত্যাশিত উৎস যেমন তাঁর ক্যাথলিক মানসগড়নকে নির্দেশ করে, তারা অত্যন্ত কার্যকরভাবে দেয় উপন্যাস দুটোর মর্মবস্তু সম্পর্কে কাব্যিক-দার্শনিক বার্তাও।
আচেবের চমৎকার সব প্রবন্ধের চমৎকার সব শিরোনামের কয়েকটি সংকলনও প্রকাশিত হয়। কবিতার বই বি অ্যাওয়ার সৌল ব্রাদার্স অ্যান্ড আদার পোয়েমস প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭১ সালে। শিশুতোষ গল্পের সংকলন চিকে অ্যান্ড দ্য রিভার প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। এসবই বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে।
আচেবের নোবেল পুরস্কার পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণের একাংশে রয়েছে তাঁর একটি বক্তৃতার প্রসঙ্গ। ১৯৭৫ সালে ম্যাসাচুসেটসে দেওয়া এক বক্তৃতায় আচেবে জোসেফ কনরাডর হার্ট অফ ডার্কনেস উপন্যাসের তীব্র সমালোচনা করেন, প্রশ্ন তোলেন এরূপ আরো অনেক বিষয়ে, অনেকের নৈতিক-সাংস্কৃতিক সততা নিয়ে। আচেবের মূল প্রশ্ন : যে-উপন্যাস একটি জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা তথা মানব-পরিচয় কেড়ে নেয়, তাকে কীভাবে মহৎ উপন্যাস বলা যায়? তিনি কনরাডকে একজন বর্ণবিদ্বেষী ঘোষণা করেন। তখন উপস্থিত কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপক ধ্বনি তোলেন, ‘কী স্পর্ধা!’ এবং সভাস্থল ত্যাগ করে চলে যান। আমাদেরও প্রশ্ন সেটাই : আফ্রিকার মানুষের মনুষ্যত্বকে অস্বীকার করে তারপরে আফ্রিকায় পরিচালিত ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন-শোষণকে চিহ্নিত-উন্মোচিত করাটা কতোটুকু কৃতি? আচেবে বলেছিলেন, ‘কনরাড ঔপনিবেশিক শোষণের অভিশাপ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং নিন্দাও করেছেন, কিন্তু বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে কোনো কথাই বলেননি। অথচ, উপনিবেশবাদীর বিষদাঁত তো ধারালো করেছে বর্ণবিদ্বেষ।’ আচেবের এ-বক্তব্য দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় তোলে। অনেকে বলেছেন, কনরাডকে বর্ণবিদ্বেষী বলাটা কালবিভ্রম। আচেবে উত্তর দিয়েছেন, ‘কনরাডের আগেও অনেক মহৎ ব্যক্তিত্ব বর্ণবিদ্বেষী হতে অস্বীকার করেছেন।… কোনো মহৎ ব্যক্তিত্ব তাঁর নিজের যুগের খাঁচায় বন্দি থাকেন না।’ আমার খুব ইচ্ছে ছিল আচেবেকে একবার জানাই কীভাবে আমাদের দেশের কত-কত বুদ্ধিজীবীও, একেবারে কনরাডের মতো করেই, সারাক্ষণ  পুঁজিবাদ ইত্যাদি বলে মুখে ফেনা তুলতে থাকেন, কিন্তু এ-সত্যটি একবার উচ্চারণ করেন না যে, এ-ভূখণ্ডে সাম্প্রদায়িকতার ভাবাদর্শটিই পুঁজিবাদী শোষণ-বঞ্চনার সর্ববৃহৎ অস্ত্র।