প্রচ্ছদের জাদুকর কাইয়ুম চৌধুরী

 

বাংলাদেশের বইয়ের জগতে প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে এক অবিসংবাদিত পুরুষ কাইয়ুম চৌধুরী। প্রচ্ছদশিল্পের ইতিহাসের অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে তাঁর নাম, তাঁর সৃষ্টি, তাঁর অবদান। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদের কথা ভাবাই যেত না। দেশ বিভক্তির পর পঞ্চাশের দশক থেকে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) তাঁর যাত্রা শুরু।

শুরু থেকে তিনি আলোচিত হয়েছেন। পরবর্তী দশকগুলোতে দাপটের সঙ্গে তাঁর অবস্থান আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করেছেন। ষাট-সত্তর-আশি-নববইয়ের দশক পেরিয়ে বর্তমানকালে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিরলস বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে গেছেন। এক বাক্যে সবাই স্বীকার করবেন, আজকে আমরা প্রচ্ছদের আঙ্গিকগত যে সৌকর্য ও উত্তরণ দেখি, তার পেছনে আছে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর জাদুকরী হাতের ছোঁয়া। কী অসামান্য অবদান, তিনি যেন কিংবদন্তিতে পরিণত।

তিনি অনবরত তাঁর স্টাইল পরিবর্তন করেছেন। একটি নতুন ধারা সৃষ্টি – এ যেন কেবল কাইয়ুম চৌধুরীই করতে পারেন এবং তা অনুসরণযোগ্য হবে উত্তরসূরি ও সমসাময়িক শিল্পীদের কাছে। এমন শিল্পী বাংলা প্রচ্ছদজগতে খুব কমই পাওয়া যাবে, যিনি কোনো না কোনোভাবে কাইয়ুম চৌধুরীর কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং খানিকটা প্রভাবান্বিতও হয়েছেন।

তাঁর জীবনের সমগ্র কাজ নিয়ে আলোচনা বর্তমান প্রবন্ধের পরিসরে সম্ভব নয়। তাই তাঁর শুরু অর্থাৎ পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত আঁকা প্রচ্ছদগুলো নিয়ে সামান্য পর্যালোচনার প্রয়াস রাখা যায়। জীবদ্দশায় তিনি বলেছিলেন, ১৯৫২ সালে লেখকবন্ধু সৈয়দ শামসুল হকের লেখা বুনোবৃষ্টির গান দিয়েই তাঁর প্রচ্ছদশিল্পী-জীবনের সূচনা। দুর্ভাগ্যক্রমে বইটি প্রকাশিত হয়নি।

পঞ্চাশের দশকের নবীন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী প্রথমে সবার নজর কাড়েন জহুরুল হকের সাত সাঁতার গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকে। ১৯৫২ সালে কথা বিজ্ঞান বইটি প্রকাশ করে। গ্রন্থটি ছিল লেখকের আমেরিকা প্রবাসের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ। প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব বোঝানোর জন্যে শিল্পী মোজাইক চিত্রের আদলে প্রচ্ছদে দুটি ভাগে অলংকরণ করেন – প্রথম ভাগে বাংলাদেশের মসজিদ বা পুরনো বাড়ির দেয়াল- নকশার ছবি (চীনামাটির বাসন বা ভাঙা পেয়ালার টুকরো দিয়ে), দ্বিতীয় ভাগে বাইবেল ইলাস্ট্রেশন, ‘এনানসিয়েশনে’র ছবি।

১৯৫৯ সালে তিনি শামসুর রাহমানের প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে কাব্যের প্রচ্ছদ আঁকেন। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে তিনটে রং – কালচে মেরুন, সবুজাভ ধূসর ও হলুদাভ সবুজ। পটভূমিতে মেরুন রং দিয়ে তিনি চারটে প্রায় গোলাকার ফর্ম এঁকেছেন ধূসর রঙে। প্রতিটি ফর্মের মাঝখানে একটি করে পাতার ফর্ম ব্যবহার করেছেন রিভার্সে অর্থাৎ সাদায়। এবং মাঝামাঝি জায়গায় ওপরে-নিচে একদিকে মুখ করা দুটি রঙের পাখি বসিয়েছেন ফর্মভিত্তিক। বইয়ের নাম ও রচয়িতার নাম খুব ছোট করে লিখেছেন। বইটির প্রকাশক বার্ডস অ্যান্ড বুক্স।

চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের শেষভাগ পর্যন্ত পলাশ প্রকাশনী, খোশরোজ কিতাব মহল, আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ওসমানিয়া বুক ডিপো, রেনেসাঁ প্রিন্টার্স, ওয়ার্সী বুক সেন্টার, মখদুমী লাইব্রেরি, আহছানউল্লাহ লাইব্রেরি, প্যারাডাইস লাইব্রেরি, মৌসুমী পাবলিশার্স, রিপাবলিক পাবলিশার্স, স্টুডেন্ট ওয়েজ, নওরোজ কিতাবিস্তান, বার্ডস অ্যান্ড বুক্স ইত্যাদি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গ্রন্থের সাজসজ্জার দিকে মনোযোগী হয়েছিল। সে-লক্ষ্যে তারা তখনকার খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীদের প্রচ্ছদ অঙ্কনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ফলে পাঠকরা পেয়েছিলেন ভালো এবং নান্দনিক গুণসম্পন্ন কিছু প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদশিল্পের গোড়াপত্তনকালে তাই এসব প্রকাশক ও প্রচ্ছদচিত্রীর অবদান ভোলার নয়।

ষাটের দশক বিশ্ব সাহিত্য ও শিল্পের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। অগ্রগতি, উন্নয়ন, মেধায় ও মননে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিটি বিভাগে বিশ্বব্যাপী আলোড়িত একসময়। আমাদের তখনকার গ্রন্থ প্রকাশনার জগৎও এর বাইরে ছিল না। এ-দশকে প্রচ্ছদ নিয়ে শিল্পীরা নানাভাবে ভেবেছেন, এঁকেছেন নানান কায়দায়। তখন সাহিত্যে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে, নান্দনিক গুণাবলিসমৃদ্ধ সাহিত্যগ্রন্থের জন্যে প্রয়োজন পড়েছে তেমন সমমানের প্রচ্ছদকর্মের।

ষাটের দশকে কাইয়ুম চৌধুরী প্রচুর নিরীক্ষা চালিয়েছেন, ঝোঁক ছিল অর্থবহ প্রচ্ছদ আঁকার দিকে। ১৯৬১-তে তিনি আঁকেন জসীম উদ্দীনের সুচয়নী। সুচয়নীতে হলুদ পটভূমির ওপর নকশিকাঁথার ফর্মের ফুল, মাছ ও পাতা,           লাল-কালো ও ইন্দ্রনীল রঙে অঙ্কিত। লেটারিংয়ে তিনি নকশিকাঁথার সুচকর্মের স্টাইলটি অনুসরণ করেছেন।

১৯৬৩, ১৯৬৫ ও ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত যথাক্রমে মুহূর্তের কবিতা, তৃষ্ণার অগ্নিতে একা এবং কণ্ঠস্বর – এ তিনটে বই-ই ক্যালিগ্রাফিক। মুহূর্তের কবিতার প্রকাশক বার্ডস অ্যান্ড  বুক্স। ঘন সবুজ রঙের জমিনে সাদা ও বাদামি রঙে শিল্পী ব্রাশিংয়ে লেটারিং করেছেন, ওপরের দিকে অতিক্ষুদ্র আয়তাকার কতগুলো ফর্ম বসিয়েছেন। এর ফলে প্রচ্ছদে খেলেছে অপূর্ব এক ছন্দ। ফজল শাহাবুদ্দীনের কাব্যগ্রন্থ তৃষ্ণার অগিণতে একা, যার প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স এবং বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কণ্ঠস্বর পুরোপুরি ক্যালিগ্রাফকেন্দ্রিক হলেও অক্ষর তৈরিতে কাইয়ুম চৌধুরী কিছুটা জ্যামিতিক হতে চেয়েছেন।

