লোককথার কিংবদন্তি ধারা : শীলা বসাকের অনুসন্ধান

মনিরুজ্জামান

সুবোধ ঘোষের কিংবদন্তীর দেশে (১৯৬১) সাহিত্যিক ও লোক-গবেষকদের চমকিত করে তুললেও কিংবদন্তি এবং কিংবদন্তি-সৃষ্টির রহস্য কী, এ-নিয়ে বিস্তৃততর কোনো আলোচনা ও বিশে�ষণ কোথাও তেমন দেখা যায়নি। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও আনন্দ পুরস্কারসহ নানা সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখিকা ড. শীলা বসাক তিন দশক ধরে নানা গবেষণার পর এ-বছর বাংলার কিংবদন্তি (আনন্দ পাবলিশার্স, জানুয়ারি ২০১৩) প্রকাশ করে বিষয়টিকে খানিকটা এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। তাঁর সংগ্রহ, শ্রেণিকরণ ও উপস্থাপন তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মতোই ঋদ্ধ এবং আকর্ষণীয়। ইংরেজি ও বাংলায় বাংলার ধাঁধা বিষয়ে তাঁর দুটি আলোচনা (২০০৬), আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত গ্রন্থ বাংলার নকশী কাঁথা (২০০২), ইংরেজিতে সম্পাদিত দীনেশচন্দ্র সেনের The Folk literature of Bengal (2006) প্রভৃতি তাঁর নামকাড়া গ্রন্থ ও ঈর্ষণীয় কীর্তি।

বাংলা কিংবদন্তিও বাংলা লোকসংস্কৃতির গবেষণার ক্ষেত্রে সমানভাবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। গ্রন্থটি দুই বাংলারই লোকসম্পদ বিষয়ক; তেমনি উৎসর্গও করা হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবী প্রফেসর আনিসুজ্জামান ও সিদ্দিকা জামানকে – দাদা ও দিদি সম্বোধনে।

কিংবদন্তি প্রাচীন সমাজের সম্পদ। আধুনিক সমাজে এ-বিষয়ে অন্যরকম কথাও হতে পারে, যেমন কিংবদন্তির মধ্যে আর্যীকরণের বিষয়টি জটিল রূপ নেবে – এটাই স্বাভাবিক। শীলা বসাক পুরাণভাঙা রূপ (Broken down myth) ও অন্যান্য রূপে লভ্য কিংবদন্তিগুলি নিজস্ব ধারণা থেকেই সংগ্রহ করে সেগুলি সনাতনভাবে সাজিয়েছেন। তাঁর এই সংগ্রহ ও তাঁর শ্রেণিকরণ আধুনিক ব্যাখ্যার অনুপযোগী নয়। সংকলকের অভিজ্ঞতা ও লোকজ্ঞানই এর কারণ। এ-গ্রন্থের মূল্য সেদিক থেকে ঐতিহাসিক।

দুই

কিংবদন্তির নানা উৎস, নানা দিক, নানা সূত্র, নানা মাত্রায় তার প্রসার ও বিশ্বাসের গভীরে তার স্থিতি। বাংলার কিংবদন্তি গ্রন্থের সংকলয়িতা ড. শীলা বসাক স্বল্পপরিসরে (৬+৪ পৃষ্ঠা মাত্র) এরবিষয়-পরিচিতি এবং সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যাদি আলোচনা করে ১০টি বিভিন্ন শ্রেণিতে ও বিবিধ পর্যায়ে আরো কিছু কিংবদন্তি যুক্ত করে বিষয়টি বিশদ করেছেন। কোষ হিসেবেও সংকলনটি নানা মাত্রিকতাযুক্ত। সবই প্রায় মাঠকর্মভিত্তিক কাজ ও নিজস্ব সংগ্রহ, – যা তিনি দুই বাংলা থেকে সংগ্রহ করে সাজিয়েছেন। বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন উৎসের এসব গল্প-কাহিনি সংগ্রহ করে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে এসব কাহিনির গঠন ও বিশ্বাসের রূপগুলি প্রায় এক, মোটিফের বৈচিত্র্যও কম। শুধু সংখ্যাগতভাবেই নয়, এর গঠন ও বৈশিষ্ট্য নিয়েও শীলা বসাক একটি নতুন ধারণা দিতে সমর্থ হয়েছেন।

উলে�খ্য, বাংলা কিংবদন্তি বাঙালি সমাজেরই সৃষ্টি হলেও ধর্মে ও ভাষায় এই সমাজের আহ্নিক পরিচয় কী, তার উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক। তাঁর কাছে সে-আলোচনা প্রত্যাশিতও ছিল। আসলে কিংবদন্তির উৎসেই থাকে নৃতাত্ত্বিক বীজ  কিংবা শিকড়ের সত্য। কেবল সংগ্রহটাই বড় নয়, তার ক্ষেত্র, মোটিফ ও অন্যান্য নৃচারিত্র্য এবং ধারাকেও বুঝে নিতে হয়। সংকলয়িতা বা গবেষিকা সেগুলি সামান্যত ইঙ্গিত করলেও তা বিস্তৃত করেননি, হয়তোবা স্পেস বা পরিসরের ইকোনমির জন্য। ফলে এর অন্তর্বৈশিষ্ট্য যা-ই হোক, বহিঃপ্রকাশে তা প্রশ্নবিদ্ধও হতে পারে।

তিন

প্রথমে সেরূপ কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।

শীলা বসাক দশটিরও অধিক বিচিত্র বিষয়কেন্দ্রিক কিংবদন্তি সংগ্রহ করেছেন যার সংখ্যা চার শতকেরও অধিক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি উভয় বাংলা থেকে উদাহরণ দিতে চেষ্টা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে বাস করে বাংলাদেশ থেকে উদাহরণ সংগ্রহ করা সহজ নয়। তথাপি তিনি ৯৮টি স্থান নামের উৎসকাহিনির মধ্যে ৪৩টি সূত্র নিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যমের উদাহরণ। অবশ্য সব ক্ষেত্রে তা হয়তো সম্ভব হয়নি, – অর্থাৎ ব্যক্তিনামকেন্দ্রী বা দেবদেবী-কেন্দ্রী কাহিনি বা মেলা উৎসব-কেন্দ্রী কাহিনি সে তুলনায় বেশ হ্রস্ব। আলৌকিক কথা বা বৃক্ষলতা, বনজঙ্গলের        প্রসঙ্গী-কথাও তেমনি। অবশ্য সেরকম বিভাগ রচনা তাঁর উদ্দেশ্যও নয়। তবে এখানে কয়েকটি বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। যেমন –

