বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরী

সৈয়দ জাহাঙ্গীর

সেদিন ছিলো রোববার, ৩০ নভেম্বর। কাইয়ুম যাচ্ছিলো পাশ দিয়ে। হাত ইশারা করে ডাকলাম। আমার বাঁপাশের চেয়ারটায় এসে বসলো কাইয়ুম। আমি বসে ছিলাম  বেঙ্গল ফাউন্ডেশন-আয়োজিত ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালের দর্শক-শ্রোতা অঙ্গনের অষ্টম সারিতে। বললাম, ‘কেমন আছো?’ বললো, ‘এই তো…।’ ‘কেমন লাগছে অনুষ্ঠান?’ ‘খুউব ভালো। তুমি জাদুঘরের মিটিংয়ে যাওনি?’ জানতে চাইলো কাইয়ুম। আমি বললাম, ‘কিসের মিটিং?’ ‘আবেদিন স্যারের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে জাদুঘরের করণীয় সম্পর্কে।’ বললাম, ‘না, যাইনি।’ ‘তুমি গিয়েছিলে?’ জানতে চাইলাম। ‘হ্যাঁ।’ ‘কী আলোচনা হলো?’ ‘কিছু কর্মসূচির প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে, সামনে আরো সিটিং করবে।’ ‘এ-সংখ্যার কালি ও কলমে আমার লেখাটি পড়েছো?’ ‘হ্যাঁ, খুব ভালো লেগেছে, কিছু ফটোগ্রাফ ব্যবহার করতে পারতে তোমার ওই মডেলদের, তাহলে আরো ভালো হতো।’ বললাম, ‘বইটা বেরুবে একুশের আগেই। বইয়ের প্রচ্ছদটা তুমি আঁকবে।’ ‘আমি, না না, তোমার বই তুমিই এঁকো।’ আমি বললাম, ‘তুমি আঁকলে বন্ধুর একটা স্মৃতি থেকে যাবে, তাছাড়া তোমার চাইতে ভালো প্রচ্ছদ আমি কখনোই আঁকতে পারব না – প্রশ্নই ওঠে না।’ ‘ঠিক আছে, আমি এঁকে দোবো।’ কাইয়ুম উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ওই যে হাসনাত বসে আছে, আমাদের হাসনাত, কালি ও কলমের, ওর সঙ্গে কিছু কাজ আছে, কাজটা সেরে নিই।’ কাইয়ুম চলে গেলো, আমার তিন সারি পেছনে মাঝখানটায় হাসনাত যেখানে বসে ছিলো, সেখানে। এর প্রায় আধঘণ্টা পর কাইয়ুমকে দেখলাম অনুষ্ঠানমঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছে। সুন্দর গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাস করেছিলো কাইয়ুম বেশ কয়েক বছর ধরে। কাইয়ুম জোর দিয়ে উচ্চারণ করছিলো, ‘…শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এদেশে শুধু শিল্প-শিক্ষাকেন্দ্রই স্থাপন করেননি, তিনি চেয়েছিলেন একটি শিল্প-আন্দোলন গড়ে তুলতে…।’ ভাষণ শেষে ফিরে গেলো স্টেজের পেছনের দিকে রাখা একটা প্ল্যাটফর্মের দিকে। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে এলো মাইক্রোফোনের দিকে, একটা কথা বলতে ভুলে গেছে সেটা বলতে। কিন্তু শুধু বললো, ‘আমার…’; মুহূর্তেই নিস্তেজ শরীরটা সরাসরি চিৎ হয়ে মঞ্চে লুটিয়ে পড়লো। মাথাটা এত জোরে মঞ্চে আঘাত করলো যার শব্দ আমরা অতদূর থেকেও স্পষ্ট শুনতে পেলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সিটেই বসে রইলাম। কাইয়ুমের ছেলে ও আরো কয়েকজন দৌড়ে চলে গেলো স্টেজের দিকে। কিছুক্ষণ পর স্কয়ার হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারকে খুঁজতে মাইকে ঘোষণা দিলেন স্বয়ং আবুল খায়ের। বুঝলাম, কাইয়ুমকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হবে। পরে জানতে পারলাম, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের কথা চিন্তা করে তাকে সিএমএইচে নেওয়া হয়েছে। আরো কিছু পরে জানতে পারলাম কাইয়ুম আর নেই।

কাইয়ুমের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫০ সালে আমার আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর। কাইয়ুম তখন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। হ্যাংলা-পাতলা গড়ন, বেশ মিশুক। ক্লাসে কাজের সময়েই দেখা এবং আলাপ। ওদের ক্লাসের আরো কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয় – তাদের মধ্যে মুর্তজা বশীর, রশিদ চৌধুরী এবং আবদুর রাজ্জাক ছিল অন্যতম। কাইয়ুম থাকতো শান্তিনগরে। প্রায়ই যেতাম তার বাসায়। কাইয়ুমও আসতো আমাদের তারাবাগের বাসায়। আমি থাকতাম আমার অগ্রজ সিকান্দার আবু জাফরের সঙ্গে। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের নিয়মিত আনাগোনা ছিলো ওই বাড়িতে। আমি যখন থার্ড ইয়ারের ছাত্র, তখন একবার গেলাম কাইয়ুমের গ্রামের বাড়ি, ফেনীতে। কয়েকদিন ছিলাম ওখানে। বিকেলে আমরা বিস্তীর্ণ সীমানাহীন নদীর ধারে সূর্যাস্তের ছবি আঁকতে যেতাম। সূর্যাস্তের সময় সূর্যটা অতিদ্রুত নিচে নেমে যায় দেখে নতুন এক অভিজ্ঞতা হলো। জলরঙে এত দ্রুত আঁকা সম্ভব নয় বলে আমি পোস্টার কালার ব্যবহার শুরু করলাম। এটার আরো একটা সুবিধা হলো, রঙের হেরফের হলে পরে তা সংশোধনও করা যায়। কাইয়ুমও বেশ কয়েকটা ছবি আঁকলো পোস্টার কালারেই।

আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরুবার পর নিয়মিত দেখা হতো ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্টের আড্ডায়। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের আড্ডা জমতো দারুণ। আসতো হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, খালেদ চৌধুরী, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, সঞ্জীব দত্ত, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর এবং আরো অনেকে। চায়ের সঙ্গে প্রিয় খাবার ছিল টোস্টের ওপর মাখন দিয়ে চিনি ছিটিয়ে খাওয়া। আমি ইতোমধ্যে রাঙামাটি গিয়ে বেশ কিছু জলরঙের ছবি এঁকে এনেছি – নিসর্গ আর পাহাড়ি রমণীদের। সেটা ১৯৫৬ সালের কথা। আমার কাজ দেখে বশীর প্রস্তাব দিলো, চলো আমরা তিনজনে মিলে একটা যৌথ প্রদর্শনী করি। কাইয়ুমের ছবি আঁকা ছিলো না আর রাজিও হচ্ছিলো না। আমাদের অনুরোধে কাইয়ুম বেশ কিছু জলরঙের ছবি এঁকে ফেললো। আমরা একটা প্রদর্শনী করলাম প্রেসক্লাবের (পুরনো) দোতলার তিনটে কামরায়। দারুণ সাকসেসফুল হয়েছিল প্রদর্শনীটা। সবারই অনেকগুলো করে ছবি বিক্রিও হয়েছিলো। ইউএসআইএস লাইব্রেরির ডিরেক্টর গ্যে লর্ড হফটাইজার একাই কিনেছিলেন প্রায় ডজনখানেক ছবি।

কাইয়ুম ইতোমধ্যে বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দারুণ সুনাম অর্জন করে ফেলেছে। লেখক-প্রকাশকদের কাছে তার প্রচুর চাহিদা। সংখ্যায় কম হলেও কাইয়ুম নিয়মিত ছবি   আঁকে তখন। খুবসম্ভবত ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমী-আয়োজিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে সে একাডেমী অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছিল। বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেও কাইয়ুম বহু পুরস্কার লাভ করেছিলো। বছর দুই আগে জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত একটি বই-প্রদর্শনীতে নিচতলার প্রদর্শনী কক্ষের গেটের সামনে টেবিলে সাজিয়ে রাখা বইগুলোর মধ্যে থেকে গোটা চারেক বই দেখিয়ে কাইয়ুম বললো, ‘এগুলো আমার আঁকা’। হাসতে হাসতে বললো, ‘জানো, এযাবৎকাল আমি যত প্রচ্ছদ এঁকেছি তা একত্রে প্রদর্শনী করলে এই ঘরে স্থান সংকুলান হবে না।’ সত্যিই অবিশ্বাস্য। আন্দাজ করলেও চমকে যেতে হয় (হায়! এই প্রদর্শনীটা যদি কেউ করতে পারতো)।

কাইয়ুমের সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে সপ্তাহে অন্তত একদিন সাক্ষাৎ হওয়া প্রায় নিশ্চিত ছিলো। প্রতি শুক্রবার সকালে গুলিস্তান এবং নাজ সিনেমা হলে ইংরেজি মুভি দেখানো হতো আর আমরা অবশ্যই তা দেখতাম। বেশিরভাগ নামকরা ছবি দেখানো হতো – ক্যাট অন এ হট টিন রুফ, স্নোজ অব কিলিমানজারো, অন দ্য ওয়াটার ফ্রন্ট ইত্যাকার অনেক ছবি। আরো আকর্ষণীয় হতো আমেরিকান ওয়েস্টার্ন ছবিগুলো। তখনকার সময় নামকরা অভিনেতাই ওয়েস্টার্ন ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করতেন। জন ওয়েন, রবার্ট টেলর, গ্রেগরি পেগ প্রমুখের অনেকেই ছিলেন ওই তালিকায়। সিনেমার প্রতি কাইয়ুমের যেমন আগ্রহ ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল সংগীতের প্রতি। লং প্লেইং ডিস্ক রেকর্ডের জামানায় তার ছিল একটা বিশাল কালেকশন। ওয়েস্টার্ন মিউজিকের প্রতি ছিল তার দারুণ আকর্ষণ। কাইয়ুমের বাসায় রেকর্ড বাজিয়ে বহুদিন ওইসব গান শুনেছি। তবে সবকিছুর মধ্যে গুরুত্ব পেত তার ছবি আঁকা। শুরু থেকেই তার কাজে বাংলার মাটি, মানুষ আর ঐতিহ্যবাহী নকশা ফুটে উঠতো। কাইয়ুম তার ছবিতে এমন একটি বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করেছিল, যা এদেশে আর কারো কাজে দেখা যায় না। ডিজাইন ফর্মগুলোও ক্রমান্বয়ে স্বতন্ত্র আঙ্গিকে উপস্থাপন করছিল। অতিসম্প্রতি বেশ কিছু বিমূর্ত কাজে স্পেস বিভাজনের মাধ্যমে ডিজাইন ফর্মগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছিলো। দেখলে মনে হবে রং ও স্পেসকে নিয়ে অত্যন্ত সহজভাবে, যেন খেলাচ্ছলে বিমূর্তধারার ছবিগুলো এঁকেছে কাইয়ুম। একই সঙ্গে, কালো লাইনে ড্রইংগুলোও তার স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি তুলে ধরে।

বেশ কয়েক বছর ধরে কালি ও কলমের ভেতরসজ্জার নকশা আঁকায় কাইয়ুম হয়ে উঠেছিলো অনন্য সিদ্ধহস্ত। কালো রেখার বেষ্টনীর মাঝে রঙিন প্যাস্টেলের প্রলেপ মোহনীয় এক আবেশ সৃষ্টি করে। রেখার বেষ্টনীগুলো কখনো শায়িত রমণী, কখনো নৌকা, কখনো আকাশ আবার কখনো কৃষকের প্রতিকৃতি। ইলাস্ট্রেশনের নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করেছিল কাইয়ুম। এই ড্রইংগুলো অধিকাংশ সময় পত্রিকার কবিতা অংশে সংযোজিত হতো। নিজের লেখা কবিতায়ও স্থান করে নিয়েছিল তার ড্রইং। এই তো গেল সংখ্যা কালি ও কলমে ছাপা হলো তার কবিতা ‘শীতলক্ষ্যা’। ‘…বিবর্ণ শুকনো বাতাস/ শুশুকের পৃষ্ঠদেশ/ নৌকোর চারিপাশ/ তিরতির বয়ে যাওয়া/ একদা এক নদী -/ বয়ে যেত নিরবধি/ তলদেশ পায় না খুঁজে/ ইটবাঁধা লাশ/ ভেসে ওঠে/ কর্দমাক্ত পাঁকে -/ শীতলক্ষ্যার দুই পারে/ বেদনার্ত/ ছবি আঁকে।/ জনতার ভিড়/ সূর্যাস্তের রক্তিম আভায়/ শোকস্তব্ধ নদীর দুধার -/ কেঁপে-কেঁপে/ বাতাসে মিলায়/ গুমরানো/ হাহাকার’ কবিতার রূপকল্প আর ছবির বিষয়বস্ত্ত অনেকটাই একে অন্যের পরিপূরক। কাইয়ুমের ছবিতেও তা দৃশ্যমান। সাহিত্য, সংগীত, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র, চারুকলা, এমনকি রাজনীতিতেও ছিলো কাইয়ুমের উপস্থিতি।

আজ কাইয়ুম নেই, কাইয়ুমের অভাব পূরণ হবার নয়।