বিদায় সুবীর চৌধুরী…

রফি হক

যখন সুবীর চৌধুরীকে চিনতাম না, তখন থেকেই শিল্পকলা বিষয়ে নানা তর্ক করতাম অন্যদের সঙ্গে। তখন আমরা ছাত্র, আমাদের মনোভাবটা এরকম ছিল, আমরা তরুণ শিল্পী, চিত্রকলা নিয়ে, অগ্রজদের নিয়ে, বাংলাদেশের আর্টের ধারা নিয়ে যা খুশি বলতেই পারি। একটা বয়স থাকে, যখন সম্মানিত ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের অস্বীকার করে একরকমের আনন্দ পাওয়া যায়, তখন আমাদের সেই বয়স। আমরাই তো পারি পরিবর্তন করতে!

তিরানববই সালে সুবীর চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হলো, শিল্পী মনিরুল ইসলামের প্রিন্টমেকিং ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে। মুনির স্যার তখন কুড়ি-বাইশ বছর পর দেশে ফিরেছেন, তিনি তখন কিংবদন্তিতুল্য! শিল্পকলা একাডেমীতে খুব হইচই করে ওয়ার্কশপ করছি, সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা অবধি ওয়ার্কশপের সময়। কিন্তু আমি ওয়ার্কশপের পরও দীর্ঘসময় থাকি সেখানে। ভীষণভাবে কাজে ঝুঁকে আছি, তাই কখনো কখনো রাত বারোটা পেরিয়ে যেত ওয়ার্কশপ শেষে বাসায় ফিরতে! আমি এই সুবিধাটা পেয়েছিলাম সুবীর চৌধুরীর জন্য। কারণ তিনি অত রাত অবধি অফিসে থাকতেন বলেই আমার কাজ করার অমন সুযোগ মিলেছিল। কাজের প্রতি আমার অমন একাগ্রতা দেখে তিনি খুশি হয়ে কাছে টেনেছিলেন। তাঁর প্রতি আমারও শ্রদ্ধা প্রসারিত হলো, তাঁকে সম্বোধন করলাম, ‘সুবীরদা’!

আরো অনেক পরে যখন এশিয়ান দ্বিবার্ষিকীর সহ-সংগঠক হিসেবে শিল্পকলা একাডেমীতে তাঁর সঙ্গে রাত-দিন কাজ করার সুযোগ পেলাম, সুবীর চৌধুরী লোকটিকে নতুন করে জানলাম! এই লোক সকাল আটটায় অফিসে এসে বাড়ি ফেরেন ভোর   চারটা-পাঁচটায়! তিনি যে একা কাজ করেন তা-ই নয়, তাঁর পুরো বাহিনী নিয়ে আঠারো-কুড়ি ঘণ্টা কাজ করে যান তীব্র শীত উপেক্ষা করে! কিন্তু ওই কাজের সময়গুলো কাটে বড়ো মধুর। সাইমনভাই, নাসিম আহমেদ নাদভী, শামীম ও আমি মিলে একটা কর্মোদ্যম তৈরি হয়েছিল তখন। বড়ো মধুর সময় কেটেছে আমাদের।

সুবীরদা দিনরাত চবিবশ ঘণ্টা বাংলাদেশের চিত্রকলা প্রসারের ভাবনায় আকণ্ঠ ডুবে থাকতেন। কিন্তু নীরস মানুষ ছিলেন না। তাঁকে যারা খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা জানেন তিনি কতটা রসবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন।

মাস্টার্সে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবচেয়ে বেশি নম্বর নিয়ে পাশ করলে তিনি কী যে খুশি হয়েছিলেন! মনে হলো আমার  রেজাল্টটি যেন তাঁর! আমাকে কীভাবে সম্মানিত করবেন সে- উৎকণ্ঠায় আমি নিজেই লজ্জা পেয়েছিলাম। আমাকে শিল্পকলা একাডেমীতে প্রদর্শনী করতে বারবার আহবান করেছেন সে-সময়ে। আমার অলসতার কারণে আমি তা পারিনি। বেঙ্গলে এসেও বলেছেন, তুমি প্রদর্শনী করো। আমার আলস্যে উনি বিরক্তি প্রকাশ করতেন। আমি তো মনে করি, তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন আমাদের নবীন শিল্পীরা।

২০০০ সালে জাপানের ফুকুওকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামের আবাসিক শিল্পী হিসেবে মনোনীত হওয়ার পরপর তাঁর উচ্ছ্বাস আমাকে আপ্লুত করেছিল। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ এশিয়ান  দেশগুলো থেকে মোট দুশো ঊনচল্লিশ জনের ভেতর আমাকে নির্বাচিত করেছে, এটা একটা বিশাল খবর, সেটা বারবার আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। খবরটা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম, হায় হায়… আমার তো জাপান যাওয়ার প্লেনভাড়াটাও নেই! আজ বলতে দ্বিধা নেই, সেটাও ব্যবস্থা করেছিলেন সুবীরদা। এটা কেবল আমার বেলায় করেছেন তা নয়, তিনি অসংখ্য শিল্পীর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সে-ঋণ শোধ হওয়ার নয়!

পরবর্তীকালে বেঙ্গল গ্যালারিতে পরিচালক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর শিল্পীদের প্রতি তাঁর প্রসারিত হাত বাড়িয়েছেন দ্বিধাহীনভাবে। শিল্পকলা একাডেমীর সরকারি সীমাবদ্ধতা থেকে  বেরিয়ে এসে বেঙ্গলে পেয়েছিলেন কাজ করার অবাধ বিচরণের  ক্ষেত্র। তিনি তাঁর সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রম দিয়ে সেখানে কাজ করেছেন।

সুবীরদার সঙ্গে অনেক বিষয়ে আমার মতের মিল হওয়ার কথা নয়। শিল্প কিংবা জীবন-ভাবনা নিয়ে দূরে থেকেছি আমি। তিনিও থেকেছেন দূরেই। আমার প্রতি তাঁর একরকমের অধিকারবোধ ছিল যেমন, তেমনি তীব্র অভিমানও ছিল। কিন্তু তিনি কখনো কোনো বিষয়ে আমাকে ফোন করলে আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তাঁর অনুরোধ রাখতে। আবার আমিও কখনো কোনো অনুরোধ তাঁকে করলে তিনি শুনতেন, পরামর্শ দিতেন।

বাংলাদেশের চিত্রকলা প্রসারে তাঁর মতো সংগঠক আর কেউ রইলেন না। পরবর্তীকালের শিল্পীদের জন্য এটি একরকমের ক্ষতি। আমাদের মনে তাঁর হঠাৎ এ-অনুপস্থিতি বড়ো বেদনার মতো বাজবে।

বিদায় সুবীরদা।