দক্ষিণ-এশীয় শিল্পকলা উৎসব

বসন্ত রায় চৌধুরীinstallation-by-rana-begum

বিশ্ব-শিল্পকলার পরিধিতে দক্ষিণ-এশীয় অঞ্চলের শিল্পীদের সৃষ্ট শিল্পকর্ম একটি স্থান দখলে নিয়েছে – ঢাকা আর্ট সামিট তাই জানান দিয়েছে। বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনের ইতিহাসে এবারের ঢাকা আর্ট সামিটকে ভিন্নধর্মী আয়োজন বলা চলে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শুরু করা গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষার্ধে ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ) এক বৈপ্লবিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছে। শিল্পসৃষ্টির বহু পথ ও মতের মানুষ আজ সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শিল্পচর্চা ও মননশীল মানুষের রুচি নির্মাণে ভূমিকা রাখছে। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার এক লাখ বিশ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে এ বর্ণিল উৎসব শুরু হয় গত ৭ ফেব্রুয়ারি। এবারের সামিটে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো হলো আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। এ-অঞ্চলের খ্যাতিমান ১৪ জন শিল্পীর একক শিল্পকর্ম-প্রদর্শনী ছাড়াও এ-আয়োজনে যুক্ত হয়েছে ৩২ জন প্রথম সারির বাংলাদেশি শিল্পীর চিত্রকর্ম-প্রদর্শনী। একনজরে বিস্তারিত আয়োজন হলো এরকম – আন্তর্জাতিক মিডিয়া অঙ্গনে খ্যাত রাকস মিডিয়া কালেকটিভ তৈরি করেছে সিটি পাবলিক আর্ট প্রজেক্ট। চলচ্চিত্র-প্রদর্শনী, পারফরম্যান্স আর্ট, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ৩৩টি গ্যালারির সংগৃহীত শিল্পকর্মের প্রদর্শনী সামিটে প্রদর্শিত হয়। সামিটে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত সম্ভাবনাময় কিউরেটর, শিল্পী ও সংগ্রাহকের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়। প্রথম আর্ট সামিটে আনুমানিক পঞ্চাশ হাজার দর্শক প্রদর্শনী দেখেন। এবারের প্রদর্শনীতে আরো বেশিসংখ্যক দর্শক উপস্থিত হয়েছেন বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। ঢাকা আর্ট সামিটে এবার সহায়তা দিয়েছে – ব্রিটিশ কাউন্সিল, দ্য গ্যেটে ইনস্টিটিউট, ঢাকা, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, সুইস আর্টস কাউন্সিল ও বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট। আন্তর্জাতিক জুরি প্যানেল দশজন শিল্পীকে নির্বাচন করে সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ডের জন্য। তাঁরা হলেন – আফসানা শারমিন ঝুম্পা, আয়েশা সুলতানা, কবির আহমেদ মাসুম চিশতী, পলাশ ভট্টাচার্য, প্রমথেশ দাস পুলক, সঞ্জয় চক্রবর্তী, সরকার প্রতীক, সুমন আহমেদ, সাইয়েদ তারেক রহমান ও ইয়াসমিন জাহান নূপুর। ডেলফিয়া ফাউন্ডেশন সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ডের জন্য এ দশ শিল্পীকে মনোনয়ন দেয়। ছয় বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকলার বিস্তৃতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এ-ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পকলায় ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী তরুণ শিল্পীদের শিল্পভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে ডেলফিয়া কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বশিল্পকলা অঙ্গনে বাংলাদেশি তরুণ শিল্পীরা প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে বিজয় লাভ করবেন – এটা তাদের প্রত্যাশা। অ্যারন সেজার যিনি এ-ফাউন্ডেশনের পরিচালক হিসেবে এ-আয়োজনে যুক্ত হয়েছেন। সুমন আহমেদ প্রতিযোগিতায় রেখেছেন আলোকচিত্র ও ভিডিও ফিউশন। শিরোনাম ­- ‘হোয়াট আই হ্যাভ ফরগোটেন, কুড আই ফল অ্যান ওশান, হোয়াট ইজ নট রিয়েল নেভার লিভড’ ২০১১। তিনি সাম্রাজ্যবাদের নেওয়া সন্ত্রাসী নির্মূলের গুয়ান্তানামো বে  কারাগারে থাকা কয়েদির প্রতিরূপ তুলে এনেছেন। পলাশ ভট্টাচার্য স্থাপনাশিল্পে একটি রাস্তার গল্প বলেছেন, শিরোনাম দিয়েছেন ‘দ্য রোড’ ২০১১। পারফরম্যান্স ও ভিডিও আর্টে মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে আশপাশের পরিবেশ প্রভাব রাখে। পলাশ ভট্টাচার্যের স্মৃতিভান্ডার থেকে তৈরি করেছেন ‘দ্য রোড’ শিরোনামের শিল্পকর্ম। সঞ্জয় চক্রবর্তীর শিল্পকর্ম ‘আনটাইটেলড’ – ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ভাষার বর্ণনা দেন তাঁর শিল্পকর্মে। তিনি একটি লাল  রং দিয়ে আঁকেন শিল্পকর্ম। সঞ্জয় মনে করেন, রক্তের একমাত্র রং লাল, যেটি বিশ্বব্যাপী একক। কবির আহমেদ মাসুম চিশতীর ভাস্কর্য, অ্যানিমেশন ও ল্যান্ড আর্টের শিরোনাম – ‘কোয়েনড্রি’। ব্যক্তিগত অনুভূতি ও স্বপ্নের সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রকাশ করেন তিনি। এই শিল্পকর্মে সামাজিক বিস্তৃত পরিধিতে তখন বৈপরীত্য দেখা দেয়। কবির আহমেদ আত্মকথনকে শিল্পে রূপ দিয়েছেন। সরকার প্রতীকের শিল্পকর্মের মাধ্যম আলোকচিত্র। শিরোনাম ‘উইন্ড ২০১৩’। ঝড়ের মুহূর্তে গাছের ডালপালার দ্রুত নাচন দেখে তিনি এ-শিল্পকর্ম গড়েছেন। ইমেজকে নয় রকমভাবে দেখিয়েছেন তাঁর আলোকচিত্রে। এটিকে এককথায় প্রামাণ্যচিত্র বলা যায়। প্রমথেশ দাস পুলকের ভিডিও আর্টের শিরোনাম ‘এনক্যাপসুলেটেড ২০০৮’। শোলার তৈরি ফুলের ব্যবহার নিয়ে প্রমথেশ দাসের ভিডিও আর্ট। হিন্দু-বিয়েরীতিতে এ-ফুলের ব্যবহার করা হয়। তিনি প্রকৃতি থেকে আহরিত ফুলের সঙ্গে বৈপরীত্য দেখিয়েছেন গ্যাসের তৈরি মুখোশ, একে-৪৭ অথবা গ্রেনেডের। ইতিহাস বর্ণনার সঙ্গে সংস্কৃতির পরিচয়ের সূত্র দেখা যায় এ-ছবিতে। পুরস্কারের জন্য মনোনীত আয়েশা সুলতানার কাজের শিরোনাম ‘ক্যাটারাক্ট’। আয়েশা শিল্প সৃষ্টি করেন ড্রইং, পেইন্টিং, শব্দ ও ছবির অবজেক্ট নিয়ে। ছন্দ ও শব্দের পুনঃপুন ব্যবহারে তাঁর শিল্পকর্মে জীবনবোধ স্পষ্ট হয়ে দেখা যায়। আফসানা শারমিন ঝুম্পা পারফরম্যান্স শিল্পী। সামাজিক দৃষ্টিতে নারীর ভূমিকা নিয়ে তাঁর কাজ। এ-প্রদর্শনীর কাজের শিরোনাম ‘হয়ার ইজ দ্য আর্টিস্ট’। ইনডিগো রঙে মোড়ানো শুকনো ডালপালা ও পাতায় করা তাঁর কাজ। শিল্পী প্রকৃতির প্রতি মমতা থেকে মরা ডালপালার গায়ে রং ছড়িয়ে দেন। ইয়াসমিন জাহান নূপুর পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন ‘আই ক্যান টেক ইওর পেইন’ শিরোনামে। তিনি মুখমন্ডলে জড়ানো একটি দড়ির কষ্ট থেকে উৎসারিত অনুভূতি ভাগ করে নেন দর্শকদের সঙ্গে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও নারীর অধিকারকে নূপুর তাঁর কাজে দেখান।

