গল্প হত্যার লঘু-গুরু

মামুন হুসাইনGalpha Hottar Lagu Guru

একদিন খুব প্রত্যুষে ঘণ্টা বাজছিল – ধারণা হলো এখানে নিশ্চয় কোনো গ্রাম আছে এবং ঘণ্টা বাজিয়ে তারা এখন প্রার্থনার ভেতর অস্তিত্ব আবিষ্কার করার কাজে ধ্যানমগ্ন। আমি ভেবেছি – আমার কি তবে কখনো ভয় হয়? যেমন – কেউ জাদু করল, অথবা জোর করে পামিস্ট্রি করতে চাইছে, অথবা নিখোঁজ গুলি উড়ে এলো, অথবা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়ার জন্য দরিদ্র-পুলিশ আমার মরা দেহ বাঁশে ঝুলিয়ে অনেকদূর হেঁটে, ফটোসেশন শেষে, নিঃসঙ্গ ভাঙা গাছের ছায়ায় চা খেতে-খেতে লাশ ফেলে চলে গেল, যেন মা সঠিক উপায়ে লোকগীতি রচনা করতে সক্ষম হন। মনে পড়ল, পত্রিকার রাশিফল দেখে বৃশ্চিক রাশির জাতক হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম অনেককাল আগে। বৃশ্চিকের ইংরেজি নামটিও শিখেছিলাম। শিখেছিলাম এরা বিপদাপন্ন হলে, ধড় উঁচু করে, আর ভাঙা শুঁড় গুঁড়িয়ে গেলেও অবশিষ্ট বিষ ছড়িয়ে দেয় আক্রমণকারীর হাতে-পিঠে। বিষয়গুলো মাথায় রেখে একবার ভাবি – আমার কি তবে ভীত হওয়ার কোনো কারণ তৈরি হচ্ছে সত্যি-সত্যি? নাকি জগৎখ্যাত লেখকের মতো বলতে পারছি আমার অন্তর্গত-স্করপিওন বিষ ছড়িয়ে দিলেই আমি কেবলমাত্র লিখতে পারি? ‘স্করপিওন’ খুঁজতে খুঁজতে ডিকশনারির গায়ে হঠাৎ ‘ক্র্যাব’ দেখি এবং স্ত্রীর কারসিনোমা-সার্ভিক্স আমাদের বোধগম্য করার জন্য চিকিৎসক কেন সেদিন ওই দুটি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, তার খানিকটা আন্দাজ পাই। ব্রেকিং ‘ব্যাড নিউজ ইজ অ্যান আর্ট’ –  চিকিৎসা বিভ্রাটে ভুগতে ভুগতে চিকিৎসকের শিল্পবোধ নিয়ে আমাদের তখনই কথা বলা হয় না। কারণ কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির স্রোত এসে আমাদের ঘর, ডাইনিংরুম, কাপড় মেলে দেওয়ার তার, পুরনো কয়লা, কফি মগ, রান্নাঘরের জানালা এবং স্ট্রিটল্যাম্প প্লাবিত করে দেয় অচিরেই। বুঝতে পারি – মেয়ের সঙ্গে আমার একটি আশ্চর্য মিল আছে, মাতৃবিয়োগ হয়েছে আমাদের দুজনেরই। গত বছর এই তারিখে, আমার মা ছেড়ে গেছেন, এ-বছর ঠিক একই তারিখে তোমার মা! আমার কন্যা কি কখনও বুঝতে পারে, ওর বাবা সামান্য আলাদা; বৃশ্চিকের বিষ ভর করলে, বাবা মাঝে-মাঝে উবু হয়ে কীসব লেখে কাগজের জন্য? ওর মায়ের মৃত্যুর পর আমার চেষ্টা ছিল, আর একটু ভালো বাবা হওয়া যায় কিনা। চেষ্টা করেছি, ওর মায়ের মতো আচরণ করতেও; হয়তো তা ছিল আমার শ্রেষ্ঠ ভুল, আমার সমস্ত শক্তি-ইচ্ছা নিবেদিত হয়েছিল মাতৃহীনা কন্যার জন্য। আমি কদাচিৎ বাইরে বেরুতাম, বন্ধু সংসর্গ কমিয়ে ফেলি, ভ্রমণ ভুলে যাই, লেখা ভুলে যাই এবং কেবলই ঘরের কাজে নিমজ্জিত হই। ওর কাপড়, বিছানার চাদর, ওর খাবার, লাঞ্চবক্স, হোমওয়ার্ক গোছাতে গোছাতে একখন্ড মুখস্থ-মানুষে রূপান্তরিত হই। কিন্তু এতকিছুর পরেও, … মাই চাইল্ড ওয়াজ নট হ্যাপি; … তুমি সারাদিন কেন ঘরের ভেতরে কাটাও, … আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও না কেন একদিনও, … আই অ্যাম মিসিং মাই মাদার অ্যান্ড ফাদার অ্যাজওয়েল অ্যাজ!

মেয়ে স্কুলে গেলে ঘরজুড়ে অবশ, ভোঁতা এক ধরনের সাদা নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে। আবার তক্ষনি কাচের স্লাইডিং জানালায় অচীন এক জোড়া কাক-চড়ুইয়ের ছায়া আসে, অথবা তৈরি হয় ডিলুশান অফ ডাবলস। সারা সকাল-সারা দুপুর পক্ষীকুল মিছেমিছি তাদের কাচের শরীর ঠুকরে চলে। ফলে ঘরের নীরবতা এবং বাইরের একঘেয়ে শব্দ কেমন আচ্ছন্ন করে রাখে। আমি কি তবে ভীত হয়ে পড়ছি? – মেয়েটির দরকার ছিল একজন বাবার, আর আমি হয়ে উঠেছিলাম একজন শোকতপ্ত মানুষ; যে-মানুষটি ভয়ে ছিল, যেনবা সে যুক্তি এবং বুদ্ধি হারিয়ে ফেলছে, যেন সে অসুস্থ হয়ে পড়ছে, মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে; আর হারাতে বসেছে সবকিছু – ঘর, কলম, বইপত্র, লেখাপড়া এবং তার প্রিয় কন্যাটিকেও। মেয়েটি স্কুলে যাওয়ার পর, ঘরজুড়ে যে নীরব-ঠান্ডা-সাদা স্রোত নামে, তাতে সাঁতার দিতে দিতে বৃশ্চিক রাশির লোকটি এসবই ভাবছিল, আর হঠাৎই আবিষ্কার করে – একটি গোপন বিষ স্করপিওনের মৃত বুক-পেট থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে সাদা কাগজের শরীরে।

এর অর্থ কী, লেখা তৈরির গোপন প্ররোচনা চুইয়ে পড়া? লোকটি বহুদিন পর মেয়ের স্কুলে যাওয়ার সুবাদে তৈরি অনুপস্থিতি এড়ানোর জন্য ঘরটা অাঁটো করে হাঁটতে এলো। রাস্তায় ডাঁই হয়ে থাকা বালির ওপর শিশুরা স্বরবর্ণ, পাখি এবং সূর্য অাঁকছিল। একটি কাক গোপন হত্যাকান্ডের রক্ত জমে থাকা পলিপ্যাক নিয়ে গম্ভীর-সাহসী পদক্ষেপে হাঁটছিল, আর রাস্তাজুড়ে রক্তের অবশিষ্ট রঙে কাকের ঠ্যাঙ ও বকের ঠ্যাঙ তৈরি হচ্ছিল। লোকটি এসব দেখছিল, আর হঠাৎ অনুভব করল – কে যেন ক্ষুধা, বৃষ্টিপাত, ভেঙে পড়া রেললাইন এবং আগুনে বোমা নিয়ে কথা বলছে। ‘চায়না পিকটোরিয়াল’ এবং ‘… অ্যাসেজ অন মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স’ থাকার জন্য যে-ভদ্রলোকের বাড়ি ১৯৭৩-এর অক্টোবর নাগাদ তল্লাশি হয়েছিল, তার সঙ্গে দূর থেকে দৃষ্টি বিনিময় হলো – লোকটি স্ট্রোকের পর সামান্য পা ঘষটে হাঁটছিল। তখন ট্রাফিকের নিষিদ্ধ আলো জ্বললে, সমস্ত গাড়ি বাধ্যতামূলক মৌনব্রতে আক্রান্ত হয়। এই সুযোগে দুজন বিপজ্জনক পথশিশু হাত বাড়িয়ে গাড়িতে আটক জনৈক সিভিল সোসাইটির সুদৃশ্য প্রতিভূকে নাছোড় করলে, শিশুরা দশ টাকা সম্মানী পায়। জানালা নামিয়ে কালো চশমার আড়াল থেকে তিনি উপদেশ পাঠান, .. শোন, দুজন ভাগ করে নিবি।… ট্রাফিক সরে গেলে রাস্তা আবার এত চঞ্চল হয় ওঠে যে, শিশুদের সমবায়ী প্রকল্প কিংবা সমবণ্টনের অঙ্গীকার মুহূর্তে বাতাসে মিলিয়ে যায়। লোকটি আকাশ দেখল এবং সময় আন্দাজ করার চেষ্টা করল। কাঁঠালপাতাভর্তি একটি বামুন-লরি ধুলো উড়িয়ে চলে গেলে সে ভাবল, সামনের মুদি দোকান থেকে কিছু একটি কেনা যায়। ভেবে-ভেবে সে সোনামুগ কিনল, মিছেমিছি একজোড়া সাবান কিনল এবং সূর্যমুখী তেলের দামদর করল। দোকানি তাকে বসতে বলে। কিন্তু সে দাঁড়িয়ে থাকে, অথবা দোকানটা ঘুরে-ঘুরে দেখে। একট ইঁদুরছানা সাবানের রাজ্য থেকে মুখ দেখিয়ে চলে গেল তেজপাতার অরণ্যে। বড় একটি কাগজের প্যাকেটে সওদাগুলো সাজানো হলে, সে হাঁটতে থাকে বাড়ির দিকে আর সামান্য সময়ের জন্য মনে হলো, স্কুলে কন্যার শেষ পিরিয়ড চলছে। এতক্ষণে সে কাগজের প্যাকেটে চোখ ঘোরায় – পুলিশ কমিশনারের আদেশ; গেজেটে ছাপা হওয়া তথ্য কখন ঠোঙা তৈরির কারিগর বরাবর পৌঁছে গেছে, কে জানে? সওদাগুলো টেবিলে ছড়িয়ে সে পড়তে শুরু করে : শহরে সাংঘাতিক হিংসাত্মক ঘটনা আকস্মিকভাবে দেখা দেওয়ায় এবং যখন-তখন পুলিশের ওপর আক্রমণ, বিশেষ করে জঙ্গি মনোভাবাপন্ন চরমপন্থীদের দ্বারা পুলিশের ওপরে আক্রমণ হওয়ার ফলে পুলিশের অনেক কর্মীকে আত্মরক্ষার জন্য তথা অপরের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য হয় আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া হয়েছে অথবা আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগের জন্য শেষ পন্থা হিসেবে এবং একান্ত অপরিহার্য পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলি চালাতে পারে। যেসব অফিসার এবং কনস্টেবল কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে থাকেন তাঁদেরকে কর্মস্থল হতে এমন সময়ে ছাড়তে হবে যেন তাঁরা সন্ধ্যার পূর্বেই তাঁদের বাড়ি পৌঁছাতে পারেন। কোনো স্থানে দুজনের কম লোককে পাঠাবেন না এবং তাঁদের মধ্যে একজন সশস্ত্র থাকবেন, কর্তব্যরত না থাকার সময় সন্ধ্যার পর যতটা সম্ভব চলাফেরা বন্ধ করা উচিত। তাঁদের পরিবারের লোকেরা, বিশেষ করে শিশুরা যেন তাদের পিতার পেশা সম্পর্কে কোনো কথাবার্তা না বলে। সিনেমা ইত্যাদি অনুষ্ঠানও পরিহার সম্পর্কে যথেষ্ট সজাগ থাকা দরকার। এই ব্যাপারে যদি পরিবারের লোকেরা পীড়াপীড়ি করেন, তাহলে বর্তমানের এই বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁদের এই সাধারণ শখ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য চেষ্টা করা উচিত।… আমরা সকলেই যেন সাবধান ও সতর্ক থাকি এবং ধীর, সুস্থির, অনুত্তেজিত, বিচক্ষণ এবং কৌশলী হই।…

আমাদের বৃশ্চিক রাশির জাতক, এই পর্যন্ত পাঠ করার পর থামতে বাধ্য হন, কারণ পরের বাক্যসমূহ ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেছে ঠোঙার আঠায়, অথবা ঠোঙা তৈরির অদৃশ্য কারিগর বাক্যসমূহ মহাশূন্যে বিসর্জন দিয়েছেন ভবিষ্যৎ পাঠচক্রের সকল সম্ভাবনা বিস্মৃত হয়ে। লোকটি তার পড়ার টেবিল অথবা লেখার টেবিলে বসে থাকে। অনেকক্ষণ বসার পর তার মনে এলো – যদিবা মেয়েটি কখনো জ্বরে আগাম স্কুল থেকে ফিরে আসে, আমাকে ডাক্তারের জন্য দৌড়াতে হবে নিশ্চয়। নাকি আমি প্যারাসিটামল খাইয়ে লেমোনেন্ড এবং ডায়জেস্টিভ বিস্কিট আনার জন্য বাইরে ছুটব? তখন থার্মোমিটার দরকার হবে, কারণ টেমপারেচার চার্ট ইজ আ মাস্ট! জ্বর মাপার এক ফাঁকে জানালা খুলে দেব আমি। হয়তো কান্নার মতো মুখ হবে আমাদের। বাথরুম-বেডরুম পরিষ্কার করে, ওর স্কুল ড্রেস বাতাসে ঝুলিয়ে দেব। আর তখন হয়তো জানালা দিয়ে লম্বা একটি ফুলের ছায়া ভেসে এলো। ফুলের গোছাটা যেনবা দ্রুত হলুদ হতে শুরু করল। ফুলের হলুদ-সমুদ্র দেখতে-দেখতে মিছেমিছি কন্যার ডেস্ক ল্যাম্প বন্ধ করে, চা ছলকে যাওয়া দাগ দেখি। হয়তো মৃদু ঝিমুনি। কিছু একটা নাম মনে আসছে। খানিকটা রং, শব্দ এবং দিন শুরু হওয়ার নতুন গন্ধ। একটি ভালো দিন। একটি কাজের দিন এবং একটি সঠিক দিন। মাকড়সার জালে কোনো একটি পোকা আটকে ঘরের ভেতর নতুন শব্দ ছড়িয়ে চলেছে। জালে পোকার পাখনা জড়িয়ে যাওয়ার তীব্র ঝিমঝিম শব্দে মাথায় অস্পষ্ট ব্যথা আসে। ব্যথার ওষুধ চিবুতে-চিবুতে দেখি –  বাগানের আঁধার-ঘাসের রাজ্যে প্রাক্তন উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুদৃশ্য-কুকুর কামড়ে একটি বেওয়ারিশ বেড়ালকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে, অথবা তৈরি করেছে এক নেয়ার ডেথ এক্সপেরিয়ান্সের আবহ। মুমূর্ষু শরীর টানতে-টানতে বেড়াল এসেছে লোকটির চোখের গোড়ায়, যেন তার প্রতি মার্সি-কিলিং করে আমাদের লোকটি। বেড়ালটিকে কি তবে মৃত্যু-যন্ত্রণা এড়ানোর জন্য আমার হাতে হত্যা হতে হবে? বোঝা যায় – রক্তের ভেতর ডুকে থাকা হতদরিদ্র বেড়ালটিকে কেউ হাসপাতালে পৌঁছাতে ইচ্ছুক নয়। লোকটি গৃহপালিত পশুর ইউথ্যানেসিয়া নিয়ে বাক্য তৈরির উত্তেজনা ভাবতে-ভাবতে বিছানায় গড়িয়ে নেওয়ার ইচ্ছে আনে মনের ভেতর। বিছানায় ডুবে যেতে-যেতে তখন কন্যার ইউনিফর্মের গন্ধ আসে যেন। আর হঠাৎই সে বন্ধ চোখের নিচে দু-দশটি স্করপিওন হাঁটতে দেখে – ভীত উদ্বিগ্ন নিরুপায় বৃশ্চিকের দঙ্গল মুমূর্ষু অবস্থায় বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর রক্ত এবং মস্তিষ্কে সেই আকাঙ্ক্ষিত বিষ ছড়িয়ে গেলে তার বহুদিন পর লিখতে ইচ্ছে হয়, অথবা তখন তার ঘুম আসে এবং ঘুমের ভেতরেই লেখার অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হয় ধীরে ধীরে।

শহরে এরকম এক মনোরম-মনোটোনাস দিনযাপনের কালে আচমকা ঘটনাটি ঘটে এবং বৃশ্চিকশাসিত লোকটি বহুদিন পর হঠাৎ লেখার অনুরোধ পায় তার পুরনো বন্ধুর কাছ থেকে। বন্ধুটি সাপ্তাহিক যোগাযোগের যুগ্ম-সম্পাদক এবং দূর ইউরোপের কোনো শহরে স্ত্রীকে আইভিএফ প্রকল্পে আটক করে মৃদু-নিঃসঙ্গতার উত্তাপ অনুভব করছেন অনেককাল। মৃত বৃশ্চিক কি তাহলে সত্যিই বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে রক্তের গলিঘুঁজে? আর এজন্যই কি সে লিখতে চাইছিল, না এসবই ছিল বন্ধুকৃত্য – শহরে খবরটি ততক্ষণে ছড়িয়ে গেছে :

বৃহস্পতিবার বিকেল ৫.১২। মাননীয় ন্যায়পাল গাড়িতে যাওয়ার সময় নিশ্চিন্তিপুরের মোড়ে জনসমাবেশের উদ্দেশে হাত নেড়ে হাসি-হাসি মুখে সম্ভাষণ বিনিময় করছিলেন। কেউ কেউ নিরাপত্তারক্ষী আড়াল করে তাঁর হাত স্পর্শ করার সুযোগ পায়। কিন্তু জনৈক বাসেত হাওলাদার ন্যায়পালের বুক এবং কাঁধে আচমকা এলোমেলো ছুরি চালালে, নিরাপত্তারক্ষী তাকে আটক করে। এদিকে ন্যায়পালকে দ্রুত নিবিড়-পরিচর্যার আওতায় আনা গেলেও তিনি শঙ্কামুক্ত নন কোনোভাবেই।