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে নাইজেরিয়ায়ও চলছিল রক্তপাত, মনে পড়ে। বিয়াফ্রার যুদ্ধ। একে উপজাতিক সহিংসতা বলা হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ। বিয়াফ্রা সরকারের তথ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছিলেন আচেবে। যুদ্ধ থামার পর তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি নাইজেরিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের শত্র“ হয়ে দাঁড়ান। তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছিল। প্রাণসংশয় হওয়ায় ১৯৭২ সালে সপরিবারে দেশত্যাগ করেন আচেবে। তারপর দীর্ঘদিন পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। পরে অবশ্য নাইজেরীয় সরকারের আমন্ত্রণে দেশে ফেরেন তিনি, এবং নাইজেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সেখানে অধ্যাপনা করেন।
অবসর নেওয়ার পর আচেবে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি-অধ্যাপনা করেছেন। বহু সভায় বক্তৃতা করার জন্য আমন্ত্রিত হন। তবে, অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ১৯৯০ সালে নাইজেরিয়ায় এক ভয়াবহ মোটর দুর্ঘটনায় তাঁর শরীরের নিুাংশ পঙ্গু হয়ে যায়। চিকিৎসার সুবিধার জন্য তখন থেকে তিনি স্থায়ীভাবে আমেরিকায় ছিলেন, এবং বার্ড কলেজে অধ্যাপনা করেন।

তিন
আমরা এতক্ষণ পর্যন্ত নানা ইঙ্গিত এবং উল্লেখ করেছি Ñ চিনুয়া আচেবের কিছু আদর্শ এবং মতাবস্থান সম্পর্কে। এখন তাদের সামান্য বিশদে যাবো, বিশ্লেষণে। বাংলাদেশকে মাথায় রেখে। বাংলাদেশের মানুষের জন্যে আচেবের বিশেষ কি প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে?
সম্পূর্ণ নামটি তাঁর আলবার্ট চিনুয়ালুমোগু আচেবে। জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬  নভেম্বর, দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার ইবো প্রদেশে – ওগিডি নামের একটি বেশ বড় গ্রামে। আচেবের বাবা-মা যথাক্রমে ইসাইয়া ওকাফো আচেবে এবং জ্যানেট আনানেকি ইলোএগবুনাম প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। এসবের কি কোনো বড় তৎপর্য রয়েছে অমাদের জন্যে? উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ইসাইয়া ওকাফো ‘পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু তিনি সে-ধর্মের ঐতিহ্যগুলোকে শ্রদ্ধা করতেন, এবং নিজেদের খ্রিষ্টান অনুশীলনীগুলোতে তার আচার-অনুষ্ঠানের কিছু উপাদানকে গ্রহণ করতেন।’ ঔপন্যাসিক আচেবের নামে ‘চিনুয়ালুমোগু’ শব্দটির অর্থও হচ্ছে ‘ঈশ্বর আমার পক্ষে যুদ্ধ করবেন’। আচেবেদের পরিবারের অন্য সন্তানদের নামেও রয়েছে নতুন ও পুুরনো ধর্মের সঙ্গে যুক্ত শব্দের এরূপ সংশ্লেষণ। মূল্যবান পুরনোকে রক্ষা করার এই মনোভাব দেখতে পাওয়া যায় আচেবের সাহিত্যকর্মের ভাষা এবং শৈলীতেও। সেখানে রয়েছে ইবোদের কথনরীতি – সরাসরি বর্ণনা, লোককাহিনি, প্রবাদ ও ভাষণ।            দূর-অতীত এবং জনজীবনের রীতি-পদ্ধতির সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করার মনোভাব-মূল্যবোধ আচেবের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
