প্রভাতফেরি

কানাই কুন্ডু

একই টেবল। একই চেয়ার। টানা করিডোর পেরিয়ে ছোট সেই কাচের ঘর। একটা জানালা। একই কর্মধারা। পরিবর্তন কেবল খান-তিনেক প্রমোশন। এবং পাখার বদলে দেয়ালে লটকানো বাতানুকূল বাক্স। এই চক্রাবর্তে পঁয়ত্রিশটা দীর্ঘ বছর ছিল নিয়ন্ত্রিত। এবং আশ্চর্য, এই বৃত্তটাই পরিপূর্ণ। বাকি সব অর্ধবৃত্ত বা কাস্তের ফালি। এর মাঝে বউ-ছেলেমেয়ে। বাবা-মা এবং বউ মলির চলে যাওয়া। মেয়ের বিয়ে। ছেলের শিক্ষান্তে দিল্লিতে চাকরি। অবসৃত জীবনের একাকিত্বেও কেটে গেল উনিশটা বছর।
মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনটা বুঝি তার নয়। এটা ঠিক রতিকান্ত নন। অন্য কেউ। যাকে তিনি চেনেন না। অথচ জানতেন। অথবা বিগত জীবন বলে যদি কিছু থাকে। কিংবা সবই অনস্তিত্বের কল্পনা। তিনি একা। তার কেউ নেই।
মাসের কোনো একদিন ছেলের ফোন আসে। খবরাখবর নেয়। শরীর-স্বাস্থ্য সম্পর্কে সাবধান করে। এবং প্রতিবার একই কথা বলে, বাড়ি বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা-পয়সা নিয়ে চলে এসো।
রতিকান্ত উত্তর দেন না।
আমাদের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা না হলে আলাদা ফ্ল্যাটে থেকো। তোমার টাকাতেই তোমার চলে যাবে।
আর কিছু বলার আছে তোর?
কী হবে আসলে? সব ভূতে খাবে।
রতিকান্তর ইচ্ছা হয় বলেন, ভূত তো তুই। কিন্তু তার বদলে বলেন, মরার খবর পেলে তোর আসতে হবে না। শ্রাদ্ধ শান্তিও নয়। তুই দায়মুক্ত। ওসব আমি বিশ্বাস করি না, বলে রিসিভার নামিয়ে রাখেন রতিকান্ত।
মেয়ের সংসার বোম্বাইতে। বিগত উনিশ বছরে তিনবার এসেছিল। নিজের তাগিদে। অর্থাৎ কারও বিয়ে, কলেজের রি-ইউনিয়ন বা বরের কোনো কাজে। দু-চারদিন থাকে। ‘বাবা বাবা’ করে কলকল করে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকেই নাকে কাঁদুনি। থাকার তো ইচ্ছা হয়। এখানেই তো সব। তবে কিনা ছেলেটা বিচ্ছু। সামনের মাসেই একজাম। ওর তো নাক-কান বোজা। সকাল ৭টায় বেরোয়। রাত ১০টায় ফেরে। না দেখলে ছেলে গুগল আর ওয়েবসাইটে। অর্ধেকদিন স্কুলেই যায় না। মেয়ে আবার উলটো। তার ধ্যান জ্ঞান ফ্যাশন শোর মডেল হওয়া। আরে সবার আগে তো এডুকেশন। কিছুতেই বোঝানো যায় না… এবার যাই বাবা। পরের বারো দিন পনেরো থেকে যাবো।
বাড়িটা কারাগার হয়ে যায়। ব্যালকনির তারে কাক ডাকে। চড়ুই কুটো মুখে নিয়ে উড়ে বেড়ায়। বেরিয়ে আসা সকাল কখন অন্ধকার হয়। রাক্ষুসে আলো ঝলসে ওঠে।
