মা ও মেয়ে

মীনাক্ষী সেন

মা ক্রমাগত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন।

মেয়ের বাড়ি ফেরার সময় হলো, অথচ সে বাড়ি ফিরছে না। স্কুল ছুটি হয় চারটের সময়, পুলকার ঠিক করা থাকে, মেয়ে বাড়িতে এসে নামে ঠিক সাড়ে চারটের সময়। কোনোদিন, ক্বচিৎ হঠাৎ, চারটে পঁয়ত্রিশ কি চলি�শ হয়। তারচেয়ে দেরি মানে কোনো গোলমাল। হয়তো পুলকারটি স্কুলে পৌঁছাতে দেরি করেছে। কখনো কখনো এমন হয়। মা পুলকারের নম্বরটা খুঁজতে মোবাইলের সুইচে টিপ দিলেন। নম্বরটা স্ক্রিনে ফুটে উঠতেই মা আবার সুইচ টিপে ‘কল’ পাঠালেন পুলকারের চালককে।

– হ্যালো হামকিন/ পামকিন/ হ্যালো হানি বানি/ টোগো টোগো…

মোবাইল বেজে বেজে নিভে গেল। কেউ ধরলো না। মা আবার টিপলেন। আবার ‘হ্যালো হামকিন…’।

আবার ‘হ্যালো হাম…’।

পঞ্চমবারের বার সাড়া মিললো।

– বুঝলেন হেভি বৃষ্টি নেমেছে তো, রাস্তা জ্যাম। আমি এখনো ইস্কুলেই পৌঁছাতে পারিনি। আপনার মেয়েকে বলুন ওয়েট করতে।

– বৃষ্টি? কোথায় বৃষ্টি? এদিকে তো কোনো বৃষ্টি নেই। তুমি বৃষ্টি পেলে কোথায়? এখনো পৌঁছাতেই পারোনি। এখন তো পৌনে পাঁচটা বেজে গেলো –

কী বিপদ…

পুলকারচালক ততোক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে।

মা উতলা হলেন। নিজের ওপর নিজের রাগ হলো তার। মেয়ে সবসময়ই সঙ্গে একটা মোবাইল ফোন রাখতে চায়, তিনি দেন না। মেয়ে বলে – ‘স্কুলে সুইচ অফ’ করে সঙ্গে রাখবো, যাতায়াতের পথে হঠাৎ কোনো দরকার হলে -’।

তিনি ধমকে দেন মেয়েকে – ‘গাড়িতে যাচ্ছো, আসছো, মোবাইলের কী দরকার পড়বে?’ – এখন মনে হলো, মেয়ের কথাটা মেনে নিলেই হতো। মেয়ের বাবাও রাজি ছিলেন। তিনিই রাজি হননি। ক্লাস নাইনের মেয়ের হাতে মোবাইল দেওয়া মানে তাকে উচ্ছন্নে যাওয়ার পথ দেখানো – এই ছিল তার মত।

সে মত এক্ষুণি এই পুলকারের লেটের পৌঁছানোর কথা শুনে নিমেষে বদলে যাচ্ছিলো – মনে হচ্ছিলো মেয়ের কাছে একটা মোবাইল থাকলে কী ভালোই না হতো। তিনি এক্ষুণি জেনে নিতে পারতেন মেয়ে কোথায়, কী করছে। স্কুলের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকলে ওখানেই অপেক্ষা করতে বলতে পারতেন পুলকারের জন্য…

মেয়ের বাবা সব সময়েই বলে :

– তুমি বড্ডো ব্যাকডেটেড। সময়ের সঙ্গে তোমার মন চলে না।

এখন নিজেকে মায়ের ব্যাকডেটেডই মনে হলো।

– কেন আমি মোবাইল দিলাম না ওকে!

তিনি প্রায় কেঁদে ফেললেন ও দৌড়ে গিয়ে সদর দরজাটা খুলে দাঁড়ালেন। যেন দরজা খুললেই দেখতে পাবেন মেয়ে বাড়ি পৌঁছে গেছে। বাইরের লনে দেখা যাচ্ছে তার স্কুলের পোশাকপরা চেহারা। দরজা খুলতেই প্রথমে একদমকা ভিজে বাতাস এলো, তারপর বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি।

– ওহ্। তাহলে সত্যিই বৃষ্টি হচ্ছে। এদিকটায় দেরিতে এসে পৌঁছালো বৃষ্টি! কী যে সব হচ্ছে আজকাল। পাঁচ-সাত কিলোমিটারের মধ্যে একসঙ্গে বৃষ্টি না এসে কোথাও আগে আসছে বৃষ্টি, কোথাও পরে… যতো সব অলক্ষুনে কান্ডকারবার। ভাবতে ভাবতে মা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই লনে নেমে গেলেন। দরজাটা খুলে রেখেই।

লন ছাড়িয়ে, বাড়ির সদর গেট খুলে রাস্তা ধরে সোজা হাঁটা লাগালেন। রাস্তাটা একটা তেমাথার মোড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। তিনি মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে ডাইনে-বাঁয়ে তাকালেন, কাউকে দেখতে পেলেন না। না, এ-কথা ভুল। দেখলেন, একদল ছেলে রাস্তায় ভিজে ভিজে হুপ-হাপ শব্দ করতে করতে আনন্দে খেলছে, দুজন অল্পবয়স্ক ছেলে ভিজতে ভিজতে যার যার বাড়ি ঢুকে গেল। রাস্তায় আর জনপ্রাণী নেই। মেয়ে যে-রাস্তা দিয়ে আসতে পারে সেদিকেও কেউ নেই – উলটো দিকের রাস্তাতে খেলছে ছোটো ছোটো ছেলে। মা উদ্বিগ্নভাবে দুটি রাস্তা ধরেই অনেকখানি এগিয়ে গেলেন। আবার ফিরে এলেন। না, দুটো অটো তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল, কোনোটিতেই তার মেয়ে আসেনি। সে হেঁটে হেঁটেও ফেরেনি। মা একবার রওনা দিলেন তার মেয়ের এক বান্ধবী ঋতুপর্ণাদের বাড়ির দিকে। ঋতুপর্ণা তার মেয়ের সঙ্গে পুলকারে ফেরে। ঋতুপর্ণা হয়তো জানবে –

