একটি মেয়ে

আফসার আমেদ

\ ১৯ \

সেঁজুতির মোবাইল সেটটা কোথায় খোয়া গেছে। আলমদের বসতিবাড়ি থেকে ফিরে আর পাচ্ছে না। ফেরার পর দুদিন পেরিয়ে গেছে, আজই মনে পড়ল তার। সেই যে ওখানে মোবাইল সেটটা নীরব করে রেখেছিল, তারপরেও এই দুদিনে তার সরবতা বোধ করেনি। নিয়ে এসেছিল তো? জানে না। সুইচ স্টপ আছে, কোথাও গুঁজে রেখেছে, দরকার হয়নি বলে পায়নি। এই দুদিন তাতে কত আরাম! আর প্রজেক্টের কাজ সে এই দুদিনে করেছে। বিবরণ লিখেছে
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পথশিশুদের ভাবনা, কল্পনা, কষ্ট আর অভাববোধ নিয়ে লিখে গেছে। বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে-বসে ডায়েরিতে সাদা কাগজে কলম চালিয়ে গেছে। কাজটাতে আনন্দও পাচ্ছে সে। বাইরের কোনো সংশ্রবের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি সে। তাতে একরকম শান্তিতে থাকা গেছে। কাজের প্রাণতা ধারাবাহিক রাখতে পেরেছে। কেউ আসেনিও তার বাড়িতে। বন্ধুরা। বন্ধুত্বে তার আর বিশ্বাসও নেই। তবুও বন্ধুরা তার মন কুরে কুরে খায়।
আমিনা ও আলমদের পরিত্যাগ করতেই চায় সে। ওরা দূরতর নক্ষত্র হয়ে থাক। মনে পড়ে, আলমটা ভালো আছে তো?
এদিকে রবিদা এখন নার্সিং হোমে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। ফুসফুসে গুরুতর সংক্রমণ হয়েছে। খুব জ্বর ছিল। কিছুতেই সারছিল না। কাজের মেয়ে নীলাদি ডাক্তার ডেকে এনে দেখায়। দুদিন ওষুধ খাওয়ার পর সারল না। বেঘোরে পড়ে থাকল। নিশ্বাসে কষ্ট। পাশের ফ্ল্যাটের সামন্তদার কাছে সুচরিতা বউদির মোবাইল নম্বর ছিল। ফোন করতে সুচরিতা বউদি চলে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে রবিদাকে নার্সিং হোমে নিয়ে যান। চিকিৎসা চলছে। রবিদা এখন চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন।
দুবার সুচরিতা বউদির কাছে গেছে সেঁজুতি। হৃদয়কে আদর করে এসেছে। খোঁজখবর নিয়েছে রবিদার। রবিদা এখন ভালোর দিকে।
এখন সে শুধু রান্নার সময়টুকু ব্যয় করে। বাকি সময়টা রিপোর্ট লেখার কাজে ব্যাপৃত থাকে।
হৃদয় আবজানো দরজা ঠেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
সেঁজুতি মিষ্টি করে তাকায় হৃদয়ের দিকে। ‘আসবে? ভেতরে এসো।’
হৃদয় তেমনই দাঁড়িয়ে থাকে।
সেঁজুতি হাতের কাজ শেষ করতে পারছে না।
হৃদয় বলল, ‘তুমি তো লিখছ। হোমটাস্ক?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি কদিন স্কুল যাইনি। কাল থেকে যাব।’
‘কবে থেকে?’
‘কাল থেকে।’
‘কাছে এসো। বসবে?’
‘কাছে যাচ্ছি। বসব না।’
‘কেন?’
‘তুমি আমার সঙ্গে দেখা করোনি কতদিন।’
‘তুমি না এলে দুদিন পরে ঠিক যেতাম।’
‘তোমার মনেই ছিল না।’
‘না, মনে ছিল। তুমি কি কিছু খাবে? বিস্কুট? চানাচুর?’
‘চানাচুর দাও, চুপি চুপি। মা যেন জানতে না পারে।’
‘কেন? মা খেতে দেয় না?’
‘না।’
‘তোমার খেতে ভালো লাগে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমারও। আয় আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে খাই।’
চানাচুরের কৌটো রান্নাঘর থেকে আনে সেঁজুতি। ওরা খায়। সেঁজুতি যেন বালিকা হয়ে গেছে। চোখে উজ্জ্বলতা, মুখে দুষ্টুমি।
হৃদয় বলল, ‘তুমি নাকি রাতের বেলা বাবার কাছে যাও?’
