রূপ ও অরূপের দর্পণ

Rup o Oporuper darpanমোস্তফা জামান

ফর্ম আর কনটেন্ট – এই দুই বাংলাদেশের আর্টে নানা তর্কের জন্ম দিয়েছে। যদিও ফর্ম বা আঙ্গিক এবং কনটেন্ট বা বিষয়বস্ত্ত – এই দুই আলাদা করা কঠিন কাজ; এই কঠিন কাজ সাধ্য করেই দুই মেরু সৃষ্টি হয়ে গেছে। নিষ্ঠাবান আঙ্গিকবাদী হিসেবে মোহাম্মদ কিবরিয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, অন্যদিকে বিষয়বস্ত্তনির্ভর শিল্পী হিসেবে শাহাবুদ্দিন ও রাজনৈতিক ছবির আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ‘সময়’ শিল্পীদলের নাম সবার আগে উচ্চারিত। এই দুই মেরুর বিবদমানতার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো শিল্পী বিষয় যে-আঙ্গিকের সহযোগিতা ছাড়া হাজির হয় না – এমন সহজ সত্য মেনে ছবি-আঁকার জগতে পদার্পণ করেন; ওঁদের মধ্যে রোকেয়া সুলতানা অন্যতম। বিষয়ের সঙ্গে ফর্মের মেশাল, কিংবা বিমূর্ত আঙ্গিকের সঙ্গে বিষয়বস্ত্তর মেশাল দিয়েই রোকেয়ার শিল্পজগৎ সমৃদ্ধ। তিনি ফর্মের দূরবর্তিতা বা বিমূর্তায়নের সঙ্গে বরাবরই বিষয়ের সাজেশন যুক্ত করে কল্পদৃষ্টির জগতে বিচরণ করতে উদ্যোগী।

‘ফাতা মরগানা’ তাঁর সাম্প্রতিক একক প্রদর্শনীর শিরোনাম। এই লাতিন এক্সপ্রেশনের মরু, মেরু, এমনকি সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলের মরীচিকার দিকে নির্দেশ করে, যা মানুষের দৃষ্টিক্ষমতা ও বাস্তব জগতের সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় এক বাস্তবতার অবতারণা করে। অর্থাৎ বাস্তব বিষয়বস্ত্ততে চোখ রেখে তা পাঠ করার ধারণাটা অতোটা সরল নয়; দৃষ্টি ও বাস্তব এই দুইয়ের মাঝে তৃতীয় এক পর্দা উপস্থিত, যা মোটেও ব্যক্তিগত ভ্রম নয়, বরং বাস্তব জগতেরই তৈরি ভিন্ন এক রূপ।

বাস্তব দুনিয়ার যে-রূপ – তা যে মরীচিকাসম – এই সত্য গ্রিক দর্শন জন্মের আগেও মানুষের জানা ছিল। ঋষি, ফকির-দরবেশ বাস্তবরূপকে ‘খোদ’ বাস্তবতা থেকে আলাদা করেই দেখতেন। ফলে ফর্ম কনটেন্টের সহজ কোনো সমাধানে যাওয়া সম্ভবপর নয়, যে-ফর্ম বা রূপ চোখে দেখা যায়, যা থেকে শিল্পের কনটেন্ট বা বিষয়বস্ত্ত তৈরি হয় – সেখানেই অনিশ্চয়তার গলদ হাজির থাকে। ফলে খোদ চৈতন্যে যে-সত্য হাজির হয়, মানুষের ধারণায় বা মনে, তার প্রতীক নির্মাণে সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে নানাবিধ ফর্মের জন্ম হয়েছে : যেমন বৌদ্ধ ধর্মের ‘মন্ডল’ যা ভারতীয় তন্ত্রে বৃত্ত হিসেবে রহস্যময় এক ফর্ম, কিংবা আত্মধ্বংসী সাপের বৃত্তাকার রূপ, অথবা ইসলাম বা ইব্রাহিমের প্রদর্শিত ধর্মে কালো কিউব আকৃতির ‘কাবা’। এগুলোর ব্যাখ্যায় ইয়ুং-প্রবর্তিত আর্কেটাইপ বা খোদ রূপের ধারণা ব্যবহার করা চলে। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি হওয়া ফর্ম কিংবা রূপ তখনই খোদ রূপ হয়ে ওঠে, যখন তা হাজার বছর পরও মানব অস্তিত্বে সাড়া তোলার মতো শক্তি ধারণ করে। রূপের এমতো শক্তি যখন আধুনিক শিল্পীরা ব্যবহার করেন, তখন রংও একটি প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। রোকেয়া সুলতানার কাজে কাঠামোর জঙ্গমতা রঙের সূত্রেই ঘটতে থাকে। বর্তমান একক প্রদর্শনীতে রঙের চেয়ে কাঠামো বা অবয়বের (বিমূর্ত অবয়ব) পাল্লা ভারি হয়ে আছে মনে হলেও রংই কোনো কোনো ছবির চালিকাশক্তি। একদিকে অর্গানিক, কসমিক ও শিশুসুলভ ফর্মের আয়োজন; অন্যদিকে লাল, হলুদ ও নীলের নানান মাত্রা অর্জনের মধ্যে দিয়ে কোনো শিল্পী বর্তমান প্রদর্শনীর মূলভাব নির্ধারণ করেছেন। যে-রূপকল্প ছবি থেকে ছবিতে বিস্তৃত তা গাছ, প্রকৃতি এবং মহাকাশে দৃশ্যমান বস্ত্তর সঙ্গে হুবহু মিল সৃষ্টি না করেই এমন অনুভূতির জন্ম দেয়।

