অদ্ভুত ক্ষমতা, নমনীয় অহঙ্কার

আবুল মোমেন

সূর্যাস্তের বেশ কিছুক্ষণ পরও শ্রাবণের বর্ষণক্লান্ত ছিন্ন মেঘে আচ্ছন্ন গোধূলির ফিকে লালিমায় চারিদিক অলৌকিক আলোয় ভাসছে। তাতে চেনা মানুষটা অন্যতর ব্যঞ্জনায় অচেনা হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তাতে নাতাশার মনে কোনো খটকা লাগে না। বরং মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গান – অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে?

শহরের এক ধারের এই পাহাড়ের ঢালে সে আগেও এসেছে। কিন্তু জায়গাটা গোধূলির আলোয় একদম অচেনাই লাগছে আজ। তার মন অবশ্য অচেনা ভাবছে না, ভাবছে, বাহ্, এক্কেবারে আনকোরা নতুন তো!

রাহাত গাড়িতে সঙ্গে ছিল, কিন্তু পথে নেমে গেছে বন্ধুর অফিসে।

জরুরি কাজ আছে। অধ্যাপক ফিরোজ ওদের গুরুস্থানীয় ব্যক্তি। ওঁর পাঠচক্রে নিয়মিত যেতে যেতে ইদানীং ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে। পাঠচক্রের পরে ঘনিষ্ঠ কজনের আড্ডায় নাতাশা আর রাহাত প্রায়ই থেকে যায়। মাঝে মাঝে উনি চলে আসেন ওদের বাসায়। চমৎকার আড্ডা জমে। এরকমই এক আড্ডার পরে আজ ওরা বেরিয়ে পড়েছে।

অধ্যাপক ফিরোজের বয়স ষাট ছুঁইছুঁই, নাতাশার বত্রিশ। বিবাহিত জীবন ছয় বছরের, বাচ্চা নেওয়ার কথা ভাবছে ইদানীং।

অধ্যাপক ফিরোজকে ও পিতার মতোই জানে, তিনি চেন্নাই থেকে ওকে কন্যা সম্বোধন করে চিঠিও লিখেছেন গত বছর। বিপত্নীক নিঃসঙ্গ মানুষটার খোঁজখবর করার দায়িত্ব কখন ওদের হয়ে পড়েছে সেটা না রাহাত, না নাতাশা – কেউই সচেতনভাবে বুঝতে পারেনি।

প্রথমে নাতাশা ভেবেছিল মাঝে মাঝে গিয়ে ওঁর খাওয়া-দাওয়া, ওষুধপথ্যের ব্যাপার গুছিয়ে দেবে। বছর দশেক আগে স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে, একমাত্র ছেলে কানাডায় ভালো চাকরি করছে। বাবাকে নিতে চায়, কিন্তু উনি কেনই-বা ছাত্রছাত্রী গুণগ্রাহীদের জমজমাট আসর ছেড়ে দূরদেশে নির্বাসনে যাবেন। নির্বাসন শব্দটা ফিরোজ সাহেবেরই। রাহাত যখন বলেছিল, প্রবাসজীবন, তখন উনি স্বভাবের বাইরে গিয়ে অধৈর্য হয়ে এই শব্দটা প্রয়োগ করেছিলেন।

তিনি দেশ আর মানুষ অন্তপ্রাণ। নানা জেলায় পাঠচক্র গড়ে তুলেছেন। যুক্তি আর মননচর্চার মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে চান তিনি। রাহাত ততোটা নয়, কিন্তু নাতাশার মন থেকে-থেকে ওঁর স্বপ্নের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে।

ওর খুব ইচ্ছা অধ্যাপক ফিরোজের সাথে মফস্বলে যাবে, ওঁর কাজে লাগবে। কিন্তু রাহাতকে সঙ্গে পায় না, আবার ওঁর সঙ্গে একাই চলে যাওয়ার ইচ্ছাকে দ্বিধার খোলসমুক্ত করতে পারে না। কয়েকবার ওঁর বাসায় যাওয়া হয়েছে, বাসাটা একজন মানুষের জন্যে বেজায় বড়, তবে পৈতৃক বাড়ি বলে কথা। কিন্তু ওই বড়বাড়িতে একা মানুষটাকে নিঃসঙ্গ মনে হয়নি তার। এতো বিষয়ে ওঁর আগ্রহ, আর এতো বিচিত্র ধরনের মানুষের সাথে মিলে ব্যতিক্রমী সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এতোই খেপে থাকেন যে, তাঁর মধ্যে নির্জনতার কোনো ছোঁয়াচমাত্র নেই। মানুষটা সদাপ্রস্ত্তত, যাওয়ামাত্র কোনো একটি নতুন প্রসঙ্গ তুলে আলোচনা জুড়ে দেন। কখন তাতে মজে যায়, তা নাতাশা টেরই পায় না। তাঁকে খুব ভরাট পরিপূর্ণ মানুষ মনে হয় তার।

এই তো সেদিন চাইকোভস্কির ‘সোয়ান লেক’ শোনাতে শোনাতে পশ্চিমা অপেরা সংগীতের চুলচেরা বুঝিয়ে দিলেন তাকে। হবাগনারের কথা জানলো, নিৎশে কেন তাঁকে ক্র্যাংকি ডেকাডেন্ট আখ্যায়িত করেছেন, তাও বলেছেন। হবাগনারে বিখ্যাত ত্রিস্তান ইজোল্ড অপেরার গল্প শোনালেন।

মাঝে মাঝে নাতাশা ভাবে, ভাবতে বাধ্য হয়, এতোসব তথ্য, জ্ঞানগর্ভ কথা, আর এক আপনভোলা ভাবুকের পান্ডিত্য ও প্রজ্ঞার ভান্ডার যে তার সামনে খুলে যাচ্ছে তার কিছু কি নিজের সঞ্চয়ে জমা পড়ছে? ও বোঝে ওঁর সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করা নিরর্থক, তা হবে হাস্যকর। কিন্তু ওঁর সান্নিধ্য যে তার মধ্যে একটা সার্থকতার বোধ এনে দেয়, সেটা কেন কীভাবে ঘটছে তা নাতাশা বুঝতে পারে না। কিন্তু বোঝে তার ভেতরে থেকে থেকে বন্ধ কপাট খুলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। আর তাতে দিনযাপন তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে নাতাশার জন্যে।