চমকে ওঠে সেঁজুতি, হৃদয়ের মুখে একথাটা শুনে। ‘কে বলল তোমাকে?’
‘সামন্তকাকু চুপিচুপি মাকে বলছিল।’
‘কখন?’
‘একটু আগে। কাকুটা খুব দুষ্টু। মা বলল -’
‘মা কী বলল?’
‘মা বলল, একা থাকে, তবুও দেখার কেউ আছে।’ চানাচুর একটু খেয়ে নিয়ে বলল, ‘তুমি খুব ভালো?’
‘তা তো বলতে পারব না। তোমাকে এসব কথা ভাবতে হবে না।’
‘না, মা বলছিল, তুমি নাকি ভালো। আমি এসব কথা শুনেছি বলে মায়ের আমার ওপর খুব রাগ হয়েছে।’
‘ঠিকই তো, এসব বড়দের কথা, তুমি শুনবে কেন?
‘তবে কি শুনব?’
‘পড়াশোনার কথা, ভালো হওয়ার কথা।’
‘আমি তো ভালো হতে চাই, পারছি না যে?’
‘ভালো হতে পারছ না কেন?’
‘মা সবেতে বারণ করে বলে।’
‘এটা মায়ের খুব অন্যায়।’
‘বাবার কাছে নিয়েই আসে না।’
‘এই যে নিয়ে এলো?’
‘বাবার তো অসুখ বলে।’
‘তুমি এখানেই থাকতে চাও নাকি?’
‘আগের মতো। মা থাকতে দেবে না।’
‘বড়দের কথা শুনতে হবে তো, মা তোমার থেকে বড়।’
‘আমিও তো বড় হচ্ছি।’
‘মা তোমার চেয়ে কত বড়, ভেবে দেখো।’
‘তুমিও তো তোমার মায়ের থেকে ছোট, তুমি কি শুনছ?’
‘কে বলল, আমি শুনি না?’ হেসে ফেলে সেঁজুতি।
‘আমি জানি।’
‘পাকামি হচ্ছে!’
হৃদয়ের রাগ হয়। খাওয়া বন্ধ করে।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সেঁজুতি, ‘আরে খাও খাও।’
‘বকলে যে?’
‘আর বকব না।’ এবার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় হৃদয়ের। ‘বাবাকে দেখতে গিয়েছিলে?’
‘আমাকে দেখায়নি।’
‘তাহলে?’
‘মা বাইরে বসিয়ে রেখে যায়।’
‘তুমি দেখতে চেয়েছিলে?’
‘কথা বলতে ভালো লাগবে।’
‘বাড়িতে এলেই বোলো।’
‘বাবা কি কথা বলতে পারবে?’
‘কেন পারবে না?’
‘বাবার যে খুব অসুখ।’
‘সেরে যাবে।’
‘সেরে যাবে তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরা আবার একসঙ্গে বেড়াতে যাব কোথাও।’
‘হয়তো।’
‘সত্যি কথাটা বলো না আন্টিমণি।’
‘সত্যি কথাই তো।’
‘পুরী যেতে পারবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘সমুদ্রে নামতে পারবে?’
‘পারবে পারবে।’
‘মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করবে না?’
‘না।’
‘মাও বাবাকে মারে। লাথি।’
‘তুমি ওসব কথা বোলো না হৃদয়।’
‘আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে।’
‘ছিঃ ওসব কথা বোলো না, ভেবো না। চানাচুর খাও।’
‘খাচ্ছি তো।’
‘তুমি কাকে বেশি ভয় পাও?’
‘মাকে।’
‘বাবা যে তোমাকে ভয় দেখাত?’
‘সে তো ছোটবেলায়। এখন ভয় পাই না। বড় হয়েছি।’
‘আমার মতো বড়?’
‘সে তো কটা মাস গেলেই তোমার মতো বড় হয়ে যাব।’
দরজায় সুচরিতা বউদির মুখ। নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছেন। কটমট করে তাকিয়ে আছেন। সচকিত হয়ে ওঠে সেঁজুতি। ‘আসুন বউদি, হৃদয় আমার কাছেই আছে।’
‘ও কী খাচ্ছে শুনি, যার দুদিন আগে ডায়রিয়া হয়েছিল।’
‘আমিই দিয়েছি। জানতাম না।’
‘ও তো জানত।’ শাসনের ভাষায় সুচরিতা বললেন, ‘আয়, এদিকে আয়।’
বিছানা থেকে নেমে গিয়ে মাথা নিচু করে কাছে যায় সে।
সুচরিতা বউদি হৃদয়ের হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে যান ঘর থেকে।
ব্যাপারটা খুবই ভয়ানক মনে হলো সেঁজুতির। সহসা সুচরিতা বউদি এমন ভয়ঙ্কর আক্রমণ করবেন বুঝে উঠতে পারেনি। সিঁড়ি দিয়ে হৃদয়কে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছেন আর হৃদয় আর্তচিৎকারে কেঁদে চলেছে।
পিছু পিছু যায় সেঁজুতি। খুবই প্রতিকূল দশায় সে এখন। এ-ধরনের ঘটনায় সে কখনো জড়াতে চায়নি। অথচ জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু হৃদয়ের প্রতি একটু বেশি স্নেহ থাকায় সে পিছু পিছু চলেছে। হৃদয়কে লাঞ্ছনা থেকে উদ্ধার করতেই চায় সে। আর হৃদয় সুচরিতাদের দত্তককন্যা। এই দুর্বল সম্পর্কটা তাকে এই ঘটনার দিকে নিয়ে চলেছে, সহায়তা দিতে সে এগিয়ে চলেছে। এছাড়া তার উপায়ও নেই। হৃদয়ের কাছে এক মাতৃত্বের বোধ তাকে উদ্বেলিত করে। সেও যেন মা।
ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল।
ঝাঁপিয়ে পড়ে হৃদয়কে সুচরিতা বউদির হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয় সেঁজুতি। ‘কি হচ্ছে কি, ওকে চানাচুর আমিই খেতে দিয়েছি। আমাকে মারুন। ওকে মারবেন না।’
‘না, ও আজ আমার হাতে মার খাবে।’
‘আন্টি, মা আমাকে খুব মারবে। মেরে থাকে।’ চিৎকার করে কাঁদে হৃদয়।
সেঁজুতি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কেন মারেন? নিজের পেটের সন্তান হলে পারতেন?’
সুচরিতা এই কথার আক্রমণে নাড়া খেয়ে যান। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঘুরে যায়।
সেঁজুতি সুচরিতাকে ধরে ফেলে।
‘হৃদয় আমার নিজের মেয়ে নয়, বলতে পারলে কথাটা?’
সুচরিতা বউদিকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে রেখে সেঁজুতি বলল, ‘বলবই তো, ওকে যে মারবেন বলছিলেন।’
‘আমার মারবার অধিকার নেই?’
‘না।’
‘কী বলছ তুমি?’
‘ঠিকই বলছি। ও দত্তক বলে মনে হয় এমন ঘটনা কখনো ঘটাবেন না।’ ধরে ধরে সোফায় বসিয়ে দেয় সেঁজুতি সুচরিতাকে। তারপর ঠান্ডা জল এনে মুখে-চোখে দেয়।
‘মাথা ঘুরে গেল।’
‘মাথা তো ঘুরবেই।’ জল খেতে দেয়।
জল খান সুচরিতা।
পাশের ঘরে দরজা বন্ধ করে হৃদয় আছে। আত্মরক্ষার জন্য গেছে।
‘তুমি এই ফ্ল্যাটে ওর কাছে আসো, এই খবর পেয়েছি।’
‘জানি, সামন্তদা বলেছে তো?’
‘তুমি কী করে জানলে?
‘জানব না, কুচুটে মনের মানুষরা এমনই কথা বলতে অভ্যস্ত।’
‘ঠিক আছে ভালোই তো।’
‘সারারাত মদ খায় আর বেহেড হয়ে পড়ে থাকে। মদ না খাওয়ার অনুরোধ দুদিন এসে করে গেছি। আর যা-ই বলুন রবিদার মেয়েমানুষে লোভ নেই। মদ খেয়ে লিভার পচিয়ে মরে যেতে সাধ খুব।’
‘আমিও জানি, মেয়েমানুষে লোভ নেই; কিন্তু তোমাকে কেমন রকম দেখে?’
‘খুবই আন্তরিক।’
‘আমার ভয় ওখানেই।’
‘কীসের ভয়?’
‘একটা প্রেম ও চায়। দিতে পারলে দিও।’
‘দুঃখী মানুষকে অপমান করবেন না। আপনিই তো ছেড়ে চলে গেছেন ওকে।’
‘সত্যি, আমার ভেবে ভালো লাগছে, ওর জন্য তুমি ভাবো। হয়তো বন্ধু হয়েছ।’
‘বন্ধুই তো।’
‘সহায়তা দাও।’
‘সহায়তাই তো। যে কোনো রাতে আট-দশটা স্লিপিং পিল খেয়ে নিতে পারেন।’
শিউরে ওঠেন সুচরিতা। ‘হ্যাঁ, ও ডেথ উইশে ভোগে।’
‘ওঁর জন্য একটু ভাবুন বউদি, প্লিজ!’
