বাংলা ব্যাকরণের নতুন দিগন্ত

মাহবুবুল হক
বাংলা একাডেমী
প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
(প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড)
সম্পাদনা : রফিকুল ইসলাম
ও পবিত্র সরকার
বাংলা একাডেমী
ঢাকা, ২০১১

৪০০ ও ৫০০ টাকা

বাংলা ভাষার বয়স হাজার বছরেরও বেশি। আর এর ব্যাকরণ লেখা শুরু হয়েছে প্রায় পৌনে তিনশো বছর আগে থেকে। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে এ-ভাষার কোনো নিজস্ব ব্যাকরণ রচিত হয়নি। এ যাবৎ যেসব ব্যাকরণ লেখা হয়েছে সেগুলিতে প্রাধান্য পেয়েছে মূলত সংস্কৃত রীতি, কখনো কখনো তা লাতিন তথা ইংরেজি ব্যাকরণ রীতি দ্বারা প্রভাবিত।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ভারতবর্ষে আগত ধর্মপ্রচারকদের জন্যে জারিকৃত একটি নির্দেশকে কেন্দ্র করে। ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে গোয়ার তদানীন্তন গভর্নর এ মর্মে নির্দেশ জারি করেছিলেন যে, ভারতবর্ষে আগত ধর্মপ্রচারকদের ছয় মাসের মধ্যে স্থানীয় ভাষা শিখতে হবে। ফলে তাদের জন্য তা শেখা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এ প্রেক্ষাপটেই পর্তুগিজ পাদরি মানোএল্-দা-আস্সুম্পসাঁও রচনা করেন বাংলা পর্তুগিজ শব্দকোষ Vocabulario em Idioma Bengalla e Portuguez। তা পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় ১৭৪৩-এ। এটি মূলত শব্দকোষ হলেও বাংলা ভাষার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য সূত্রায়ণের প্রয়াস তাতে লক্ষ করা যায়। সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণ অংশটি পর্তুগিজ ভাষায় রচিত। মানোএল্ যখন এ-ব্যাকরণ রচনা করেন, তখন বাংলা ভাষা শেখা বা শেখানোর আদর্শ কোনো পদ্ধতি ছিল না। তাছাড়া তুচ্ছ জ্ঞান করতেন বলে সংস্কৃত-পন্ডিতরাও তখন এ-ভাষা চর্চায় এগিয়ে আসেননি। ফলে মানোএল্ লাতিন ভাষার অনুসরণে এ-ভাষার ব্যাকরণ রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন। তখন বাংলা হরফ তৈরি না হওয়ায় ব্যাকরণটি রোমান হরফে মুদ্রিত হয়েছিল।
বাংলা অক্ষরে প্রথম মুদ্রিত ব্যাকরণটিও বিদেশির লেখা। ১৭৭৮ সালে A Grammar of the Bengali Language নামে এ-ব্যাকরণটি লিখেছিলেন প্রাচ্যবিদ ও ভাষাতাত্ত্বিক নাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। ব্যাকরণটি লিখিত হয়েছিল ফিরিঙ্গিদের জন্য। মূল ব্যাকরণ অংশ রচিত হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়। অনুসৃত হয়েছিল ইংরেজি ব্যাকরণ রচনার রীতি আর কাঠামো তৈরি হয়েছিল সংস্কৃত ব্যাকরণের ধাঁচে। এ ব্যাকরণে উদ্ধৃতিগুলো নেওয়া হয়েছিল রামায়ণ, মহাভারত, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি কাব্য থেকে। সেগুলি মুদ্রিত হয়েছিল বাংলা হরফে। বাংলা ভাষা শেখা ও শেখানোর ক্ষেত্রে এ-ব্যাকরণটি ছিল প্রথম উল্লে­খযোগ্য প্রচেষ্টা।
এর পরের উল্লে­খযোগ্য ব্যাকরণটিও বিদেশির কাছ থেকে পাওয়া। সেটি হলো বহুভাষাবিদ ধর্মযাজক উইলিয়াম কেরি-রচিত A Grammar of the Bengali Language (১৮০১)। এটিও রচিত হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়। আর এতে অনুসৃত হয়েছিল হ্যালহেডের ব্যাকরণের আদর্শ। ইংরেজ রাজকর্মচারীদের বাংলা ভাষা শেখায় সহায়তা করাই ছিল এটি রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য।
এই দুই ব্যাকরণের মাধ্যমে হ্যালহেড ও কেরির হাতে বাংলা ভাষা পেয়েছিল স্বতন্ত্র মর্যাদা ও স্বীকৃতি। তবে এতে বাংলা ভাষার ওপর সংস্কৃত ভাষার আধিপত্য স্বীকৃত হয়েছিল এবং যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সংস্কৃতের প্রভাবকে। ফলে বাংলা ব্যাকরণ গোড়া থেকেই হয়ে উঠেছিল সংস্কৃত ব্যাকরণঘেঁষা।
বাঙালির হাতে বাংলা ব্যাকরণ রচনার সূচনা হয় উনিশ শতকের গোড়ায়। ১৮০৭ সালে প্রকাশিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ হলো বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ।
বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত থেকে একেবারে আলাদা ভাষার মর্যাদা দিয়ে ব্যাকরণ রচনায় প্রথম উদ্যোগী হন রামমোহন রায়। তিনি প্রথমে বাংলা ব্যাকরণ লেখেন ইংরেজি ভাষায়। Bengalee Grammar in the English Language (১৮২৬)। পরে বাংলা ভাষায় লেখেন গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩)। চলিত ভাষাকে উপেক্ষা করে কেবল সাধু ভাষায় ব্যাকরণ লেখাকে রামমোহন সংগত বলে মনে করেননি। তাঁর গৌড়ীয় ব্যাকরণেই প্রথম বাংলা ভাষার প্রকৃত স্বরূপ চিহ্নিত করার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে।
এরপর উনিশ শতকে অনেকগুলো ব্যাকরণ লেখা হয়েছে। এগুলি ছিল প্রথাবদ্ধ এবং সংস্কৃত ব্যাকরণঘেঁষা। তবে এগুলোর মধ্যে উনিশ শতকের মধ্যভাগে লেখা শ্যামাচরণ সরকারের বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৮৫২) বইটি ব্যাকরণ-ভাবনার ক্ষেত্রে উল্লে­খযোগ্য। এ ব্যাকরণে তিনি কথ্য ও লেখ্য ভাষার পার্থক্য নিরূপণে অগ্রসর হয়েছিলেন।
উনিশ শতকে ইউরোপে ব্যাকরণ-ভাবনার ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু তখনকার বাংলা ব্যাকরণে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। এর কারণও ছিল। তখন বাংলা ব্যাকরণ-ভাবনা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের বেড়াজালে বন্দি। তাছাড়া সেসব ব্যাকরণের প্রণেতারা ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত। তাঁরা অন্ধভাবে সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুকরণ ও অনুসরণে ছিলেন অভ্যস্ত। অবশ্য কেউ কেউ ইংরেজি ব্যাকরণের কাঠামোতে বাংলা ভাষার নিয়ম-শৃঙ্খলা সন্ধানে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরাও সংস্কৃত ব্যাকরণের   প্রভাব-বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনায় সংস্কৃত-প্রভাব অব্যাহত থাকলেও উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে বাংলা ভাষার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে। প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) ও কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬২) প্রভৃতি গ্রন্থে চলিত ভাষারীতি লক্ষণীয় স্থান করে নিলে এ-রীতিতে সাহিত্য রচনার প্রত্যাশা ও দাবি সামনে চলে আসে। অচিরেই চলিত ভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সাহিত্যে চলিত ভাষার ব্যবহারে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসেন প্রমথ চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো খ্যাতিমান লেখক।
উনিশ শতকের শেষ দিকে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও ব্যাকরণ-ভাবুকদের মধ্যে এ-ভাবনা গুরুত্ব পেতে থাকে যে, বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে আলাদা এক স্বাধীন ভাষা। স্বভাবতই সংস্কৃত ও ইংরেজি ব্যাকরণের প্রভাবমুক্ত বাংলা ব্যাকরণ রচনার পক্ষে একদল নব্যপন্থী তখন সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এ নিয়ে রক্ষণশীলদের সঙ্গে নব্যপন্থীদের বিতর্ক জমে ওঠে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রতিষ্ঠার (১৮৯৩) পর।
এভাবে শতবর্ষেরও আগে বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ বরেণ্য বাঙালি এ-ধরনের ব্যাকরণ রচনার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন বিশ শতকের গোড়ায়। রবীন্দ্রনাথ নিজে কিছু কাজও করেছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার নিজস্ব ভঙ্গি চিহ্নিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার প্রমাণ রয়েছে তাঁর শব্দতত্ত্ব (১৯০০), বাংলা শব্দতত্তব (১৯৩৫) ও বাংলাভাষা পরিচয় (১৯৩৮) গ্রন্থে।
বিশ শতকে পাশ্চাত্য আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের প্রভাব পড়ে বাংলা ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে। মুহম্মদ শহীদুল্ল­াহর বাঙ্গালা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৫-এ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করে লেখেন ভাষাপ্রকাশ বাংলা ব্যাকরণ (১৯৩৯)। তবে তাঁদের ব্যাকরণ প্রথাগত সংস্কৃত ও ইংরেজি ব্যাকরণের সূত্র অনুসরণের প্রবণতা থেকে মুক্ত ছিল না। অন্যদিকে স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের আওতায় ব্যাকরণ লিখেও তাতে কিছুটা স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় রেখেছিলেন মুহম্মদ এনামুল হক, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ।
বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পাশ্চাত্যে ভাষাবিজ্ঞান চর্চা নতুনতর মাত্রা পায়। এডওয়ার্ড সি ডিমোক, চার্লস ফার্গুসন, নোয়াম চমস্কি প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানীর অবদানে খুলে যেতে থাকে ভাষাবিজ্ঞানের নিত্যনতুন দিগন্ত। তারই আলোয় বাংলা ভাষা গবেষণায় এগিয়ে আসেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ। এ ধারায় পরবর্তীকালে বাংলা ভাষা চর্চায় ভূমিকা রাখেন রফিকুল ইসলাম, পবিত্র সরকার, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, হুমায়ুন আজাদ, উদয়কুমার চক্রবর্তী, উদয়নারায়ণ সিংহ, মৃণাল নাথ, জ্যোতিভূষণ চাকী, মনিরুজ্জামান, সুভাষ ভট্টাচার্য প্রমুখ। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার স্বকীয় ব্যাকরণ লেখার কাজটি অসম্পন্নই থেকে যায়।
আমাদের সৌভাগ্য, বাংলাদেশের জাতীয় বিদ্বৎ প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী বহু-আকাঙ্ক্ষিত এ-কাজ সম্পন্ন করেছে। সম্প্রতি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ প্রকাশ করে পালন করেছে এক ঐতিহাসিক কর্তব্য।
বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের স্বপ্নদর্শী ও সাহসী উদ্যোগের ফসল প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ। এ ব্যাকরণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালের জুনে। আগস্টে বাংলা একাডেমীতে দুদিনব্যাপী ‘বাংলা ব্যাকরণ’ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় ব্যাকরণবিদ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। এ কর্মশালায় বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়নের রূপরেখা ও রীতিপদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমির সহযোগিতায় কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় দুদিনব্যাপী আলোচনাচক্র। এপ্রিলে বাংলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচিত লেখকদের নিয়ে কর্মশালা। তার পর দেড় বছর ধরে চলে লেখা ও সম্পাদনার কাজ। ২০১১-এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় বহু-আকাঙ্ক্ষিত এ-ব্যাকরণ।

দুই

প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ দুটি খন্ডে  বিভক্ত। প্রথম খন্ডে রয়েছে পাঁচটি পর্ব। প্রথম পর্বে ধ্বনিবিজ্ঞান অংশে দেখানো হয়েছে বাংলা স্বর ও ব্যঞ্জন ধ্বনিগুলির উচ্চারণপ্রক্রিয়া ও তরঙ্গ-ধ্বনিচিত্র।
দ্বিতীয় পর্বের আলোচ্য বিষয় ধ্বনিতত্ত্ব। এ-অংশে প্রমিত বাংলা ধ্বনিগুলি নিরূপণ করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে এ-ধ্বনিগুলির বিন্যাসের বা অবস্থানের স্বরূপ। অর্থাৎ শব্দের আদিতে, মধ্যে ও শেষে কোন কোন ধ্বনি বসে, কোথায় কোথায় বসে, কোন কোন ধ্বনির আগে বা পরে বসে, বিশেষ বিশেষ প্রতিবেশে কোনো ধ্বনি বদলে যায় কিনা – এসব বিষয় ধ্বনিতত্ত্বের আলোচনায় স্থান পেয়েছে। সেইসঙ্গে এ-অংশে দেখানো হয়েছে :
১. বাংলা বর্ণমালায় বর্তমানে এগারোটি স্বরবর্ণ ব্যবহৃত হলেও প্রমিত বাংলায় স্বরধ্বনির সংখ্যা সাতটি; ২. বাংলা বর্ণমালায় ঊনচল্লি­শটি বর্ণ ব্যবহৃত হলেও প্রমিত ব্যঞ্জনধ্বনির সংখ্যা আটাশটি; ৩. প্রমিত বাংলায় অর্ধস্বরের সংখ্যা চারটি এবং যথার্থ দ্বিস্বরের সংখ্যা সতেরোটি।
এছাড়া এ-অংশে বাংলা যুক্তব্যঞ্জনের প্রকৃতি, ধ্বনিদল সংগঠন, সঞ্জননী ধ্বনিতত্ত্ব, ধ্বনির স্বলক্ষণ, অধিধ্বনি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
তৃতীয় পর্বের আলোচ্য বিষয় রূপতত্ত্ব। এ ব্যাকরণে বাংলা ভাষার রূপতত্ত্বকে শব্দনির্মাণের রূপতত্ত্ব ও পদনির্মাণের রূপতত্ত্ব – এই দুটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। শব্দনির্মাণের রূপতত্ত্বে আলোচিত হয়েছে আদ্যপ্রত্যয় (উপসর্গ), মধ্যপ্রত্যয় ও অন্ত্যপ্রত্যয় যোগে এবং সমাস ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় বাংলা শব্দ গঠনের প্রসঙ্গ। শব্দগঠনের প্রক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে  এ ব্যাকরণে সংস্কৃত ও বৈভাষিক শব্দনির্মাণের দিকটি (আরবি, ফারসি, ইংরেজি ইত্যাদি) আলোচ্য বলে বিবেচিত হয়নি। বরং প্রমিত বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দগঠন প্রক্রিয়া দেখানোর বিষয়টিকে এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শব্দনির্মাণের রূপতত্ত্বে বিশেষ্য, বিশেষণ, যোজক, অনুসর্গ ও আবেগশব্দ গঠনের প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। সমাসের আলোচনায় সংস্কৃত সমাস আলোচনার প্রথাবদ্ধ রীতি থেকে কিছুটা সরে আসা সম্ভব হয়েছে। সংস্কৃত ব্যাকরণের সমাস সংক্রান্ত পরিভাষা বদলের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রচলিত পরিভাষার পাশাপাশি বন্ধনীর মধ্যে বিকল্প পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন : দ্বন্দ্ব (বন্ধন) সমাস, তৎপুরুষ (কারকলোপী) সমাস, কর্মধারয় (বর্ণন) সমাস, বহুব্রীহি (অন্যার্থক) সমাস। অব্যয়ীভাব সমাস প্রশ্নসাপেক্ষ বলে মান্য করা হয়নি। প্রাদি সমাসকে গ্রাহ্য বলে বিবেচনা করা হয়েছে। দ্বিগু সমাসকে কর্মধারয় সমাসের অংশ হিসেবে গণ্য করায় তার আলোচনা বর্জিত হয়েছে।
পদ গঠনের রূপতত্ত্বে নিরূপণ করা হয়েছে বিভক্তি যোগে পদ গঠনের বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে আলোচিত হয়েছে বিশেষ্য ও সর্বনাম শব্দের কারক-আশ্রিত রূপ বা কারক-প্রকরণ এবং ক্রিয়াপদের রূপ গঠনের প্রকৃতি বা ক্রিয়া-প্রকরণ। ক্রিয়ার রূপ নির্মাণ আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবে কাল, প্রকার, ভাব ও পক্ষের (পুরুষ) আলোচনা এসেছে।  প্রথাগত ব্যাকরণের মতো সংস্কৃত ব্যাকরণের শব্দ নির্মাণের বিষয়টি এতে ঠাঁই পায়নি, প্রমিত বাংলার শব্দগঠনের প্রকৃতিই গুরুত্ব পেয়েছে। প্রথাগত ব্যাকরণে বাংলা ভাষার পাঁচ ধরনের শব্দশ্রেণির কথা বলা হয়। এ ব্যাকরণে বাংলা ভাষার শব্দশ্রেণিকে আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলি হলো : বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া, ক্রিয়াবিশেষণ, যোজক, অনুসর্গ ও আবেগশব্দ। অব্যয় বলে যে শ্রেণিটির কথা প্রথাগত ব্যাকরণে বলা হয়, তা ভাষাবিজ্ঞানসম্মত নয় বলে বর্জিত হয়েছে। এছাড়াও রূপতত্ত্ব অংশে শব্দদ্বিত্ব, বচন, বহুশাব্দিক ক্রিয়া, লগ্নক বা বিশেষার্থক অন্ত্যপ্রত্যয়, বাগধারা ইত্যাদি বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। প্রথাগত ব্যাকরণে যে লিঙ্গান্তর প্রক্রিয়া দেখানো হয়, তা সংস্কৃত ব্যাকরণের লিঙ্গান্তর প্রক্রিয়ার প্রভাবজাত। এ ব্যাকরণে বলা হয়েছে যে, বাংলায় অর্থগত লিঙ্গ থাকলেও ব্যাকরণিক লিঙ্গ নেই। তাই রূপতত্ত্বে লিঙ্গের আলোচনা বাদ দেওয়া হয়েছে।
চতুর্থ পর্বের বিষয় বাক্যতত্ত্ব। প্রচলিত ব্যাকরণে বাক্যতত্ত্বের আলোচনা থাকে খুবই সীমিত পরিসরে। এ ব্যাকরণে বাক্যতত্ত্বের আলোচনা করা হয়েছে মোটামুটি বিশদভাবে। প্রমিত বাংলার বাক্যতত্ত্ব আলোচনায় প্রধানত নিচের বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে :
১. বাক্যের গঠন-উপাদান সম্পর্কে আলোচনা; ২. সরল, জটিল ও যৌগিক বাক্যের গঠন-প্রক্রিয়ায় বাক্যের  গঠন-উপাদানের ভূমিকা; ৩. সরল বাক্যের বিভিন্ন ধরন : বিবৃতি বাক্য (স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি বাক্য), প্রশ্নবাক্য, অনুজ্ঞা বাক্য, আবেগবাক্য নিয়ে আলোচনা; ৪. বাক্যের উপাদান বিন্যাসের ক্রম বা পদক্রম; ৫. বাক্যের উপাদানের লোপ; ৬. বাক্যের কর্তার ভূমিকার রদবদল (বাচ্য) ইত্যাদি।
বাক্যতত্ত্বে বাক্যের গঠন-উপাদান হিসেবে বিশেষ্যবন্ধ, বিশেষণবন্ধ, ক্রিয়াবিশেষণবন্ধ, ক্রিয়াদল ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। বিশে­ষিত হয়েছে ছয় ধরনের বিশেষ্যবন্ধের গঠনপ্রকৃতি।
পঞ্চম পর্বের আলোচ্য বিষয় বাগর্থতত্ত্ব ও ব্যঞ্জনাতত্ত্ব। বাগর্থতত্ত্বে আলোচিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পদপ্রতিবেশে  শব্দের অর্থগত ভিন্নতা। আর ব্যঞ্জনাতত্ত্বে দেখানো হয়েছে তির্যক অর্থ প্রকাশে বাক্যের শব্দ ও পদবন্ধের ব্যবহার।
প্রথম খন্ডে সুপরিকল্পিতভাবে বাংলা ভাষার গঠন-বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগকলার সার্বিক পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এ-ব্যাকরণ অনেক জায়গায় প্রচলিত ব্যাকরণ থেকে অনেকখানি সরে এসেছে এবং তাতে অনেক অনালোকিত দিকে আলোকসম্পাত করা হয়েছে।
প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণের দ্বিতীয় খন্ড চারটি পর্বে বিভক্ত। এ-খন্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলা ভাষার ব্যাকরণের বিভিন্ন আনুষঙ্গিক দিক। প্রথম পর্বের বিষয় : বাংলা ভাষা ও লিপির বিবর্তনের ইতিহাস, বাংলা ব্যাকরণ ও এর পরিভাষা নির্মাণের ইতিহাস। দ্বিতীয় পর্বে আলোচিত হয়েছে বাংলার সঙ্গে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, তিববতি-বর্মি ভাষাগোষ্ঠী এবং সংস্কৃত, আরবি-ফারসি ও ইংরেজি ভাষার সম্পর্কের বিভিন্ন দিক। তৃতীয় পর্বে আলোকপাত করা হয়েছে উপভাষা-ভূগোল, সমাজভাষাবিজ্ঞান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষা সম্পর্কে।
চতুর্থ পর্বের আলোচিত বিষয় : আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপি ও রোমান হরফে বাংলার প্রতিবর্ণীকরণ, আরবি-ফারসি হরফের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ, যতিচিহ্ন, বর্ণক্রম, কাব্যভাষার ব্যাকরণ ও ভাষাপরিকল্পনা।

তিন

প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ  রচনার কাজে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ব্যাকরণবিদ ও বিশেষজ্ঞবৃন্দ। তাঁরা হলেন : পবিত্র সরকার, রফিকুল ইসলাম, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মনিরুজ্জামান, অনিমেষকান্তি পাল, সুভাষ ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, কাজী রফিকুল হক, রাজিয়া সুলতানা, সুনন্দকুমার সেন, বেগম জাহান আরা, কৃষ্ণা ভট্টাচার্য, মহাম্মদ দানীউল হক, অশোক মুখোপাধ্যায়, আবদুস সবুর খান, অমিতাভ মুখোপাধ্যায়, মাহবুবুল হক, মীনা দাঁ, জীনাত ইমতিয়াজ আলী, স্বরোচিষ সরকার, ফিরোজা ইয়াসমিন, গুলশান আরা বেগম, তপতী সরকার, সৌরভ সিকদার, অশোক বিশ্বাস, মো. শরিফুল ইসলাম, শাহরিয়ার রহমান, শিশির ভট্টাচার্য্য, সাখাওয়াৎ আনসারী, এম মনিরুজ্জামান ও রাজীব চক্রবর্তী। তাঁরা আলাদা আলাদাভাবে ব্যাকরণের বিভিন্ন অংশ রচনায় ভূমিকা রেখেছেন। সেগুলিকে পরিমার্জনা করে সামগ্রিকতা দেওয়ার কাজটি করেছেন সম্পাদকমন্ডলী। বিভিন্ন লেখকের শৈলীগত বিভিন্নতা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত স্বাতন্ত্র্যের ক্ষেত্রেও সমতাবিধানে সচেষ্ট ছিলেন তাঁরা। ব্যাকরণের পরিভাষাকে স্বচ্ছতা দেওয়ার জন্যে কিছু নতুন পরিভাষাও এ-গ্রন্থে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যবহারকারীরা সহজে যেন তা বুঝতে পারেন সেজন্যে দ্বিতীয় খন্ডে বাংলা-ইংরেজি ও ইংরেজি-বাংলা পরিভাষা সংকলিত হয়েছে। এ ব্যাকরণে ধ্বনির প্রমিত উচ্চারণ নির্দেশের জন্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপি ব্যবহার করা হয়েছে। পরিশিষ্ট অংশে সংকলিত গ্রন্থপঞ্জি বাংলা ভাষা চর্চায় আগ্রহীদের কাজে যথেষ্ট সহায়ক হবে।
এ-গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন রফিকুল ইসলাম ও পবিত্র সরকার। সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন মাহবুবুল হক, জীনাত ইমতিয়াজ আলী, স্বরোচিষ সরকার ও রাজীব চক্রবর্তী। মাহবুবুল হক ব্যাকরণ প্রণয়নবিষয়ক কোর কমিটির আহবায়কের দায়িত্বও পালন করেছেন। উপদেষ্টা ছিলেন অনিসুজ্জামান ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কর্মসূচি পরিচালক ও প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেছেন আবদুল ওয়াহাব। সম্পাদনা সহযোগী ছিলেন কাজী রুমানা আহমেদ সোমা ও সায়েরা হাবীব।
গোটা বাঙালি জাতির জন্যও এটি গর্ব করার মতো একটি ঐতিহাসিক সাফল্য।