হুমায়ুন চৌধুরী : নশ্বরস্রোতে কি ভাসমান শিরোনামহীন?

ফারুক আলমগীর

হুমায়ুন চৌধুরী সম্প্রচার সাংবাদিকতার আদি-পুরুষ বাংলাদেশের; অন্যতম আদি-পুরুষ উপমহাদেশের সন্দেহাতীতভাবে। ‘সম্প্রচার সাংবাদিক’ রূপে তাঁর কীর্তি ও কথকতা স্বদেশ-স্বকাল ছাড়িয়ে বিশ্বময় এতটা ব্যাপ্তি লাভ করেছিল, যার ফলে তাঁর একদার ‘সাহিত্য পরিচয়’ ক্রমশ অন্তরালবর্তী হয়নি কেবলই, বলা যায় একেবারেই অন্তর্হিত হয়েছে। কারণ হুমায়ুন চৌধুরী নিজেই।

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্পরূপে প্রবর্তিত হওয়ার দিন থেকেই হুমায়ুন চৌধুরী টেলিভিশনের প্রথম ঘোষক ও সংবাদ-পাঠক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সুললিত কণ্ঠের প্রয়াত হেনা কবির এবং তাঁদের সঙ্গে পরে যোগ দেন মডি কোহেন; সম্ভবত এখন কলকাতা প্রবাসী। টেলিভিশনের এই অঞ্চলের প্রথম ‘স্টেশন অ্যানাউন্সার কাম নিউজ রিডার’ থেকে তাঁর উত্তরণ ঘটেছিল বার্তাকক্ষে অনতিবিলম্বে। সময়টা ছিল আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন ও তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের যুগ এবং তাঁর উদ্ভাবিত গণতন্ত্রের অধীনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তোড়জোড়। ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট লেখক কন্যাকুমারীখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক। তিনি ছিলেন দেশভাগের পর মুসলিম লীগ শাসকদের হাতে অতিনিপীড়িত, নির্যাতিত ও পরবর্তীকালে নিষিদ্ধঘোষিত একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। সংগত কারণে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হলে তিনি নিবর্তন এড়াতে আত্মগোপন করেন। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের মাথায় যেন বাজ পড়ল, কেননা সেই সময়ের ঢাকা কেন্দ্রে নিয়োজিত অধিকাংশ টিভিকর্মীই ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতির সপক্ষে। ঢাকা স্টেশনের কর্মাধ্যক্ষ জামিল চৌধুরী, প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী তদানীন্তন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রয়াত কলিম শরাফী ও সিনিয়র প্রডিউসার প্রয়াত মনিরুল আলম সংবাদ তৈরি নিয়ে চিন্তায় পড়লেন। তখন পৃথকভাবে কোনো বার্তাকক্ষ বা বার্তা বিভাগ গড়ে ওঠেনি; সবাই একটা পরিবারের মতো কর্ম সম্পাদন ও পরিচালন করতেন। মনিরুল আলমের সিনে-জার্নালিজমের প্রেক্ষাপট ছিল এবং তিনি নিয়মিত মর্নিং নিউজে লিখতেন। কিন্তু অনুষ্ঠান অধিকর্তারূপে তাঁর দায়িত্ব এত বেশি ছিল যে, তাঁর পক্ষে বার্তা তৈরি করা সম্ভব ছিল না। মনিরুল আলম ভেবে দেখলেন টিভিকর্মীদের মধ্যে একমাত্র হুমায়ুন চৌধুরীর সাংবাদিকতার একটা সুস্পষ্ট প্রেক্ষাপট রয়েছে। দৈনিক ইত্তেহাদ ও মিল্লাতে চাকরি, বেতারে স্থানীয় সংবাদ অনুবাদ ও পাঠের অভিজ্ঞতা, সব মিলিয়ে সুতরাং তাঁরই নির্বাচন হুমায়ুন চৌধুরী। জামিল চৌধুরী, কলিম শরাফী, মনিরুল আলমসহ সকলের আগ্রহ ও অনুরোধে হুমায়ুন চৌধুরী ‘স্টেশন অ্যানাউন্সার’ থেকে ‘নিউজ এডিটর’ হলেন এবং বার্তাকক্ষে সাব-এডিটর, বার্তা-প্রযোজক, সংবাদ-পাঠক ও সর্বোপরি বার্তা-সম্পাদকরূপে দীর্ঘদিন ঢাকা কেন্দ্রের প্রকল্পকালীন সময়ে একাই সর্বেশ্বর হয়ে কাজ করেন। টেলিভিশন সংবাদ তৈরির তথা সম্প্রচার সাংবাদিকতার ভুবনে সেই যে পদপাত হুমায়ুন চৌধুরীর, সেখান থেকে তিনি অন্যত্র কোথাও যাননি। এমনকি পেছন ফেরেননি তাঁর পুরনো দিনের সাহিত্য সহযাত্রার সময়গুলোতে।