যেতে যেতেই ফিরে এলেন তিনি।

– নাহ্। মেয়ে যে এখনো বাড়ি ফেরেনি, এ-কথা কাউকে জানানোর দরকার নেই। নিশ্চয়ই ঋতুপর্ণা বাড়ি ফিরে এসেছে – নাহলে ওর মা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ফোন করতো।

মা ভাবলেন – ওহ্। মোবাইল বাড়ির টেবিলে, ল্যান্ডফোন, যদি ফোন করে। আমি তো রিসিভ করতে পারবো না, যদি রাস্তার কোনো বুথ থেকে ফোন করে!

ভাবতে না ভাবতেই মা দৌড়ালেন বাড়ির দিকে। ইতোমধ্যে তিনি ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছেন। সুসজ্জিত ড্রইংরুমের ঝকঝকে মেঝে জলে ভিজে নোংরা হয়ে উঠলো – তিনি খেয়াল করলেন না। দৌড়ে টি-টেবিলে রাখা মোবাইলটি হাতে তুলে নিলেন।

– নাহ্, কোনো মিসড কল আসেনি। ল্যান্ডফোনটিও অন্তত এখন বাজছে না।

মা সভয়ে লক্ষ করলেন, ঘড়িতে ইতিমধ্যে কখন যেন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে উঠলো তার। তিনি আবার এলোমেলোভাবে ছুটে গিয়ে পুলকারচালককে ফোন করলেন। এবার ফোনটা কোনো গান শোনানোর আগেই চালক সাড়া দিলো – না, আপনার মেয়ে তো স্কুলের বাইরে ছিলো না। বাকি দুজন ছিল। ঋতুপর্ণা আজ স্কুলে আসেনি। আপনাদের ওদিকে তাই আর যাইনি – তা ও বাড়ি ফেরেনি এখনো?

মা উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিলেন। কী করবেন, বুঝতে পারছেন না, কেমন পাগল পাগল লাগছে তার। শেষে মনে পড়লো মেয়ের বাবাকে।

ল্যান্ডফোন ডায়াল করার সময়টুকুও না নিয়ে তিনি মোবাইল টিপে মেয়ের বাবার কাছে ফোন করলেন।

ডায়াল টোনে গান বাজলো – ‘তুম আয়ি তো আয়ে বাহার/ গলি মে আজ চাঁদ নিকলা…।’ ফোন তুলে মেয়ের বাবা বললেন – বলো, কী দরকার?

– তোমার মেয়ে!

মায়ের গলা ধরে গেল। ওধারে কণ্ঠস্বরের নিশ্চিন্ত নির্লিপ্ততা মুহূর্তে উধাও।

– কী হয়েছে? কী?

– স্কুল থেকে এখনো বাড়ি ফেরেনি।

– ওহ্, এই কথা।

ওধারে গলা থেকে উদ্বেগ সরে গেল। এই তো পৌনে ছটা বাজে। সাড়ে চারটা-পাঁচটায় তো বাড়ি ফেরে। আজ হয়তো একটু ঘুরছে-ফিরছে, আইসক্রিম বা ফুসকা খাচ্ছে – রোজ রোজ তোমার বাঁধাগত রুটিনে কি মন সায় দেয়?

– তুমি কী বলছো? পাঁচটা কবে হয়? সাড়ে চারটের মধ্যে ফেরে রোজ গাড়িটা।

– হ্যাঁ। গাড়িটা।

হঠাৎ যেন মনে পড়ে যায় মেয়ের বাবার।

– গাড়িতেই তো ফেরে। ড্রাইভারকে ফোন করোনি?

– করিনি আবার, সেজন্যই তো এতো চিন্তা। বৃষ্টি, জ্যাম, গাড়ি তো গিয়ে সময়মতো পৌঁছায়নি। যখন পৌঁছেছে, তখন তোমার মেয়ে স্কুলের সামনে ছিলো না। বোধহয় দেরি দেখে একাই রওনা দিয়েছে বাড়ির দিকে।

– তাহলে ফিরবে। বৃষ্টি হচ্ছে বলছো, গাড়িঘোড়া পাচ্ছে না বোধহয়।

– তোমার মতো নিশ্চিন্ত পাবলিক যদি আমি হতে পারতাম। মায়ের ধৈর্যচ্যুতি হলো।

– কোনোদিন একা বাড়ি ফিরেছে তোমার মেয়ে স্কুল থেকে?

রাস্তাঘাট চেনে? এই বৃষ্টিবাদলে একা-একা কী করে বাড়ি ফিরবে? ফিরছে না তো! ছটা বাজে। মায়ের গলা কাঁপছে এখন।

– আহ্। এত আতুপুতু করে আগলে রেখেছো মেয়েকে না। এতো ভেবো না। আর আধঘণ্টার মধ্যে যদি বাড়ি না ফেরে জানিও। আমি চলে আসবো।

– আ-ধ ঘণ্টা।

এতো দুশ্চিন্তার মধ্যেও মায়ের রাগে মাথা জ্বলে উঠলো।

– এমন নির্বিকার লোকটা!