১. গ্রন্থনাম যেখানে বাংলার কিংবদন্তি সেখানে হঠাৎ দক্ষিণ ভারতের কন্যাকুমারীর প্রসঙ্গ (পৃ ৯৫) কেন, এর যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না।

২. সব কাহিনিই স্থানগতভাবে উলি�খিত হয়েছে, আবার মাঝে মাঝে শ্রেণিবিভাগটি একেবারেই স্থাননিরপেক্ষ থেকেছে। ফলে ঘটনাটি কোথাকার তা জানা যায় না, নাকি সর্ববঙ্গীয় তাও অনুলি�খিত  থাকায় আরো অস্পষ্টতা ঘটেছে; মালেকের সাইটো (পৃ ১৫৯), সাঁওতালদের ‘বীরশিখা’  (পৃ ৩১১-৩১২) কিংবা ‘মুরগি বলি’ (পৃ ৩১২) প্রভৃতি সেই শ্রেণির।

৩. কিছু নামে সম্ভবত ভ্রান্তি ঘটেছে। চট্টগ্রামের চেরাগির পাহাড়-প্রসঙ্গে হজরত বায়েজিদ বোস্তামির উপস্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে। চেরাগ জ্বালানিয়া মাহীসওয়ারের কিংবদন্তিটি ভিন্ন। বায়েজিদ বোস্তামির কবরের প্রসঙ্গটিও ভুল।

৪.  চেরাগি পাহাড়ের কথা বলা হলেও তারই পাশে ‘কদম মোবারকে’র কথা এবং নারায়ণগঞ্জের প্রসঙ্গ একাধিকবার এলেও সেখানকার বিখ্যাত ‘কদম রসুলে’র কথা উলে�খ করা হয়নি। বাংলাপিডিয়াতে এ-বিষয়ে আরো তথ্য আছে।

৫. খোয়াজখিজিরের কাহিনি বাংলাদেশে বিখ্যাত। এ-গ্রন্থে তাঁকে  পীর বলা হয়েছে, কিন্তু তাঁর নামে কোথাও কোনো আস্তানা নেই। আসলে তিনি পানির বাদশা, জিনেরও মালিক। দরিদ্রদের বা অভাবীদের কান্ডারি। ‘খোয়াজখিজিরের বাক্স’ আকারে ক্ষুদ্র এক মহাসাহায্য  ভান্ডার। গরিবের কান্নাকাটিতে এই বাক্স উপস্থিত হয়, তবে তার থেকে একটিমাত্র জিনিস নেওয়া যায়। শীলা বসাকে গ্রন্থে শুধু নদীতে বিপত্তারণে খোয়াজের ভূমিকা এবং তাঁর অলৌকিক বিবাহের কথাই  বলা আছে।

তবে এই সমালোচনা এখানে মুখ্য বিষয় নয়। আমরা অন্য বিষয়েও লক্ষ করবো। এ-কথা সত্য যে, এটি একটি একক গবেষণার ফল। এ-ধরনের কোনো একক গবেষণায় নিশ্চিতই প্রত্যাশিত সবদিকে আলোকপাত করা সম্ভব হয় না। প্রয়োজনও হয় না। তবে তার মানে এই নয় যে, সেসব অস্পর্শিত বিষয়ে তিনি একেবারেই অজ্ঞ রয়েছেন। সুমিত আয়তনের গ্রন্থ প্রকাশের সমস্যা সেখানেই। বাংলার কিংবদন্তির আরো সংস্করণ হবে – এটাও প্রত্যাশিত। সেই দিকে লক্ষ রেখে কিছু প্রশ্ন ও পরিপূরক কথা যোগ করা যেতে পারে। যেমন – দশটির অধিক ভাগে বিন্যস্ত এ-গ্রন্থের কাহিনিসমূহ কিসের ভিত্তিতে সাজিয়েছেন কিংবা মধ্যযুগের সাহিত্যে যেসব কিংবদন্তির সূত্র পাওয়া যায় সেগুলিরই বা উলে�খ থাকলো না কেন এ-গ্রন্থে, এরূপ প্রশ্ন উত্থাপন তাই অসঙ্গত নয়। লেখিকা যখন বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস যথেষ্ট পুরনো নয়, তাই পুরাণ কথার সৃষ্টি হতে পারেনি যথেষ্টভাবে (পৃ ১৫) তখনো তো প্রশ্ন হতে পারে, ইতিহাসের প্রাচীন তথ্য কতটুকু আমরা সংরক্ষণ করতে পেরেছি? এসব কথা কি পাশ্চাত্য ধারণাজাত বা অনুকরণ মাত্র নয়?

ধরা যাক, মনসা বা চন্ডীর কথা। মঙ্গলকাব্যের ব্রাহ্মণ কবিগণ কোন কথাকে কোথা থেকে এনে কী রূপ দিলেন, সেটাই কি বড় হলো! এ যেন জেসুইট দোম আন্তনিওর বাংলা-রোমান দ্বিভাষী কথনমালা ও ব্যাকরণরূপকে অগাস্টানিয়ান ম্যানুয়েলের নিজের বলে দাবি করার মতো। সেইরকম মনসামঙ্গলের মধ্যে পদ্মপুরাণও অন্তর্ভুক্ত হয়ে বা একীভূত হয়ে পূজ্য হয়ে উঠলো, কিন্তু কোন যুক্তিতে? মমতাজুর রহমান তরফদার বলেন, ‘জৈন দেবী পদ্মাবতীর সঙ্গে  মনসার সম্পর্ক থাকতে পারে। কেননা উভয়েই সাপের দেবী। হয়তো মনসা পদ্মাবতীর রূপান্তরিত সংস্করণ নন।’ – তিনি এখানে পি কে মাইতির প্রভাব বা রূপান্তরতত্ত্ব নাকচ করেন এবং সাম্প্রতিককালে উত্তর বর্ধমান প্রভৃতি রাঢ় অঞ্চলের আবিষ্কৃত অনেকগুলি জৈনমূর্তির (যার নির্মাণকাল ৯-১২ শতকের মধ্যে) উলে�খ  করে প্রমাণ করেন যে, এই অঞ্চলেই মনসা দেবী পূজার ও তৎসম্পর্কিত কাহিনির সূত্রপাত ঘটেছিল। (দ্র. আনিসুজ্জামান-সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড ২০০৮, পৃ ১০৯)। ড. তরফদার এখানেই থামেননি, তিনি দেখিয়েছেন, চন্ডী ছিল লৌকিক দেবতা মাত্র। টি. ডব্লিউ. ক্লার্কের ধারণা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাঁর মতে দেবী চন্ডী ছিলেন সেনপূর্ব যুগে ওই অঞ্চলের সভ্যতা-সংস্কৃতিবিহীন, অরণ্যচারী ব্যাধদের দেবতা। এগারো থেকে বারো শতকের মধ্যে সেন আমলে ব্রাহ্মণ্য প্রভাব এই অঞ্চলে বৃদ্ধি পেলে ধর্মতত্ত্ববিদগণ ও দার্শনিকগণ তাঁদের orthodox metaphysics অনুযায়ী চন্ডীপূজার (আমাদের মতে, গোধিকারূপিণী  টোটেমপূজার) একধরনের ব্রাহ্মণ্য ব্যাখ্যা দিয়ে ওই পূজাব্যবস্থাকে নিজেদের ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যিক ঐতিহ্যের ছকে ফেললেন।’  (ওই, পপৃ ১১৩) এবং আর্যীকরণ প্রসঙ্গেও আরো স্পষ্ট করে বলেন, ‘প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে যে সংস্কৃতি ক্রমাগত রূপ পাচ্ছিল তা আর্য সংস্কৃতি নয়। তার প্রাণশক্তি জোগাচ্ছিল লোক-সংস্কৃতি, তার শরীরেরই শুধু  পৌরাণিক নামধামের লেবেল লাগানো হয়েছিল।’ (পৃ ১১৫) স্থানীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে গবেষণা যে অনেক এগিয়েছে, সেটাই এখানে বিবেচ্য। লোক-গবেষকগণ আরো কিছু বিষয়ের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। স্থান-নামের মতো গোত্র-নাম, দেবদেবীর নামের মিশ্রণ প্রভৃতি নানা বিচিত্র বিষয় নিয়েও সন্নিষ্ঠ নব্য গবেষকগণের আগ্রহ এখন পূর্বাপেক্ষা অধিক।