অথচ এই হুমায়ুন চৌধুরীর সঙ্গে একজন গল্পকাররূপে আমার প্রথম পরিচয়। ১৯৬২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে, বাংলা অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়েছি এবং আমাদের মতো অনেক নবীন-যুবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হচ্ছে। বাষট্টির শরৎকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘সংস্কৃতি সংসদ’ আয়োজন করে আমাদের জন্য ‘নবীনবরণ উৎসব’। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের হল গমগম করছে। শ্যামা নৃত্যনাট্য হবে। পর্দা-উত্তোলনের পূর্বে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ নবীন তরুণ-তরুণীরা। এমন সময়ে পর্দার আড়াল থেকে মৃদুমন্দ অথচ সুমিষ্ট স্বরে ভেসে এলো কার কণ্ঠ-নিঃসৃত হয়ে মোতাহার হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি-কথা’ থেকে বাণী ‘বাঁচা, বাঁচা… বাঁচা… নতুন করে বাঁচা…’ ইত্যাদি। আমরা সেই কণ্ঠে ও কণ্ঠ-নিঃসৃত বাণী শুনে স্থাণুর মতো বসে রইলাম। এরপর পর্দা উঠল। যথারীতি আবাহনী বক্তৃতার পর শ্যামা নৃত্যনাট্য প্রদর্শিত হলো। মনে পড়ে কামাল লোহানী বজ্রসেন এবং শ্যামার ভূমিকায় ছিলেন রাহিজা খানম ঝুনু, উত্তীয় হয়েছিলেন দুলাল তালুকদার। প্রয়াত জাহিদুর রহিমের অপূর্ব-অমিয় কণ্ঠ আমাদের সর্বক্ষণ মোহমুগ্ধ করে রেখেছিল। পর্দার অন্তরালবর্তী ঘোষকের নামটি জেনেছিলাম হুমায়ুন চৌধুরী। অনুষ্ঠান শেষে ঘোষককে দেখা ও আবিষ্কার করা আমার ব্রত হয়ে উঠল, কারণ নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল একটি গল্পের মাধ্যমে। গল্পের শিরোনাম ‘এত আলো’, প্রকাশিত হয়েছিল ড. এনামুল হক-সম্পাদিত উত্তরণ সাময়িকীতে প্রায় দুবছর আগে ১৯৬০ সালে, আমি তখন প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী। রাত জেগে পড়াশোনার ফাঁকে এ-গল্পটি পড়ে আমি শিহরিত হয়েছিলাম। নবীন কিশোর বয়সে গল্পের কিছুটা বুঝেছি, অধিকাংশই ধাতস্থ করতে পারিনি। তাই প্রথম সাক্ষাতে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কি ‘এত আলো’ গল্পের লেখক হুমায়ুন চৌধুরী? তিনি খুব অবাক হয়েছিলেন, তাঁর চাইতে চার-পাঁচ বছরের ছোট এই পুঁচকে ছোড়া কী করে ওই গল্পের সন্ধান পেল? আবার অন্যদিকে বেশ গর্ববোধ করেছিলেন যে, তাঁর গল্পের অনুসন্ধানী পাঠকও রয়েছে। বাষট্টির শরৎকালীন সংস্কৃতি-সংসদের অনুষ্ঠানের পরে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎকারের সময় থেকে আমরা অগ্রজ-অনুজ সুহৃদপ্রতিম হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন তাঁর কর্মস্থলে কনিষ্ঠ সহযোগী হয়েও অগ্রজ-অনুজ সম্পর্ক অটুট ছিল। আমরা যে-বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদচারণা শুরু করি, হুমায়ুন চৌধুরীর সেই বছর বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার কথা ছিল স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে। তিনি ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সেবাব্রত চৌধুরী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও হায়াৎ মামুদের সতীর্থ। নানা কারণে পরীক্ষা না দিয়ে ১৯৬৪ সালে অতঃপর আসাদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসদের সঙ্গে পাশ করেন। বারংবার পরীক্ষা-বিরতির জন্য আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার। দীর্ঘকায় উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুদর্শন মানুষটি বিশ্ববিদ্যালয়িক জীবনে পাজামা ও গরদের পাঞ্জাবি পরতেন। বেতারে সকালে অনুষ্ঠান ঘোষণা করে ক্লাসে আসতেন; বিকেলে ঢাকা বেতারের স্থানীয় সংবাদ পাঠ এবং প্রায়শ রাতের শিফটে পত্রিকায় চাকরি করতেন। চৌষট্টিতে টেলিভিশনে প্রবেশের পর সম্ভবত পঁয়ষট্টির মধ্যভাগ পর্যন্ত কিছু লেখালেখির পর গল্পের কলম তিনি আর ধরেননি। কিন্তু আটান্ন থেকে চৌষট্টি পর্যন্ত মাত্র ছয় বছরে অল্প কয়েকটি গল্প তাঁকে আমাদের গল্পকারদের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। মাত্র সাত-আটটি গল্প লিখে এত সুনাম তাঁর সুহৃদ-সাহিত্য সহযাত্রী অনেকে অর্জন করেননি। মনে পড়ে ২০০৬ সালে কুয়ালালামপুর থেকে পাট গুটিয়ে ঢাকায় এলে আমি তাঁকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের নজরুলবিষয়ক বক্তৃতার আসরে নিয়ে যাই। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় মান্নান সৈয়দের জন্য ‘নজরুল চেয়ার’ সৃষ্টি করে তাঁকে গবেষণায় সুযোগ ও সম্মানে ভূষিত করেছিল, যা আমাদের দেশে কোনো সাহিত্য-গবেষক পন্ডিতদের জন্য প্রথম একটি মর্যাদাবান কার্যক্রম বলে অভিনন্দিত হয়েছিল। প্রফেসর হারুন-উর-রশীদের আমন্ত্রণে আমরা ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। বক্তৃতা শুরুর একটু পর আমরা অনুষ্ঠানকক্ষে পৌঁছলে মান্নান সৈয়দ বক্তৃতা থামিয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে বলে ওঠেন, আমি কবি ফারুক আলমগীরের সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি হুমায়ুন চৌধুরীকে, যিনি একদা কিছু সাংঘাতিক গল্প লিখেছিলেন, এখন বিস্মৃতপ্রায়। তাঁকে হঠাৎ দেখার ঘোর কাটিয়ে মান্নান সৈয়দ আরো বলেন, হুমায়ুন চৌধুরী আমাদের দেশের প্রথম সুররিয়ালিস্ট গল্পকার।

১৯৬৪ সালে তাঁর সতীর্থ-সুহৃদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাম্প্রতিক ধারার গল্প নামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন, যেখানে নয় গল্পকারের মধ্যে হুমায়ুন চৌধুরীও সংকলিত হয়েছেন। গ্রন্থ শুরুর গল্পকার সৈয়দ শামসুল হক – বিখ্যাত ‘রক্তগোলাপ’ দিয়ে শুরু এবং শেষ হয়েছে হাসান আজিজুল হকের ‘বৃত্তায়ন’ দিয়ে। হুমায়ুন চৌধুরী গ্রন্থের তৃতীয় গল্পকার এবং সংকলিত গল্পটি হচ্ছে ‘গ্রহণের রাত’। গল্পটি আমি নতুন করে পড়তে গিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের কথা মনে পড়ছে – ‘হুমায়ুন চৌধুরী আমাদের প্রথম সুররিয়ালিস্ট গল্পকার’। গল্পটি সংকলিত করতে গিয়ে সম্পাদকের উক্তি প্রণিধানযোগ্য – ‘বয়সের দিক থেকে কনিষ্ঠ হলেও হুমায়ুন চৌধুরীর মনোগঠন সৈয়দ হকের সমধর্মী। সৈয়দ হকের মতো তিনিও কবি। তফাৎ এই যে, হুমায়ুন চৌধুরী কবিতা লেখেন না, অন্যজন লেখেন। বস্ত্তত আমাদের তরুণ গল্পকারদের মধ্যে তাঁর গল্পই সবচেয়ে বেশি কবিতা। হুমায়ুন চৌধুরীর সবচেয়ে অবলম্বন বোধহয় তাঁর তীক্ষ্ণ সতর্ক উৎসাহী চোখ যা চারদিককে খুঁটিয়ে দেখতে জানে। গল্পের আঙ্গিক জিনিসটার ওপর স্বাভাবিক অধিকার থাকায় কয়েকটা উল্লেখযোগ্য গল্প লিখেছেন। একসঙ্গে গল্প লিখতে শুরু করলেও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং হুমায়ুন চৌধুরী ভিন্ন জাতের লেখক। শব্দের প্রলোভন হুমায়ুনকে অনেক সময় অস্পষ্টতার দিকে টেনে নেয়, কিন্তু সংযম জ্যোতিপ্রকাশের গল্পের প্রধান চরিত্র। হুমায়ুন সূক্ষ্ম, কবিত্বময় ও ব্যক্তিগত; জ্যোতিপ্রকাশ বিস্তারিত, বাস্তবনির্ভর ও সমস্যা সজাগ। এই সংকলনের গল্পকারদের মধ্যে তিনিই একমাত্র লেখক, যিনি কবিতাকে কোনোরকম ব্যবহার না করে গল্প লিখেন।’ প্রায় ৫০ বছর আগে এই সম্পাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যে সত্য ভাষণটি করেছেন তা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে, যা আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য উদ্ধৃত করছি – ‘সাম্প্রতিক ধারার যে লেখককুল এই সংকলনের লক্ষ্য, সৈয়দ শামসুল হক তাঁদের প্রথম। প্রথম বলছি এ কারণে যে, সাম্প্রতিক ধারার লেখকদের মধ্যে বিষয় ও আঙ্গিকের যে অধুনাতম উত্তরণ দেখা যায়, সৈয়দ শামসুল হকের আগে আর কারো মধ্যে তাঁর সগোত্র নেই। এমনকি তাঁর সতীর্থদের মধ্যেও তিনি সেই লেখক যার সঙ্গে আজকের তরুণতম লেখকদের রক্তের মিল রয়েছে।’ পঞ্চাশের দশকের সৈয়দ শামসুল হক তখনো ‘সব্যসাচী’ হয়ে ওঠেননি, কবি শামসুর রাহমানের রৌদ্র করোটি মাত্র প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু মননে-মানসে তাঁরা ছিলেন ষাটের ব্যতিক্রমী একদেশদর্শী নিরীক্ষাধর্মী উন্মাতাল উচ্চকিত সাহিত্য-আন্দোলনের তরুণতমদের সগোত্র। সৈয়দ সম্পর্কে হুমায়ুন চৌধুরী কথা বলতেন অতি সমীহভরে। ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’, ‘পরাণের গহীন ভিতর’ তাঁর খুব প্রিয় ছিল। অতিসম্প্রতি জলেশ্বরীবিষয়ক দীর্ঘ কথোপকথন করেন আমার সঙ্গে। ঢাকা শহরের যাতায়াত দুর্গম হয়ে ওঠায় তিনি প্রায়শ টেলিফোনে কথা বলতেন ও কাজ সারতেন। একটি সংগীত চ্যানেল (পশ্চিমবঙ্গের) তাঁর খুব প্রিয় ছিল, নিয়মিত গান শুনতেন এবং সংগীত বিষয়ে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে তাঁর প্রিয় ব্যক্তি আবদুশ শাকুরের আশ্রয় নিতেন। এই দুই মামা-ভাগ্নে গভীর রাত পর্যন্ত সাহিত্য-সংগীতসহ নানা বিষয়ে দূরালাপনিতে নিমজ্জিত থাকতেন। অনন্যসাধারণ পন্ডিত আবদুশ শাকুরের হঠাৎ প্রয়াণ তাঁকে মর্মাহত করেছিল। তাঁর অপর এক প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী, এখানেও তাঁদের মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক ছিল। অন্য যাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন তাঁরা হলেন সতীর্থ হায়াৎ মামুদ, কবি ইমরুল