দেহ ও দেহাতীত

হুমায়ূন মালিক

ড্রইংরুমে বসে ও বোঝে শোভনা অদ্ভুত এক রাফ ভঙ্গিতে ওয়্যারড্রব খুলছে – তা খোলার শব্দে তার দিকে তাচ্ছিল্য ছুড়ে মর্দানি ফলাচ্ছে। মাহিনকে স্কুলে পাঠিয়েই সে বেরিয়ে যাওয়ার এমন এক প্রস্ত্ততি খেলায় মাতে। এখন ও তার পার্মিশন নেওয়া দূরে গায়ে-গতরে কামত্রুুদ্ধ হুলোবিড়ালের ভঙ্গি নিয়ে তারই সামনে দিয়ে বেরোবে। ঠিক আছে, একটা মেয়ে, তা একটু শক্তসমর্থ ও অকমনীয় হলেও একটা মেয়েমানুষ তো – সে কী করে আমার ওপর মর্দানি ফলায় আমিও দেখব। কী করা – এরই মধ্যে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত সে নিয়ে ফেলে। শোভনার ইনটেনশন যেমন যথার্থ শব্দ-তরঙ্গ তৈরি করে তাকে ঘা দিতে পারে তেমনই তার অঘোষিত সিদ্ধান্তও নিশ্চয়ই ওর অ্যান্টেনায় ধরা না পড়ে যায় না, অন্তত তার আশা এন্টারপ্রাইজ থেকে তার ম্যানেজার, নানা পয়েন্ট থেকে তার এজেন্ট বা কর্মচারীর করা জরুরি কলও যখন সে কোনো পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত না দিয়ে রাগত কণ্ঠে কাট করে দিচ্ছে।

কিন্তু তাতেও যে ও কোনো গা করে না!

গত রাত থেকে রুমানা, বিশেষত ফিদার অাঁকা প্রিয় চিত্রনায়িকার কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো তার বিশেষ কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শোভনার মগজে এক ধরনের নেশার জট পাকিয়ে তাকে টানছে। কিন্তু মাহিনকে স্কুলের জন্য তৈরি না করে কী করে বেরোয় ও!

শুধু এই মাহিনটার জন্য ডিভোর্স দূরে সেপারেশনের মতো একটা প্রাথমিক সিদ্ধান্তেই যেতে পারছে না ও।

যে-সন্তানের জন্য এই ত্যাগ সেও নিশ্চয়ই আরেকটু বড় হয়ে বাবার পথ ধরবে। ছেলেকে নিয়ে এমন ভাবনাকে ও মনে ঠাঁই দিতে চায় না কারণ এটা তার মধ্যে ইডিপাস-কমপ্লেক্সের এমন একটা ঘোলা রূপ নেয়, যা তার বেশ আপত্তিকর ঠেকে। তার ঘৃণা বা ক্রোধকে ও রাজীবের ওপরই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। সেক্ষেত্রে তার যে উচিত নিজের সুখের কথা ভেবে একটা ডিসিশন নিয়ে নেওয়া – যেক্ষেত্রে আর পুরুষের ঘর নয়, সোজা গিয়ে ওঠা রুমানার রুমে।

কিন্তু ওই মাহিনটার যে সকালে উঠে মাকেই চাই, নাস্তা থেকে… আগে সে স্কুলেও নিত-আনত কিন্তু দিন পনেরো আগে রাজীব টের পায় মাহিনকে স্কুলে ঢুকিয়ে ও আর সব মহিলা গার্জেনের মতো প্রতীক্ষা না করে চলে যায় রুমানাদের মেসে। ব্যস, রাজীবের কঠোর পদক্ষেপ – মাহিনকে স্কুলে আনা-নেওয়ার দায়িত্ব কাজের মেয়ে ছালেকার, যদিও এতে মাহিনের ঘোর আপত্তি, যেন মাহিন স্কুলে যাওয়া-আসা শুধু তার ওপর জুলুম নয়, পড়াশোনা, ছবি অাঁকা, গান বা শরীরচর্চা তথা তাবৎ সাধনাই অর্থহীন। শেষে মাহিন বলে বসে, ছালেকার দরকার নেই, সে একা ইস্কুলে যাওয়ার মতো যথেষ্ট বড় হয়েছে। হয়তো তাই; কিন্তু একমাত্র যুবরাজ – কী করে তাকে ন্যূনতম সিকিউরিটি ছাড়া মুক্তিপণ-সন্ধানী গ্যাং, মাথা বিগড়ানো যানবাহনের ঝুঁকির এই মেগাসিটির হাতে ছেড়ে দেয়! এদিকে গেল সপ্তাহে জ্বরে যে কয়দিন শোভনা বিছানা থেকে উঠতে পারেনি মাহিন প্রায় উপোস স্কুলে গেছে, ছালেকার বেশ চেষ্টা-চরিত্তির সত্ত্বেও। ক্লাসে আনমনা থাকায় প্রথমদিকে টিচারের বকাঝকা, এখন কিনা মারও খাচ্ছে। এর পেছনে কী কেবল তার মায়ের এই না আনা-নেওয়াই নাকি… আর এর মধ্যে যদি ঘুম ভেঙে দেখে মা-ই নেই!