নাতাশা এটাও বোঝে, সম্পর্কটা কেবল দায়িত্ব গ্রহণ আর পালনেই শেষ হয় না। কিংবা জানা-বোঝা-শেখার আনন্দটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা একটা বন্ধন, স্থায়ী সম্পর্ক। পরিচিত সামাজিক বন্ধন-সম্পর্কের চেনা চেহারায় এর ব্যাখ্যা মিলবে না। অসামাজিক বলা যাবে না, তবে সমাজাতীত বটে। এ তো আসলে সংসারকে ছাপানো, সমাজকেও। এ-বন্ধন মুক্তির, এ-সম্পর্ক ব্যাপ্তির। এর নতুনত্ব, এর সীমাহীনতা, এর গভীরতা এবং এর অক্ষয় ইতিবাচকতা তার জন্যে তৈরি করে প্রণোদনার অফুরন্ত ভান্ডার। নিশ্চয় চাপ পড়ে এতোকালের অভ্যস্ত গন্ডিগুলোর ওপর।

তাকে গন্ডি ভাঙতে হবে – নাতাশা বোঝে। সংসারেই সে বাস করে, সমাজেও থাকতে হবে, কিন্তু তার ঠিকানা ঠিক এখানেই গাঁথা নয়। নাতাশা এখন জানে, সনাতন পথ ধরে চলার উপায় নেই, গতানুগতিক পথ তার নিয়তি নয়। তার সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক – খুব স্পষ্ট নয় হয়তো এগুলো, কিন্তু সে বোধশক্তি দিয়ে ঠিকই বোঝে। বুঝেছে তাকে মানসিকভাবে আরো শক্ত, আরো প্রস্ত্তত থাকতে হবে।

দুই

তাই নাতাশার জীবনে অধ্যাপক ফিরোজের একটা বিশেষ স্থান তৈরি হয়েছে। রাহাত অন্তত অতোটুকু উদার, শ্রদ্ধেয় গুরুকে স্ত্রীর যে একটু সময় দিতে হবে সেটুকু সে বোঝে।

ফলে নাতাশার জন্যে গুরুর দেখভাল করায় মানসিক চাপ তেমন ছিল না। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনেও, সে ওঁর কাছে ছুটে এসেছে। আর সতেজ ও সমৃদ্ধ হয়ে ফিরে গেছে। এর মধ্যে একদিন সারাটা বিকেল পাঠচক্রে আর চক্র-পরবর্তী আড্ডায় সন্ধ্যাটা পার করে সে যখন হালকা মনে চপল পায়ে ঘরে ঢোকে তার মনে হয়, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও রাহাত যেন ঠিক মেজাজে নেই। কী গো, কী হলো – বলতে বলতে নাতাশা বিছানায় আধশোয়া রাহাতের কপালে হাত রাখে – শরীর খারাপ হয়নি তো? জ্বরটর ওঠেনি তো? উদ্বিগ্ন হয়ে সে প্রশ্ন করে।

না, রাহাত বিরক্তি প্রকাশ করেনি। ঝটকা মেরে স্ত্রীর কল্যাণী হাত সরিয়ে দেওয়ার মতো কান্ড বাধায়নি। একটা বড় শ্বাস ফেলে শুধু বলল – আমি স্নান করে আসি, তারপর বেরিয়ে চায়নিজে যাবো।

নাহ্, এর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। তবু, তবুও নাতাশার মন – হালকা সতেজ মনটা কেন যে ভারী হয়ে উঠল, কেনই-বা মিইয়ে এলো, সেটা ও বুঝতে পারল না।

– জন্মদিনে দেওয়া ধনেখালিটা পরলে না। ও বলেছিল – অকেশন বুঝে পরব। আজ সেই অকেশন, নাতাশা ভাবল।

রাহাত চমকালোও বটে। জড়িয়ে ধরে চুমোও খেলো। কিন্তু সেটা রাহাত যে উপভোগ করল তা মনে হলো না। মনের এই খটকাটার ঘুরপাকে থেকেই ও বেরোলো রাহাতের সঙ্গে।

দুদিন পরে আপনিই ওরা একটু হালকা হলো। বোঝা গেল, এমন কিছু ঘটেনি যাতে তারুণ্যের সহজাত ধর্মে ঘা লাগে – দেহে-মনে একে অপরকে ওরা কাছেই টেনেছে। দুজনের কেউই একে অন্যকে এ নিয়ে জেরা করেনি, উৎপাত বাধায়নি।

হয়েছিল কী, অফিসে লাঞ্চের টেবিলে এক বয়োজ্যেষ্ঠ কলিগ কারো প্রতি কোনো ইঙ্গিত না করে সমবয়সী একজনকে লক্ষ্য করে মন্তব্য করেছিলেন – ফিরোজ আমাদের বহুদিনের চেনা মানুষ, একটু মেয়েঘেঁষা পুরুষ বলে জানি। তরুণীদের আকৃষ্ট করার ক্ষমতা ওর ছাত্রজীবন থেকেই। এ-ই, আর কিছু নয়। কথাটা শুনে রাহাতের কান লাল হয়ে উঠেছিল। ধাক্কা লেগেছে মনে, মনটা বিস্বাদ বেজার হয়ে গিয়েছিল। বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী রফিক সাহেব ঠোঁটকাটা আর পরচর্চায় পারদর্শী হিসেবেই পরিচিত। ওঁর কথার অতো দাম দিতে নেই সে জানে। সব বুঝেও সেই থেকে একটা অদৃশ্য তীর তার মনে গেঁথে আছে, কিছুতেই যেন ছুটছে না।

সে-রাতে চায়নিজে যাওয়া, পরপর দুরাত দুজনে মিলে সিনেমা দেখা, ফিরোজ সাহেবের আড্ডায় দুজনে মিলে যাওয়া – সবই সে করেছে দাওয়াই হিসেবে। খটকার ক্ষতটাকে আর বাড়তে না দেওয়ার, বইতে না হওয়ার দাওয়াই। কষ্ট বইলেও সে বিষয়টা নাতাশাকে ভেঙে বলতে পারেনি। অনেকভাবে কথা সাজিয়ে দেখেছে কেমন নোংরা বিচ্ছিরি হয়ে যায়। তীরের খোঁচা তো তার একার লাগছে, এবং তা ঘটছে সবার অগোচরে মনের গহিনে। কিন্তু নোংরা তো দুজনের; নাহ্, তিনজনের গায়েই লাগবে। ওটা চলবে না। ফলে ভেতরে ভেতরে দুজনের মন বেশ কদিন ধরে পরস্পরের অজ্ঞাতসারে খটকায় আছে, অব্যক্ত ব্যথায় কাতরাচ্ছে এবং অশনাক্ত অনুচ্চারিত ক্ষতের বকেয়ার ভার বইছে।