‘ফাতা মরগানা’র সব ছবিই ছাপাই মাধ্যমে করা। শিল্পী ফুলব্রাইট প্রোগ্রাম শেষ করে এসেছেন গত বছর। প্রত্যাবর্তন-পরবর্তী ছবিতে যে নব ফর্মের উদয় হয়েছে, তা নেব্রাস্কার লিংকনে অবস্থানকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল। রোকেয়া সুলতানা ফুলব্রাইট বৃত্তির আওতায় ক্যারন কুনের পদ্ধতিগত ইনোভেশনের সংস্পর্শে আসেন। কেমিক্যালবিহীন ছাপাই ছবি তৈরির বিষয়ে শিল্পীর মন আগেই স্থির ছিল; লিংকনে নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপাই ছবি বিভাগের প্রধান ক্যারন কুন এই মনোবাঞ্ছায় বাস্তবতা যোগ করতে রোকেয়াকে সাহায্য করেছেন।

প্রকৃতি বিষয়ে রোকেয়ার আহ্লাদ লক্ষ করা গেছে শুরু থেকেই; আশির দশকে এচিং বা ধাতুতক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি                 যে-রূপকল্পের জন্ম দিচ্ছিলেন তাতে প্রকৃতিই ছিল মৌল ধারণা। এই প্রকৃতি প্রত্যক্ষ জগতের হুবহু অনুবাদের মধ্যে দিয়ে শিল্পে ধরা দেয়নি, বরং প্রাকৃতিক, প্রকৃত বা খোদ মানব অস্তিত্ব বলে যে-ধারণা আমাদের মনে জন্মায়, সেই মানব বা মানবীর ভিশন বা কল্পদৃষ্টিই এসব ছবির অনুষঙ্গ। বাইরের প্রকৃতি আর অন্তর্গত দুনিয়া – এ দুয়েরও যে-বিভাজন আধুনিক মানুষ সৃষ্টি করেছে, তা আদিকালের চিন্তকেরা মানতেন না। প্রকৃতি ও পুরুষ (অর্থাৎ সেলফ) এক ও অভিন্ন অবস্থায় যে-মনোভঙ্গির জন্ম দেয় রোকেয়ার ছাত্রজীবনের কাজেও তার ইশারা মেলে। শিল্পী শান্তিনিকেতনে মাস্টার্স করেছেন; সে-সময়ের কাজে সেখানকার প্রকৃতি ও স্কুলিংয়ের ছাপ তাঁর কাজে লক্ষ করা গেছে। পরবর্তীকালে নববইয়ের দশকে তিনি ‘ম্যাডোনা’ সিরিজের মাতৃত্বের পাশাপাশি মাতা ও সন্তানের সহজ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করে গড়ে তোলেন নানা মাত্রার সিরিজ। এচিং মাধ্যমে রঙের উজ্জ্বলতায় এবং শিশুসুলভ সহজতায় গড়ে তোলা রূপকাঠামো ছাপচিত্রী হিসেবে তাঁর খ্যাতি অর্জনে সহায়ক হয়।