১৯৬৬ সালে সন্ধানী প্রকাশনীর বই হাসান হাফিজুর রহমানের অন্তিম শরের মতোতে শিল্পী লেটরিংয়ের সঙ্গে অবয়বের অংশবিশেষ এঁকেছেন বিমূর্ততায়। স্টুডেন্ট ওয়েজ-প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস নদীর নাম তিস্তার ঘটনা ও পরিবেশের আবহ তুলে ধরায় শিল্পী সচেষ্ট থেকেছেন। নদীর ঢেউ, সারি সারি পালতোলা নৌকা, দুই সারি মাছ, বৃষ্টি ইত্যাদি এসেছে জ্যামিতিক ফর্মে, যে-ফর্ম কাইয়ুমের নিজস্ব ভাংচুরের ফলে তৈরি হয়েছে।

জসীম উদ্দীনের সাড়াজাগানো বই বাঙ্গালীর হাসির গল্প কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ নিয়ে বেরোয় ১৯৬৪ সালে নওরোজ কিতাবিস্তানের প্রকাশনায়। ফিগারেটিভ এই প্রচ্ছদে শিল্পী রিয়েলিস্টিক থেকে ফর্মে গড়েছেন ফিগারগুলোকে এবং এগুলোর ভঙ্গি ও প্রকাশে কৌতুকরসের আস্বাদন ঘটে। রং-ব্যবহারে উজ্জ্বল প্রচ্ছদটি, তবে আলোচ্য বইয়ে তিনি প্রাথমিক রঙের নির্বাচনকে এড়িয়ে গিয়ে মিশ্রিত পরিশীলিত রঙের দিকে ঝুঁকেছেন, যা বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদের প্রাথমিক যুগে খুব একটা দেখা যায়নি।

ক্যালিগ্রাফিক প্রচ্ছদের অতিসুন্দর একটি নমুনা রৌদ্র করোটিতে। শামসুর রাহমানের লেখা এ-কাব্যটি বইঘর বের করে ১৯৬৩ সালে। বইয়ের পুরো নামটিকে শিল্পী পৃষ্ঠাজুড়ে কম্পোজ করেছেন, অক্ষরগুলোকে তৈরি করেছেন ত্রিভুজাকৃতিতে, এই সাদা ফর্মের গায়ে গায়ে তুলি দিয়ে এঁকেছেন ফুল ও লতা-পাতার পেঁচানো মোটা রেখা। তারপর ডানদিকে লম্বিকভাবে বইয়ের নাম ও কবির নাম লিখেছেন লাইনো টাইপের আদলে। বইটি একরঙে ছাপা। এক রঙে যে সুন্দর প্রচ্ছদ আঁকা যায় তার আরেকটি উদাহরণ আল মাহমুদের কালের কলস। এটিও প্রকাশ করেছে বইঘর ১৯৬৬ সালে। এখানে মুখ্যত তিনটে ফর্মের গায়ে পাখি ফুল ও মাছের মোটিফ এসেছে। টেক্সচার ব্যবহার করেছেন স্পঞ্জের রং লাগিয়ে ছাপ দিয়ে। তাতে করে ফ্ল্যাট পটভূমিতে তৃতীয় মাত্রার অনুভব জন্ম নিয়েছে। এই দশকের শেষে ১৯৭০ সালের একটি বিশিষ্ট প্রকাশনা মাওলা ব্রাদার্স-প্রকাশিত বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতিতে ধূসর-লাল ও সবুজের তিনরঙা প্রচ্ছদে শিল্পী টাইপোগ্রাফিকে খেলিয়েছেন।

সত্তরের দশকে চিন্তা ও মননের ক্ষেত্রে স্বাধীন প্রকাশভঙ্গি গোটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে প্রাণের জোয়ার আনে। সাহিত্যে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও বিকাশে নিত্যনতুন গ্রন্থ প্রকাশের প্রয়োজন দেখা দেয়। অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে অনেক শিল্পী এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।