বাঙালির ইতিহাসে দেখা যায়, অশোকের পূর্ব থেকে শ্রীচৈতন্যোত্তর যুগ পর্যন্ত এদেশ বৌদ্ধ প্রভাবাধীন ছিল। রাঢ় বঙ্গে প্রাপ্ত ও খননলভ্য সকল দেবদেবী মূর্তির মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছে বৌদ্ধতন্ত্রের বিগ্রহসমূহ। এজন্য বলা হয়, ‘রাঢ়বঙ্গে বৌদ্ধধর্ম যত প্রাচীন, হিন্দুধর্ম তত প্রাচীন নয়।’ লোকপ্রভাবে কালের চিহ্ন বিদ্যমান থাকে। সেভাবেই কালুবীর, ময়নামতীর গীত, পাঁচ পীরের মাজার সংস্কৃতি ও কথামালার সৃষ্টি।

বিস্তৃতির জন্য বিশেষ উদাহরণ আনা যায়। জাতি বা গোষ্ঠী নামের ক্ষেত্রে শীলা বসাকের খুব একটা দৃষ্টি পড়েনি। এখানে কিছু পরিপূরক তথ্য উলে�খ করা যেতে পারে। যেমন বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া গ্রামের কথা জগদ্বিখ্যাত। বিশেষত তার মৃত্তিকাশিল্পের অননুকরণীয়তার কারণে। মানিকলাল সিংহের (রাঢ়ের জাতি ও কৃষ্টি, তৃতীয় খন্ড, ১৯৮৩) মতে, ‘তা বৌদ্ধসভ্যতার ক্ষীণ স্মৃতি রক্ষা করিয়া চলিতেছে।’

একইভাবে পাল আমলের হস্ত্যায়ুর্বেদ, বৃক্ষায়ুর্বেদ প্রভৃতি  বৈদ্যশাস্ত্র ও চিকিৎসামন্ত্রের যুগাবসানে অর্থাৎ ধন্বন্তরিতার বিলুপ্তিকালে নানা কিংবদন্তি গড়ে ওঠে ও নানা অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ে। ধন্বন্তরী চিকিৎসকগণ ঐতিহাসিক ব্যক্তি হলেও তাঁদের উদ্ভব বা জন্ম-ইতিহাস নিয়েও গড়ে উঠেছে কিংবদন্তি। যেমন, গালব নামক এক ঋষি তীর্থভ্রমণকালে একবার ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হন, তখন এক কুমারী কন্যা তাঁকে জলপান করায়। তুষ্ট ঋষিও তাকে পুত্রবতী হবে বলে আশীর্বাদ করেন। তাতে অন্যান্য ঋষি দেখলেন, ঋষি-বাক্য মিথ্যা হবে এবং তিনি পাতকী হবেন। এ ভয়ে তাঁরা ওই কুমারীর কোলে কুশপুত্তলিকা দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে পুত্তলিকারূপী ধন্বন্তরীর মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘটিয়ে ঋষি-বাক্যকে সত্যে পরিণত করেন। জনশ্রুতি, এই পুত্তলিকার বংশে চার পুত্রের চার গোত্রে ধন্বন্তরী-চিকিৎসার বিকাশ ঘটে। মৌদগল্য, আঙ্গিরস, ভরদ্বাজ, শান্ডিল্য, বশিষ্ঠ, ব্যাৎস্য, সার্বণী প্রমুখ সেই বিভিন্ন গোত্রগ জগৎখ্যাত চিকিৎসকবৃন্দ। বেদমন্ত্রে প্রাণসঞ্চারের কারণেই কুশপুত্রগণ ও তাঁদের বংশ ‘বৈদ্য’ নামে অভিহিত হন। মধ্যযুগেও মাধব কর, চক্রপাণি দত্ত, গয়দাস, বৃন্দকুন্ড প্রমুখ অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন চিকিৎসক ছিলেন। বাংলাদেশের চিরকালের গর্ব তাঁরা। ঐতিহাসিক ব্যক্তি হলেও এঁদের নিয়ে বৈদ্য ক্ষমতার নানা কাহিনি সমাজে এখনো প্রচলিত। তাঁরা কিংবদন্তিরও সৃষ্টি এবং নিজেরাও কিংবদন্তি পুরুষ।