সৈয়দ তারেক রহমান মূলত ভাস্কর। তারেক তাঁর কাজে মেটাল, সিমেন্ট ও ফাইবার গ্লাস এবং কাঠ, লোহা ও ব্রাশের ব্যবহার করেন। প্রতীকধর্মী কাজের মাধ্যমে বিষয়ের ভাষা ফুটিয়ে তোলেন। নগরায়ণ বিষয়ে তিনি তৈরি করেছেন মানুষের আকৃতি। নগরের মানুষের জীবনে জড়িয়ে থাকা যান্ত্রিক রূপ গড়ে তোলেন তিনি সূক্ষ্ম রেখার জালে। তাঁর ‘আরবান কিংস’ শিরোনামের কাজে একটি স্তম্ভের আকৃতিও দেখা যায়। উৎসবে অগ্রজ ও অনুজ বাংলাদেশি  শিল্পীদের সমন্বয়ে একটি স্পিকারস প্যানেল তৈরি করা হয়। এটি কিউরেট করেন ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট। চারজন শিল্পীর কথোপকথনের বিষয় ছিল শিল্প ও শিল্পসৃষ্টির বাংলাদেশ। শিল্পীরা হলেন – সৈয়দ জাহাঙ্গীর (জন্ম ১৯৩৫), ওয়াকিলুর রহমান (জন্ম ১৯৬১), নাঈম মোহাইমেন (জন্ম ১৯৬৯) ও আয়েশা সুলতানা (জন্ম ১৯৮৪)। পাইওনিয়ার প্যানেলের আলোচনার বিষয় ছিল সমকালীন               দক্ষিণ-এশীয় শিল্পকলায় বিপত্তির ধাপসমূহ। এ আয়োজনের মর্ডারেটর ছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের শ্রেলা ঘোষ। স্পিকার হিসেবে কথোপকথনে যোগ দেন পূজা সৌধ; ভারতের ‘খোঁজ ইনস্টিটিউটে’র পরিচালক। ১৯৯৭ সালে ভারতের এ-সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। দুশো ভারতীয় ও চারশো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শিল্পীর শিল্পসৃষ্টির বার্ষিক কর্মশালার আয়োজন করে এ-প্রতিষ্ঠান।

এছাড়া আছেন কলম্বো আর্ট বিয়েনালের আনুশকা হ্যামপেল, ছবিমেলা বাংলাদেশের উদ্যোক্তা শহীদুল আলম, পাকিস্তানের বিকন হাউস বিশ্ববিদ্যালয়ের রশিদ রানা, ভারতের কচি মোজিরিস বিয়েনালের আয়োজক রিয়াস কোমু ও ইউকের ট্রায়াঙ্গল আর্টস নেটওয়ার্কের অ্যালেসিও অ্যানটনোলি। উৎসবে আলোকচিত্রের দলীয় প্রদর্শনী কিউরেট করেছেন দীপক আনাথ। তাঁর বাছাই করা আলোকচিত্র থেকে আমরা বুঝতে পারি, প্রথাগত আলোকচিত্র দেখার অভ্যাস থেকে দর্শক বেরিয়ে এসেছেন এ-প্রদর্শনীতে। প্রতীকধর্মী, রূপাশ্রয়, জ্যামিতি, সমাজবাস্তবতা ও আবহমান বাংলাদেশ উঠে এসেছে আলোকচিত্রীদের কাজে। ‘লাইফ ব্লাড’, ‘সিটিজেন অব টাইম’ ও ‘এক্সিস্ট’ শিরোনামের দলীয় আয়োজনে আলোকচিত্রের নিরীক্ষায় বিষয় গড়েছেন তাঁরা। লিবার্টি শিরোনামের প্রথাগত চিত্রকর্মের প্রদর্শনী কিউরেট করেছেন ­মো. মনিরুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাকির হোসাইন। এই প্রদর্শনী দর্শকদের সামনে এনেছে বাংলাদেশি সমকালীন শিল্পকলার সম্ভার। প্রদর্শিত কাজের শিরোনাম বা ভাবনা ‘লিবার্টি’, নানা কৌশল ও রীতির কাজে শিল্পীর নিজস্বতা স্পষ্ট হয়েছে কাজগুলোতে। বাংলাদেশের শিল্পকলায় যাঁরা ধারাবাহিক অবদান রাখছেন, তাঁদের শিল্পকর্মকে একটি ভাবনাপ্রধান বিষয়ে আবদ্ধ হতে দেখা যায়। গত শতকের তিন প্রজন্ম সত্তর, আশি ও নববইয়ের দশকের শিল্পীদের কাজ নিয়ে শিল্পীরা হাজির হয়েছেন। আবদুল মান্নান প্রকৃতিকে এঁকেছেন বাস্তবরীতিতে। আবহমান বাংলার আকাশ, নদী, জাল, নৌকা ও মানুষের কোলাহল এ-শিল্পকর্মের প্রাণ।

আবদুস শাকুর শাহ্ বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা এঁকেছেন মেটে হলুদ রং আর নকশিকাঁথার নকশার মাঝে। আবদুস শাকুর শাহ্র লোককথার ধরন এ-কাজে হাজির হয়েছে খানিকটা। সৈয়দ আবুল বারক আলভী প্রকৃতির রং-রেখা জ্যামিতি নিয়ে ক্যানভাস সাজিয়েছেন। বাস্তবধর্মী নির্মাণে আহমেদ সামছুদ্দোহা, জামাল আহমেদ ও মোস্তাফিজুল হক নিজস্ব করণরীতি বজায় রেখেছেন।

ষাটের দশকে ঢাকার চারুকলা শিক্ষার ঊষালগ্নের শিল্পীদের কাজের ধরন আর নববইয়ের দশকের কাজের বিষয় সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি হয়, যেমন ­- রশীদ আমিন, তাসাদ্দুক হোসেন দুলু, আলপ্তগীন তুষার, শিশির ভট্টাচার্য প্রমুখ। তাঁদের কাজে জ্যামিতি, ব্যক্তিক অনুভূতি, সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজের চলতি আবহ  উঠে এসেছে। উৎসবে দক্ষিণ এশিয়ার একত্রিশটি আর্ট গ্যালারি তাদের সংগৃহীত শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে। এ সামিট থেকে দক্ষিণ-এশীয় দেশগুলোর ছবির বাজার ও খ্যাতিমান শিল্পীদের আঁকা কাজের ধরন সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয় দর্শকদের মাঝে। যেমন ভারতের মহারাষ্ট্রের ‘আর্ট অ্যান্ড সোল’ গ্যালারি প্রদর্শন করে ভিনিতা করিমের কাজ ­- ‘দ্য ফুল মুন’; বাংলাদেশের ‘এথেনা গ্যালারি অব ফাইন আর্টস’ কনক চাঁপা চাকমা, জামাল আহমেদ, রোকেয়া সুলতানা, মো. আইনউদ্দিন, মো. টোকন ও সৈয়দ ফিদা হোসেনের কাজ প্রদর্শন করে; বাংলাদেশের ‘বৃত্ত আর্ট স্পেস’ ১৫ জন শিল্পীর শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে; ‘দিল্লি আর্ট গ্যালারি’ চিত্ত প্রসাদসহ আরো পাঁচজন শিল্পীর কাজ প্রদর্শন করে;  ‘ঢাকা আর্ট সেন্টার’ প্রদর্শন করে আনিসুজ্জামান সোহেলের শিল্পকর্ম। এছাড়া ‘দৃক গ্যালারি’, কলকাতার ‘এক্সপেরিমেন্টাল’, বাংলাদেশের ‘গ্যালারি 21’, ‘গ্যালারি চিত্রক’, ‘গ্যালারি কসমস’, ‘গ্যালারি জলরঙ’, ‘গ্যালারি কায়া’, ‘ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান ক্রিয়েটিভস’ প্রভৃতি গ্যালারির চিত্রকর্ম প্রদর্শনের পাশাপাশি তুর্কিস্তানের ‘পি-১ আর্ট ওয়াকর্স গ্যালারি’ তৈয়বা বেগম লিপির স্থাপনাশিল্প প্রদর্শন করে। ভারতের মুম্বাইয়ের ‘গ্যালারি প্রজেক্ট ৪৮৮’ রিসাম সাঈদের শিল্পকর্ম নিয়ে প্যাভিলিয়ন সাজায়।

উৎসবে একক শিল্পকর্ম প্রজেক্টের কিউরেটর ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট দক্ষিণ-এশীয় শিল্পকলার এ বৃহৎ আয়োজন প্রসঙ্গে মত দেন। এরকম সীমানার বাইরের অংশগ্রহণে ইচ্ছুক দল ও দেশগুলোকে একটা কঠিন ভিসা ও পাসপোর্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হয়। শুল্ক বিভাগের আধুনিক শিল্পকলার মাধ্যম ও তৈরির নানা কৌশল না জানায় বিষয়টি কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে কোনো কোনো শিল্পী বাংলাদেশের বাইরের শিল্পনির্মাণ উপকরণ সীমাবদ্ধতার কারণে নিয়ে আসতে পারেননি। ঢাকা আর্ট সামিটের এই জটিল প্রক্রিয়া বাদে অন্যান্য আয়োজন একেবারে ব্যতিক্রম। শিল্পকর্মের ধারণা, মাধ্যমের নতুনত্বে শিল্পীরাই শুধু নন, অন্য পেশার মানুষও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এটি এ-উৎসবের ব্যতিক্রমী দিক। শিল্প সামাজিক নির্মাণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে গণমানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এগিয়ে যাবে – এমন মতামতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনের কিউরেটর ঢাকা আর্ট সামিটের আগামী আয়োজনের জন্যে অপেক্ষায় রইলেন। ঢাকা আর্ট সামিটের কিউরেটর শিল্পীজীবনের কথনের সঙ্গে এ-সামিট নিয়ে মূল্যায়ন করেন এভাবে, পারফরম্যান্স ও নিরীক্ষামূলক চলচ্চিত্রের অংশটি কিউরেট করেন মাহবুবুর রহমান। তিনি সরাসরি কিছু শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেন। কিন্তু চলচ্চিত্র-নির্মাতারা আমার অচেনা। এক্ষেত্রে চূড়ান্ত নির্বাচনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে। মূলধারার চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রের পার্থক্য হলো একটির উপকরণ ঋদ্ধ নয়, অন্যটির উপকরণে নন্দনতাত্ত্বিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়। এ-উৎসবের চলচ্চিত্রে রাজনীতি, সামাজিক লক্ষ্য ও ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের আঁচ পাওয়া যায়। বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পকলা উৎসবের মধ্যে ভেনিস বিয়েনাল, লিয়ন বিয়েনাল, ডকুমেন্টা ফেস্টিভাল ও কলম্বো বিয়েনালের কাজ দেখেছি। কিন্তু বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজে যথাযথ কিউরেটিংয়ের অভাব বোধ করেছি। বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট গড়ে তোলার সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতায় যোগ হয়েছে বিভিন্ন শিল্পীর শিল্পকর্ম। ঢাকা আর্ট সামিট এমন একটি উৎসব, যেখানে শিল্পী, কিউরেটর এবং কমিশনার একসঙ্গে তাঁদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। উজ্জ্বল দক্ষিণ-এশীয় শিল্পকলা সম্পর্কে তাঁরা জানতে পেরেছেন। বিশ্ববাসীর কাছে এ-উৎসব মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সমকালীন শিল্পকলা-সম্পর্কে বিশ্বের শিল্পকলার দর্শকদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। উৎসবের একক প্রদর্শনীর বিষয়ে রয়েছে ১৪টি বাংলাদেশি সমসাময়িক উপাদানে গড়া। কিউরেটর ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট মাধ্যমের বৈচিত্র্যের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগ রয়েছে মনে করেন। সাজিয়া সিকান্দারের মাল্টি চ্যানেল ভিডিওগ্রাফিতে তাঁর নিজের আঁকা চিত্রকর্মের আবহ দেখা যায়। সুরের সঙ্গে কবিতা মিশিয়ে তিনি তৈরি করেছেন ‘দিস ইজ অ্যা প্যারালাক্স’। রানা বেগম জন্মেছেন ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের সিলেটে। তারপর তিনি ১৯৮৫ সালে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। শ্লেড স্কুল অব ফাইন আর্ট অ্যান্ড দ্য চেলসি কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন লন্ডনের ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিল্পী রানা শিল্পকর্ম গড়েছেন হাতে তৈরি বাঁশের ঝুড়ির সাহায্যে। তাঁর শৈশবের স্মৃতিতে থাকা বাঁশের ঝুড়ির সাহায্যে (১০০০ ঝুড়ি) গড়েছেন একটি তোরণ, যেটি উৎসবে আসা দর্শকদের স্বাগত জানায়। নেপালি শিল্পী তাসিহিরিন শেরপা তিনটি নতুন চিত্রকর্মে টিবেটনে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেছেন একুশ শতকের দর্শকের সঙ্গে। নাঈম মোহাইমেনের ‘সকল চরিত্র কাল্পনিক’ শিরোনামে ২০২৪ সালের সংবাদপত্র ফিকশনাল সংবাদে ছাপা একটি খবরপত্র দর্শকদের কাছে ছড়িয়ে দেয়। এটির পরিকল্পনার সঙ্গে দর্শকদের একাত্ম হতে কিছু সময় ভাবতে হয়। রশিদ রানা পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। তাঁর শিল্পকর্ম ‘অ্যা রুম ফ্রম টেড মডার্ন’। দর্শক এতে ত্রিমাত্রিক আলোকচিত্রের অনুভূতি পাবেন। স্থির আলোক প্রবাহের সঙ্গে দেয়ালের চিত্র দর্শক-অনুভূতিতে নাড়া দেয়। রথিন বর্মণ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সম্পর্ক নিয়ে গড়েছেন ‘আনটাইটেলড’। ত্রিপুরা ভারতের রাজ্য হলেও বাংলাদেশ তার তিনদিক ঘিরে আছে। ১৯৫০, ১৯৬০ সালের দেশভাগ তাঁর ভাষা ও কৃষ্টিকে বিভক্ত করতে পারেনি। এটি ছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিভাজন। রথিন বর্মণ মূলত একজন যন্ত্র-প্রকৌশলী। তিনি এ-উৎসবে সৃষ্টি করেছেন নতুন আকৃতি। পুরনো বিল্ডিং তৈরির আগ্রহকে এ-শিল্পকর্মে প্রাধান্য দিয়েছেন। তৈয়বা বেগম লিপি বাংলাদেশের সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। বারো ভাইবোনের বড় এক পরিবারে লিপির জন্ম ও বেড়ে ওঠা। গাইবান্ধার ছোট্ট গ্রামে চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল ছিল গত শতকের সত্তরের দশকে। সেখানে মানবশিশুর জন্মের সময় একমাত্র অস্ত্র ব্যবহৃত হতো ধারালো ব্লেড। লিপির গড়া শিল্পকর্মে ব্লেড ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের চিকিৎসা সংস্কৃতির প্রকৃত বেদনা উৎসারিত। বাংলাদেশি ব্লেডের ব্র্যান্ড বলাকা খোদাই করে লেখা হয়েছে প্রতিটি ব্লেডে। তাঁর ‘বিজার অ্যান্ড বিউটিফুল’ সিরিজের এ-শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেছে ‘সলোমন আর গুগেইনহাম মিউজিয়াম’। ঢাকা আর্ট সামিটে লিপির শিল্পকর্মের শিরোনাম ­- ‘অ্যা রুম অফ মাই ওন’। এটি তাঁর জীবনের ধারাবাহিক একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের প্রতিচ্ছবি। সে-সময়ে ধারণ করা সাদা-কালো ও রঙিন আলট্রাসাউন্ড রিপোর্ট। দর্শকের জন্যে তিনি প্রকাশ করেছেন কম আলো ও বেশি আলোর কিছু ব্যক্তিগত রিপোর্ট। মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশে নিরীক্ষাধর্মী শিল্পের সঙ্গে যন্ত্র সংযোগ করেন। ‘অ্যা স্পেস ফর রেইনবো’ শিরোনামের চার চ্যানেলের ভিডিও স্থাপনা শিল্পকার্য শব্দ, রেপ্লিকেটেড অনুষঙ্গ ও স্টেইনলেস স্টিলের কাঁচির সাহায্যে গড়েছেন ইউরিনাল ও বেসিনের অবয়ব। শিল্পকর্মে শিল্পী মনে করেন, মানুষ তাঁর পরিচয় হারাচ্ছে ওয়াশরুমে, যেটি একমাত্র কক্ষ যাতে মানুষ নিজেকে শুদ্ধ করে নেয়। শান্তি ও সুখের আশায় অস্থির মানুষের আস্থা রংধনুর আকাশে। তিন ধরনের শিল্পকর্মে মাহবুবুর রহমান তিনটি বক্তব্য হাজির করেছেন। ২০১২ সালের  সফল আয়োজনের পরে এ-বছরের দ্বিতীয় ঢাকা আর্ট সামিট বাংলাদেশের ইতিপূর্বে আয়োজিত সব শিল্পকলার উৎসবকে ছাড়িয়ে যায়। ২৫০ জন দক্ষিণ-এশীয় শিল্পীর শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে বিশ্ব-শিল্পাঙ্গনে দক্ষিণ-এশীয় শিল্পীদের জন্যে নতুন দুয়ার খোলা  হলো।