এই দশকে কাইয়ুম চৌধুরী প্রচ্ছদে নানা ঢং, নানান কৌশল, নানান নিরীক্ষার কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। এঁকেছেন প্রচুর প্রচ্ছদ। এ-সময়কার কতগুলো উল্লেখযোগ্য প্রচ্ছদের নাম করা যায়, যেগুলো তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (বদরুদ্দীন উমর), নোঙর (আবু রুশ্দ), নামহীন গোত্রহীন (হাসান আজিজুল হক), নন্দিত নরকে (হুমায়ূন আহমেদ), পথ বেঁধে দিল (আ ন ম বজলুর রশীদ), চিত্রশিল্প : বাংলাদেশের (বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর), পৃথক পালঙ্ক (আবুল হাসান), শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা (সংকলন), পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (সৈয়দ শামসুল হক), সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিতত্ত্ব (বুলবন ওসমান), হাজার বছর ধরে (জহির রায়হান), শেষ বিকেলের মেয়ে (জহির রায়হান), আরেক ফাল্গুন (জহির রায়হান), বরফ গলা নদী (জহির রায়হান), তৃষ্ণা (জহির রায়হান), আমি কিংবদন্তির কথা বলছি (আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ), মেঘ বলে চৈত্রে যাব (আহসান হাবীব) ইত্যাদি।

জহির রায়হানের লেখা একগুচ্ছ গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাসের প্রচ্ছদে কাইয়ুম চৌধুরী বিমূর্ততার আশ্রয় নিয়েছেন এবং বইয়ের নাম ও বইয়ের ভেতরের বিষয়বস্ত্তকে মহান গুরুত্বে উপস্থাপন করেছেন। লেটারিংকে নানান আবহে টুকরো টুকরো করেছেন, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছেন আর ইলাস্ট্রেশনে যে-ফর্মে বিষয়বস্ত্ত এনেছেন তা তাঁর নিজস্ব এবং বিমূর্ত। বইয়ের নাম ও লেখকের নাম আবার সংস্থাপন করেন প্রচ্ছদে, তবে পরিষ্কারভাবে ৩৬ পয়েন্ট রোমান হরফের আর্টপুল তুলে।

নামহীন গোত্রহীন বইয়ের টাইপোগ্রাফি ও ছবি পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে অবস্থান করে এখানেও ফর্মগুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, কিছুটা জ্যামিতিক, রঙের স্কিম লাল, বাদামি ও বেগুনি। বইঘর ১৯৭২ সালে বইটি প্রকাশ করে। নন্দিত নরকে বইয়ের প্রচ্ছদে শিল্পী রৈখিক ড্রইংকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচ্ছদকে ইলাস্ট্রেটিভ চরিত্র দিয়েছেন। অন্তঃসত্ত্বা রমণীর শরীরকে আধাবিমূর্ত গড়নে রেখায় আঁকা আলংকারিক ফুল-ঘাস-লতাপাতার একটি ফর্মের পটভূমির ওপর আড়াআড়ি বসিয়েছেন। বইটি ১৯৭২ সালে খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি ছাপে। তখন এটি বেশ প্রশংসিত হয়েছিল।

একেবারে সাদা জমিনে প্রচ্ছদ আঁকলে কেমন দাঁড়ায় তা কাইয়ুম দেখেন আদিল ব্রাদার্সের বই পথ বেঁধে দিলতে। লেখকের ইউরোপ ভ্রমণের ওপর বইটি। অতএব তিনি প্রচ্ছদে চারটে লম্বাটে ধরনের চিত্রমালা আঁকেন। স্কাইস্ক্রেপার দালান, মদের বোতল-গ্লাস, রমণী, সমুদ্র, আকাশ, গাংচিল, উড়োজাহাজ, বরফ, স্কি ক্রীড়ারত পুরুষ ইত্যাদি চিত্র ইউরোপ-আমেরিকার চেহারারই প্রতিনিধিত্ব করে। এগুলোতে তিনি ডিটেল ড্রইং রিয়েলিস্টিক ফর্মে করেননি, করেছেন জ্যামিতিক ও আধা জ্যামিতিক ফর্মে। এ প্রচ্ছদের বৈশিষ্ট্য হলো, চারটে দৃশ্য আলাদা আলাদা হলেও উপস্থাপনার নৈপুণ্যে চিত্রগুলোকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত মনে হয় এবং মনে হয় আসলে পুরো প্যানেল মিলিয়েই একটি দৃশ্য। কালো, সোনালি ও ইন্দ্রনীল রঙের ব্যবহার অত্যন্ত সার্থক।