একইভাবে শুধু বৈদ্য নামেই নয়, অন্যান্য পেশাগত নাম ও গোত্র নামের সঙ্গেও নানা কাহিনি যুক্ত হতে দেখা যায়। এইভাবেই করণ বা করণিক (আক্ষরিক জ্ঞানসম্পন্ন খোদাইকারী, যারা পরে রাজকর আদায় ও রক্ষায় নিযুক্ত হতেন) কিংবা ‘কায়স্থ’ (রাজা-মহারাজার গা ঘেঁষে বা কায়া স্পর্শ করে বাঁদিকে দাঁড়িয়ে হিসাব বোঝাতেন বলে  এই নাম হয়) প্রভৃতিকে কেন্দ্র করেও কিংবদন্তি সৃষ্টি হয় বলে কথিত আছে। কুরুক্ষেত্রের লোকক্ষয় ও  পাপ-পুণ্যের হিসাবরক্ষার কারণে যমরাজার প্রার্থনার ফলে ব্রহ্মার কায়াজাত চিত্রগুপ্তের সৃষ্টি হলে তিনিই করণ-কায়স্থদের আদিপুরুষরূপে আবির্ভূত হন। সুতরাং দেখা যায়, স্থান-নাম, জ্ঞাতি-নাম বা জাতি-নাম প্রভৃতি সবই কিংবদন্তির অধীন। কিংবদন্তি এক আশ্চর্য গল্পগ্রন্থন।

যেভাবেই এসব কাহিনি সৃষ্টি হয়ে থাকুক, এর যৌক্তিকতার মূলে কিন্তু রয়েছে লোকবিশ্বাস। লোকমুখের ইচ্ছা-কথনের গল্পরূপই হচ্ছে এসব সৃষ্টি। মিথ এবং ফোকটেল দুয়ের ক্ষেত্রেই তা সাধারণ। গ্রিম এগুলিকে বলেছেন broken down myth অর্থাৎ নানা দেশে নানা রূপে ছড়ানো একই মৌল অতীত গল্পরূপের (archetype) কোনো না কোনো আদল বা অংশ-কাহিনি। অধিকাংশই লোকপুরাণের রোমান্টিক কাহিনির রূপান্তর এসব। তবু দুই এক নয়, অর্থাৎ সম্যক সৃষ্টি নয় এসব,  – গল্পসৃষ্টির নানা দ্বিপ্রকৃতিগ্রহণের কারণে এই ভিন্নতা। মনোবিজ্ঞানী ইয়ুংয়ের ভাষায়, ‘কালেকটিভ আনকনশাসনেস’-জাত এক প্রাক-আদর্শের রূপ, কোনো আর্কেটাইপ। এগুলি পরিণামে খন্ড খন্ড রূপ নিলেও এর মধ্যে ঐক্যের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো এর ইনডেক্স। সঠিক ইনডেক্স, অভিপ্রায়-তালিকা। অভিযান, জয়, কল্যাণ-অকল্যাণ, জাদু-টোনা, সাহায্যলাভ প্রভৃতি সেই মোটিফ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরি, দৈত্য বা রাক্ষস-জুজুর সাক্ষাৎ বা ভয় এবং তাদের বশ করার ব্যাপারটা থাকে,  যা রূপকথার ক্ষেত্রে খুব সাধারণ।  তবে ধর্ম ও  অলৌকিকতার ক্ষেত্রে কোথাও দেবদেবতার অঙ্গবিশেষ বা প্রতীক চিহ্নকেই ব্যবহার করা হয়। তেমনি কোথাও গাছপালা, দিঘি ও পাথরবিশেষ নিয়েও, বিশেষত কিংবদন্তিতে, মোটিফগুলো তীব্রতা লাভ করে। তবে তাত্ত্বিকতা বাদ দিয়ে শীলা বসাক ১০টি বিষয়কে স্থির করেছেন তাঁর বাংলার কিংবদন্তিতে। এছাড়াও তিনি কিছু বিবিধ (২৬টি) বিষয়ের কথা বলেছেন। তাঁর গ্রন্থটি দশটি প্রবন্ধ ও অতিরিক্ত ‘বিবিধ’ ভাগে মোট ৪০০-র অধিক কিংবদন্তির সাম্প্রতিক সংগ্রহ (নির্দেশিকায় ভুক্তি সংখ্যা ৪২৮)।  শ্রেণিকরণটি তাঁর নিজস্ব।

আগেই বলেছি গ্রন্থটি কিংবদন্তির বিশে�ষণ নয়, মোটিফ নির্ধারণেরও চেষ্টা নয়, এটি তাঁর অসাধারণ পরিশ্রমের ফলে দুই বাংলার গ্রামনগর থেকে সংগৃহীত কিংবদন্তিমালার একটি শ্রেণিবদ্ধ উলে�খপঞ্জি। তখন থেকে আমরা যেমন আঞ্চলিক তথ্যগুলি পাই, তেমনি পাই এর প্রকৃতি, ধরন ও লোকমনস্কতার ক্ষেত্রে লোকালয়গত প্রবণতাসমূহও। বাংলাদেশে আশরাফ সিদ্দিকী, খন্দকার রিয়াজুল হক প্রমুখ ছাড়াও হাবিবুল�� পাঠান, সরকার আবুল কালাম প্রমুখ পরবর্তী গবেষকগণও কিংবদন্তির সংগ্রহ এবং আলোচনায় যাঁরা এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের সংগ্রহ এত বিপুল নয়, ঋদ্ধও নয়। গ্রন্থখানি সেদিক থেকে তথ্যসংগ্রহ তথা মাঠ-কর্মের একটি আদর্শবিশেষ, এবং কিংবদন্তি-সন্ধানের ক্ষেত্রেও উৎস বা আকরতুল্য। গ্রন্থটির মূল্য সেদিক থেকে ঐতিহাসিক এবং দৃষ্টান্তমূলক।

তিন

শীলা বসাক লোকসাহিত্যের গবেষক, কিংবদন্তিকে লোকসাহিত্যের উপাদানরূপে বিবেচনা করেই তিনি তাঁর সংগ্রহের প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হয়েছেন।

অবশ্য কিংবদন্তি লোকসাহিত্যের কোন পর্যায়ে পড়ে, এটা খুব স্পষ্ট বা নিশ্চিত নয় – যেমন পূর্বসূরিদের আলোচনায়, তেমনি তাঁর মধ্যেও। ইতিহাসগর্ভ কথা বা ঐতিহাসিক কাহিনি – যেমন বিক্রমপুর-রামপাল নামের ইতিকথা, আধা কাহিনি আধা উপাখ্যান – যেমন, ‘মধুমালতীর উপাখ্যান’, লোকগীতের কাহিনি – যেমন আদম খাঁ বা মহীপালের গীত; প্রাচীন বৌদ্ধকৃষ্টিতে কুমিল��-সংকথন ও ময়নামতীর গীত প্রভৃতি; ঈশ্বর গুপ্ত-সংগৃহীত কুমিল্লার গোমতী-সম্পর্কিত লোক-তথ্য, ময়মনসিংহের কেল্লাতাজপুর-জঙ্গলবাড়ির কাহিনিসূত্র নিয়ে রচিত লোকগাথা, মসজিদকেন্দ্রী উপাখ্যান – যেমন নরসিংদী-শিবপুরের পথে কুমরাদির অলৌকিক মসজিদ নির্মাণের কথা বা  সাকির আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কসবা মসজিদের কাহিনি; বাউল-কথা – যেমন লালন-প্রসঙ্গী নানা কথা; খনা-সম্পর্কিত কথা; জ্যোতিষ্ক তথা চন্দ্র-তারা, বিশেষত শুকতারা, ধ্রুবতারা প্রভৃতি কেন্দ্রী মিথ ও রূপকথা; শিবকে কেন্দ্র করে শনির বলয়ের রূপ নিয়ে কথা, ইত্যাদি বিষয়ক লোকবিশ্বাস থেকে কিংবদন্তি কি আলাদা?

