জীবনানন্দ দাশ : বিচিত্র চেতনার সময়োত্তর কবি

কামরুল ইসলাম

জীবনানন্দের মহত্ব নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই; বস্ত্তত তাঁকে একজন বিশিষ্ট কবি হিসেবে আবিষ্কার এবং প্রতিষ্ঠাদান বুদ্ধদেবের অন্যতম কীর্তি। জীবনানন্দ খাঁটি কবি ছিলেন; তাঁকে আমি দু-একবার মাত্র দেখেছি; কিন্তু তাঁর রচনা পড়ে আমার মনে হয়েছে যেন তিনি এক নক্ষত্রবিম্বিত জলাশয়, যেখানে গভীর অন্ধকারের স্তরে স্তরে নানা অনুভব ও ভাবনার ওঠাপড়া আছে…

(শিবনারায়ণ রায়, ভারত বিচিত্রা, ২০০৫)

পশ্চিমা মডার্নিস্ট মুভমেন্টের আলোকে ভাবতে গেলে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল তিরিশের দশকে। এই আধুনিকতার সাঁকোটি যারা সযত্নে নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ শুধু কবিতা লেখাকেই জীবনের অন্যতম সংগ্রাম হিসেবে নিয়েছিলেন। ইউরোপীয় কবিতার নির্যাস আর বাংলার শ্যামল মাটির গন্ধ মিশিয়ে তিনি যে কবিতা-সংসারের গোড়াপত্তন করেছিলেন, সেই গেরস্থালির উত্তরাধিকার আজকের আমরা যারা কবিতার নতুন জল-ভূমির সন্ধানে মরিয়া, তাদের সামনে রৌদ্রকরোজ্জ্বল যে-সাঁকোটি নির্ভার রহস্যের ঢেউ তুলে কথা বলতে চায়, তার দিকে আমাদের তাকাতেই হয়। সাঁকোটিতে রং-রস-রূপের মাধুর্যে এই শুদ্ধতম কবির শিল্পীসত্তার অহংকার মিশে আছে নিবিড় মমতায়। এ এক অভিনব সখ্য, ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনানন্দ দাশ, এপারে আমরা কুয়াশা ভেঙে ভেঙে গুচ্ছগ্রাম বানাই কিংবা জলজ অাঁধারে বৃক্ষের কাছে হাত পাতি শব্দের খোঁজে। এই সাঁকোটি কালের নিরালম্ব স্রোতে এক আশ্চর্য বাতিঘর, সেখানে দাঁড়াতেই হয়, এ এক মহাতীর্থ আমাদের।

কবিতার চঞ্চলা হরিণী ধরা দিয়েছিল তাঁর কাছে কোনো এক পৌষ-সন্ধ্যায়, তিনি বুঝেছিলেন ‘সে যেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা হয়।’ অন্ধকারের যোনির ভেতরে তিনি সৃষ্টির অপার সম্ভাবনাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। প্রকৃতির নিবিড় অবলোকনের ক্ষমতা তিনি পেয়েছিলেন তার অন্তর্গত বিষাদ থেকে। অনেক ভেতরে খুঁড়ে খুঁড়ে সংগ্রহ করেছিলেন কবিতার আকর,                 মণি-মুক্তো, কৈবল্যের উড়ন্ত পত্রালি। তাঁর কবিতার অন্তরালে যে গানের দীপাবলি মনকে অন্যভাবে আবিষ্ট করে, সেখানেও আমাদের দাঁড়াতে হয়, ভাবতে হয় এই নির্জনতম কবির প্রজ্বলিত হৃদয়ের অভিজ্ঞান কীভাবে কালিক সত্যকে বহন করে বয়ে যায় কালান্তরে।

এজরা পাউন্ড কবিদের বলেছিলেন ‘জাতির অ্যান্টেনা’। তিনি বিশ শতকের কবিতা-আন্দোলনের প্রধান পুরুষ, যিনি খাঁটি কবিতার পক্ষেই ওকালতি করেছেন সারাটা জীবন। জীবনানন্দ দাশ সেই খাঁটি কবি, যাঁকে আমরা বাংলা আধুনিক কবিতার প্রধান রূপকার বললে তাতে কোনো অত্যুক্তি হবে না। তাঁকে কবিদের কবিও বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের পরে তিনিই সবচেয়ে বড় কবি এবং তিরিশি কবিদের মধ্যে তাঁর কবিতাই বহুলপঠিত ও নন্দিত। বর্তমানে যাঁরা বাংলা কবিতার প্রধান কবি হিসেবে পরিচিত, তাঁদের সবাই জীবনানন্দ দ্বারা প্রাথমিকভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং সে-প্রভাব কাটিয়ে উঠতে অনেককেই অনেক পথ হাঁটতে হয়েছে এবং অনেক বড় কবির কবিতায় আজো বয়ে গেছে জীবনানন্দীয় আবহ কোনো-না-কোনোভাবে। শামসুর রাহমান, শঙ্খ ঘোষ এবং উৎপলকুমার বসু থেকে শুরু করে অন্যরা, পঞ্চাশ-ষাটের সব কবিই বলতে গেলে, জীবনানন্দের জগৎ হয়েই নতুন কবিতার পথ নির্মাণ করেছেন, আবার কেউ কেউ সে-চেষ্টায় আজো অবিরাম পথ কেটে চলেছেন নিরলসভাবে এবং এ-কথা সত্য যে, জীবনানন্দ-মুক্তি আজ কবি হয়ে-ওঠার অন্যতম প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তাঁর কবিতাপাঠ আমাদের অস্তিত্বের অন্তর্তল এমনভাবে স্পর্শ করে যে, তা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের অনিবার্য পাঠ। তিরিশি কবিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র কবি, যাঁকে প্রথম জীবনে অনেক ধকল সহ্য করতে হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন কবিতা লেখার অপরাধে। একমাত্র বুদ্ধদেব বসুই বুঝেছিলেন বাংলা কবিতায় একজন প্রোফেটের আগমন ঘটেছে এবং তিনিই সর্বপ্রথম সবাইকে জানিয়ে দিলেন জীবনানন্দ দাশই ‘খাঁটি আধুনিক’ কবি।

এ-কথা সবারই জানা যে, বুদ্ধদে বসুর আগে তাঁকে নিয়ে বা তাঁর কবিতা নিয়ে কেউ কোনো প্রশংসার বাণী তো দূরের কথা, তাঁর সহকর্মীরা পর্যন্ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। এমনকি সুধীন দত্তের মতো কবিও তাঁর পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা না ছেপে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এসবের কারণ হলো, তিনি ছিলেন দূরবর্তী সময়ের সচেতন কবিব্যক্তিত্ব। তাঁর সময়ের সেই জনপ্রিয় কবি-পুরোহিতদের কেউ কেউ কবেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন, বেঁচে আছেন তিনি আজো সাবলীল অহংকারে কবিতার বরপুত্র হিসেবে।

তিনি চর্যাপদ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এবং বাঙালির হাজার বছরেরও বেশি সময়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-ইতিহাসকে আত্মস্থ করেছিলেন নিমগ্ন সাহসে এবং পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-নন্দনতত্ত্বের নানাবিধ অনুষঙ্গের অন্তর্গত নির্যাসও তিনি পান করেছেন সৃজনতেষ্টায় এবং তার সবটুকু জীবনকে তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন কবিতার পাত্রে, যা আমরা পান করছি  গন্ডূষে গন্ডূষে এবং অনাগতকালের কবিরাও করবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ তিনি ‘সময়োত্তর’ কবি; কবিতা ও জীবনকে তিনি একাকার করে ফেলেছিলেন এবং জীবনকে মন্থন করে কবিতা-অমৃত দিয়ে গেছেন আমাদের। তাঁর অস্থিমজ্জার জারকরসে নির্মিত বিশাল সঞ্চয়ই বাংলা কবিতার কালসঞ্চারী আলো, যার মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে পাই আমাদের চিরায়ত বাঙালিসত্তার বিচিত্র বৈভব।

বিশ্বকবিতার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, তার চেয়ে অনেক নিম্নমানের কবিই ‘নোবেল’ পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর কবিতার যদি ব্যাপক অনুবাদ সম্ভব হতো সে-সময়ে এবং আমরা যদি তা কবিতাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারতাম, তাহলে তিনি হয়তোবা ‘নোবেল’ পুরস্কারেও ভূষিত হতে পারতেন। অবশ্য এই পুরস্কার পাওয়া না-পাওয়া নিয়েও রয়েছে রাজনীতি। পৃথিবীর অনেক বড়মাপের শিল্পীকেই তা দেওয়া হয়নি, আবার জ্যঁ পল সার্ত্র তা প্রত্যাখ্যানও করেছিলেন। যা হোক, তিনি যে একজন বিশ্বমানের কবি, সে-ব্যাপারে আজ আমরা নিঃসন্দেহ হয়েছি। সেদিন ট্রামের তলে বাংলা কবিতার এই প্রোফেটের মৃত্যু থামিয়ে দিয়েছিল কবিতার আধুনিক যাত্রার অপ্রতিরোধ্য গতিকে। মৃত্যুর (২২ অক্টোবর, ১৯৫৪) এত বছর পরেও তিনি আজো এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, তাঁর কবিতা আমাদের সময় ও প্রজন্মকে নতুন করে নাড়া দেয়। তাঁর কবিতা সেই টেক্সট, যা আজকের নতুন নতুন সাহিত্য-থিওরিতে আলোচনা সম্ভব এবং এভাবেই তাঁর কবিতার নতুন নতুন পাঠ তাঁকে আরো নতুনভাবে বৃহত্তর পাঠকের কাছাকাছি নিয়ে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

তাঁর অনেক কবিতাই জটিল ও বিস্ময়কর। ‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে’র অর্থ কী, এ-ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল হলেও আমরা এ-পঙ্ক্তি নির্মাণের কারুকার্যে চমৎকৃত হই। কবিতা বা যে-কোনো লেখনশিল্পই যখন টেক্সট, তখন তাঁর ভেতর বিশেষ কোনো অর্থ খোঁজার প্রচেষ্টা আজ বাতুলতা মাত্র। তিনি তাঁর কবিতাকে টেক্সট করে  তুলতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর কবিকৃতি তাঁর সময়ের অন্য কবিদের মতো ম্রিয়মাণ হয়ে যায়নি, বরং তাঁর কবিতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত-বৈপরীত্য-জটিলতা পাঠককে আরো উৎসুক করে তুলছে ক্রমাগত।

জীবনানন্দের কবিতা ‘communicate’ করে before it is understood, তাঁর অনেক কবিতারই কাব্যরস আস্বাদনের পরও তা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য, রহস্যাবৃত থেকে যায়। ‘A poem should not mean but be’,  যা জীবনানন্দের কবিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সত্য হয়ে দাঁড়ায়। কবিতা যে ‘separate language’ এবং ‘different subjects’ সে-কথা বিবেচনায় রেখে নির্বিঘ্নে বলা যায়, তিনি একজন বড়মাপের কবি, আর সেসব গুণের অভাবেই ‘সকলেই কবি নয়; কেউ কেউ কবি’।

জীবনানন্দ দাশ একটি কবিতার গঠনে যে শ্রম ও সময় দিয়েছেন, তা শঙ্খ ঘোষের কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে :

যদি তাঁর রচনাবলির ভেরিওরাম সংস্করণ ছাপা হয় কখনো, দেখতে পাব যে কোন-কবিতায় কত অসংখ্য তাঁর পাঠান্তরের প্রক্রিয়া। আর তাঁর আপাত-বিহবল কবিতার কথার প্রবন্ধগুলি বিশ্লেষণ করলে ধরা পড়বে, কবিতার শরীর নিয়ে, তাঁর ছন্দ নিয়ে কত সতর্কভাবেই ভাবতে চেয়েছিলেন তিনি দিনের পর দিন।’ (‘ছন্দের বারান্দা’)

শঙ্খ ঘোষ থেকে আমরা আরো জানতে পারি যে, ‘সহজ শব্দে শাদা ভাষায় লিখেছি বটে, কিন্তু তবু কবিতাটি হয়ত অনেকে বুঝবে না; খাতায় এরকম মন্তব্য লিখে রেখেছিলেন জীবনানন্দ, তাঁর ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির বিষয়ে’ (ওই) যা তাঁর অনেক কবিতার ক্ষেত্রেই সত্য; পরিচিত শব্দ আর পরিচিত ভূগোলের মধ্যেই এক দুর্বোধ্য লুকোচুরি খেলা।

এটা ঠিক যে, তাঁর কবিতা তাঁর উন্মেষকালে বাঙালি পাঠকের কাছে খুবই নতুন ও অপরিচিত ছিল। আজ তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তার কালেও তাঁর কিছু  কবিতার অস্থিমজ্জায় এমন অতিবর্তী কল্পনা ও চিন্তার প্রলেপ লেগে আছে, যা আমাদের বিভ্রান্ত করে। ‘কেউ যাহা জানে নাই কোন এক বাণী’ – তিনি  তা-ই বয়ে এনেছেন এবং সে-হিসেবে তিনি কবিতার প্রোফেট (নতুন বার্তাবাহক)। তিনি বলেছেন : ‘মহাবিশ্বলোকের ইশারা থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো; কবিতা লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোন মানেই নেই আমার কাছে। তবে সময়চেতনার নতুন মূল্য আবিষ্কৃত হতে পারে।’

(‘কবিতা প্রসঙ্গ’, কবিতার কথা)।

এই সময়চেতনার অপরিহার্য বোধই কোনো কবিকে কালোত্তীর্ণ করে তোলে। তিনি যে সবার থেকে আলাদা, সে-ব্যাপারে তিনি নিজেই বলেছেন : ‘সকল বোধের মাঝে বসে/ আমার নিজের মুদ্রাদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা।’ পৃথিবীর অনেক প্রতিভাবান শিল্পীই এভাবে নিজের আলাদা সত্তার ঘোষণা নিজেই দিয়েছেন যখন অন্যেরা সেই আলাদা সত্তার খোঁজ পেতে ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকান কবি এড্রিন রিচ যেমন তাঁর একটি কবিতার শেষ লাইনে বলেছেন, ‘… a whole new poetry beginning here …’

টি এস এলিয়েটের একটি কথা স্মর্তব্য, প্রত্যেক প্রধান কবিই তাঁর সৃষ্টিকর্মে এমনকিছু রেখে যান যা থেকে ভবিষ্যৎ কবিতার গোড়াপত্তন হতে পারে; – জীবনানন্দ দাশ সে-মাপেরই বড় কবি এবং আজ আধুনিক-উত্তর কবিতার যে-কথাবার্তা চলছে (পশ্চিমবঙ্গে এ-ব্যাপারে হইচইটা একটু বেশি, যদিও তালগোল পাকানো এবং বাংলাদেশে হাতে-গোনা কিছু তরুণ ও প্রবীণ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ব্যাপারটি সীমিত; কবিদের ধারণাটা ঝাপসা ও অপ্রতুল) সেই আধুনিক-উত্তর অথবা, উত্তরাধুনিক বা অধুনান্তিক যাই-ই বলি না কেন, সময়েরই আবদার কোনো নতুন কবিতার এবং সেই নতুন কবিতার বীজ রয়েছে জীবনানন্দে। সুতরাং আজকের কবিদের জন্য আধুনিক-উত্তর কবিতার গোড়াপত্তনে জীবনানন্দ পাঠ যেমন অপরিহার্য, তেমনি জীবনানন্দ-মুক্তিও আবশ্যক। কারণ, কবি হিসেবে স্বকীয়তা অর্জনের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ একটি বড় রকমের বাধা – এই প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেই পৌঁছতে হবে নতুন কবিতার জগতে।

তাই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যখন বলেন, ‘জীবনানন্দ এখনো বাংলা ভাষার পদকর্তাদের স্বকীয়তার পক্ষে সম্ভবত সবচেয়ে প্রতিকূল শক্তি’, তখন আর বলার কিছুই থাকে না। তিনি বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পরেই প্রধান ও প্রতিনিধিত্বশীল কবি। তিনি যে বড় কবি সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহই থাকে না যখন বুদ্ধদেব বসু বলেন,

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে চলতিকালের কাব্যরচনার ধারাকে তিনি গভীরভাবে স্পর্শ করেছেন, সমকালীন ও পরবর্তী কবিদের উপর তার প্রভাব কোথাও-কোথাও এমন সূক্ষ্মভাবে সফল হয়ে উঠেছে যে বাইরে থেকে হঠাৎ দেখে চেনা যায় না।

(‘কালের পুতুল’)

তাঁর সময়ের কবিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র কবি, যিনি রবীন্দ্রনাথের ভাব ও ভাষা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন – বাংলা কবিতায় একটি আলাদা সুর ও স্বরের সৃষ্টি করেছিলেন। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন :

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নয়, আধুনিক পাঠক তার জীবন খুঁজে পান জীবনানন্দেরই রচনায় – ‘কবিতা’ পত্রিকার শেষ পর্যায়ে প্রত্যক্ষ-তুলনা দিয়ে একথা বলতে শুরু করলেন নিরূপম চট্টোপাধ্যায় বা জ্যোতির্ময় দত্তের মতো সেদিনকার তরুণেরা।

এই বোধ পরবর্তীকালের অনেক আধুনিক কবির মধ্যেই আমরা লক্ষ করেছি। কারণ, সময় বদলায় এবং বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় জীবন, জীবনবোধ এবং জীবনের চাহিদা। আমরা ইতোমধ্যে বলেছি, পরবর্তীকালের কবিদের ওপর তাঁর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা। তিনি এক অফুরন্ত সময়কে কাব্যবৈচিত্র্যের বিধুরভুবনে অন্বিত করেছেন, যেখানে বাঙালির জীবনসত্যের আকাশখানি ঝলসে ওঠে রক্তিম আলোকে। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘বাংলা কাব্যের ঐতিহ্য স্রোতের মধ্যে একটি মায়াবী দ্বীপের মতো’ মনে করেছেন, যা ‘বিচ্ছিন্ন ও উজ্জ্বল’, সেই মায়াবী দ্বীপ আজ          ফলে-ফুলে, গন্ধরস ছড়িয়ে আমাদের কাব্যপ্রেরণাকে যেমন উসকে দেয়, তেমনি আক্রান্তও করে। তাঁর কবিতার রহস্যদ্যুতিতে আমরা চমকিত হই, ভেবে ভেবে অস্থির হই সে-রহস্য উদ্ঘাটনে।

তাঁর অনেক কবিতাই আমাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। এর কারণ, মহৎ কবিরা আমাদের মতো সাধারণ পাঠকদের থেকে যুগ যুগ সামনে এগিয়ে থাকেন। কবিতার obscurity তাই              চিন্তা-চেতনারই একটি ব্যবধান মাত্র। সেই ব্যবধান কমে এলে বা ঘুচে গেলে কবিতাও সহজ হয়ে আসে। তাঁর কবিতার ভিন্ন ভিন্ন পাঠ ও আবিষ্কার আমাদের কাব্যপিপাসু মনকে নানাভাবেই তৃপ্ত করে – আর এ-কারণেই আজকের আধুনিক-উত্তর সময়ের যে-চাহিদা শিল্পের কাছে, কবিতার কাছে, তা জীবনানন্দে খুঁজে পাওয়া যায়। মায়াকোভস্কি বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখার জন্য নতুন কাব্যভাষা সৃষ্টি বাধ্যতামূলক।’ রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কবিতায় আর কোনো নতুন কথা, নতুন ভাষায় ভাব প্রকাশ সম্ভব কিনা এ নিয়ে যখন অনেকেই ভাবিত, ঠিক সে-সময়েই জীবনানন্দের আবির্ভাব। তিনি ঘোষণা করলেন : ‘এতদিন শুনেছ যে সুর -/ ফুরায়েছে – পুরোনো তা – কোনো এক নতুন কিছুর/ আছে প্রয়োজন,/ তাই আমি আসিয়াছি, – আমার মতন/ আর নাই কেউ।’ জীবনকে, জীবনের অসীম সৌন্দর্যকে তিনি প্রকাশ করলেন এক নতুন বাণীর মোড়কে, আলাদা ভঙ্গিতে, ইতিহাসচেতনার আচ্ছাদনে এবং ভাবের বৈচিত্র্যে। সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলছেন :

জাতীয়তা-বিচ্যুত দৃঢ়কণ্ঠ মনস্বী তিনি – সমালোচক তিনি, হুদয়ের কারুশিল্পী তিনি। সহৃদয় ও সদর্থক কাব্যমূল্য তাঁর রচনায় এত অধিক যে সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার প্রবাহ জীবনানন্দের কাব্যকলার উৎস থেকে নির্গত হয়ে ভাষায়, রূপকল্পে এবং সপ্রাণতায় কাব্যদেহ মন্ডিত করছে।

(‘জীবনানন্দ দাশের কবিতা’, দেশ, সুবর্ণজয়ন্তী সংখ্যা)

এ-কথা মানতেই হবে যে, তাঁর কবিতায় রয়েছে দূরসময়ের ইঙ্গিত। তিনি কবিতাকে গ্রহণ করেছিলেন একই সঙ্গে হৃদয়ে ও আবহমান ইতিহাসের চৌকাঠে এবং রক্তাক্ত, শহিদ হয়েছেন কবিতার বেদিতে। তাঁর সঞ্চয় এত বিপুল ও সম্ভাবনাময় যে, কোনো বিশেষ কালের নিরিখে তা বিচার্য নয়, আরো অনেককাল পরে তাঁর কাব্যচেতনার পরিধি ও ভাবলোকের বৈচিত্র্যকে আরো স্বচ্ছভাবে হয়তো নির্ণীত করা সম্ভব হবে। তিনি আর কারো মতো নন, দুর্বিনীত-বিশৃঙ্খল অনৈতিক সময়ের উঠোনেও তাঁর নক্ষত্র-আলো ঠিকরে পড়বে – সেই ভরসা তাঁর কাব্যপ্রত্যয়ের দূরগামী চিহ্নগুলোয় ভেসে ওঠে। ফলে আর সন্দেহ থাকে না যে, তিনি ‘সময়োত্তর’ কবি। সে-হিসেবেই বলতে হয় যে, ‘জীবনানন্দ-মুক্তি’ মানে এই নয় যে, জীবনানন্দকে একালের কাব্যভাবনা থেকে একেবারে ছুড়ে দেওয়া – এটা সম্ভবও নয়। এ-কালের কবিদের জন্যে জীবনানন্দ-মুক্তি মানে জীবনানন্দীয় আবেশ থেকে বেরিয়ে আসা এবং একই সঙ্গে তাঁকে ঐতিহ্য হিসেবে গ্রহণ করে (যা কেবল তাঁর ব্যাপক পাঠের মাধ্যমেই সম্ভব) তাঁরই পথের শেষে নতুন পথের সন্ধান করা এবং সেই পথকে বিস্তৃত করা নতুন আঙ্গিকে, সময়ের রংরক্তকে অধিকারের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু যেমন বলেছেন :

রবীন্দ্রনাথের উপযোগিতা, ব্যবহার্যতা ক্রমশই বিস্তৃত হয়ে, বিচিত্র হয়ে প্রকাশ পাবে বাংলা সাহিত্যে। তারই ভিত্তির উপর বেড়ে উঠতে হবে আগামী কালের বাঙালি কবিকে। বাংলা কবিতার বিবর্তনের পরবর্তী ধাপেরও ইঙ্গিত রয়েছে এইখানে।

বাংলা কবিতার বিবর্তনের পরবর্তী ধাপের যে-ইঙ্গিতের কথা বলেছেন বুদ্ধদেব বসু, সেই বিবর্তনের পরবর্তী ধাপের কবিই জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতার প্রধান কবিপুরুষ যে জীবনানন্দ দাশ, এ-ব্যাপারে আজ আমরা নিঃসন্দেহ। তাই বুদ্ধদেব বসুর সুরে সুর মিলিয়ে বলতেই হয় যে, বাংলা কবিতার বিবর্তনের পরবর্তী ধাপের ইঙ্গিত রয়েছে জীবনানন্দের কবিতায়।

সেই ইঙ্গিতকে অনুধাবন ছাড়া তাঁর মতো বড়মাপের কবি হওয়া সম্ভব নয়, যার কবিতা বহন করবে পরবর্তী কালের কবিতার বীজ। কবিতার কথা গ্রন্থে জীবনানন্দ দাশ তাঁর এক লেখায় বলেছেন :

আধুনিকদের অনুভূতি ও বোধ রবীন্দ্রনাথের স্তরে নেই, সরে গেছে, বিশেষ হয়েছে। আধুনিকদের কাল কেটে গেলে আরেক রকম স্বতন্ত্রতায় দাঁড়াবে কবিতা …। সে কবিতাকে গ্রহণ করবার জন্যে অনুভূতি ও আলোচনা ঠিক আজকের ভাবনা বিচারের কোণ থেকে কাজ করতে পারবে না।

কবিতা আলোচনার সেই নতুন অনুভূতির অভাব সর্বত্রই পরিলক্ষিত আজ। ফলে সাম্প্রতিক সময়ের কবিতাচর্চা নিয়ে এক নৈরাজ্যিক অবস্থার সূচনা হয়েছে সংগত কারণেই। ইতোমধ্যে জীবনানন্দ-উত্তর বাংলা কবিতায় অনেক বড়মাপের কবির জন্ম হয়েছে এবং তাঁরা বাংলা কবিতাকে আরো বিস্তৃত ও বিকশিতও করেছেন, অনেকেই জীবনানন্দের ভাষা ও আঙ্গিক থেকে পৃথক কাব্যভাষায় কবিতা লিখেছেন ও লিখছেন, কিন্তু এ-কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, তাঁর মতো দূরসময়ের কবি, প্রধানতম কবি যিনি সবকিছুকে পেছনে ফেলে সবকিছু আলোকিত করে জ্বলে উঠবেন মাথার উপরে – এরকম কালোত্তীর্ণ মহত্তম কবি এখনো আমরা পাইনি। অজস্র পদ্যলেখক ও ভাঁড়ের ভিড়ে যখন প্রকৃত কবি ও কবিতা দূরে সরে যাচ্ছে, তখন আরেকটি নক্ষত্রের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার অবাধ বাসনা আমাদের অধীর করে তোলে। আমরা অপেক্ষায় আছি, একদিন তিনি আসবেন – নতুন কবিতার গন্ধ চোখে মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করবেন : ‘আমার পায়ের শব্দ শোন,/ নতুন এ, – আর সব হারানো পুরোনো’ অথবা অন্য কোনো ঐন্দ্রজালিক স্বরক্ষেপণে তিনি পৌঁছে যাবেন অলক্ষেই আমাদের মাঝে।

জীবনানন্দ দাশের ‘হায় চিল’ এবং ইয়েটসের ‘He Reproves The Curlew’-এর তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে জীবনানন্দ গ্রন্থে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বলছেন :

আসল কথা, কোনো কবিই উত্তরাধিকারের দায় থেকে মুক্ত নন। তিনি কীভাবে ওই দায়ভাগ থেকে নতুন দায়িত্ববোধ তৈরি করে নেবেন, সেটাই  হলো বিবেচ্য। এদিক থেকেই আমাদের আলোচনার পরবর্তী অংশটি সূচিত হতে পারে। আমাদের প্রভাবসন্ধানী মনের সহজাত প্রলোভন নিশ্চয়ই পূর্বগামীর কোনো পদ উত্তরসাধকের কোনো পদ্যে কীভাবে অনুসৃত হলো, সেদিকেই নিবদ্ধ। কিন্তু তুলনামূলক সাহিত্যের কোনো অপ্রতিভ শিক্ষার্থীও আজ এভাবে কোনো উত্তীর্ণ কবিতার উৎকর্ষ-অপকর্ষ বিচার করতে যাবেন না। তিনি দেখতে চাইবেন, মোটিভসংক্রান্ত প্রভাবসত্ত্বেও পরবর্তী কবি কোন শিল্পভাবনার টানে মৌল অনুষঙ্গকে দুমড়ে-মুচড়ে ব্যবহার করেছেন। (পৃ ৪৫)

এই বোধ থেকে ভাবতে পারলে প্রভাবসংক্রান্ত সংস্কারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে আলোকিত ময়দানে এসে দাঁড়ানো সম্ভব এবং কবি ও কবিতার আলোচনা-সমালোচনার পথও অনেকখানি প্রশস্ত হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ দাশের প্রভাব কাঁধে নিয়েও নতুন কবিতা লেখা সম্ভব, কারণ মৌলিক প্রতিভার কাছে প্রভাব মূলত শিল্প-আকর ছাড়া আর কিছু নয়।

জগতের অন্যসব আলোড়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ শুধু কবিতাকেই জীবনের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর কথায় বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে :

… এই রকম আক্রমণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যে ছিলেন জীবনানন্দ, তাতে আমার যেমন উত্তেজনা হতো নিজের বিষয়ে মন্তব্য পড়েও তেমন হতো না; যেহেতু তার কবিতা আমি অত্যন্ত ভালোবেসেছিলুম, আর যেহেতু তিনি নিজে ছিলেন সব অর্থে সুদূর, কবিতা ছাড়া সব ক্ষেত্রে নিঃশব্দ, তাই আমার মনে হতো তার বিষয়ে বিরুদ্ধতার প্রতিরোধ করা বিশেষভাবে আমার কর্তব্য।

(‘জীবনানন্দ দাশ’, কবিতা, পৌষ ১৩৬১)

কেবলই কবি হতে চাওয়া এক নির্মম প্রার্থনা; এই প্রার্থনার কোনো ভূগোল নেই, মানচিত্র নেই, নেই কোনো সবুজ বনভূমি – এ এক নিঃসঙ্গ যাত্রা সম্ভাবনার সাত সমুদ্রপাড়ে। আর মৌলিক কবি হতে হলে এই সিঃসঙ্গ যাত্রার যাত্রী হওয়ার আর কোনো বিকল্প নেই।

ওই সাঁকোটি এখন এক ঐন্দ্রজালিক আলোর ভেতরে দোল খায়। ওই সাঁকোটি এখন মহাকালের শিল্প-মৌতাত, আমাদের আনন্দ-বেদনা-বিম্বিত আরশি, ওখানের গভীর অাঁধারে আমাদের মন খুঁজে পায় দুদন্ড আশ্রয়। তার পাশে আরো অনেক অনেক নতুন সাঁকোর গোড়াপত্তন হলেও নতুন নতুন কবিতা-অভিযাত্রিকের আগমন-প্রস্থানে আমরা আলোড়িত হলেও কেন যেন সেখানে ফিরে ফিরে যাওয়া, সেই ঐন্দ্রজালিক আলোর ভেতরে। জীবনানন্দ দাশ সত্যিই এক নক্ষত্রবিম্বিত জলাশয়, নিবিড় শিল্প-প্রত্যয়ে তাকে না দেখলে তাঁর কবিতার গহিনের রূপ-সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব নয়, তার অনুভবের বিচিত্র জগৎ অধরাই থেকে যাবে পাঠকের কাছে।

নির্জনতার মধ্যে অবগাহন করে তিনি খুঁজতেন কবিতার নিবিড় নীরব পথ। জীবনের অপরাপর বিষয়-আশয় তার কাছে তুচ্ছ বলে মনে হতো। কবিতা ছাড়া সবকিছু থেকে একটু দূরে থাকতেই ভালোবাসতেন তিনি। বুদ্ধদেব বসু বলছেন :

… এই দূরত্ব তিনি শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। তিন বা চার বছর আগে সন্ধেবেলা লেকের দিকে তাঁকে বেড়াতে দেখতাম, আমি হয়তো পিছনে চলেছি, এগিয়ে গিয়ে কথা বললে তিনি খুশিও হতেন, অপ্রস্ত্ততও হতেন, আলাপ জোমতো না, তাই আবার দেখতে পেলে আমি ইচ্ছে করে পেছিয়েও পড়েছি কখনো কখনো, তাঁর নির্জনতা ব্যাহত করিনি।

(কালের পুতুল)

মানুষের অগাধ সান্নিধ্যেও তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন আর সে কেবল ওই কবিতার কারণেই। আবার এ-কথাও সত্য যে, ‘যেখানে সভ্যতা বা সংস্কৃতি নেই, সেখানে শুধু প্রকৃতি বা নির্জনতা নিয়ে তিনি থাকতে পারেন নি।’

(বাণী রায় : নিঃসঙ্গ বিহঙ্গ)

তিনি উচ্চাঙ্গেই বলার সাহস রাখেন :

উৎসবের কথা আমি কহিনাকো,

পড়িনাকো ব্যর্থতার গান;

শুনি শুধু সৃষ্টির আহবান, –

তাই আসি,

নানা কাজে তার,

আমরা মিটায়ে যায়, –

এই সচ্ছলতা

আমাদের; –

(কয়েকটি লাইন)

জীবনানন্দ দাশ কেবলই কবি হতে চেয়েছিলেন, এক নক্ষত্রবিম্বিত জলাশয় হতে চেয়েছিলেন, আর কিছু নয়; এই সত্যটা বুঝে উঠতে পারলে কোনো কবিতা-যাত্রিকের কাছে কবিতা-দেবীর সাক্ষাৎ পাওয়াটা সহজতর হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার কবি হওয়ার সহজ কোনো পথ নেই, কবিতার শরীরে তাই দেখা যায় কবির কতশত রক্ত-মাংসের ঝাঁঝালো দুপুর, মৃত্যুর গোধূলিলগ্ন মৌন অন্ধকার আর রাশি রাশি ফেনায়িত আহত সত্তার সংগ্রাম। কবি-হতে-চাওয়া কোনো কিশোর-বালকের জন্য এ-কথা সুখের নয় যদিও, এই সত্য মেনে নিতে হবে; মনে রাখতে হবে কবিতা-দেবী খুব অল্পতে  সুপ্রসন্ন হন না। তাই কবিতার সংগ্রাম আর জীবনের সংগ্রামকে আলাদা করে দেখার কোনো উপায় নেই আজ আর। এই সংগ্রামে জয়ী হতে হলে নির্মম প্রার্থনায় নত হতে হবে, স্পর্শ করতে হবে কবিতার সর্বগ্রাসী সত্যকে।

 

দুই

প্রকৃতির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তিনি কবি, তাঁর বিচিত্রমুখী কাব্যপ্রত্যয় প্রকৃতির আশ্রয়েই লালিত-পালিত, বিকশিত। একটি বিশেষ সময়ে তিনি প্রকৃতি ছেড়ে সমাজচেতনা তথা গণচেতনার দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন, যা ছিল তাঁর কবিস্বভাবের বিরুদ্ধযাত্রা। তবু তিনি সেই যাত্রা করেছিলেন, তিনি হয়তোবা প্রলুব্ধ হয়েছিলেন – সময়টা ছিল সে-ধরনেরই – গণগন্ধময়। মূলত বাংলাদেশেরই প্রকৃতিচিত্র জীবনানন্দে দেখা যায়। যদিও দীর্ঘ সময়ই তিনি কলকাতায় কাটিয়েছেন নগরজীবনের জনকোলাহলে, তাঁর কবিতায় সেসব বিষয়-আশয় মাড়িয়ে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত জন্মভূমি বরিশাল তথা বাংলাদেশের জল-নদী-মাঠ-পাখি-পথ-ঘাট-নিসর্গ-প্রকৃতি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। ‘বাংলার মুখ’ তিনি দেখেছেন, তাই তিনি পৃথিবীর রূপ আর খুঁজতে যান না। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ বলেছিলেন, তাঁর এই নির্জন জীবনবিন্যাস গাড়ীকৃত হয়েছে প্রকৃতির সান্নিধ্যেই। প্রকৃতি, এটা ঠিক যে ‘চিত্ররূপময়’, কিন্তু তারও অধিক কথা তাঁর প্রকৃতিবিষয়ক কবিতার ভেতরে থেকে যায়, যা    নানাভাবেই বিশ্লেষণের যোগ্য। সাদামাটা কথায় নিছক যদি প্রকৃতি বর্ণনার কথা বলা হয়, তাহলে তা আমাদের এই চারপাশের পরিচিত জনপ্রান্তর হিজল-তমাল-শালিখ-নদী-খাল-বিল-কাক ও কোকিল এবং এর মধ্যেই নিহিত তাঁর বাংলাদেশ প্রীতির পরিচয়।

তাঁর ‘পিরামিড’ কবিতায় ‘ধূম্র মৌনসাঁঝে’ পড়লে প্রতিমুহূর্তে আমাদের গ্রামবাংলার একটি সজীব চিত্র উঠে আসে, যা আমাদের অতিচেনা প্রতিবেশ। ‘মাটির বাটের চুমা শিহরি উঠিল মোর           ঠোঁটে- রোমপুটে!/ ধু ধু মাঠ-ধানক্ষেত-কাশফুল-বুনোহাস-বালুকার চর (‘সেদিন এ ধরণীর’)। এসব চিত্র, এসব প্রপঞ্চ কবির হৃদয় থেকে উৎসারিত মাটির প্রতি ভালোবাসার অভিজ্ঞান। এই মমতাময়ী প্রেম বাংলা কবিতায় তাঁর আগে এমনভাবে আমরা দেখিনি – এখানে মাটির বাটের চুমো সম্পূর্ণ নতুন ডিকশন যা সে-সময়ে অন্য কেউই এমনভাবে ভাবতে পারিনি। ‘নির্জন খড়ের মাঠে পউস সন্ধ্যায়’, ‘অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল’, ‘শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র আকাশ’ কোনটি নয় বাংলার রূপ – বাংলাদেশ যেন জেগে ওঠে তাঁর চিত্রকল্পে নতুন সাজে। এসব কবিতায় তাঁর চিত্রকল্প নির্মাণের অভিনবত্ব আমাদের মুগ্ধ করে এবং এই নির্মাণকৌশল রবীন্দ্রনির্মিতি থেকে যে সম্পূর্ণই আলাদা, সে-কথা বলাই বাহুল্য।

‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে’ (‘অবসরের গান’) ‘পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা-কড় কড়!/ শসাফুল – দু-একটা নষ্ট শাদা শসা/ মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা/ …ইঁদুর পেঁচারা/ ঘুরে যায় মাঠে মাঠে,… ’ (‘পঁচিশ বছর পরে’) এসব দৃশ্য আমাদের অত্যন্ত চেনা ও জানা এবং একেবারেই দেশজ। মাটি অন্বিষ্টতা কতখানি প্রগাঢ় হলে এসব ছবি অাঁকা যায় তা অনুমেয়। উত্তরাধুনিকরা বলছেন – মানুষ ছাড়া তারা এখন কবিতায় দেখতে চাচ্ছে কীটপতঙ্গ ও অন্যসব মাইনর জিনিস। সেক্ষেত্রে এখানে জীবনানন্দকে আদর্শ উত্তরাধুনিক কবিই বলতে হবে বইকি! এ ছাড়া পাখি, শকুন, বিড়াল ইত্যাদি নামে তাঁর যেমন কবিতা রয়েছে, তেমনি তাঁর অনেক কবিতায়ই পশুপাখির নানাবিধ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ‘অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে/ চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে/ ভোরের দোয়েলপাখি -’ (‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’) এসব চিত্রকল্পে বাংলার চিরন্তন প্রকৃতি-দৃশ্যই ভেসে ওঠে স্বাভাবিক প্রত্যয়ে এবং ‘কৃষ্ণ দ্বাদশীর জ্যোৎস্না এখন মরিয়া গিয়াছে নদীর চড়ায়’ – প্রকৃতির এই কাব্যায়ন আমাদের নিয়ে যায় জীবনের অন্য কোনো মোড়ে – এই বিমুগ্ধ বৃত্তায়নই জীবনানন্দের কাব্যশক্তির ভিন্নতর দিক।

গ্রামবাংলার যেসব দৃশ্য প্রতিদিনই আমাদের চোখে ভাসে – সেই চিরচেনা দৃশ্য – সেই অন্তর্ভেদী জীবনঘনিষ্ঠ পথঘাট, বিজন প্রান্তর এবং শাশ্বত গ্রামীণ নিসর্গের বিস্তার দেখা যায় তাঁর ‘আকাশে সাতটি তারা’ কবিতায়। আকাশে সাতটি তারা জ্বলে উঠলে তিনি দেখতে পান ‘বাংলার নীল সন্ধ্যা -/ কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে’ এছাড়া … ‘নরম ধানের গন্ধ-কলমির ঘ্রাণ,/ হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল,/ চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল-ধোয়া ভিজে হাত – শীত হাতখান/ লাল লাল বটের ফলের/ ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা – এরি মাঝে বাংলার প্রাণ :’ বাংলার শ্যামল নিসর্গ এবং এসব চিত্র ও চিত্রকল্পে লেপ্টে আছে কবির মমতাময়ী দেশচেতনার নিগূঢ়তা। যে-কবি ‘চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ’ পান আর ‘লাল লাল বটের ফলের ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা’ অবলোকন করেন, সে-কবিকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছাড়া আর কী ভাবা যেতে পারে! তাঁর কবিতায় ইন্দ্রিয়পরায়ণতার (sensuousness) ব্যাপ্তি যে কীটসকেও ছাড়িয়ে যায় কখনো কখনো, সে-কথা বলাই বাহুল্য। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘আপাদমস্তক রোমান্টিক’ বলেছিলেন। তাঁর রোমান্টিক-ইম্প্রেশনিস্টিক ভাববলয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকৃতির বহুমাত্রিক উপাত্তসমূহে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপতিত, যা কালিক প্রেক্ষাপটে এক চিরন্তন বৈচিত্র্যে সংস্থিতি পেয়েছে। যে-কারণে তাঁর প্রকৃতির  কবিতা আমাদের অভিনব জাগৃতির আস্বাদ দেয় প্রতিটি পাঠে।                 ‘… এইখানে আম লিচু কাঁঠালের বন,/ ধনপতি, শ্রীমন্তের, বেহুলা, লহনার ছুঁয়েছে চরণ;/ মেঠোপথে মিশে আছে কাক ও কোকিলের শরীরের ধূল,’ (‘এখানে আকাশ নীল’)। তাঁর কবিতায় যেমন বাংলার অতিপরিচিত ফলের বাগান মূর্ত হয়ে ওঠে, তেমনি লোককথার, উপকথার বেহুলা, লহনারও উল্লেখ পাওয়া যায় – এবং ফিরে ফিরে আসে কাক, কোকিল ও বাংলার অন্যান্য চিরচেনা পাখির কথা।

মৃত্যুর পরে তিনি বাংলার বুকে শুয়ে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ‘…একদিন মৃত্যু এসে যদি দূর নক্ষত্রের তলে/ অচেনা ঘাসের বুকে আমারে ঘুমায়ে যেতে বলে,/ তবুও সেই ঘাস এই বাংলার অবিরল ঘাসের মতন/ মউরীর মৃদু গন্ধে ভরে রবে,’ (‘দূর পৃথিবীর গন্ধে’) বাংলার কোনপথে তিনি হাঁটেননি, সব পথ সব নদী সব প্রান্তরেরই তিনি প্রাজ্ঞ পথিক। ‘গোরুর গাড়িটি যায় মেঠোপথ বেয়ে ধীরে ধীরে;/ আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে; (‘সন্ধ্যা হয় – চারিদিকে শান্ত নীরবতা’) ‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;/ পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;’ – এখানে  আপাত রোমান্টিকতার আড়ালে তিনি তাঁর প্রকৃতিপ্রেমকে ব্যাপকতা দিয়ে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত খাড়া করেছেন। এমনকি তাঁর ‘অন্ধকার’ কবিতায় যেখানে মৃত্যুচেতনা প্রগাঢ় রূপ পেয়েছে, সেখানেও ‘ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে’ শুয়ে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।

‘কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলো (ঘাস) যেমন তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না, তেমনি ‘কাঁচা বাতাবীর মতো সবুজ ঘাস’, ‘ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো’ তাঁর পান করতে ইচ্ছে করে। ঘাসের প্রতি কবির এই অসীম দুর্বলতা জীবনের প্রতি ভালোবাসারই এক অঙ্গীকার। এখানে ঘাসের ‘মটিফে’ ভেসে ওঠে হারানো কৈশোরিক সময়ের মধুর স্মৃতিগুঞ্জন কিংবা জীবনের আরেক সৌন্দর্য যা অনাবিষ্কৃত, স্বপ্নের ডিঙিতে ভেসে বেড়ায় অধরা হয়ে। পরিশেষে এই কবিতায় (ঘাস) আমরা দেখি ‘ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্ম’ নেওয়ার এক নিবিড় প্রত্যয় তিনি ব্যক্ত করেন ‘কোন এক নিবিড় ঘাস-মাতার শরীরের অন্ধকার থেকে নেমে’ (ওই)। এই কবিতায় তার জীবনমুখীনতার, দেশমাতার কোলের চিরস্থায়ী আসন পাওয়ার আকুলতা লক্ষ করা যায়। প্রকৃতিকে তিনি বিশ্বস্ত আশ্রয় হিসেবে মনে করেছেন সব সময় এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যেই সমীকৃত হয়েছে তাঁর গূঢ় জীবনচেতনার মৌলিক দিকগুলো – সেদিক থেকে বলা যায় যে, তিনি যতটা প্রকৃতির কবি তার চেয়ে বেশি প্রকৃতি-আশ্রয়ী জীবনের কবি।

‘আকাশের রঙ ঘাস ফড়িং-এর দেহের রঙের মতো কোমল নীল’ ‘চারিদিকের পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ’ (শিকার) খুব সরল ও সোজা কথায় হলেও এরকম উপমা বাংলা কবিতায় আমরা তার আগে দেখিনি কিংবা ‘মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন’ উটের গ্রীবার মতো কোনো নিস্তব্ধতা এসে’, ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ – এসব উপমা চিত্রকল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাঁরই কথা যে, ‘উপমাই কবিতা নয়, উপমাতেই কবিত্ব’। তার এসব উপমা এবং আরো অনেক অনেক ডিকশন এতটাই নতুন ও অপূর্ব যে, কয়েক দশকেও তার আবেদন শেষ হয়নি এবং বলতে গেলে সাম্প্রতিক সময়েও তিনি আমাদের প্রধান প্রতিবন্ধক নতুন করে কোনো কিছু বলার, আর  সে-ক্ষেত্রেই তাঁর মৌলিক কবিপ্রতিভার পরিচয় ফুটে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাকে ‘চিত্ররূপময়’ বলেছিলেন। তাঁর কোনো কোনো কবিতার চিত্রকল্প এমনই বিস্তৃত ও নিটোল, এমনই স্পষ্ট ও অন্তর্ভেদী যে তাঁর এসব ছবি আমাদের শুধু অভিভূতই করে না, এক দূরবর্তী রহস্যযাত্রায়ও আমন্ত্রণ করে। গোরুর গাড়িটি কার খড়ের সুসমাচার বুকে/ লাল বটফলে থ্যাতা মেঠোপথে জারুল ছায়ার নিচে সুমুখে/ কতক্ষণ থেমে আছে; – চেয়ে দেখো নদীতে পড়েছে তার ছায়া;/ নিঃশব্দ মেঘের পাশে সমস্ত বিকেল ধরে সে-ও যেন মেঘ এক, আহা/ শান্ত জলে জুড়োচ্ছে; …।

আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মৃত্যুচিন্তা। এই মৃত্যুচিন্তা জীবনানন্দে এতটাই প্রগাঢ় যে, আর কোনো তিরিশি কবির ক্ষেত্রে তা এভাবে দেখা যায় না। তাঁর এই মৃত্যুচিন্তার অন্যতম কারণ বোধহয় তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানাবিধ হতাশা-কষ্ট-বেদনা এবং সর্বোপরি অমানবিক দুনিয়ার বিষবাষ্পের ক্ষত  ‘জীবন-জ্বর প্রসূত পরিণতি পলায়ন ও মৃত্যুচেতনা।’ তাঁর এই মৃত্যুচেতনা জীবনচেতনারই একটি অংশ বলা যায়। অন্ধকারের প্রতি ছিল তাঁর দুর্মর আকর্ষণ। তিনি চেয়েছিলেন, ‘জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ।’ অথবা ‘সব ভালোবাসা যার বোঝা হলো – দেখুক সে-মৃত্যু ভালোবেসে’ (‘জীবন, ধূ, পা’)। এই মৃত্যুচিন্তার সঙ্গে জড়িত তাঁর জীবনবাদী চেতনাও শেষমেশ স্থিতধী হয় পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনায়।

পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনা ভারতীয় হিন্দু ধর্মমিথের একটি অংশ। মৃত্যুর পর মানুষের পুনরাগমন – যে-কোনো পশুপাখির বেশে এবং ভাবা হয় পার্থিব জীবনের পাপ-পুণ্যের ওপর এই পশুপাখির ধরনটা নির্ভর করে। জীবনানন্দ দাশ সর্বান্তঃকরণে পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন – বাংলার  মাটি-জল, নিসর্গের অনুপম সৌন্দর্য, স্নিগ্ধ কাশবন হিজলের ছায়া এবং কাক কোকিলসহ বাংলার সবকিছুর মায়ায় তিনি এতটাই আপ্লুত ছিলেন যে, তিনি তাঁর অনেক কবিতায়ই মৃত্যুর পরে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে – এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে,/ … হয়তো বা হাঁস হবো – কিশোরীর – ঘুঙুর রহিবে লাল পায়/ সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে/ … আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।’

প্রকৃতির সাম্রাজ্য হয়ে প্রেম ও জীবনের বোঝাবোঝি শেষে তিনি ইতিহাস-চেতনায় অন্বিষ্ট হয়েছেন; অতীত ইতিহাসের দরজায় বারবার টোকা দিয়েছেন বোধের সংকীর্ণ চৌহদ্দি থেকে  বিস্তৃত পরিসরে – যে-কারণে আমরা তাঁর কবিতায় দেখি গ্রিস-মিশর, বিম্বিসার-অশোকের কিংবা কনফুসিয়াস বা বুদ্ধের কথা। ইতিহাসচেতনা বা কালচেতনা তাঁর কবিতার ঐশ্বর্যে একটি বিশেষ সংযোজন। তাঁর শেষের দিকের কবিতাগুলোয় যন্ত্রসভ্যতার নানাবিধ অনুষঙ্গের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কিমাকার ডাইনামো, হাইড্র্যান্ট, ট্রামের লাইন, মাইক্রোফোনসহ আধুনিক সভ্যতার অনেক প্রপঞ্চের সার্থক প্রয়োগ তাঁর কবিতায় রয়েছে।

তাঁর শেষের দিকের কবিতায় সমাজমনস্কতা কাজ করেছিল এবং আমরা জানি, সে-ব্যাপারে বুদ্ধদেব বসুর বেশ আপত্তিও ছিল। যাহোক, জীবনানন্দ যে কেবল প্রকৃতির কবি কিংবা নির্জনতার কবি, এ-অপবাদ তিনি ঘুচিয়েছিলেন। ‘বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেজ।’ অথবা ‘হাত নেই – কোথাও মানুষ নেই; বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন আলপনার, পটের ছবির মতো সুহাস্যা, পটলচেরা চোখের মানুষী হতে চেয়েছিল প্রায়; নিভে গেছে সব’ (‘১৯৪৬-৪৭’)। যুদ্ধোত্তর এসব কবিতায় কবির হতাশাচিত্রই ফুটে ওঠে। আগেকার ‘বনলতাসেন’ বা ‘রূপসী বাংলার’ কবি হয়ে ওঠেন নস্টালজিক ও বেদনাবিধুর। ‘এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে;/ নতুন চালের রসে রৌদ্রে কতো কাক/ … ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হতো/ ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে মাঝি বাগদীর ঈশ্বরী মেয়ের সাথে বিবাহের কিছু আগে … (ওই), অতঃপর তিনি বলেন, ‘সে-সব সন্তান এ-যুগের কুরাষ্টের মূঢ় ক্লান্ত লোকসমাজের ভিড়ে চাপা পড়ে মৃতপ্রায়;’   ‘মন্বন্তর দাঙ্গা’, ‘অন্ধ শতছিন্ন গ্রাম্য প্রাণীদের’ ইত্যাদির মধ্যে গণচেতনার যে স্ফুলিঙ্গের সন্ধান মেলে তা তাঁর কাব্যচেতনার পরিপূরক অধ্যায় মাত্র, মৌলিক কাব্যযোজনা নয়। ‘এ-যুগে কোথাও কোনো আলো – কোনো ক্লান্তিময় আলো/ চোখের সমুখে নেই যাত্রিকের’। তাঁর সমাজমনস্ক হওয়ার পেছনে যা কাজ করেছে তা হলো, তাঁকে বারবার নির্জনতম কিংবা প্রকৃতির কবি বলা অথবা এরকম বলা যে, সমাজ-মানুষ বা মানুষের দুঃখ-বেদনা তাঁকে স্পর্শ করে না – ইত্যাদি ইত্যাদি নানা আলোচনা ও সমালোচনা এমনকি নিন্দাও। বুদ্ধদেব বসু তাকে শুধু নির্জনতম কবিই বলেননি, তাকে আপাদমস্তক রোমান্টিকও বলেছিলেন, কিন্তু তিনি যখন নির্জনবাস ছেড়ে মুখ ফেরালেন গণমানুষের দিকে – অনেকখানি গহীন অরণ্য থেকে রোদ-ঝলসিত খোলা ময়দানে মানুষের ভিড়ে, তখন তাঁর এই ফেরাও বুদ্ধদেব বসু পছন্দ করেননি। কারণ, তিনি মনেপ্রাণেই চেয়েছিলেন তিনি খাঁটি কবিতা লিখুন। আর অনেকে যারা বাহির পৃথিবীতে টানছিলেন তাঁকে নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে, তারা সে-সময়ে এই বিরল প্রতিভাকে না চিনতে পারলেও পরবর্তীকালে তারা তাদের মতামত শুধরে নিয়েছিলেন। আমরা শনিবারের চিঠির কথা যেমন জানি, তেমনি জানি পরিচয়ও তাঁকে সেরকম মূল্যায়ন করেনি। তাঁর কবিজীবনে যত বিরূপ সমালোচনা কটু-কাটব্য তাকে শুনতে হয়েছে, তা বোধহয় আর কোনো বাঙালি কবির ভাগ্যে জোটেনি। আর এসব তিনি সহ্য করেছেন নিঃশব্দে, নীরবে করে গেছেন কাব্যচর্চা কারণ তাঁর ‘সত্তা ছিল সর্বাঙ্গীণ কবিত্বে আচ্ছন্ন’ (অরুণ মিত্র)।

‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’ আজকের এই পৃথিবীতে যে-অনাচার এবং যারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিচালনার মাধ্যমে গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মালিক হয়ে উঠেছে, তাদের হৃদয়হীন কর্মকান্ড এবং আগ্রাসনবাদী মানসিকতা আমাদের সে-কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। পাশাপাশি ‘যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।’ এভাবে তাঁর কবিতা লেখার একটি বিশেষ সময়ে তিনি সমাজচেতনার বিষয়-আশয় কবিতায় আনলেন। তিনি নিজে বলেছেন, ‘হতে পারে কবিতা জীবনের নানা রকম সমস্যার উদ্ঘাটন, উদ্ঘাটন দার্শনিকের মতো নয়; যা উদ্ঘাটিত হলো তা যে-কোনো জঠরের থেকে হোক আসবে সৌন্দর্যের রূপে, আমার কল্পনাকে তৃপ্তি দেবে; যদি তা না দেয় তাহলে উদ্ঘাটিত সিদ্ধান্ত হয়তো পুরনো চিন্তার নতুন আবৃত্তি … কিন্তু তবু তা কবিতা হল না, হলো কেবলমাত্র মনোবীজরাশি। কিন্তু সেই উদ্ঘাটন – পুরনোর ভিতরে সেই নতুন কিংবা সেই সজীব নতুন যদি আমার কল্পনাকে তৃপ্ত করতে পারে, আমার সৌন্দর্যবোধকে আনন্দ দিতে পারে, তাহলে তার কবিতাগত মূল্য পাওয়া গেল।’ (কবিতার কথা)।

কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন – সবক্ষেত্রেই যে সফল হয়েছেন এ-কথা বলা যাবে না। তাঁর সমাজভাবনাবিষয়ক কবিতায় কোথাও কোথাও তিনি দার্শনিকতাও করেছেন এবং তাঁর স্বভাববিরোধী কাব্য রচনায়ও ব্রতী হয়েছেন, এটিও ছিল তাঁর একধরনের এক্সপেরিমেন্টই। হ্যাঁ, তিনি প্রশ্নবিদ্ধ হতেই পারেন। তবে সিনিকের দৃষ্টিতে যারা তাঁকে মূল্যায়ন করতে যাবেন তারা জীবনানন্দের সৃজনকেন্দ্রের সন্ধান কখনো পাবেন না। কারণ, অসফলতার চেয়ে তাঁর সফলতার পাল্লাই অনেক ভারি। আলোক সরকারদের মতো সমালোচকদের সমালোচনা সেক্ষেত্রে হাস্যকরই বটে।

‘আমি বলতে চাই না যে কবিতা সমাজ বা জাতি বা মানুষের সমস্যাখচিত – অভিব্যক্ত সৌন্দর্য হবে না। তা হতে বাধা নেই। … সে সমস্ত চিন্তা, ধারণা, মতবাদ, মীমাংসা কবির মনে প্রাক্কলিত হয়ে কবিতার কঙ্কালকে যদি দেহ দিতে যায় কিংবা সেই দেহকে দিতে যায় আভা তাহলে কবিতা সৃষ্টি হয় না – পদ্য লিখিত হয় মাত্র।’ (কবিতার কথা)। বাংলা কবিতার চল্লিশের দশকে এ-ধরনের পদ্য লিখিত হয়েছে অনেক কবির দ্বারাই এবং সে-সময়টায় ত্রিশের কবিরা এতটাই সক্রিয় ছিলেন যে, সে-ধরনটাই শেষমেশ বাংলা  কবিতার জন্য সত্য হয়ে দাঁড়ায়নি। তবে এ-কথা স্বীকার করতেই হয় যে, জীবনানন্দ দাশ যে-কারণেই হোক সমাজ বা জাতি বা মানুষের সমস্যাখচিত বিষয়কে কেন্দ্র করে কবিতা রচনায় হাত দিয়েছিলেন এবং সেক্ষেত্রে তিনি সফলতা এবং অসফলতার মাঝখানে ‘মহাপৃথিবীর’ তিক্ত-রিক্ত-রক্তাক্ত বিকার ও নগর সভ্যতার কেদ-গ্লানির মুখোমুখি হয়েছেন। এ-সময়ে বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত যেমন, তেমনি জীবনানন্দও পথ বদল করেছিলেন। সময়টা ছিল সাম্যচেতনা এবং নগরচেতনার এবং এই সময়ের কবিতায় তাঁর নগরচেতনার সারাৎসারে নির্বাসিত হয়েছে আগেকার সমস্ত নিসর্গসম্ভার, চিত্ররূপময়তার, সমস্ত পত্রালি-শাখা-প্রশাখা-পত্র-পল্লব। সময়ের পাপে ও চাপেই বলতে গেলে তিনি সরে এসেছিলেন সৃজনশীলতার মৌলিক অভিগমন থেকে এবং ঘোর কেটে গেলে আবার ফিরে গেছেন কেন্দ্রে।

‘আধুনিক বাংলা কবিতা’র ভূমিকায় বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতার চারিত্র্যলক্ষণ আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।’ জীবনানন্দ দাশ সেই কবি যাঁর কবিতায় এসব অনুষঙ্গের সন্ধান মেলে সময়ের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে। এডওয়ার্ড সাঈদের কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম গ্রন্থে ‘রেজিস্ট্যান্স অ্যান্ড অপোজিশন’ অধ্যায়ে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কবি এইমে সেজায়ারের কবিতার আলোচনায় সিএলআর জেমসের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘The vision of the poet is not economic or politics, it is poetic, sui generis, true unto itself and needing no other truth.’ জীবনানন্দের কবিতার ক্ষেত্রেও এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। জি এস ফ্রেজার এক আলোচনায় বলেছেন ‘দুই আত্মার (কবির ও দৃশ্যমান বস্ত্তর) মিলনেই কবিতার জন্ম হয়’ আর এই মিলন সম্ভব কেবল কবির           অন্তর্দৃষ্টির প্রাখর্যে, কবির সমস্ত হৃদয়মন দৃশ্যমান বস্ত্তর মধ্যে মিশে গিয়ে যখন বস্ত্তর ভেতর জগতের বৈচিত্র্যকে চিনে ফেলে তখনই কেবল সৃষ্টি হয় সৃষ্টিশীল সৎ অনুভূতির এবং এই অনুভূতির প্রকাশই কবিতা। জীবনানন্দ দাশ তাঁর হৃদয়-মন উৎসর্গ করেছিলেন কবিতার জন্য; যে-কবি নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে না, সে-কবি কখনো সৎ অনুভূতির সন্ধান পেতে পারে না। সৎ অনুভূতির অভাবেই ‘সকলেই কবি নয়’ এবং অজস্র অকবির ভিড়ে প্রকৃত কবির দেখা পাওয়াও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, আর যে-কারণে মাঝপথে অনেক চৌকস অকবিই দখল করে বসে প্রকৃত কবির আসন। জীবনানন্দের সময়েও অনেক রথি-মহারথির দাপটের খবর আমরা জানি, যারা একচেটিয়াভাবে দখল করে ছিল বাংলা কবিতার পুরো জায়গাটি। সেসব মাইনর কবির আজ কেউ সেভাবে মনেও করে না। তবে এ-কথা আমি স্বীকার করি যে, মাইনর কবিদের জন্ম হয় বলেই মেজর কবিদের সহজে চেনা যায়। ফলে শিল্পের বৃহৎ সাম্রাজ্যে গৌণ শিল্পীদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো জায়গা নেই। গৌণ শিল্পীরাও কিছু-না-কিছু রেখে যান তাঁদের শিল্পকর্মে, যা হতে পারে অনাগতকালের মহৎ কোনো শিল্পের উপাদন।

চরম বিষাদ ও হতাশার মধ্যেও একধরনের আশাবাদ ও স্বপ্নের আলো তিনি রেখে যান সমাজ ও সভ্যতার পক্ষে – সুভত্বের পক্ষে ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও থেকে যায় মানব’। বুদ্ধদেব যেমন তার এ-সময়ের কবিতার প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তেমনি আবার সঞ্জয় ভট্টাচার্য তার শেষের দিকের কবিতায় দেখেছেন ‘জীবনের প্রবীণতা’। তাঁর এ-সময়ের কবিতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেকেই মতামত রেখেছেন। সেই চল্লিশের দশক থেকে জীবনানন্দ-সমালোচকরা বারবার বাঁক বদলে – বারবার ভুল স্বীকার করে জীবনানন্দকে বিকশিত করেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিংবা অন্যদের আমরা বলতে শুনেছি – আমার সে-সময়ের মতামতের জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব থেকে বোঝা যায় তিনি শুধু বিচিত্র চেতনারই কবি নন, বাংলা কবিতার এমন একটি জায়গায় তার অবস্থান, যেখানে আলো ফেলে নতুন নতুন জগৎ আবিষ্কারের সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।