নিমেষে মা তার মা হওয়ার পরের সমস্ত দিনগুলোতে ঘুরে এলেন। মা নিজে ডাক্তার। তার বর ইঞ্জিনিয়ার। লোকটা কোম্পানি, অফিস, ট্যুর এসব নিয়ে ডুবে থাকে। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়, অনেক রাতে ফিরেও ল্যাপটপের সামনে। নাহলে আউট অফ স্টেশন যাচ্ছে। এই যাচ্ছে, এই আসছে, যেন সুকুমার রায়ের গেছোদাদা। হিসাব কষেও ধরা শক্ত লোকটা কখন কোথায় আছে। মাঝে মধ্যে বিদেশেও যায়। এহেন লোকের বউ হয়ে এসে ডাক্তারিটা আর করা হয়নি মায়ের, মেয়ের জন্মের আগে চাকরি করতেন – সেটা ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে বুকে আগলে বড় করেছেন। এখন লোকে সাধারণ জ্বরজ্বারির চিকিৎসা জিজ্ঞেস করলেও নার্ভাস হয়ে যান। মেয়ে আর সংসার ছাড়া অন্য কিচ্ছু তার মনে নেই। মাস গেলে যে-টাকা মেয়ের বাবা আনে, তা দিয়েই সুন্দরমতো সব ম্যানেজ করে নেন। মেয়ের দিকে সব সময় মনোযোগ দিতে পারছেন – এতেই তিনি সন্তুষ্ট।

নার্সারি-কেজি-প্রাইমারি থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত তিনি নিজেই মেয়েকে স্কুলে দিয়ে-নিয়ে এসেছেন। এই ক্লাস নাইনে উঠেই যত ভ্যাজাল। মেয়ে বড় হয়েছে। রোজ মা স্কুলে দেওয়া-নেওয়া করলে নাকি তার ‘প্রেস্টিজে লাগে’, ‘বন্ধুরা হাসে’ – বলে, ‘খুকুমণি তোমার নাক টিপি? দুদু বের হবে। এখনো তো দুদু খাওয়া খুকুমণি আছো কিনা তাই -’

এসব আসলেই কেউ বলে, না একটু স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য মেয়ে বানিয়ে বলে কে জানে; কিন্তু মেয়ে আর তার বাবা এমন জোট বাঁধলো যে রাজি হতে হলো মায়ের। সেই থেকে পুলকারে চারজন মিলে স্কুলে যায়-আসে। সেই জন্যই না আজ এই বিভ্রাট। ওদিকে বাপ এমন বাপ যে, তার কোনো উদ্বেগই নেই – মেয়ে সে স্কুলের সামনে নেই, বাড়িও ফেরেনি, তা জেনেও।

মা ঘড়ির দিকে চাইলেন। ছটা বাজে, এবার তার বুক ফেটে কান্না এলো। তিনি আবার দৌড়ে বের হলেন। আবার ঘরে ঢুকলেন। কী ভেবে কে জানে ল্যান্ডফোনের কাছে গিয়ে স্কুলের ল্যান্ডফোনে ফোন করলেন। ফোন বেজে গেল কর্কশ শব্দে। কেউ তুললো না। মা এবার ভেতরের ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে তার পার্স বের করলেন। পার্স ঠাসা রয়েছে নোটে।

আলমারি খোলাই রইলো চাবি লাগানো অবস্থায়। মা বাইরের ঘরে এসে এক টুকরো কাগজ আর কলম নিয়ে মেয়েকে লিখলেন।

– আমি বাইরে যাচ্ছি। তুমি বাড়ি ফিরে এলে বাইরে অপেক্ষা করো। না হয় ঋতুপর্ণার বাড়ি গিয়ে আমাকে ফোন করো।

মায়ের সংসারে সবকিছু গোছানো। প্যাড, কলম, আঠা। মা আঠা হাতে, ঘরের চাবি নিয়ে বাইরের দরজায়, যেখানে বৃষ্টির ছাঁট লাগার সম্ভাবনা কম, সেখানে চিঠিটি সাঁটলেন, আঠা দিয়ে তারপর দরজা লাগিয়ে পার্স হাতে দৌড়ে বের হলেন রাস্তায়।

দুই

মেয়েটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুলকারের অপেক্ষা করছিল। পুলকার আসার সময় পার হয়ে গেছে। এমন সময় পুলকারের বদলে বৃষ্টি এলো। মেয়েটা কোনো শেডের তলে না গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সঙ্গে দুজন মেয়ে, পুলকারের সঙ্গী, ডাক দিলো :

– আমরা গার্ড আঙ্কেলের ঘরে বসছি, তুইও আয়।

সে দুহাত ওপরে তুলে বললো,

– তোরা যা। আমি বৃষ্টিতে ভিজছি। মেয়েটার বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে নাচতে ইচ্ছে হচ্ছিল। স্বাধীন, মুক্ত আর একা হতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।

– মাম্মি আমাকে একটুও ফ্রিডম দেয় না।

সে বৃষ্টিকে বললো। বৃষ্টিঝরানো আকাশকে বললো।

– সবাই বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যায়। সাইবার ক্যাফেতে চ্যাট করতে যায়। আমি যেখানে যাই সঙ্গে মা। টিউশনে, মার্কেটে, রেস্তোরাঁতেও, আর স্কুলের জন্য এই পুলকার! আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই – ফ্রিডমই নেই।

মেয়েটা বাতাসকে বললো। যে-বাতাস শনশন করে বইছিলো আর বৃষ্টির ছাঁট বয়ে এনে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো শরীর।

এমন সময় বিশাল আকাশি নীল গাড়িটা মেয়েটার সামনে এসে দাঁড়ালো। ড্রাইভারের সিট থেকে বাইরে মুখ বাড়িয়ে লাল টুকটুকে একটা ছেলে, গায়ের গেঞ্জিটা সবুজ, বললো – হাই বেব, লিফট চাই?

মেয়েটা চট করে রেগে গেল।

– আমি বেব নই। বেব কাকে বলছো?