অবশ্য এর উত্তরও দ্বিবিধ। সুতরাং কিংবদন্তির সংজ্ঞা নির্ণয় এবং এ-জাতীয় যত কাহিনি তার সংগ্রহ, নির্বাচন, শ্রেণিকরণ বা বর্গীকরণ এবং তৌলজ আলোচনা বা বিশে�ষণ যে বাস্তবিক দুরূহ কর্ম, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। শীলা বসাক সমস্যাটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন মাত্র, তিনি বাস্তবে বা বস্ত্তগতভাবে যেটুকু পেয়েছেন তার পরিচয়ই প্রকাশ করেছেন বা উপস্থিত করেছেন, যেখানে সম্ভব হয়েছে সূত্র নির্দেশ করেছেন, করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর মাঠকর্মের দীক্ষা ও শ্রম এবং লোকজ্ঞান তাঁর নানা গবেষণার মধ্য দিয়েই আজ লোক-গবেষকগণের কাছে পরিজ্ঞাত।

তাঁর তথ্যসম্ভার ও সমীক্ষান্ত তথ্য-বিভাজন যা যথাকাহিনির যথাস্থানে উপস্থাপনের জ্ঞান ও কৌশল তাঁর অনুসৃত সনাতন রীতিকেও একটা মাহাত্ম্য দান করেছে। এখানেই তাঁর বৈশিষ্ট্য ও অন্যান্য গবেষকের পাশে তাঁর স্বাতন্ত্র্য। উলি�খিত প্রশ্নসমূহ যে আমাদের  মনে জেগেছে, এটাও তাঁরই কৃতিত্ব।

চার

কিংবদন্তি শুধু আবেগ বা কল্পনা এবং শ্রুতির কাহিনি নয়, জাতিতত্ত্ব বা বর্ণগোত্র-তত্ত্বেরও উৎস। গবেষিকার ভাষায় (পৃ ৩২৪) – ‘তা আমাদের পিছন ফিরে তাকাতে আপ্পুত করে’।

তা আধুনিক ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ হলেও সেখানে তার লালন ভিন্ন বা রহস্যময়। কিংবদন্তি ইতিহাসকে স্পর্শ করেই উঠে আসে, তবু তার প্রকাশ অনেক ক্ষেত্রেই গুপ্ত বা দুর্বোধ্য, প্রকাশে সে অবরুদ্ধ। নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিকগণের চেষ্টায় সে-রহস্যের উন্মোচন সম্ভব। এ জন্য কিংবদন্তি একটি মাল্টিডিসিপি�নারি স্টাডির বিষয়। তাকে লোকসাহিত্যের বিবর বা ঘেরাটোপে ফেলে রাখলে চলে না।  আন্তঃজ্ঞানতাত্ত্বিক বিশে�ষক সেখানে আবশ্যক। ধরা যাক, কিংবদন্তির কোনো টুকরো ঘটনা, কোনো ইঙ্গিতগর্ভ বা মোটিফ শব্দ কোনো লোককথা কিংবা প্রবাদাদির ভেতরে পাওয়া গেল, যেখানে তার পূর্বপ্রকাশ সংগুপ্ত।  তার আর্কেটাইপ রূপ ও বাস্তবচিত্রটি পুনর্গঠন করা লোকবিজ্ঞানীদের দায়িত্ব। সেখানে আলোচনা বা বিশে�ষণটি অবশ্যই হতে হবে প্রয়োজনীয় জ্ঞানসমূহের ভিত্তিমূলক। বাংলা ছড়ায় (সাধারণ বা খেলার ছড়ায়) এরূপ অনেক রহস্যাবৃত তথ্যশব্দ লক্ষ করা যায়। ‘আগডুম বাগডুম’ ছড়াটি যেমন। সেনাবাহিনীর অনীকরূপী অগ্রসেনা হিসেবে ডোম  (ডুম)-দের শৌর্যবীর্যের কথা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানাদি বা রাজ-উৎসবে তাদের বাদ্য পরিচালনে দক্ষতার কথা ছড়াটির মধ্যে উঁকি দিয়ে আছে। কর্নেগি অ্যাটাচিকসন বা স্যার এইচ ইলিয়ট প্রমুখ গবেষক বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। আবার এই ডোমরাই যে ড্রাম জাতীয় যুদ্ধবাদ্যযন্ত্রেরও বাদক-সৈনিক, তাও জানা গেছে। উলে�খ্য, ডোমদের বিশেষ শ্রেণি বা উপযোগীদের নাম ‘বাজানি’ বা ‘বাজুনিয়া’।

কোথাও কোথাও স্থাননামেও এর প্রতিরূপ পাওয়া যায়, যেমন – বাজুলি, বাজালিয়া প্রভৃতি। এদেরই এক গোষ্ঠী ‘বাগদী’ বা ‘লেট’ প্রভৃতি। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, এরাই মিশ্র ‘ভেডডি’ (ভেডড্ডি)।

সংকরদের মধ্যে এরা অন্ত্যজ। কিন্তু ‘কালুবীরে’র কিংবদন্তি কাহিনি জড়িয়ে আছে এদেরই আদিপুরুষ হিসেবে। শীলা বসাক উলি�খিত ড. ওয়াইজের (Dr Wise) মতেই এরা শিল্পমনস্ক হলেও ‘শ্মশান ডোম’ (মর্গের ডোম) হিসেবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এজন্য জীবন-ভাবনার দিক থেকেও তারা অনেকটা রূঢ় বা পাষাণ প্রকৃতির : ‘He is believed to have no human or kindly feelings’ তবে আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, দ্বাদশ শতকে বা পাল আমলের দিকে তাদের সাধন-ভজন প্রকৃতি ছিল খুবই উন্নত। কিংবদন্তির অন্ত্যজদের সামাজিক মূল্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই এই  গবেষণার উদ্দেশ্য। গ্রন্থশেষে এই মূল্যের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে, কিন্তু ব্যাখ্যায় আনা হয়নি।