রতিকান্ত তাকিয়ে থাকেন। শহরের আলোয় আকাশ খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা তারাও নেই। বিশাল মাল্টিপ্লেক্সের খুপরিতে টিমটিম জোনাকি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবনারা ভিড় জমায়। নিজেকে অস্তিত্বহীন জড়পদার্থ অথবা বায়বীয় মনে হয়। আর তখনই তিনি দেখতে পান টলটলে জলের এক নদী। বাঁধানো খাটের কিনারে ছল-ছলাত ঢেউ। খেজুর গাছে বাঁধা কোষা নৌকো। অল্পদূরে এক দ্বীপ। সেখানে ডালপালায় ছড়ানো একা একটা বিশাল বট।
একটা দিন মানে, সকাল থেকে সন্ধে। দীর্ঘ সময়। তারপর পক্ষ মাস বছর। বছরের পর বছর। মনের আয়নায় একই দৃশ্য। কখনো দেখেন, কৈশোরছোঁয়া এক শিশু কোষা নৌকোর দড়ি খুলে বৈঠা নিয়ে বসে। ভেসে বেড়ায় ধান-মাঠ। গ্রামান্তর গঞ্জ গাঙ। নৌকো টলবল করে। সামাল দিতে হিমশিম। ওই ছোট দুই হাতে ওর কতটুকু ক্ষমতা। ও কি সাঁতার জানে? জানলেও কি জলরাশির বিস্তার পেরিয়ে কিনারে আসতে পারবে? আরে ও ঘূর্ণির দিকে এগোচ্ছে কেন? যদি ডুবে যায়!
রতিকান্ত ঘেমে ওঠেন। মনে অহেতুক আতঙ্কের তোলপাড়। বুক ধড়ধড় করে। প্রেশার কি বেড়েছে! অনেকদিন হলো ব্লাডসুগার চেক করা হয়নি। যতসব আবোল-তাবোল ভাবনা।
এইসব নাকি ঘরকুনো থাকার ফল, বলেছিলেন বর্তিকা অ্যাপার্টমেন্টের বিনয়বাবু। আরে মশাই, মন কখনো ফাঁকা থাকে না। কিছু না কিছু ভাবেই। বেশিরভাগই ভুয়ো ভাবনা।
কিন্তু, রেহাই তো নেই।
থাকবে না কেন! আপনি তো আবার গুরু পুরোহিত বিশ্বাস করেন না।
সেও তো ভুয়ো ভড়ং।
ভড়ং বোকামি যা-ই বলুন, সময় তো কাটে।
জানি না। তবে আমার গুরু ভজনা হবে না। অন্য উপায় নেই?
আছে। কিন্তু খরচ-খরচা আছে।
কীসের খরচ?
মাঝে মাঝে বাইরে বেরিয়ে পড়ুন। কত জায়গা আছে। দীঘা পুরী চাঁদিপুর দার্জিলিং সোলেগাঁও…

মুকুটমণিপুরে কাঁসাই কুমারীর জলাধার। বিস্তৃত জলক্ষেত্রের মাঝে এক নিরালা দ্বীপ। শাখা-প্রশাখায় পরিব্যাপ্ত নিবিড় সবুজ আকাশ ছুঁয়ে খাড়া। রতিকান্ত অবাক। এটাই কি তার একাকিত্বের মহাতরু! কোষা নৌকোর মতো টলবলে নৌকোয় হোটেল থেকে বাজারে পারাপার। এপারে ছোট ছোট গ্রাম। মাঠময় সবুজ হাওয়ার দোলা।
রতিকান্ত হদিস পেয়ে যান। পাঁচদিনের হোটেলবুকিং বাতিল করে দ্বিতীয় দিনই ফিরে আসেন। উড়ুউড়ু মন। শেয়ালদা স্টেশন। ঘোড়ার গাড়ি। শহরের রাস্তায় লোহার লাইন। একতলা বাড়ির মতো ট্রামের ঘড়ঘড়। চারতলায় ভাড়া নেওয়া ঘর। গাদাগাদি করে থাকা। স্কুলে ফাঁকি দেওয়ার আনন্দ। ফুচকা ফুটবল ম্যাটিনি সিনেমা। এবং এভাবেই কলেজ, প্রেমে পড়া, বড় হওয়া। তবু এ তার দেশ নয়। নদী নেই। নৌকো নেই। দৃষ্টি হারানো দিগন্ত নেই।
এবার দ্রুত প্রস্ত্ততি। বিমান নয়, বাসে। দেখতে দেখতে যাওয়া। শীতের ভোরে বাসস্ট্যান্ড। বারাসত মধ্যম গ্রাম হৃদয়পুর বনগাঁ এমনকি পেট্রাপোলও অচেনা। আসেননি কখনো। কিন্তু যশোর খুলনা মৈমনসিং টাঙ্গাইল কোথায় যেন শোনা মনে হয়। আলঘেরা ধানক্ষেত, নারকেল সুপুরির বাগান বড় চেনা লাগে। যেন ছেলেবেলায় মুখস্থ করা ভুলে যাওয়া কবিতা।