সারাদেশজুড়ে এই খবরের উত্তেজনা ছড়িয়ে যায় – নিতান্ত সাধারণ বৃত্তির একজন অজ্ঞাত মানুষ কেন মাননীয় ন্যায়পালকে আঘাত করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ? মিডিয়ার লোকবল ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ছড়িয়ে দিয়ে তাকে ঘেরাও করে – আপনি কেন তাঁকে হত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করেন সেই বিকেলে? নাকি কোনো দুষ্টুচক্র বা গোপন নিখোঁজ কোনো সংগঠন আপনাকে নিযুক্ত করেছিল? মুহুর্মুহু প্রশ্নে জনাব বাসেত হাওলাদার খুব অবিচল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন – এর অর্থ, আমি জানি না। এক্সক্লুসিভ একটি স্টোরি আবিষ্কারের জন্য যোগাযোগ সম্পাদক তক্ষুনি আমাদের পূর্বপরিচিত বৃশ্চিক রাশির জাতককে আবারো ফোন করেন। ফোনের ওপারে বন্ধুকে স্টোরি তৈরি সম্পর্কে আশ্বস্ত করার উদ্যোগ নেয় লেখক। কিন্তু মগজের ভেতর সত্য কথাটা আসে খানিক পরেই – বন্ধুকে বলতে ইচ্ছা করে, আসলে আমার লেখা তৈরির আকাঙ্ক্ষা-উদ্যম তোমাদের তুলনায় অনেক কম; এত তীব্র সংকোচ থাকে যে অধ্যবসায়ী হওয়ার সুযোগ দ্রুত মিলিয়ে যায় মলিন বাতাসে; আর আমাদের ওপর অভিশাপ আছে, যেন কখনই কোনো সামাজিক সফলতা জয়যুক্ত না হয়। বন্ধুকে বাধ্যতামূলক বক্তৃতা শোনার প্রকল্পে আটক করার পর লেখক এবার বাসেত হাওলাদারের ঠান্ডা চাউনি মনে করতে পারল। বলা যায়, সে হাওলাদারের চোখ থেকে সূর্য এবং নীল-ধূসর ধোঁয়ার জাল উড়তে দেখেছিল। তার চোখের ভেতর কোনো আনন্দ বা লোভ খুঁজে পাওয়া গেল না, লোকটি কি আদালতের সামনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করবে? আদালতপাড়ায় সবচেয়ে সৃজনশীল প্রতিবেদক, লোকটি যখন প্রিজনভ্যানে উঠবে, তখন হয়তো লিখবে – এই লোকটি ছিল অবসন্ন, লোকটির ভেতর ছিল এক ধরনের অহংকার, খানিকটা রুগ্ণ এবং যন্ত্রণাকাতর। লেখক হাওলাদার-পরিবারের লোকজনকে দেখতে পায় কাগজে, ছবিতে এবং তাদের গাঁয়ের উঠোনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তাকে হঠাৎ-ক্রোধের কারণ সম্পর্কে ইশারা দেয় – ‘ফ্রাস্ট্রেশন-অ্যাগ্রেশন’-এর তত্ত্ব দিয়ে; তুমি এভাবে মানুষের ক্রোধ ব্যাখ্যা করতে পারো। কখনো মানুষ শব্দদূষণ, হট্টগোল, লাগাতার ব্যথার অনুভূতি; কিংবা প্রতিনিয়ত টেলিভাইজড ভায়োলেন্স দেখেও অ্যাগ্রেশন শিখে ফেলে। লেখক স্টোরি তৈরির এপিগ্রাফে এসব উদ্ধৃতি রাখার পরিকল্পনা করে। লেখক ভাবে, লোকটি কি কোনো তীব্র মনোবৈকল্যে ভুগছিলেন ভেতরে-ভেতরে? যেমন, তিনি হয়তো বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছিলেন, শৈশবে ছিলেন তীব্র চঞ্চল, তার ছিল স্বাভাবিক আচরণবিধি প্রতিপালনের সমস্যা, তার ছিল সিজোফ্রেনিয়া, নেশাসক্তি এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশের তীব্র জটিলতা! নাকি আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত তার পূর্বের জীবনাচরণ এবং অভিব্যক্তি? আমরা কয়েকজন প্রতিবেদক অনেক ভেবে একটি তালিকা তৈরি করি তার আচরণের ভয়ংকরত্ব বুঝবার সম্ভাব্য চিহ্ন খোঁজার জন্য; হতে পারে লোকটি তার বেড়ে ওঠার কালে এরকম কতিপয় নমুনা তৈরি করেছিল ভবিষ্যতের হত্যাকান্ড ঘটানোর পূর্বাভাস হিসেবে –

– সকল সময়ে সে ছিল তীব্র মারমুখো

– প্রকাশ্যে সে সবাইকে হুমকি দিয়ে বেড়াত

– এই ঘটনার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল

– দুর্যোগ তৈরির জন্য তার ছিল প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র

– প্রায়শ সে নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে পড়ত

– অত্যন্ত আনন্দ নিয়ে অন্যের ওপর জুলুম এবং আক্রমণকে উপভোগ করত

– তার কোনো সহমর্মিতা ছিল না

– প্রতিমুহূর্তে সকল প্রতিষ্ঠান এবং কর্তাব্যক্তিদের ওপর ছিল তীব্র ঘৃণা

– শৈশব ছিল তীব্র বঞ্চনাময়

– ঘরে-বাইরে তার ছিল তীব্র অনাদর এবং অবহেলা

– অতি শৈশবে বাবা-মায়ের মৃত্যু

– যত্রতত্র আগুন লাগানো এবং বিছানায় প্রস্রাব করার অভ্যাস

– অসম্ভব ক্রুদ্ধ হয়ে সে প্রাণীদের ওপর চড়াও হতো

– পূর্বে ভয়ংকর আরো সব দুর্যোগ তৈরির ঘটনা

– বিপুল বেসামাল গাড়ি চালানোর অভ্যাস

– বিবাহিত সঙ্গীর অকালমৃত্যু

– বিবাহবিচ্ছেদ

– জোরপূর্বক কর্মচ্যুতি

– জেল-হাজতবাস

– যৌনজীবনে অসফল-অসুখী

– অবসর জীবনের নিঃসঙ্গতা

– দেউলিয়া হওয়া

– অথবা, তার ছিল নিরাময়হীন এক মরণব্যাধি

কিন্তু আমরা প্রতিবেশী এবং আত্মীয়বর্গের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি – হাওলাদার আর সবার তুলনায় ছিলেন খুব বেশি রকমের নিরাপদ, নিরীহ এবং সম্ভ্রম উদ্রেককারী মানুষ। খানিক কৃষিবিদ্যা, খানিক শিক্ষকতা নিয়ে তিনি ছিলেন নিতান্ত একজন সহজবুদ্ধির মানুষ। বাট হোয়াই হি অ্যাটেম্পটেড অ্যান হোমিসাইড? হতে কি পারে, পুরো দেশের হয়ে, রাষ্ট্রের অচল-অসম্ভব পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন তিনি? কিংবা অ্যালট্রুয়েস্টিক সুইসাইড বলে একটি ভাষা আছে প্রতিবাদের, তিনি কি কখনো এ-বিষয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন? আমরা জবাবটি তখনই জানতে পারি না। আমাদের মৃদু ভয় হচ্ছিল, তাকে এই মুহূর্তে তীব্র ইন্টারোগেশন পাড়ি দিতে হচ্ছে। পুরনো
বই-পুস্তকে আমরা আটক-মানুষের অত্যাচারিত হওয়ার দীর্ঘ বিবরণী পাঠ করে হাওলাদারের জন্য বেদনা অনুভব করি। ঢাকা অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে –  স্টোরি এখন কদ্দুর? বৃশ্চিক রাশির লেখক ফোন মিউট করে রাখে, অথবা হঠাৎ সামান্য কথা বলে অন্য কিছু ভাবে। হয়তো মেয়ের অসুখের কথা, মেয়ের হোমওয়ার্কের কথা, মেয়ের বালক-বন্ধুর কথা এবং মেয়ের সুযোগ্য বাবা না হয়ে ওঠার কথা নিয়ে তখন সে গল্প লেখার অনুপান জমা করে। হয়তো সে লিখতে চায় সত্য এবং স্বাধীনতা মিশিয়ে। সবাই যা বলে, যা ভাবে, যা লেখে – সত্য থাকে এর বাইরে; আর সত্য কথাটা বলার স্বাধীনতাও তা-ই জরুরি। বৃশ্চিক রাশির লেখক কাগজে লেখে – এখন কথা বলা ভয়ংকর বারণ, এখন চোখের সামনে ঘটনার পর ঘটনা, এখন ঘুমের ভেতর হেঁটে বেড়ানোর কাল, এখন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দুঃস্বপ্ন দেখার সময়,… তাই কেউ-কেউ আমরা পদ্য আক্রান্ত হয়ে পড়ি রাষ্ট্রের কোনো অনুমতি ছাড়াই! লেখকের অনুভব হলো। সে হাড় ও রাবার পোড়ার ঘ্রাণ পাচ্ছে। বড় একটি রেল এবং কাপড় তৈরির কল গত একমাস ধরে চিতার মতো সার্বক্ষণিক জ্বলছে! কাপড়, সুতো, মাংস, পেট্রোল এবং রক্ত পোড়ার আগুনে সে চারপাশে কবরস্থানের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল। মসজিদের মাইকে যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ ভেসে আসছে তখন, আর মৃদু ঘণ্টাধ্বনি বাজছে, আর তার অনুভব হলো  – আত্মা ভেতরে-ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছে। ষোলোটি বাসের ১৬ x ৫২ জন মানুষ এইমাত্র পুড়ে চিরকালীন কার্বন-সাম্রাজ্যে প্রবেশ করল। তাদের কফিন ভেসে যাচ্ছে পালতোলা নৌকার মতো। দু-একটি লাশ জলে ঝরে পড়েছে – এদের জিভ বা গলা নেই। অনুভব হয় মৃত্যু বেরিয়েছে এক বিপুল পরিভ্রমণে। মৃত্যুর দৃষ্টিতে সবুজ অথবা বেগুনি আলো। সেই মৃত-আলো আমাদের শোয়ার ঘরে; অথবা অবহেলায় পড়ে থাকা আমাদের সেই মৃত্যু-সুচ এখন খুঁজে চলেছে এক অলৌকিক-দীর্ঘ-মায়াবী-হলুদ-ঝলমল সুতোর স্রোত।

বৃশ্চিক রাশির লেখক পালতোলা নৌকার মতো কফিনের স্রোত দেখতে-দেখতে সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিল। এরকমটি সে ভাবল আরো দু-একবার ঘটেছে – যখন জাগরণ থেকে টুপ করে ঘুমের রাজ্যে ঝরে পড়ছি; অথবা ঘুম থেকে জাগছি, পুরো জাগরণ হয়নি, কিন্তু নিদ্রারাজ্য আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে; ঠিক তখন কেউ তাকে পরামর্শ দেওয়ার মতো, খানিকটা প্রশ্রয় নেওয়ার ভঙ্গিতে কথা বলে –  যখনই আপনি আমার সঙ্গে কথা বলেন, তখন মনে হয় আপনি ভুগছেন মৃত্যুব্যাধিতে। গোড়ায় এই অসুখের নাম আমার মনে হয়নি। আপনি জিজ্ঞেস করলেন : মৃত্যুব্যাধি কেন প্রাণঘাতী? আমি বললাম : কারণ, যখনই কেউ এই অসুখে পড়ে, সে কোনোভাবেই জানতে পারে না, আর এমন কোনো লক্ষণ ফোটে না, যা দেখে ক্লিনিসিয়ান আপনাকে অ্যালার্ম করবেন। কেবলমাত্র আপনিই ওর একমাত্র বাহক। আর একটি বড় কারণ, এমন এক পরিস্থিতিতে লোকটি মারা যায়, যখন মারা যাবার ঘটনা তৈরির মতো কোনো জীবন তার জন্য অবশিষ্ট থাকে না; আর সে মৃত্যুবরণ করছে, এই কথাটিও সহসা বুঝতে পারে না।