চৌধুরী, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাট্যজন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি মনজুরে মাওলা, কবি মোফাজ্জল করিম, সাবেক রাষ্ট্রদূত লেখক মাহবুব আলম, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং আমাদের এককালীন কনিষ্ঠ সহকর্মী ও বাংলাদেশ বেতারের সাবেক মহাপরিচালক মাহবুবুল আলম। এঁদের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার সর্বশেষ তথ্য পরে আমাকে টেলিফোনে পরিবেশন করা হতো। যেন আমি কোনো সম্প্রচারকর্মে নিয়োজিত, যাতে সর্বত্র ওইসব তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারি। কবি মনজুরে মাওলা তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থটি তাঁকে উৎসর্গ করেছেন, এই কথা আমাকে জানিয়ে তিনি আনন্দের আতিশয্যে অবগাহিত হয়েছিলেন। কবি মনজুরে মাওলা তাঁকে খন্ডকালীন কবি আখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ ১৯৮১ সালে হুমায়ুন চৌধুরী হঠাৎ করে কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং ১৯৮৩ সালে কুয়ালালামপুর গমনের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই সময়কালে তাঁর বুকের মধ্যে বসত-বাড়ি নামে একটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, খুব সম্ভবত সুবর্ণ প্রকাশনার মাধ্যমে। এই গ্রন্থে কিছু দারুণ প্রেমের কবিতা ছিল, বিশেষত তাঁর প্রেমবিষয়ক একটি পদাবলি ‘নন্দিনী একবার’ বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়ে তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছিল। এই কবিতার ওপর ভিত্তি করে বিটিভির তৎকালীন প্রযোজক ফখরুল আবেদীন দুলাল একটি নাটকও প্রযোজনা করেছিলেন। প্রয়াত সৈয়দ নাজমুদ্দিন হাশিম তথ্য ও বেতারমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি একুশের কবিতা নিয়ে প্রথম ও অদ্যাবধি শেষ বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক গ্রন্থ প্রকাশ করলে হুমায়ুন চৌধুরীর একটি কবিতা সেখানে গুরুত্বের সঙ্গে সংকলিত হয়। কবিতার নাম ‘আমি অপেক্ষায় আছি, অপেক্ষায় থাকবো’। উল্লেখ্য, এই কবিতায় একুশের দিনে শহীদ একটি বেওয়ারিশ লাশের কথা বলা হয়েছে – ‘ধাবমান পুলিশ ভ্যানের পলাতক আলো/ ভুল করে রেখে গেল আমার লাশ/ বত্রিশটি একুশের বর্ণিল বসন্তেও যা শনাক্ত হয়নি।’ আশ্চর্য কালি ও কলমে এপ্রিল ২০০৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বিস্রস্ত সংলাপ’ কবিতায় লক্ষ করি আবারো বেওয়ারিশ লাশের কথা – ‘আমার নিজের লাশ পড়ে থাকতে দেখি/ শিরোনামহীন, দিকনির্দেশনাহীন/ এক আকাট ভূতলে/ এবং আমারই মতো আরো সারি সারি।’ আরো আশ্চর্য তাঁর ২১-২২ বছর বয়সে রচনা ‘গ্রহণের রাত’ গল্পটির শুরু এমনিভাবে – ‘মৃত কবির শব নিয়ে অন্ধকার একা একা পথ হাঁটছে, একটা চতুষ্পদীর দশ লাইনের মাথায় খানিকটা ধোঁয়া বেরোলো। লাইনে দাঁড়িয়ে ইঞ্জিনটা ধুঁকছিল। ও তারপর স্মৃতি থেকে খানিকটা নিরুত্তাপ নির্জীবতা নিয়ে ছুড়ে দিল ধোঁয়ার মাথায়। কিছু একটা যেন হলো। ধোঁয়া স্মৃতি হয়ে, স্মৃতি গান হয়ে, গান নক্ষত্র হয়ে, আকাশে যেখানটায় ফুটে উঠলো গোধূলি সেখানে কুয়াশায় ভিজে ধূসর হয়ে গেছে। আর যে তারাটা ফুটলো নিঃসঙ্গ, তার নামও জানে না… পরিত্যক্ত গীর্জার নিসঙ্গতা কম্বলটা আগাগোড়া টেনে দিল, কফিনের উপর শুয়ে পড়লো সটান। অসমাপ্ত চতুষ্পদীর দশটা লাইন বুকের দশটা পাঁজরে পেরেক দিয়ে গাঁথা হয়ে আছে।