নতুন সহস্রাব্দে রোকেয়ার রঙে ও নারী-অবয়বের ফ্লুইড অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে শরীরী সংবেদনার প্রকাশ দেখা যায়। দ্বিতীয় লিঙ্গের যে-ভাষ্য তা মাতৃত্ব ও অস্তিত্বের সংকটের মধ্যে দিয়ে শিল্প হয়ে উঠেছিল তাঁর ম্যাডোনা সিরিজে। সম্পর্ক নামের নতুন সিরিজে তিনি নারীত্বের প্রাইমর্ডিয়াল বা আদি রূপ বা স্বভাব নিয়ে ভাবিত হন। নারী ও প্রকৃতি – এ দুয়ের সহজ যে-যোগাযোগ তা সামাজিক-রাজনৈতিক ভাষ্যের বিপরীতে, আত্মপরিচয় ও গোষ্ঠী পরিচয়ের রাজনীতি থেকে দূরে থেকে অস্তিত্বের আদি-অন্ত সন্ধান করতে সহযোগী হয়েছে। যে-অনুসন্ধানের সূত্রে শিল্পী আদিমসন্ধানী স্বর নির্ধারণ করতে পেরেছেন এবং তার সঙ্গে শরীরী সংবেদনার মেলবন্ধন আবিষ্কার করেছেন, তান্ত্রিক পদ্ধতিতেও এমন শরীর ও প্রকৃতির ঐক্য আবিষ্কার সম্ভব। যদিও রোকেয়ার এ-আবিষ্কার কোনো গুহ্য সাধনার সূত্রে সম্ভবপর হয়নি, বরং চিত্রকল্পে নারীর সংবেদনের জায়গাটি চিহ্নিত করতে গিয়ে নতুন যে-উপলব্ধিতে তিনি পেঁছান তারই ফসল বলে ধরে নেওয়া যায়।

এ পর্যায়ের মিশ্র ভাষার শিল্পের পাশাপাশি রোকেয়া সমউদ্যমে বিমূর্ত বা  আঙ্গিকবাদী ছবি আঁ কতে মন দিয়েছেন। তথাপি তিনি যে আঙ্গিকের কড়া পাহারায় না থেকে নানাভাবে, চৈতন্য উৎপাদনে উৎসাহী আকার-আকৃতির প্রতি মনোযোগী, তা তাঁর কাজে লক্ষ করা গেছে। সজ্জাধর্মিতার মধ্যে অবস্থান করেও তা থেকে তিনি বের হয়ে এসেছেন – রং ও ফর্মের অর্থ নির্মাণের স্বাভাবিক পদ্ধতির মধ্যে থেকে প্রক্রিয়ার অনির্দিষ্ট ফলাফলে অভিজ্ঞতার বা দৃষ্টিচেতনার মাত্রা অর্জনের চেষ্টা করেছেন। বর্তমান প্রদর্শনীর কাজেও আকারের সজ্জার মধ্যে দিয়ে জগতের চৈতন্য ধরার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। বেঙ্গল লাউঞ্জের প্রদর্শনীর ক্যাটালগে তাঁর কাজ নিয়ে নিজ ভাষ্যে ‘ইনফিনিট ওয়েব অব নোন অ্যান্ড আননোন’ ফুটিয়ে তোলার কথা বলেছেন; আবার এই ‘মহাজাগতিক সত্য’ প্রকাশের চেষ্টার পাশাপাশি আপন ‘আইডেনটিটি’ খোঁজার বিষয়টিও জরুরি বলে মনে করেছেন। রোকেয়া ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক – এই দুয়ের  অন্তর্বর্তী প্রদেশে অবস্থান করেন। ফলে তিনি মতামত বা ধারণার আদলে ‘সত্য’ সন্ধানে ব্রতী না হয়ে, রং, ফর্ম ও জগতের নানাবিধ পাঠ্য ও দুষ্পাঠ্য নকশার মধ্যে, বস্ত্তর অবস্ত্তগত ভাষ্যের মধ্যে সত্য-সন্ধান করেন। ফলে রূপের জগৎ থেকে তাঁর ছুটি নেই, বরং রূপের মধ্যগগন থেকে তিনি অদৃশ্যমান বিষয়বস্ত্ত বা ভাব ধরতে উদ্যোগী।

