কুলিমানুর আশ্চর্য ঘুম

আহমেদ বাসার

কুলিমানুর ঘুম

শুভাশিস সিনহা

অ্যাডর্ন পাবলিকেশন

ঢাকা, ২০১২

১৫০ টাকা

সূচনালগ্নে বাংলা উপন্যাস উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনচিত্রণে উৎসাহী হলেও ধীরে ধীরে নিম্নবিত্ত ও ছিন্নমূল মানুষের জীবনযাত্রার দিকেও তার দৃষ্টি প্রসারিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের ঘটনাবহুল জমজমাট কাহিনি শোনাতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের অন্তর্জগতে উঁকি দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন ঘটনাহীন জীবনেও বলার মতো অন্তহীন ঘটনা থাকে। তিরিশের দশকে মানিক-বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় অন্ত্যজ শ্রেণির জীবনকে বৈচিত্র্যময় প্রেক্ষণবিন্দু থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। এরপর বাংলা উপন্যাস প্রান্তিক মানুষের সাবলীল উপস্থিতিতে ভিন্নমাত্রা লাভ করে। তরুণ ঔপন্যাসিক শুভাশিষ সিনহা কুলিমানুর ঘুম উপন্যাসে নিঃস্ব অথচ আত্মগর্বী ও ব্যক্তিত্ববান এক চরিত্র কুলিসানুকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। কুলিমানুর পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন :

‘অনেক কাল আগে এই দেশে নদনদী তেপান্তর পার হয়ে কিছু লোক এসেছিলো, সেই গৌণ লোকগুলোরই একজন কুলিমানু। মানুষকে তারা মানু বলে।’ এই ‘গৌণ মানুষ’ কুলিমানুর ভেতর ও বাহিরকে শুভাশিস অবলোকন করেছেন গভীরভাবে।

অবাঙালি অথচ বাংলায় পারঙ্গম কুলিমানুর সহায়-সম্বল বলতে একমাত্র তার শরীর। পরিশ্রম করেই তাকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। শিল্পী এস এম সুলতানের চিত্রের পেশিবহুল মানুষের মতো কুলিমানুর শরীরের গড়ন। লেখকের ভাষায় – ‘কুলিমানুর শরীর এখানকার মাটির চেয়ে চোদ্দোগুণ শক্ত; তবে হঠাৎ করে তার বড় একটা সমস্যা দেখা দেয়। সেই সমস্যার নাম – ঘুম, লেখকের ভাষায় ‘ঘুমরোগ’।

ঘুম মানুষের অতীব প্রয়োজনীয় ও স্বাভাবিক একটি দৈনন্দিন কর্ম। কিন্তু সেই ঘুমের যদি স্থান-কাল-পাত্রজ্ঞান লোপ পায় তাহলেই সমস্যা। আর সেটা যদি হয় কুলিমানুর মতো খেটে-খাওয়া মানুষের ক্ষেত্রে তাহলে তো তাকে মহাসমস্যাই বলতে হয়। লেখক কুলিমানুর সমস্যাকে এভাবে চিত্রিত করেছেন – ‘বসলেও ঘুম পায়, দাঁড়ালেও ঘুম পায়। কারো সঙ্গে কথা বলছে, এমন হলো যে টানটান ক্লাইমেক্স, তারই মধ্যে হারামির ঘুম এসে চোখ অাঁধার করে ফেলল। লজ্জার আর শেষ নেই’।

তবে কুলিমানুর ক্ষেত্রে এটি যতটা না লজ্জার, তার চেয়ে বেশি শঙ্কার। কারণ কুলিমানু সমাজের এমন এক শ্রেণির মানুষ, যা বুদর কাছে ঘুমই এক ধরনের বিলাসিতা। দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রমই যাদের নিয়তি।

কুলিমানুর এই সমস্যাকে আমরা অন্যদিক থেকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারি। মানসিক অবদানও মানুষের মধ্যে ঘুমের অনুভূতি সৃষ্টি করে। কুলিমানুর সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ও অবসাদ সৃষ্টির অনুকূল ছিল। একদিকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে ছোট মেয়ে রানীর মৃগরোগ ও বড়মেয়ে রত্নার বিবাহ-সমস্যা তাকে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। রানীর ওষুধের জন্যই মাসে নয়শো টাকা খরচ। দিনরাত পরিশ্রম করে ও জমি বন্ধক রেখে সে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করে।

 

দুই

কুলিমানু চরিত্রের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ঐতিহ্য-সচেতনতা। মণিপুরি ঐতিহ্য ও পূর্বপুরুষদের কীর্তি তাকে হীনমন্যতা থেকে রক্ষা করে। ‘মণিপুরী মণিপুরী বলে একটা গর্বভাব তার হয়। কারণ সে মনে করে তারা অর্জুনের বংশধর। ইতিহাসে ও নাকি লেখা আছে’। নিজস্ব সবকিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত থেকে চন্দ্রকুমার নামে একজন ইশালপা এলে সবাই যখন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন কুলিমানু বিরক্ত হয়। কারণ তাদের হরিণারায়ণ গোপীচালই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মণিপুরের একটা সমৃদ্ধ ছবিও তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে – ‘ওখানে সোনা মানিক্য’ আরে মনিমুক্তা আছে বলেই তো মনিপুর নাম’।