… ম্যাকেঞ্জি সাহেবের শ্বেতশুভ্র মূর্তি তাঁর শিয়রে-পায়ে অনেক প্রান্তরের ধূলি চিহ্ন আর ঠোঁটের প্রান্তে একটুকরো হাসি – কাম অন জেন্টলম্যান, লেট মি এনজয় এ-ডেথ আন আইডেনটিফাইড – হাউ শিরিন অ্যান্ড লোনলি ইট ইজ – এ পোয়েট ক্রুসিফাইড বাই-এ পোয়েম – কিন্তু তাঁর আগেই তোমার জন্মসূত্রকে ভুলতে হবে…।’ হুমায়ুন চৌধুরী মগ্ন চৈতন্যের সবই অনিঃশেষ শিরোনামহীন। এমনি আরো একটি গল্প ‘নশ্বর স্রোত’, সম্ভবত সমকালে বেরোয়। এমনকি ২০ মার্চ ২০০৮ সালে ঢাকা থেকে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর বন্ধু কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে দীর্ঘ ফোনালাপ করে যে-কবিতা লিখেছেন (কালি ও কলম, জুন ২০০৮ সংখ্যা দ্রষ্টব্য) তা স্মর্তব্য হতে পারে – ‘বৃষ্টি পতনের মতো অন্ধকার/ যখন প্লাবিত করে চরাচর/ বাঁশি বেজে যায় বেলা থেকে অবেলায়/ কুহকের মতো ডেকে নেয় তাঁকে।’ অগ্রজের প্রতি কবিতায় কবি শহীদ কাদরী লিখেছিলেন, ‘শহীদ বাড়ি নেই’ সেই কবে একদা – আর এখন হুমায়ুন চৌধুরীর ভাবনাও উঠে এসেছে শহীদ কাদরীর বাড়ি কবেই বা ছিল? তাঁর প্রকৃত সুহৃদরা পর্যন্ত কোনো কালে দাবি করেনি শহীদ কাদরীর আসল ঠিকানা তাদের জানা! সুদূর নিউ জার্সিতে ‘জন্ম বাউন্ডুলে আর আমরণ উদ্বাস্ত্ত/ স্বপ্নের রেশনশপে কিউ ধরে।’ অবাক হতে হয় বন্ধু শহীদ কাদরীও তাঁর কবিতায় এখানে একজন অশনাক্ত ব্যক্তি, ‘যার কাজ খুলে দেয়া বুকের বসতবাড়ি/ অনন্তের অনিঃশেষ বিভিন্ন দরোজা।’

২০০৬ সালে কুয়ালালামপুর এশীয়-প্যাসিফিক ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ২৩ বছর পর দেশে ফিরলে কিছু পেশাগত কাজ করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানান বিটিভির এককালীন ইংরেজি সংবাদ পাঠক শামীম আহমেদ। শামীমের ‘এষণা’ নামের প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা থেকে নানাবিধ সৃষ্টিশীল নানা ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল। নতুন নতুন টিভি চ্যানেলের স্থাপনাকর্মে তাঁর সংযুক্তির ফলে ‘ বৈশাখী’ টেলিভিশনের প্রকল্পপত্রটি আমি তাঁর প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তৈরি করে দিয়েছিলাম। বনানীতে বেশ বড় একটা ফ্লোর নিয়ে ‘এষণা’র দফতর ছিল। হুমায়ুন চৌধুরী প্রতিদিন ১১-১২টার দিকে ওই দফতরে নিয়মিত আসতেন এবং ওই অফিসে পরিবেশ ও বিশাল অবসর সময়ে আবারো কবিতা লিখতে শুরু করেন। একমাত্র কালি ও কলমে কবিতাগুলো প্রকাশের আগ্রহ ব্যক্ত করেন আমার কাছে, কারণ পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসনাত তাঁর সুপরিচিত এবং ষাট দশকের একজন কবিই নন (কবি মাহমুদ আল জামান), দীর্ঘদিন তাঁর পছন্দের সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদকও বটে। অতএব নতুন এয়ারপোর্ট রোডে বেঙ্গল সেন্টারে তাঁকে নিয়ে আমাকে যেতে হলো। মনে আছে, প্রথম সাক্ষাতে আবুল হাসনাত হুমায়ুন চৌধুরীর কাছে গল্প চেয়েছিলেন