বর্তমান প্রদর্শনীর ফর্ম অপরাপর সকল প্রদর্শনীর কাজের পাশে অনেক বেশি দ্বিমাত্রিকতানির্ভর। অপরিচিত নকশা এখানে পরিচিত জগতের অন্তরালের রূপ তুলে ধরতে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘লিভিং ওশেন’ সিরিজ, বা ‘ভেনাস ক্রসিং দ্য মুন’, কিংবা ‘ফ্লোরা, ফনা অ্যান্ড আই’ সিরিজে, এমনকি রঙে উজ্জ্বল ‘ফাতা মরগানা’ সিরিজ – সবই নিসর্গ ও মহাকাশের দিকে নির্দেশ করে। শিরোনামে সৃষ্টির যে আদিম ও প্রাকৃত বাস্তবতার দিকে নির্দেশ করেছেন, ছবিতে তা আদিমতানির্ভর কাঠামো মারফত প্রকাশ পায়নি। বরং বায়োলজিক্যাল বা প্রাণী ও উদ্ভিদবিদ্যার কাল্পনিক ছবির মতো শিল্পীর কাছে তা প্রতীয়মান। অনুবীক্ষণে দেখা জগতের মধ্যে যে এসথেটিক বিস্ময় – তেমনটাই লক্ষণীয় হয়ে ওঠে রোকেয়ার সাম্প্রতিক সিরিজে। প্রতিটি ছাপাই ছবিই নতুন এক পদ্ধতির স্বাক্ষরবহ এবং কোনো কোনো ছবিতে নকশার যে-আবর্ত তৈরি হয়েছে তা কসমিক মাত্রায় উন্নীত। ‘সোলারিস-২’ ছবিটিকে এই ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে দিয়ে জগতের শক্তি বুঝে ওঠার চেষ্টার সার্থক ফসল বলে চিহ্নিত করা যায়। এর কম্পোজিশনের গতি ফর্মের নববিন্যাসের মধ্যে দিয়ে সম্ভব হয়েছে। ডায়নামিজম বা জঙ্গমতা তৈরির সূত্রেই অনেক ছবিতে শিল্পী ফর্মের চক্রাকার ধারণাটি নানাভাবে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্যবহার করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই মাতিসের কোলাজের কথা মনে পড়ে। প্যারিসের এই মডার্ন মাস্টার শেষ জীবন মানব-অবয়ব ও প্রকৃতির সঙ্গবদ্ধ ঐকতান ফর্মে রূপ দিতে স্বাভাবিক এক আপাত ইনফর্মাল ছন্দনির্ভর ফর্ম রঙিন কাগজ কেটে শিল্প সৃষ্টি করেছিলেন। হয়তো এমন সাযুজ্য টেকনিক্যাল কারণে দ্বিমাত্রিকতার সূত্রে ঘটেছে।

বর্তমান প্রদর্শনীর সব কাজ ‘প্রেশার প্রিন্ট’ পদ্ধতিতে করা এবং রোকেয়ার বস্ত্তগত বিষয়ের উপস্থাপনা – যা গোল, চক্রাকার পাতা সুলভ ও কোষ সুলভ গুচ্ছফর্মের মধ্যে দিয়ে জায়মান – নির্বস্ত্তক ভাবের উদ্বোধন করতে উদ্যোগী। এ-কারণে তারা কখনো তলের মধ্যে বিলীন, কখনো রঙের মধ্যে নিমজ্জিত। তবে, পূর্ববর্তী সময়ের কাজের সঙ্গে তুলনা করে যে-বিষয়টি লক্ষযোগ্য হয়ে ওঠে তা হলো – ‘ফাতা মরগানা’য় হাজির হওয়া কাজে রঙের চেয়ে ফর্মের খেলাই বেশি। হয়তো প্রেশার প্রিন্ট পদ্ধতির প্রয়োগ এখানে ভূমিকা রেখেছে।

ফর্মের মধ্যে দিয়ে রহস্যময়তা নির্দেশ করার যে প্রতীকী পদ্ধতি প্রাচীন সভ্যতায় প্রচলিত ছিল, তারই সমান্তরালে ভারতে চালু ছিল প্রাক-আর্য যুগের তান্ত্রিক ধারা। সাধনার সহযোগী চিত্র হিসেবে যে মন্ডলাকৃতির ব্যবহার – তা চিত্রল না হয়ে একধরনের শুদ্ধ ধ্যানমগ্নতার জন্মদায়ী ফর্মের মারফত কসমিক বিমূর্ততায় পর্যবসিত। রোকেয়ার ‘সোলারিস-১’ চিত্রে এমন প্রতীকী চিত্রের সমান্তরাল ফর্ম প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এই প্রদর্শনীতে অর্গানিক জগতের ব্যাখ্যা হিসেবে যে-চিত্রকল্প দেখা যায়, তাদের পাশে এটি একটি ব্যতিক্রমী রচনা। পাশ্চাত্য চারুকলার দর্পণে রেখে বিচার করলে এটি মিনিমালিস্ট ধারার ছবির মতো চিত্ররূপময়তার বিপরীত এক জগৎ, যাতে শরীরী উপস্থিতির বিপরীতে অশরীরী কসমিক রহস্যের দ্যোতনাই প্রধান। রোকেয়ার সেনসুয়াল বা সংবেদনের জগৎ থেকে এই রহস্যময়তার জগতের দূরত্ব হয়তো খুব বেশি নয়, তথাপি প্রকাশের যে-উত্তাপ রোকেয়ার কাজকে অনুভূতি-আধারে রূপান্তরিত করে – তা এখানে থমকে দিয়ে দূরবর্তী কোনো অজানা জগতের রহস্য-প্রতীক ফুটিয়ে তোলার চেষ্টাই এ-ছবিকে আলাদা করে দিয়েছে।

