ইচ্ছামৃত্যুর খোলনলচে

চন্দন আনোয়ার

Chandan Anowar-1

স্ত্রী সাবিত্রী দেবী,  দুটি বাড়ন্ত ছেলে, নিজের একটি বাড়ি, সরকারি ব্যাংকের চাকরি ইত্যাদি নিয়ে শ্যামল বৈশ্যের সুখের জীবন। এই বাংলাদেশেই, এবং মাত্র ছ-মাস আগে, তার পিতা কৈলাস বৈশ্যের মৃত্যু ঘটে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে। তাই, তার আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার আত্মহত্যাপিয়াসু সেই মানুষটির মতো। কিন্তু সাধ করে আত্মহত্যা করার বয়স, আবেগ ও সময় তিনি পার করে এসেছেন। এখন তার আত্মহত্যার ঘটনাটি সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক মস্তিষ্কের কাজ। মহৎ একটি কাজ। বেঁচে থাকার চেয়ে মহৎ। তবে কৌশলগত কারণে আত্মহত্যার কারণ ও সময় গোপন রাখতে হচ্ছে। ভাবছেন

কাজটি করবেন নিজ বাড়িতেই। বাড়ির ছাদে উপযুক্ত একটি চিলেকোঠাও আছে। কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো নিচে ছোট্ট একটি সিঁড়িঘরও আছে।

কৈলাস বৈশ্য গল্প-উপন্যাস লিখতেন। চিলেকোঠায় থাকতেন গল্পের মানুষদের নিয়ে। আহার-বিহারে দিনে এক-দুবার করে নিচে নেমেছেন বটে, কিন্তু তা ছিল নিতান্তই কেজোনামা। কী এক আশ্চর্য কারণে ছাদে কাউকে উঠতে দেখলেই চেঁচাতেন – কেন এসেছো? কী দরকার? খবরদার এদিকে উঁকি দেবে না? সব তো ছেড়ে দিয়েছি। এখানে আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও।

শেষ নিশ্বাস ফেলার ঠিক আগের মুহূর্তে, কৈলাস বৈশ্য ছেলেকে কিছু একটা বলে যেতে চেয়েছিলেন; কিন্তু ততোক্ষণে তার চোখের আলো নিভে যাচ্ছিল, অন্ধকার নেমে এসেছিল। তার মৃত্যুর ছ-মাস পরে স্রেফ আত্মহত্যার কাজে লাগতে পারে বলে শ্যামল বৈশ্য চিলেকোঠার তালা খোলেন এবং অবিশ্বাস্য একটি জিনিস আবিষ্কার করেন। একটি পরিপূর্ণ মানব-কঙ্কাল কুঁজো হয়ে আছে, সামনে খোলা একটি  বই। কঙ্কালটি যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন। শ্যামল বৈশ্য প্রথমে ভাবলেন, চোখের ধাঁধা হতে পারে। মানুষের কঙ্কালের মতো করে মাকড়সা জাল বানিয়ে রাখতে পারে। আত্মহত্যার পরে নিজের দেহটিও একটি কঙ্কাল হয়ে যাবে কিনা। সব রকমের আন্দাজই ব্যর্থ হয়। বাস্তবেই একটি কঙ্কাল। কিন্তু তার মনে পড়ে না, বাবা কখন কঙ্কাল এনেছিলেন। লিখেছেন তো গল্প-উপন্যাস। কঙ্কাল তার কী প্রয়োজন? আর এমন নিখুঁত কঙ্কালটিই কোথায় পেলেন? একটি জয়েন্ট পর্যন্ত খসেনি। মাংস সেট করে দিলে জ্যান্ত মানুষের মতো নড়েচড়ে উঠবে। এই ছ-মাসে কঙ্কালটির শরীরে সামান্য ধূলি জমেছে। কঙ্কালটির সামনে একটি চেয়ার। এখানে বসে বাবা কৈলাস বৈশ্য কঙ্কালটির সান্নিধ্য-উপভোগ করতেন কিনা, এই দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করেন, দুই পায়ে সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে একটি স্বর্ণের চেইন। এছাড়া কঙ্কালটি নিরাভরণ। দুই হাতের আঙুলগুলো মুষ্ঠিবদ্ধ। কঙ্কালটির দাঁড়ানোর ভঙিমায় বিচিত্র ও জটিল কিছু ভাষা লুকিয়ে আছে। ঠিক কী ধরনের ভাষা পাঠ করা কঠিন।  তবে সেই ভাষায় একধরনের প্রতিবাদ, ঘৃণা, প্রত্যাখ্যানের ব্যাপার জড়িয়ে আছে।

কে হতে পারে কঙ্কালের মানুষটি?