– ওক্কে! ওক্কে।

ছেলেটা মাথাটা বাইরে রেখেই বললো।

– ওকে গার্ল। লিফট নেবে?

– না। আমার গাড়ি আসবে।

মেয়েটা বেশ জোর গলাতেই বললো। যদিও তার গলায় দোনামোনা ভাব ফুটে উঠলো।

– গাড়ি আজ আর আসবে না। যে জোর শাওয়ার হচ্ছে তোমাদের ওদিকে – একবুক জল জমে গেছে ওধারে।

– তাই – তুমি দেখেছো? তবে তুমিইবা কী করে যাবে ওদিকে?

– আমার গাড়ি আকাশ দিয়েও উড়তে পারে। জলেও সাঁতার কাটে, চরে দেখো না। ছেলেটা ডাক দিলো। মেয়েটা চারদিকে তাকালো। পুলকারের জন্য অপেক্ষমাণ মেয়ে দুজন গার্ডের ঘরে, তাদের দেখা যাচ্ছে না। অন্য মেয়েরা, এমনকি টিচাররাও যে যার ঘরে ফিরে গেছে। একটু আগেও এখানে ভিড়, জটলা ছিলো, এখন সব ফাঁকা, সুনসান। বৃষ্টি আরো ঝেঁপে এসেছে। চারদিক বৃষ্টির তোড়ে ঝাপসা, অদৃশ্য। তার মনে হলো, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে আর কেউ নেই – কেবল সে আছে আর ওই হালকা নীল গাড়ি আর সবুজ গেঞ্জি গায়ে লাল টকটকে ছেলেটা। তার মাথায় ঘোর লেগে গেলো।

তবু সে আচ্ছন্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো – তুমি আমাকে ঠিক ঠিক বাড়ি পৌঁছে দেবে তো?

– না হলে কোথায় নিয়ে যাবো? তুমি যদি আমার সঙ্গে ইলোপ করতে চাও তো ভেবে দেখি। লেট মি থিংক ওভার ইট –

মেয়েটা ‘ইলোপ’ শব্দের মানেটা ঠিক ঠিক না বুঝেও আচ্ছন্নতা ভেঙে ঝাঁপিয়ে উঠলো।

– বাকোয়াস করছো কেন? যাও, চলে যাও। থিংক করতে হবে না।

– আরে গুসসা হলে কেন? চলে আসো। ছেলেটি বৃষ্টির মধ্যেই দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমেই ভিজে চুপসে গেল।

– আরে তুমি কেন ভিজছো?

মেয়েটা ব্যস্ত হলো। তার গলা নরম হলো।

– ইটস কুল বেব। ডোন্ট ওরি। কাম অন।

– ই-ই-ই, বেব! মেয়েটা মুখ ভ্যাঙালো। তুমি জানো আমি কোথায়?

– কেন আমি জানবো না। কতদিন গেছি তোমার পুলকারের পেছনে পেছনে –

মেয়েটার বুকের রক্ত ছল-ছল-ছলাৎ করে উঠলো। মনে পড়ছে বটে। এই গাড়িটাই তো। মাঝে মাঝেই তাদের পুলকারের পেছন পেছন আসে। তারা চার বন্ধু এ নিয়ে হাসাহাসিও করে। গাড়িটা তাদের পাড়ার মোড়ে এসে চলে যায়। আর ঢোকে না। সে ঋতুপর্ণাকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে বলে – তোর জন্য আসে। বিউটিকুইন ঋতুপর্ণা। ঋতু তাকে চিমচি কেটে বলে – না; তোর জন্য, বুঝলি! তুই যা প্রিটি।

তাহলে ছেলেটা তার জন্যই আসে? ঋতুর জন্য নয় তাহলে। সে তো কখনো একা হয় না, ফাঁকা হয় না, তাই ছেলেটা কিছু বলতেও পারে না তাকে বোধহয়।

– আজ পুলকার কাকুর লেট আর বৃষ্টি ওকে সুযোগ দিয়েছে, কথা বলার। তাহলে মায়ের এতো নজরদারির পরও সে একজন বয়ফ্রেন্ড পেতে চলেছে – আর অন্তত একদিন পুলকারে বা মায়ের সঙ্গে না ফিরে সে একা একা বাড়ি ফিরতে পারবে –

মেয়েটা ছেলেটার খুলে দেওয়া দরজা দিয়ে গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসলো। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

 

তিন

মা রাস্তায় বেরিয়ে স্কুলের দিকে যে-রাস্তাটি যায় সেটি ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটতে থাকলেন। রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ দু-চারজন পথচারীর দেখা মেলে। বড় রাস্তায় পৌঁছে দেখলেন কম হলেও গাড়ি চলছে। রাস্তায় ইতোমধ্যেই অল্পস্বল্প জল জমে গেছে। গাড়িগুলো জল ছিটিয়ে, ঢেউ তুলে দিয়ে হুশ-হুশ করে চলে যাচ্ছে।

– ভিজছেন কেন দিদি? অটো চাই?

মায়ের পাশে হুশ করে একটা অটো থামলো। মা যেন মেঘ না চাইতেই জল পেলেন। উঠে বসলেন অটোতে। তারপর মেয়ের স্কুলের দিকে চললেন। স্কুলে পৌঁছে দেখলেন স্কুলের সদর গেটে মস্ত-মস্ত তালা। ধারেকাছে কেউ কোথাও নেই। মা তখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তাটির বদলে উলটো রাস্তায় চলতে বললেন অটোকে। এ-রাস্তা তার কিছুদূর দেখা হয়ে গেছে আগেই। অন্য  রাস্তাটাও দেখতে হবে।

– এতো বৃষ্টি-তুফান। আমাকে পুষিয়ে দেবেন কিন্তু।

– হ্যাঁ হ্যাঁ দেবো। তুমি চলো, তবে আস্তে যাবে।

– এত বৃষ্টি। জল জমেছে। স্পিড নেবো কী করে?