নৃতাত্ত্বিক ও সমাজ-ইতিহাসবেত্তাদের ধারণার উন্নতি ও বিকাশের কারণে দেবদেবী-বিষয়ক ধারণার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে এবং কিংবদন্তির ব্যাখ্যা ও তার সম্প্রসার লক্ষ করা সম্ভব। সুন্দরবনের  বিস্তার একসময়ে হুগলি পর্যন্ত ছিল এবং ২৪ পরগনার ডায়মন্ডহারবার (লেখকের শৈশবকালীন অভিজ্ঞতা স্মরণে) প্রভৃতি স্থানে ‘বনবিবি’ ও তার এজেন্ট ‘যৌরনী’ এবং হুগলিতে ‘বনদেবতা’র থান লক্ষ করা যেত। হয়তো এখনো তা বর্তমান। পঞ্চাননতলা, ঠাকুর পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দের নামে এইসব থানের প্রতিষ্ঠা ঘটে থাকে। পঞ্চানন অর্থ শিব, কিন্তু পঞ্চানন্দের পরিচয় বা ব্যুৎপত্তি লভ্য নয়। বিগ্রহটিও শিবের নয়। এর অর্থ এটি অনার্যমূল। লোকসমাজে তা-ই ‘বাবাঠাকুর’।

সম্ভবত দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ভক্তদের বিস্তার ঘটলে আর্যপ্রভাবে শিবপুত্ররূপে এই বিগ্রহটিকেও পূজামন্ডপে রাখা হতো। আর্যীকরণের ধারায় পঞ্চানন্দরূপের পঞ্চাননরূপে উন্নয়ন ঘটে। তারাপদ সাঁতরা, মানিকলাল সিংহ তার বিগ্রহের বর্ণনাও দিয়েছেন। শিবপুত্র দুখেকে কোলে নিয়ে বনবিবির রূপ হয়েছে মনসা, শীতলা প্রভৃতি। পঞ্চাননের দেবস্থানে এরা সবাই অবশ্য লৌকিক দেবী। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পূজারিদের মূর্তিলাভ ও তদ্বারা মূর্তিপ্রতিষ্ঠা প্রভৃতি এরপর সাধারণ মোটিফ। শীলা বসাকে তার উদাহরণ আছে। কিন্তু রূপান্তরের উদাহরণ বা আলোচনা নেই তাঁর মধ্যে। উলে�খ্য, সাঁওতালদের মধ্যে পরেশনাথ ও মারাংবুরু সমকায়া হয়েছে এভাবেই। কিংবদন্তি থেকেই এভাবে ঘটেছে দেবযাত্রা, প্রতিষ্ঠা হয়েছে নাটমন্ডপের, এবং ভৈরব পঞ্চানন, অশ্বারূঢ় দ্বিভুজ পঞ্চানন প্রভৃতি নানা নামাচারের মধ্য দিয়ে ঘটেছে বিগ্রহের বৈচিত্র্য প্রতিষ্ঠা, সংস্কার ইত্যাদি। লোক-দেবতার উন্নয়ন তো কালেরই দাবি। সেখানে এখন যুক্ত হয়েছে দেবোত্তর সম্পত্তি, পূজাপাঠ ও ব্রাহ্মণের স্বস্ত্যয়ন। তথাপি লক্ষণীয় যে, পঞ্চানন থানের মাটি নিয়ে বাতব্যাধি থেকে যাবৎ রোগমুক্তি কামনা এখনো লোকবিশ্বাসের অন্তর্গত। এছাড়া ‘মঙ্গল’ রচনাও করেন কবিগণ (উদাহরণ দ্বিজ রঘুনন্দন-কৃত পঞ্চানন মঙ্গল কাব্য)।

এভাবে দেখা যায় বাইরে পরিবর্তন যতই ঘটুক, বা স্থানভেদে রূপভেদ যা-ই হোক, সব বিতর্কের মধ্যেও মূলসত্যটি থেকে যায়, তাই লোকবিদগণ লক্ষ করেছেন যে, ‘লোকদেবতার মৃত্যু নেই, – যতই ঘটনা ঘটুক, উপাচারে ও স্থানভেদে আচারাদিতে যতই অস্থিরতা থাকুক, অমিলও যদি থাকে তবু।’

কিংবদন্তির এ আরেক রহস্য!

পাঁচ

শুধু কিংবদন্তি কেন, সকল লোকসাহিত্য-প্রসঙ্গেই মারিয়া লিচের অভিধানগত সংজ্ঞায় আমাদের যেতে হয়। শীলা বসাকও উদ্ধৃত করেছেন একই সংজ্ঞা। কিন্তু জোর দিয়েছেন এই কথায় যে, ‘ইংরেজি লেজেন্ড শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কিংবদন্তি।’ তাঁর সংজ্ঞাটি হয়েছে এইরূপ –

ইতিহাস ও কল্পনার মিশ্রণে লৌকিক কথাসাহিত্যের রূপধারণকারী লোককাহিনীকে কিংবদন্তি বলা হয়।… পূর্বকালে সংগীত বা উপাখ্যান হিসেবে যে কাহিনীগুলো পরিচিত ছিল, পরবর্তীকালে তার সঙ্গে কিছু সংস্কার, লোকাচার, লোকবিশ্বাস, ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও স্থানের সঙ্গে জড়িত হয়ে যে মুখরোচক গালগল্পের সৃষ্টি করে তাকেই বলা হয় কিংবদন্তি। (পৃ ১৫)

এর অর্থ জনশ্রুতি, লোকাপবাদ, লোক-পরস্পরগত কথা-কাহিনি, লোকবিশ্বাস প্রায় সবই কিংবদন্তির নানা রূপ। এই কথারূপ ‘বায়চানা’ বা বিষয়রূপে আশ্রয় করে পাথর গাছ বন হ্রদ নদী মারামারি লাঠালাঠি যুদ্ধ, এমনকী প্রেম বা বিচ্ছেদ প্রভৃতিকে। যার মুখ থেকে প্রচার  ঘটে তার প্রাধান্য সেখানে গৌণ কিংবা শূন্য। তবে কল্পিত কোনো লোকের নাম যুক্ত হয়েও প্রচারিত হতে পারে। কাহিনির রূপান্তরও হতে পারে পঞ্চতন্ত্র – ঈশপের (ঈশা নবী?) গল্পে, বা সরিৎসাগর-বৃহৎকথা-আরব্যোপন্যাসের মতো করে কিংবা গিলগামেশ-ফালেভালে-রামায়ণ প্রভৃতির বীজ রূপে ও বিস্তৃতিতে গিয়ে। আসলে মূলরূপটিই হলো কিংবদন্তি, যা এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি, যার কাঠামো বিশে�ষণযোগ্য এবং লোকমুখেই যার জীবন। অলীক হয়েও তা অলীক নয়, বিতথ হলেও তা তথ্যহীন নয়, লোককথা হয়েও রূপকথা বা মিথ নয়; যদিও তা লোককথারই বিশেষ রূপ বটে। এরও নায়ক আছে, ঘটনার বিস্তার আছে, নাটকীয়তা আছে, অসম্ভবতার বাস্তবরূপের প্রকার আছে, তারও অধিক আছে জনপ্রিয়তা ও জনমূলে বিশ্বাস। এর গঠন সরল কিন্তু বিচিত্র, ঘটনাশ্রয়ী হয়েও ইতিহাসগত নয়। এর নায়ক অন্ত্যজ রঘুডাকাত বা কোনো ডোম থেকে উচ্চবংশীয় – যেমন ভাওয়াল সন্ন্যাস প্রমুখ – যে-কোনো চরিত্ররূপ নিয়ে যে-কোনো ঘটনার ও বিবরণের বিষয়ীভূত হতে পারে। এমনকি নায়ক হতে পারে প্রকৃতির যে-কোনো রূপ, দৃশ্য বা অবস্থাও – যেমন চন্দ্রাহত কোনো অতল দিঘি, মেঘনাবতী কোনো সুবিস্তৃত বা অকূল নদী,  বহুশাখি প্রাচীন বট, তেপান্তরের মাঠ, রহস্যযুক্ত পাথরখন্ড, কিংবা জ্বলজ্বলে কোনো তারাও। অর্থাৎ কিংবদন্তির বিষয়-বিস্তার অসীম ও আদিগন্তিক। নদীরঘাটে কাদায় আটকে পড়ে থাকা একপাটি নাগরাও হতভাগ্য এক নবাবের শেষ জীবনচিত্র হয়ে ফুটে ওঠে। এভাবে ইতিহাসের কত আলোছায়া কিংবা দীপালিমুখর কাহিনি প্রাকৃতিক আবেশমুগ্ধ জীবনখন্ড (যেমনটি দোষাদ-গাঙ্গো তাদের ভাহে-বিরল আরণ্যক জীবন-রচয়িতা বিভূতিভূষণ বা Extra realistic বা Supra-realistic বা আরণ্য জীবনচিত্রকার বুদ্ধদেব গুহের মধ্যে বা আফ্রিকার চিত্রে সোল বেলোর ‘শ্রাবণ রাজা’ অর্থাৎ ‘কিং অব রেইনে’ পাওয়া যায়, এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রের ক্ল্যাসিকধর্মী রচনা কপালকুন্ডলা থেকে আনন্দমঠে – বিচিত্র জ্যোৎস্নার মায়াময় কথাধারা হয়ে কিংবা শ্রীকান্তের (শরৎচন্দ্র) অমাবস্যায় অাঁধারের রূপ হয়ে ফুটে আছে; এর মাঝেই আছে কত ভবানী পাঠকের সংগ্রাম, কত বৈঁচি ফুল গাঁথার বাল্যপ্রেমের কথাও। তার কিছু আকর্ষণ করে স্মৃতি এবং সাধারণ জীবনের প্রতিভারূপে, কিছু বা অতিক্রম করে যায় প্রাতিস্বিকতাকে তার অন্যতর আবেদন নিয়ে। মানুষের ইতিহাসগত ও দৈনন্দিন এইসব কথাবৃত্তই আবার কখন ‘মাহাত্ম্য’-আশ্রয়ী হয়ে ওঠে; – পুরাণ ও দেবদেবীর বিশ্বাসে রূপ নেয় তখন সেসব।

ছয়

শ্রদ্ধা বা ভীতিকরতা এবং লোকমাত্রার ধর্মচিন্তা – এসবই আসলে কতক প্রক্রিয়ামাত্র। এভাবে দশানন্দেরও সৃষ্টি হয় আবার দশাননও দ্বিবাহু হয়ে ওঠে। ইতিহাসের যাত্রারম্ভে সুদূর প্রাচীনে কিংবদন্তির বাহুলগ্নতা তাই সাধারণ। আনন্দবাজার পত্রিকায় (নভেম্বর ১৯৭৬) মেদিনীপুরের আগুইবনী গ্রামে যে তাম্রায়ুধ সামগ্রী আবিষ্কৃত হয় কিংবা প্রায় সমকালে ওয়ারি-বটেশ্বরে (নরসিংদী, বাংলাদেশ), তা নিয়ে নানা কল্পনা-জল্পনা ও ইতিহাসের পুনর্গঠন-চিন্তা শুরু হয়েছে। এসব জায়গায় প্রাপ্ত আধভাঙা কুঠার (‘পরশু’ শব্দযোগে প্রাচীনতার এবং কিংবন্তির উষস-প্রাপ্ত লক্ষযোগ্য হয় বটে) এবং নানারকম শ্যাওলাধরা তাম্রবস্ত্ত ও মৃত্তিকাপাত্র এবং অন্যান্য শিল্পবস্ত্ত আরো কিছু এলাকায়ও (যেমন মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জেলাতে) দেখা গেছে। এসব থেকে সোনারগাঁ, সুবর্ণগ্রাম, সুবর্ণবীথি প্রভৃতির মতো (নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ) মেদিনীপুরের তামাজুরি গ্রাম নিয়েও নানা কথা শ্রুত হয় এবং সেখানেও নানা নিদর্শন পাওয়া যায়। এখন স্টুয়ার্ট পিগট এ থেকে ভিন্নমত দেন যে, আর্যরাই স্থান থেকে  স্থানান্তরে ঘুরে বেড়ানোর পর্যায়ে এসব বস্ত্ত বয়ে নিয়ে আসে। কারণ নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ছাড়া এসব বস্ত্তর আর কোনো নজির পাওয়া যায় না। অথচ বিশেষ স্থাননাম, দেবতার থানে অতীত কোনো জাতি (মুন্ডা আজীর গোপ প্রভৃতি এবং আর্যরা যাদের অন্ত্যজ করে রাখেন নিম্নবর্ণ হিসেবে) সম্বন্ধে নানা তথ্যের সন্ধান (যথা হো অ্যাগ্রিকালচারিস্টের বৈশিষ্ট্য) প্রভৃতি বিষয় ও রাঢ়ের দেওনদ (দেবনদ), শিলাই নদীতীরের অসুর গোষ্ঠী বা প্রাক-মুন্ডা জাতির আরণ্য জীবন ও কৃষিজীবনের মিশ্রণ (বিভূতিভূষণের আরণ্যকে যার সামান্য বিবরণ বুঝিবা লভ্য) এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মবৃত্তের রহস্যঘন লক্ষণ পুরাতত্ত্ববিদ ও লোকবিদদের এখনো বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলছে। আরণ্য জাতি থেকে তাম্রলিপ্তির পথে অরণ্যজাত পণ্যের কেনাবেচার (বিনিময় প্রথার) ঐতিহ্য ছিল সুপ্রাচীন। হাজারীবাগে দুধপানি পর্বতগাত্রে বণিক উদয়মানের উৎকীর্ণ শিলালিপির তথ্য এদিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্ববহ। আর্যগণ মুন্ডাদের আয়ুধসম্ভার (বাঁশের হোক, ধাতুর হোক – বিশেষত তাম্রায়ুধসমূহ) বিনষ্ট করলে নানা লোককথা ও ঐতিহ্যস্মারক পদ সৃষ্টি হয়। পূর্বোলি�খিত লোকগবেষক মানিকলাল সিংহের আলোচনায় দুটো চিলের প্রসঙ্গ দেখা যায়, এগুলো সিংবোঙ্গার প্রসঙ্গে সোনাদিদি (Golden vulture) ও রূপাদিদির (Silver vulture) কাহিনি। এগুলোকে শীলা বসাকের local legend তত্ত্বে আনলে অর্থতাৎপর্য ও ব্যবহারিক ঐশ্বর্য সীমিত হয়ে পড়ে। আসলে লেজেন্ডের কথা কিংবদন্তির একটা স্থানাতীত এলাকা বা legend area গড়ে ওঠে।

অতএব বোঝা যায়, কিংবদন্তিগুলি প্রাচীন সৃষ্টি, প্রাচীন মানুষের চিন্তার সঙ্গেই তার মিল। সুতরাং ভাবা অন্যায় নয় যে, প্রাচীন বা বহুতর প্রাচীন জনপদকেই ছুঁয়ে আছে এসব কাহিনি বা জীবনচিত্রসমূহ, – চিত্তে আমূলবিদ্ধ বিশ্বাসের উপকরণের রূপ নিয়ে। সমাজের আনুভূমিক ও আলম্বিক অবস্থানের বিশেষ সমানুপাতের হিসাবে ঘটনাদি কিংবদন্তির রূপ পায়। যে-জনগোষ্ঠী যত প্রাচীন, যত তার পুরনো ও সুস্থিত মূল্যবোধ, ‘তাদের মধ্যে লোকপুরাণের সন্ধান ততো বেশি পাওয়া যায়’ (শীলা বসাক, ওই, পৃ ১৫)।

গবেষিকার এই ধারণা এবং তাঁর মন্তব্য – বাঙালিসমাজ যথেষ্ট পুরনো নয়, ‘বাংলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসংখ্য লোকপুরাণ থাকলেও বাঙালি লোকসমাজের লোকপুরাণ অনেক কম।’ (ওই, পৃ ১৫) কথাগুলির ভিত্তি থাকলেও এখনকার গবেষকগণ তা সর্বৈব সত্য বলে মেনে নেবেন না।  বাংলাদেশের অতীত লোক-উপাখ্যানের সঙ্গে জড়িত সংস্কারাদিতেই এবং স্থান ও ব্যক্তিনামের মাহাত্ম্য জড়িয়ে তার নানা কাহিনিবিস্তারেই কিংবদন্তির জন্ম; ইতিহাসের বাইরেই (beyond) তার রূপ। শীলা বসাকের ভাষায়, ‘ইতিহাস যেখানে নীরব, কিংবদন্তি সেখানে মনোরম কাহিনি নিয়ে সরব হয়ে ওঠে। অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনার ক্ষীণসূত্র ধরে কিংবদন্তির যাত্রা শুরু।’ (ওই, পৃ ১৫-১৬) কিন্তু ‘(এ) কাহিনিকে লোকে বিশ্বাস করে। এটাই কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্য।’ (ওই, পৃ ১৬) গোড়ায় বৈদ্যদের কাহিনিতে এ-কথারই সাক্ষ্য পাওয়া যায়। যাই হোক এসব কাহিনি স্বতঃভ্রাম্যমাণ, তাই একই কাহিনি বিশ্বস্তভাবে বহু স্থানে শ্রুত হয়, সমবৈশিষ্ট্যিক ঘটনা বা দৃশ্যাদির আবির্ভাব ঘটলে বা মূল বিষয়টি সাধারণ হলে কাহিনিটিও তখন সাধারণই হয়ে পড়ে। লেখিকার সংগৃহীত তিনটি যোগাদ্যা দেবীর কাহিনিতেও (পৃ ৯১, ৯২, ১৭১) তার একটি প্রমাণ মেলে। তাই তিনি উলে�খ করেন, ‘একই কাহিনি নানা স্থানে নানা দেবীকে আশ্রয় করে ছড়িয়ে আছে।’ এমন আরো কাহিনি পাওয়া যায়, যেমন ‘দিঘি থেকে বাসন ওঠা’ (পৃ ৮৯, ২৫৪), জলাশয়কে কেন্দ্র করে অলৌকিক রহস্যবর্ণনার কথা (চট্টগ্রামের ‘বাইশ্যার ডোবা’, দিনাজপুরের ‘বানিয়া দিঘি’র কথা, পৃ ২৫৫; কুমিল��র ‘ রৈরাগ্য-বৈরাগিনীর দিঘি’ পৃ ২৫৪) প্রভৃতি এবং ‘এইভাবে Migrated হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে কমলারানিকে নিয়ে একই কিংবদন্তি শোনা যায়।’ (পৃ ২৫৫) শীলা বসাকের সংগ্রহে এইরূপ সমঘটনার ও সমতুল্য প্রাকৃতিকতার (ফেনোমেনা) উলে�খ তাঁর অভিজ্ঞতা এবং তত্ত্বীয় ধারণারই ফল। এ-গ্রন্থে তাঁর এ-কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। প্রতিটি শাখা (শ্রেণিভাগ) ক্ষেত্রে স্বল্পপরিসর হলেও সংশি�ষ্ট আলোচনা থাকায় সংগ্রহগুলি যেমন কেজো তেমনি আগ্রহোদ্দীপক হয়েছে। গ্রন্থের পাঠমূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে। গ্রন্থাকারের ভাষা সেখানে উপরি লাভ।

গ্রন্থটি লোকসাহিত্য-গবেষণায় নানাদিক থেকেই আলোচনাকে প্রসারিত করবে – উপাদানের সে বহুলতায় তা ঋদ্ধ।