হরিচরণ কুলিমানুকে কৃষিকাজ ছেড়ে রিকশা চালানোর পরামর্শ দিলে সে রেগে যায়। তার ভেতর জেগে ওঠে প্রবল জাত্যভিমান। এছাড়া মণিপুরি রক্ত শরীরে নিয়ে হরিচরণ কীভাবে ঘুষ খায়, অপকর্ম করে তা ভেবে কুলিমানু বিস্মিত হয়। তার ভাষায় – আরে তোরা জাতটার দিকে একবার তাকাবি না? কতো বড় সম্মান নিয়ে আমরা ছিলাম। আজ সব গিয়ে এক কাতারে শামিল হবার তোড়জোড়। ঘুষ খেতে ও বাঁধছে না।’

এই ঐতিহ্যচেতনাই তাকে দুঃসময়ে শক্তিও সাহস জোগায়। বাতরোগগ্রস্ত স্ত্রী, মৃগী আক্রান্ত মেয়ে রানী, নিজের ঘুমরোগ আর বড় মেয়ে রত্নার বিবাহ-সমস্যায় ও কুলিমানু পূর্বপুরুষদের কীর্তি স্মরণ করে গর্বিত হয়, ফিরে পায় বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় প্রেরণা।

 

তিন

কুলিমানু চরিত্রের অন্তর্লোক ও লেখক দৃষ্টিপাতের অবকাশ পেয়েছেন। অবদমিত আকাঙ্ক্ষার স্ফুলিঙ্গ ভেতরে ভেতরে বয়ে বেড়ায় সে। রামকানাইয়ের স্ত্রী রূপসী বউদির প্রতি কুলিমানুর আদিম আকর্ষণ খুব স্পষ্ট। ক্যান্সারে মৃত্যু হয়েছে তার। কিন্তু ভরাট বুক আর আকর্ষণীয় শরীরী উন্মাদনা নিয়ে রূপসী বউদি কুলিমানুর স্বপ্নে এসে হানা দেয়। ইশারা-ইঙ্গিতে তাকে আকর্ষণ করে, বলে – ‘ঠেইপঙ আগ ছিবে, দিয়াতা’ অর্থাৎ ‘একটা কাঁঠাল পেড়ে দিয়ে যাও’। কুলিমানু জানায় এখন সে কাঁঠাল পাবে কোথায়? রূপসী বৌদি তখন রহস্যম ভঙ্গিতে হাসতে থাকে। কুলিমানু সেই হাসি ও কথার রহস্য উন্মোচন করতে চায়; কিন্তু তার আগেই মশা ও স্ত্রী তপতী এসে স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটায়।

স্ত্রী তপসীর কঙ্ক্ষালসার শরীর কুলিমানুকে তৃপ্ত করতে ব্যর্থ হয়। স্নান করতে গিয়ে তপতী অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলে সে বিরক্ত হয়। তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয় – গায়ে তো হাড্ডি আর চাম ছাড়া কিছু নেই। আগে পেটে খানিকটা মেদ ছিলো, তার মাঝখানে নাভিটা কুচকুচ করে বেশ একটা ছিলো… দেখলে দুবার তাকাতে ইচ্ছে করতো, এখন পেটটা ও সামনে পিছে আলাদা করা যায় না কিছু, বুকের দিকে তাকালে পিঠ দেখা যায়… শরীরের কাঠামোই যখন বলে দিচ্ছে এইটা আর শরীর নেই, শরীরের ভাব ধরে আছে, তখন কী দরকার তাকে ঘষে মেজে চামড়া সুদ্ধা তুলে ফেলার’। তারপরও সামান্য আনন্দের জন্য এই শরীরটাকেই জাপটে ধরতে হয়। কারণ – জীবন যদি তাদের শরীরের ভেতর বাঘ-সিংহ পুরে বাইরে ইঁদুরের ঘর বানিয়ে রেখে দেয়, তাহলে চলবে কী করে।

চার

কুলিমানু চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তোলার উপযুক্ত ভাষাভঙ্গি ও শুভাশিস নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছেন। উপন্যাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মণিপুরি শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার। পাঠকের সুবিধার্থে তার অনুবাদ ও লেখক অধিকাংশ ক্ষেত্রে জুড়ে দিয়েছেন। কুলিমানু অন্ত্যজ শ্রেণির জীবন-যন্ত্রণায় যতটা না বিপর্যস্ত, তারচেয়ে বেশি বিস্মিত। লেখক তার যন্ত্রণায় কিছুটা হাস্য-রসাত্মক আবহ তেরির চেষ্টা করেছেন। কুলিমানু চোখে আধা ঘুম নিয়ে যখন মাঠে যায়, তখন ষাড় আর বলদগুলোকে তার ছাগল-কুকুর মনে হয়। একবার চাষ করতে গিয়ে সে হঠাৎ ঘুমে ষাঁড়ের ওপর ঢলে পড়েছিল। এ ঘটনার পর স্ত্রী তার সঙ্গে দুই দিন কথা বলেনি। গাঁয়ে তার সম্মানহানিও ঘটেছিল। ছোট মেয়ে রাত্রীর মৃগীরোগে বিরক্ত হয়ে কুলিমানুর ভাবনা ও হাস্যরস তৈরি করে, যদিও বাস্তবতা তার বিপরীত – চড়থা পুড় মারলে রোগ যদি দূর হতো, তাহলে মেয়েটাকে আচ্ছা করে দু-চারটা থাপ্পড় সে লাগাতই। যেখানে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগানোর নিশ্চয়তা নেই, সেখানে মেয়ের মৃগীরোগে কুলিমানুর ভাবনা আর কী-ইবা হতে পারে।

কুলিমানু বাংলা সাহিত্যে মৌলিক কোনো চরিত্র না হলেও শুভাশিস অভিনব ভঙ্গিতে চরিত্রটি রূপায়িত করেছেন, যা সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।