লেখক দুধের ভেতর কফি ছড়িয়ে, কফি ও দুধের মিলিয়ে যাওয়া জগৎ দেখতে-দেখতে নতুন এই ব্যাধির কার্য-কারণ পাঠ করছিল। গত দুদিন মেয়ের সঙ্গে কথা হয়নি, অথবা আমরা কথা এড়িয়ে গেছি। গত দুরাত লোকটি তার কন্যাকে কেবল দূর থেকে দেখেছে, আর কন্যাকে এবং নিজেকে সে বুদ্ধি জুগিয়েছে অনর্গল –  দেখো, নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করা আর সত্যিকারের নিঃসঙ্গ হওয়ার মধ্যে ঠিক তফাৎ তুমি এখনো করতে পারোনি। অনেক দিন আগে তোমার আনন্দিত চোখ দেখেছিলাম একবার। এই দুদিন তুমি নিশ্চয় অনেক কবার ঘরের এমাথা-ওমাথা হেঁটেছ। হয়তো হাঁটাটা কখনো হয়েছিল বিছানা বরাবর। তুমি কান্না করেছিলে। কখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলে। বিছানায় শুয়ে থাকা কন্যারা ঘুমের ভেতর কী ভাবে, সব কি বুঝতে পারি? কন্যাটি হয়তো ফিরে যেতে চায় তার শরীরের ভেতর। বাবা এসে দেখে মেয়েটি ঘুমুচ্ছে, জাগায় না তাকে। মনে হয় বিছানা থেকে লেবু এবং হালকা পার্পল রঙের সুগন্ধ ভেসে আসছে। যতই তার ঘুমের রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকে, ততই একখন্ড বিষাদ ক্রমে-ক্রমে ঘরের ভেতর ডালপালা ছড়িয়ে দেয়। মাতৃহীনা মেয়েটি একবার মেঝেতে ঘুমোয়, একবার ডিভানে, একবার বিছানায়, আর একবার হয়তো ঘুমোয় হেঁটে-বেড়ানোর সময়। লোকটি প্রিয় কন্যার ঘুমন্ত পায়ের কাছে দাঁড়ায়। লোকটি কন্যার মসৃণ ঘুম দেখে। লোকটি কন্যার আলো করা মুখ দেখে। তারপর অনুভব হয় সেই অসুখটি তাঁর শরীরের চোখ অবধি পৌঁছে গেছে। বলা যায়, এর বিস্তার এখন গলার স্বর ছুঁইছুঁই। কন্যা কি ঘুম-ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করবে, বাবা তোমার কী অসুখ? লোকটি জবাব প্রস্ত্তত রাখে – ঠিক বলতে পারছি না মা, এক্ষনি। পত্রিকা অফিসের ফোন আবার তাকে তাগাদা পাঠায়। সেলফোনের শব্দ কন্যার সঙ্গে বাক্যালাপ চূর্ণ করে তাকে অনেক সময় পর্যন্ত ন্যালাভোলা করে রাখে। আমাদের স্বল্পপরিচিত লেখক স্থিত হওয়ার জন্য মিছেমিছি বাক্য তৈরির খেলা খেলে মনীষীদের  মতো : এই যে বেঁচে থাকা, এর জন্যও নিশ্চয় সাহস দরকার; অনুমান হয় আমার এই ‘আমি’ সে এক অন্য ‘আমি’র সংসারে অহরহ নির্যাতিত। আমাদের এক মাস্টারমশাই শিখিয়েছিলেন – রাষ্ট্র একটি অবস্থা মাত্র। মানুষের সঙ্গে একধরনের সম্পর্ক এবং আচরণবিধি তৈরির উপায়। তাতে করে মানুষ নিজেই হয়ে ওঠে এক একটি রাষ্ট্র, যখন সে সমাজের ভেতর তার অন্তর্গত সত্য মিলিয়ে তৈরি করে অজস্র প্রতিষ্ঠান।… সব কথা এখন ঠিক ঠিক মনেও নেই। কত রকমের সম্ভাবনা ছিল আমাদের এক জীবনে! জায়গা-মানুষ মিলিয়ে সহস্র নাম আমরা একদিন জমা করেছিলাম। এখন সব আলাদা-আলাদা বলতে পারি না। প্রতি মুহূর্তে একটি নতুন ঘরের ভেতর, নতুন ঠিকানা, নতুন ভালোবাসার মানুষ নিয়ে আমরা যেন বাঁচি। যে-বাড়িতে থাকছি, সেই চক্ষু শীতল করা কন্যা, বুঝতে পারি – অতিদ্রুত আমাকে ছাড়িয়ে, আমাকে পরিত্যাগ করে চলে যাবে। ‘এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম’ তাড়ানোর জন্য তখন হয়তো এমন কোনো জায়গায় গেছি, যেখানে কোনোদিন যাওয়া হয়নি। নতুন বই, অদ্ভুত ঘরবাড়ি, নতুন কন্যা, নতুন মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষের শরীর – সব আর আগের মতো ফিরে আসে না। মায়ের পুরনো কাপড় মনে-মনে সেলাই করে আমি কাউকে কল্পনা করি। আমি কখনো জন্তুর মতো, কখনো মায়ের মতো ঘুমোই। ধোপাবাড়ি থেকে আসা কাপড়ের গন্ধ পাই, নখ কাটি, সিঁড়িতে মানুষের শব্দ শুনি,… আর দেখি, কন্যা গত তিনদিন কোনো ব্রেকফাস্ট করেনি।… হয়তো তক্ষনি ফোনে রিংটোন বাজে।

এবার সম্পাদক নিজে আবার কথা বলেছেন;… তুমি দু-একদিন এক্সট্রা সময় নাও, আমরা ন্যায়পালের হত্যা নিয়ে স্পেশাল সংখ্যা করব। একবার হাওলাদারের ফ্যামিলিকে ইন্টারভিউ করা যায় কি? আমাদের লেখকও এরকম করে ভেবেছে এক-দুবার। একজন হাওলাদার খানিকটা কৃষিকাজ, খানিকটা শিক্ষকতা ছাড়িয়ে অ্যাসাসিনেশানে নাম লেখাতে চাইছিল কেন? লোকটিকে নিয়ে কি সত্যিই কোনো স্টোরি করা যায়? লেখক নিজেকে পোষ মানানোর চেষ্টা নেয় :… আমি হয়তো তাকে চিনি না, কিন্তু হতে কি পারে, তাকে আমি এই শহরের সমস্ত জায়গাতেই দেখেছি – হোটেলে, রাস্তায়, মাঠে, ট্রেনে, কোনো বইয়ের ভেতর, সিনেমার ভেতর, নিজের ভেতর, কিংবা একেবারে ভেতরের আমিতে তাকে দেখার সুযোগ হয়েছে! লোকটি কি কোনো ডাইরি রাখত? নাকি হত্যা করার আয়োজনটিই তার একটি অগ্রিম ও স্থায়ী সুইসাইডাল নোট? ছাপা কাগজের ভেতর সে লোকটির ফটো আবার খুঁজে বের করল : লোকটির স্ত্রী, স্ত্রীর কোলে একমাত্র কন্যা, বাবা-মা; এবং সেই   সঙ্গে খড়ভর্তি উঠোন, দু-একটি মুরগির ছানা এবং ছাই জমে ওলের জঙ্গলসহ একটি চিরায়ত যৌথ-পরিবারের পোর্ট্রেট তৈরি হয়েছে পত্রিকা অফিসের জন্য। ছবির শান্ত জগতে ডুব দিতে-দিতে সে ভাবছিল – মাননীয় ন্যায়পালকে ছুরিবিদ্ধ করার আগে লোকটি কি তাহলে কোথাও বদলে যাচ্ছিল? ক্রোধ, অসহায়ত্ব, বিবমিষা মিশেল হয়ে কি তবে তার ভেতর কোনো গোপন জিঘাংসা বলবান হচ্ছিল? নাকি ইট ওয়াজ সাম সট অফ প্রোটেস্ট অ্যাগেইনস্ট স্টেট  মেশিনারি! দিন দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, অথচ স্টোরি তৈরির আয়োজন করতে পারছি না! লেখক সামান্য অসহায়বোধ করেন। অগত্যা বিপদ উদ্ধারের জন্য মনে-মনে সে একটি এক্সারসাইজ খাতা আবিষ্কারের পরিকল্পনা করে। সিদ্ধান্ত হয়, প্রোলোগ-এ বলা হবে – পরিত্যক্ত একটি বাক্স থেকে উদ্ধারকৃত এই খাতার নানান জায়গায় হাওলাদার মাস্টারের নাম লেখা ছিল। কিছু উদ্ধৃতি ছিল, ছোট ছোট ঘটনার বর্ণনা ছিল… লেখাগুলি কখনো কাঠ পেনসিলে, কখনো ছিল কলমে। অনুমান করা যায়, বাক্যের এই ভাঙা-ভাঙা অংশগুলো হাওলাদার মাস্টারের-ই

লেখা। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই যে, খানিকটা পাঠ উদ্ধারের পর, যখন কম্পোজে দিই আমাদের পাড়ার ইমপেল কম্পিউটার্সে, তখন সেখান থেকে নোটস্গুলো চিরকালের মতো নিখোঁজ হয়ে যায়। আসলে ওই সময় পুলিশের রাবার বুলেটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, কেউ একজন দৌড়ে ইমপেল কম্পিউটার্সে আশ্রয় নিতে আসে, অথবা হঠাৎই একটি উড়ে আসা বোমায় পুরো দোকান হাওলাদার মাস্টারের খাতাসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। লেখক ভাবল, গবেষণার প্রাথমিক উৎস কি এভাবে হত্যা করা যায়? আমাকে কি কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করবেন, লেখার সত্য এবং স্বাধীনতা বিষয়ে? হতে পারে ইমপেল কম্পিউটার্স পুড়ে যাওয়ার একটি ফটো রাখা হলো, বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরির জন্য। নাকি লেখার সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য দরিদ্র কোনো বোমারু মানুষকে নেমন্তন্ন করে রাতের অাঁধারে দোকান নিশ্চিহ্ন করার আয়োজন সারতে হবে গোপনে? আর লোকে তখন নিশ্চিত বিশ্বাস করবে, একমাত্র কন্যাসহ বসবাসকারী বৃশ্চিক রাশির জাতক, এই লোকটি কখনো পাইরোম্যানিয়াক হতে পারেন না।

বৃশ্চিক রাশির লেখক এবার মরা বৃশ্চিকের শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া বিষের সংক্রমণ অনুভব করলে মাথায় বিনবিনে ঘামের মতো শব্দের স্রোত আসে। খুঁজে পাওয়া, অথবা খুঁজে না পাওয়া, অথবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া খাতার ভেতর নিজের মতো, হাওলাদার মাস্টারের মতো, হাওলাদার মাস্টারের ভেতর লুকোনো অন্য এক বৃশ্চিক রাশির লেখকের মতো সে বাক্য তৈরির আরবান-গেরিলা ওয়ারফেয়ারে জড়িয়ে যায়। লেখক শিরোনাম ভাবেন : ন্যায়পালের ভ্রমণবৃত্তান্ত এবং হাওলাদার মাস্টারের নিঃসঙ্গ যুদ্ধ। না, তখনি মনে হয়, নামটি সঠিক হলো না। কিন্তু তখন মিলিটারি কনভয়ের মতো বাক্য আসছে গলার কাছে, যেমনটি হয় রক্তবমির কালে। আমরা ভাবি – হাওলাদার মাস্টারের লেখার শুরু হওয়া উচিত এমনটি, যেজন্য বাক্য তৈরির খেলায় আমরা একদা পরিত্যক্ত খাতার পৃষ্ঠাগুলো দ্রুত উল্টে যাই; হাওলাদার মাস্টার লিখেছেন : এক প্রবল মৃত্যুব্যাধিতে আমি এবং আমরা তখন ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। ইনোসেন্ট বাইস্ট্যান্ডার অর্থাৎ নিরীহ ভঙ্গিতে কেবল দেখছি, বিষয়টি সঠিক নয়, যদি তুমি কেবল দাঁড়িয়ে-থাকা মানুষ হও, তুমি তারপরেও নিরীহ নও – … ইফ ইউ আর আ বাইস্ট্যান্ডার, ইউ আর নট ইনোসেন্ট! তোমরা যখন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট
মি. তানজিরের কাছে আমার অ্যাগ্রেশানের তত্ত্বতালাশ করছিলে; আমি তখন আগ্রহবোধ করছিলাম হসপিটাল ইকোনমিক্সের ডা. তালুকদারের সঙ্গে কথা বলতে। ডা. তালুকদার বললেন – এ-বছর হাসপাতালের বড় অংশের অর্থ ব্যয় হচ্ছে পুড়ে যাওয়া মানুষের পরিচর্যায়। দেখো – রাস্তায় মানুষ হয়তো হাঁটছে, কিংবা কেউ গেছে স্কুলের পথে, অফিসের পথে, হসপিটাল-ইমার্জেন্সির পথে –  তখন পুষ্প রেণুর মতো পেট্রোল বোমা ঝরে পড়ল। অথবা তৎক্ষণাৎ যুদ্ধজয়ের নির্দেশ এলো মসজিদের নিঃসঙ্গ মাইক্রোফোন গড়িয়ে। এবার গভীর শান্ত মগ্নতায় আগুনের শিখা তোমার মুখ এবং কাঁধ ঝলসে দেয় অনায়াসে। যদিবা তুমি পুড়ে যাওয়া ঘরে কখনো আটকে যাও, তাহলে দেখবে তোমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আর গলার স্বর বদলে যাচ্ছে। দেখবে ধোঁয়া, গ্যাস এবং বাষ্প তোমার নিঃশ্বাস এবং শ্বাসনালি আরো ভারী করে দিয়েছে। যদি পুড়ে যাওয়া জায়গা বিস্তৃত হয়, হাসপাতালের ভাষায় টেন পার্সেন্ট,… ফিফটিন পার্সেন্ট,… থার্টি পার্সেন্ট,… সিক্সটি পার্সেন্ট,… সেভেনটি পার্সেন্ট,… তবে লোকটি দ্রুত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরা বলছেন, লোকটির ফুসফুস, চোখ, অন্ত্র এবং খাদ্যনালি কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। হতে পারে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ ক্ষীণ হয়ে আসছে, হতে পারে কারো চামড়া সমস্ত অংশটুকু পুড়ে গভীর স্কার হয়েছে। সারা হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের আলো রাতভর জ্বলতেই থাকে। ড্রেসিং-ট্রলি নিয়ে সিস্টার দৌড়ে চলেছে। আঙুল অটো অ্যাম্পুটেড নাকি চিকিৎসক স্কার-ম্যানেজমেন্ট নিয়ে খুব বসা গলায়, মাস্কের আড়াল থেকে কথা বলছেন। আর সারা ওয়ার্ডজুড়ে ব্যথা, ভয়, নিদ্রাহীনতা এবং ক্ষণে-ক্ষণে তৈরি হওয়া রোস্টেড-স্কিনের অভূতপূর্ব দৃশ্যাবলি! অথবা ফ্রন্টাল লোবে তখন আবছা বিশৃঙ্খলা হচ্ছে সদ্য পুড়ে যাওয়া কন্যাটির বুদ্ধি, সচেতনতা, স্মৃতি এবং অনুভূতি মিলিয়ে – পুড়ে যাওয়ার শুরুর মুহূর্তটি একবার চকিতে মনে আসে, একবার হারিয়ে যায়। পেট্রোল, ধোঁয়া এবং পোড়া চামড়ার তীব্র গন্ধ নাকে আসছে। হয়তো ভুল হচ্ছে। তখন আসলে নিদ্রার মতো আচ্ছন্নতা অথবা সামান্য এক মুহূর্তের ঝলসে যাওয়া তীব্র গনগনে আলো চামড়া হয়ে বুকের ভিতর বিঁধে গেছে।

হাওলাদার মাস্টারের নিখোঁজ খাতায় ধরা যাক, পুড়ে যাওয়া অন্য মানুষের দু-একটি কথাও নিশ্চয় জমা ছিল; আমরা খুঁজে পেতে সেই পৃষ্ঠাটি মেলে ধরি : পুড়ে যাওয়া গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির জ্বলন্ত আগুন থেকে খেয়াল করুন, শেষ ফোন এসেছিল বোনের – আমরা আর বাঁইচত পারতাম না, তুমি আমাগো লাশ নিত আইস! আসমা আক্তার তাই আশুলিয়া থেকে মেডিকেল হাসপাতাল, বিজিএমই ভবন হয়ে পিএম অফিস পর্যন্ত ধরনা দিয়েও সুরাহা করতে পারেনি  – ‘আমাগো লাশগুলা না দিক, আমারেসহ জ্বালাইয়া দিক। আমার টাকা লাগত না।’ আমরা হাওলাদারের এক্সারসাইজ খাতার গায়ে মৃদু ক্রোধ এবং ভারী হয়ে-ওঠা নিঃশ্বাসের অাঁচ পাচ্ছিলাম। আর আমাদের পূর্বতন-স্বল্পপরিচিত লেখক এবং অন্য প্রতিবেদকবৃন্দ খাতার পৃষ্ঠা ছুঁয়ে তখন গোপন ধোঁয়া এবং বারুদের ছায়া উড়ে যেতে দেখল। আমরা দেখলাম রাষ্ট্রীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সেনাবাহিনীর অস্ত্রসম্ভার প্রদর্শনের মেলা চলছে। দেখলাম ট্রাফিক লাইট বদলে যাচ্ছে। অ্যায়ারবেস তৈরির জন্য পুরো আদিবাসী পল্লিতে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পলায়নরত আদিবাসীকে নিচু হয়ে যাওয়া হেলিকপ্টার ফলো করে এবং গহিন বনের ভেতর হত্যা করার জন্য গুলি ছোড়ে। দেখা গেল – জমি হারানোর কারণে প্রতিদিন ফার্মার্স সুইসাইড উদ্যাপিত হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বত্র। কৃষকের আত্মার বিনিময়ে এবার ধান চাষের নিখোঁজ জমিতে তৈরি হয় উন্নয়ন-রাজনীতির পাওয়ার প্ল্যান্ট, গ্রাম রক্ষার বেড়িবাঁধ, মুক্ত অর্থনীতির সুউচ্চ হাইওয়ে ও ইস্পাত-সিমেন্টের বলশালী কারখানা। ফলে স্থানচ্যুত কৃষক এবং আদিবাসী সম্প্রদায় উন্নয়নের পতাকা থেকে চুইয়ে পড়া মরণব্যাধি নামক রোগের প্রকোপে নাকাল হতে থাকে নিশিদিন। মানুষ এবার ‘পবিত্র সংবিধান’, ‘জরুরি অবস্থা’ এবং সুশীল সমাজের এনজিও-সম্পৃক্ততা নিয়ে গল্পগাছা তৈরি করে। মানুষ গল্প বলে আগুনে-বোমা ছোড়ার পদ্ধতি, উপায় এবং ফলাফল নিয়ে। মানুষ গল্প বলে মসজিদের বারান্দা থেকে ঘোষণাকৃত যুদ্ধজয়ের পরিণতি ও নিয়মাবলি সম্পর্কে। অথবা হঠাৎই কেউ জিজ্ঞেস করে – শেষ পর্যন্ত ন্যায়পাল হত্যা-প্রচেষ্টার চার্জশিট কি তৈরি হয়েছে? আমরা বুঝতে না পেরে আবারও হাওলাদারের এক্সারসাইজ খাতা খুঁজতে শুরু করি গোপন তত্ত্ব-তথ্যের আশায়। কথাটা সম্ভবত ভুল হলো – হাওলাদারের মৃত-নিখোঁজ পুড়ে যাওয়া সম্ভাব্য খাতার ভেতরে আসলে আমরা তাকে পাব, এরকম ভরসা হয়। আমরা এলোমেলো পৃষ্ঠা উল্টাই এবং কখনো থমকে দাঁড়াই। এই পাঠচক্রের পরিক্রমায়, পঞ্চম পৃষ্ঠায় দেখা গেল – লং লিভ রেভ্যুলুশন এবং ডাউন উইথ ইমপেরিয়ালিজম লিখে, আবার সবুজ কালিতে কেটে দিয়েছেন। একটি পৃষ্ঠায় ‘অ্যাসেম্বলি বোম্ব কেস’-এর জন্য লাহোর হাইকোর্টে দেওয়া ভগৎ সিংয়ের স্টেটমেন্টের খানিকটা বাংলা অনুবাদ। পরের পুরো একটি পৃষ্ঠাজুড়ে নানান ফন্টে লেখা – দ্য পিপলস্ ওয়ার! এরপর খানিকটা শূন্যস্থান রেখে টানা লেখা – আমার ভেতর বসবাস করে একখন্ড আগুন, বুলেট, অপমান, লজ্জা, সস্ত্রাস এবং জীবন।… আমাদের স্মৃতি মৃত্যুবরণ করে প্রতিদিন। ধরা যাক – আপনি তখন সমুদ্রের ধার থেকে, বাইরে থেকে, সিনেমা থেকে ফিরলেন, এবং তৎক্ষণাৎ রাইফেল বা পয়েন্টেড-নাইফ ছুটে এলো শরীরের খুব ভেতরে…। আম্মাকে বলি, আম্মা আপনি কান্না করবেন না। মাথার ভেতর তখন বিবিধ জিভ নড়াচড়া করে এবং আমি প্রকাশ্যে অথবা গোপনে বাচাল হতে থাকি। দেখি কেউ অাঁধার বনের ভেতর থেকে, মাটির নিচ থেকে উঠে আসছে কালাশনিকভ হাতে। মৃদু গোঙানি হয় – বাবা আপনি শুনতে পাচ্ছেন, আপনার খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমরা জবাবের অপেক্ষা না করে একটি স্বল্পচেনা ঘরের দিকে হাঁটতে থাকি। ফ্লোরে সলিমুল্লাহ খানের টর্চার, টেরোরিজম এবং ফ্র্যাঞ্জফেনোবিষয়ক প্রবন্ধের পঞ্চম অধ্যায়। এই ঘরটিতে কোনো টিভি নেই, ভিডিও নেই। অথচ কোথা থেকে চিকেন কাটলেটের গন্ধ আসছে। দুজন ক্ষুধার্ত মানুষ একটি ঝোপের আড়ালে একে-ফোরটি সেভেন হাতে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে গেছে। রাতে স্বপ্নের ভেতর মৃত্যুর আর্তনাদ এলো। এরপর এলো রেডিও রিপোর্ট এবং সংবাদপত্র : একশ পাঁচজন গুলিবিদ্ধ, বিয়াল্লিশটি ঘর ভস্মীভূত, বাহাত্তরটি বাস যাত্রীসহ অগ্নিদগ্ধ এবং রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় আঠারোজন মস্তকহীন! ঘরের ভেতর সন্তান এবং তাদের স্ত্রীদের শোক আমি কল্পনা করতে পারছিলাম। আমি দেখলাম আমার স্বপ্ন এবং সত্য আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। তারপর কিছুই হয়নি, এই ভঙ্গিতে আমি কোথাও হাঁটতে যাই। দেখি ঘাসের ভেতর গান পাউডার এবং একটি টংঘরে গ্যাংরেপের পর ঘুমিয়ে পড়া পাহাড়িকন্যার বিধ্বস্ত শরীর। মধ্যরাতের টেলিভিশনে ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিতে-দিতে বিশ্লেষকেরা মজা করে – টেরোরিজম এখন বড্ড সস্তা, সম্ভবত শিশুর খেলনার চেয়েও অতিসহজে জোগাড় করা সম্ভব! অন্য বন্ধুরা বলেন – ইনোসেন্ট বাইস্ট্যান্ডার বলে কিছু নেই।… ইফ ইউ আর আ বাইস্ট্যান্ডার, ইউ আর নট ইনোসেন্ট! আমি নির্দোষ হওয়ার ভান করে জাতিসংঘের পিস-কিপিং বাহিনীর কাউকে আমাদের গ্রামের ভেতর আবিষ্কার করি: যে-মেয়েটিকে এইমাত্র সৈনিকটি আটক করল কমফোর্ট-উইমেন হিসেবে, মেয়েটি যদিওবা বুলেট ভিক্ষে চাইছিল মৃত্যুর জন্য, কিন্তু ভালো-মানুষের মতো মুখ করে সৈনিকটি কোনো বুলেট বরাদ্দ করতে অপারগতা প্রকাশ করল। সৈনিকটি তার রক্তে এইচআইভি পজিটিভ ভাইরাস বহন করছিল এবং সে চাইল মেয়েটির ভেতর যেন এর সংক্রমণ হয় এবং তার মৃত্যু হয় অনেক ধীরলয়ে। মেয়েটি ধরা যাক – পজিটিভ এইচআইভিসহ ওয়ার-চাইল্ডের নড়াচড়া অনুভব করে জরায়ুর ভেতর…, আর হঠাৎ তার ক্ষুধা বৃদ্ধি হয়। মেয়েটি শোনে – কেউ কথা বলছে ফুল, ধান, আগুন, বৃষ্টি, পলায়নপরতা, স্বাধীনতা এবং নারীর দুঃখ নিয়ে। মেয়েটি দুঃখ ভুলে, অনেক দূরে তার দিদিমার মতো কাউকে দেখে – দুধ দুইবার সময় সরু একটি দুধের স্রোত গাই গরুটির ওলান থেকে তার চোখে ছড়িয়ে যাওয়ায় ফোকলা দাঁতে হেসে চলেছে। তখন হঠাৎ ভেসে আসে সাইরেনের মতো, হতে পারে কোনো অ্যাম্বুলেন্স। কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় না। একটি বাড়ি নতুন চুনকাম হয়েছে। কেন এত তীব্র সাদা রং – জিজ্ঞেস করা হয় না কাউকে। মৃত্যুর মতো সাদা রং! ঘাড়-মুখ-গলা আবদ্ধ করে একটি হাত একে-ফোর্টিসেভেন জাপ্টে আকাশ অথবা মৃত্যুর সাদা রং দেখছিল। আর অন্যরা মনোযোগ দিয়ে তখন দেখছিল টেলিভিশনের ছায়াপথ: সাদা রঙের মৃতদেহ, পোড়া মাংস, বোম্বব্লাস্ট, ভেঙে পড়া বাড়ি, অগ্নিদগ্ধ কমিউটার ট্রেন, মৃত মাজার এবং অবিন্যস্ত সিটিস্ট্রিট। টেলিভিশনে এতসব দৃশ্যাবলি তারা দেখছিল বটে, কিন্তু মাথার অন্যত্র দৌড়ে যাচ্ছিল তাদের শৈশব, তাদের সিনেমা দেখা, তাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, দলের হোর্ডিং, দলের নিউজপেপার, খালের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা শান্ত নৌকার ভিড়, কোরান শরিফের রেহেল এবং পুড়ে যাওয়া বাসের রাজ্যে শুয়ে থাকা অগ্নিভুক প্রিয় আত্মীয়বৃন্দ। কেউ ফিসফিস করে আপনার বাড়ি থেকে কেউ কি তবে গোপনে মিলিট্যান্ট হয়ে উঠছে? জানি না। তবে জানি, কেউ মিলিট্যান্ট হলে, তিনি মৃত্যুর প্রস্ত্ততি নিয়েই এগোন। কিন্তু ওরা শুরুতেই কেন আমাদের এগারো জনকে নলডাঙ্গা হাটের দিন হত্যা করল প্রকাশ্যে? সব কথা বিশ্বাস করবেন না। কথা শুনবেন হৃদয় দিয়ে, কান দিয়ে নয়…।… আমরা যখন এখানে পালিয়ে আসি, তখন ছিলাম কপর্দকহীন, এই আশ্রয়-শিবিরে চামচ থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি জিনিস আমাদেরকে জোগাড় করতে হয়; … পুরনো ভগ্নঘর, প্রাইভেসি নেই, দমবন্ধ, স্যাঁতসেঁতে, তীব্র গরম, আর আমরা এখানে শুয়ে আছি দিনের পর দিন …!

আমাদের বৃশ্চিক রাশির জাতক এবং সহযোগী অন্য লেখকবৃন্দ আশ্রয় শিবিরের বর্ণনা পড়তে পড়তে এবার সত্যিই যেন দমবন্ধ, স্যাঁতসেঁতে, গুমোট, ঘেমো, অস্বস্তিকর একটি ঘরের আভাস পেয়ে চমকে তাকায়। দেখা গেল – হাওলাদার মাস্টারের অস্পষ্ট এবং যোগসূত্রহীন নোটবইয়ের এটিই ছিল শেষ পরিচ্ছেদ। খাতার শেষে যদিওবা অনেকগুলো পৃষ্ঠা খালিই ছিল, কিন্তু তিনি কোনো বাক্য লেখেননি। বোধ করি, আবারও ভুল কথাটি বলা হলো – ইমপেল কম্পিউটার্সে কম্পোজের সময় উড়ে আসা আগুন-বোমার স্পর্শে হাওলাদারের সম্ভাব্য পুড়ে যাওয়া খাতায়, ধরা যাক এসবই তিনি একদিন লিখেছিলেন, ইন্টারোগেশনের প্রবল তোড়ে নিখোঁজ হওয়ার আগে। আমাদের কেউ তখন জিজ্ঞেস করে – শীত এখনো আসেনি? না, শীত পৌঁছয়নি – এই রকম জবাব আসে ভিড়ের ভেতর থেকে। ভিড় থেকে বেরিয়ে কেউ হাঁটে অথবা হেঁটে-হেঁটে ঘুমুনোর প্রতিজ্ঞা নেয়। লোকেরা বলে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ন্যায়পাল-হত্যা প্রসঙ্গে আমাদের মতামত কী? আমরা বলি, জানি না। কী করেই বা সব কথা আমরা জানতে পারি? ভেজা চুল সেঁটে থাকলে যেমন গন্ধ হয়, তেমনি গন্ধ আসছিল এক তরুণীর হাঁটা-চলার পথ থেকে। গন্ধের জগৎ থেকে চুইয়ে পড়া যৎসামান্য আনন্দ এসে আমাদের অন্যমনস্কতাকে তছনছ করছিল ক্ষণে-ক্ষণে। আমরা হয়তো এরপরেও আমাদের অন্যমনস্কতাকে দখল করতে চাইছিলাম। আমাদের উদ্যোগ নেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল, এবং একই সঙ্গে আমাদের উদ্যোগ নেওয়ায় অনিচ্ছাও হচ্ছিল। বিশ্রাম নেওয়ার মতো চোখ সামান্য বন্ধ হয়ে আসছিল। নতুন মা তার বাদামি স্তন শিশুর মুখে স্থির রাখার সংগ্রামে ভারি বিপদ গুনছিল। সেই পুরনো বেগুনি গন্ধ ছড়িয়ে, ভেজা চুল ছড়িয়ে হেঁটে-যাওয়া মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সমুদ্রের দিকে মুখ করে। তখন ঘরের বাতি কেউ নিবিয়ে দেয়, আর প্রশস্ত আকাশ ভেসে ওঠে। আমরা দুচোখ আধখোলা করে নড়াচড়া করি, আর আমাদের মনে হয় – মরা মানুষ অদ্ভুত এক জিনিস বটে! তুমি আবার জিজ্ঞেস করলে, মৃত্যুব্যাধি কেন প্রাণঘাতী? আমি বললাম, যার ওই অসুখ থাকে সে কোনোদিন এই জীবাণুর কথা জানতে পারে না; আর শেষ পর্যন্ত সে মারা যায় মৃত্যুরই হাতে। তুমি ঠাট্টা করলে – আমি নাকি আমার জন্যেই কেঁদেছিলাম।… প্লিজ কাঁদবেন না। কান্নাটা বড্ড সিলি,… মিনিংলেস, আপনার নিজের জন্য কান্নার অভ্যাসটা দয়া করে ত্যাগ করুন,… এর কোনো মানে হয় না!

বৃশ্চিক রাশির লেখক নিজেও এই ভৎর্সনার অাঁচ গায়ে অনুভব করতে পারল একবার। মনে হলো – ন্যায়পাল হত্যার অ্যাসাসিনেটর হাওলাদার মাস্টার অনেকদিন ধরে নিখোঁজ অথবা তীব্র ইন্টারোগেশনের পর মিউট হয়ে গেছে। ঢাকার সম্পাদক বন্ধুরা ফোন করতে করতে ক্লান্ত। যেজন্য আমাদের লেখক ন্যায়পাল হত্যা বিষয়ক স্টোরি তৈরির আয়োজনে এবার ধীরে ধীরে নির্লিপ্ত হতে থাকে। ফলে, কেন শান্ত-নির্বিবাদী একজন অচীন মাস্টার অনেকদিন আগে নিশ্চিন্তিপুরের মোড়ে মারমুখো হয়েছিল রাষ্ট্রের ন্যায়পালের প্রতি, আমরা সহজে তার নাগাল পাই না। ততদিনে হাওলাদার মাস্টার আরো খানিকটা বিস্মৃতির জগতে মিলিয়ে গেলে, আমরা আবার আমাদের ঘর-সংসারের দিকে চোখ ফেরাই। দেখি মাতৃহীনা সুকন্যা ঘুমিয়ে আছে এবং আমাদের লেটারবক্সটি তালা খোলা। বৃশ্চিক রাশির লেখক শরীরের ভেতর, চামড়ার নিচে, রক্তের স্রোতজুড়ে পুরনো সেই লুকানো বিষক্রিয়া অনুভব করে একবার। কন্যা ঘুমোয় এবং ধীরে-ধীরে বরফ রাজ্যের রাজকন্যার মতো তার শরীর বদলে চলে। অনুভব হয় – একধরনের নীরবতা, আর ভয়ংকর-ভীতিপ্রদ-শান্ত একখন্ড অাঁধার চারপাশ জাপ্টে ধরেছে। দেখতে পাই – সারারাত ভয় এবং শঙ্কা কাঁধে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স দৌড়ে চলেছে এবং হাসপাতালের বার্ন ইউনিট মানুষের কলরোল এবং বিদ্যুতের আলোয় অলৌকিক ঝলমলে-স্টিমারের মতো দাঁড়িয়ে। বার্ন ইউনিটের বারান্দায় পুড়ে যাওয়া মাংস জমে তখন ভিন্ন এক গন্ধের আকর তৈরি করে, আর সেই গন্ধ-রাজ্যে ফুল, ডিওডোরেন্ট এবং ভ্রমণ-পিপাসু প্রাইম মিনিস্টারের বিন্যস্ত শাড়ির গন্ধ মিশেল হয়ে অন্য এক অচেনা জগতের উদ্বোধন ঘটায়। বৃশ্চিক রাশির লেখক মাথার ভেতর শব্দ-বাক্য নড়াচড়ার আভাস পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। লেখক ভাবল – কতকাল আগে বুকের ভেতর ফ্যাকাশে একরত্তি ক্রোধ জমেছিল, কিন্তু কেউ সেই ক্রোধ আটকে দিয়েছিল ঘরের সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই। সেইদিন কন্যাকে ‘গ্রিনহাউজ ইফেক্ট’ বুঝিয়ে খানিকটা ক্লান্তও ছিল। মিছেমিছি দুটি ফুলের নাম আওড়ে ছিল – রডোডেনড্রন এবং ক্রিসেনথিমাম! লেখক ভেবেছিল দোকানে যাবে। কিন্তু আচমকা মনে হলো – আমি আমার সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। আমার শুরুটাও মনে নেই আর। আমি এখন কিছুই দেখতে পাই না। না গাছ, না রাস্তা, না ভবিষ্যৎ, না স্বাধীনতা,… কিছুই নয়…! নিজেকেই আমার এখন শেখানো উচিত : অনেকদিন আগে আমি একজন অ্যাসাসিনেটরের নোটবই জোগাড় করেছিলাম, আবার হারিয়েও ফেলেছিলাম, অথবা চোরাগোপ্তা আগুন-বোমায় আমি সেই নোটবইটি নিশ্চিহ্ন হতে সাহায্য করেছিলাম;… আর এইসব ব্যক্তিগত পরাজয়ের কাহিনি ভাবতে-ভাবতে জানালায় হঠাৎই বৃষ্টি ঝরে পড়লে সেদিন অপরূপ এক স্বপ্নের ঘ্রাণ পেয়েছিলাম। স্বপ্নের ভেতর একটি বই লেখা হয়েছে। নাকি বই লেখার একটি পরিকল্পনা হয়েছিল? লেখার অনেকগুলো আউটলাইন করা হয়েছিল, আর অনেকগুলো ড্রাফট করা হলো,… আর খুব ভেবে লেখার শিরোনাম ঠিক হলো – একটি স্বপ্নের বই অথবা বইয়ের স্বপ্ন!

অথবা উইকএন্ডের লম্বা ঘুমের ভেতর সে নিজেই স্বপ্নের বই বেয়ে সরাসরি নেমে এল ঘরের ভেতর। হয়তো ঘরের একদম মাঝ বরাবর টেবিল ক্লথ বিছানো এবং সিলভার কাটলারি, আর বাড়ির সবচেয়ে অপূর্ব গ্লাস ছিল ঘরের এই টেবিলজুড়ে। টেবিলক্লথ মসৃণ করতে-করতে সে বারান্দায় আসে। রেলিংয়ে ভর দিয়ে উজ্জ্বল আকাশ দেখে, এক ফাঁকে সিক্সথ ফ্লোরের মিস ডি’কস্টাকে দেখে, আর দেখে নাইনথ ফ্লোরের ছফা সাহেবকে। আর দেখে বাংলা সাহিত্যের সেই অসামান্য বেড়ালকে কমলা আলো গা-পায়ে মেখে হেঁটে আসছে। রাস্তায় তখন লোক বাড়ছে, আর লোকেরা তামাক খেতে-খেতে ধোঁয়া উড়িয়ে আফটার সেভের গন্ধ ছড়িয়ে মজা করছে। স্বপ্নের বই খুঁজতে-খুঁজতে, স্বপ্ন লিখতে-লিখতে, আমাদের বৃশ্চিক রাশির জাতক এসবই সেদিন দেখছিল, অথবা হঠাৎই অনেক শূন্যে একটি খেলনা-গুলি ছুড়ে, বুকে-পিঠে নকল রক্তের দাগ এঁকে সে শুয়ে পড়ল বিপুল পেভমেন্টের মাঝখানে। খানিকটা পরীক্ষাই বটে! পরখ করে দেখা – ভিড়ের মানুষেরা একজন পথচারীর হঠাৎ রক্তাক্ত হওয়ার আয়োজনে সচকিত হয় কিনা আর তারা রক্তাক্ত লোকটিকে হাসপাতাল বারান্দায় পৌঁছায় কিনা! স্বপ্নবন্দি লেখক অপেক্ষায়-অপেক্ষায় ক্লান্ত হয় এবং সে দেখল –  কেউ তাকে স্পর্শ করেনি এ-বেলা। লোকটির ক্ষুধা হয়, ক্ষুধা কমলে ঘুমের মতো হয়, স্বপ্নের মতো হয়, আর তার বড্ড সংকোচ এবং লজ্জা হয় – ভিড়ের ভেতর মানুষের জুতো-স্যান্ডেল বাঁচিয়ে মুমূর্ষু হওয়ার পর হঠাৎ প্রকাশ্যে জেগে ওঠা কি সমীচীন হবে? বুদ্ধিমান মানুষ ভাববে – মরা মানুষ অথবা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত লোকটি হঠাৎ হাঁটাচলা করার বুদ্ধি রপ্ত করল কীভাবে? বৃশ্চিক রাশির লেখক শুকনো-খটখটে পেভমেন্টে, ম্যাট্রেসের অভাবে স্পাইনাল কর্ড এবং বাটকে ব্যথা অনুভব করে, এবং মাংসজুড়ে একটি অবশ আচ্ছন্নতা ছড়িয়ে পড়তে দেখে। শহরের মানুষগুলো দায়িত্ব সম্পাদনের পরীক্ষায় স্কোর কেমন করল – এরকম একটি উদ্বেগময় আনন্দ ছড়িয়ে গেলে, তার ক্ষুধা কয়েক মুহূর্তের জন্য উবে যায়। তাহলে ভিড়ের জগতে লাশ হয়ে থাকলে, মানুষ কি খোঁজ নেয় না? এরপরেও প্রকাশ্যে জেগে উঠতে তার লজ্জা এবং ভয় হচ্ছিল।

বেলা পড়ে এলে, যখন সামান্য অাঁধার সামান্য আলো, যখন মানুষ একটুখানি উদাস হয়, অফিসের ছাতা সামলাতে-সামলাতে যখন মানুষ অন্যমনস্ক হয় – তখন যেনবা, সে স্থির করল, হয়তো সবাই এই রক্তাক্ত-পড়ে থাকার ঘটনাটি ইমিডিয়েট মেমোরি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। এর অর্থ, সামান্য আড়াল পাওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়া; অথবা আমি যে আমার থেকে পৃথক আর একজন মানুষ –  এই কথাটি কেউ বুঝতেই পারল না কোনোদিন। লোকটি ঠিক এই সময়, প্রায় কিছুই হয়নি, এরকম মুখভঙ্গি করে আচমকা কোনো একদিকে হাঁটতে থাকে। মৃদু ভার্টাইগো হতে-হতে হাত-পা-মাথা সবল হয়ে উঠছে, সে বুঝতে পারল।

প্রতিবেশীদের মতো চেহারার দুজন লোক রেডিও শুনছে এবং সম্ভ্রান্ত বেড়াল নিয়ে খেলা করছে। ‘বেড়াল’ শব্দ নিয়ে সে নিজেও এক-আধটু খেলা করতে চাইল – মনে-মনে তাই বেড়ালের ইংরেজি করল ‘ক্যাট’,… সি এ টি,… অর্থাৎ কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার অ্যান্ড ক্রুয়েল! হঠাৎ নিখোঁজ হওয়া মানুষের ওপর তীব্র টর্চার নিয়ে কি আমাদের কথা বলা উচিত? পলাতক মানুষ হিসেবে আমরা তক্ষুনি চুপসে যাই। দেখি শহরের জায়গায়-জায়গায় সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ – কে একজন ওয়ার ক্রিমিন্যাল আজ রাতে হ্যাংগ্ড হবে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে। রাস্তার জায়গায়-জায়গায় জটলা; আবার কোথাও অনেকখানি ফাঁকা, কিংবা ল্যাম্পপোস্টের ভয়-ভয় অাঁধার ছোট-ছোট ঝোপের ভেতর গোপন মানুষের মতো, অথবা একে-ফোরটি সেভেন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা নিষিদ্ধ মানুষের মতো আলো-ছায়ার মিছিল তৈরি করেছে। বৃশ্চিক রাশির জাতক এই আলো-অন্ধকার ভাঙতে-ভাঙতে হাঁটছিল, আর ক্ষুধার্ত হওয়ায় হঠাৎ তার মনে হলো ডিনারের কথা। শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ,…, প্রতিদিন ডিনারের আয়োজন করা নিয়ে মা কি তটস্থ থাকতেন? কী রান্না করব, কী তোমরা খাবে, কী অপছন্দ করবে – এসব নিয়ে মা ভাবতে-ভাবতে ভীত হতেন অথবা অসহায় হওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করতেন। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা হয়তো চোখে মায়া ছড়িয়ে বলতেন – সবদিন কেন ডিনার করো না, রাতে সামান্য হলেও খাবে। বিকেল-সন্ধ্যায় হাঁটবে, খানিকটা ব্রিস্ক ওয়াক। বাবার সঙ্গে হাঁটছি, অথবা বাবা পিঠে হাত ছুঁয়েছেন – এরকম একটি আভাস তৈরি হয় বুকের কোথাও। দেখতে পাই ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আকাশছোঁয়া হোর্ডিং। একটি সময় ছিল, প্রতি ছুটির দিন কয়েকটি লিটারেরি সাপ্লিমেন্ট কিনে আমরা এই চায়ের দোকানটায় বসতাম; একই জায়গা, একই জানলা, সেই একই লোক চা নিয়ে আসে,… শেষের দিকে চায়ের সঙ্গে, সম্মানিত করার জন্য লোকটি কফি ছড়িয়ে দিত। গুঁড়া কফি জলের রাজ্যে ডুবে যাচ্ছে – এসব দেখার ফাঁকে সেই একই জানলা দিয়ে দেখা যেত একটি নিঃসঙ্গ বাঁশবন এবং নদীর ভেতর ডুবে যাওয়া শুশুকের ধ্যানমগ্ন ছবি। খুব দ্রুত একটি মিলিটারি ভ্যান তখন চলে যায়, আর পেছনে-পেছনে অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র সাইরেন। অ্যাম্বুলেন্সের ছায়া ধোঁয়া উড়ে যাওয়ার গন্ধ এবং মিলিটারি সাজসজ্জা হঠাৎই আমাদেরকে আবার ভীত করে এবং ভয়ের ছবি আনে বুকের ভেতর। অনুমান হয় – শহরের ভেতর ঘন-ঘন মিলিটারি ভ্যান এবং অ্যাম্বুলেন্স দৌড়ে যাওয়ার অর্থ গোপন এক অাঁধারকালের ডালপালা ছড়িয়ে যাওয়া। হাওলাদারের মতো কেউ এখন নিশ্চয় তীব্র ইন্টারোগেটেড হওয়ার পর, এক্ষুনি যেন মৃত্যুবরণ না করে, তার জন্য অ্যাম্বুলেন্সের লম্বা সিটে শুয়ে। হাওলাদারের মতো যে-লোকটির নখ উপড়ে ফেলা গেছে একটি জানালাবিহীন স্বল্প আলোর ঘরে, সেই লোকটিকে পঞ্চমবারের মতো টর্চার-এপিসোডে হাজির করার জন্য চিকিৎসার আয়োজন চলছে অ্যাম্বুলেন্সের অক্সিজেন দিয়ে। অথবা আমাদের মতো এবং হাওলাদারের মতো আরো একুশজনকে ব্লাইন্ড ফোল্ডেড করে হাঁটতে বাধ্য করা হচ্ছে, হাঁটুর-পায়ের সমস্ত অস্থি চূর্ণ করে। আমরা পা ঘষটাতে-ঘষটাতে হাঁটি এবং শুয়ে থাকা লাশের ওপর হোঁচট খেয়ে পড়ি। আমরা উঠে দাঁড়াই এবং আবারও হাঁটতে থাকি। তখন গাছের ডালে, নতুন সয়ারেজে, খেয়াঘাটের পরিত্যক্ত নৌকায়, জাতিসংঘের গাড়িতে, প্রধান বিচারকের ছাদে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানহোলে, স্কুলের ডেস্কে, উপাচার্যের পুকুরে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কন্টাক্ট লেন্সে এবং কাঁচাবাজারের সর্বত্র নিখোঁজ লাশের তীব্র দমবন্ধ ঘ্রাণ ছড়িয়ে গেছে। এবার এসব অচিন-অগুনতি মৃত মানুষ, পোড়া মানুষ অথবা মুমূর্ষু মানুষ মৃত্যুব্যাধির সংক্রমণ ঘটাতে-ঘটাতে নগরের রাস্তাঘাট পরিভ্রমণ শুরু করলে তার হঠাৎ মনে হলো –  মেয়েটি সিলভার রংয়ের ‘পুমা’ সোলডার-ব্যাগ চেয়েছিল। আর মনে হলো – হেয়ার ডাই নিতে হবে, নিতে হবে গ্লুস্টিক এবং এ-ফোর সাইজের সাদা কাগজ। আর তখন তার ক্ষুধার কথা মনে হলো, এবং মৃত ন্যায়পালের পরিত্যক্ত বাড়ির গাছে ঝুলে থাকা একটি পেয়ারা সে চুরি করে খেল, আর তার হঠাৎই মনে হলো – সে যেন বাড়ি থেকে, মুমূর্ষু হওয়ার এক্সপেরিমেন্টাল-পেভমেন্ট থেকে এবং সৈন্যদের প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে। সামান্য সময় সে একটি ল্যাম্পপোস্ট ছুঁয়ে দাঁড়ায় – তাহলে সে কি এতক্ষণ ভুল পথে হেঁটেছে? লোকটি তার নিজের স্বার্থে মায়ের গলার স্বর ব্যবহার করল – এদিকে কেন? তোমাকে ফিরতে হবে বাঁদিক হয়ে সরু রাস্তার দ্বিতীয় লেন বরাবর। ঘরে যাও। ঘরে যেয়ে ঘরটা গুছিয়ে ফেল। বাড়ি ফিরতে দেরি করে কেউ? সব বাড়িরই একটি নিয়ম থাকে, জানো তো? লেখক ইংরেজিতে কথা বলে, মেয়েটির হাউসটিউটরের স্বর নকল করে – দ্য রুলস অফ দ্য হাউস, আই ফলো দেম।