অটোচালক বললো। মা চারদিকে তাকাতে তাকাতে চললেন। নাহ্, কোথাও মেয়ের কোনো চিহ্ন নেই। পুরো রাস্তাটার দুদিক দেখতে দেখতে মা গাড়ি ঘোরালেন মেয়ের স্কুলের দিকে। এখনো স্কুল অনেকদূর। মেয়ে যদি কোনো যানবাহন না পেয়ে হেঁটেও ফেরার চেষ্টা করে, এ-রাস্তা সে ধরবে না। এ-রাস্তা সে চেনে না। অটো বা পুলকার কোনো কিছুই এতো ঘুরপথে তাদের বাড়ির এলাকায় যায় না। তবু মা ওই রাস্তা ধরেই চারদিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছিলেন – যদি হঠাৎ দেখতে পান – লম্বা বিনুনি ঝুলছে পিঠে, মোটা কালো সর্পিল বেণি। মায়ের নিজের হাতে বাঁধা। লম্বা চুল এখনকার ফ্যাশন – মা অনেক অনেক যত্নে মেয়ের অমন চুল বানিয়েছেন।

কী যেন ভাবছিলেন মা।

হ্যাঁ, মোটা, কালো বিনুনি ঝুলছে পিঠে। সাদা ব��উজ, থ্রি কোয়ার্টার, সবুজ-মেরুন-কালো ডোরা কাটা টিউনিক, পিঠে ব্যাগ, কালো শু, তার মেয়ে, কী মিষ্টি হয়েছে দেখতে – না, না থু – ওয়াক থু, আমি মা, এমন বলতে নেই, মা ভাবছিলেন হয়তো দেখতে পাবেন তার মেয়েকে – এই রাস্তায়।

কিন্তু না, কেউ নেই। একসময় স্কুলের সামনে এলো অটো। না, কেউ নেই। বৃষ্টি তার গভীরতা বাড়াচ্ছে – অবিশ্রাম বৃষ্টির আর বাতাসের সগর্জন শব্দ। মা এবার বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন। যে-পথ দিয়ে তার মেয়ে নিত্যদিন পুলকারে করে ঘরে ফেরে, এ-পথ মেয়ের চেনা। নিশ্চয়ই এ-পথে কোথাও মেয়েকে পেয়ে যাবেন – মা আশায় বুক বাঁধলেন।

কী বৃষ্টিই না পড়ছে। সৃষ্টি বুঝি আজ রসাতলে যাবে। চারদিক ঝাপসা, অস্পষ্ট নিভে আসা আলো, পথে-ঘাটে পথচারী কেন,  কাক-কুকুরও এখন আর চোখে পড়ে না। কেবল কিছু যানবাহন জলে ঢেউ তুলে সরসর শব্দে যাতায়াত করছে।

মা প্রায় বাড়ির কাছে এসে পৌঁছলেন ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো করে বেঁচে আছে তার আশা – হয়তো দেখতে পাবেন মেয়ে ফিরেছে। বসে আছে বন্ধ দরজার সামনে।

বাড়ির গলিতে ঢোকার মুখে মা দেখলেন মস্ত একখানা নীল গাড়ি চারদিকে জল ছিটিয়ে দ্রুত চলে গেল। সেই বেগে জল লাফিয়ে উঠলো অনেকখানি। অটোতেও ছিটকে উঠে জল মাকে ভিজিয়ে দিলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত। রাগ ও বিরক্তিতে শিউরে উঠেও মা চুপ করে রইলেন। মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা তার কথা বন্ধ করে দিয়েছিল।

– কখনো একা ছাড়িনি ওকে। আজ এই বৃষ্টিবাদলে কী করে সে একা একা বাড়ি চিনে ঘরে ফিরবে? মা ভয় পেতে পেতে ভাবলেন – বাড়ি ফিরে যদি দেখেন মেয়ে ফেরেনি বাড়িতে তবে তিনি কী করবেন এরপর? মায়ের মাথায় আর কোনো ভাবনা এলো না। মনে হলো, বাড়ি পৌঁছে যদি দেখেন মেয়ে বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নেই। তবে পৃথিবীই থেমে যাবে, বলার বা করার মতো আর কিছু থাকবে না। মেয়ে কিন্তু বাড়ির দরজায় বসেছিলো। মা তাকে দেখতে পেলেন অটো বাড়ির গলিতে ঢুকে একটু বাড়ির দিকে এগোতেই। বাড়ির সিঁড়িতে বসেছিলো তার মেয়ে, স্কুল ব্যাগটা একটু দূরে পড়ে আছে পায়ের কাছাকাছি। যেন কেউ ছুড়ে ফেলেছে ব্যাগটা ওখানে। মেয়েটা ভিজে চুপসে কেমন ন্যাতার মতো হয়ে রয়েছে। গায়ের রং, একটু দূর থেকে দেখাচ্ছে যেন প্রাণহীন ফ্যাটফেটে সাদা।

মা – ‘থামাও অটো’ বলে অটো থামতে না থামতেই লাফিয়ে নামলেন অটো থেকে।

– অনেক ঘুরেছি, কিছু বেশি দেবেন, এই ঝড়জলে অটোটারও বারোটা বেজেছে। ফিরতে পারবো, না ইঞ্জিন বসে যাবে কে জানে –

অটোচালকের কথা শেষ হওয়ার আগেই মা ব্যাগ হাতড়ে পাঁচশো টাকার একটা নোট পেলেন, সেটা অটোআলার হাতে গুঁজে দিয়ে বাড়ির হাঁ করে খোলা গেট পেরিয়ে বাড়ির দরজার দিকে দৌড় লাগালেরন।

– কতো রাখবো?

মা অটোচালকের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দৌড়ে গেলেন। অটোচালক খুশি হয়ে অটো স্টার্ট দিলো ঘর্র শব্দে। মা দৌড়ে মেয়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন – ডাক দিলেন

– মা মণি!

বুকের একেবারে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মায়ের এই ডাক কিন্তু মেয়ের নতচোখ তখন মাটির দিকে, মেয়ে চোখ তুললো না।

– মাম্!

মা কাঁপতে কাঁপতে আবার ডাক দিয়ে মেয়ের সামনে উবু হাঁটু হয়ে বসে পড়ে দুহাতে তার কাঁধ আঁকড়ে ধরে ডাক দিলেন – মাম্ – মামণি…

মা দেখলেন মেয়ে ভিজে ন্যাতা। গলায় টাই নেই, পিঠের বেণির চুল অর্ধেক খোলা এলোমেলো, আর মেয়ে চুপ, বাক্যহারা।

মায়ের হঠাৎ প্রচন্ড শীত করে উঠলো। ঠকঠক করে কেঁপে উঠলেন তিনি। কাঁপতে কাঁপতেই আপনা-আপনিই চিৎকার বেরিয়ে আসছিল তার গলা চিরে – কী হয়েছে তোর?

কিন্তু হঠাৎ প্রবল আত্মসংযমে নিজেকে বাঁধলেন মা। গলা থেকে উঠে আসা চিৎকার আটকাতে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। দাঁত বসে রক্ত এলো ঠোঁটে। মা তার চিৎকারের সঙ্গে যে ব্যথাও গিলে নিয়ে একেবারে নরম, নিচু গলায় বললেন,

– দাঁড়া, দরজা খুলছি, ঘরে চল।

প্রবল বৃষ্টি, সব দরজা-জানালা বন্ধ, সমস্ত প্রতিবেশীর ঘরে, তবু মা চারদিকে তীব্র সন্ধানী সার্চলাইট দৃষ্টি ফেললেন।

– না; কোথাও কোনো জানালা খোলা নেই। মা নির্ভুল চাবিতে দরজা খুলে ফেললেন যখন মেয়ে তখনো একইভাবে বসে। মা কোনো কথা না বলে প্রথমে মেয়ের বইয়ের ব্যাগ ঘরে ছুড়ে ফেললেন – তারপর মেয়েকে দুই কাঁধ ধরে নিজের বুকের আশ্রয়ে টেনে তুলে সামনের দিকে ফিরিয়ে ঘরে ঢোকালেন। মেয়ে যখন পা টেনে টেনে, ঠেলে ঠেলে হাঁটছে মা দেখলেন তার পায়ে জুতো নেই, কেবল মোজা।

মেয়ে হেঁটে হেঁটেই ঘরে ঢুকলো, যদিও মা তাকে শক্ত করে ধরেছিলেন – আর মেয়েটি হাঁটছিলো শক্তিহীন, দুর্বল ল্যাগবেগে পায়ে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে।

মা তাকে জলে ভেজা শরীরেই সোফায় বসিয়ে দিলেন। তারপর দৌড়ে গিয়ে দরজার লক বন্ধ করে, ছিটকিনি তুলে মেয়ের কাছে ফিরে এলেন। বসলেন তার পায়ের কাছে, জড়িয়ে ধরলেন মেয়ের ভিজে হাঁটু দুটি। কাতর উদ্বেগে অদ্ভুত ভয় পাওয়া গলায় বললেন – বল, কী হয়েছে, বল আমাকে। বল রাক্ষুসী, হতচ্ছারি, বজ্জাত মেয়ে, বল আমাকে, হয়েছেটা কী? এতক্ষণ ছিলি কোথায়? কোত্থেকে এলি? কী সর্বনাশ করে এলি?

মায়ের তিরস্কার আর প্রশ্নে বুঝি মেয়ের কানে মায়ের চেনা স্বর বেজে উঠলো। মেয়ে যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠলো দুঃস্বপ্ন ভেঙে এমন গলায় বললো – মা, আমি কিচ্ছু করিনি মা। আমার কোনো দোষ নেই। আমি বুঝতে পারিনি…।

মা আঁতকে উঠলেন। মেয়ে তখনো বলে চলেছিলো,

– নীল গাড়ি নিয়ে এসে ছেলেটা বললো লিফট দেবে, পৌঁছে দেবে বাড়ি, পুলকার কাকু লেট করছিলো, আমি গাড়িতে উঠেছিলাম মা – বুঝতে পারিনি…।

মেয়ে এটুকু বলে থমকে গেল মায়ের মুখের দিকে চেয়ে। কী অদ্ভুত হতাশা ভরা চোখে মা তার দিকে চেয়ে রয়েছেন। কী যেন রয়েছে ওই চোখে, এমনিতেই ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েটি আরো ভয় পেয়ে চুপ করে গেল। মা আসলে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। যে মেয়েকে আগলে রাখাই তার জীবনের ব্রত – তার কোনো অঘটন ঘটবে কী করে। বিয়ের পরপর তিনি তার ডাক্তারি আর ক্যারিয়ার, মেয়ের বাবা তার মাল্টিন্যাশনালের ক্যারিয়ার নিয়ে দিবারাত্তির ব্যস্ত। বছর পাঁচেক পরে, হঠাৎ মায়েরই খেয়াল হলো পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে, কোনো জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না নিয়েও তারা তখনো নিঃসন্তান।

– এটা খুব খারাপ সিম্পটম।

মা খেয়াল করে বরকে খেয়াল করিয়েছিলেন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। পাঁচ বছর নানা চিকিৎসার পর মেয়ে এলো পেটে। তাও জন্মালো প্রিম্যাচিউর বেবি হয়ে। মেয়ের জন্ম পর্যন্ত সব চিন্তা-দুশ্চিন্তার ভাগিদার ছিলেন মেয়ের বাবা। প্রিম্যাচিউর মেয়ের বেঁচে থাকা নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত তিনি মেয়ে-বউয়ের পাশে ছিলেন। সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পর ক্যারিয়ার তাকে ডেকে নিলো কিন্তু মা আর ডাক্তারিতে ফিরে গেলেন না।

এই মেয়ে, বিয়ের দশ বছর পরে জন্মানো মেয়ে তার ধ্যানজ্ঞান হলো। তাকে নাওয়ানো, খাওয়ানো, অসুখে শুশ্রূষা, খেলায় সঙ্গী, হাঁটার সময় আঙুল ধরা, তারপর পড়াশোনা করানো, জীবনকে চেনানো… সব করেছেন মা, ডাক্তারি ভুলে, ক্যারিয়ারের স্বপ্নকে কবর দিয়ে শুধু মেয়েকে বড় করেছেন।

আজ, তার সেই সর্বস্ব ছেড়ে দেওয়া দিনরাতের সাধনা ওই নীল গাড়ি চালানো একটা ছেলে এক নিমেষে নষ্ট করে দেবে তা কী করে হয়? তা হতেই পারে না!

মেয়ে চুপ করে গিয়েছিলো। মা খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে যেন ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠে মেয়েকে ডাক দিলেন – চল, স্নান করে নে। তখন প্রায় স্বাভাবিক মায়ের গলার স্বর। মেয়ে তবু বললো – মা, একটু শোনো।

– না। কিচ্ছু শোনার দরকার নেই। তুই স্নানে চল। মা মেয়ের হাত ধরে তুললেন, সোফা ভিজে উঠেছে, মেঝে দুজনের শরীরের জলে থইথই। মা বললেন, সাবধানে আয়, পা টিপে টিপে, বলে মেয়ের হাত ধরে তাকে বাথরুমে নিয়ে গেলেন। ঝকঝকে শুকনো টাইলস বসানো বাথরুম। মা গিজার অন করে বাথরুমের আয়নার থেকে পেছন ফিরিয়ে এক উঁচু প��স্টিকের টুলে মেয়েকে বসালেন। তারপর প্রথমে মোজা, তারপর টিউনিক, তারপর টেপজামা একে একে যা-যা পড়নে ছিলো, সব খুলে ফেললেন মেয়ের শরীর থেকে। মেয়ে পোশাক খোলাতে মায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করলো – বাকি সময় বসে রইলো নিষ্ক্রিয়। তার নিরাবরণ দেহ শীতে শিউরে উঠলেও সে শব্দমাত্র করলো না।

মা নির্ণিমেষে চেয়ে রইলেন। এই এতোটুকু, ছোট্ট একটা বারবি পুতুলের মতো ক্ষীণ, রুগ্ণ হয়ে জন্মানো মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে। তার চোখের সামনে বড় হয়েছে। তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মায়ের চেনা – এই ছোট্ট, সুন্দর, কোমল স্তন দুটি ওঠার সময়ের ব্যথা, ভয় দুশ্চিন্তা – যা কিছু ছিলো মেয়ের সব জানতেন, সব কথা মেয়ে তাকে বলতো। কী সুন্দর, নরম, পাতলা ত্বক তার মেয়ের শরীরে – কী কোমল গোধূলি আলোর মতো গায়ের রং, তাই বোধহয় সামান্য একটা অাঁচড়ও কি স্পষ্ট করে দেখা যায়, কি প্রকট হয়ে চেয়ে থাকে। এই মেয়ে তার গর্ভজাত। এই মেয়ের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার সৃষ্টি। মা সাবান হাতে তুলে নিলেন। গিজার খুলে গরম জলের তাপমান অনুমান করে জল ঢাললেন মেয়ের মাথায়, জল গড়িয়ে নামলো সারা শরীরে, মা সাবান ঘষতে লাগলেন সারা শরীরে। ঠিক ছোট্টবেলার মামণিকে বাথটাবে বসিয়ে যেভাবে স্নান করাতেন সেভাবে স্নান করাতে লাগলেন মেয়েকে। সাবান ঘষে ঘষে। শরীরের গোপন ও স্পর্শকাতর সমস্ত অঙ্গে ঘুরে বেড়ালো মায়ের হাত। সাবান ঘষে ঘষে সর্বত্র পরিষ্কার করে অপর্যাপ্ত জল ঢালতে ঢালতে মা বললেন – নে, সব ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলাম। তুই ঝরঝরে পরিষ্কার হয়ে গেলি। নোংরা লেগেছিলো তোর শরীরে, পরিষ্কার করে দিলাম। ব্যথা-বেদনা আর যা-যা বিপদ ভয় আছে, আমি ডাক্তার, ওষুধ দেবো, সব সেরে যাবে। তুই একেবারে ঠিকঠাক আগের মতো হয়ে যাবি। তুই কেবল মনে রাখিস – কিচ্ছু ঘটেনি, কেউ তোকে গাড়িতে তোলেনি, কোনো নীল গাড়ি তোর স্কুলের সামনে দাঁড়ায়নি। পুলকার কাকু যায়নি বলে আমি গিয়ে তোকে স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছি। বুঝেছিস? বুঝেছিস তো? মা মগ মগ জল ঢেলে মেয়েকে পরিষ্কার করতে করতে বলেন – এই দ্যাখ, স্নান করলি, সব ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আর তো কিচ্ছু নেই। আর যা বলে, লোকে বাড়িয়ে বলে, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলে, আমাদের মেয়েদের ভয় দেখাতে বলে… কেবল শরীরের ওপর আমাদের মনকে আটকে রাখতে বলে। শরীর কিছু নয়। মন-ই সব।

– এই দ্যাখ, সব ঠিক হয়ে গেল। তুই পরিষ্কার, সাফসুতরো হয়ে গেলি। এখন মন থেকে পেছনের এক-দেড় ঘণ্টার কথা মুছে ফেলে দে। মেয়েকে শুকনো তোয়ালেতে জড়িয়ে মা ঘরে নিলেন, তাকে রাত পোশাক পরিয়ে দিলেন। চুল শুকিয়ে দিলেন হেয়ার ড্রায়ারে, তারপর দুটো বালিশ এনে শুইয়ে দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে গরম দুধ নিয়ে এলেন – খেয়ে নে; দাঁড়া, দুটো ওষুধ দিচ্ছি।

মেয়েকে প্রথম ওষুধটা খাইয়ে বললেন,

– নে, আর ব্যথা-বেদনা নেই, ঘুম থেকে উঠে দেখবি, ঝরঝরে হয়ে গেছে শরীর।

তারপর আরেকটা ওষুধ খাইয়ে বললেন

– আর কোনো ভয় নেই এখন। তুই ঘুমালে একটু মলম লাগিয়ে দেবো শরীরের এখানে-ওখানে। সব ঠিক হয়ে যাবে। কেবল তোর বিশ্বাস করতে হবে যে, কিচ্ছু হয়নি, কিছুই ঘটেনি। কেবল তুই বৃষ্টি ভিজে চুপড়ি হয়ে বাড়ি এসেছিস, তারপর একগ��স গরম দুধ খেয়ে ফের চাঙা। দাঁড়া তোর জন্য আরেক গ��স গরম দুধ নিয়ে আসি, সঙ্গে কোকো দেবো তো?

– কিন্তু মা, ওই ছেলেটা, খুব বদমাস মা…

মেয়েটা স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় ডুবে গেল। ছেলেটা তার মনের সদ্য জেড়ে ওঠা কোমল অনুভূতিতে যে নির্দয়, নিষ্ঠুর, স্থূল আঘাত হেনেছে সেখানে তো কোনো শুশ্রূষাই পৌঁছায়নি তখনো। মেয়েটি তাই বললো,

– ওকে শক্ত শাস্তি দেওয়া দরকার মা।

– ওকে শাস্তি দিতে গিয়ে তোমাকে আরো অনেক অনেক কঠিন শাস্তি পেতে আমি দেবো না। যা বলছি শোনো, এখন আর একটু গরম দুধ খেয়ে ঘুমাও।

মা উঠে কিচেনে গিয়ে আবার দুধ গরম করে আনলেন। বেশ খানিকটা চিনি আর কোকো মিশিয়ে এনে দেখলেন মেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে – তার চোখ দুটো খোলা –

– নে, দুধটা খেয়ে নে। না, উঠিস না, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

মা তার চোদ্দো বছরের মেয়েকে দুধ খাইয়ে দিতে লাগলেন গ��স ধরে।

– নে ঘুমিয়ে পড়। ঘুম থেকে উঠে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। শরীরে কোনো কষ্ট নেই। মনেই বা কী থাকবে – কিচ্ছু হয়নি, কিছুই তো হয়নি, তাই না?

মায়ের ঝুঁকে আসা চোখের দিকে তাকিয়ে মেয়ে হঠাৎ চমকে ওঠে। কী এক মর্মান্তিক যন্ত্রণার অভিব্যক্তি মায়ের চোখে। কিছু যদি হয়নি তবে মায়ের চোখ দুটিতে কেন এমন মর্মান্তিক যন্ত্রণা?

– মা, মা, কী ভেবেছ তুমি? মা? তেমন কিছু কিন্তু হয়নি মা, মানে সেই রকম কিছু…

– হ্যাঁ, এই তো ঠিক বলছো। হয়নি। তেমন কিছুই হয়নি। কিচ্ছু হয়নি। এখন ঘুমিয়ে পড়ো মামণি। ঘুম থেকে উঠেই দেখবে সব আবার আগের মতো হয়ে গেছে।

মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর জন্য ছোট্টবেলার মতো ঘুমপাড়ানি গান গাইছিলেন মা। অনেকদিন পরে ডাক্তারিবিদ্যা প্রয়োগ করে মা মেয়ের শরীর-মনের সব যন্ত্রণা সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করছিলেন। তার হাতের আঙুল চলছিলো মেয়ের চুলের ভেতর। গুনগুন করে গান করছিলেন তিনি, ঘুমপাড়ানি গান।

– চন্দা হ্যাঁয় তু, মেরে সুরজ হ্যাঁয় তু।

ও মেরি আঁ খোকা তারা হ্যাঁয় তু।

মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে তিনি যখন সোফা আর ঘরের জল পরিষ্কার করছিলেন তখন কর্কশ স্বরে বারবার ডোরবেলটা বেজে উঠলো। দরজা খুললেন তিনি।

– কী হলো এতো কল করছি ল্যান্ডফোনে, মোবাইলে, ধরছো না কেন? ভয়ে তো আমার হার্ট অ্যাটাক হবে – আমাদের কন্যা কই?

– ফিরেছে, বাড়ি ফিরেছে। সব ঠিক আছে। বৃষ্টি ভিজে ওর ঘুম এসেছে। ঘুম থেকে উঠলে কথা বলো। সব ঠিক আছে।

– বাবাঃ। বাঁচলাম। যে-দুশ্চিন্তা ধরিয়ে দিয়েছিলে। বাবা সোফায় পিঠ এলিয়ে বললেন – এমা, এ তো ভিজে গেছে।

– ঠিক করে দেবো এক্ষুণি। সব ঠিক করে দেবো। সব ঠিক আছে। আমি শুধু শুধু এতো দুশ্চিন্তা করছিলাম। ওই একটা বাতিক আমার, উদ্বেগ করা, বুঝলে না…

মা নিপুণ হাতে ঘরের মেঝে মুছে আগের মতো করতে করতে বললেন। তিনি যে ডাক্তার। তার মতো নিরাময় আর কে জানে।