শ্যামল বৈশ্যের নিকটাত্মীয় বলে দেশে কেউ নেই। দেশভাগের কিছুকাল, বাবা কৈলাস বৈশ্য ছাড়া কাকারা সবাই বাংলাদেশ ছেড়ে বর্ধমানে বাড়ি করেছিল। কৈলাস বৈশ্য তখনো বিয়ে করেননি। বয়স  আঠারো কি উনিশ, কলেজে পড়েন। বর্ধমানের পরিবারের সঙ্গে আর কখনোই সম্পর্ক রাখেননি। রক্ষা করেননি তুলসীমঞ্চে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে শঙ্খ বাজিয়ে গাছের গোড়ায় জল দেওয়ার ঐতিহ্য। প্রথমদিকে তার বাবা সমরজিৎ বৈশ্য নিজেই ছেলেকে এসে দেখে যেতেন, টাকা-পয়সা দিয়ে যেতেন, তবে কখনো বর্ধমানে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করেননি। বরং ছেলের এই জেদ তাকে দেশত্যাগের মর্মান্তিক যন্ত্রণা থেকে খানিকটা মুক্তি দিয়েছে। যতোদিন বেঁচেছিলেন, বাংলাদেশে তার বাড়ি আছে, বাংলাদেশ তার ঠিকানা, এমনকি মরবার কিছুদিন আগে অন্য ছেলেদের কাছে বিদায় নিয়ে স্থায়ীভাবে চলে আসবেন বাংলাদেশে এবং শেষ নিশ্বাস ফেলবেন সেই ভিটায়, যেখানে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে তার বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা থেকে পূর্বপুরুষের আত্মারা। বর্ধমানে মরলে তার আত্মা নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে, এই ভয়ে আলাদা একটি বাক্সে তালা দিয়ে রাখতেন কিছু কাপড়, ওষুধ ও নির্দিষ্ট পরিমাণ কিছু টাকা। শরীরের গতি-প্রকৃতি উল্ট-পাল্ট কিছু মনে হলেই আর একমুহূর্তও দেরি করেননি। যতোবারই মৃত্যু প্রস্ত্ততি নিয়ে এসেছেন, বাড়ির ভিটায় পা ফেলতেই সেই মৃত্যুভয় কোথায় যে হারিয়ে যায়! এভাবে স্বাভাবিক আসা-যাওয়ার মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ফেরার পথে কোথায় যে নিখোঁজ হয়ে গেলেন, নাকি পথে কোনো দাঙ্গায় পড়েছিলেন, অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও জানা যায়নি।

তবে কি এই কঙ্কালটি ঠাকুরদারই কঙ্কাল! বাবা ঠাকুরদার সন্ধান পেয়েছিলেন?

শ্যামল বৈশ্য তাই ভাবতে চেয়েছিলেন কিন্তু কঙ্কালটির দুই পা বাঁধা একটি স্বর্ণের চেইন দিয়ে। এবং কঙ্কালটির উচ্চতা ও দাঁড়ানোর ভঙিমায় স্পষ্ট হয় মেয়েমানুষের কঙ্কাল। তবু, মনের দ্বিধা মিটিয়ে ফেলার জন্যে, নারী-পুরুষের কঙ্কালের কী কী পার্থক্য আছে তা জানতে এক অর্থোপেডিক্স ডাক্তারের দ্বারস্থ হন। ডাক্তার তাঁর সহকর্মীর বন্ধু। বেশ খোলামেলা আলাপের মধ্য দিয়ে যে-পার্থক্যগুলো জানতে পারেন, তাতে তার দ্বিধা কেটে যায়। কঙ্কালটি কোনো একজন মেয়েমানুষের কঙ্কাল। মেয়েমানুষটি সতেরো-আঠারো বছরের যুবতী।

