ঢাকা আগমন ও আর্ট কলেজে ভর্তি

সৈয়দ জাহাঙ্গীর

ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই কলকাতায় জাফর ভাইয়ের পার্ল রোডের বাসায় একবার বেড়াতে গেলাম। জাফর ভাই আমাকে একটা নতুন জুতো কিনে দিয়েছিলেন। ওই জুতোর বাক্সের ভেতর সুন্দর কিছু ড্রইং করেছিলাম। জাফর ভাইয়ের চোখে পড়েছিল সেসব। তিনি সেটা মনে রেখেছিলেন। জাফর ভাই ঢাকা চলে আসেন সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পরপরই। কলকাতায় একজন পরিচিত তরুণ মুসলমান লেখক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন ওই সময়। ঢাকায় এসে বেতারের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দিলেন। গান, নাটক লিখতেন, অভিনয়ও করতেন। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। ভাবছি কী পড়ব, কোথায় পড়ব। জাফর ভাই চিঠি লিখে বললেন ঢাকায় চলে আসতে, আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে। বললেন এখানে একটা নতুন আর্ট স্কুল খুলেছে। সেখানে শিক্ষক আছেন জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, কামরুল হাসান, আমার খুব পরিচিত। ওখানে সহজেই ভর্তি হতে পারবি। ঢাকায় আসার পথে কুমিল্লায় নামলাম। জাফর ভাই তখন সেখানেই ছিলেন। তাঁর অনুজপ্রতিম বন্ধু আহমেদ রফিকের বাড়িতে। বাড়িটা ছিল এক বিত্তশালী হিন্দু পরিবারের। দেশ বিভাগের পর তারা কলকাতা চলে যায় এবং আহমেদ রফিক বাড়িটা রক্ষার দায়িত্ব নেন। রফিক ভাই ঢাকা বেতারে ইংরেজিতে খবর পড়তেন। পরে তিনি একসময় জার্মানির কোলোনে ডয়েশেভিলা রেডিওতে বাংলা অনুষ্ঠানের প্রচারণা ও পরিচালনা করতেন। কুমিল্লা জংশনের পাশেই ছিল বাড়িটা। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত আর প্রচুর গাছপালা দিয়ে ঘেরা সুন্দর ছিল একতলা বাড়িটা। বিরাট একটা পুকুর ছিল বাড়িতে। চারপাড়ে আমলকী গাছ, তার ডালগুলো নেমে গেছে জলের ভেতর। ভারি সুন্দর দৃশ্য। সাঁতরাতে খুব পছন্দ করতাম। সাঁতরাতে গিয়ে মনে হলো পুকুরের তলটা দেখে এলে কেমন হয়। ডুব দিলাম। নিচে নামছি। নামছি তো নামছিই। তল আর পাইনে। একসময় মনে হলো, আরো নিচে নামলে দম ফুরিয়ে যাবে, আর ভেসে ওঠা সম্ভব হবে না। তখন ওপরে উঠে আসতে শুরু করলাম। গতি মন্থর। হাত এবং পা দিয়ে সাঁতরে ওপরে ওঠা দুষ্কর। তলার মাটিতে পা-দিয়ে ধাক্কা দিতে পারলে গতি অনেক দ্রুত হতো। এরই মাঝে সংজ্ঞা হারালাম। জ্ঞান ফিরে দেখি পুকুর পাড়ের ঘাসে শুয়ে আছি। চারপাশে অনেক অচেনা মুখ। আসলে আমি কোনো রকমে ভেসে উঠেছিলাম। এক পথচারী চৌকিদার দূর থেকে দেখতে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে পাড়ে নিয়ে আসেন। তিনি উদ্ধার না করলে সেদিন হয়তো মারাই পড়তাম। পরে জেনেছি ওই পুকুরের তল দেখতে গিয়ে এর আগে অনেকেই মারা গেছে। সত্যিই ওই পুকুরটা ছিল অনেক গভীর।

দুমাস ছিলাম কুমিল্লায়। সেখানে আমার ভাবি নার্গিস জাফরও ছিলেন, আর তাদের সন্তান শমু (আলমগীর জাফর)। ঢাকায় ওয়ারী এলাকায় রোজ সন্ধেবেলা একটা লোক মই নিয়ে এসে রাস্তায় মোড়ের গ্যাসলাইট জ্বালিয়ে দিত। তখন নবাবপুরের রেলগেট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ঢাকা শহর। ওয়ারী এলাকাটা ছিল বনেদি। ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে জনসন রোডের পাশে ছিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট। ওটার একপাশে ছিল নাট্যশালা। ভবনের নিচতলার দুটো কামরা নিয়ে শুরু হয় আর্ট কলেজ। জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, শফিকুল আমীন, খাজা শফীক আহমেদসহ আরো কয়েকজন শিক্ষক বসতেন এক কামরায় এবং অন্য কামরায় শ্রেণিকক্ষ। শিক্ষকদের কামরায় ঢুকে আমার পরিচয় দিলাম। জয়নুল আবেদিন স্যার সিগ্রেট খাচ্ছিলেন। দু-আঙুল বাদামি হয়ে গেছে সিগ্রেটের ধোঁয়ায়। তাঁকে খুব চটপটে আর সজাগ লোক বলে মনে হলো। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ভর্তি হইবা? আমি মাথা নাড়লাম। তিনি আনোয়ারুল হককে বললেন, যান ওর পরীক্ষা ন্যান। আমার সামনে একটা কলসি রাখা হলো। ওটার ড্রইং করতে হবে। ড্রইং করলাম। ভালো হলো কিনা জানি না। কিন্তু পাশ করে গেলাম। পরদিন থেকে নিয়মিত ক্লাস শুরু করলাম। আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর আমি ছিলাম থার্ড ব্যাচের ছাত্র। আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমানসহ জনা-দশেক ছাত্র ছিলেন প্রথম ব্যাচের। হামিদুর রহমানকে আমি অল্পদিনের জন্যে দেখেছিলাম আর্ট কলেজে। আমি ভর্তি হওয়ার পরপরই তিনি চলে গেলেন লন্ডনে পড়াশোনা করতে। দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাকসহ জনা-পনেরো। আমাদের ব্যাচে, অর্থাৎ তৃতীয় ব্যাচে মবিনুল আজিম, মীর মুস্তাফা আলী, আব্দুস সবুরসহ জনা-বিশেক। তখনো কোনো ছাত্রী ভর্তি হয়নি। আমি বলছি ১৯৫০ সালের কথা। আমি যখন পঞ্চমবর্ষের ছাত্র তখন ভর্তি হলো চারটি মেয়ে। এর ভেতর দুজন আবার দুই শিল্পীর স্ত্রী হন পরবর্তীকালে। এঁরা হলেন আমিনুল ইসলামের স্ত্রী রুমী আর কাইয়ুম চৌধুরীর স্ত্রী তাহেরা। আমি আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পরের বছর আবেদিন স্যার বিলেতে চলে গেলেন স্কলারশিপ নিয়ে। বছরখানেকের জন্যে। পরে তিনি ফ্রান্স, ইতালি এবং মেক্সিকোতেও যান। ওখানে তিনি বেশকিছু ড্রইং করেছিলেন। খুবই সুন্দর। আমার জন্যে যা ছিল প্রেরণাদায়ক। মনে আছে আমাদের ক্লাসে তাঁর একবার আসার কথা। আমরা তখন মোরগ অাঁকছিলাম। তিনি চটজলদি মোরগের একটা পা এঁকে ফেললেন। ভারি সুন্দর ড্রইং। মোরগের পায়ের মধ্য থেকে কীভাবে ছোট নখ বেরিয়ে আসে। পাগুলো কীভাবে ছড়িয়ে থাকে। আঙুলগুলো জোড়া থাকে একটা জায়গায়। দারুণ ড্রইং। এখনো চোখে ভাসে। তিনি অবশ্য আমাদের হাতে ধরে শেখাতেন না। এঁকে দেখিয়ে দিতেন। আনোয়ারুল হক সাহেব আসতেন ক্লাসে। তিনি আমাদের পারসপেকটিভ ড্রইং শেখাতেন। দূরের বস্ত্তকে পেনসিলে বুড়ো আঙুল ধরে মাপ নেওয়া শেখাতেন – শেখাতেন দূরের এবং কাছের বস্ত্তর মাপের তারতম্য। রাজমিস্ত্রিদের ব্যবহৃত ওলন ধরে বস্ত্তর খাড়া-সরল রেখার সঠিক মাপ নেওয়া। খুব সিরিয়াসলি তিনি এ-কাজগুলো করতেন। তিনি আমাদের ফিগার ড্রইং শেখাতেন। তখন মডেল হতেন একজন ব্যায়ামবিদ। কিন্তু কোনো ন্যুড মডেল ছিল না। আমরা যখন ফাইনাল ইয়ারে এবং আমাদের স্কুল শিফট করে সেগুনবাগিচায় একটা পরিত্যক্ত মেয়েদের হোস্টেলে এসেছে। আমরা জনা-আটেক ছাত্র নিজেরাই পালাক্রমে ন্যুড মডেল হতাম। ড্রইং ইমপ্রুভ করার জন্য। তখন একদিন আনোয়ার স্যার এলেন আমাদের ক্লাসে। তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে ফিগার ড্রইংয়ের সহজ পদ্ধতি ও নিয়মকানুন দেখিয়ে দিলেন। আমরাও উপভোগ করতাম তাঁর উপস্থিতি।

পরে কামরুল হাসান এসে আমাদের ড্রইং শেখাতেন এবং আউটডোরে স্কেচ করতে নিয়ে যেতেন। আমি আর দেবদাস প্রায়ই একত্রে যেতাম আউটডোর স্কেচ করতে। হাটখোলার মোড়ে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরিতে যেতাম রাতে ড্রইং করতে। শক্ত গ্লাস-পিন্ড জ্বলন্ত চুলায় গলিয়ে ফেলা হতো। এরপর একটা ফানেলের মাথায় সেই জ্বলন্ত গ্লাস-পিন্ডটিকে ফানেলের অন্য মুখে ফুঁ-দিয়ে ফুলিয়ে সাঁচের মধ্যে বসিয়ে সাঁচের বিভক্ত দুটি অংশকে একত্রে চাপ দিলেই তৈরি হতো বোতল, হারিকেনের চিমনি, পানির গ্লাস ইত্যাদি। বানানো দেখতাম মনোযোগ দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ড্রইংও করে ফেলতাম, মনের আনন্দে। ফ্যাক্টরির গোটা পরিবেশ – টিনের দেয়াল, টিনের ছাদ, উন্মুক্ত চুলা, ফানেলের মাথাভরা গনগনে আগুনের গ্লাস-পিন্ড অন্ধকারে যত্রতত্র উড়ে বেড়ানো, এক রহস্যময় আবহাওয়া সৃষ্টি করতো। কখনো রেলওয়ে স্টেশনে যেতাম স্কেচ করতে। গভীর রাতে ঘুমন্ত মানুষজন জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকতো। তার ড্রইং করতাম। প্রায়ই সদরঘাট যেতাম। যেতাম ছোটকাটরা ও বড়কাটরায়। একদিন খুব মজার একটা ঘটনা ঘটল। পুরনো ঢাকায় বাবুবাজারের মধ্যে দিয়ে সদরঘাট যাচ্ছি। এটা ছিল শর্টকাট রাস্তা। অনেকগুলো মেয়ে রাস্তার দুধারের দরজায় অথবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ চুল বাঁধছে, কেউবা পেটিকোট পরে দাঁড়িয়ে দেখছে আমাদের। হঠাৎ একটা মেয়ে দেবদাসের হাত ধরে একটানে বারান্দার কাছে নিয়ে যায়। দাদা কোথায় যাচ্ছো, আমাকে নেবে না? দেবদাস হতভম্ব, মহাবিব্রত। আমরা জানতাম না এটা সেই নিষিদ্ধ পল্লি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি খুব সাহসের সঙ্গে বললাম, দেখো আমরা আর্টিস্ট, ছবি অাঁকি। এই বলে হাতের স্কেচবোর্ড, কাগজ আর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ দেখিয়ে বললাম, আমরা সদরঘাট যাচ্ছি ছবি অাঁকতে। ততক্ষণে আরো অনেক মেয়ে জড়ো হয়ে গেছে। সবাই জানতে উৎসুক ছবি অাঁকে কী করে। দেবদাস ততক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়েছে। বলল, আমরা যখন ফিরব। এ-পথেই ফিরব। তখন তোমাদের দেখাবো ছবি কী জিনিস। আমরা কথা রেখেছিলাম। পরিচিত বুড়িগঙ্গার তীরের ছবি দেখে ওরা মুগ্ধ হয়েছিল। ভবিষ্যতে ওরা আর কখনো ঝামেলা করেনি ওপথে যাওয়ার সময়। তবে তাদের উত্তেজক কথাবার্তা আর গান শোনায় প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ধুতিপরা বাবুকে দেখে অনেকেই মাঝেমধ্যে পুজোর ভোগ নিয়ে বসে থাকতো। আমাকেও ভোগের অংশীদার করতে তাদের কোনো আপত্তি থাকত না।

ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে আমাদের কলেজ চলে আসে সেগুনবাগিচায় পরিত্যক্ত একটা মেয়েদের হোস্টেল ভবনে। ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। লোহার রেলিংয়ে জং ধরে ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। এখানে আমরা ছিলাম প্রায় চার বছর। তারপর ১৯৫৬ সালে বর্তমান ভবনে স্থানান্তরিত হয় আর্ট কলেজ। একবার এই ভবনে একটা লোকশিল্প প্রদর্শনী হচ্ছিল। সফিউদ্দীন স্যার, খুব রসিক ছিলেন। প্রদর্শনী দেখে রসিকতা করে বললেন, ‘কি-হে তোমাদের ফোক আর্ট যে ফেটে যাচ্ছে।’ একটা মুলিবাঁশ যার উপর পাটের তৈরি অনেকগুলো সিকা, ব্যাগ ইত্যাদি ঝোলানো ছিল। গরমে মুলিবাঁশটা ফেটে গিয়েছিল। শফি স্যার খুব হ্যান্ডসাম ছিলেন। পরিপাটি, নিখুঁতভাবে জামা-কাপড় পরতেন। গ্রাফিক ডিপার্টমেন্টের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

নবাবপুর রেলক্রসিংয়ের কাছেই ছিল তখনকার সময় জনপ্রিয় ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্ট। আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতাম। আসতেন হাসান হাফিজুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, খালেদ চৌধুরী, সঞ্জীব দত্ত প্রমুখ। তরুণ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের আড্ডায়, আলাপচারিতায় মুখর থাকত ক্যাপিটাল রেস্তোরাঁ। কবিরা কী লিখছেন, তাঁদের চিত্রকল্প, মনন প্রকাশ সম্পর্কে আমরা চিত্রশিল্পীরা যেমন সম্যক ধারণা লাভ করতাম, কবি-সাহিত্যিকরাও তেমনি চিত্রশিল্পের মৌলিক গুণাবলি, বিবর্তন ও অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত হতেন। বাস্তবতার নিরিখে ভাবের আদান-প্রদান-বিতর্ক অব্যাহতভাবে চলতো ওখানে। উভয়পক্ষই উপকৃত হতাম। অবশ্য ক্যাপিটালের আরো একটি আকর্ষণ ছিল চায়ের সঙ্গে পাউরুটি টোস্টের ওপর মাখন দিয়ে তার ওপর চিনি ছিটিয়ে খাওয়া।

মদন মোহন বসাক রোড দিয়ে আর্ট কলেজে যেতাম রথখোলা মোড় হয়ে। একদিন ওই রথখোলা মোড়ে দেখা হলো এক যুবকের সঙ্গে – বিহারি ছেলে। ফর্সা, বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে। নাম বাবু। বাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বেশ চটপটে। আলাপ থেকে ক্রমে বন্ধুত্ব হলো। একদিন ছুটির দিনে বাবু বলল, তুমি তো ফুটবল খেলতে, চলো আজ বিকেলে স্টেডিয়ামের মাঠে খেলা দেখতে। বর্তমানের নতুন স্টেডিয়াম তখনো তৈরি হয়নি। খেলাটা হচ্ছিল একটা ড্র-গেম। গতকাল হার-জিত হয়নি বলে আজ আবার খেলা হচ্ছে। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং সম্ভবত ওয়ারী ক্লাবের মধ্যে খেলা। হাফ টাইম পর্যন্ত কোনো গোল হয়নি। বাবু আমার ফুটবল খেলার গল্প শুনে ধারণা করে ফেলেছিল আমি এখানেও খেলতে পারব। বলল, তুমি খেলবে বদলি খেলোয়াড় হয়ে – আমি মোহামেডানের ক্যাপ্টেন শাহজাহান সাহেবকে বলি, তুমি খেলবে। এরকম একটা সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। রাজি হয়ে গেলাম। শাহজাহানের সঙ্গে কথা বলে নেমে গেলাম মাঠে। আমি বললাম, আমি ফরওয়ার্ডে খেলি। ভালো বল পেলে গোল করতে পারব। ব্যাক পজিশন থেকে শাহজাহান সাহেব একটা বল আমাকে পাস করে দিয়ে চিৎকার করে বললেন, জাহাঙ্গীর এই নাও তোমার বল। আর যায় কোথায়। বল নিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে গিয়ে ড্রিবল করে দুজন প্লেয়ারকে কাটিয়ে সোজা গোলে শট। গোলকিপারের একেবারে নাগালের বাইরে ছিল শটটা। শাহজাহান সাহেব ছুটে এসে আমাকে কাঁধে করে প্রায় অর্ধেক মাঠ ছুটে গেলেন আনন্দে। আনন্দে আত্মহারা টিমের সকল খেলোয়াড়, বন্ধু বাবু – সারা মাঠ। মোহামেডান জিতে গেল এক গোলে। এরপর আর কখনো ফুটবল খেলা হয়নি। ছবি অাঁকা বাদ দিয়ে ফুটবল খেলা সম্ভব ছিল না।

১৯৫২ সালে আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বাইশে ফেব্রুয়ারি পুরনো জাদুঘরে ঢাকা আর্ট গ্রুপের চিত্র-প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের স্ত্রী লেডি নুন উদ্বোধন করবেন। এটার দায়িত্বে ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। জাদুঘরে প্রদর্শনী উদ্বোধনের আগের দিন ২১শে ফেব্রুয়ারি পাথরের বড় বড় মূর্তি সরিয়ে জায়গা করছি ছবি প্রদর্শনের জন্যে। নেতৃত্বে আছেন কামরুল ভাই। তাঁর শরীর তো ছিল দারুণ পেটোয়া, ব্যায়ামের মাধ্যমে সুগঠিত। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বেশ ক-সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চলছিল। মিছিল-সভা-সমিতির ওপর ছিল নিষেধাজ্ঞা। ওইদিন ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। ছাত্র-সংগঠন সিদ্ধান্ত নিল ওই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার। পাঁচজন করে একত্রে রাস্তায় বের হবে। এমন সময় খবর এলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। ছাত্ররা মারা গেছে।  তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, আমরা এই প্রদর্শনী করব না। তখন অনেকের সঙ্গে আমিও গেলাম মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলের সামনে, যেখানে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন ছাত্র। হোস্টেলের দু-নম্বর শেডের সামনে রাখা ছিল স্ট্রেচারের ওপর এক নিহতের লাশ। মাথার খুলিটা উড়ে গেছে। খুলির কিছু অংশ আর একরাশ চুল ঝুলছিল স্ট্রেচার গড়িয়ে। ভয়াবহ ওই দৃশ্য দেখে ভীত, হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ইতিপূর্বে এ-ধরনের নৃশংস দৃশ্য আর কখনো দেখিনি। পরে জেনেছিলাম ওটাই ছিল বরকতের লাশ। সম্ভবত আরো দুটো লাশ রাখা ছিল কাছাকাছি। ২২শে ফেব্রুয়ারিও নবাবপুরে গোলাগুলি হয়েছিল। রেলওয়ে হাসপাতাল পেরিয়ে আমরা এসেছি কার্জন হলের কাছে। সেখানে প্রাচীরের রেলিংয়ের ওপর রাইফেল তাক করে পুলিশ বসে আছে। কিছু ছাত্র ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু করেছে পুলিশকে তাক করে। দূরত্ব অনেক, তাই সেগুলো পুলিশের ধারেকাছেও যাচ্ছিল না। এরই ভেতর নবাবপুরের দিক থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্স এলো। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে নিহতদের লাশ ছিল। মোড়ের কাছে জনসমাগম দেখে ড্রাইভার ভেবেছিল লাশ ছিনিয়ে নিতে পারে। তাই সজোরে মোড় ঘুরল অ্যাম্বুলেন্সটি। একটা ছেলের গায়ের ওপর দিয়ে চলে গেলে তার শরীর দুমড়ে-মুচড়ে গেল। আমাদের ভেতর কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ছেলেটি আসলে তখনই মারা গিয়েছিল। পরের বছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে একটা বড় মিছিল বের করা হয়। এর আগের রাতে সারারাত ধরে অনেকে মিলে আমরা পোস্টার, ব্যানার লিখি। সকালে ওই ব্যানার-পোস্টার নিয়ে আমরা মিছিলে অংশগ্রহণ করি। বড় ব্যানারটিতে অাঁকা ছিল এক ব্যক্তি একজন ছাত্রের লাশ দু-হাতে তুলে নিয়ে মিছিলের অগ্রভাগে এগিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভবত বিজন চৌধুরীর অাঁকা ছিল ওই ব্যানারটি। ওই সময় হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় বেরিয়েছিল ঐতিহাসিক একুশের সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারি।

আমাদের কলেজে বার্ষিক প্রদর্শনী হতো। একবার জয়নুল আবেদিন স্যার বললেন, এ-বছর আর বার্ষিক প্রদর্শনী হবে না। সরকার থেকে প্রদর্শনীর জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। আমাদের আবেদন-অনুরোধে কোনো কাজ না হওয়ায় ঠিক করলাম আর্ট কলেজের বাইরে কোথাও প্রদর্শনীর আয়োজন করব। সেটা হবে যৌথ প্রদর্শনী – তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম বর্ষের ছাত্ররা মিলে। উদ্যোগটা আমিই নিলাম। কামরুল ভাইকে সভাপতি করে একটা সংগঠন করলাম ‘ইস্ট আর্টস গ্রুপ’ নামে। প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছিলাম ‘ঢাকা হলে’। আবেদিন স্যারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সে-প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। একধরনের প্রতিবাদই ছিল সেটা। বইয়ের মলাট তৈরির জন্যে একধরনের সামান্য এমবস্ করা মোটা কাগজ পাওয়া যেত সে-সময়। আমরা তার ওপর ওয়াটার কালার করেছিলাম। কাগজটির বৈশিষ্ট্য ছিল জলরংকে হুবহু ধারণ করা। শুকানোর পরও রংটার কোনো তারতম্য ঘটত না। প্রদর্শনীটা বেশ জমেছিল। প্রচুর ছবি বিক্রি হয়েছিল। ফিরে দেখলে মনে হয়, একটা প্রতিবাদী সাংগঠনিক সত্তা আমার ভেতর শুরু থেকেই কাজ করত।

এরপর ১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে আর একটা সংগঠন করি ‘পেইন্টারস্ ইউনিট’ নামে। আমাদের প্রদর্শনীটি হয়েছিল প্রেসক্লাবে। তারও একটা ইতিহাস আছে। জয়নুল স্যার পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে বেশ কিছু ওয়াটার কালার করেছিলেন। ‘শিয়ালভুক্কা’ নামের এক গ্রামে গিয়ে ছবিগুলো এঁকেছিলেন। ছবিগুলো আমাদের দেখিয়েছিলেন। আমারও জিদ চেপে গেল। আমিও পার্বত্য চট্টগ্রাম গেলাম। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলোক চিত্রশিল্পী শামসুল আলম (লাকী) চাকরি করতো বার্মা অয়েল কোম্পানিতে। সে মাঝে মাঝে যেত পার্বত্য চট্টগ্রামে ছবি তুলতে। সে-ই নিয়ে গেল আমাকে। মনোমুগ্ধকর নৈসর্গিক দৃশ্য আর অপরূপ পাহাড়ি রমণীদের অনেক ওয়াটার কালার ছবি অাঁকলাম। মুর্তজা বশীর আমার কাজগুলো দেখে বলল, সাংঘাতিক কাজ। কেউ বলবে না যে এটা আবেদিন স্যারের কাজ না। ওই কাজগুলো ছিল পেইন্টারস্ ইউনিটের প্রদর্শনীতে। বশীর অনেকগুলো তেলরঙের কাজ দিলো প্রদর্শনীতে। কাইয়ুম প্রদর্শনীতে অংশ নিতে চাইছিল না। কারণ সে ওয়াটার কালার খুব একটা করত না। পরে অবশ্য বেশ কিছু কাজ করেছিল। গুলিস্তানের সামনের রাস্তার আইল্যান্ডে কিছু গাছ লাগানো ছিল। ইট দিয়ে খাঁচা মতো করে গাছগুলো ঘিরে দেওয়া হতো। এরকম কিছু গাছসহ রাস্তার ছবি এঁকেছিল কাইয়ুম। ওটা ছিল ঘটনাবহুল প্রদর্শনী। কেউই প্রদর্শনীর জন্যে জায়গা দিতে রাজি হচ্ছিল না। সবারই এক কথা – জয়নুল আবেদিন না বললে আমরা জায়গা দিতে পারব না।

ওদিকে আমরা তো তাঁর অনুমতির তোয়াক্কা না করেই আর্টিস্ট গ্রুপ গঠন করেছি এবং প্রদর্শনী করার প্রস্ত্ততি নিচ্ছি। তারপর শরণাপন্ন হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। প্রেসক্লাবে গিয়েও বাধা পেলাম। সেখানেও একই কথা – আবেদিন স্যারের অনুমোদন নিয়ে এসো। আমরা প্রেসক্লাবের সামনের লোহার রেলিংয়ের ওপর ছবি ঝুলিয়ে প্রদর্শনী করার জোগাড়যন্ত্র করছি। প্রেসক্লাবের দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন আমাদের ঘনিষ্ঠ, শ্রদ্ধেয় ফতেহ লোহানী ও নাজির আহমেদ। ওখানে তাঁরা তাস খেলতেন, আড্ডা দিতেন। নাজির আহমেদ হলেন শিল্পী হামিদুর রহমানের বড় ভাই। তাঁরা আমাদের হইচই-চেঁচামেচির কারণ জানতে চাইলেন। সব শুনে বললেন, তোমাদের প্রদর্শনী হবে এখানেই। সেটা ১৯৫৬ সালের কথা। খুবই সফল হলো সে-প্রদর্শনী। বহু ছবি বিক্রি হয়ে গেল। সব থেকে বেশি বিক্রি হলো মুর্তজা বশীরের কাজ। ওর ছবি ছিল বেশির ভাগ তেলরঙে আর দামও রেখেছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। গেলর্ড হফটাইজার নামের এক মার্কিনি, ইউএসআইএসের তৎকালীন ডিরেক্টর, কিনলেন অনেকগুলো কাজ। সেই থেকে হফটাইজার তথা ইউএসআইএসের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হলো।

এখানে একটা ঘটনার উল্লেখ না-করে পারছি না। আমি তখন ফাইনাল ইয়ারে। এক বন্ধুর বাড়িতে সন্ধ্যায় দাওয়াত খেতে গেছি। বন্ধুর বোনের বাড়ি। একজন স্কুলশিক্ষিকা। তাঁর স্বামী একজন পুলিশ অফিসার এবং লেখালেখিতে অনেক সময় দেন। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে গানের সুর ভেসে এলো। এক তরুণী গান গাইছে : চম্পাবতীর দেশে রে ভাই, চম্পাবতীর দেশে… সোনার বরণ কন্যা সে যে কোথায় গেল ভেসে…। সুন্দর কণ্ঠস্বর। তারও বেশি সুন্দরী দেখতে সে। বন্ধুর আরেক বোনের কন্যা। কলেজে পড়ে। সেখানেই পরিচয় হলো মেয়েটির সঙ্গে। বন্ধুর পরিবারটি বেশ শিক্ষিত, উদারমনা। আমার পরিচয় মেয়েটির সঙ্গে খুব একটা কারো নজর কাড়ল না। তবে ওদের বাড়িতে যখন-তখন যাওয়াও সম্ভব ছিল না। মেয়েটির কলেজে গিয়ে ডেকে পাঠাতাম। গেটের বাইরে এসে আলাপচারিতা চলতো নিয়মিত। ওই  সময় কোনো মেয়েকে নিয়ে রিকশা চড়ে ঘুরে বেড়ানো ছিল প্রায় অসম্ভব। তবু আমরা বেশ কয়েকবার রিকশা করে ঘুরেছি কোনো ঝামেলা  ছাড়াই। একবার সন্ধ্যায় বর্তমান আর্ট কলেজের দোতলায় আমিনুল ইসলামের স্টুডিওতে তার কাজ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। কাজ দেখে আমরা বেরিয়ে আসি। বারান্দার রেলিং ধরে গল্প করছি – আমিনুলের কাজ নিয়ে। কথা বললে ওর গালের দুপাশে টোল পড়ে। বললাম, তোমার টোলগুলো বেশ সুন্দর লাগে। দুষ্টুমির একটা চাপা হাসি দিয়ে জবাবে বলল, জানেন, (তখনো সম্পর্কটা তুমিতে পৌঁছায়নি) যাদের গালে টোল পড়ে তারা তাড়াতাড়ি মারা যায়। ভুল শুনেছ, যাদের গালে টোল পড়ে তারা একশ বছর বাঁচে। বুড়ি হয়ে? না! ওরকমই যুবতী থাকে।

পেইন্টারস ইউনিটের প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। একদিন মেয়েটি এলো প্রদর্শনী দেখতে। অবশ্যই মুখ্য উদ্দেশ্য আমার ছবি দেখা। সে  অবশ্য মুর্তজা বশীরের কাজ দেখেও মুগ্ধ হয়েছিল। বশীর ছিল না, তাই বললাম, অপেক্ষা করো, এখনই হয়তো আসবে। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর বশীর এলো। বশীরকে বললাম, মেয়েটা তোর সঙ্গে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করছে – বশীর হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে বলল : আমি কি চিড়িয়া যে আমাকে দেখতে এসেছে? ততক্ষণে মেয়েটি বারান্দায় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। বশীর আর কোনো কথা না বলে গ্যালারির ভেতর চলে গেল। পরিচয়টা আর করানো হলো না। অবশ্য কাইয়ুমের সঙ্গে ইতিপূর্বে আলাপ হয়েছে। কাজও দেখেছে তার। মেয়েটি কিছুটা বিব্রতবোধ করছিল। চলে গেল। মেয়েটির কথা আবারো আলোচনায় আসবে।

ঢাকা আর্ট কলেজে আমাদের চিত্রশিক্ষা ছিল ব্রিটিশ আঙ্গিকের। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে প্রায় একই সময় তিনটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। একটা বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই), একটা লাহোর ও অন্যটা কলকাতায়। কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে এখানে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান প্রমুখ শিল্পী। তাঁরা যেভাবে এবং যেটুকু শিখেছিলেন তা একটা নতুন দেশের নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নবীন ছাত্রদের মধ্যে উজাড় করে দিতে চেয়েছিলেন। এখানে অ্যাকাডেমিক বিষয়টিই বেশি প্রাধান্য পেত স্বাভাবিকভাবে। ড্রইং, ফিগার ড্রইংয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো বেশি। জলরং শেখানো হতো সতর্কতার সঙ্গে। তাই আমরা বাস্তবধর্মী কাজই বেশি করতাম যার ভেতর ছিল নৈসর্গিক দৃশ্য ও মানুষের জীবন। সে-সময় তেলরঙের উচ্চমূল্য আমাদের সুলভ জলরঙে কাজ করতে বাধ্য করত। সেই সঙ্গে এ-কথাটাও যোগ করতে হবে যে, কাগজের ওপর জলরঙে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটে উঠত সহজ ও সুন্দরভাবে। আমরা বেশি বেশি জলরং করতাম। তবে তেরলঙে কাজও আমাদের করতে হতো থার্ড ইয়ার থেকে। এর জন্য আলাদা নাম্বারও ছিল। ফাইনাল পরীক্ষায় আমি তেলরঙে যে-কাজটি করেছিলাম সেটি ছিল পুরনো ঢাকায় চলাচলকারী ঘোড়ার গাড়ির চাকায় লোহার বেড়ি লাগানোর দৃশ্য। চাকাটি কাঠের হলেও তার ওপর লোহার বেড়ি লাগানো হতো। লোহা গরম করে তা কাঠের ওপর বসিয়ে আটকে দিয়ে দ্রুত পানি ঢেলে লোহা ঠান্ডা করা হতো। ফলে ওই লোহার পাতটি কাঠের চাকার ওপর সেঁটে বসে থাকতো। সেটা খুলে পড়ার কোনো আশঙ্কা থাকতো না। ছবিতে এটি বেশ প্রাধান্য পেয়েছিল। সে-সময় প্রচুর ছবি এঁকেছি। প্রতি মাসে ক্লাসে আমাদের কুড়ি থেকে ত্রিশটি পর্যন্ত ছবি জমা দিতে হতো আউটডোর ওয়ার্ক হিসেবে। ড্রইং ও জলরং মিলিয়েই এসব ছবি জমা দেওয়া যেত। এতগুলো ছবি অাঁকার জন্য আমাদেরকে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে হতো। বিশেষ করে নদীর তীরে, ধানক্ষেতের পাশে গিয়ে আমরা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি অাঁকতাম। তবে আরো ভালো লাগত পুরাকীর্তির ছবি অাঁকতে, সদরঘাট, ছোটকাটরা ও বড়কাটরার ছবি। কখনো কখনো ঢাকার বাইরে গিয়েও ছবি এঁকেছি। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় কলকাতা থেকে এসেছিল বিজন চৌধুরী ও দেবদাস চক্রবর্তী। বাম রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ওরা কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল। ওরা এসে ভর্তি হলো ঢাকায়, বিজন আমার দু-ক্লাস ওপরে, আর দেবদাস এক ক্লাস নিচে। আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। দেবদাসের দারুণ হাত ছিল ড্রইংয়ে। ওর এই গুণের প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম এবং ওর সঙ্গে আমার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। দেবদাস অদ্ভুত ধরনের মানুষ ছিল। সবার সঙ্গেই ছিল তার চেনাজানা, সবাই তাকে ভালোবাসত। ছোট-বড় সবার সঙ্গেই সে মিশতো এবং পরিচয়ের অল্পদিনের মধ্যেই তুমি-তুইয়ের সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলত। জলরঙে আমার ঝোঁক ছিল বেশি আর করতামও অগণিত কাজ। ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ইউএসআইএসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে ওরা আমার জলরঙের কাজ সংগ্রহ করতে শুরু করেছিল। এভাবে ছাত্রাবস্থাতেই আমার ছবি বিক্রি শুরু। ছবি বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে ছবি উপহারও দিতে হতো। একবার আমার এক দূরসম্পর্কের ভাবি জাফর ভাইয়ের বন্ধুর স্ত্রী, ওই সময় তিনি কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলের অ্যাসিসট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস ছিলেন। আমি থাকতাম ওই স্কুলের পাশেই এক বাসায়। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বড় একটা এলাকা, নাম ছিল তারাবাগ। অনেকগুলো বাড়ি ছিল ওখানে। একটা বাড়িতে থাকতেন বেগম সুফিয়া কামাল। ভাবি, মিসেস শামসুল হুদা আমার স্টুডিওতে এসে জোর দাবি জানালেন তাঁকে কিছু ছবি দিতে হবে। আমি গোটা তিনেক জলরঙের ছবি উপহার দিলাম। ওর প্রায় মাস ছয়েক পরে আবার ভাবি এলেন আমার স্টুডিওতে। এবার সঙ্গে তাঁর দুই কিশোরী কন্যা। তারাও কামরুন্নেসা স্কুলে পড়ে। ছোট মেয়েটার নাম মেরী। একসময় সে জেনারেল এরশাদের স্ত্রীর পরিচয় লাভ করে।

ভাবি বললেন, সেলিম (আমার ডাকনাম) আমাকে আরো কয়েকটা ছবি দাও। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই না সেদিন আপনাকে তিনটা ছবি দিলাম। জবাবে তিনি বললেন, ওগুলো না কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না। সেদিন থেকে আমি আর কাউকে ছবি উপহার দিই না।

সাহিত্যপত্রিকা সমকালের সঙ্গে সম্পৃক্ততা

সাহিত্য মাসিক সমকাল বেরিয়েছিল ১৯৫৬-৫৭ সালের দিকে। প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক, দেবদাস চত্রবর্তী, বেলাল চৌধুরী যুক্ত ছিলেন পত্রিকাটির সঙ্গে। এঁরা অর্থসংকটে পত্রিকাটি বের করতে পারছিলেন না। সবাই মিলে আমার বড় ভাই সিকান্দার আবু জাফরের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। তারাবাগে তখন দাদাভাইয়ের বাসা। কাছেই প্রধান ভবন সংলগ্ন সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের দুই কামরায় আমার বাসস্থান ও স্টুডিও। হাসান এবং কবি-সাহিত্যিকেরা আমার মাধ্যমে জাফর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলেন। সমকাল পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করলেন সকলে। সমকাল প্রকাশনী থেকে পত্রিকাটি বেরুবে। জাফর ভাই সম্মতি দিলেন। তাঁরও এমন একটি পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা ছিল। প্রথম দিকে হাসান হাফিজুর রহমান পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। পরে জাফর ভাইয়ের সম্পূর্ণ কর্তৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে সমকাল প্রকাশিত হতে থাকে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল পত্রিকার প্রচ্ছদ তৈরির। আমি নিজে সব প্রচ্ছদ না করে একটু ভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা করলাম। একেকটি সংখ্যার প্রচ্ছদ একজন প্রখ্যাত শিল্পী অাঁকবেন। ওভাবে সমকালের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, কামরুল হাসান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, আব্দুর রাজ্জাক, নিতুন কুন্ডুসহ মোট বারোজন শিল্পী। এঁদের কোনো সম্মানী প্রদান করা হতো না। বরং সমকালের প্রচ্ছদ করা মানে শিল্পীর প্রতি একধরনের সম্মান প্রদর্শন ও তাকে স্বীকৃতি জানানো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমিই সমকালের প্রচ্ছদ অাঁকতাম। আর করত জুনিয়র ছাত্র হাসান আহমেদ।

সমকাল থেকে যেসব বই প্রকাশ করা হতো তার প্রথম কয়েকজনের মধ্যে ছিল বন্ধু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। গাফ্ফারের প্রথম প্রকাশিত বই সম্রাটের ছবির প্রচ্ছদ ছিল আমার অাঁকা। অনেকটা বিমূর্ত ঢংয়ের ছবি ছিল সেটা। দেবদাস এঁকেছিল সানাউল হক সাহেবের কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ বিচূর্ণ আর্শীতে। একইভাবে কাইয়ুম, আমিনুল, মুর্তজা বশীর এবং আরো অনেকে শিল্পী সমকালের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে কভার ডিজাইনে নতুন মাত্রা সংযুক্ত করেছিলেন। একবার জাফর ভাই (দাদাভাই) নিজেই তাঁর কয়েকটা বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন এবং বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, অনুজ এবং অনুজপ্রতিম শিল্পীদের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ধৈর্য হারিয়ে নিজেই রংতুলি নিয়ে বসতে বাধ্য হয়েছি। জ্যামিতিক ফর্মে বেশ কিছু লাইন ও রঙের প্রলেপে অাঁকা প্রচ্ছদগুলো দৃষ্টিনন্দন ছিল বলাই যায়। কভারগুলো করার জন্য তাগিদ ছিল, দেবদাস, কিবরিয়া আর আমার ওপর।

দাদাভাই ছবি অাঁকতেন না, কিন্তু বাড়িতে আমার কাজ দেখে এবং অন্যান্য সমসমায়িক শিল্পীর কাজের সঙ্গে পরিচিত থাকার ফলে চিত্রকলা সম্পর্কে মোটামুটি একটা জ্ঞান তাঁর ছিল। কবিতার চিত্রকল্প আর শিল্পীর চিত্রের মধ্যে যে গভীর সংযোগ বিদ্যমান, তার প্রমাণ পাওয়া যেত তিনি যখন আমার ছবির কোনো কোনো বিষয়ে সমালোচনা করতেন বিজ্ঞ সমালোচকের মতো।

আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়াটা আববা খুব ভালো করে মেনে নিতে পারেননি। প্রথমত তিনি বুঝতেন না আর্ট কী এবং আর্ট কলেজে পড়ে ভবিষ্যতে কী হবে। আর্ট কলেজে পড়ে ভবিষ্যতে কী হবে তার জবাব আমিও দিতে পারিনি। কারণ আমিও জানতাম না ভবিষ্যতে কী হবে! আববার বিশ্বাস ছিল, আমি স্কুলের মেধাবী ছাত্র ছিলাম। উচ্চশিক্ষা অর্থাৎ বিএ, এমএ পাশ করে একটা ভালো চাকরি নিয়ে ভালোভাবে উপার্জনক্ষম হব। গ্রামে বাস করা স্বল্পশিক্ষিত একজন পিতার পক্ষে এ-ধরনের চিন্তা খুবই স্বাভাবিক। ফলে কিছুদিন পর দাদাভাইয়ের পরামর্শে আমি মদন মোহন বসাক রোডে অবস্থিত কায়েদে আজম নাইট কলেজে ভর্তি হলাম বাণিজ্য বিষয়ে পড়ার জন্য। দাদাভাই ভাবির সঙ্গে থাকতাম মদন মোহন বসাক রোডে বলধা গার্ডেনের উত্তর দিকে রাস্তার ওপারের এক বাসায়। ওখান থেকে হেঁটে ভিক্টোরিয়া পার্কে আমার আর্ট কলেজে যাওয়া এবং সন্ধ্যায় ফিরে এসে সামান্য নাস্তা করে আবার কলেজে যাওয়া ছিল বেশ ঝামেলার ব্যাপার। তারপর রাত বারোটা পর্যন্ত কলেজের পড়া তার সঙ্গে পরদিনের আর্ট ক্লাসের হোমওয়ার্ক অর্থাৎ কিছু স্কেচ করা এবং খুব সকালে উঠে ঠাটারীবাজার থেকে রান্নার জন্য রোজ বাজার করে আনতে বেজে যেত প্রায় সকাল আটটা। তাড়াহুড়ো করে গোসল সেরে দুটো খাবার মুখে দিয়ে দৌড়াতে হতো আর্ট কলেজের উদ্দেশে। কিছুদিন পর দাদাভাই কয়েকটা বইয়ের প্রচ্ছদ অাঁকার জন্যে আমাকে কিছু পান্ডুলিপি ধরিয়ে দিলেন এবং মোটামুটি একটা ধারণা দিলেন প্রচ্ছদটা কেমন হওয়া উচিত। আমি তখন মাত্র সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই শুরু করলাম প্রচ্ছদ অাঁকতে। বাংলাবাজারে দাদাভাইয়ের পরিচিত ঘনিষ্ঠ এক প্রকাশকের কাছ থেকে নিতেন ওই প্রচ্ছদ অাঁকার দায়িত্ব। আমার ওপর কাজের চাপ আর এক ধাপ বেড়ে গেল। ‘এটা তোমাকে করতেই হবে’, দাদাভাই কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন। বললেন, তুমি বিনা-পয়সায় খাচ্ছ-দাচ্ছ এটা ঠিক না – তোমাকে কিছুটা হলেও উপার্জন করে সংসারে দিতে হবে। ভাবলাম, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিছু একটা আলোচনা হয়েছে নিশ্চয়ই। তাই কিছু না বলেই সম্মতি জানালাম। সেই সুবাদেই শুরু হলো আমার বইয়ের প্রচ্ছদ অাঁকার পর্ব। দাদাভাই বললেন, বইয়ের প্রচ্ছদে লেখা শেখার জন্যে তুই কামরুলের বাসায় চলে যা, আমি কামরুলকে বলে দিচ্ছি। নতুন আরো একটা তালিকা দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে যুক্ত হলো। অবশ্য কামরুল ভাইয়ের বাসায় বেশিদিন যেতে হয়নি। ব্রাশ দিয়ে ফ্রি-হ্যান্ড লেটারিং শেখা খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না। তাছাড়া মাঝে মধ্যে কলেজেও কামরুল ভাইকে দেখিয়ে নিতাম আমার কাজের নমুনা।

একদিন বিকেলে বাসায় ফিরে দেখি বসার ঘরে খুব উচ্চৈঃস্বরে এক মহিলা কথা বলছেন। দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করলাম এবং জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম এক তরুণী নাটকের ডায়ালগ বলছে… ‘আলো, আলো, দরবারের সব আলো জ্বেলে দাও’ – পরিচালক ইসমাইল মোহাম্মদ (উদয়ন ভাই) তাকে থামিয়ে দিয়ে বলছেন… আলু নয়, আলু নয়  – আলো…। মেয়েটা শুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারছিল না। উদয়ন ভাই কলকাতা থেকে এসেছেন। দাদাভাইয়ের বন্ধু এবং একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। ঢাকায় এসেছেন দাদাভাইয়ের আমন্ত্রণে শচীন সেনগুপ্তের সিরাজউদ্দৌলা নাটকের মঞ্চায়নে সাহায্য করতে। মহিলা অভিনেত্রী পাওয়া প্রায় যেতই না ওই সময়। তাই বহু কষ্টে দু-একজনকে পাওয়া গেলেও তাদের দিয়ে অভিনয় শেখানো ছিল আরো কঠিন ব্যাপার। এই তরুণী ঢাকারই বাসিন্দা, আমাদের পরিচিত এক বন্ধু বাবুর বোন। ম্যাট্রিক পাশ মেয়েটি কিন্তু উচ্চারণ শুদ্ধ নয় এবং অভিনয়ের কলাকৌশল আয়ত্ত করতে তার বেশ সময় লাগছিল। নাটকটি পড়তে পড়তে দাদাভাই আবিষ্কার করলেন শচীন সেনগুপ্ত সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রটিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করেননি, বরং দুশ্চরিত্র, অদক্ষ শাসক হিসেবে দেখিয়েছেন  – আসলে তা সঠিক ইতিহাস নয়। এমনকি ‘মীর মদন’ চরিত্রটিও সঠিক ছিল না। তার নাম ছিল মীর মর্দান। দাদাভাই লেগে গেলেন নতুন করে সিরাজউদ্দৌলা নাটক লিখতে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ইতিহাস বিকৃত না করে লিখে চললেন নাটক। শুরু হলো নতুন সিরাজউদ্দৌলার রিহার্সাল। একদিকে নাটক লেখা হচ্ছে, অন্যদিকে তাল মিলিয়ে চলছে রিহার্সাল। শেষ পর্যন্ত নাটকটি যখন শেষ হলো লেখা এবং প্রস্ত্ততি, আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল মঞ্চের ডিজাইন এবং মঞ্চ তৈরির কাজ। একটা কেল্লার ভেতরের দৃশ্য। ভেতর থেকে কামান দাগা হবে, বাইরে থেকে দেওয়া হবে গোলার শব্দ আর আলোর বিচ্ছুরণ, যা স্টেজে বসে দর্শকরা দেখবে। নাটকের শুরুটা ছিল ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ হুকুম দিচ্ছে – ‘ফায়ার…ফায়ার… মার্সিলেসলি…’ ভেতর থেকে কামান দাগা হচ্ছে। বাইরে থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে। বৈদ্যুতিক বাতির সাহায্যে গোলাগুলির আগুন দেখানো হচ্ছিল দুর্গের বাইরে। কিছু ইংরেজ সৈন্য ভেতরেও গুলিবিদ্ধ হচ্ছে। দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল নাটকটি ওই সময়। নতুন নাটক, কিন্তু খুব আকর্ষণীয় ছিল। মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ-নাটকটি। মঞ্চ ডিজাইনের প্রশংসা করেছিলেন উদয়ন ভাই, নাটকের পরিচালক। এরপর আরো কয়েকবার নতুন এই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। পরবর্তীকালে সিকান্দার আবু জাফরের সিরাজউদ্দৌলা নাটক কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য করা হয়। সম্ভবত এখনো সেটা চালু আছে।

আর্ট কলেজে সহপাঠী সবুর এবং মবিনুল আজিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল একটু বেশি। সবুর ভালো ছবি অাঁকত। ক্লাসে ফার্স্ট হতো। মবিন ছিল খুব চটপটে, আড্ডাবাজ। ছিল অনেক বন্ধু-বান্ধব। তাদেরই কজনার সঙ্গে পরবর্তীকালে আমারও ঘনিষ্ঠতা হয়। আব্দুল আজিজ। বয়সে বড় এবং কলকাতা থেকে মাস্টার্স করা ছিলেন বলে ডাকতাম আজিজদা বলে। আর ছিল টিপু, টিপু সুলতান। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র। খোশমেজাজী। আমরা একসময় সদরঘাটের এক শরীরচর্চা কেন্দ্রে যেতাম। তখন বুড়িগঙ্গার চেহারা ছিল একেবারেই ভিন্ন। বাকল্যান্ড বাঁধের ওপরে কোনো প্রকার দোকান বা অন্য কোনো স্থাপনা ছিল না। নদীতে বাঁধা থাকত নৌ-রেস্তোরাঁ, অনেকগুলো। গরম ভাত, ডাল, মাছ, ভাজি থাকত খাবার মেন্যুতে। মুরগিও থাকতো মাঝেমধ্যে। কিছু রেস্তোরাঁ আবার আবাসিকভাবে ব্যবহার হতো। ইচ্ছে করলেই কয়েক ঘণ্টার জন্য কামরা ভাড়া নিয়ে বিশ্রাম করা যেত। ইটের গাঁথুনি দেওয়া বাঁধের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া প্রায় নিয়মের মধ্যেই এনে ফেলেছিলাম আমরা। এছাড়া বিকেলে, সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত সদরঘাট থেকে নবাবপুরের রেলগেট পর্যন্ত হাঁটতে যাওয়াও আমাদের প্রায় নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। অবশ্য ঢাকা শহর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ওই রেলগেট পর্যন্তই বিস্তৃত ছিল। এরপর ছিল কেবল গভর্নর সাহেবের বাড়ি। তারপর শুধুই জঙ্গল আর ধানক্ষেত। তবে হ্যাঁ, বর্তমানের গুলিস্তান সিনেমার ঠিক পেছনে ছিল একটা রেস্টহাউস, ব্রিটিশ আমলের তৈরি।

মবিনুল আজিমের সঙ্গে অন্য আরেকটি কারণে সখ্য ছিল, তাহলো আমরা দুজনে ব্যাডমিন্টন খেলতাম, ডাবলসে। প্রেসক্লাবের উলটোদিকে ইউএসআইএস ভবনটি যেখানে ছিল ঠিক সে-জায়গাটিতেই ছিল একটা ক্লাব এবং ওই ক্লাবের ব্যাডমিন্টন কোর্ট। আমি এবং মবিন একবার ওই মাঠে অনুষ্ঠিত একটা টুর্নামেন্ট ম্যাচে সেমিফাইনালে উঠেছিলাম। সেই থেকে আমাদের সম্বোধনে ‘পার্টনার’ শব্দটি যুক্ত হয়েছিল। মদন মোহন বসাক রোডের যে-বাড়িতে আমরা থাকতাম সেটার পেছনেই ছিল একটা খেলার মাঠ। ওখানে আমি প্রায়ই যেতাম ফুটবল এবং ব্যাডমিন্টন খেলতে। ওখানে খেলতে আসত জহির এবং জমির। পরবর্তীকালে খ্যাতিমান আইনবিদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জহির। যখনই কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হতো, স্মরণ করত আমাদের সেই পুরনো দিনের খেলাধুলার কথা। জহির চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। অ্যাম্বাসাডর জমির এখনো তার অসাধারণ কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব আছেন। মাঝে মধ্যেই দেখা হয়। স্মৃতিচারণ করি, প্রথম এশিয়ান আর্ট বিয়েন্নাল বাংলাদেশ অনুষ্ঠানের সময় জমির ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পরিচালক। সেই সুবাদে তিনি অকৃপণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রথম প্রদর্শনীর সফল অনুষ্ঠানের জন্যে। অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এশিয়ান আর্ট বিয়েন্নাল প্রদর্শনী আয়োজনে সহযোগিতার মাধ্যমে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সেই শুরু থেকে অদ্যাবধি পালন করে আসছে।

দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেল। আমার আর্ট কলেজে পড়ার সময়ও পার হলো। এখন কী করব! চাকরি-বাকরি পাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। আর সত্যিকথা বলতে কি চাকরি করার ইচ্ছা আমার আদৌ ছিল না। অনেক মেহনত করে ছবি অাঁকা শিখেছি, ছবিই অাঁকব, যা থাকে কপালে। (চলবে)