১৯৫৮ সালে চট্টগ্রামে রোকেয়ার জন্ম; বর্তমানে তিনি ঢাকার চারুকলা ফ্যাকাল্টির কর্ণধার। শিল্পী হিসেবে নিজেকে তিনি ব্যাখ্যা করেন ‘ইনটুইটিভ থিংকার’ হিসেবে – যাকে বাংলায় সজ্ঞানির্ভর চিন্তক বলা যায়। সজ্ঞার মধ্যে দিয়ে দুনিয়ার রহস্য অনুভব করার বিষয়টি আদিকাল থেকে সভ্যতার একটি মূল স্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। আধুনিক বিজ্ঞান একে প্রথমদিকে নাকচ করে দিতে চেয়েছে। আজকে সজ্ঞা বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মহলে নতুনতর ব্যাখ্যা ও মনোযোগ জন্ম হয়েছে।

শরীরের পেশি যে-মেমোরি বা স্মরণশক্তি ধারণ করতে সক্ষম তা আজ সর্ববিদিত; ফলে জ্ঞানকে মাথার বিশেষ বিজ্ঞানভিত্তিক লজিক হিসেবে আর দেখা সম্ভবপর নয়। শরীরী সংবেদনার সঙ্গে এর জটিল যোগাযোগ বিদ্যমান। শিল্পীর দেহ তান্ত্রিকের দেহের মতো নিষ্ঠার অর্গলে বাধা নয়, তবু তাঁর আচারে, কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে একপ্রকার একনিষ্ঠ ‘দেখা’ বা অনুভব করার সাধনা রয়েছে। এই সাধনা জগতের সঙ্গে আপন স্বভাব-চরিত্র ও আপন ভাবজগতের যোগাযোগ সৃষ্টির সাধনা। রোকেয়ার ক্ষেত্রে এই যোগাযোগ প্রকৃতি ও নারীর মেলবন্ধন-নির্ভর – তিনি তাঁর রং, ফর্ম ও ফর্মের বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে এই যোগাযোগ পারফর্ম করে যাচ্ছেন দুই-আড়াই যুগ ধরে। ‘ফাতা মরগানা’য় তাঁর ছোট্ট একটা ব্যতিক্রমী লিথোগ্রাফ গ্যালারির প্রথম কক্ষে টানানো আছে – যেখানে আপন মুখাবয়ব তিনি নিরীহ এক বাঘের প্রতিকৃতিতে প্রক্ষেপণ করে প্রাণীর সঙ্গে আত্মার যোগ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। ‘সেল্ফ’ শিরোনামের এই চিত্রকল্প জগৎ দেখার সহজ বা স্বতঃস্ফূর্ত পন্থার মধ্যে দিয়ে শিল্পীর কাছে হয়তো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। এই চিত্রের নানান ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা হতে পারে; তবে, ইগোর বিলোপের পর মানব, প্রাণী, গাছ ইত্যাকার সবকিছুর মধ্যে যে মানবাত্মা সহজে বিরাজ করতে সমর্থ হয়, এমন ধারণা প্রাচ্যে বহুদিন ধরেই প্রচলিত। এমন জ্ঞানের আলোতে এ-ছবির মর্যাদা যাচাই সম্ভব হতে পারে।

‘ফাতা মরগানা’ শিল্পীর ১৪তম একক প্রদর্শনী এটি। এতে দুটি কলাপসিবল শিল্প আছে – টেবিলে সাজিয়ে রাখা এই দুটি কাজ অ্যাকোর্ডিয়ন বই হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন পদ্ধতিতেও রোকেয়া রূপের বিবিধতা নিয়ে চিন্তিত হয়েছেন : তাঁর একটি বইয়ে আঙুলের রেখার আদলে রস্বকৃত অঙ্কনরীতি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, অপরটিতে রঙের আধিক্যে এক চিত্ররূপময় অনুভূতির জগৎ তৈরি হয়ে আছে। রং ও বিশুদ্ধ ফর্ম – এ দুয়ের দোদুল্যমানতা এই প্রদর্শনীর একনাগাড়ে শক্তি ও দুর্বলতা। এই দুইয়ের মধ্যে দিয়েই এই শিল্পীর ভবিতব্য নির্মাণের ইঙ্গিত বর্তমান এককের ছবিগুলোর মধ্যে স্পষ্ট।