১৯৭৪ সালে প্রকাশিত বাংলা একাডেমির বই চিত্রশিল্প : বাংলাদেশের, ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত সন্ধানী প্রকাশনীর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এবং ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত মুক্তধারার বই সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিতত্ত্ব মূলত টাইপকেন্দ্রিক ডিজাইনে তৈরি তিনটে অত্যন্ত ছিমছাম, সরল ও গুরুগম্ভীর মেজাজের প্রচ্ছদ। একটি রঙের জমিনে অন্য রঙের একটি বর্গক্ষেত্রকার বক্সে মনোটাইপে লেটারিং দেওয়া হয়েছে। চিত্রশিল্প : বাংলাদেশের বইয়ে নিচে ছোট টাইপে লেখকের নাম। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়তে সলিড রঙের জমিনে বইয়ের নাম ও লেখকের নাম রানিং কম্পোজ পদ্ধতিতে ৩৬ পয়েন্ট রোমান হরফে, আর্টপুল ব্যবহৃত হয়েছে অন্য দুটো রঙে। এত সরলভাবে যে এত সুন্দর প্রচ্ছদ হতে পারে, এর আগে তা ছিল অনাবিষ্কৃত। সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিতত্ত্বে ৩৬ পয়েন্ট রোমান হরফ ব্যবহার করেছেন শিল্পী, সেইসঙ্গে একটি ফর্মের ফুলগাছ এঁকেছেন নিচ থেকে ওপরে। এক রঙে ছাপা প্রচ্ছদ, কিন্তু অন্য রঙের আবহ এনেছেন এবং তা করেছেন তিনি কয়েকটি ফর্মে সূক্ষ্ম লাইনস্ক্রিন বসিয়ে।

পৃথক পালঙ্কে আলপনার চিত্রকে কাইয়ুম চৌধুরী হাজির করেছেন কাঠখোদাই চিত্রের চরিত্র মনে রেখে। পাতা, ফুলের পাপড়ি, জোড়া পাখি এবং কবি ও কাব্যগ্রন্থের নামটিও স্থান পেয়েছে নকশায়। ওপরের নকশাটিকেই আবার উলটো করে নিচে পুনরায় ব্যবহার করেছেন। মাঝখানে বইয়ের নাম ও রচয়িতার নাম এক লাইনে বসিয়েছেন প্রেস টাইপে। প্রচ্ছদটি একরঙে ছাপা। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর বই শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতায় টাইপ ব্যবহৃত হয়েছে, তবে তা গৌণ, মুখ্য পত্রশোভিত ডালপালা যা আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন।

ইসলামি স্থাপত্যের গায়ে যে-নকশা থাকে, জ্যামিতিক ফর্মে তারই একটি অংশ নিয়ে লাইনে সংস্থাপন করেছেন হালকা বেগুনি জমিনে কালো রঙে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর অঙ্কিত ইসলামী শিল্পকলা ও স্থাপত্য বইয়ে। ওপরের দিকে ডিজাইন এমনভাবে সংস্থাপিত হয়েছে যে, দেখলে মনে হবে, পুরো ডিজাইনে হয়তো মাঝখানে অসমানভাবে ভেঙে আলাদা করে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে উদ্ভূত শূন্যস্থানে শিল্পী টাইপে বই ও লেখকের নাম বসান ভিন্ন উচ্চতায় ও রঙে। বইটি ১৯৭৭-এ বইঘর প্রকাশ করেছে। জহির রায়হানের গল্পসমগ্র সন্ধানী প্রকাশনী বের করে ১৯৭৯ সালে। নামফলকটি এখানে ফেস্টুনসদৃশ ব্লকের মধ্যে শিল্পী তুলে ধরেছেন। পশ্চাৎ পটভূমিতে অনেক নারী ও পুরুষের মুখাবয়ব করেছেন বিমূর্ত ফর্মে, তাঁর নিজস্ব ঢঙে।

আশির দশকে আধুনিক মুদ্রণ ব্যবস্থার অনুষঙ্গ ফটো কম্পোজ ও অফসেট ছাপা পদ্ধতি চালু ছিল। অধিকাংশ প্রচ্ছদ ছাপা হয়েছে অফসেট পদ্ধতিতে। তবে মুদ্রণযোগ্য নকশায় লাইন ও হাফটোন ওয়ার্ক সমান তালে চলেছে। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, ব্লক পদ্ধতিতে ছাপা এ-দশকেও হয়েছে তবে সংখ্যায় অনেক কম।

আশির দশকে কাইয়ুম চৌধুরী প্রচ্ছদে আরো উন্নত, আরো সংহত এবং দ্রুত পরিবর্তন করেছেন অঙ্কনশৈলীর আঙ্গিক। এ-সময়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রচ্ছদ : নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান (সৈয়দ শামসুল হক), অদম্য পথিকের গান (সাইয়িদ আতীকুল্লাহ), শোকার্ত তরবারি (হাসান হাফিজুর রহমান), উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ (শামসুর রাহমান), সশস্ত্র সুন্দর (রফিক আজাদ), সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ), মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি (শামসুর রাহমান) ইত্যাদি।

সম্পূর্ণ টাইপোগ্রাফিক প্রচ্ছদ, নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান (সব্যসাচী, ১৯৮১)। এখানে শিল্পী বিদ্যাসাগর টাইপকে ব্রো-আপ করে নামের চারটি শব্দকেই মাঝখানে ছেঁড়ার এফেক্ট দেন। রং বেছে নেন ইয়েলো অকার জমিনে হালকা কমলা ও হালকা সবুজ। সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (সন্ধানী প্রকাশনী, ১৯৮২) – চাররঙা প্রচ্ছদ, এখানে ফুল-কুঁড়ি-লতাপাতা দিয়ে অলংকরণ করেন সলিড রঙে এবং প্রতিটি মোটিফে আউটলাইন ড্রইং করেন কালো রঙে। এখানে সমস্ত সাদা পটভূমিতে তিনি লম্বিকভাবে সারি সারি ভাঙা সরলরেখা আঁকেন, নামাঙ্কনে তাঁর নিজস্ব ক্যালিগ্রাফি।

অদম্য পথিকের গানে আধুনিক ঢঙে বৃক্ষের নিচে বাঁশি বাদনরত ফিগার, চারদিকে চিকন চিকন আড়ম্বিক রেখা – এভাবে চিত্রটি অঙ্কিত, নাম ক্যালিগ্রাফিতে। সন্ধানী প্রকাশনী সে-সময়ে কবিতার জনপ্রিয়তাকে সার্থক করে তুলতে কবিতার বই প্রকাশনায় মনোযোগ দিয়েছিল। তাদের আরেকটি বই উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশের প্রচ্ছদে কাইয়ুম পুরো ক্ষেত্রকে তিন ভাগ করে ওপরে ও নিচে বেগুনি পটভূমিতে সলিড কালোতে বিশেষ ভঙ্গির (ভূমিতে স্পর্শ করা হাত, মাথা নিচের দিকে ও পা উলটো করে ঊর্ধ্বে ওঠানো) মানুষকে খন্ডিত করেন। বিভক্ত নিচের অংশ ওপরে এবং ওপরের অংশ স্থাপন করেন নিচের অংশে। দুটো পাখির নৃত্যরত ভাবটিও কৌতূহলোদ্দীপক, এখানেও যথারীতি তাঁর হাতের লেখার ক্যালিগ্রাফি।

১৯৮৩-তে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী-প্রকাশিত সৈয়দ আলী আহসানের শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্যতে মোটা ও স্রেফ ভোঁতা তুলির টানে ক্যালিগ্রাফি দিয়ে পুরো পৃষ্ঠা সাজিয়েছেন, যা এককথায় অপূর্ব। তাঁর আঁকা আধুনিক উপস্থাপনা শোকার্ত তরবারিতে তরবারি ও চোখের ফর্মের সহাবস্থান। আরেকটি  অদ্ভুত বাঙ্ময় প্রচ্ছদ সশস্ত্র সুন্দর।  এ-প্রচ্ছদে হাতে ধরা স্টেনগানকে ফুলের ডাঁটা বানিয়ে রঙিন ফুল ফুটিয়েছেন তাতে, কালো রেখার ড্রইংয়ে মাঝে মাঝে বিন্দুর স্ট্রোক দিয়েছেন।

’৮৩ সালে সন্ধানী প্রকাশনীর মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং ’৮৪-তে প্রকাশিত একই প্রকাশনীর মুক্তিযুদ্ধের কবিতা দুটি ভিন্ন মাধ্যমে করা অপূর্ব দুটো প্রচ্ছদ। দুটো প্রচ্ছদেই শিল্পী বিষয়বস্ত্ত বর্ণনায় ছবিকে সামনে থেকে পেছনের পৃষ্ঠা পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের গল্পের প্রচ্ছদে ইলাস্ট্রেশন ও টাইপোগ্রাফি সমান গুরুত্ব বহন করে। গ্রামের সাধারণ কৃষক মুক্তিযোদ্ধা যুবকের পূর্ণ ফিগারকে ছোট-বড় নানা সাইজে পুনঃপুন ব্যবহার এবং পোস্টার রঙে চ্যাপ্টা তুলি দিয়ে ড্রাইওয়াশ প্রলেপন (চড়া লাল-হলুদ) যুদ্ধের আবহ তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। টাইপোগ্রাফিতে পরিপ্রেক্ষিতের সঠিক প্রয়োগ, চাররঙা বড় ফিগারগুলোকে কেন্দ্র করে বাকি ফিগারগুলো (অপেক্ষাকৃত ছোট সাইজের) শুধু কালো রেখার ড্রইংয়ে পটভূমি নকশার ওপর ওভারপ্রিন্ট যথেষ্ট লক্ষণীয়।

’৮৪-তে কাইয়ুম চৌধুরী অঙ্কনকৌশলে পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হন। মাধ্যম বদলালেন। আধুনিক মুদ্রণ পদ্ধতি চালু হওয়ায় তিনি সে-সুযোগটা গ্রহণ করলেন। জলরং ও গোয়াশে ওয়াশ টেকনিকে প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা ও কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি পুরোপুরি জলরঙের কাজ, বলা যায় ইলাস্ট্রেটিভও। চিত্রকলাকে তুলে আনলেন প্রচ্ছদে। মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় পতাকা ও যুদ্ধাস্ত্র হাতে নারী-পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের ফিগার কম্পোজিশন উজ্জ্বল রঙে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এমনিভাবে কবিতার সঙ্গে গেরস্থালিও মনোরম প্রচ্ছদ হয়ে ওঠে জানালা, বৃক্ষ, চাঁদ ও পাখির নান্দনিক উপস্থাপনায়।

১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদ প্রকাশ করে শান্তির জন্য পঙ্ক্তিমালা কাব্যগ্রন্থ। এর উল্লেখযোগ্য প্রচ্ছদ আঁকেন কাইয়ুম চৌধুরী। কাজটি পুরো ক্যালিগ্রাফিক, গ্রন্থের নামটিকে সলিড ও লাইনের ঘেরাটোপে চার রঙের নানান স্তরে সাজানো হয়েছে। মাঝখানে নিরেট সাদায় বেরিয়ে এসেছে পাতা ঠোঁটে নিয়ে উড্ডীন শান্তির পায়রা – মধ্যে প্রেস টাইপে গ্রন্থের নাম।

এমনিভাবে পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন অনবদ্য দাপুটে খেলিয়ে। একের পর এক তিনি কাজ করে গেছেন, পুরনো এবং নতুনদের সঙ্গে সমানতালে। কখনো ক্যালিগ্রাফি, কখনো টাইপের নানান ক্যারিশমা, কখনো ইলাস্ট্রেটিভ করে, কখনোবা ফটোগ্রাফি ব্যবহার করে আবার কখনো কোলাজ – কতভাবেই না ভেবেছেন প্রচ্ছদের আঙ্গিক নিয়ে। গ্রন্থের অন্তর্গত ভাব প্রচ্ছদে প্রতিফলন ঘটাতে তাঁর চেয়ে পারদর্শী কে-ই বা হতে পেরেছেন?

নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরা তাঁর একেকটি প্রচ্ছদ আমাদের আজো ভালোলাগায় আপ্লুত করে, মননকে করে ঋদ্ধ। এ কি সবাই পারেন? এ যে কেবল কাইয়ুম চৌধুরীর জাদুকরী স্পর্শেই সম্ভব।