ঢাকায় ব্রিটিশ চিত্রকরের প্রদর্শনী

ইব্রাহিম ফাত্তাহ

বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জ ঢাকার গুলশানের নতুন একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠছে।  গুলশান-১ থেকে ২-এর পথে সামান্য এগিয়ে উদয় টাওয়ারের উলটোদিকে ১৩১ নম্বর সড়কের ৬০ নম্বর বাড়ির নিচতলায় বেঙ্গল লাউঞ্জ। কালো কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই শীতল বাতাসের হাতছানি। চলছিল ব্রিটিশ শিল্পী হাওয়ার্ড হজকিনের ১২টি চিত্রকর্মের একটি একক চিত্রপ্রদর্শনী। এটি চলেছে গত ১২ এপ্রিল থেকে ৩ মে ২০১৩ পর্যন্ত।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকের ব্রিটিশ শিল্পী হাওয়ার্ড হজকিনের এ-প্রদর্শনী ঢাকায় আয়োজিত হয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায়। প্রদর্শিত ১২টি চিত্রকর্মের বেশিরভাগই ছাপচিত্র – স্ক্রিনপ্রিন্ট, লিথোগ্রাফ, এচিং অ্যাকোয়াটিন্ট মাধ্যমে আঁকা। একটি চিত্রকর্ম কাঠে তেলরঙে আঁকা। এর শিরোনাম একটি রেস্টুরেন্টে জড়জীবন।

সমকালীন ব্রিটিশ চারুশিল্পের খ্যাতিমান এবং সেইসঙ্গে বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত চারুশিল্পী হাওয়ার্ড হজকিন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩২ সালে লন্ডনে। শিল্পী সেখানকার কেম্বারওয়েল স্কুল অব আর্ট এবং করশ্যামের বাথ অ্যাকাডেমি অব আর্টে শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত লন্ডনের চেলসি স্কুল অব আর্টে শিক্ষকতা করেন। সত্তরের দশকেই টেইট গ্যালারি ও ন্যাশনাল গ্যালারির ট্রাস্টি নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালে তিনি কমান্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার এবং ১৯৯২ সালে নাইট উপাধি লাভ করেন। চিত্রকলায় কৃতিত্বের জন্য তিনি টরেনার প্রাইজ সম্মানে ভূষিত হন। হজকিন ন্যাশনাল আর্ট কালেকশন ফান্ড কমিটির সদস্য। ১৯৮৪ সালে ৪১তম ভেনিস বিয়েনালে তিনি ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০০৩ সালে কম্প্যানিয়ন অব অনার নিযুক্ত হন। হাওয়ার্ড হজকিন বর্তমানে বসবাস করছেন লন্ডনে।

ঢাকার এ-প্রদর্শনীতে শিল্পীর যেসব চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে, সেগুলো ১৯৬৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে অাঁকা। তাঁর কাজের পরিবেশনা অনেকটা বিমূর্তরীতির হয়েও বাস্তবতার প্রায় কাছাকাছি। তিনি ছাপচিত্র অঙ্কন করলেও তাতে সন্তুষ্ট থাকেন না। হাত লাগান কাগজে, রঙের আলিম্পনে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলেন নিজের চিত্রকর্মগুলো। যেমন ‘সূর্যাস্ত’ সুগারলিফ্ট অ্যাকুয়াটিন্টের সঙ্গে হাতে রং করা চিত্র। ২০০৮ সালে আঁকা চিত্রকর্মটির মাঝখানে মোটা রেখায় কালো একটি দাগ, যেটি মাঝে মাঝে ক্ষয়ে গেছে বিন্দু থেকে বৃত্ত হয়ে। এটিকে শিল্পী আবৃত করেছেন খুনে লাল বর্ণে আর নিচের অংশে হালকা রঙের ব্রান্টসিয়েনার প্রলেপ।

‘জলোচ্ছ্বাস’ তাঁর আরেকটি চিত্রকর্ম। ১৯৭৭ সালের লিথো মাধ্যমের এ-ছাপাইয়ে শিল্পী হাত লাগিয়েছেন, রঙের প্রলেপ দিয়েছেন ছাপাইয়ের সঙ্গে মিল রেখে। বেগুনি বর্ণের প্রাধান্যের ভেতর আরো গাঢ় বেগুনির জলোচ্ছ্বাসের ভয়ংকর সুন্দর অবয়ব তৈরি হয়েছে। ৫১ x ৬১ সেন্টিমিটার আকারের কাজ এটি। সহজ পরিবেশনার কাজ।

‘জড়জীবন’ তো আরো সহজ, স্বচ্ছন্দ কাজ। ৭৮ x ৯৪ সেন্টিমিটার আকারের স্ক্রিনপ্রিন্ট। মাঝখানের গোল নকশার ভেতর সারিবদ্ধ গোলাকার কিছু ফলের মতো ফর্ম। যেমন বার্ডস আইভিউ থেকে দেখা। আরেকটি কাজ ‘সুভ্যেনির’ ১৯৮১ সালের স্ক্রিনপ্রিন্ট। কালোবর্ণে অনেকগুলো গাছের মতো ফর্ম।

কলাগাছের মতো একটি গাছের ফর্মের রং লালচে, অথচ পশ্চাদপটে কলাপাতার সবুজ রং। ৯২ x ১২১ সেন্টিমিটার আকৃতির এ-কাজটিতে সরল চেনা একটি চেহারা উঠে এসেছে। এর শিরোনাম ‘ইন্ডিয়ান ট্রি’। মাধ্যম এচিং ও হাতে রং প্রয়োগ। একই পদ্ধতিতে করা আরেকটি চিত্রকর্ম ‘আম’ ১৯৯০-৯১ সালের কাজ। ৭৬ x ১১১ সেন্টিমিটার আঁকারের চিত্রপটের কেন্দ্রে হলুদাভ পাকা আমটি। আমের দেশে আমের দিনে গ্যালারির দেয়ালে আম আবিষ্কার আনন্দদায়কই বটে!