যুবতীটি কে? কখন, কীভাবে এবং কেন মারা গেল? আত্মহত্যা, নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল? আর বাবার সঙ্গে যুবতীর কী সম্পর্ক? এই কারণেই কি চিলেকোঠায় কারো প্রবেশাধিকার ছিল না? মা কি তবে জানতেন না এই কঙ্কালটি সম্পর্কে? কখনো বলেননি তো। অবশ্য মাকে কখনো চিলেকোঠায় ঢুকতে দেখেছেন বলে মনে পড়ে না।

বাবা গল্প-উপন্যাসে কী লিখছেন, কোথায় ছাপা হচ্ছে, এসবের প্রতি শ্যামল বৈশ্যের সামান্য আগ্রহ  ছিল না। ছেলেবেলা থেকেই বাবার এই লেখালেখিকে তার শত্রু মনে হয়েছে। কলেজে শিক্ষকতা আর এই লেখালেখি ছাড়া উত্তর-দক্ষিণে তাকিয়ে একবার চোখের পলকও ফেলেননি। এমনি অন্ধ! মায়ের ওপর সংসারের সমস্ত ভার চাপিয়ে চিলেকোঠায় বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। মা মারা যাওয়ার পরে সেই দায়িত্ব নিয়েছে সাবিত্রী। এতো লেখালেখির সবই পন্ডশ্রম। লিখে কিছুই হয়নি। টাকা জোটেনি, নাম ফোটেনি। শত শত গল্প, বড়ো বড়ো উপন্যাস লিখেছেন। অনামা অখ্যাত সব প্রকাশনী আর পত্রিকায় এসব বের হতো বলে খুব বেশি মানুষ তার লেখা পড়েনি।

চিলেকোঠায় যখন-তখন আসা-যাওয়া, বাবার বই নিয়ে নাড়া-ঘাঁটা দেখে সাবিত্রীর মনে খটকা লাগে। লোকটি আসলে কী করে তা দেখতে পা টিপে টিপে সিঁড়িঘরের দরজায় দাঁড়ায় নিঃশব্দে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে বাবার মতোই চিৎকার করে শ্যামল তেড়ে আসে তার দিকে, খবরদার সাবিত্রী! এ-ঘরে উঁকি দেবে না। বাবার অভিশাপ লাগবে! তুমি চলে যাও! শ্যামল বৈশ্যের এই রূপ সাবিত্রীর কাছে সম্পূর্ণ নতুন। তার মনে হচ্ছে, এই মানুষটিকে সে জীবনেও দেখেনি। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় একবার ভাবে, ফিরে গিয়ে সোজা ঘরটির ভেতরে ঢুকে পড়বে। কী জাদুমন্ত্র হীরা-জহরত আছে এর মধ্যে দেখে আসবে। এত বছর ধরে সে এই বাড়িতে আছে, কিন্তু একবারের জন্যে এ-ঘরটিতে ঢোকেনি। বাবা তার লেখালেখির ঘরে নিজের মতো করে থাকেন, সেখানে ঢোকার তেমন আগ্রহ কখনোই তৈরি হয়নি। বরং বাড়ির অন্যদের, এমনকি শাশুড়িকে পর্যন্ত ছাদে উঠতে দেখলেই বাবা যেভাবে তেড়ে আসতেন, দুর্ব্যবহার আর গালাগাল করতেন, সাবিত্রীকে দেখলে তেমন উচ্চবাচ্য করতেন না। সাবিত্রী ইচ্ছে করলে, বিশেষ করে, শাশুড়ির মৃত্যুর পরে দশ-এগারো বছর ধরে বাবার খাবার, গোসল, ওষুধ ইত্যাদির দায়িত্ব পালনের ছুতোয় সে চিলেকোঠায় ঢুকতেই পারতো; যেখানে শাশুড়ির পর্যন্ত প্রবেশাধিকার ছিল না, সেখানে ঢোকাটা তার নিজের জন্যেই লজ্জার। এছাড়া একজন মানুষ নিজের একটি জগৎ নিয়ে আছেন, সেখানে উঁকি মেরে দেখার কী আছে। শ্যামল বৈশ্যের এমন ব্যবহারে সাবিত্রীর মনে সন্দেহ হয়, একটা কিছু রহস্যের বিষয় অবশ্যই আছে। বাবার লেখালেখি গুছিয়ে সংরক্ষণ করার মতো সাহিত্য-দরদি মানুষ সে নয়, কিছু একটা রহস্য আছে তো বটেই।

শ্যামল বৈশ্য যখন নিচে নেমে আসেন, তখন রাত দশটারও বেশি। সাবিত্রীর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল একবাক্যেই মাটি করে ফেললেন। সরি, তুমি কিছু মনে করো না? বাবার বইগুলো গোছাচ্ছি। চিলেকোঠাটাকে একটু পরিষ্কার করছি।

সাবিত্রী চমকে ওঠে, তুমি এগুলো গুছিয়ে কী করবে? বিক্রি করে দেবে নাকি?

ধ্যাত! বাবার লেখা বই আমি ছেলে হয়ে বিক্রি করে দেবো। তোমার এ কি কথা!

সাবিত্রী ঢেঁকুর গেলে, না, তুমি  তো বলতে, বাবা মারা গেলে সব সের দরে বিক্রি করে দেবে। চিলেকোঠা ভেঙে ফেলবে।

শ্যামল বৈশ্য হেসে বললেন, সে তো বাবার ওপরে অভিমান করে বলেছি। সত্যিই তাই করতে পারি নাকি?

আমাকে দেখে এভাবে চিৎকার করে উঠলে কেন? কী পেয়েছো ওর মধ্যে? সাবিত্রী বলে।

আকস্মিক ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে শ্যামল বৈশ্যের সমস্ত শরীর, কিছু না! আরে কিছু না! কী আর থাকবে। বাবা তো লিখেছে গল্প-উপন্যাস। ওখানে তাই আছে। আর কী থাকবে। আর কিছু নেই।

শ্যামল বৈশ্য হঠাৎ নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। দেয়ালে টাঙানো বাবা কৈলাস বৈশ্যের যৌবনকালের একটি ছবির দিকে আঙুল উঁচিয়ে মদ্যপের মতো জড়ানো প্যাঁচানো কণ্ঠে বলছেন, এই লোকটা! এই লোকটাকে আমার মাঝে মাঝে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করতো! শুধু বাবা বলে…

এ কী বকছো? পাগল হয়ে গেলে নাকি! সাবিত্রী সবিস্ময়ে বলে।

না, আমি পাগল হইনি! সত্যিই পাগল হয়নি। এতো ভয় নিয়ে বাঁচা যায় না! চারদিকে ফাঁদ পাতা। সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দেবে, আপস করে আর কদিন টিকতে পারবে, ফাঁদে পা না দিয়ে কী করবে?  তৈরি করা বাড়ি, বাগান, পুকুর এসবের লোভ…

সাবিত্রীর বিস্ময় আরো বেড়ে গেল। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না, কিসের ফাঁদ, আর কে তাড়িয়ে দেবে, কেন এই ভয়ানক ভয়! বাবার  চিলেকোঠায় কি সত্যিই কিছু রহস্য লুকানো আছে? এভাবে ভেঙে পড়ার মতো দুর্বলচিত্তের মানুষ সে নয়। সাবিত্রী পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনার জন্যে স্বাভাবিক আচরণ করে, ওসব ছাড়ো তো, কী পাগলামিতে ধরেছে তোমাকে।

তোমাকে ইমোশনালি ব্লাকমেইল করছি, বলেই হা-হা-হা করে দমফাটা হাসি দিলেন শ্যামল বৈশ্য। বাবার গল্পের ডায়ালগ এসব, ফের একইভাবে হাসি দিতে গিয়ে বিষম খেলেন। তিনি ধরতে পারেন, এই অনর্থক হাসি দিয়ে পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা নিজের ব্যক্তিত্বের জন্যে সম্পূর্ণ বেমানান। এই হেঁয়ালিপনা তার স্বভাবের বিরুদ্ধে, এ করে লাভ হবে না। বরং খোলামেলা হওয়াই ভালো। এই মুহূর্তেই বলে দেওয়া যায়, প্রস্ত্ততিস্বরূপ মনে মনে বলেও ফেললেন, সাবিত্রী, আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি। স্বার্থপরের মতো তোমাদের ফেলে যাচিছ, ক্ষমা করো। কিন্তু বুকের ভেতরে কোনো এক জালে কথাগুলো যেন আটকে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, এখন কেন, কখনোই সাবিত্রীকে জানানো যাবে না। এতোকাল ধরে নীরব একটি আত্মহত্যার পরিকল্পনা বয়ে বেড়াচ্ছেন। দুর্নিরীক্ষ্য কোনো একটি আশা বেঁচে ছিল, এখন সবই ধূলির মতো বাতাসে ওড়ে।

আত্মহত্যার নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন শ্যামল বৈশ্য। তাই প্রলাপ বকছেন, শালাদের খুব দরদ! অসাম্প্রদায়িকতা! অসাম্প্রদায়িকতা!! একজন বেশ্যাও মিনিমাম নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ মেনে চলে, ভোটের লোভে ক্ষমতার লোভে শালারা… ওফ্! আমি শালা সংখ্যালঘু ছেঁচড়! আমাকে ঘাড় ধরে সীমান্তের ওপারে ফেলে আসে না এই তো কপালের জোর। গোপনে গোপনে মানে মানে কেটে পড়লেই দেশটা বাঁচে! বারবার সংবিধান সংশোধন করে আমাকে ফতুর করে দিচ্ছে, ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দখল নিতে শকুনের মতো ছায়া ফেল রাখছে,  তবু শালা আমি দেশকে মা-বাপ মনে করি। আমার জন্যে সবকিছুই করুণা! আমার বাইরেটাই দেখে সবাই, ভেতরে কি রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কেউ দেখতে চায় না। এখন আমি খাঁচায় বন্দি পাখির মতো! না, আমি পালাবো না। না, আমি দেশ ছাড়বো না, কিছুতেই ছাড়বো না! আমাকে আত্মহত্যাই করতে হবে। কৈলাস বৈশ্যের ছেলে শ্যামল বৈশ্য আত্মহত্যার দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের প্রস্ত্ততি শেষে আত্মহত্যা করেছে! এ-খবরটি প্রগতিশীলতার ভেকধারী কিছু পত্রিকা নিশ্চয়ই গুরুত্ব দিয়ে ছাপবে, ওদের নিজেদের স্বার্থেই ছাপবে।

মৃদু অন্ধকার এখনো রয়েছে। সকালের আলো-বাতাস ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশ করছে। সাবিত্রী ঘুমিয়ে আছে। ছাদে পা ফেলেই শ্যামল বৈশ্য চমকে ওঠেন। মনে হচ্ছে, এইমাত্র ছাদে কেউ হেঁটে বেড়িয়েছে। শিশিরের ওপর এলোমেলো পা ফেলার চিহ্ন। তার উপস্থিতি টের পেয়ে হয়তো চলে গেছে। সাবিত্রী কি ছাদে উঠেছিল? কিন্তু যে গভীর ঘুমে মরে আছে, তার পক্ষে আসা অসম্ভব। কে হবে? চিলেকোঠার সামনে দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে ভাবলেন, আত্মহত্যার জন্যে সকালের এই সময়টাকেই বেছে নেওয়া যায়। এই সময়ে সাবিত্রীর ঘুম গাঢ় হয়। এসব ভাবতে ভাবতে চিলেকোঠার তালা খুলে যেই না প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, তখনি কে যেন তার শরীরে বাতাস লাগিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। কে? কে আপনি? সাবিত্রী? শ্যামল বৈশ্যের বুক কেঁপে উঠলো। কঙ্কালটির সামনে দাঁড়িয়ে আরো একবার চমকালেন। কেউ একজন কঙ্কালটিকে নাড়িয়ে গেছে! মানুষ আত্মহত্যা করলে নাকি তার আত্মা দেহের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে। যে-যুবতীর কঙ্কাল, সে কি তাহলে এখানেই আছে, আশেপাশে। কঙ্কালটির শরীর স্পর্শ করতে গিয়েও হাত সরিয়ে আনেন।

সকালে সাবিত্রী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। রাতের সবকিছু ভুলে গেছে বলে মনে হয়। শ্যামল বৈশ্য যে-ধরনের ভয় করেছিলেন, সাবিত্রী বিষয়টিকে ঘাঁটাঘাঁটি করে শেষে তার আত্মহত্যা ঠেকিয়ে দেবে, পরিস্থিতি সেদিকে গড়ায়নি। নাস্তা খেতে খেতে বললেন, আচ্ছা, তোমাকে দেখতাম প্রায়ই বাবার সঙ্গে গল্প করছো, অতীত জীবন সম্পর্কে কি কখনো কিছু বলেছে? অতীত মানে, কোনো প্রেম-ট্রেম এইসব আর কী।

সাবিত্রী হেসে বলে, তোমার কি মতিভ্রম হলো! বাবা কবে আমার সঙ্গে গল্প করলেন? টুকটাক সাংসারিক বিষয়-আশয় নিয়ে কথা বলেছেন। তাও আবার চামচ দিয়ে মেপে এবং আমি জিজ্ঞেস করলে। নিজের প্রেমের গল্প শোনাবে পুত্রবধূকে! বাবাকে এই চিনেছো! কিন্তু কেন বলো তো, হঠাৎ এ-কথা কেন?

শ্যামল বৈশ্য রেগে গেলেন, এই তো, গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়ে গেল! ধ্যাত! নাস্তা অসমাপ্ত রেখেই উঠে যেতে যেতে বললেন, বাবার গল্প-টল্প পড়ে মনে হচ্ছে…। সাবিত্রীও রেগে গেল, ও-কথা বললেই হয়, তুমিই তো রহস্য করছো, রাতে একবার কী সব বলে শেষে নিজেই দাঁত বের করে বললে, গল্পের ডায়ালগ বলছো। এখন আবার বলছো। এখন তো দেখছি, বাবার গল্প আমার সব পড়ে তারপর তোমার সঙ্গে ঘর করতে হবে। নইলে আমি বুঝবো কী করে, কোনটা গল্পের ডায়ালগ আর কোনটা তোমার নিজের কথা! শ্যামল বৈশ্যের পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকতে গিয়ে এই কথাগুলো বলে সাবিত্রী। এবার বৈশ্যের ঠিক নাক বরাবর দাঁড়িয়ে বলে, আচ্ছা, এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাসায় আছো কেন? এর রহস্য কী?

ঘাড়ে কোপ খাওয়া কুকুরের মতো শ্যামল বৈশ্যের ভেতর থেকে কোঁ-কোঁ শব্দ বের হয়। এই মেয়েমানুষটা কেঁচোর মতো, সবকিছু খুঁড়ে বের করে ছাড়বে। ভয় পেয় গেলেন, আত্মহত্যা কী হবে না? আত্মহত্যার পরিকল্পনা কী ফাঁস হয়ে যাবে? এবারো ব্যর্থ!

শ্যামল বৈশ্যের আকস্মিক নীরবতা সাবিত্রীর জন্য অপমানের। খুনির মতো মুখ করে বসে আছো কেন? ছুটি নিয়ে বাড়ি আছো কেন? এবার কোপ-খাওয়া ঘাড়টা যেন ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। রসের হাঁড়ির মতো মাথাটা বুকের ওপরে ঝুলছে। ঝুলে ঝুলেই বললেন, খুনিই তো। আমি তো খুনিই! ঠান্ডা মাথায় নিজেকে যে খুন করতে পারে তার চেয়ে বড়ো খুনি কে আছে?

সাবিত্রী আরো রেগে গেল, আবার গল্পের ডায়ালগ বলছো? এ কী জ্বালায় পড়লাম!

শ্যামল বৈশ্যের ঠোঁটে এবার বিদ্রূপের হাসি, ঠিক ধরেছো। আমরা একটা গল্পের চরিত্র হয়ে গেছি। গল্পকার যেভাবে নির্মাণ করে দিয়েছেন, সেভাবেই চলছি। কী আশ্চর্য এক গল্পের চরিত্র আমরা!

সাবিত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, গল্পের না, নাটকের। শেক্সপিয়রের নাটকের চরিত্রের মতো।

চিলেকোঠার কঙ্কালটিই শ্যামল বৈশ্যের আত্মহত্যার জন্যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দিন এগোচ্ছে আর কঙ্কাল-রহস্য তাকে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। এ-শহরে বাবা কৈলাস বৈশ্যের কারা বন্ধু ছিলেন তার খোঁজ করতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে হরেন সাহার কথা। খোঁজখবর নিয়ে তার ঠিকানা জোগাড় করে বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখেন, হরেন সাহার দমবন্ধ হয়ে গেছে। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষমাণরা সুর করে কাঁদছে। ভেতরে গিয়ে একবার মানুষটিকে দেখে আসবেন কি না এই দোটানা নিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছেন, ঠিক তখনি পিঠে হাত রেখে কেউ একজন বললেন, তুমি কৈলাসের ছেলে, ভুল করছি না, তাই তো? শ্যামল বৈশ্য চমকে পেছনে ফিরে দেখলেন, লোলচর্ম প্রবীণ। তার কাঁপছে শরীর, পা-দুটি কাঁপছে বেশি, তাই শরীরের কাঁপুনি তার নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। প্রবীণকে দেখে শ্যামল বৈশ্যের ভীষণ মায়া হলো। তার সঙ্গে কথা বলার অর্থ হচ্ছে, তাকে কষ্ট দেওয়া। তাই, সংক্ষেপে বললেন, হ্যাঁ, আমি কৈলাস বৈশ্যের ছেলে। আপনি?

আমি, আমি কৈলাসের… এই শব্দ দুটি বলতে গিয়ে যেন বিশাল পাথর নাড়ানোর শক্তি প্রয়োগ করছেন। কিন্তু তিনি কৈলাসের কী হন তা আর বলে উঠতে পারেননি। শ্যামল বৈশ্য তাঁর হাত ধরে একটি চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। কৈলাস তোমাকে কিছু বলেনি? ঘোলাটে জলের মতো পর্দা দুটি চোখে ঢেউ খেলছে। তোমার নাম শ্যামল, তোমার জন্মের পরে চিঠিতে লিখেছিল একবার, তুমিই তো সেই ছেলে। বাবা-ছেলের আশ্চর্য মিল, কৈলাসের নাক-মুখ-চোখ সবই তুমি নকল করে নিয়েছো। একদিনও না দেখে পেছন থেকে তোমাকে চিনতে পারলাম।

লোকটি কে? বাবা সম্পর্কে তার এতো কৌতূহল! বাবা তাকে চিঠি লিখেছেন। শ্যামল বৈশ্য মনে মনে বললেন।

কৈলাস তাহলে তোমাকে কিছু বলে যায়নি? প্রবীণের চোখভরা বিস্ময়।

না, বাবা তার কোনো বন্ধু কেন, নিজের সম্পর্কে কোনো কিছুই বলেননি। শ্যামল বৈশ্য আরো একটু যোগ করতে চেয়েছিলেন। বাবা, আমাদের খুব অপমান করেছেন। মায়ের ওপর খুব অবিচার করে গেছেন। বাবা হিসেবে, স্বামী হিসেবে কৈলাস বৈশ্যের পারফরম্যান্স জিরো। এই কথাগুলো মনে মনে বললেন।

আশ্চর্য শক্তি কৈলাসটার! এতো বড় কষ্ট, এতো বড়ো ঘটনাকে আড়াল করে এতোটা বছর কী করে কাটিয়ে গেল! প্রবীণ বিড়বিড় করে বললেন।

শ্যামল বৈশ্য চমকে উঠেলেন, আপনি? আপনি কি বাবার ছেলেবেলার বন্ধু? পি�জ বলবেন কি, কী ঘটনা ঘটেছিল।

প্রবীণ এবার ক্ষেপে গেলেন, তুমি তো শিক্ষিত ছেলে, তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলে কোনোদিন, তার কী কষ্ট? কী ঘটেছিল সাতচলি�শের পরের কয়েক বছর ধরে। কেন তোমার বাবার ভাইরা দেশ ছেড়ে গেল? অন্তত, এইটুকু তো কৌতূহল জন্মাবার কথা ছিল, কৈলাস কী কারণে একাই থেকে গেল। তুমি কি কখনো বর্ধমানে তোমার জেঠুদের কাছে যাওনি।

না, ওদের সঙ্গে বাবা কোনো সম্পর্ক রক্ষা করেননি। এর বেশি আমি কিছুই জানি না।

আপন ভাইদের সঙ্গে কেন সম্পর্ক রক্ষা করেনি, তোমার কৌতূহল হয়নি, জানতে ইচ্ছে করেনি।

ওরা দেশ ছাড়ছে, তাই বাবা পছন্দ করতেন না।

তোমার এই জানাটা আংশিক, অথবা ভুল।

এই পর্যন্ত আলাপ। এরপরেই বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে এলো এক তরুণ। তোমাকে ডাকছে বলে প্রবীণের হাত ধরে ছাগল টানার মতো হেঁচড়াতে-হেঁচড়াতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। শ্যামল বৈশ্য তরুণটির দিকে তাকিয়ে দুবার প্লিজ প্লিজ বললেন বটে, কিন্তু তরুণের সামান্য ভ্রূক্ষেপও ছিল না। উপস্থিত একজনের কাছে জিজ্ঞেস করে প্রবীণ সম্পর্কে জানতে পারেন, তিনি এখানকার লোক নন, কলকাতা থেকে এসেছেন। কিছুক্ষণ পরেই সেই তরুণটি ছুটে এসে বললো, আপনাকে ঠাকুরদা ভেতরে ডাকছেন, আসুন! বাড়ির যেদিকে হরেন সাহা মৃত্যুর জন্যে প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন, তার বিপরীত দিকে ছোট্ট একটি রুমে নিয়ে গেল শ্যামল বৈশ্যকে। প্রবীণ লাশের মতো টান হয়ে শুয়ে আছেন। শ্যামল বৈশ্যকে সিঁথানে বসতে বলে তরুণকে চলে যাওয়ার জন্যে ইশারা করেন। ধীরে ধীরে কথা শুরু করেন, যে মারা যাচ্ছে, হরেন সাহা, সে আমার বন্ধু, আবার খুড়তুতো ভাইও। আমরা এক বয়সের। কৈলাস-সুব্রত-সনৎ ওরা সবাই চলে গেছে, আজকে যাচ্ছে হরেন, এরপর আমি। বলে টানা লম্বা একটি শ্বাস ফেললেন প্রবীণ। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে শ্যামল বৈশ্য পিঠে হাত দিয়ে বসিয়ে দিলেন।

কৈলাস তোমাকে কিছুই বলে যায়নি! এ কী করে হয়? এটি আমার কাছে রহস্য ঠেকছে। লোকটির নিশবাসে টান ধরে, বুকের ভেতরে যেন বাতাস দিয়ে ফারাক্কার মতো কঠিন বাঁধ তৈরি করা, সেই বাঁধে আটকে যাচ্ছে সব কথা। তাহলে ওকে কার কাছে রেখে গেল!

শ্যামল বৈশ্য আঁতকে উঠলেন, কাকে? কে সে?

তুমি জানো না! তোমাকে কিছুই বলে যায়নি!

না, বাবা কিছুই বলে যাননি। মৃত্যুর মুহূর্তে ছটফট করেছিলেন কিছু একটা বলার জন্যে, কিন্তু ভাষা পাচ্ছিলেন না।

তাহলে ফাল্গুনীকে কোথায় রেখে গেল!

ফাল্গুনী! কে ফাল্গুনী? শ্যামল বৈশ্য দাঁড়িয়ে পড়লেন।

তোমার পিসি, আগুনের মতো রূপবতী ছিল। কৈলাসের ছোট ছিল।

অসম্ভব! বাবার বোন ছিল আর আমি জানবো না, অসম্ভব! আমি কেন জানবো না? বাবা লুকাবেন কেন?

কেন লুকাবেন!  লোকটির চোখে-মুখে ঘৃণা আর ক্রোধ। কেন লুকাবেন? ছেলে, এই ইতিহাস, বাঙালির এই আত্মঘাতী ইতিহাস তুমি জানো না! দেশভাগের হিড়িকে মান-সম্মান নিয়ে বাঁচার জন্যে বাবা তার যুবতী মেয়েকে নাই করে দিয়েছে, ভাই নাই করে দিয়েছে তার যুবতী বোনকে। আবার, মেয়ে নিজেই বাবা-ভাইকে বাঁচার পথ তৈরি করে দিয়েছে। ঘরের মেয়ে-বউকে একবার ঘর থেকে বের করে নিলে তাকে আর ঘরে তোলা হয়নি। পাশবিক দংশনে ক্ষতবিক্ষত শরীর-মন নিয়ে এরা অন্ধকার জীবন বেছে নিয়েছে। এই হিংসার ইতিহাস তুমি জানো না! এই ঘৃণার ইতিহাস তুমি জানো না, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! নাকি জেনেও পালিয়ে বেড়াচ্ছো? আমি ওখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, আর তুমি এখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছো! এই ইতিহাসের শেষ হবে কোন প্রজন্মে? বলতে পারবে? প্রবীণের চোখে অন্ধকার নেমেছে। সামনে হাত বাড়িয়ে খোঁজেন শ্যামল বৈশ্যকে। কিন্তু ততোক্ষণে শ্যামল বৈশ্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন।

শ্যামল বৈশ্যের ইচ্ছেটাই পূরণ হয়। তার আত্মহত্যার খবরটি প্রগতিশীল দৈনিকগুলো গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে।