লোকসংস্কৃতি ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য

আহমেদ বাসার
আধুনিক বাংলা কবিতা, কথাসাহিত্য ও ভাষাবিজ্ঞানে লোকসংস্কৃতি
ড. রহমান হাবিব
জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ
ঢাকা, ২০০৭
২০০ টাকা

পৃথিবীর যে কোনো দেশেরই সৃষ্টিশীল কর্ম-প্রণোদনায় সেই দেশের লোকসংস্কৃতি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূলত লোকসংস্কৃতিই সৃষ্টিশীলতার আদি ও অকৃত্রিম উৎসমূল। আধুনিক  বাংলা সাহিত্য বহিরঙ্গে যতই কৃত্রিম অলঙ্কারে সজ্জিত হোক না কেন, তার অন্তমূলে লোকসংস্কৃতির প্রবহমান ধারাকে অস্বীকার করা যায় না। বর্তমান সময়ের একজন প্রতিশ্রুতিশীল সাহিত্য-গবেষক ড. রহমান হাবিব তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতা, কথাসাহিত্য ও ভাষাবিজ্ঞানে লোকসংস্কৃতি গ্রন্থে এ-বিষয়টিকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। আলোচ্য গ্রন্থে তিনি লোকভাষার সঙ্গে সমাজ ভাষাবিজ্ঞানের সম্পর্কসূত্রের প্রাসঙ্গিকতাকে পর্যালোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও আধুনিক সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির সম্পর্কসূত্রকে বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন, যা গ্রন্থটিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে গ্রন্থটিকে তিনটি প্রধান অংশে ভাগ করেছেন। ‘আধুনিক বাংলা কবিতায় লোকসংস্কৃতি’ অংশে মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের কবিতার বিশ্লেষণ করে তিনি এঁদের সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞে লোকসংস্কৃতির প্রণোদনাকে চিহ্নিত করেছেন।
‘আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে লোকসংস্কৃতি’ অংশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জসীম উদ্দীন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আহমদ ছফা ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথাসাহিত্যের অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণে লোকজীবনের সংশ্রব উদ্ঘাটিত হয়েছে।
‘ভাষাবিজ্ঞানে লোকসংস্কৃতি’ অংশে জীবনানন্দ দাশের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের গল্প ও  সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাসের সমাজভাষাবিজ্ঞান ও লোকভাষা বৈজ্ঞানিক অভিনব অবলোকন স্থান পেয়েছে।

দুই

মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম জীবনে ইংরেজি সাহিত্যের বড় কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু অচিরেই তার ভুল ভাঙে। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অপরিসীম ঐশ্বর্যের সন্ধান পান। আঙ্গিকগত দিক থেকে তিনি পাশ্চাত্য রীতিকে অনুসরণ করেছিলেন, এ-কথা অস্বীকার না করেও বলা যায়, বিষয় নির্বাচনে তিনি বাংলার লোকঐতিহ্য, মিথ ও লোকসংস্কৃতির দ্বারস্থ হয়েছিলেন। রহমান হাবিব মধুসূদনের সাহিত্যকর্মকে বিশ্লেষণ করে লোকসাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলোকে চিহ্নিত করেছেন। ‘বঙ্গভাষা’ কবিতায় মধুসূদন দত্ত যে ‘বিবিধ রতনে’র কথা বলেছেন তা মূলত বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের প্রতিই ইংগিতবাহী। ‘সমাধি লিপি’ কবিতায় স্বভূমি, প্রকৃতি ও পিতামাতার অনুষঙ্গ তাঁর মৃত্তিকালগ্ন শেকড়-অভিমুখী অভিযাত্রারই স্মারক। এছাড়া ‘বঙ্গভূমির প্রতি’, ‘ভাষা’ প্রভৃতি কবিতায় কবির শেকড়-অন্বেষী মানসিকতারই স্বরূপ উন্মোচিত। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্যের কাহিনি ভাগ তিনি রামায়ণ কাব্য থেকে গ্রহণ করেছেন। ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যটি ওভিদের ‘হিরোইদস’ কাব্যের অনুসরণে লেখা হলেও মধুসূদন চরিত্র চয়ন ও সংলাপ বিন্যাসে লোকসংস্কৃতিকেই উজ্জীবিত করে তুলেছেন।
জীবনানন্দ দাশ তিরিশের দশকের পঞ্চপান্ডবখ্যাত কবিকুলের অন্যতম। শিল্পবোধ ও শিল্পচেতনায় আধুনিক এই কবি তাঁর কবিতায় লোকজ অনুষঙ্গকে গ্রহণ করেছেন অসামান্য দক্ষতায়। রহমান হাবিব জীবনানন্দের ধূসর পান্ডুলিপি, রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কবিতা বিশ্লেষণ করে ঐতিহ্যিক অনুষঙ্গগুলোকে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। জীবনানন্দের কবিতায় তিনি খুঁজে পেয়েছেন লোকজীবনানুষঙ্গ টোটেম, কৃষিসংস্কৃতির অনুষঙ্গ ও সামষ্টিক অনুভব (Collective consciousness)। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাও লোকজীবন-চেতনায় ভাস্বর। অগ্নিবীণা কাব্যের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্য, গ্রিক পুরাণ ও লোকজ-ভাবনার নান্দনিক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এছাড়া ‘দোলন চাঁপা’, ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘জিঞ্জির’ প্রভৃতি কাব্যে নজরুলের লোকজীবন সম্পৃক্ততাকে লেখক চিহ্নিত করেছেন।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন লোকজীবনের বিস্তৃত ভূখন্ডকে কাব্য-পরিসরে তুলে এনেছেন। তাঁর কবিতা লোকসংস্কৃতির এক অকৃত্রিম শিল্পভাষ্য। নক্সী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যে জসীম উদ্দীনের গ্রামীণ জীবনাবহে অভিসার কিংবা রাখালী, বালুচর প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে লোকসংস্কৃতির বিনির্মাণ রহমান হাবিবের পর্যবেক্ষণে চমৎকারভাবে ধরা পড়েছে।
চল্লিশের দশকের কবি ফররুখ আহমদ তাঁর কবিতায় ইসলামি ঐতিহ্যের রূপক ও প্রতীকী প্রয়োগের মধ্য দিয়ে মুসলমান সমাজকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন। আরবি লোককাহিনির নায়ক সিন্দবাদ, সোহরাব-রুস্তম, লাইলি-মজনু, হাতেম তায়ী প্রমুখ চরিত্র তাঁর কবিতায় নতুন ব্যঞ্জনা পেয়েছে। লেখক ফররুখের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কবিতার তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণের সাহায্যে লোকসাংস্কৃতিক উপাদানের প্রয়োগ-কৌশল উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন।
তিরিশের দশকের আরো দুজন গুরুত্বপূর্ণ কবি বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দের কবিতায়ও রহমান হাবিব লোকসংস্কৃতির অন্তঃপ্রবাহের সন্ধান পেয়েছেন। বুদ্ধদেব বসুর ‘কঙ্কাবতী’ কবিতায় কঙ্কাবতীর প্রেমপ্রবাহ লোকজীবনকে আশ্রয় করেই অগ্রগামী হয়। এছাড়া ‘মাছ ধরা’, ‘লোকটা’, ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’, ‘ইলিশ’, ‘দময়ন্তী’ প্রভৃতি কবিতায় লোকজ চেতনা আধুনিক প্রলেপে রূপায়িত হয়েছে। বিষ্ণু দে মার্কসবাদে বিশ্বাসী সমাজসচেতন একজন কবি। স্বভাবতই তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে লোকায়ত বিভিন্ন চরিত্র ও অনুষঙ্গ। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য পুরাণের নান্দনিক প্রয়োগ তাঁর কবিতায় ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। ‘উর্বশী’, ‘আর্টেমিস’, ‘শ্রীকৃষ্ণ’, ‘হেক্টর’, ‘ইউলিসিস’ প্রমুখ তাঁর কবিতায় বিচিত্র রূপ নিয়ে রূপায়িত হয়েছে। সাত ভাই চম্পা কাব্যের নামটিই লোকজ চেতনার স্মারক।
বাংলাদেশের কবিতার দুই প্রধান কবি-ব্যক্তিত্ব শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের কবিতায় লোকজীবনানুষঙ্গ ব্যাপকভাবে চিহ্নিত হয়েছে। পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যিক অনুষঙ্গ যেমন শামসুর রাহমানের কবিতায় স্থান পেয়েছে, তেমনি চিরায়ত বাংলার লোকসাংস্কৃতিক উপাদানকেও তিনি কবিতায় সন্নিবেশিত করেছেন। রহমান হাবিব শামসুর রাহমানের কবিতায় পৌরাণিক অনুষঙ্গের প্রয়োগ বৈচিত্র্যকেও চিহ্নিত করেছেন। আল মাহমুদের কবিতা লোকজ ভাবনার এক ঋদ্ধ ও অনবদ্য রূপ। বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজীবন ও বাঙালির শাশ্বত অনুভবের অনুপম দোলা তাঁর কবিতায় সহজলক্ষ। লোক লোকান্তর, সোনালি কাবিন, বখতিয়ারের ঘোড়া, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের কবিতা বিশ্লেষণ করে রহমান হাবিব আল মাহমুদের কবিতায় লোকজীবন-সম্পৃক্তির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন।

তিন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কঙ্কাল’ ও ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্প দুটি বিশ্লেষণ করে লেখক অতিপ্রাকৃত উপকরণ-সম্পৃক্ত লোকসংস্কৃতির আবহকে তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে তিনি চরিত্রচিত্রণ, ভাষাবোধ ও পরিবেশ নির্মাণের কৌশলকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি কবি উপন্যাসের বিষয় ও আঙ্গিক লোকসংস্কৃতির নিবিড় উপাদানে নির্মিত। এ-উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কবি নিতাইচরণ হিন্দু সমাজের প্রায় পতিততম স্তরের অন্তর্গত ডোম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলার ঐতিহ্যময় কবিগানকে আশ্রয় করে উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্র বিকাশ লাভ করে। উপন্যাসে লোকজ অনুষঙ্গবাহী বেশ কিছু গান সংযোজিত হয়েছে, যা উপন্যাসটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। রহমান হাবিব এ-বিষয়গুলোকে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা উপন্যাসটি বিশ্লেষণ করে প্রাবন্ধিক বাঙালির লোকজীবন-চেতনা ও বাঙালির সামষ্টিক জীবনমর্ম-দর্শনকে উন্মোচিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। আহমদ ছফার সূর্য তুমি সাথী উপন্যাসটিকে তিনি ‘কৃষক জীবনের প্রাকৃত শিল্পরূপ’ বলে অভিহিত করেছেন।
ভাষাবিজ্ঞানে লোকসংস্কৃতি অংশটি এই গ্রন্থের একটি অভিনব সংযোজন। এই অংশে লেখক বাংলা লোকভাষা পুনর্গঠনে বাঙালির জাতিক-সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক অঙ্গীকারের বিষয়টিকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। এছাড়া এই অংশে সংযোজিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের ‘তিমির হননের গান’, ‘সূর্য নক্ষত্র নারী’, ‘এইসব দিন রাত্রি’, ‘এইখানে সূর্যের’ ও ‘১৯৪৬-৪৭’ কবিতার সমাজভাষিক বিশ্লেষণ। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের সমাজভাষা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন যে, সমাজের গতিশীলতা ও ভাষার পরিবর্তনশীলতা পরস্পরকে যেমন প্রভাবিত করে তেমনি সামাজিক শ্রেণি অবস্থানের ভিন্নতার কারণেও বিভিন্ন চরিত্রের সমাজভাষিক বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্পটিকেও তিনি লোকভাষাবিজ্ঞানের আলোকে মূল্যায়নের প্রয়াস পেয়েছেন। এছাড়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লালসালু উপন্যাসের লোকভাষার বৈজ্ঞানিক অবলোকন এখানে স্থান পেয়েছে। সর্বোপরি আধুনিক সাহিত্যকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অবলোকনের এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।