তো দ্রুত মাহিনকে তার স্বাবলম্বী করে তোলা উচিত। আর তখন রাজীব গায়ে হাত তুললেই, তা না-তুললেও চলে যাবে রুমানাদের ফ্ল্যাট ভাড়া করে করা স্বাধীন মেসে – পার্মানেন্টলি।

শোভনা ড্রইংরুমের পর্দা সরাতেই রাজীব তার পথ আগলে মুখোমুখি – ভিৎরে যাও।

শরীর দিয়েই সে তার জবাবটা দিতে তাকে ঠেলে বেরোনোর প্রচেষ্টা নেয়। রাজীব তাতে এমন রিঅ্যাক্ট করে যে তার বলে শোভনার ছিটকে বেডরুমে গিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু সে টাল সামলে সোফায় পড়ে। তার ঊর্ধবাঙ্গ থেকে শাড়ি খসে গেলে যা দৃশ্যমান হয় রুমানা তা দেখলে নিশ্চয়ই মাতাল হয়ে যেত। এরা এদের এই খাচ্ছতের দায় নিতে নারাজ, উত্তরের ভূত এদের ওপর আসর করেছে! উত্তরে –

ভাতার নির্মম স্বামীগিরি ফলায় বলে বউ তাকে ছেড়ে লাঙের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করতে গিয়ে দেখে সে ফুটন্ত কড়াই থেকে লাফিয়ে তার জ্বলন্ত জ্বালানিতে – এখানেও তার ওপর যথেচ্ছ মর্দানি ফলানো! তো নিছক ফ্রি-সেক্স। মাই গড, এখানেও যে এক বুনো ষাঁড় কেবল তাকে গুঁতিয়েই মজা লুটছে! নারী শেষে নারীর কাছে। পরিণতিতে জাপানে লেসবিয়ানিজমের বিপ্লব – প্রায়/ হয়তো!

কিন্তু তাতে জাপানি ছোঁড়াদের কী! তারা কুঁতকুঁতে ক্ষুদ্র নয়না স্বজাতির বদলে বহুজাতির মিলনমেলা ম্যারিকায় গিয়ে ডাগর ডাগর সব যুবতী ধরে!

আশ্চর্য, বিয়ের আগে তো লেসবিয়ানিজমকে ও সাপোর্ট করেছে, কিন্তু এখন কেন তা এভাবে নিচ্ছে!

শোভনার পরের সংগ্রাম প্রতিহত করতে রাজীব তার গলায়-গর্দানে বাহুবলের শৃঙ্খল সাঁটে। ধস্তাধস্তির মধ্যে সোফায় শোভনার ওপর রাজীব। দেয়ালের চিত্রকলায় বন্দি মদন ও রতিদৃশ্যটা দেখে ভাবে, যুদ্ধের এমন পর্যায়ে বহু ক্ষেত্রে শরীর জেগে ওঠায় সম্ভোগের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের আপস, এমনকি প্রেম হয়।

কিন্তু দুজন ধস্তাধস্তি করে গড়িয়ে পড়ে ফ্লোরে!

বাসর রাতেই রাজীবের আচরণ শোভনার কাছে অদ্ভুত ঠেকে। মনে কয়, কর্তব্য বলেই যেন তার সঙ্গে একটা কিছু করা, মন তার অন্য কোথাও! তার মুদ্রাগুলোও কেমন! কিংবা এ নিছক তারই মনের ব্যাপার – এতে তারই পরম সুখ নেই বলে পালটা তাকে তার সন্দেহ। শেষে এই ভেবে সে এই সন্দেহ দূর করতে চায় যে, যেহেতু ও-ই বাৎসায়নের সূত্রসমূহে অভ্যস্ত বা পরিচিত নয় সে-কারণেই এ তার কাছে এমন অস্বাভাবিক ঠেকছে।

দেহ তার এমন চেতনায় কী করে পৌঁছে! তখন কাকা মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বলে বাবা-মা তাদের যৌবন ছুঁইছুঁই কিশোরী শোভনাকে কাকির সঙ্গে শুতে দেয়। যখন তার ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হওয়ার পর্ব, তখন তাদের ইভটিজিংয়ে অতিষ্ঠ তার মধ্যে তৈরি হচ্ছে ভয় – ঠিক এ-সময় কাকি তাকে নারী হিসেবে নিজেকে আবিষ্কারের বিকল্প কিন্তু পূর্ণাঙ্গ জগৎ খুলে দিলেন যেমনটি ব্লু ইজ দি ওয়ারমেস্ট কালার ছবিতে ষোড়শী আদেলেকে অসম বয়সী নীলকেশী রমণী এমা। এদিকে সেই থাকার সুবাদে শোভনার দেহ অভিজ্ঞ চাচিকে পেয়ে যায়। আর চাচির সাহচর্যে তার মধ্যে যে জেগে ওঠে, সে যেন তার দেহে সুপ্ত কী আধফোটা কিংবা বিকাশোন্মুখ ছিল, না হলে কাকিকে তো সে প্রত্যাখ্যান করত। কিংবা এ তার রক্তের অন্তর্গত দাবি নয়, অভ্যাসের মধ্য দিয়ে এর জন্ম ও বিকাশ। রক্তজ বা অভ্যাস কিংবা প্রথম বা উন্মেষকালের বলে চাচির দেহকলা তার চেতনে টাইপ বা আদর্শ হয়ে যায়। তা বিয়ের পর কোনোভাবেই ও রাজীবের কঠিন হাত, শক্ত শরীরে পরমকে পায় না! তার তিয়াস চৌচির অফলা মাঠ খোঁজে কোমলতা। এমন তেষ্টার মধ্যে রুমানার সঙ্গে দেখা – ব্যস, ও যেন তার পরমকে পেয়ে যায়।

তো সে যে এখন সেই রুমানার কাছেই যাচ্ছে তা কি রাজীব বুঝে গেছে! ও তো ভাবতে পারত জেদ ফলাতে ও আড়াই গলি হেঁটে তার বোনের বাসায় যাচ্ছে, গিয়ে দুই-এক প্রহর থাকবে তার ভাতার কর্তৃক মান ভঞ্জানোর প্রতীক্ষায়, অতঃপর… এরই মধ্যে ছালেকার হাত ধরে মাহিন রুমে ঢোকে – দেখে বাবা-মা ফ্লোরে, কুস্তি লড়ছে। কী কারণে আজ স্কুলে ক্লাস হয়নি। রাজীব দেখে, মাহিন দেখছে বাবা-মায়ের মতো একটা মেয়েমানুষের সঙ্গে রেসলিং বা পাছাড় ধরে পেরে উঠছে না। ওদের দেখে সহসাই রাজীব একটু অপ্রস্ত্তত, সে সুবাদে হাত একটু শিথিল হতেই শোভনা একঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।

রাজীবের বরং এখন ওকে আটকে রাখা নয়, ইচ্ছা করে চুল ধরে ঘর থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে। বিয়ের পর তার প্রতি শোভনার ভালোবাসার জায়গায় যখন ক্রমাগত চোরাবালি ঠেকছে, তখন এরই মধ্যে তাদের বাসায় রুমানার আনাগোনা। এই আনাগোনাটা রহস্যজনক ঠেকলে তাকে গোয়েন্দাগিরিতে পায়। একদিন সে বাসায় ঢোকার পর ও বেডরুমে রেকর্ডারে রেকর্ডিং সিস্টেম অন করে বাইরে চলে এলো, পরে যখন রেকর্ডারে শোনে, দুজনার শিৎকার তার মগজে কী যেন বিষ-কিড়ের মতো কিলবিল করে তাকে অস্থির করে তোলে! এ কি তার ইগোতে ঘা, নাকি ঈর্ষা! কিন্তু তার এমন প্রতিক্রিয়ার পেছনে যুক্তি কী! শোভনা নামের এক রমণী তার কী প্রয়োজন! তার জন্য এই মুহূর্তে সুমন প্রতীক্ষমান, একদা যেমন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো জগদ্বিখ্যাত কবির জন্য…

কিন্তু মাহিন! শোভনাকে ছাড়া তার জীবনযাপন অসম্ভবই। তাই শোভনাহীন এই ফ্ল্যাটে অঞ্জন বা সুমনের মতো কিশোর বা তরুণ নিয়ে তার হোমলি পরিবেশে থাকার স্বপ্ন ফানুসের মতো শূন্যে উড়ে উড়ে মিলিয়ে যায়। তার ওপর ওদের কারো সঙ্গে যখন ও হোটেলে তখন তার সুখটাকে যে স্বস্তিতে উদযাপন করতে পারে তা তো এই ভেবে যে, মাহিন ভালো আছে, যা কিনা শোভনার জন্যই। আসলে কিনা অঞ্জনের মতো কাউকে নিয়ে এখানে সুখে থাকার মূল বাধা মাহিনই, তার ওপর সে যখন আবার বাবার সঙ্গ চেয়ে কিংবা বাবা-মায়ের সঙ্গে মার্কেটিং বা বেড়ানোর আবদার করে, তখন তার নিজের ওপর রাগ হয় – এ কে আমার দুনিয়ায় আনাই ঠিক হয়নি।

এর মধ্যে চেতনে প্রশ্নও উঁকি দেয় – এমন রাগ তার হয় কী করে!

এ আমার হরমোন – গিন্সবার্গ তার হয়ে তাকে জবাবটা দেয়। নারীহীন জেলখানা, দুর্গ, বিদ্যায়তন বা তেমন কোনো সামাজিক অবদমনজাত হরমোন – ইনহেরিট্যান্স অব অ্যাকোয়ার্ড ক্যারেক্টার! সেই প্রাচীনকালে তা তাহারই সম্প্রদায়ে মহামারির মতো লেলিহান দেখিয়া লুত তাহাতে আসক্তদের ডাকিয়া কহিলেন, তোমরা এইভাবে পুরুষ পুরুষে উপগত হইয়া সীমা লঙ্ঘন করিয়াছ।

বরং তুমিই অতিশয় শুচিবাইগ্রস্ত, তাহারা তাহার দিকে তেড়িয়া আসে, আমরা তোমাকে আমাদের সমাজেই রাখিব না।

তখন স্বয়ং আমি তাহাকে উদ্ধার করি পরিবারের যাহারা তাহাকে অনুসরণ করে তাহাদের সমেত, তাহার আসমানি কিতাবে ঈশ্বর বলেন, আর তাহার তথা তাহাদের পেছনে পড়িয়া থাকা ভ্রষ্টদের ওপর প্রস্তরবৃষ্টি হইতে থাকে এবং তাহারা ধ্বংস হয়।

গ্রিক পুরাণে দেখা গেল, বীর তার শত্রুকে ধরে এনে বুঝি সে মর্দা বলেই তাকে… কাউকে অপমানের, ধ্বংসের এর চেয়ে নিকৃষ্ট ও কার্যকর উপায় বুঝি আর নেই!

ভারতীয় পুরাণ তো এর পক্ষে দূরে, এ নিয়ে কোনো কথাই কয় না!

এসবের তফসির কি এই, মানব-ধর্ম এমুখী নয় কারণ এতে মহৎ কিছু নেই! আর –

জৈব বিবর্তনে এতো যে বৈচিত্র্য, এতো বিকৃতিও অথচ জীবজগতে এমনটি তেমন করে আর কই, মানবে যেমন! নিশ্চয়ই ফুলে-ফসলে তাকে যা বাঁচিয়ে রাখে না প্রকৃতির সে-লীলায় উৎসাহ নেই! কিন্তু ফসল না ফলুক যে চাষবাসে নিঃস্বার্থ, অনাবিল আনন্দ মেলে সেই তো মহৎ এক শিল্প!