আগামীতে প্রকাশিতব্য কালি ও কলমের গল্পসংখ্যার জন্য। শুধু আবুল হাসনাত নন, ইতোপূর্বে ইমরুল চৌধুরী তাঁর কালের যাত্রার জন্য গল্প লিখতে এবং বিউটি বোর্ডিংয়ে আমাদের এক সমাবেশে হক ভাই, সায়ীদ ভাই এবং কবি আসাদ চৌধুরী তাঁকে আবারো তাঁর গল্পের শানিত কলম ধরতে বলেছিলেন। কিন্তু কেন যে তিনি গল্পে হাত দিলেন না, আমাদের সকলের অজানা রয়ে গেল। গত পাঁচ-ছয় বছরে শুধু কালি ও কলমে তাঁর একাধিক কবিতা প্রকাশিত হয়, অন্য কোথাও লেখা প্রকাশে তাঁর আগ্রহ ছিল না। বিষ্ণু দে ‘সুচিত্রা মিত্রের গান শুনে’, শামসুর রাহমান ‘ফাহমিদা খাতুনের গান শুনে’ এবং হুমায়ুন চৌধুরী ‘অদিতি মহসিনের গান শুনে’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন। হয়তো মূলে কবি বিষ্ণু দে থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করবেন অনেকেই, কিন্তু হুমায়ুন চৌধুরীর ঊনসত্তর পঙ্ক্তির দীর্ঘ কবিতাটি অসাধারণ, আগ্রহীরা কালি ও কলমের নভেম্বর ২০০৮ সংখ্যা একবার অবলোকন করতে পারেন।

পেশাগত কারণে হুমায়ুন চৌধুরীর কর্মক্ষেত্র তেহরান থেকে টোকিও এবং সুদূর অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আবুর (ABU) উপগ্রহ সংবাদচিত্র বিনিময় এশিয়াভিশনের প্রথম সমন্বয়কারী ও পরে সিনিয়র নিউজ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ওই অঞ্চলের রেডিও টেলিভিশনের সঙ্গে সংযুক্ত কর্মকর্তা ও সংবাদকর্মীদের কাছে একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় নাম ছিল চৌধুরী। আঞ্চলিক ছাড়াও আন্তঃমহাদেশীয় সংবাদচিত্র বিনিময় কার্যক্রমের জন্য য়ুরোভিশন তথা য়ুরোপের দেশসমূহেও তাঁর সুপরিচিতি ছিল। বস্ত্তত হুমায়ুন চৌধুরী বাংলাদেশে সম্প্রচার জগতের একমাত্র পেশাদার শীর্ষ ব্যক্তিত্ব যিনি বিদেশে দেশের মর্যাদা বহন করতেন। কুয়ালালামপুর থেকে ফিরে এষণার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর তাঁর ভারতীয় বন্ধু দূরদর্শনের রতিকান্ত বসুর আমন্ত্রণে তিনি তারা নিউজের সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ পেলেন। রতিকান্ত ডিডি ছেড়ে ওই নতুন টিভি চ্যানেলটি গড়ে তুলেছিলেন। হুমায়ুন চৌধুরীর কল্যাণে এষণা তাঁরা নিউজের কাজ পেলে তাঁর সার্বক্ষণিক ডান হাত আমার ডাক পড়লো। আমি কিছু রিপোর্টার, ভিডিও এডিটর ও ক্যামেরাম্যান নিয়ে পরিকল্পনায় নেমে পড়লাম ফিল্ড রিপোর্ট সংগ্রহ ও প্রতিবেদন কর্মযজ্ঞে। শামীম আহমেদ তাঁর দফতরের বিশাল ফ্লোরের একাংশে একটি টিভি স্টুডিও তৈরি করলো। তারা নিউজের সঙ্গে সেই সময়ে নির্বাচন প্রস্ত্ততির তিন মাসে আমরা প্রতিদিন তাঁদের একটি করে আধঘণ্টার টক শো এবং আধঘণ্টা টিভি প্রতিবেদন দেওয়ার চুক্তি করেছিলাম। ২০০৬ সালে নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাস কাজ করার পর ১ জানুয়ারি ২০০৭ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলে তারা নিউজের কাজ স্বাভাবিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে হুমায়ুন চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে আমাদের পেশাগত কিছু পুরনো বন্ধু ও সহকর্মীকে নিয়ে আমরা মিডিয়াবিষয়ক একটি লিমিটেড কোম্পানিও গঠন