গোয়ালন্দ পৌঁছে মনটা এক লাফে আটে নেমে যায়। কেবলই ছটফট করেন। ঢাকায় বুড়িগঙ্গার ঘাট থেকেই তো দোতলা স্টিমারে পদ্মাপারের এই আশ্রয়। এখান থেকে ট্রেনে ওঠা। শিয়ালদহ। কিন্তু বাস এখানে থামেই না। হুহু করে পার হয়ে যায়। তাহলে পদ্মা! সরে গেছে অনেক দূরে। কালের স্রোত টেনে নিয়েছে তাকে। বয়সের ভারে আয়তন শীর্ণ। বিস্তীর্ণ বালুচড়া।
ঢাকায় পা দিতেই শরীরে শিহরণ। এই মাটি ছেড়ে দেশান্তরী হওয়া। যেমন গ্রাম ছেড়ে তার এই ঢাকা শহরে পড়তে আসা। গ্রামে পাঠশালা ছিল। কিন্তু সেখানে তাকে পাঠানো হতো না। মা, ঠাকুমা কাজের এবং কাছের লোক যোগাদারা আদুরে রতিকান্তকে বিদায় জানাতে এসেছিল নদীর ঘাটে। নৌকোয় উঠে বসতেই বলেছিল, ছুটিছাটায় আসিস।
আর গ্রামে ফেরা হয়নি। তখনো দেশভাগ হয়নি। পাকিস্তান বাংলাদেশের অস্তিত্ব ছিল না। একটাই দেশ বাংলা। তবে রায়ট বলে একটা শব্দের ফিসফাস ছিল হিন্দু পরিবারে। বাবা চাকরি করতেন ঢাকায়। বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। কাকা-কাকিমারাও সেখানে। বাবার দূরদৃষ্টি ছিল। অথবা তার ভাবনাই সঠিক প্রমাণিত হয়। কলকাতায় চৌরাস্তার মোড়ে পাঁচতলা বাড়ির একটা ছোট অংশ ভাড়া নিয়ে রেখেছিলেন। গ্রামের জমিজমা সব বিক্রি করে সবাইকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। দু-একজন আত্মীয় ছাড়া খালি পড়ে থাকল দোতলা বাড়ি, বাগান বাঁধানো নদীঘাট। কোষা নৌকোটা ঢেউয়ের দোলায় দুলতে লাগল একা একা।
শৈশবের সেই গ্রাম ঝাপসা। এই ঢাকাও তিনি ঠিক চেনেন না। বারিধারা গুলশান আড়ং ইত্যাদি নামে শহর ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু মনে পড়ে বুড়িগঙ্গা ঘাটের পাশে বাংলাবাজার সূত্রাপুর গেন্ডারিয়া পুরানা পল্টন। আর জগন্নাথ কলেজের ভেতরের গলি দিয়ে তার স্কুল। সেন্ট গ্রেগরি। পাশেই গির্জা। ফাদারদের কোয়ার্টার। তা-ও কম দিন নয়। টানা বছর দেড়েক।
সেই ঠিকানা সম্বল করে এগিয়ে আসা। জগন্নাথ কলেজ এখন বিশ্ববিদ্যালয়। গলিপথ বন্ধ। পাশের পার্ক প্রায় অদৃশ্য। মফস্বলের বাসডিপো। রিকশা-অটোর ভিড়ে রতিকান্ত দিশেহারা। আপাতত ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে একটা হোটেল। একটু বিশ্রাম।

পরের দিন সকালে হোটেল ম্যানেজারকে ঢাকা আগমনের উদ্দেশ্য জানান রতিকান্ত। যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায়। কিন্তু তিনিও বিভ্রান্ত। এমন অনেক অখ্যাত গ্রাম আছে বাংলাদেশে একই নামে। এবং সবই তার অচেনা। তিনি পালটা প্রশ্ন করেন, আত্মীয় বা পুরনো বন্ধু কেউ নেই?
না। তেমন কেউ নেই। তবে একজনকে খুব মনে পড়ে। একসঙ্গে পড়তাম। কিন্তু তার বাড়ি-ঠিকানা জানা নেই।
নাম?
বোধহয় হারুণ। হারুণ আমেদ।
নামটা শুনেছি মনে হয়। পন্ডিত মানুষ। তিনিই আপনার বন্ধু কিনা কাল বলতে পারব।
আজ নয় কেন?
আজ জুম্মাবার। কলেজ ইউনিভার্সিটি সব ছুটি। অতীতকে পেতে বুড়িগঙ্গার ঘাটে আসেন রতিকান্ত। ওপারে হারানো জলরাশি আর নেই। শীর্ণ কালো জলে ঘুলিয়ে ওঠা ফেনা। অস্বস্তিজনক দুর্গন্ধ। তারই বুকে ভাসমান তিন-চারতলা জাহাজবোট। কাউন্টারে টিকিট বিক্রি চলছে। কুমিল্লা বরিশাল কুতুবদিয়া নোয়াখালি। এসি রুম, স্যুইটও ভাড়া পাওয়া যায়। ঘাটের বাইরের অঞ্চল ঘিঞ্জি। ফুটপাতময় দোকানপাট ছড়ানো। কলকাতার বড়বাজারের মতো। এটাই এখানকার বাংলাবাজার। কিন্তু অতীত নেই। সবই প্রায় নতুন। চার-পাঁচতলা বাজার দোকান অফিস। বাংলাদেশের মানচিত্র কিনে হোটেলে ফেরেন রতিকান্ত।
সকালে হাড়-কাঁপানো শীত। গা-মোড়ানো কম্বলে আলস্যের আমেজ। যা অবস্থা, নিজেকেই উদ্যোগী হতে হবে। সাভারে গিয়ে হাঁটাপথেই যাবেন। এখন হয়তো রিকশাও চলে। এখন তিনি মানচিত্রে ব্যস্ত। নীলাভ রেখায় পদ্মা মেঘনা কর্ণফুলী কপোতাক্ষ বুড়িগঙ্গা। বাকি সব নামহীন সুতোর মতো। হঠাৎ দরজায় টোকা।
খোলা আছে; জানান রতিকান্ত।
দুই হাত প্রসারিত এক বয়স্ক পুরুষ। পাকা চুল। উজ্জ্বল চোখ। মুখে দুষ্টু হাসি। কী, চেনা লাগে?
বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি নেমে রতিকান্ত এগিয়ে আসেন। উষ্ণ আলিঙ্গনে ধরা দেন। হারুণ!
নয়তো কে? ভেবেছিলে না জানিয়ে চুপচাপ কেটে পড়বে। আরে, অনেক চর আছে আমার ঢাকা শহরে।
তুমি যে এত খ্যাতিমান হয়েছ জানলে, প্রথমে তোমারই খোঁজ করতাম।
এই একটু গালমন্দ লিখিটিখি। বক্তিমে দিয়ে বেড়াই। পরে কথা হবে। এখন চল, বলে ব্যাগ-ব্যাগেজ হাতে নেয়।
কোথায়?
আমার বাসায়।
আমার অবস্থান তো দেখলে। সকাল সন্ধ্যায় এসো…
তাই হয় নাকি। ঢাকায় এলে, তোমার ঠিকানা হারুণ আমেদ।
একটু অপেক্ষা কর। বেয়ারাকে ডাকি। বিলটা মেটাতে হবে।
ওসব আগেই চুকিয়ে দিয়েছি। কথা না বাড়িয়ে এখন চল।
তিনতলা বিশাল বাড়ি। ভাই পরিবারবর্গ থেকেও অর্ধেকের বেশি ফাঁকা। সারি সারি ঘর। খান-চারেক হারুনের বইপত্রে ঠাসা। বাকি খালি পড়ে থাকে। এরই একটিতে রতিকান্তর অধিষ্ঠান। হোটেলের চেয়ে আরামপ্রদ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।
বন্ধুত্বে আপ্যায়নে আত্মীয়তায় স্মৃতিচারণে এবং গুণীজনের আড্ডায় কেটে যায় কয়েকটা সুখময় দিন। তারপর এক কাকভোরে রতিকান্ত উঠে বসলেন হারুণের গাড়িতে। সঙ্গে তৈফুর মিঞা। জিজ্ঞাসা করলে বলে, তৈফর।
জলপথ নয়। স্থলপথেই এখন ঢালাও যোগাযোগ। এবং দ্রুততর। ভোরের হাইওয়ে। ফাঁকা এবং শীতার্ত। শহরসীমা শেষ হলে দুপাশে ঢালু মাঠ। ছোট ছোট গ্রাম। টিলার উচ্চতায় পথ। ৮টা নাগাদ এক শিশু-আশুদের ছায়ায় বিরতি। তৈফুর বা তৈফর বলে, নামেন ছ্যার।
নদী?
হোই তো, আপনের তুরাগ।
রতিকান্ত বিস্মিত। হাইওয়ে থেকে সন্তর্পণে পা টিপে ঢালে নামতে হয়। কিন্তু কোথায় সেই জল থইথই নদী। কেবল ধুধু মাঠ। শুকনো মাটি। বলেন, তুমি ঠিক চেনো তো? আগে তো সাভারের দিক থেকে আসতে হতো।
কী যে কন ছ্যার। হোই দ্যাখেন ঢাকা থিকা বড় নৌকা আসে। হোই ফেরিঘাট। লোকজন খাড়াইয়া আছে। হোই ওপারে আপনের গ্রাম তেঁতুলিয়া। অখন পানি কম। সব নদীই এমন শুখা।
কালো জল। দুর্গন্ধ। বুড়িগঙ্গার তীরে গজিয়ে ওঠা যথেচ্ছ ট্যানারি দূষিত করেছে নদীকে। হাত-বিশেক বিস্তার। কিন্তু গভীর। ফেরিতে এপারে এসে নিজেকে খুঁজে পান রতিকান্ত। এটাই তো বাঁধাঘাট। ঢালু থেকে ওপরে উঠলে গ্রাম। এখানেই তার আবাল্যের চলাচল। ভেসে বেড়ানো। ওই তো তার দামাল পায়ে চষে বেড়ানো ইট বিছানো পথ। ওই ঘোষেদের পুরনো বাড়ি। এখনো অক্ষত। পুজোমন্ডপ। সামনে খোলা মাঠ। পাশের পাঠশালা এখন স্কুল। এপাশে বাজারপাড়া। দোকানপাট বেড়েছে। সেলুন হয়েছে একটা। আগে হাতবাক্সওয়ালা নাপিত ছিল। ওদিকে উত্তরপাড়া। মাঝখানে মধ্যিপাড়া, আরো এগিয়ে জেলেপাড়া। শেখপাড়া। সেখানে কয়েক ঘর মুসলমানের বাস ছিল। তারপর নমোশূদ্রপাড়ার শেষে সাভারে যাবার রাস্তা।
চটিটা পা থেকে খুলে ব্যাগে রেখে দেন। অনভ্যাসের খালি পায়ে ইটের খাঁজ। ধুলো। ছেলেবেলাকে ফিরে পেত চান। তখন এত জুতো-চটির চল ছিল না। কেবল স্কুলে যাওয়ার সময়। পুজোর মাঠ ছাড়িয়ে একটু এগোতেই মধ্যিপাড়া। ডানদিকে আলাদা বৈঠকখানা চিনতে পারেন। এখনো অক্ষত। কারা যেন বাসা বেঁধেছে ভেতরে। কোনো আকর্ষণ নেই। বৈঠকখানায় আসার অধিকারই ছিল না তার। বাবা-কাকারা এলে খোলা হতো। কিন্তু উলটো দিকের দোতলা বাড়িটা! কোথায় সেই আম কাঁঠাল নারকেল সুপুরি কলা পেঁপের বাগান! সব নিশ্চিহ্ন। জমিটার মালিকানা এখন দুভাগে। একতলা ঘিঞ্জি বাড়ি। একদিকে শাটার নামানো কয়েকটা খুপরি। পেছনে বসতবাড়ি। একপাশ থেকে ভেতরের উঠোন দেখা যায়। একবার, মাত্র একবার উঠোনে দাঁড়াবার বড় ইচ্ছা হয়। তৈফরকে জানাতেই, এগিয়ে যায়। গলা চড়িয়ে ডাকে, কত্তা আছেন নাকি। কত্তা?
লুঙ্গি পরা এক ভদ্রলোক বাইরে আসেন। পাকা দাড়ি। পাকা চুল। চশমা। মাথায় কুরুশের টুপি। কেডা?
ছ্যার আইসেন। একটু উঠানের দিকে যাইব।
ক্যান?
জন্মভিটা ত। একটু খাড়াইয়া দ্যাখবেন।
হ্যারে ত চিনি না। নিতাইবাবুর নাম শুনছি।
রতিকান্ত বলেন, আমার ছোট কাকা।
আসেন। দেইখা যান, বলে তিনি বেরিয়ে যান। ভেতর মহলে পরপর দরজা বন্ধ হয়। বারান্দায় খান-চারেক অর্ধনগ্ন শিশু। অসীম কৌতূহলে রতিকান্তকে দেখে।
রতিকান্ত উঠোনে পা রাখেন। আগলে রাখেন আবেগ-বাষ্প। ঘাট বাঁধানো সিঁড়ির খান-ছয়েক মাটিতে বিলীন। মাত্র দুটির অবস্থানচিহ্ন জেগে আছে। নদী নেই। এই ঘাটেই দস্যুর মতো জল ছিটিয়ে দাপিয়ে ডুবসাঁতারে সবাইকে উত্ত্যক্ত করত বালক রতি। এখন তা আগাছায় আকীর্ণ। দুর্গম জঞ্জাল। পাঁচটা পায়খানার একটি মাত্র টিকে আছে। কুয়োয় জল নেই। অর্ধেক বোজানো। ঘেরা পাঁচিল অদৃশ্য। গোয়ালঘরটা গোয়াল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। পাশে সেই কাঁচা অচ্ছুৎ অাঁতুড়ঘর। ইটের গাঁথুনি। টিনের চালা। বেশ ছোট। আরো ছোট তার জানালা। স্তব্ধ মুগ্ধ বিষণ্ণ রতিকান্ত। এই তার জন্মস্থান। জীবনের উন্মেষ। কীসের যেন গন্ধ পান তিনি। মাটির। মরা নদীর। নাকি মায়ের গায়ের!
ছিটকে বেরিয়ে আসেন। রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকেন শেষপ্রান্তে। গুইনবাড়ির তিনতলা পর্যন্ত ওঠা চারখানা বিশাল থাম। এখনো চিনেমাটির টুকরো ঝিকঝিক করে। প্রতি খুপরিতে বেদখল পরিবার। দরিদ্র হতশ্রী। তারকবাবুর বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না। কয়েকটা টিনের চালাঘর। এমন অনেক ঘরবাড়ি তার স্মৃতি-বিচ্ছিন্ন। পরিবর্তনে অচেনা। আর পাড়া বিভাজনও নেই। পুরো গ্রামটাই এক পাড়া। তার বাল্য, দামাল কৈশোর হারিয়ে গেছে। স্মৃতি স্বপ্নের কোনো মিল নেই। একটি মানুষও চেনা নয়। তাকেও অচেনা মানুষ কৌতূহলে দেখে। রাস্তায় হাঁটা কোনো ভিনদেশি পথিক। রতিকান্তর কেবলই মনে হয়, এখানে তিনি কেন এলেন। কেন!