নিশ্চয়ই এ-কারণে ক্রমাগত দলিত-মথিত হয়েও সে মরে না! এবং –

উনিশ শতকে এর একটা টাইপ কিনা পশ্চিমে প্রায় এক বিশেষ প্রজাতি, শ্রেণি তো বটেই, সৃষ্টি করতে লাগে! সমান্তরাল প্রত্যন্ত এই ভাটির দ্যাশে ঘেঁটু সংস্কৃতি – নাচে-গানে এবং কামে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক শিল্প।

শিল্প যদি উন্নততর অভিব্যক্তি সে তো তবে সে প্রাগ্রসর শ্রেণির – নাকি! তো –

অঞ্জনের সঙ্গে তার সম্পর্ক দেহ ও দেহাতীত। ওর সঙ্গে মেলামেশার প্রথমদিকে তনিমার সন্দেহ হয়, সে তার সঙ্গে প্রেম করার জন্যই তার ছোট ভাইটির সঙ্গে খাতির পাতিয়েছে। কিন্তু কয়েক মাসেও তার দিক থেকে কোনো নিবেদন না পেয়ে তনিমা অবাক। তেমন সন্দেহ – প্রতীক্ষার মধ্য দিয়ে ততোদিনে ও তার প্রেমে তলিয়ে গেছে। শেষে সে-ই তাকে প্রেম নিবেদন করেও যখন কোনো সাড়া পায় না তার দিন কয়েক পর কী করে যে তনিমা আদত রহস্য ভেদ করে ফেলে! অতঃপর ভাইবোনোরা মিলে অঞ্জনকে হেদায়েতে লাগে। একপর্যায়ে রাজিব আর তার নাগালই পায় না। অদ্ভুত এক বিচ্ছেদ-যন্ত্রণার মধ্যে একদিন ডাকে তারই গ্রামের অঞ্জনের চিঠি পায় সে – অধঃপতিত ওই পাপজীবন থেকে ভগবান আমায় উদ্ধার করেছেন। আপনার মতো নষ্ট মানুষকে এখন আমি ঘৃণা করি। আপনার মতো পশুর সঙ্গে আমাকে পশুর জীবন যাপন করাতে এভাবে আর আমার পিছে লেগে থাকবেন না।

আশ্চর্য, এ পশুর জীবন কেন হবে, শুধু অভিব্যক্তির সেরা জীবই এটা পারে – এ এমন এক শিল্প! কিন্তু এটা এখন আর অঞ্জনকে বোঝানোর উপায়  নেই। কিন্তু  অঞ্জনহীন জীবনের কী অর্থ, তাকে ছাড়া কী করে বাঁচা। সহসাই তার মনে আশা কিংবা বিশ্বাসও উঁকি দেয়, অঞ্জনের এ-দশা কৃত্রিম এবং সাময়িক। তবু ও ঘুরে-ঘুরে বিভিন্ন ডিসপেনসারি থেকে একটা-দুইটা করে ঘুমের বড়ি কিনতে থাকে। আর তার এ-সংগ্রহ যমদেবকে বরণ করার মতো পর্যাপ্ত হলে নিয়তি দেবী তার ওপর আসর করে তাকে যমদেব, যমদেবের বিপরীতে অঞ্জন দুজনার যে-কাউকে বরণের জন্য প্রস্ত্তত রাখে।

এর মধ্যে এক রাতে তার দরজায় টোকা – অঞ্জন। ভোরের আলো ফোটার আগে যুগল প্রেমিক কক্সবাজারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে : তাদের মনে হয় তারা হানিমুনে যাচ্ছে। তো সেবারের কক্সবাজারের মোটেলের কয়েকটি নিবিড় রাত, সি-বিচের কয়েকটি আনন্দঘন সকাল-বিকেল যেন জীবনের এক দুর্লভ স্মৃতি। যাক, মা তখন তার উড়নচন্ডি ছেলেকে বিয়ে করিয়ে সংসারী বা ঘরমুখো করার চেষ্টা চালায় কিন্তু বাবা ত্যক্ত-বিরক্ত-হতাশ – বিয়া! বিয়া তো সে অঞ্জন আর রাজনীতিরেই করছে। এই নিয়ে বাবার এমন আচরণ থেকে রাজীবের মনে কয়, এ হয়তো তার বাবার দিক থেকে ইনহেরিট করা। দাদার তো ঘেঁটু গানের একটা দল ছিল। মা জানে কারণ মাকে ও বলেছে, সাম্প্রদায়িক কারণে দিনে দিনে একঘরে হয়েপড়া সেনদের শেকড় – অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে তার চাই সামাজিক শক্তি – যার জন্য ভালো রেজাল্ট করেও চাকরি নয়, ব্যবসা ও রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত তার। কিন্তু যুবক ছেলের এক কিশোরের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে বাবার এমন বেলাইন কথায় মা ভারি চটে।

আরে এ দুস্তি না, মায়ের অজ্ঞতায় বাবা আরো ক্রুদ্ধ, পুংটামি!

আপন ছেলের প্রশ্নে এমন বেফাঁস শব্দ ব্যবহার করে বাবা কী বোঝাতে চায় তা মায়ের জ্ঞানেই নেই! বাবা তাকে আরেঠারে বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে শেষে তা তার সামনে এক কদর্য দৃশ্যনগ্ন করে।

মা প্রথমে বোবা, পরে হয়তো তার মনে হয় রমণীসঙ্গের  অভাবে পুত্রধন তার বিপথে গেছে। তিনি তার জন্য সুন্দরী বউ খোঁজেন। কিন্তু মা জানে না ব্লু ইজ দ্য ওয়ারমেস্ট কালার – এক কুমারী কী করে এক রমণীতে পরম আনন্দ খুঁজে পায়, অজ্ঞ এই নারী জানে না, ততোদিনে প্রায় সমগ্র ইউরোপ তোলপাড় হয়ে গেছে। তাদের অনেকেই রাজীব ও অঞ্জনকে মেনে নিয়েছে, তারা যাতে অভ্যস্ত, তাদের যা চাই; এমন একটা জৈবিক পদ্ধতি মানবে যবে আছে, এমনকি প্রচলিতও এবং তা কোনোভাবেই রোধ করাও যেহেতু সম্ভব নয়, তখন আইন করে বৈধতা দেওয়াই তো উচিত! উচিত কাজটি করে আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, ডেনমার্ক, সুইডেন, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, স্পেন, দক্ষিণ আফ্রিকা – এই ১২ দেশ কবেই বাহবা কুড়িয়েছে। হালে ওবামাও তার ধ্বজা তোলে সে-দলে। ফাজিলেরা কয় বটে, ব্ল্যাক ওবামা সভ্যতা বিকাশের বিরুদ্ধে সুবিধাবাদী অবস্থান নিলেন। এদিকে অবশ্য ক্ষেপে যায় ফ্রান্সের পাবলিক। কিন্তু ওলান্দ তার নির্বাচনী প্রচারে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে জয় বাগিয়েছেন তার মধ্যে সমবিবাহ আইন অন্যতম। তো অনেকে যে বলছে, এর বিরুদ্ধে ওই ক্ষেপামি আদতে রক্ষণশীলদের   উসকানো-যড়যন্ত্র তাতে আর সন্দেহ কী! তা কিন্তু রক্ষণশীলতার প্রশ্নে স্ববিরোধীও, রাজীব বোঝে, খোদ পরপারেই যেখানে পুণ্যবানের জন্য বালকের ব্যবস্থা আছে। তো দেখা যাক, এরা মানুষের রক্তের দাবি কেমনে, কয়দিন ঠেকিয়ে রাখে!

তার ধর্মে তেমনটি নেই, তবু কিন্তু তার স্বপ্নে তারা আসে –  নাদুস-নদুস সুশ্রী বালক, তারা কোনো প্রাকৃতিক কর্মে নেই, তারা সাকি – স্বর্গীয় সরাব তুলে দেয় মুখে, নেশাগ্রস্ত চুম্বনের প্রত্যাশায়!

তো বাবা-মায়ের চাপে শোভনাকে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়ার পর ও শেষে শেষের কবিতা অনুসরণে সান্ত্বনা খোঁজে এই দর্শনে যে, বউ তবে আমার ঘটিভরা জল – প্রতিদিনের প্রয়োজনের, আর সাকিরা আমার পুকুরভরা জল – অবাধ আনন্দ সাঁতারের।

অজ্ঞাতপরিচয় সুমন প্রথম যখন তাকে মোবাইলে মেসেজ পাঠায় তা পড়েই ও চার্জড – শ্যামলা বর্ণের নাদুসনুদুস তরুণের শারীরিক বর্ণনার শেষে সে লেখে তার গোপন পথটি টাইট তবে স্থিতিস্থাপক, এমন বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে সে যা বোঝাতে চায় তার মানে সে কুমার, অনূঢ় কিন্তু প্রেমিক-পিয়াসী। বছরখানেক আগে চাস্টলে বসে পার্টির কর্মী তৌহিদের সঙ্গে সামনের নির্বাচনী শোডাউন নিয়ে কথা হচ্ছে, এরই মধ্যে এক যুবক হাজির। তৌহিদ তাকে তার খালাতো ভাই ফারুক বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। আড্ডার মধ্যেই কৌশলে তৌহিদকে না বুঝতে দিয়ে ফারুক তাকে বলে, লিডার আপনার সঙ্গে আমার কন্ফিডেনশিয়াল একটা ব্যাপার আছে। রাজিব ধরে নেয় শোডাউনে লোক জোগানের দালালি। তৌহিদকে পাশ কাটিয়ে ফারুককে নিয়ে সন্ধ্যায় ও কলেজ মাঠে বসে।

আপনার সম্পর্কে আমি তৌহিদের কাছে শুনছি।

কী শুনছ!

আপনে আমাদের জগতের মানুষ!

সে কোন জগৎ!

ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ও, আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ পেয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বে – সেই ওই জগৎ। সেখানে বাইরের প্রথিতযশা কয়েক শিল্পী-সাহিত্যিকের পৃষ্ঠপোষকতায় তার এক মধ্যবয়সী টিচারের নেতৃত্বে এক ডজন ছাত্রের গোপন চর্চা কেন্দ্র – মুভমেন্ট ফর আনক্যাপ্টিভ্যাটিং সেক্স বা মুস। মুস নিউজিল্যান্ড ও উরুগুয়ের মতো সফলতামুখী একটা বিপ্লব গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছে এরই মধ্যে

কিন্তু আমি তার কে!

এই চর্চা এবং আন্দোলনের জন্য আমারে আমার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহিষ্কার করছে, আর আমাদের দীক্ষাগুরুর গেছে চাকরি।

তো!

আমি আমার হারানো গুরুরে আপনের মধ্যে আত্মগোপন দেখছি, আপনে যদি মুসের নেতৃত্ব নিয়া আমাদের মুক্তির জন্য নামেন আমার বিশ্বাস…

তুমি আসলে আমার মধ্যে অতিমানবের ভূত দেখতাছ!

সেকথা সহসাই যেন তাকে পানিতে একটা চুবান দেয়। কিন্তু মাথা তোলার পর একটু রিলিফ নেয়, তারপর বলে, আমি কারো ভিতরের প্রকৃত শক্তিকে জাগানোর মন্ত্র জানি –

তাই!

আপনে চাইলে… তার কণ্ঠ ক্রমশ যেন সম্মোহনে, আপনে যদি এখন আমারে বিশ্বাস করে আমার সামনে নগ্ন হন…

রাজিবের মনে হয়, হতাশায় ডুবতে ডুবতে কোনো তল পাচ্ছে না যেন ও।

আর আমারে মহান মিনারের মতো উত্থিত আপনের সৌন্দর্যে…

এমন প্রার্থনার জবাব রাজিব কী দেয় তা নিয়ে যখন ও এক সংকটে সহসাই সে দেখে সামনে ক্রুদ্ধ ভূত – তৌহিদ!

ও তার খালাতো ভাইটিকে সে-রাতের আন্ধারে এমন মিলিয়ে দেয় যে রাজিব অনেক চেষ্টা করেও আর তাকে কখনোই অস্তিত্বে ফিরে পায় না!

এবার সুমনের এই মেসেজ পাওয়ার পর রোমান্টিকতার পাশাপাশি হোমোফোবিয়া তাড়া করে তাকে – পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে তার চরিত্র নিয়ে কানাঘুষা আছে, এর জন্য ও নিজেই নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখে, তাকে নেতা হিসেবে ঋজুভাবে বেড়ে উঠতে দেয় না, এই সুবাদে দুইজন তাকে ল্যাং মেরে উপজেলা কমিটিতে ওপরেও উঠে যায়। এমনকি গুজাকাঁটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মফিজ শেখের গেলমানতুল্য সুদর্শন ছেলেকে যখন ইস্কুলে যাওয়ার পথে ছয়-সাত ছোঁড়াখোর বলাৎকার করে তখন চেয়ারম্যান মনে করে কন্যাহীন তার মান-ইজ্জত ধ্বংসের জন্য প্রতিপক্ষ এটা করিয়েছে, কিন্তু কয়েকজনা যখন তাকে আলতি দেয় এই সুবাদে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ডাইন হাত রাজীবকেও এতে ফাঁসিয়ে শায়েস্তা করতে তখন সে তা না করে যারা এতে জড়িত তাদেরই আসামি করে। তো সুমন কি তেমন কোনো ফাঁদ! নিজের মধ্যে দুঃসাহস সঞ্চয় করে মেসেজ চালাচালির একপর্যায়ে ও গুপ্তধনের মতো ওকে পায়! কিন্তু একদফা অভিসারেই ও টের পায় সে আসলে চতুর এক গে-বয় এবং তাকে দিয়ে কোনো চক্র বড় কোনো শিকারের ফাঁদ পেতেছে।

এসবের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে যখন মাহিন আসার খবর হয় তখন যদিও সে জানে না ও মাহিন (ছেলে/মেয়ে) কিনা কিন্তু ও উপলব্ধি করে যে আসছে সে অঙ্কুরের মতো সুপ্ত ছিল সেনবাড়ির সুগভীর-সুবিস্তৃত শেকড়ে। এদিকে তিন-চার মাস গড়াতে না গড়াতে তাকে নিয়ে নানা জটিলতা, আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে দেখা গেল এমব্রায়ো থ্রেটেন্ড, তো এক উদ্বেগ তাকে তাড়া করে – ও না এলে যে তার ব্যবসা-রাজনীতি সব অর্থহীন! এখনো এমনই বোধের ফসল তার ব্যবসা, রাজনীতির অনুপ্রেরণা। কিন্তু ইদানীং শোভনার সঙ্গে তার ঝামেলায় কিংবা তার নিজের ওই চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে মাহিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ালে মেজাজ বিগড়ে যায়, এইটা মরে গেলে রেহাই।

ধিক্, সহসাই ও অনুশোচনায় জ্বলে ওঠে – আমার মতো আত্মঘাতী অবিমৃষ্যকারীর ইচ্ছায় এমন অনিষ্ট তুমি করো না ভগবান। মানুষের পশ্চাৎপদ চেতনে হেয় হয়ে পড়ায় আমি যা পারিনি, মাহিন তা নিশ্চয়ই পারবে – ভুল যৌনপাঠ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির গলায় পা রেখে আপন মহিমায় ভাটির বটবৃক্ষ হয়ে দাঁড়াবে।

অতএব অন্তত মাহিনের স্বার্থে শোভনাকে তার ঠেকাতে হয়। কিন্তু কীভাবে! সেদিন না যেতে পারলেও সুযোগ পেলেই ও রুমানা বা তেমন কোনো গন্তব্যে যাবে, যাবে নিশ্চয়ই।

আশা এন্টারপ্রাইজে ব্যস্ত ও, সহসাই তার মোবাইলে বাসার পাশের জেনারেল স্টোরের মালিক ‘সোহাগ কলিং’ ভেসে ওঠে!

ভাইজান, ফোন রিসিভ করতেই ছালেকার রাগঢাক-গুড়গুড়ে গলা, ভাবি যেন কার ফোন পাইল, পাইয়া অহনকা রেডি অইতাছে…

ছালেকার কথার ভাবটা এমন যে বউ তার পর-পুরুষের পাল্লায় পড়ে ব্যভিচারে মেতেছে! কথাটা যে সে তার ভাটির দ্যাশেও পাচার করবে! এর সামনে তো বটেই তার চেয়ে বড় ব্যাপার সেদিন মাহিনের সামনে ও একটা মেয়েমানুষের সঙ্গে ঠিক পেরে ওঠেনি।

আজ!

যাইতে পারবা না তুমি।

তুমি পারো আমি পারব না! শোভনার চোখে লাল কাপড় দেখে ধাবমান উন্মত্ত মোষের দৃষ্টি, আমিও অবশ্যই…

রাজিব সহসাই তার সমস্ত ক্রোধকে বাহুবলে রূপান্তর করে শোভনার কানচাপায় একটা থাপ্পড় কষে। মাহিন দেখে তাতে তার মার মাথা প্রায় এক সমকোণ ঘোরে আর শরীর সহসাই কোনো অবলম্বন না পেয়ে ধপাস করে কঠিন ফ্লোরে পড়ে যায়, কাতরায় – মায়ের নিরাবলম্ব কাতরতা তাকেই চায় বুঝেও কোনো কিছু করতে না পারার অসমর্থতা-হাহাকার অতিকায় এক থাবায় তার চেতনা, শরীর খাবলে ধরে। রাজীবের একবার মনে হয় তাকে এক্ষুনি কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নেওয়া দরকার; কিন্তু তার নিজের কিছু করতে ইগোতে লাগে, একবার মনে হয় স্বাভাবিক হয়ে গেল বলে – সে দ্বিধায় ঝুলে থাকে! নওল কিশোর মাহিনকেই শেষে মাকে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হয়, ছালেকা শোভনাকে ধরে বেবিট্যাক্সিতে উঠতে সাহায্য করে।

কানের পর্দা ফেটেছে, সার্জন বলেন, মেরামত করা যাবে তবে তা অনেক…

শোভনার বাবা-মা বোঝে এমন একটা ক্রুয়েল-ব্রুটের হাতে মেয়ের ভাগ্য ছেড়ে দেওয়া যায় না। হাসপাতাল থেকে তাকে রিলিজ দিলে তারা তাকে জামালপুর শহরের নিজেদের বাসায় নিয়ে যান।

মাহিন থেকে যায় বাবার কাছে। ছালেকা যেখানে আছে সেখানে তার সেবাযত্নের কোনো ঘাটতি হওয়ার কথা নয়! স্বামীর অত্যাচারে গ্রাম থেকে সরাসরি তার বাসায় উঠলেও তার মাধ্যমে বা নিজ চেষ্টায় ও এরই মধ্যে কোনো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে একটা চাকরি নিয়ে নিতে পারত, নেয়নি, হয়তো সে দুজনার ঝগড়াঝাটি থেকে এমন একটা পরিস্থিতির আশায় আশায় ছিল, তার উদ্ভিন্ন শরীরের ভাবভঙ্গিতে এখন যা স্পষ্টতর। আজ সকালেই উষ্টানি খেয়ে পড়ার চালাকিতে তার গায়ের ওপর পড়ে। এতদ বিবেচনায় তার মহিনকে বিশেষভাবেই আদর-যত্ন করার কথা। এর মধ্যে মাহিনও তার মায়ের প্রশ্নে কোনো অভিযোগ বা দাবি দূরে থাক, কোনো কথাই বলে না! তবে ছালেকা বিরক্ত, বলে, কার্টুনের পোকা যে টিভিই খোলে না!

হয়তো এ কোনো অস্বাভাবিকতা নয়, মাহিন ভেতরে ভেতরে খুব দ্রুতই ম্যাচিউর্ড হয়ে উঠছে। কিংবা তার বয়ঃসন্ধি বাবা-মার স্বভাবের রহস্য ভেদ করে মগজে কোনো গোলমাল পাকাচ্ছে! সম্প্রতি ঘেঁটু বিষয়ে একটা আর্ট ফিল্ম মুক্তি পাওয়ার পরপরই খুব আলোচিত হচ্ছে। এতে ঘেঁটু গানের সংস্কৃতিকে যেমন চমৎকারভাবে তুলে আনা হয়েছে, তেমনি দলটির মালিকের সঙ্গে কিশোর ঘেঁটুর সম্পর্ককে এক অমানবিক ক্রাইম হিসেবে। ব্লু ইজ দ্য ওয়ারমেস্ট কালার এবার কান চলচিত্র পুরস্কার জিতেছে – যাতে কিনা অসম বয়সী দুই নারীর প্রেম নারীর নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের মহিমায় ভাস্বর। মাহিন কি এসব জানে বা এমন সব বিষয় পত্র-পত্রিকা, ক্লাসফ্রেন্ডদের সুবাদে মগজে ঢুকে বিষম বিক্রিয়া ঘটিয়েছে!

কিন্তু এদিকে মুক্ত তারই মধ্যে শোভনার প্রশ্নে শৃঙ্খলের পিছুটান না অনুশোচনা – কী এক বিষণ্ণতা তাকে কাবু করতে বড় তৎপর! মাহিন ঘুমিয়ে গেলে ও হোটেলে গিয়ে সাকি ও সরাবে ডুবে যেতে চায়। কিন্তু –

স্কুলে যেতে যেতে বিমনা মাহিনকে হিউম্যানহলার ধাক্কা মেরেছিল প্রায়, ছালেকা কোনোভাবেই তাকে দুপুরের খাবার খাওয়াতে পারেনি, রাতে কিছুতেই হোমওয়ার্ক করাতে পারেনি স্বয়ং সে চেষ্টা করেও – সরকার তো আইন করেও টিচারের মারধর বন্ধ করতে পারেনি – কাল যে তার কপালে কী জুটবে – বিলে এখানে-সেখানে ভূতের আগুনের মতো ধপ করে জ্বলে ওঠা এ-ভাবনা সে-ভাবনা তাকে নেশায় চূর হতে দিলে তো!

ভাইজান, মাহিন ত ঘুমতে উঠতাছে না,… সকালে ছালেকার উপর্যুপরি কল তার নেশা ভেদ করে, ভয়ার্ত গলায় ও বলছে, অনেক ত ডাকাডাকি করলাম, ধাক্কা দিলাম কিন্তু তার নড়চড় নাই, শরিলও ঠান্ডা!

মাহিন এতগুলো ঘুমের বড়ি কী করে জোগাড় করে তা আশপাশের সব অষুধের দোকান অনুসন্ধান করেও হদিস মেলে না! হয়তো একদা সে অঞ্জনের বিচ্ছেদে যেমন করে করেছিল মাহিনও তাই! ইতোমধ্যে সত্যি ও ম্যাচিউর হয়ে উঠেছিল!

ঘরময় – খাট-সোফা – প্রতিটি খেলনার অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস থেকে মাহিনের বিচ্যূতি; ব্যালকনি, ছাদ, ওই নারকেল-গামারি, তা পেরিয়ে আকাশময় তার না থাকা একা কী করে বহন করে ও! শোভনাই-বা কী করে তা পারে!

সন্ধ্যায় আসে ও!

আমি মাহিনরে গোর, গোর না, তারে মাইরা মাটি চাপা দিছি।

না, আমিই… কান্নায় বেফানা শোভনা তার দায় নেয়, আমি থাকলে নিশ্চয়ই…

এরপর আর কোনো কথা বলতে পারে না ও, বিছানায় এলিয়ে পড়া দেহ থেকে কান্না কিংবা আহাজারি যেভাবে গোঙানোতে রূপ নেয় তাতে রাজীবের শঙ্কা হয় ওর স্ট্রোক করবে।

সহসাই শোভনার সেলফোন বেজে ওঠে। হোম দে ব্রড হার অরিয়র ডেড – যখন শহীদকে তার স্ত্রীর সামনে আনা হলো, সে লাশ দেখে পাথর – বাকহারা, বোধহীন। কোনো সান্ত্বনা, কোনোভাবেই যখন তার কোনো পরিবর্তন হয় না বলে শঙ্কায় সবাই দিশাহীন এরই মধ্যে কেউ তার কোলে তার শিশুটিকে তুলে দিতেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। যে ফোন করেছে সে হয়তো শোভনাকে তেমন কিছু বলবে আর তাতে তার বোধ বাঁকবদল করবে – এমন এক তাত্ত্বিক চিন্তা থেকে রাজীব তার কানে ধরার জন্য হাতে সেটটি নিতেই দেখে কলিং রুমানা!

আমি বাঁইচা তাইলে কী করব! হয়তো ‘কলিং রুমানা’ অাঁচ বা ঠাহর করে সহসাই অস্ফুট-জড়ানো কণ্ঠ ফোটে শোভনার, আইস চকোলেট বানায়া কার জন্য…

আমি যে ব্যবসাপাতিৎ এত ঘাম ঝড়াইয়া প্লট কিনলাম.. যেন সুযোগ পেয়ে তার হতাশা উথলে ওঠে, আমার পৈতৃক  জমিজমা-পুকুর-সুপারি বাগ, সেনবাড়ির ঐতিহ্য…

বিয়ের পর প্রথম যেবার শোভনা তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার ভাটি এলাকায় যায় তখনই বোঝে, পাড়াপড়শি সব কীভাবে ওঁৎ পেতে আছে কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার সুবাদে দিনে দিনে একঘরে হয়ে পড়া সেনবাড়ি গিলে খেতে। এদিকে তার শেকড় থেকে তাকে যাতে কেউ উপড়ে ফেলতে না পারে, সেজন্য ভালো রেজাল্ট করে সিভিল সার্ভিস বা ঘুষের ভালো চাকরি খোঁজেনি রাজীব। আজকাল তার টাকা বা ভাড়া করা লোক তার এলাকার মিছিল-মিটিংয়ে যত শক্তি জোগায় তা তার দলীয় এমপিকেও ছাড়িয়ে। তার এই ত্যাগের ফল এখন কে ভোগ করবে!

বস্ত্তত এমন এক শূন্যতায় কেউ তাদের কারো বিকল্প পরিপূরক হতে পারে না ভেবেও রাজীব শোভনার সেলফোনের কললিস্টে নজর রাখতে ভুল করে না।

রুমানাকে ও কলব্যাক করছে না। ওকে তবে ধরে রাখার চেষ্টা করা যাক, কিন্তু অবশ্যই রুমানা-মুক্ত শোভনাকে। কিন্তু তাকে তার ভবিষ্যৎ আসরের সম্ভাবনা মুক্ত কী করে করা! গীতা পড়ে ও। তবে কিনা পাছে তা অশুচি হয় নিশ্চয়ই সে-কারণে রামায়ণ, মহাভারত কী গীতায় এর বিপক্ষে দূরে কোনো কথাই নেই – তো কী বলে তাকে ও হেদায়েত করে! কিংবা এরই মধ্যে ও অনুশোচনায়, পরিতাপে পুড়ে প্রায়শ্চিত্ত করে চির শুদ্ধ হয়ে উঠেছে তাই রুমানার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করে না।

কিন্তু আদতে তারই তো প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত, মাহিনের মৃত্যুর জন্য কি সেই দায়ী নয়! যদি সে… কিন্তু যতই সে প্রায়শ্চিত্ত করুক মাহিনকে কোন দেবতা তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে!

এভাবে অসীম শূন্যতা হাতড়ে হাতড়ে এক রাতে ও শোভনাকে জড়ায়। মাহিনের আরেক জন্মের কামনায় তার দেহে মগ্ন হতে গিয়ে কী এক অসংগতি ঠাহর করে তার ভেতর সন্দেহগ্রস্ত বাৎসায়ণ উঁকি দেয় – শোভনার ভাবভঙ্গি কী খোঁজে তার মধ্যে! কোমল মুদ্রা! নিশ্চয়ই এ রুমানার মতো কোনো রমণী পিয়াস! এটাকে দুর্বাই বলে পিছে ঠেলে সামনে যেতে যেতে ডিম লাইটের সান্ধ্য আলোয় ও দেখে এ শোভনা নয় – তার দেহের প্রপঞ্চে অঞ্জন, সুমনেরা ঘাপটি মেরে – ওরা বা ওদের মতো কেউ তাকে জড়িয়ে পুকুরভরা অপার জলের আনন্দের দিকে টানছে!

সন্তানের শব মাড়িয়ে এ তারা যাচ্ছে কোথায়, অসীম এক হাহাকারে সহসাই সচকিত রাজীব মাহিনকে আঁকড়ে ধরতে আকুল, তুমি জীবনে জেগে উঠে বলো, এসবই দুঃস্বপ্ন বাবা!