মেয়েরা প্রতিরোধ গড়তে পারে, অবরোধের প্রাচীর তুলতে পারে, কষ্ট ভোগ করতে পারে। যে-কোনো ধরনের বন্দিদশা আর এই অনিশ্চিতি, অনির্দিষ্টতা এবং এই পরোক্ষ সংঘাত ছেলেরা বেশিক্ষণ সইতে পারে না। তুলনায় তারা প্রত্যক্ষ জীবনে অভ্যস্ত, আশু সমাধান চায় সমস্যার এবং সব প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে শেষ দেখে নিশ্চিন্ত হতে চায়। মেয়েরা এসব ক্ষেত্রে পরোক্ষ ও প্রতীক্ষাপ্রবণ।

রাহাত এতদিন দেখে এটুকু বোঝে, অধ্যাপক ফিরোজ কোনো বিপজ্জনক পুরুষ নন। নিঃসঙ্গ মানুষটার তরুণীর সঙ্গ যদি ভালো লাগে দোষ দেবে না সে।

তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল একদিন। দেখি না সন্ধ্যার মুখে ওদের দুজনকে নিরিবিলি পাহাড়ের ঢালে পাঠিয়ে দিই, ঘণ্টা দুয়েক থাকুক, কী ঘটে দেখি। তবে ও জানে ঘটা মানে অনেক কথা হবে। সে জানে, বলবেন একতরফা ফিরোজ সাহেবই, তাঁর এক মুগ্ধ শ্রোতাকে। তাই আয়োজনটা করে সে মাঝপথে নেমে পড়েছে বন্ধুর অফিসে জরুরি কাজের দোহাই দিয়ে।

 

তিন

শেষ গোধূলির লালিমা এখনো ঔজ্জ্বল্য হারায়নি। ঢালটা বাইতে গিয়ে নাতাশা একটু পিছিয়ে পড়েছে। হাত দশেক দূর থেকে একটু উচ্চতায় মানুষটা তার জন্যে দাঁড়িয়ে প্রসন্নমুখে অপেক্ষা করছেন। পাহাড়ি পটভূমির নির্জনতা আর আসন্ন সন্ধ্যার স্তব্ধতার প্রভাব মানুষ এড়াতে পারে না। ফেলতে পারে না শেষ-গোধূলির লালিমায় ভাস্বর অলৌকিকের আমন্ত্রণ। মন আপনিই আবিষ্ট হয় অপরূপা রহস্যময়ী প্রকৃতির এই আয়োজনে। মুগ্ধ মানুষ প্রকৃতিরই স্বজন হয়ে ওঠে, বন্ধনগুলো আপনিই খসে যায় – তাদের তুচ্ছতার কারণে।

মুক্তি? বাড়াবাড়ি হবে হয়তো, তবে ভারমুক্ত মনে হয় নিজেকে নাতাশার। এই প্রকৃতি, এই নির্জনতা, এই নৈঃশব্দ্য, এই লালিমা, এবং সামনে দাঁড়ানো স্মিত হাসিতে প্রসন্ন মানুষটা একাকার হয়ে একঝটকায় নাতাশাকেও টেনে নেয়। কেউই কোনোটার থেকে আলাদা নয়। সাহিত্যে সাবলিমিটির কথা জেনেছে। এ-ই কি সাবলাইম?

নাতাশা তা জানে না, আপাতত এ নিয়ে মাথা ঘামানোরও প্রয়োজন নেই।

বিদারিয়া

এ বক্ষপঞ্জর, টুটিয়া পাষাণবন্ধ

সংকীর্ণ প্রাচীর, আপনার নিরানন্দ

অন্ধ কারাগার –

কম্পিয়া, স্খলিয়া, বিকিরিয়া, বিচ্ছুরিয়া,

শিহরিয়া, সচকিয়া, আলোকে পুলকে,

প্রবাহিয়া চলে যাই সমস্ত ভূলোকে

প্রান্ত হতে প্রান্তভাগে, উত্তরে দক্ষিণে,

পুরবে পশ্চিমে; শৈবালে শাদ্বলে তৃণে

শাখায় বল্কলে পত্রে উঠি সরসিয়া

নিগূঢ়জীবনরসে …

ততক্ষণে নাতাশা পৌঁছে গেছে ওঁর কাছাকাছি। আবৃত্তি অব্যাহত রেখেই উনি ওকে কাছে টেনে নিলেন পিঠে হাত দিয়ে। এই প্রথম নাতাশা ওঁর হাতের ছোঁয়া পেল। না কোনো ঝাঁকুনি নয়, কোনো চমক নেই, একেবারেই স্বাভাবিক কাজটিই যেন হয়েছে। পাহাড়ের জারুল গাছটি যেমন প্রসন্ন ভাব নিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে, ফিরোজ সাহেব তারই সদোহর হয়ে প্রসারিতচিত্ত দাঁড়িয়ে আছেন। এই নির্জন প্রকৃতির মতোই মনটা সুপরিসর, উদাসী, আবার প্রসন্নও।

ভালোলাগার তৃপ্তি নিয়েই সে বুঁদ হয় আবৃত্তিতে –

হে সুন্দরী বসুন্ধরে, তোমা-পানে চেয়ে

কতবার প্রাণ মোর উঠিয়াছে গেয়ে

সবলে আঁকড়ি ধরি এ বক্ষের কাছে

সমুদ্র-মেখলা-পরা তব কটিদেশ,

প্রভাত রৌদ্রের মতো অনন্ত অশেষ

ব্যাপ্ত হয়ে দিকে দিকে অরণ্যে ভূধরে …

শেষের দিকে কথাগুলো ঝাপসা হয়ে আসে। কারণ নাতাশা এ-আবৃত্তি শুনতে শুনতে এক অদ্ভুত বোধে আক্রান্ত হয়। কী বলা যায় একে? এ তো ঠিক দৈনন্দিনের বাস্তব ঘটনা নয়, এ এক অবাস্তব অভিজ্ঞতা যা জীবনেই ঘটে। কাব্য করে বলা যায় ওর মধ্যে প্রাণ পাচ্ছিল অসীমতা, বিকশিত হচ্ছিল পৃথিবীময়তা, প্রস্ফুটিত হচ্ছিল আবহমানতা। তখন ও ঠিক পরিচিত প্রাত্যহিকের নাতাশা নয়, কাদের কন্যা, কার স্ত্রী, কার বোন, কী পাশ, কী কাজ করে – এসব অবান্তর তুচ্ছ তথ্যমাত্র, সত্য হলো সে এ-পৃথিবীর কন্যা। কবি উপন্যাসের বসনের অন্তিম সময়ের খেদোক্তির বিপরীতে নাতাশার মনে হয়, জীবন কত্তো বিশাল। তার মনে রবীন্দ্রনাথ গুঞ্জরিত হয়ে ওঠেন – বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!