ধর্ম-ত্যাগ তথা পরিবর্তন এবং বিভিন্ন ধর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নগুলো নিশ্চয় বাংলাদেশের মানুষের জন্যেও ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক সত্য। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি এবং সামাজিক জীবন থেকে তা উঠে এসেছে আচেবের লেখায় – থিংস ফল অ্যাপার্ট উপন্যাসেও। এসব বিষয় এবং স্মৃতি নিয়ে অন্য লেখালেখিও করেছেন চিনুয়া আচেবে। আফ্রিকার বড় এবং নামি লেখকদের মধ্যে এনগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোরের মতো কাউকে-কাউকে আচেবের তুলনায় অধিকতর সংগ্রামী এবং নিরাপস মনোভাবের ভাবা হয়। তদ্সত্ত্বেও আচেবের তুল্য স্বচ্ছ ও সাহসী চিন্তার দৃষ্টান্তও কিন্তু বাংলাদেশে আমরা অনেক ক্ষেত্রে হাজির করতে পারিনি। যেমন, খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ, পালন, ইত্যাদি প্রশ্নে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার নামে’ শীর্ষক প্রবন্ধে আচেবে লিখলেন – ‘আমি যখন বড় হচ্ছি – আমার মনে পড়ে আমরা তখন অন্যদের ঘৃণা করতাম। নিজেরদের আমরা আমাদের ভাষায় বলতাম ‘গির্জার মানুষ’ কিংবা ‘ঈশ্বরের সমিতি’। সত্য ধর্মের অনুসারীদের উপযুক্ত অবজ্ঞা নিয়ে অন্যদের বলতাম হিদেন কিংবা এমনকি ‘আজেবাজে লোক’। এখন এ নিয়ে ভাবতে গেলে আমি আর নিশ্চিত বোধ করি না যে, তাদেরই কি বরং স্বধর্ম ত্যাগের জন্য আমাদের ঘৃণা করা উচিত ছিল না। এবং সম্ভবত তা তারা করেছেও।’ (১৯৭৬ : ৯৫) থিংস ফল অ্যাপার্ট উপন্যাসেও স্মৃতি এবং ইতিহাস থেকে এমনসব বিষয়  তুলে  এনেছেন আচেবে, যেখানে ধর্মপ্রচারকারী মিশনারিরা ইবো জনগণের শতাব্দী-লালিত-আচরিত বিশ্বাসব্যবস্থাকে অবিশ্বাস্য-ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, ‘মিথ্যে’ ঘোষণা করেছে। উপন্যাসের ষোড়শ অধ্যায়ে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের একটি দৃশ্যের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে – এক শ্বেতাঙ্গ মিশনারি আরো পাঁচজন কৃষ্ণাঙ্গকে নিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যে একজন দোভাষীর কাজ করছে। অধ্যায়ের একটি অংশ এরূপ :
তিনি তাদেরকে বললেন যে, তারা মিথ্যে ঈশ্বরের উপাসনা করে, কাঠ এবং পাথরের ঈশ্বরের। যখন তিনি একথা বললেন ভিড়ের মধ্যে একটি গভীর গুঞ্জন উঠল। তিনি বললেন যে, সত্য ঈশ্বর ঊর্ধ্বে থাকেন, এবং মৃত্যুর পরে যখন মানুষ বিচারের জন্য তাঁর সামনে উপস্থিত হয়, কাঠ আর পাথরের কাছে মাথা নত করে যেসব খারাপ ব্যাক্তি এবং হিদেন – তাদের ছুড়ে ফেলা হবে তেমন আগুনে যা পাম তেলের মতো জ্বলবে। তবে সত্য ঈশ্বরকে উপাসনা করে যে ভালো লোকেরা চিরকাল তাঁরা তাঁর সুখের রাজ্যে বাস করে। তিনি বললেন, ‘ঐ মহান ঈশ্বরই আমাদের পাঠিয়েছেন তোমাদের মিথ্যে ঈশ্বর এবং বদমাশ রাস্তাকে ত্যাগ করার এবং তাঁর কাছে ফিরে আসার আহ্বান জানাতে; তাহলেই তোমরা রক্ষা পাবে।’ (পৃ ১০২)