করি, যার উদ্দেশ্য বিভিন্ন নতুন টিভি চ্যানেলের কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও টিভি স্টেশন স্থাপনার কাজে সহায়তা প্রদান করা। প্রতিষ্ঠানটি আবুর (ABU) সহযোগী সদস্যপদ লাভ করে। মাল্টিমিডিয়া ডেভেলপমেন্ট এবং কমিউনিকেশন সেন্টার নামে এ প্রতিষ্ঠানটি আবুর (ABU) সঙ্গে যৌথভাবে কিছু পেশাগত রোড শো, ওয়ার্কশপ ইত্যাদির আয়োজন করে। সর্বশেষ এশিয়া ভিশনের একটি আঞ্চলিক ওয়ার্কশপ ঢাকায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিমকোর সহায়তা নিয়ে আয়োজন করা হয়, যেখানে ইরান, নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামের প্রতিনিধি এবং বিটিভিসহ স্থানীয় কয়েকটি বেসরকারি চ্যানেলের সংবাদকর্মীরা যোগদান করেন। হুমায়ুন চৌধুরীর ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশে একটি টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করে এককভাবে কাজ করার। কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল তাঁর সঙ্গে কথা বলেও কথা রাখেনি। আমার অত্যন্ত বাজে অভিজ্ঞতা থেকে আমি তাঁকে কোনো বেসরকারি উঠতি চ্যানেলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেও নিবৃত করতে পারিনি। ফলে তাঁর কিছু দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হয়েছে, যা আমাদেরও মর্মাহত করেছে। তবে একমাত্র ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজের চ্যানেল আই তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আহবান জানিয়েছিল এবং তাঁরা খুব প্রিয়ভাজন সত্ত্বেও তিনি অনুরোধ রক্ষা করেননি। আমার স্নেহভাজন ছাত্র সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা  (চ্যানেল-২৪-এর বার্তাপ্রধান) হুমায়ুন চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারণে কেউ তাঁকে চিনতে পারেনি। কেউ তাঁকে ডাকেনি। সেজন্য তিনি অভিমান করে আবার বিদেশে চলে গেছেন। কথাটা সর্বাংশে সত্যি নয়। তিনি মাস দুয়েকের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইওয়া অঙ্গরাজ্যে ডি-ময়েনে ছেলের কাছে গিয়েছিলেন বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ও সদ্য-ভূমিষ্ঠ নাতনিকে দেখতে। ছেলের বাড়িতে ২৬ সেপ্টেম্বর ভোররাতে ঘুমের মধ্যে তাঁর লোকান্তর হয়। সন্দেহ করা হচ্ছে, তাঁর শরীরের কোথাও কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছিল, যা নির্ণয় করা তখনো হয়নি। সুখের বিষয়, তিনি তা জানতেও পারেননি এবং সেই রোগের অসহ্য যন্ত্রণা তাঁকে ভোগ করতে হয়নি। আমাদের সান্ত্বনা এইটুকু – ক্যান্সার আন-আইডেন্টিফাইড!

ডি-ময়েনের যে-কবরখানায় তিনি নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন, বলতে ইচ্ছে করে ‘গ্রহণের রাতে’র গল্পের মতো, ‘… বিকেল যেখানে কসাইখানার বাছুরের মতোন রক্তে কাদায় মাখামাখি হয়ে সন্ধ্যা রাত্রির খোঁয়াড়ের বাইরে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে তাঁর মৃত দেহের উপর, পৃথিবীর সব কবিতা ফুল হয়ে ঝরছে কেন?’ নিশ্চয়ই পুষ্পভারে নশ্বরস্রোতে ভাসমান এখন হুমায়ুন চৌধুরী শিরোনামহীন! অনিঃশেষ শান্তি হোক তাঁর আত্মার।