বিহবল পুলকিত নাতাশা অধ্যাপক ফিরোজের ঘনিষ্ঠতা উপভোগ করে। ভালোলাগার বোধ সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। অধ্যাপক ফিরোজ পোড়খাওয়া অভিজ্ঞ মানুষ। ওর কাঁধে হাত রেখে বলেন – দ্যাখো নাতাশা, রবীন্দ্রনাথ ক্ষুদ্র ব্যক্তিকে বিশ্বের একজন হওয়ার আহবান জানিয়েছেন বরাবর। স্পর্ধাভরা এ-উচ্চারণ আমার মতো নিরীশ্বর মানুষেরও ভালো লেগে যায় – বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেই সাথে যোগ তোমার সাথে আমারও – বলে ওই দুটি লাইন তিনি গেয়ে শোনান।

সাধা নয় গলা, কিন্তু সুর আছে, আর ভাব দিয়ে খানিকটা দেবব্রত বিশ্বাসের ঢঙে গাওয়া গানটা তার ভালো লাগে। বায়না ধরে – স্যার, পুরোটা গাইতে হবে, ভীষণ শুনতে ইচ্ছে করছে।

ওরা সরে এসে বড় জারুল গাছটার গুঁড়িতে বসে, পাশাপাশি। এ-গান শুনতে শুনতে এর বিশ্বব্রহ্মান্ডের কথা, এর নিবেদনের ভাব ছাপিয়ে আনন্দের রোমাঞ্চ এসে নাতাশাকে শিহরিত করতে থাকে। নিজেকে স্যারের বুকে সঁপে দিয়ে আনন্দে আকুল রোমাঞ্চে ব্যাকুল, পুলকে অধীর, শিহরণে কম্পমান তরুণীটি দিশা পায় না কী করবে। অসময়ে অকারণে তার চোখে বান ডাকে। নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে নাতাশা। হতচকিত অধ্যাপক ফিরোজ ওকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন – কী হলো, হঠাৎ কেন মন খারাপ হলো তোমার। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলেন – মোবাইলটাও ফেলে এসেছি, কী করে রাহাতকে খবর দিই এখন!

ওকে চুপচাপ কাঁদতে দেখে উদ্বিগ্নও হন, তার চেয়ে বেশি হন বিব্রত। – আচ্ছা শরীর খারাপ লাগছে তোমার? দেখো, রাহাত এক্ষুনি এসে পড়বে। যেন ছোট একটি মেয়েকে তিনি ভোলাচ্ছেন।

না, নাতাশার এখন রাহাতের প্রয়োজন নেই। ঠিক কী প্রয়োজন, কাকে প্রয়োজন তা সে জানে না। তবে সে বোঝে নিজেকে এখন সামলে নিতে হবে। ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে রাহাতের আসার কথা, তার আর বেশি দেরি নেই। বিব্রত হাসি আর বিহবল চাউনি সামলাতে সামলাতে নাতাশা সোজা হয়ে বসে, হাতব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে হালকা চাপ দিয়ে মুখ-চোখ মোছে। তারপর উঠে দাঁড়ায় কিন্তু কোনো কথা খুঁজে পায় না। অথচ তার এই হঠাৎ খসে পড়া অভ্যস্ততার আবরণটা টেনে নেওয়ার জন্যে কথাই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর ঢাল। কিন্তু ওর ভেতরটা যে এখন মহাশূন্যের ব্যাপ্তি ও স্তব্ধতায় ভরে আছে। ওর যে নৈঃশব্দ্যই ভালো লাগছে এখন।

অধ্যাপক ফিরোজ ঢাল বেয়ে নামতে নামতে সন্ধ্যার ঘোলাটে আলোয় নাতাশাকে গাছ চেনাতে শুরু করলেন – ওই যে ঊর্ধ্বমুখী ডাল, বাঁয়ের একহারা গাছটা, ওটা দেবদারু, ডানের বিশাল থমথমে গাছটা কালো জাম, ওর পরেরটা ছাতিম। যাকে সংস্কৃতে বলে সপ্তপর্ণী। এক বৃন্তে সাধারণত সাতটি পাতা থাকে, তাই এ-নাম।

নাতাশা ওঁর দিকে ঘুরে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখাচোখি তাকিয়ে আচমকা বলে – জীবন অনেক অনেক বড় হতে পারে স্যার, অনেক বিশাল বিপুল, কিন্তু আমরা কেন খন্ডিত জীবনের বিচ্ছিন্ন ছোট্টগন্ডিতে বন্দি হয়ে থাকি? এটাই কি সংসার? সমাজ? সভ্যতা? প্রশ্নগুলো যেন নিস্তব্ধতাকে খানখান করে ছড়িয়ে পড়ে এই নির্জন উপত্যকায়।

অধ্যাপক ফিরোজ তাকালেন আকাশের দিকে। এ-প্রশ্নের চমক হজম করতে একটু সময় নিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মনকে রাঙিয়ে দিলো গাছের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া শুক্লাদ্বাদশীর চাঁদ। জ্যোৎস্না এখনো হালকা, রাত মাত্রই আসরে নামছে। প্রকৃতির সঙ্গ আরো নিবিড় আরো উপভোগ্য মনে হলো তাঁর। বললেন – এর উত্তর সংসারে পাবে না, সমাজেও নয়। সভ্যতা বড় ব্যাপার, এখানে টানবো না। আজ এখানে তুমি প্রতিদিনের সংসারের নাতাশা নও, তুমি চিরকালের নারী, শাশ্বত তরুণী, আবহমান প্রকৃতি। প্রতিদিনকে ছাপিয়ে আজ নিত্যদিনের জয়ধ্বনি তুমি।

যেন তিনিই বিজয়ী, অধ্যাপক ফিরোজের মুখে বিজয়ী-হাসি, শান্ত কিন্তু কৌতুকি কণ্ঠে বলেন – না, আমি তোমার স্ত্ততি গাইছি না, তোমাকে তোয়াজ করে ভোলাতে চাইছি না। আসলে কি জান, মানুষই পারে সংসার, সমাজ, এমনকি হয়তো সভ্যতার লিমিটকেও ছাড়িয়ে যেতে। এসবই এক-একটা মাপ, যার ভেতরে খাপ খাইয়ে চলতে বলি, বাধ্য করি আমরা মানুষকে। এক-একটা মানদন্ড খাড়া করি, বলি এটাই চূড়ান্ত, এটাই শীর্ষ। – তাই কি আসলে সত্য, মানুষই পারে ছাড়িয়ে যেতে –

গাড়ির হেডলাইট এসে পড়ে ওদের ওপর। রাস্তায় অপেক্ষা করছে রাহাত, গাড়িতে বসে, স্টিয়ারিং ধরে। বোঝা গেল ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়েছে।

গাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে নাতাশার মনে হলো একটা খুপরির ভেতরে বন্দি হচ্ছে ও। ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। বার্ষিক পরীক্ষার পরে মামাবাড়ি বেড়াতে গেলে দেখতো সন্ধ্যা হলে নানি ছানাপোনাসহ মুরগিকে ছোট খাঁচাঘরে বন্ধ করছেন। স্যারের কথা আচমকা মাঝপথে থেমে যাওয়ার আফসোস নিয়েই ও ফিরছে চেনা জগতে, সংসারের খাঁচায়। শরীরজুড়ে ওর বিস্বাদ হানা দেয়। জীবনানন্দের পঙ্ক্তি মনে পড়ল – গাড়িতে বসে বসে সে ভাবে, এ-জীবন ফড়িঙের নয়, মুরগির, বন্দি হওয়া আর জবাই হওয়ার জন্যে। বারবার বন্দিত্ব, বারবার জবাই।

 

চার

হঠাৎ করে বেড়ে ওঠা কিশোরীর গায়ে সব জামাকাপড়ই ছোট হয়, তার মনটাও ক্রমে আগের চেনা গন্ডির ক্ষুদ্রতা-তুচ্ছতা ছাপিয়ে ওঠে। তাকে অস্থিরতা ঠেলতে থাকে সামনে। সাহসী করে তোলে। সে মস্তবড় জগতে পা ফেলে। সেটা তার জন্যে নতুন, কিন্তু একেবারে অজানা নয়। এখন এই বত্রিশে নাতাশাকে যে অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে সেটার টানে কোথায় যাবে তা সে জানে না। কে-ই বা জানে!

তাই হয়তো ক-দিন ধরে তার মনে গুনগুন করছে একটিই কলি – ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি – মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই সে কথা যে যাই পাশরি। রাহাত দেখতে পায় নাতাশা দিনে দিনে কেমন উন্মনা হয়ে পড়ছে, একটু বা সুদূর, একটু উদাসী।

রাহাত ওর মতো করে চেষ্টা করে নাতাশার মন সংসারে দাম্পত্যে ফেরাতে, দূরত্ব ঘুচিয়ে ওকে নিবিড় করে পেতে। নাতাশাও সাড়া দিতে কুণ্ঠিত নয়। ফলে রাহাত যা যা করতে চায়, যা প্রস্তাব করে সব এক কথাতেই বিনা বাধায় পাশ। স্বাভাবিক জীবনের জন্যে দুজনেই সচেষ্ট। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততা! আকস্মিকতা, বেপরোয়ামি, অফুরন্ততা! নবীন দাম্পত্যের এ অনুষঙ্গ যে বাদ পড়ছে।

 

পাঁচ

রোদের মধ্যে মেঘের হানা চলতে-চলতেই রাহাতকে কিছু ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়তে হলো। সামাল দিতে গিয়ে অফিসে ব্যাংকে মক্কেলদের কাছে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে তাকে। সংসারে অনিশ্চয়তা, ওঠানামা আছেই। রাহাত আগেও কয়েকবার এমন ব্যস্ততায় কাটিয়েছে দিন, ঘরে ফিরেছে রাতে, কখনো অনেক রাতে। সকালে বেরিয়েছে তাড়াতাড়ি, নাতাশার কাঁধে সংসারের সব দায় চাপিয়ে।

ঠিক এই সময়ে, অধ্যাপক ফিরোজের পুত্র সিরাজ দেশে ফিরেছেন। অনেকদিন আসা হয়নি দেশে, সেটা একটা কারণ বটে, তবে মূল মিশন বাবাকে একবার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। ছেলেকে পেয়ে অধ্যাপক ফিরোজ বাসার নিয়মিত আড্ডা-পাঠচক্র কিন্তু বন্ধ করেননি। সবই আগের নিয়মে চলছে। নাতাশা পিতা-পুত্রের ঘরোয়া ব্যাপারে থাকতে চায়নি। তাই কদিন আসেনি। কিন্তু দুবার ফোন করে নাতাশাকে আনিয়েছেন অধ্যাপক ফিরোজ। তারপর থেকে নাতাশা কেবল যে আড্ডায় নিয়মিত হয়ে গেল তা নয়, একেবারে জমে গেল।

তার বয়েসি সিরাজের সাথে যত সে কথা বলেছে ততই অবাক হয়েছে এ-বয়সে তার জানা-বোঝার গভীরতার খোঁজ পেয়ে। এদেশে পড়াশোনা যেসব ফাঁকিবাজি সেটা বুঝে তার বড্ড রাগ হচ্ছে আজ। শ্রোতা হতে চায়নি সে সিরাজের, চেয়েছে সমান তালে আলাপ জুড়তে। আলাপের শুরুটা সেভাবেই হয় –

সিরাজের গল্প করলেও অনেক, রাহাতকে সঙ্গে আনতে পারেনি একবারও নাতাশা। মূলত রাহাতের ব্যবসায়িক ব্যস্ততাই কারণ, কিন্তু একটা অনাগ্রহ, ঔদাসীন্য কি নেই? বলবে বলবে করেও বলা হয়নি। শেষে দ্বিধা কাটিয়ে রাহাতকে বলে – স্যার আর সিরাজকে খেতে বললে হয় না! তাই হলো, এককথায় রাজি রাহাত। রাতে খুশি মনে আয়োজনে মন দিলো নাতাশা।

রাহাত সিরাজ উভয়েই বুদ্ধিমান তরুণ, তারা বন্ধুত্বের গভীর পথে না হেঁটে সৌজন্যের সরল পথেই হাঁটল। টুকটাক কথা, এটা-ওটা নিয়ে খুচরো আলাপ, প্রয়োজনীয় কিছু তথ্যবিনিময়, পছন্দের খেলা খেলোয়াড় খাবার নিয়ে হালকা আড্ডা, দু-একজন কমন পরিচিত বন্ধুজনের খোঁজখবর, পুরনো স্মৃতি ঘেঁটে একটু পরিহাস, রসিকতা – সবই চলল। নাতাশা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভাবল, যাক, ভালোই তো জমেছে।

ওদের বিদায় দিয়ে সব গুছিয়ে রাত করে যখন শুতে এলো নাতাশা তখনো রাহাত জেগে আছে। নাতাশা ইদানীং ওকে এতো রাতে ঘুমিয়ে পড়তেই দেখে আসছে। বলল – কী, স্যারের সাথে কফি খেলে, তাই ঘুম আসছে না?

ওর কথার জবাব না দিয়ে রাহাত বলল – সিরাজ তো বাবাকেও ছাড়িয়ে গেছে, রিয়াল বুদ্ধিজীবী। আমি কিন্তু ভীষণ চার্মড। বলে ওর দিকে চোখ মেলে তাকায়। কী যেন খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে ওর চেহারায়, চাউনিতে। একটু থতমত খায় নাতাশা। কথাটা সাদামাটা বটে, কিন্তু একটা টিপ্পনির রেশ যেন তাদের দুজনের মাঝখানে নিঃশব্দে বেজে চলেছে।

নাতাশা অস্বস্তিবোধ করে, এমন একটা সোজা সরল কথা তাকে অস্বস্তিতে ভোগায়। মনে হয় এটা খোলামেলা কথা নয়, খাপের মধ্যে ভরা। খাপে ঢাকা দ্বিধারি ড্যাগার। উত্তর দিলেই ফাঁদে পড়বে। কেটে বসবে পরের কথাটা! সায় দিলে ঈর্ষামিশ্রিত বাঁকা কথার করাত চালু হবে, আর যদি উড়িয়ে দেয় তো অবিশ্বাসের ধারালো পোঁচ পড়বে। না, ওরা প্রকাশ্যে ঝগড়া করবে না, গলা উঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে না রাহাত। নিঃশব্দে চলছে এই রক্তপাত। এ কোনো একতরফা ব্যাপার নয়, দুজনের ক্ষেত্রেই সত্য। ওরা দুজন আপসে যেন নিজের নিজের ওপর সূক্ষ্ম ছুরি চালাচ্ছে কিছুদিন ধরে, যা পরস্পরকেও কাটছে।

এটা থামানো মুশকিল। কোনো প্রত্যক্ষ বাস্তব প্রতিপক্ষ যে নেই! নাতাশা কি সিরাজের প্রেমে পড়েছে? না। নাতাশার সঙ্গে ফিরোজ সাহেবের কি অসম অবৈধ সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে? না। রাহাত কি নাতাশার অবহেলার পাত্র? না। নাতাশাকে কি রাহাত পরকীয়ার সন্দেহ করে? ঠিক তাও নয়। তাহলে?

কীভাবে যেন ওদের একান্ত জগৎটার সীমানাপ্রাচীর ভেঙে পড়েছে। ভেতর-বাহির একাকার হয়ে যাচ্ছে, আপনপর ভেদ গেছে ঘুচে। ওদের একান্ততা, ওদের নিবিড়তা, ওদের যৌথতা, ওদের স্বার্থপরতা, ওদের সার্থকতা, ওদের ব্যর্থতা, ওদের আদিমতা, ওদের বেআব্রুতা যেন আক্রান্ত, যেন বা লুণ্ঠিত, যেন কুণ্ঠিত, যেন বা লাঞ্ছিত, ধর্ষিত। এক অব্যক্ত অবমাননার বোধে রাহাত কাতরায়।

নাতাশা ভুগছে একই রকম; কিন্তু প্রাচীর সে-ই ভাঙতে চেয়েছে, অর্গল খুলতে চেয়েছে সে-ই তো। সে চেয়েছে বাইরের হাওয়া ঘরে এসে ঢুকে পড়ুক, ফিরোজ সাহেবের মতো বড়মাপের মানুষের মুক্তমনের নানা উপাচারে তারাও পুষ্ট হবে। তাই তো হচ্ছিল। এখনো হচ্ছে!

ছয়

এমন সময় একেবারে বজ্রপাত। ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন ফিরোজ সাহেব। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দাউদকান্দির কাছে সামনের চাকা পাংকচার হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁদের গাড়ি গিয়ে সোজাসুজি আঘাত করেছে পাশে দাঁড়ানো কাভার্ড ভ্যানে। ফিরোজ সাহেব গুরুতর আহত, সিরাজের আঘাত হালকা।

রাহাত আর আড্ডার কজন মিলে হাসপাতাল, ডাক্তার, এক্স-রে, সিটিস্ক্যান, নানান প্যাথলজি, স্পেশালিস্ট করে সপ্তাহখানেকে একরকম আশঙ্কামুক্ত স্থিতাবস্থা তৈরি করল।

এবার চিকিৎসার পাশাপাশি শুশ্রূষার পালা। কে এগিয়ে আসবে নাতাশা ছাড়া!

নাতাশা তার সীমানাহীন বিশালতায় অসহায় বোধ করলেও অজানা আনন্দে-গরিমায় আক্রান্তও হয়। ক্ষুদ্র সংসার যত বড় আকার ধারণ করে তাকে চেপে ধরতে চায় ততোই সে গোপনে সযত্নে আগলে রাখে তার গুপ্তধন – সীমানাহীন আপন গোপন বিশাল ভুবন। এটা ফিরোজ স্যারের উপহার। সে ভেবেছিল সীমা ডিঙানোর গল্পটা অফুরন্ত, এর প্রণেতা অফুরন্ত মানুষ। সে কি জানত না, জীবন একসময় ফুরিয়ে যায়, আয়ুর খাঁচায় বন্দি জীবন!

তার ভেতরে নানা ভাবনা তোলপাড় করে, ইচ্ছা দানা বাঁধে, সে তার নিজস্ব সত্তার অঙ্কুরোদ্গম টের পায়, তার ভেতরে এক স্বতন্ত্র জীবন প্রাণ পেতে থাকে। এটা বাস্তবের রক্তমাংসের মানবশিশু নয়। এ এক নবীন সত্তার উন্মোচন। আজ সে উদগ্রীব উন্মুখ উদ্বেল মানুষ।

কিন্তু একটা জলজ্যান্ত দুর্ঘটনা, মানুষের প্রাণ নিয়ে টানাটানি, দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া, সুচিকিৎসার ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় যোগাযোগ, দুষ্প্রাপ্য ওষুধ সংগ্রহ, দুর্লভ অতিব্যস্তত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে সময়মতো নিয়ে আসা – এসব কে সামলাতো রাহাত না থাকলে। ঘটনার আকস্মিকতা এবং দুর্ঘটনার ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় সে এমনিতেই ভীষণ মুষড়ে পড়েছে। রাহাতের নির্দেশে যন্ত্রের মতো কাজ করেছে। রাহাতই এ কদিনের কান্ডারি ছিল।

সাত

সপ্তাহখানেক পরে সবকিছু নিয়মে পড়ল। সিরাজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল, ফিরোজ সাহেব এখন শঙ্কামুক্ত, তবে দীর্ঘ চিকিৎসার প্রয়োজন পড়বে। হয়তো আরো সপ্তাহ-দুয়েক হাসপাতালেই কাটাতে হবে তাঁকে। সিরাজকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেওয়ার পর নিজের গাড়িতে পৌঁছে দিতে দিতে রাহাত বলল – খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। তার কথার অন্তরালে স্বস্তির সাথে একটা তৃপ্তির ভাব টের পায় নাতাশা। যদি তাই হয়, এতে দোষের কিছু নেই, কারণ নাতাশা তো জানে এদেশে গুরুতর অসুস্থ বা আহত রোগীকে বাঁচাতে হলে নিকটজন কাউকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করে যেতে হয়। কোথাও পরিচয়ের, কোথাও অর্থের, কোথাও নিয়মের, কোথাও রোগীর দোহাই দিয়ে কাজ আদায় করতে হয়। অন্তত এক্ষেত্রে, রাহাত এভাবে দায়িত্ব নিয়ে না দাঁড়ালে ফিরোজ সাহেবকে বাঁচানো মুশকিল হতো। নাতাশা নিজের দেশের হাসপাতালের অবস্থা খুব ভালো জানে। বাবার অকালমৃত্যু দিয়ে আরো ভালোভাবে জানে।

বাসায় ফিরে আরো ভালোভাবে টের পায় এ কদিনে রাহাত যেন হয়ে উঠেছে এক প্রাজ্ঞ প্রবীণ। দেদার ঝামেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের তৃপ্তিই তার মধ্যে একটা প্রশান্তি এনে দিয়েছে। তৃপ্ত প্রশান্ত মানুষটা এখন পূর্ণতা চায় জীবনে। এবং তার প্রত্যাশা অনুযায়ী পূর্ণতার বারতা নিয়েই যেন নাতাশার মর্নিং সিকনেসের লক্ষণও শুরু হয়েছে এ সময়েই। রাহাতের চাপাচাপিতে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা করা হলো, ফল পজিটিভ এলো। রাহাত নাতাশাকে না জানিয়ে চিকেন টিক্কা, পরোটা আর দহিবড়া নিয়ে এলো – সেলিব্রেট করবে।

নাতাশা বিব্রত বোধ করে বলে, বড্ড বাড়াবাড়ি করছো তুমি, তাছাড়া স্যারের এই দুঃসময়ে এসব নিয়ে আদিখ্যেতা ঠিক হচ্ছে না।

রাহাত ধুস্ বলে উড়িয়ে দেয় সব। বলে এ তো আমাদের দুজনের ব্যাপার। কাল মাকে নিয়ে আসব কদিনের জন্যে, তোমার একটু সাবধানে থাকতে হবে। এ সময়ে মুরুবিব কেউ থাকলে ভালো হয়। ওঁর পরামর্শ কাজে লাগবে।

খুবই যুক্তিযুক্ত কথা। না বলার কোনো কারণ নেই। নাতাশার শরীরও এ কদিনে যেন নতুনতর ব্যঞ্জনায় তার মনকে কেবল দোলাচলে রেখেছে। অদ্ভুত শিহরণ, অজানা বোধ, শরীরের ছন্দে পরিবর্তন, মাথা-মনে ঘোর ঘোর ভাব। শাশুড়ির কথা ধরে চলছে। রাহাতের বলিষ্ঠ শরীর, স্পষ্ট কথাবার্তায়, সে একটা নির্ভরতা পায়। রাহাত নাতাশাকে পেয়ে ভীষণ আনন্দিত। তার আনন্দের প্রকাশ ঘটছে কেনাকাটায়, মাকে রান্নার ফরমায়েশ দেওয়ায়, বাড়িতে বেশি বেশি সময় কাটানোর মধ্যে।

ফিরোজ স্যার হাসপাতালে, সিরাজ বাসায় একা। কাজের লোকটা আসে, সব করে দিয়ে যায়, তবু সৌজন্যের খাতিরে রাহাত সিরাজকে বলেছে অন্তত রাতে তাদের সাথে খেতে। তাই চলছে। সবাই একসঙ্গে খেতে বসছে রাতে। আগের মতোই গল্প আড্ডা হচ্ছে। তবে নাতাশার পরিবর্তনটা সিরাজের চোখ এড়ায় না। এড়ানোর কথাও নয়। ব্যাপারটা স্পষ্টতই ওকে ভাবায়। রাহাত অাঁচ করতে পারে সিরাজ নাতাশাকে নিয়ে ভাবছে, আগের মতো আড্ডায় না পেয়ে একটু দমে যাচ্ছে। বেশ মজা পায় তাতে ও। নিজেকে বিজয়ী মনে হয়, একেবারে নিশ্চিত বিজয়। স্বভাববশত এ-বিজয়বার্তা সে চেপেও রাখতে পারে না।

সিরাজকে জানায়, ফিরোজ স্যারকেও। ওরা দুজনেই বেজায় খুশি। সিরাজ বলে – বাবা বাড়ি ফিরুক, আমিই সেলিব্রেট করে পার্টি দেব, কারণ বাচ্চার জন্ম পর্যন্ত তো থাকা হবে না। কথায় কথায় সিরাজ তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় – ঠিক করেছি, এ-অবস্থায় বাবাকে দেশে রেখে যাব না, সঙ্গে করে নিয়ে যাব। তারপর দেখা যাক।

এ-খবরটা কেন যেন রাহাতের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়। তার বিজয় যেন পূর্ণতর হতে চলেছে। তবে বলতে ভুল করে না স্যারকে ওরা কতটা মিস করবে। জানাতে ভোলে না – সিরাজকেও তারা পরিবারের একজন মনে করে।

আট

স্যারকে হাসপাতাল থেকে ছাড়ার দিন ঘনিয়ে আসছে, মাসখানেক শাশুড়ির যত্নে নাতাশাও ভোরবেলাকার বমিভাব কাটিয়ে উঠেছে। একটা খুশি খুশি ভাব শরীরে-মনে ছড়িয়ে পড়েছে। আগের চাঞ্চল্য গিয়ে আলস্য-অবসাদের আমেজ শরীরকে মন্থর করে দিয়েছে। মনকেও ছুঁয়েছে আলস্য মন্থরতা। সবার আহ্লাদ তাকে ঘিরে, দুই বড় ননদ ঘুরে গেছে। অভিজ্ঞতা থেকে নানা উপদেশ দিয়ে গেছে। আহ্লাদও ছিল বটেই। হাসপাতালের তরতাজা খবর পাচ্ছে প্রতিদিন সিরাজের কাছ থেকে। রাহাত সময় করে যাচ্ছে, প্রতিদিন না পারলেও, দু-তিনদিনে অন্তত একবার।

সব ঠিক চলছে। স্যারকে ছেলের সাথে কানাডা যেতে রাজি করানো গেছে। সবাই স্বস্তিতে আছে, হয়তো মনের গভীরে স্যারের বিদেশ যাওয়া – অনিশ্চিতকালের জন্যে এতকালের অভ্যস্ত অভিভাবকত্ব হারানোর বেদনা – অন্তত নাতাশার মনে কাজ করছে। স্যার তো দেশ-অন্তপ্রাণ – সে জানে। নির্বাসনে একদম ভালো থাকবেন না স্যার – সে জানে। সে কাউকে বলতে পারে না, তার এই শরীরে এ বড্ড অসময় এমন প্রস্তাব পাড়ার জন্যে। তবু সে মনে মনে অস্বীকার করতে পারে না, স্যারের জন্যে সবচেয়ে ভালো বিকল্প হতে পারত একটু স্বাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে থাকা, আর পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর নিজের বাসায় ফিরে আগের জীবনে ফিরে যাওয়া। এমন একটা প্রস্তাব নিয়ে সম্ভব-অসম্ভবের দোলাচলে সে যখন কাবু তখন সব ভাবনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে একরকম ছুটতে ছুটতে স্যারের ছাত্র রতন এসে খবর দিলো – কাল রাতে স্যারের একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ভেন্টিলেটরে আছেন, জীবনমরণ শঙ্কার মধ্যে। খুব ভেঙে পড়ল নাতাশা। রাহাতও যেন হতভম্ব এবার। তবুও ছোটাছুটি শুরু করল আগের মতোই। একটু স্টেবল হলো বটে, কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটছে না, বাহাত্তর ঘণ্টা পরেও দেখা গেল অবস্থা বেশ সিরিয়াস।

দীর্ঘ দু-মাস হাসপাতালে চিকিৎসার পরে অবশেষে বাড়ি ফেরার মতো অবস্থায় এলেন অধ্যাপক ফিরোজ। ইতোমধ্যে বাবার সুস্থতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পরে মাসখানেক আগে কানাডা ফিরে গেছে সিরাজ। আর হ্যাঁ, নাতাশার ভাবনাই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়েছে। ফিরোজ সাহেব হাসপাতাল থেকে রাহাতের গাড়িতে তাদের বাড়িতেই এলেন। তাঁর জন্যে গেস্টরুমটা আগেই গুছিয়ে রেখেছিল নাতাশা আর তার শাশুড়ি। সত্যি বলতে কি শাশুড়ির কল্যাণেই এ-ব্যবস্থাটা বাস্তবায়িত হতে পেরেছে। তিনি বলেছেন, বুড়ো মানুষটা ভাঙা পাঁজর, কোমরের ব্যথা নিয়ে হার্ট অ্যাটাক থেকে সেরে কীভাবে একা থাকবেন? আর সিরাজ ছেলেমানুষ, ওর তো চাকরিও বাঁচাতে হবে। এখন তো প্রয়োজন অঢেল টাকা। সেটা এভাবেই সম্ভব।

এর আগে তিন-চারদিন ধরে রাহাত আর নাতাশার মধ্যে অনেক তর্ক হয়েছে, মান-অভিমান, রাগ-ক্ষোভ হয়েছে। রাহাত কিছুতেই ফিরোজ স্যারকে বাড়িতে রাখতে চাইছিল না। বারবার বলছিল –   প্রস্তাবটা অদ্ভুত। নাতাশা বলছিল – তুমি ভেতরে ভেতরে ওঁর প্রতি বিরূপ। একবার রেগে গিয়ে বলেছিল – ছিহ্ একজন মরণাপন্ন বয়স্ক মানুষকে হিংসা করতে লজ্জা করে না। রাহাত হাল না ছেড়ে বলল – তোমার যে ওঁর প্রতি পক্ষপাত। তুমি যে দুর্বল।

নাতাশা নারীর অন্য এক অন্তর্লীন শক্তিতে জেগে উঠে বলল – তা তো আছেই, তিনি গুরু, আমি শিষ্য, তিনি আমাদের পথপ্রদর্শক আমরা অনুসারী। অদ্ভুত বলছ তুমি আমার প্রস্তাবকে, অদ্ভুতই বটে তোমার কাছে, কারণ তুমি আমার জন্যে কেবল একটি কেন্দ্র, একটি বৃত্তই বরাদ্দ করেছো। মাকে দ্যাখো, তাঁর অদ্ভুত মনে হচ্ছে না। হ্যাঁ এ আমাদের – মানে নারীর – অদ্ভুত ক্ষমতা বটে।

আবার বহুদিন পরে, এক অজানা নারীর জাগরণ দেখতে দেখতে রাহাত বলে – কী সে অদ্ভুত ক্ষমতা?

ভালোবাসার। একটা নমনীয় অহঙ্কারী হাসি ফুটে ওঠে নাতাশার মুখে।

এ-কথার সোজা কোনো উত্তর রাহাতের জানা নেই। কিন্তু তার বেজায় রাগ হয়। রাগে সে প্রায় অন্ধ হয়ে ওঠে, বলে, এ কিছুতে হবে না। এই সাফ বলে দিলাম।

নাতাশা বলল – সাফ হলো কি তাতে সমস্যা? তোমার দৌড়ঝাঁপে পরিশ্রমে যে মানুষটা বেঁচে উঠলেন তিনি এই বিপদের দিনে কোথায় যাবেন? এটা কেমন রসিকতা হলো তাঁর সঙ্গে। এমন সময় শাশুড়ি এসে ঝগড়া থামালেন। ওঁর এক কথাতেই সব ঝড় থেমে গেল! রাহাতের উদ্যত ফণার ফোঁস ফোঁস থেমে গেল। মায়ের মধ্যে বরাবর সে এক দৃঢ়চেতা কল্যাণী জননীকেই পেয়েছে। তাঁর কথায় অকল্যাণ হওয়ার ভয় তার কেটে  গেল।

নয়

অধ্যাপক ফিরোজকে বাড়িতে এনে খাইয়ে-দাইয়ে ওষুধপথ্য দিয়ে পরিপাটি বিছানায় শুইয়ে যখন বেশ রাতে ওরা ঘরে এসে শুয়েছে তখন নাতাশাকে জড়িয়ে ধরে রাহাত বলল – সত্যিই তুমি বড় অদ্ভুত। ভালোবাসি কথাটা আমি শুধু তোমার ক্ষেত্রেই বলতে পারি। তুমি এভাবে কীভাবে বললে? নাতাশা নিজেকে না ছাড়িয়ে ওর বেষ্টনীতে বুঁদ হয়ে রহস্য করে বলল – এই সুরে কাছে দূরে জলেস্থলে বাজায় বাঁশি। তারপর ওর কানে কানে ফিসফিস করে সুরে বলল – ভালোবাসি ভালোবাসি।

তারপর চেহারায় সেই অহঙ্কারী ভঙ্গিটি ফিরিয়ে এনে বলল – হ্যাঁ, মেয়েরা বড় অদ্ভুত! তবে সব মেয়ে নয়, কেউ কেউ।