গ্রামবাসীদের উপস্থিতিতে মিশনারি ধর্ম প্রচারকদের বক্তৃতা-ভাষণ এবং আলাপ-আলোচনার ঘটনার এরূপ বর্ণনায় থিংস ফল অ্যাপার্ট উপন্যাসের আলোচ্য অধ্যায়টি পূর্ণ এবং অত্যন্ত উপভোগ্য, আলোকপ্রদ, চিন্তা-উদ্রেককারী। এর মধ্য দিয়ে দুপক্ষ যে একে অপরকে খুব বেশি বুঝতে পেরেছে, তা কিন্তু নয়। এবং একপর্যায়ে সাহেব মিশনারি লক্ষ করে, তার আনা বাইসাইকেলটি গ্রামবাসীর দৃষ্টি কেড়েছে এবং তিনি তাদের তার দোভাষীর মাধ্যমে বলেন, ‘তাদের বলুন যে, তাদের মধ্যে বসবাস শুরু করার পর আমি অনেক লোহার ঘোড়া আনব। তাদের কেউ-কেউ নিজেরাই লোহার ঘোড়ায় চড়বে।’ এতে দেখা যায় যে, এ-পর্যায়ে শ্রোতারা তেমন কেউ সাহেবের এ-কথা শোনে না। সাহেব যে গ্রামবাসীর মধ্যেই বাস করার কথা বলেছে এটা তারা আগে থেকে ভাবতে পারেনি।  এ-ব্যাপারটি নিয়েই তখন শুরু হয় উত্তেজিত আলোচনা। লক্ষণীয় যে, নাইজেরিয়ার সমাজ ও সংস্কৃতি বিকাশের এ-পর্যায়ে বাইসাইকেলের ধারণাটির প্রকাশকারী সর্বাধিক সমপর্যায়ের শব্দ পাওয়া গিয়েছিল ধাতু এবং প্রাণীর একটি সমন্বয়ের মধ্যেই। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি শব্দবন্ধ : ‘লোহার ঘোড়া’। এর বিপরীত প্রক্রিয়াতেই কি সাহেব মিশনারি কিংবা এরূপ ধর্মপ্রচারক স্থানীয় দেব-দেবীকে ভাবতে-বলতে চলে যাননি কাঠ এবং ধাতু মাত্র, যে-রূপ কোনো কিছুর মাধ্যমে হয়তো দেব-দেবীর ধারণাটি প্রকাশিত? এখানে অনুধাবন কিংবা প্রকাশ করার ক্ষমতা কোন পক্ষের কী রকম? সেখানকার সততা, আন্তরিকতা, ঔদ্ধত্য? এখানে কি ঘটেনি কোনো বিকৃতি? ‘নির্মাণ’? মিথ্যে পরিবেশন? এডওয়ার্ড সাঈদ যা-সব বলেছেন? বাহাসের একপর্যায়ে একজন ইবো গ্রামবাসী বলেন, ‘যদি আমরা আমাদের দেবতাদের ত্যাগ করি এবং তোমাদের দেবতাকে অনুসরণ করি, আমাদের অবহেলিত দেবতা এবং পূর্বপুরুষদের ক্রোধ থেকে কে আমাদের রক্ষা করবে?’ উত্তর হলো : ‘তোমাদের দেবতাদের প্রাণ নেই এবং তোমাদের কোনো ক্ষতি তারা করতে পারবে না, তারা কাঠ এবং ধাতুর টুকরো।’
সমালোচকরা বলেছেন আচেবে ধর্মপ্রচার এবং বৃহত্তর উপনিবেশবাদের এই সামগ্রিক কর্মভঙ্গিকে অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। এর মধ্যে গভীর উপলব্ধি কিংবা সত্য যুক্তির প্রমাণ নেই – হাসি-ঠাট্টারই উপযুক্ত প্রায়-উন্মত্ততা এসব। তবে এসবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যে কিছু ছিল না, তা কিন্তু মোটেই নয়। ভয়ঙ্কর সব উদ্দেশ্য নিয়ে আফ্রিকায় পাঠানো হয় মিশনারিদের – আফ্রিকি জীবনধারাকে সম্পূর্ণ পালটে দেওয়ার জন্যই, যতটা সম্ভব ইউরোপীয় করে তোলার জন্য। সেভেন আফ্রিকান রাইটার্স বইয়ে জেরাল্ড মুর লিখেছেন মিশনারিদের তেমন ‘অহংকার’ সম্পর্কে, যার ভিত্তি ‘গোত্রের জীবনকে প্রকাশ করে এবং বেঁধে রাখে যেসব আচার-অনুষ্ঠান তার প্রতি তাদের মনোযোগহীনতা’। (পৃ ৬৩) এই ‘মনোযোগহীনতা’ প্রকৃতপক্ষে অবজ্ঞা। অবজ্ঞা-অমর্যাদা যে আফ্রিকানদের স্থানীয় কৌম জীবনেও অনেক ছিল, আচেবে তাও বলেছেন। আর সে-সুযোগেই খ্রিষ্টান মিশনারিরা নিজেদের ঈশ্বর ও ধর্মকে সর্বজনীন দাবি করার সুযোগ পেয়েছে। তারা আফ্রিকি সমাজের অমানবিক এবং অগণতান্ত্রিক সব প্রথার বিরুদ্ধে বলতে পেরেছে, এগুলোর শিকার যে মানুষ, তাদের কাছে টেনে নিয়েছে, দীক্ষা দিয়েছে। আমার মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের অমোঘ উক্তি : ‘ছিদ্র পাইলে শনি ঢুকিবেই’। থিংস ফল অ্যাপার্টে উমোয়াফিয়ার অরণ্যের যে-অংশটি ছিল ‘পাপপূর্ণ’ কিংবা ‘অশুভ’, আক্ষরিক অর্থে সেখানেই প্রথমে মিশনারিরা গির্জার জন্য স্থান নির্ধারণ করে। অরণ্যের এই ‘পাপপূর্ণ’ অংশেই ইবোরা দীর্ঘকাল ছুড়ে ফেলেছিল মানব-সন্তানদের, যমজ শিশুদের। প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে সনাতন উমোয়াফিয়ার ধ্বংসের বীজ এভাবে তারা নিজেরাই বুনেছিল, সেখানকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া স্থানীয়ভাবে এবং অনেক আগেই সূচিত হয়েছিল। উপনিবেশবাদ এবং খ্রিষ্টধর্ম তাতে যুক্ত হয়েছিল, তাকে ত্বরান্বিত করেছিল। ভেতর-বাহিরের পরিস্থিতির সংযোগ কোথায় না সাধিত হয়েছে? কোন পর্যায়ে নয়? স্থানীয় বা ভেতরের পরিস্থিতিকে এতটুকু কম উন্মোচন না-করার মধ্যেই বরং চিনুয়া আচেবের এবং আরো অনেক আফ্রিকীয় লেখকের অনন্য মহত্ব। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের মতো প্রবল এক শক্তির দমন-নিপীড়নের মুখে দাঁড়িয়ে এই ভারসাম্য রক্ষা তো আরো অভাবনীয় কৃতি! বলা হয়েছে আফ্রিকার সনাতন ধর্মগুলো – ইবো, উরোবা এবং স্থানীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ইত্যাদি আফ্রিকার কতিপয়  লেখক-শিল্পীকে পশ্চিমা ঔদ্ধত্য এবং দমন-নিপীড়নের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সংযম ও ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করেছে, সাহায্য করেছে আত্মসমালোচনা করতে। এক বিস্ময়কর সত্যভাষণ করেন চিনুয়া আচেবে যখন আমাদের আলোচ্য উপন্যাসের ষোড়শ অধ্যায়ের শুরুতে স্থানীয় এক নারী পুরোহিত প্রকটভাবে সীমালঙ্ঘন করে বলেন যে, খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত উমোয়াফিয়াবাসী লোকগুলো হচ্ছে তাদের ‘গোত্রের পরিত্যক্ত মল, আর এই ধর্মটি হলো একটি উন্মত্ত কুকুর, যা এসেছে এই মলকে চেটে সাবাড় করতে’। (পৃ ১০১) অর্থাৎ, আচেবের দৃষ্টি এড়ায় না যখন প্রকৃতপক্ষে পরস্পরের ধর্মকে খাটো করার একটা মল্লযুদ্ধ জমে ওঠে, যখন পারস্পরিক উপলব্ধি এবং শ্রদ্ধাবোধের পরিস্থিতি থাকে না, এবং যখন ভেতরের ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় মূলত স্বার্থের বিরোধ এবং দ্বন্দ্ব। স্থানে-স্থানে, জাতিতে-জাতিতে আদর্শ, দর্শন কিংবা বিশ্ববীক্ষার ভিন্নতার অবকাশকে তখন আর আমরা মনে রাখি না। প্রায় সকল পক্ষ থেকেই এরূপ ত্র“টি ঘটে চলে, চলেছে। একেবারে কেউ যে এই ব্যর্থতার বাইরে এসে দাঁড়ান না, তা নিশ্চয় নয়। যদিও তারা সংখ্যায় পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার মতো বেশি নন, তাদের সারিতেই দাঁড়িয়ে থাকেন অসামান্য সংযতস্বভাব এবং সমীহ-আদায়কারী কণ্ঠের অধিকারী চিনুয়া আচেবে।
ব্রাডফোর্ড মরো নামে এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথোপকথনে আচেবে বলেন, তাঁর জীবনে এবং লেখালেখিতে ধর্ম বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নাইজেরিয়ার স্থানীয় ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলো মহাবিশ্বের জটিলতা উপলব্ধি করতে তাঁকে কত সাহায্য করেছিল। আচেবের বক্তব্যটি দীর্ঘ কিন্তু আমি এর উচ্চমূল্যের জন্যেই তাঁকে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করছি। কিন্তু তার আগে বলা দরকার যে, আচেবের বাবা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলেও তাঁর চাচা কিন্তু স্থানীয় সনাতন ধর্মই বজায় রেখেছিলেন। এবারে আচেবের বক্তব্যের দীর্ঘ উদ্ধৃতি :
এটা খুব বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমার শুরুগুলো পরিষ্কারভাবে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সত্য বলতে কী, আমার গোটা শিল্পীজীবন সম্ভবত স্ফুলিঙ্গায়িত হয়েছিল আমার বাবা-মায়ের খ্রিষ্টধর্ম এবং আমার পূর্বপুরুষদের পুরনো অপস্রিয়মাণ ধর্মের মধ্যকার টানাপড়েন দ্বারা। বাড়িতে আমরা খ্রিষ্টধর্ম অনুসরণ করতাম এবং বাড়ির বাইরে আমার পক্ষে সৌভাগ্যজনকভাবে পুরনো  ধর্মটি তখনো সক্রিয় ছিল এবং এর টানাপড়েন আমার কল্পনায় স্ফুলিঙ্গ তৈরি করেছিল। আমার তখনকার সপ্রশ্নœতা বুদ্ধিভিত্তিক ধরনের ছিল না, কারণ, আমি তখন খুবই ছোট। কিন্তু, সপ্রশ্ন না হলেও তোমার মধ্যে কিছু ঘটতে পারে। আমার চাচা যে সেখানে ছিলেন এবং তাঁকে সবকিছুতে পাওয়া যেত সেটা ছিল একটি সমৃদ্ধকর অভিজ্ঞতা। সে-কারণে কিন্তু আমি কোনো কিছু বিসর্জন দিচ্ছিলাম না, যেমন যদি বলেন, আমার সংকীর্ণ খ্রিষ্টীয় পটভূমি, আমরা যে বাইবেল পড়তাম, প্রার্থনা করতাম এবং দিনে ও রাতে প্রার্থনাসংগীত গাইতাম তা অত্যন্ত কাজে আসতো। তাতে আমার কোনো অস্বস্তি ছিল না। কিন্তু আমার চাচার ধর্মে আমার আগ্রহ কোনো দ্রোহের ব্যাপার ছিল না। তা ছিল আমার অত্যন্ত সমৃদ্ধ বাল্যকালের অংশ। আমি একটি ভাগ্যবান প্রজন্মের সদস্য ছিলাম, একটা চৌরাস্তায় (crossroads) অবস্থিত, একটি সময়ে যখন দুটো সংস্কৃতির সাক্ষাৎ মূল্যবান কিছু সৃষ্টি করেছিল। ধর্মের প্রতি ছোটবেলায় আমার যে বিশ্বাস, প্রত্যয় এবং দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা নিয়ে বড় হওয়াটা এখন অসম্ভব। অবশ্য আমার দীর্ঘ-দীর্ঘ সময় গেছে সংশয় ও অনিশ্চয়তায়, এবং একটি সময় যখন খুব শক্তভাবে আমি খ্রিষ্টধর্মের সন্দেহোর্ধ্বতার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছি – আমিই পথ, সত্য এবং জীবন ইত্যাদি। যখন ছোট ছিলাম, এ নিয়ে আমার কোনো কিছু মনে হয়নি। কিন্তু, পরবর্তীকালে আমি একে তুলনা করতে পেরেছি আমার আদিবাসী ধর্মের অনেক বেশি সযতœ এবং অনেক বিনম্র মনোভাবের সঙ্গে। যেহেতু এই ধর্মে বিভিন্ন দেবতার স্থান ছিল, সুতরাং এটাও মনে হতো যে, কেউ এক দেবতার ঘনিষ্ঠ হবে, কোনো দেবতার সঙ্গে তার বিরোধ থাকবে। নিষ্ঠার সঙ্গে উডোর উপাসনা করেও কেউ ওগুউগুর হাতে বিপন্ন হতে পারে। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের সংকীর্ণ, তথ্যগত এবং ন্যায়ম্মন্য দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় এই সব বাণী এবং প্রবাদ পৃথিবীর জটিলতাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আমার নিকট অনেক বেশি মূল্যবান। এই অন্য ধর্ম, যা নানা বিপরীত মতের আধার,  আমার  নিকট  শিল্পসম্মতভাবে  অনেক  বেশি  সন্তোষজনক। আমার বিনীত ধারণা হচ্ছে, আফ্রিকার বড় লেখকদের এরূপ সাহসী বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা সারাবিশ্বের জন্যেই বিরল দৃষ্টান্ত। চিন্তাভাবনার সাম্প্রদায়িক এবং গোষ্ঠীগত গণ্ডি পার হওয়ার তুলনীয় কৃতি রেনেসাঁসের মহাদেশ খোদ ইউরোপেই কতটা মিলবে, বলা শক্ত। আমি আগেই বলেছি, আফ্রিকা নিপীড়নের শিকার হওয়া সত্ত্বেও আফ্রিকার কতিপয় বড় লেখকের পালটা সংকীর্ণতায় না-যাওয়াটা এক অকল্পনীয় ভারসাম্য। অবশ্য কেউ-কেউ যে পালটা আদর্শায়ন করতে চলে যাননি, তা নয় – গোঁড়ামি করতে গেছেন কৃষ্ণাঙ্গত্বকে নিয়ে। জাতীয়তাবাদগুলো ছিল, সংকীর্ণতার দিকে তাড়ানোর প্রবণতা নিয়ে। কিন্তু আচেবে, ওকিবো, সোয়িংকা – এঁরা বুঝি রেনেসাঁস-মনোভাবে ইউরোপকেও টেক্কা দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে স্থানীয় প্রাচীন ধর্ম ও সংস্কৃতির দিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকাতে এঁদের দৃষ্টান্ত কি আমাদের আলো আর সাহস জোগাবে না? এঁদের প্রাসঙ্গিক রচনাগুলো কি আমরা আরো বেশি-বেশি পড়ার চেষ্টা করবো না? আমার বিনীত ধারণা এও যে, আচেবের মতো লেখকগণ – ওলে সোয়িংকা, ক্রিস্টোফার ওকিবো প্রমুখ – শুধু আফ্রিকা সম্পর্কে নয়, গোটা মানব জাতি সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি-নির্ধারণে অত্যন্ত মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। সোয়িংকা একবার বলেছিলেন, ‘আফ্রিকায় যা ঘটেছে, তা গোটা মানবেতিহাসেরই প্রতিফলন।’ বহু পূর্বে, ১৯৭৩ সালে, অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মেনিং ক্লার্ক একটি চিঠি লিখে চিনুয়া আচেবেকে আবারও বক্তৃতা দিতে সেখানে যাওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি চাই আপনি  আবার আসুন, এবং এখানে আবার বক্তৃতা করুন; কারণ, অতীতের ঠুলিগুলো আমাদের খুলে ফেলা দরকার। আপনি তাই আবার আসুন এবং তরুণদের তাদের পূর্বপুরুষের কুসংস্কারগুলো বাদ দিয়ে বড় হতে সাহায্য করুন।’