১৯৭৭ সালের একটি চিত্রকর্মের শিরোনাম – ‘নিকের কক্ষ’। লিথোগ্রাফের সঙ্গে গোয়াশ রঙের কাজ। চিত্রপটের দুদিক প্রায় সমান্তরাল হলেও অন্য দুপ্রান্ত অসমান। মধ্যখানে আয়তাকার একটি ফর্মের ভেতর বুড়ো আঙুলের ছাপের মতো কতগুলো গোলাকার ফোটার নকশা  –  যেন পাখির চোখে দেখা একটি ঘরের মেঝে, তার মাঝখানে কার্পেট বিছানো। কাজটি ১৯৭৭ সালের। সেই সহজ-সুন্দর পরিবেশনা। রাতের ঘরের আলোকিত জানালার চেহারা পেয়েছে ‘নিক’ শিরোনামের কাজটি। ১৯৭৭ সালে আঁকা চিত্রকর্মটির মাধ্যম হচ্ছে এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট এবং হাতে রং প্রয়োগ।  ৪৭ x ৫৮ সেন্টিমিটার পরিমাপের এই চিত্রকর্ম বর্ণপ্রয়োগের বৈপরীত্যের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আলো আর আঁধারের লুকোচুরি ভারি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

হাওয়ার্ড হজকিনের ষাটের দশকে আঁকা ‘রাতে বালিকা’ লিথোগ্রাফ মাধ্যমের কাজ। নারী অবয়বের ছন্দময়তা, সেরূপ রেখার নকশা কাজটিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। কালোরঙের প্রেক্ষাপটে সাদা, ব্রান্ট আমবার ও ব্রাস্ট সিয়েনায় বালিকার অবয়ব পরিচ্ছন্নভাবে তুলে ধরেছেন শিল্পী। তাঁর এ-কাজের ধরনে আমরা কৃতী ভাস্কর হেনরি মুরের মানবীয় অবয়বের ছায়া দেখতে পাই।

সত্তরের দশকে হজকিন এ-জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। যত পরিণত হয়েছেন, ততই সহজ-সুন্দর হয়েছে তাঁর চিত্রকর্ম। শিল্পকে তিনি দুর্বোধ্য করেননি, তাঁর কাজ দূরতিগম্যও নয়। দর্শক-শিল্পবোদ্ধার জন্য তাঁর কাজের রসগ্রহণ সহজ ও স্বচ্ছন্দময়।

হজকিন শুরু করেন ছাপচিত্রের টেকনিক প্রয়োগ করে। চিত্রপটে কিছু একটা ছাপাই কাজ করে তিনি হাত বাড়ান ছাপাই রং কিংবা অন্য কোনো রঙের কাছে। মোটা ব্রাশ কিংবা রোলার দিয়ে রং লাগিয়ে ছাপচিত্রকে তিনি পেইন্টিংয়ের মতো নির্মাণ করেন। নিজে যা দেখেন, চারপাশে, যা কিছু অনুভব করেন  –  তাকে সাধারণের মতো অতিশয় সহজ করে তুলে ধরেন তিনি। এ যেন সেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার পুনরুল্লেখ  –  ‘সহজ করে বলতে মোরে কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ কিন্তু হজকিন তাঁর চিত্রকর্মকে সত্যিকার অর্থেই সহজ একটি ছন্দ এনে দিয়েছেন। সে-ছন্দ শিশুর মতো সরল এবং সৃষ্টিশীল।

আশি পেরিয়েছেন হাওয়ার্ড হজকিন। লন্ডনে ১৯৩২ সালের ৬ আগস্ট তাঁর জন্ম। শৈশবের তিনটি বছর ১৯৪০ থেকে ’৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি বাস করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর পরিবারের সঙ্গে। লন্ডনে শিল্পশিক্ষা নিয়েছেন দুটি স্বনামধন্য শিল্প-শিক্ষালয়ে। ১৯৫৫ সালে বিয়ে করেন জুলিয়া লেনকে। এই দম্পতির দুই সন্তান। পুরস্কৃত হয়েছেন জন মুরসের প্রদর্শনীতে। আর্টিস্ট রেসিডেন্ট করেছেন অক্সফোর্ডের ব্রাসেনজ কলেজে। ১৯৯৫-৯৬ সালে নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্টে করেছেন রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনী।

কৃতী এই ব্রিটিশ শিল্পীর স্বকৃত চিত্রকর্মের প্রদর্শনী ঢাকায় আয়োজন আমাদের শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধাদের জন্য আনন্দদায়ক। নিজ সীমানায় অগ্রজ এক খ্যাতনামা বিদেশি শিল্পীর কাজ দেখার সহজ সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্য আমরা ধন্যবাদ জানাই ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিল, শিল্পী হজকিন ও তাঁর গ্যালারির স্বত্বাধিকারী অ্যালান ক্রিস্টি এবং বেঙ্গল লাউঞ্জ কর্তৃপক্ষকে। এ ধরনের আয়োজন যত বেশি হবে, তত আমরা জানতে পারব বিদেশি শিল্পীদের কাজ ও ভাবনা সম্পর্কে। এতে আমাদেরও আরো সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকে।