মরিৎস ভিনটারনিৎস : জন্মসার্ধশতবর্ষে

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উনিশ শতকে বঙ্গীয় নবজাগরণ যদি হয় রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ আধুনিকতায় দীক্ষিত মনীষীর নিরন্তর সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আর ধর্মীয় দিকগুলোকে মধ্যযুগীয়তা থেকে যুক্তিশীল আধুনিকতায় স্থাপন প্রয়াস, তাহলে একই সঙ্গে আরো দুটি বিবেচ্য বিষয় মাথায় রাখা উচিত আমাদের। বাংলার নবজাগরণে বাঙালি মুসলমানের সংযুক্তি তার মধ্যে একটি। রাজা রামমোহন রায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সুদীর্ঘকালের কালাপানি না পেরোনোর সংস্কার সর্বপ্রথম ভেঙেছিলেন, তথ্যটি এখন বর্জনের সময় হয়েছে। রামমোহন বিলেত যান ১৮৩১ সালে। কিন্তু এর ছেষট্টি বছর আগে মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন ১৭৬৫-তেই ইংল্যান্ড যান, এবং আট বছরকাল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ভ্রমণ করে শিগার্ফনামা এ-বিলায়েত নামে ভ্রমণকাহিনি লেখেন। রামমোহনের আগে বিলেত ভ্রমণ করেছেন বলেই তাঁকে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা বলে গ্রহণ করছি না। করছি তাঁর মুক্তচিন্তা প্রকাশের জন্য। বিলেতে ইতিসামুদ্দীনের কদর ছিল, তিনি ফারসিতে পারদর্শী ছিলেন বলে (তিনি ফারসিতেই তাঁর সফরনামা রচনা করেছিলেন)। এজন্য তখনকার ব্রিটেনবাসী তাঁকে সেখানে থেকে যেতে অনুরোধ জানান, কেননা, সে-সময়ে যেসব ব্রিটিশ ভাগ্য ফেরাতে ভারতে আসতে প্রলুব্ধ হচ্ছিল, ফারসিভাষা শিক্ষা তাদের কাছে জরুরি বলে বিবেচিত ছিল। কিন্তু মির্জা থাকেননি। আর তাঁর না থাকার যুক্তিতেই আধুনিক মননের প্রমাণ পাওয়া যায়, যা নবজাগরণভাবনার সমরেখ। মির্জা লিখছেন, সুলেমানের সিংহাসনের চেয়েও নিজ জন্মভূমির প্রতি মমতা মহত্তর। ডিরোজিওর ‘To My Native Land’ কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করলে উপলব্ধ হবে, রেনেসাঁস বা নবজাগরণ যে স্বদেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধকে শিরোধার্য করেছে, সে-বিচারে মির্জা অবশ্যই নবজাগরণের বার্তাবাহী। তাছাড়া রামমোহনের আগে শেখ দীন মুহাম্মদও (১৭৫৯-১৮৫১) বিলেত যান, ১৭৮১-তে। তিনিও ইংরেজি ভাষায় তাঁর ভ্রমণকাহিনি লেখেন, The Travels of Dean Mahomet, A Native of Patna in Bengal, Through Several Parts of India. পাশাপাশি আমরা হাজী মুহম্মদ মহসীনের নামও স্মরণ করতে পারি, যিনি মুসলমানদের শিক্ষার উন্নতিকল্পে কয়েক কলস টাকা দান করে শিক্ষার প্রসারে এখনো অবদান রেখে চলেছেন। অন্যদিকে নবাব আবদুল লতিফও শিক্ষার প্রসারে কম অবদান রাখেননি। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো তাঁরও নীলকরবিরোধী ভূমিকা ছিল।

বাংলার নবজাগরণে মুসলমান বাঙালিকে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে বলেই কথাগুলি বলতে হলো। কাদম্বিনী বসু, সরলা দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী দেবীরা যেমন সে-যুগে নারী-স্বাধীনতা, নারীপ্রগতির ধ্বজা তুলে ধরেছিলেন, তেমনি বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামালদের ভূমিকাও ছিল সম্ভ্রান্ত, প্রগতিশীল এবং দিশারী।

এই এক দিক, আর অন্য দিক হলো বিদেশি ভারত-বিদ্যাপথিকদের অবদান। বস্ত্তত উনিশ শতকে যে প্রাচীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা ও কৌতূহলের সূচনা, তার পেছনে ব্যাপক অংশেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মনীষীদের ভাবিত ও তৎপর হতে দেখা যায়। মরিস ভিনটারনিৎসের ভারতচর্চা সেই ব্যাপ্ত ভারত-অন্বেষার অনুষঙ্গেই বিচার্য। এর সূচনা হয় স্যার উইলিয়াম জোনসের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নিয়ে আলোচনার সূচনায়। এরই গতিজাড্যে একদিকে হ্যালহেডের ব্যাকরণ, উইলিয়ম কেরির গ্রন্থ-প্রণয়ন, কানিংহাম, টড প্রমুখের ইতিহাস-অনুসন্ধান উসকে দিয়েছিল রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ বিশ্বজনকে নব নব মানবিকী বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হতে। সংবাদপত্রের যে-স্রোত গোটা উনিশ শতকজুড়ে বাঙালি মানসিকতাকে আধুনিকতায় দীক্ষিত করে এবং সেইসঙ্গে সাময়িক পত্রিকা, তার পেছনেও হিকি প্রমুখ অগ্রবর্তীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই পটভূমি হিসেবে পাশ্চাত্য মনীষীদের ভূমিকা অজ্ঞাত থাকলে ভিনটারনিৎসকে তাঁর যথার্থ মর্যাদায় স্থাপন করা যাবে না।

 

দুই

ভারতবিদ্যাচর্চার অগ্রগামী পুরুষ নিঃসন্দেহে স্যার উইলিয়াম জোনস (১৭৪৬-৯৪)। একাধারে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা (১৭৮৪), শকুন্তলা, হিতোপদেশ এবং নাদির শাহের জীবনী ফারসি থেকে ফরাসিতে অনুবাদ ইত্যাদি অবদানে ভারতবিদ্যাচর্চাকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন অক্সফোর্ডের এই ছাত্র। আবার উইলিয়ম কেরি (১৭৬১-১৮৩৪) পঞ্চাশের বেশি গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে যেমন সারস্বত সাধনার দীপ জ্বেলে গেছেন, তেমনি বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভাষার অভিধান রচনা, বাংলা হরফের সংস্কার, অন্যান্য ভারতীয় ভাষার হরফ নির্মাণের মাধ্যমে যে-অবদান রেখে গেছেন, তার সামগ্রিক ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। আঠারো শতাব্দীর অন্য এক ভারতবিদ, যিনি কেরি-জোনসের মতো এদেশে এসেছিলেন, ‘স্কুল বুক সোসাইটি’র সক্রিয় সদস্যরূপে যাঁর উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল, হলেন উইলিয়াম ইয়েটস (১৭৯২-১৮৪৫)। সংস্কৃত অভিধান রচনা (পরে মনিয়র উইলিয়মস ১৮৫১-তে বিপুলায়তন সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন) ছাড়াও পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক পরিভাষা নির্মাণে তাঁর স্বকীয় ভূমিকা ছিল যথার্থ শ্রদ্ধার। জোশুয়া মার্শম্যান (১৭৬০-১৮৩৭) অবিস্মরণীয় সংবাদপত্র সম্পাদনায় (Friend of India, সমাচার দর্পণ এবং দিগ্দর্শন, এই তিনটি পত্রিকার সম্পাদনার ভূমিকায় দেখা যায় তাঁকে) যেমন, তেমনি কেরি-সহযোগে রামায়ণ অনুবাদে তাঁকে সহকারী হতে দেখি। শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠাও মার্শম্যানের অপর কীর্তি। রামমোহনের সঙ্গে মসি-যুদ্ধই রামমোহনকে বেদান্ত-অনুবাদে প্ররোচিত করে। এরকমই স্মরণীয় একটি নাম জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন (১৮৫১-১৯৪১), যাঁর ২০ খন্ডে বিন্যস্ত Linguistic Survey of India এক অবিনশ্বর কীর্তি। মাক্স মিলারের (১৮২৩-১৯০০) একান্ন খন্ডে সম্পাদিত The Sacred Books of the East-এর বিস্ময়করতার পরেই স্থান দিতে হয় গ্রিয়ারসনকে। এ-গ্রন্থ সম্পাদিত না হলে রামমোহন-দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন একদিকে যেমন ইন্ধন পেত না, তেমনি একদিকে রবীন্দ্রনাথ, অন্যদিকে বিবেকানন্দের যে উপনিষদ-প্রযোজিত জীবনাদর্শন, তারও বেশ কিছুটা ন্যূনতা পরিলক্ষিত হতো।

আমাদের আলোচ্য মনীষী ভিনটারনিৎস পাশ্চাত্য ভারততত্ত্ববিদদের ব্যাপ্ত পরিসরেই একমাত্র আলোচিত হতে পারেন, নইলে তাঁর কৃতির সামগ্রিক মূল্যায়ন আমাদের চোখে ধরা পড়বে না সঠিক মাত্রায়। মনে রাখতে হবে, এর পুরোধাব্যক্তি ছিলেন উইলিয়াম জোনসের মতো অত্যাশ্চর্য ব্যক্তিত্ব, যাঁর আয়ত্তে ছিল একাধারে সংস্কৃত, অন্যদিকে আরবি, গ্রিক, ল্যাটিন, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান প্রভৃতি বহু ভাষা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদের এও জানাচ্ছেন, জোনস ছিলেন অশ্বারোহণে পটু এবং বীণাবাদনেও পারদর্শী। তিনি ভাষাবিদ্যাচর্চার দুয়ার খুলে দিয়ে দেখালেন, পৃথিবীর যাবতীয় প্রধান ভাষার মধ্যে নিবিড় আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। এরই ফল হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গড়ে উঠল ভাষাচর্চা কেন্দ্র একদিকে, অন্যদিকে Indology তথা ভারতচর্চা, ও সেইসঙ্গে প্রাচ্যবিদ্যাচর্চা (Orientalism) কেন্দ্র। ১৭৯৩-তে মিশরে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী কর্তৃক ‘রোসেটা স্টোন’প্রাপ্তি এবং ১৮১৪-তে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ টমাস ইয়ংয়ের সেই শিলালিপির পাঠোদ্ধার মিশরীয় ভাষা ও ইতিহাসচর্চার দুয়ার খুলে দিয়ে ভাষাচর্চার দিগন্তকে এ-সময় আরো প্রসারিত করে দিলো।

মাক্স মিলার ছিলেন প্রথমে বার্লিন ও পরে প্যারিসে যথাক্রমে বোপ এবং বুর্নুফের (১৮০১-৫২) ছাত্র। আবার ভিনটারনিৎস পরবর্তীকালে মিলারের সহকর্মী হন। পরম্পরাটা এবার একটু বুঝে নেব।

মরিৎস ভিনটারনিৎসের জন্ম ১৮৬৩-তে অর্থাৎ আজ থেকে দেড়শো বছর পূর্বে। তারিখটি হলো তেইশে ডিসেম্বর। অন্যূন চুয়াত্তর বছরের আয়ু ছিল তাঁর। মৃত্যু জানুয়ারির ৯ তারিখ, সাল ১৯৩৭।

তাঁর জীবনের দুটি পর্ব আমাদের প্রধান আলোচ্য হবে। প্রথমে আমরা দেখব তাঁর সংস্কৃত, প্রাকৃত, পালি ভাষা শিক্ষা, আজীবন এসব ভাষাচর্চা ও অধ্যাপনা, মাক্স মিলারের সাহায্যকারী হিসেবে তাঁর ভূমিকা, প্রাচ্যবিদ্যা সংক্রান্ত একাধিক গ্রন্থ রচনা ও পাঁচ শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে তাঁর বিশ্বভারতীতে অধ্যাপকরূপে যোগদান ও সেই সূত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হয়ে বক্তৃতা প্রদান, এবং অবশেষে পুনেতে ‘ভান্ডারকর  ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ স্থাপনে তাঁর অবদান।

ভিনটারনিৎস যখন ভারতবিদ্যাচর্চার উদ্যোগ পর্বে ১৮৮০-তে ভাষাতত্ত্ব ও দর্শন অধ্যয়নের জন্য ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তার আগেই তিনি হিব্রু ভাষা শিখে বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। সে-সময়ে ভিয়েনা সংস্কৃত ভাষাচর্চা ও তৎসহ প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার পাঠস্থান ছিল। ১৮৫২-তে হেববের (Albrecht Friedrich Seber, 1825-1991) সর্বপ্রথম ভারতীয় সাহিত্যের যে-ইতিহাস রচনা করেন, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বহু অনুসন্ধিৎসু গবেষক ভারতীয় ভাষা নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। হেববের দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর  Indische Studien নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন, ভারতবিদ্যা বিষয়ে যে-পত্রিকা নিয়ত আগ্রহীজনকে উদ্বুব্ধ করত। জন বিমসের (১৮৩৭-১৯০২) A Comparative Grammar of the Aryan Languages of India (তিন খন্ডে, ১৮৭২-৭৯) প্রকাশিত হয়ে গেছে তখন। ভারত থেকে সম্পাদিত ফ্লিটের (John Faithful Fleet,   ১৮৪৭-১৯১৭) Indian Antiquaryও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের গবেষকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো। এখানে স্মর্তব্য, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, ভূগোল, সাহিত্য ও ব্যাকরণের যাবতীয় দিক নিয়েই পাশ্চাত্য পন্ডিতদের আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসা এবং গবেষণায় আত্মনিয়োগ লক্ষ করা গেছে। পার্জিটার (১৮৪৮-১৯২৩) যেমন নিয়োজিত ছিলেন ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপির পাঠোদ্ধার, রামায়ণ, মহাভারতে বর্ণিত স্থানসমূহের ঐতিহাসিকতা নির্ণয় আর পুরাণ-গবেষণায়, অন্যদিকে স্যার জন জর্জ উডরফ (১৮৬৫-১৯৩৬) আগ্রহী ছিলেন তন্ত্রবিষয়ক গবেষণা কাজে। তাঁর হাত দিয়েই পাওয়া গিয়েছে মহানির্বাণতন্ত্রের মতো অসাধারণ তন্ত্রগ্রন্থের সম্পাদনা ও অনুবাদ (১৯১৩)। বস্ত্তত ভারতবিদ্যা ও তৎসহ প্রাচ্যবিদ্যা নিয়ে যে কী বিপুল উত্তেজনা, উৎসাহ, কৌতূহল, অনুসন্ধিৎসা এবং জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছিল, তা জানলে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। এই অনুসন্ধিৎসা, উল্লেখ করা কর্তব্য, এতো দূর পর্যন্তই প্রসারিত ছিল  যে, পার্জিটার চট্টগ্রামের প্রচলিত কথ্যভাষা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে সে-বিষয়ে বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রবন্ধ লেখেন। জর্জ অগাস্টাস জেকব (১৮১০-১৯১৮) ছিলেন সংস্কৃত অলঙ্কার ও একই সঙ্গে যোগ, মীমাংসা ও বেদান্তদর্শনে আগ্রহী ও ব্যুৎপন্ন। অন্যদিকে প্রাকৃত ভাষাচর্চা, জৈনধর্ম ও দর্শনচর্চা, শুক্রযজুর্বেদ এবং হালের প্রাকৃত ভাষায় রচিত গাথাসপ্তশতীর সম্পাদনাকাজে হেববেরকে আজীবন ব্যাপৃত দেখা যায়। অতএব ভারতবিদ্যা বিষয়টি যে কত বহুমাত্রিক আকারে পাশ্চাত্য বুধমন্ডলী গ্রহণ করেছিলেন, তা ভাবলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না আমাদের।

এই ইউরোপীয় সারস্বত পরিমন্ডলেই বিদ্যাচর্চা শুরু হয়েছিল ভিনটারনিৎসের। বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদদের কাছে তাঁর পাঠ গ্রহণের সুযোগ হয় ভিয়েনায়। এঁদের মধ্যে দুজনের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, – গেয়র্গ বুলার ফ্রিডরিশ মিলার ও অয়গেন হুলটশ। এর আগে উনিশ শতকের গোড়ায় ফরাসি প্রাচ্যবিদ উঝান বুর্নুফ (১৮০১-৫২) যে প্রাচ্যবিদ্যাচর্চা ও বিকাশের সূচনা করেছিলেন, বৈদিক ভাষার সঙ্গে জেঙ্গ আবেস্তার ভাষার নিকটসম্বন্ধ দেখিয়ে, বৌদ্ধ ধর্মের ওপর যুগান্তকারী বই লিখে, সেই ‘মনৌবজ্র সমুৎকীর্ণে সূত্রস্যমেব’ গতি হয়েছিল ভিনটারনিৎসের।

ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডক্টরেট লাভ করে পিএইচ-ডি উপাধিধারী হন তিনি। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল প্রাচীন ভারতের বিবাহরীতি ও ইঙ্গো-ইউরোপীয় মানুষের বিবাহরীতির তুলনামূলক আলোচনা। তাঁর এই গবেষণা-সন্দর্ভটি ১৮৯২-তে ভিয়েনা বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

১৮৮৮-তে ভিনটারনিৎসের সঙ্গে যোগাযোগ হয় সুখ্যাত ভারতবিদ মাক্স মিলারের (Max Mueller)। মাক্স মিলারের একজন সহকারীর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, অক্সফোর্ডে যখন তিনি অধ্যাপনা ও সেইসঙ্গে ঋগ্বেদসংকলনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অতঃপর ভিনটারনিৎস মিলারের সহযোগী হবার শেষেও অক্সফোর্ড থেকে সংস্কৃতচর্চায় মগ্ন হন। এ-সময় তাঁর কার্যাবলির মধ্যে ছিল বডলিন লাইব্রেরিতে রক্ষিত সংস্কৃত পুস্তকের তালিকা প্রণয়ন এবং লন্ডনে রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারে রক্ষিত দক্ষিণ ভারতের প্রাপ্ত পুঁথির তালিকা প্রস্ত্তত। এরপর ১৮৯৯-তে তাঁর প্রাগে ফিরে গিয়ে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান। প্রাগ থেকে তিনি ভারতবিদ্যাবিষয়ক একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন।

তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি জর্মন ভাষায় তিন খন্ডে লেখা ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস (১৯০৯-২২)। এর ইংরেজি অনুবাদ বের করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২৭-৩২)। তাছাড়া গৃহ্যসূত্র, প্রাচীন ভারতে বিবাহ অনুষ্ঠান, ভারতীয় ধর্মে রমণী তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ। ১৯২২-২৩-এ রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনার ভূমিকায় থাকাকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহাতিশয্যে তিনি ছটি ‘রিডারশিপ লেকচার’ দেন। তাঁর বক্তৃতাসমূহ Some Problems of Indian Literature নামে ১৯২৫-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর এ-পর্যায়ে বক্তৃতার বিষয়গুলি ছিল বেদের কাল, প্রাচীন ভারতের ধর্মসাহিত্য, প্রাচীন ভারতের ভারতীয় ও বিশ্বসাহিত্য, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং ভাস।

ভারততত্ত্বচর্চায় ভিনটারনিৎসের অবদান কী? ভারতবিদ্যাবিষয়ক তাঁর রচনায় তিনি বহু স্থলেই নতুন আলোকসম্পাত করেছেন। বৈদিক সাহিত্যের কাল নিরূপণ, রামায়ণ মহাভারত সম্পর্কে আলোকপাত, বৌদ্ধ ও জৈনশাস্ত্র নিয়ে গভীর অবলোকন, ভারতীয় প্রাচীন নাট্যসাহিত্য নিয়ে দিশারি দৃষ্টিপাত, ভারতীয় দর্শনের নানাদিক নিয়ে কৌতূহলী দিক উন্মোচন ভিনটারনিৎসের ভারতচর্চার অঙ্গ। বেদের রচনাকাল নিয়ে পন্ডিতে পন্ডিতে সুদীর্ঘকালের মতভেদ। মাক্স মিলার সিদ্ধান্ত করেন (তাঁর বক্তব্যের পেছনে ভাষাতাত্ত্বিক, রচনার ভূরিপরিমাণ মিসিং লিংক সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল), পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই যা ঋগ্বেদের সময়কালকে সঠিকভাবে নির্ণয় করতে সমর্থ, – ‘Whether the Vedic hymns were composed 1000 or 1500 or 2000 or 3000 years B.C. no power on earth will ever determine.’ সেখানে বিবিধ যুক্তি দেখিয়ে ভিনটারনিৎস মন্তব্য করেন, বেদ রচনার সূচনাকাল ২০০০ বা ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব এবং সমাপ্তিকাল খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অথবা ৭৫০। তিনি তথ্য নির্দেশ করে দেখান, অথর্ববেদকে মহাভারত রচনার পূর্বে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো না। মহাভারতের সময়কাল থেকেই ক্ষাত্রবেদ-রূপে রাজারাজরার কাছে এই অর্বাচীন বেদ গুরুত্ব লাভ করতে থাকে। বেদের ব্রাহ্মণ অংশকে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান, এখানে নৈতিকতার কোনো বালাই নেই, যেন মিশরের প্রাচীন অনৈতিক পুরোহিতদের মতোই এখানে ‘Corrupt priesthood eager for gain’-এরই এষণা। অন্যদিকে বেদান্ত বা উপনিষদ সম্পর্কে তাঁর মত, ‘It is the teachings of various men, even of various periods, which are presented in the single sections of the Upanishads.’

রামায়ণ মহাভারতের আলোচনায় বহু মনীষী ‘ইতিহাসবেদ’ ও ‘পুরাণবেদ’ সম্পর্কে যে বায়বীয় মত প্রকাশ করতেন, তিনি                সে-প্রসঙ্গে ‘ইতিহাসবেদ’ বলে কোনো বস্ত্ত ছিল না বলে মত প্রকাশ করেন। মহাকাব্যগুলিকে তিনি বহু কবিকৃতি বলে মত ব্যক্ত করেন। মহাভারতের প্রকৃতিগত ব্যাখ্যাদানে চমৎকৃতি এবং অভিনবত্ব প্রদর্শন করেছেন ভিনটারনিৎস। পাশ্চাত্যের যে গ্রিক মহাকাব্যদ্বয়, হোমারের ইলিয়ড ও ওডিসি, ও সেইসঙ্গে জর্মন মহাকাব্য Nibelungen Song-এর প্রতিতুলনা করে তিনি দেখাচ্ছেন, মহাভারতের যুগ যুগান্তরের চলমানতা ওই মহাকাব্যগুলোয় নেই। রবীন্দ্রনাথ যে-অর্থে আমাদের মহাকাব্যকে ভারতবর্ষের চলমান ইতিহাস বলেছেন, ভিনটারনিৎস তাঁর স্বকীয় বিশ্লেষণে একই জায়গায় আমাদের দাঁড় করান।

কেবল বৈদিক সাহিত্য বা রামায়ণ মহাভারত প্রসঙ্গেই নয়, অন্যত্রও ভিনটারনিৎস যুক্তিবাদী এবং একই সঙ্গে রসজ্ঞ। বুর্নুফ, হেববর, গোল্ড স্টুকার, কিম মিলার প্রমুখ প্রাচ্যবিদের পাশে স্বকীয় মতামত ও গবেষণার একেক নিষ্ঠায় বহু কারণেই ভিনটারনিৎস নিজস্ব অবদানের স্বীকৃতি রেখে গিয়েছেন।

যেমন ধরা যাক সংস্কৃত নাটক নিয়ে তাঁর আলোচনা। সদ্য আবিষ্কৃত ভাস নিয়ে তাঁর কৌতূহল ছিল অপার। সংস্কৃত নাট্যকাররা, যেমন কালিদাস, তাঁদের নাটকে পূর্বসূরি হিসেবে ভাসের নাম উল্লেখ করলেও ১৯০৭ সাল পর্যন্ত তাঁর কোনো নাটকেরই সন্ধান মেলেনি। দক্ষিণ ভারতের পন্ডিত গণপতি শাস্ত্রী ভাসের ১৩টি নাটকের পান্ডুলিপি আবিষ্কার করেন এবং আবিষ্কারের পাঁচ বছর বাদে    ১৯১২-তে নিজ সম্পাদনায় একে একে প্রকাশ করতে থাকেন। ১৯২৩-এ ভিনটারনিৎস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস নিয়ে যখন বক্তৃতা দেন, সে-সময় ভাস আদৌ পঠিত হয়ে ওঠেনি। সংস্কৃতানুশীলনে অনুধ্যায়ী রবীন্দ্রনাথও যে ভাস-কৃত নাটক পাঠ করেছেন, তার কোনো প্রমাণ নেই। যাই হোক, ভাসকে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখালেন এবং এ-ও উল্লেখ করলেন, সমগ্র সংস্কৃত নাট্য-সাহিত্যে ব্যক্তিক্রমীভাবে ভাস তাঁর ঊরুভঙ্গম্ নাটকে বিয়োগান্ত দৃশ্যকাব্য তথা ট্র্যাজেডির স্রষ্টা, – ‘…It is the only tragedy in the whole of Sanskrit literature.’ এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য তাঁকে সমগ্র সংস্কৃত নাট্যসাহিত্য মন্থন করতে হয়েছিল, তাঁর রিডারশিপ লেকচারে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতা)। তিনি একাধিক ভাসের অস্তিত্ব নিয়ে যে ভাস-সমস্যা (যেমন বাংলাভাষায় চন্ডীদাস সমস্যা) সে-বিষয়েও আলোকপাত করে জানান, ভাস ছিলেন এক ও অদ্বিতীয়। এ-বিষয়ে তিনি অপর পাশ্চাত্য মনীষী বার্নেটের মত খন্ডন করে ভাসের অবিভাজ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। ভাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি আরো দুটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেন। প্রথমত, তাঁর নাটকে স্ত্রী চরিত্রের সংলাপে যে প্রাকৃত ভাষার ব্যবহার, তার সঙ্গে অশ্ব ঘোষ-রচিত নাটকের প্রকৃত ভাষার মিল রয়েছে। তাছাড়া ভাস তাঁর ভাষা প্রয়োগে কখনো কখনো ‘ungrammatic’ (বিদেশি পন্ডিত এদেশি লেখকের ভাষার ভুল ধরছেন! যথার্থ পান্ডিত্য না থাকলে সম্ভব নয় তা)। অতঃপর ভিনটারনিৎসের সিদ্ধান্ত : ‘Some of these are such as we also find in epic Sanskrit and this may account for their occurrence in the dramas of the first group.’ অর্থাৎ ভাস নাট্যসাহিত্যের প্রথম যুগের নাট্যকার। একথা এখন বহুল স্বীকৃত। কালিদাসের থেকে অন্তত একশ বছর আগে ভাস আবির্ভূত হন, তাঁর মন্তব্য।

জয়দেবের গীতগোবিন্দ নিয়েও তাঁর মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, এ-গ্রন্থ একদিকে মধুর রসাশ্রিত (It is prominent in Indian love songs), এবং তদুপরি ‘Not infrequently we find true and deep sentiment and inward feeling in the erotic as well as in the religious lyric. Moreover, a deep feeling for nature is genuine and unaffected in the Indian lyric as in Indian poetry in general.’

বৌদ্ধ জাতকসহ অন্যান্য শাস্ত্র সম্পর্কে তাঁর গভীর পান্ডিত্য ছিল। এই ব্যাপ্তি আমাদের বিস্ময় জাগায়, যিনি ভাস এবং ত্রিপিটক এই দুটিতেই প্রাজ্ঞ। তাঁর বৌদ্ধশাস্ত্রচর্চা যে কতটা গভীরসঞ্চারী, দু-একটি উদাহরণের সাহায্যেই তা স্পষ্ট হবে। স্মর্তব্য, জাতকের তিনটি ভাগ, – বিনয় পিটক, সুও পিটক, অভিধম্ম পিটক। সুও পিটক পাঁচটি অংশে ন্যস্ত, যেগুলির নাম ‘নিকায়’। এই সমস্ত নিকায়গুলিতে বুদ্ধ আগে বিরোধীপক্ষের মত উল্লেখ করে পরে সে-মত খন্ডন করেন। অনেকে একে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ভাষণের প্রতি তুলনা করতে প্রয়াসী হলেও ভিনটারনিৎস অন্য মত প্রকাশ করে বলেন, উপনিষদ এবং মহাভারতে যে-উপদেশের সুর, সেগুলোর সঙ্গেই বরং বুদ্ধবচন, বুদ্ধোপদেশের স্বাজাত্য লক্ষযোগ্য।

পালি ও প্রাকৃত ভাষা নিয়েও তাঁর পরিক্রমা গভীর, মনোজ্ঞ এবং তাৎপর্যবাহী। আচার্য সুনীতিকুমার তাঁর Origin and Development of Bengali Language-এ (১৯২৬) দেখিয়েছেন, প্রাকৃত ভাষার তিনটি স্তরে পথপরিক্রমা। মধ্যস্তরে অর্থাৎ আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০-৬০০-তে সাহিত্যিক প্রাকৃতের সূচনা। ভিনটারনিৎস এই সাহিত্যিক প্রাকৃত নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে গিয়ে একদিকে জেন আগম সাহিত্য (শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর উভয় সম্প্রদায়ের), অন্যদিকে প্রাচীন জৈনদের বিশিষ্ট রীতির কথানক কাব্য নিয়ে আলোচনা করেন। জৈন রূপকথার এই জগৎ তাঁর আলোচনায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে।

তাই ভিনটারনিৎসের রচনা পান্ডিত্য এবং একই সঙ্গে রসজ্ঞতার সমাহার। প্রাঞ্জল ভাষা আর আগাগোড়া যুক্তির অবলেপে মোড়া তাঁর অনুসন্ধিৎসার সমূহ সম্পুট আমাদের কাছে আজো আহরণযোগ্য মনে হয়। ভারততত্ত্বচর্চায় তাঁর নামটি তাই অবিনাশী।

এইবার আমরা ভিনটারনিৎসের ভারতবর্ষপর্ব তথা শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীতে অধ্যাপকরূপে যোগদানের প্রসঙ্গ আলোচনা করব। যা ছিল ১৯০১-এ শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম, ১৯২১-এর ২৩ ডিসেম্বর তা-ই বিধিবদ্ধভাবে হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ‘যত্র বিশ্বম্ ভবত্যেক নীড়ম্’। বিশ্বকে এক নীড় করার লক্ষ্যে দেশ-বিদেশ থেকে নানা মনীষীর সম্মেলন ঘটান রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে। এন্ড্রুজ, পিয়ারসন এবং এলমহার্স্ট আগে থেকেই ছিলেন; এ-সময়ে যুক্ত হলেন সিলভাঁ লেভি, লেসনি, স্টেলা ক্রামরিশ, স্লোমিও ফ্লাউম এবং ভিনটারনিৎস। লেসনি ভিনটারনিৎসেরই ছাত্র, যখন তিনি প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন।

ভিনটারনিৎসের শান্তিনিকেতনে আসার একটি প্রাক্-ইতিহাস রয়েছে। ১৯২১-এর ১৯ জুন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইউরোপভ্রমণ পর্বের এক পর্যায়ে প্রাগে যান। সেখানকার স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তখন ভিনটারনিৎস অধ্যাপনারত। ২০ জুন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘The Village Mystics of Bengal’ নামে বক্তৃতা দেন। বক্তৃতাদানের পূর্বে ভিনটারনিৎস তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘You have not come as a stranger, not as a foreigner, but as a friend and brother…।’ রাতে ভিনটারনিৎস যখন রবীন্দ্রনাথকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন, তখনই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ও লেনিকে বিশ্বভারতীতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই আমন্ত্রণের সূত্রেই তাঁদের শান্তিনিকেতনে আগমন। সিলভাঁ লেভি এবং ভিনটারনিৎস, দুজনই ইহুদি ছিলেন। এর ফলে রবীন্দ্রনাথ ইহুদি ধর্ম এবং তাদের স্বভূমি ইসরায়েলের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ইউরোপ যাওয়ার পথে ইসরায়েল যাওয়ার অভিপ্রায়ও তাঁর ছিল একবার, যদিও তা বাস্তব রূপ লাভ করতে পারেনি। কলকাতার ইহুদিরা ভিনটারনিৎসকে তাঁদের সিনাগগে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

শান্তিনিকেতনে বাসকালে তিনি যেমন অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন, তেমনি অতি যত্নে বাংলা ভাষাও শিখে নিয়েছিলেন।

তাঁর শান্তিনিকেতনবাসের অনেক ছবি সে-কালের আশ্রমবাসীর রচনায় অক্ষয় হয়ে রয়েছে। সংস্কৃতে মহাপন্ডিতরূপে তাঁকে সম্ভ্রমের সঙ্গে দেখতেন সবাই। সেইসঙ্গে বেঁটেখাটো এই মানুষটির গাম্ভীর্য ও একই সঙ্গে বিনয়ের উল্লেখ করে গেছেন আশ্রমিক নন্দলাল বসু, যিনি লিখছেন, শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও চাকর নির্বিশেষে সবাইকে তিনি নমস্কার করেন। সর্বদাই ধ্যানমগ্ন, যিনি রবীন্দ্রকবিতায় অবগাহনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নিয়ে মাত্র দেড় মাসে বাংলাভাষা রপ্ত করেছিলেন। আম্রকুঞ্জে ক্লাস নিচ্ছেন ভিনটারনিৎস, অন্যদের সঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও উপস্থিত, আর উপস্থিত বিধূশেখর শাস্ত্রী। ‘খুব ধীর আর শান্ত স্বভাবের লোক ছিলেন তিনি। সব সময়েই নিচু মাথা। আর সেই মাথায় প্রচন্ড টাক। রাস্তায় হাঁটছেন, নমস্কার-প্রতি নমস্কারের পালা চলছে তো চলছেই, তাদের সকলকে চিনতেনও না হয়তো। কিন্তু দরকার নেই চেনার; আশ্রমবাসী হলেই তাঁর কাছে সে শ্রদ্ধেয়’, – লিখছেন নন্দলাল।

ভিনটারনিৎসের শান্তিনিকেতনবাসের প্রধান ঘটনাগুলির মধ্যে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে পদার্পণ অন্যতম। এ-সময় রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত মন্দিরে উপদেশ দিচ্ছেন, আর সমবেত শ্রোতৃমন্ডলীর সামনে সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করছেন অতিথি-অধ্যাপক ভিনটারনিৎস। কলাভবনে তিনি এ-সময় ‘Impression on India’ নামেও একটি বক্তৃতা দেন। সমসাময়িককালে অাঁদ্রে কার্পেলেস মেতে আছেন কারুশিল্প শিক্ষাদান কাজে, স্টেলা ক্রামরিশ শিল্পশিক্ষা দিতে ব্যস্ত, ফারসি পড়াচ্ছেন রুশ পন্ডিত বোগদানভ, সে এক আশ্চর্য সময়।

সৈয়দ মুজতবা আলী জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বই লেখেন ভিনটারনিৎস। মুজতবা আলীর মতে, ‘রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আজ পর্যন্ত যত লেখা বেরিয়েছে, তার ভিতরে আমি এটিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করি।’ রবীন্দ্রনাথের প্রতি এমন শ্রদ্ধার প্রকাশ সত্যিই সম্ভ্রম আদায়কারী।

শান্তিনিকেতন তাঁকে এক বছরের বেশি পায়নি। তার মধ্যেও আবার কিছুটা সময় তিনি ব্যয় করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে আর পুনেতে ‘ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে’র কাজে। তবু তাঁর স্বল্পস্থায়ী শান্তিনিকেতনবাস সেখানকার শিক্ষক ও আশ্রমিকদের কাছে বৃথা যায়নি। তাঁর স্বল্প অবস্থানে শান্তিনিকেতনকে তিনি যথার্থ রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন, তাঁর স্মৃতিচারণে বহু আশ্রমিকই তা জানিয়ে গেছেন। তাঁর জন্মসার্ধশতবর্ষে তাঁকে আমাদের প্রণাম।