‘স্নান করবে এখানে? খেয়ে নেবে এখানে? খাবার বেশি আছে। আমার শাড়ি পরবে। আমার খুব মন খারাপ হয়েছে, আমার সঙ্গে কাটাবে প্লিজ। কতদিন ভালো করে ঘুমোইনি। তোমাকে চাইছি আজ আমার কাছে।’
‘সে কি, আজ তো আমার অনেক কাজ।’
‘কাজ তো অন্যদিন করতে পারবে।’
‘কেন এমন করছেন বউদি, শান্ত হোন।’
‘আমি শান্তিতে একটুও নেই।’
‘চুপ করুন। ব্যথা লাগে এসব কথায়।’
‘রান্না করেছ?’
‘এখনই করব।’
‘এখানেই থাকো, তোমাকে নিয়ে আমরা নার্সিং হোমে যাবো। এখানেই খাবে। আমরা এক বিছানায় বিকেল পর্যন্ত ঘুমব। আজ তোমার রান্না নেই। একদম না করতে পারবে না।’
‘কেন এমন করছেন?’
‘তা হলে নিচে স্নান করেই এসো। একসঙ্গে কতদিন আমরা খাইনি।’
‘এবার থেকে এখানে এই ফ্ল্যাটে থাকবেন?’
‘দেখি।’
‘দেখি নয়, থাকতে হবে। ভালো থাকা রচনা করতে হবে।’
‘দেখি।’
‘হৃদয়কে আর বকবেন না।’
‘তুমি কতদিন চুলে শ্যাম্পু করোনি?’
‘জানি না।’
‘শ্যাম্পুর পাউচ একটা নিয়ে যেও।’
‘ঘরে রুম ফ্রেশনার দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘জানালাগুলোও তো বন্ধ ছিল।’
‘ফ্ল্যাটজোড়া ধুলো-ময়লা শুধু।’
‘ফুলদানিতে টাটকা ফুল রাখবেন?’
‘মনে পড়েনি।’
‘দেখবেন, সব আগের মতো হয়ে যাবে আবার।’
‘তুমি বাড়িতে গিয়েছিলে? মায়ের কাছে?’
‘না।’
‘কেন?’
‘এমনি।’
‘ওঁরা কেমন আছেন?’
‘আছে ওরা ওদের মতো। – রবিদা গান শুনতে ভালোবাসেন। আপনিও গান শুনবেন। ওঁর ভালো লাগাগুলো বিশ্বাস করতে হবে আপনাকেও। কবিতা পড়বেন, গান শুনবেন ওঁর সঙ্গে, তাতেই উনি ভালো নেশা পাবেন।’
‘তাহলে ও মদ খাবে না?’
‘খাবেন হয়তো, নিয়মিত নয়। একটু মন সাজাতে না হয় এক-আধদিন একটু মদ খেলেনই।’
‘ওর আসক্তি খুব।’
‘ওঁকে ডাক্তার দেখান। ডাক্তারের পরামর্শ উনি শুনবেন।’
‘জানি না লিভারটা কতখানি খারাপ করেছে।’
‘একসঙ্গে বেড়াতে যান কোথাও।’
‘ও খুব আমুদে লোক, বেড়াতে ভালোবাসে।’
‘সে তো জানি।’
‘তুমিও আমাদের সঙ্গ বেড়াতে যাবে না?’
‘না। আমি যাব কেন?’
‘আমার খুব ভয় করবে।’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘বলছ?’
‘মনের বয়স বাড়তে দিচ্ছেন বুঝি?’
‘জানি না। তবে আমিও খুব একা।’
‘আমিও তো একা। একা আমি একটি মেয়ে।’
‘তুমি স্নান সেরে এসো, তোমার সঙ্গে বিছানায় শুয়ে গল্প করব।’
‘আমাকে যেতে হবে ব্যাংকে।’
‘ব্যাংক থেকে তাড়াতাড়ি ফিরো। প্লিজ!’
ভাবল, সত্যিই তো আজ দুপুরে রান্না করার ঝামেলাটা না থাকলে ভালোই হয়। সুচরিতা বউদির কাছে খেয়ে নেবে। হৃদয়কে অনেকটা সময় কাছে পাবে। প্রজেক্টের লেখালেখি বন্ধ রাখবে। সকাল থেকে অনেক তো করল। বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে। জানালার বাইরে আকাশে মেঘ। কখন বৃষ্টি নামে কি জানি। ব্যাংকে আজ না হয় না-ই গেল। দুপুরে সুচরিতা বউদির কাছে খাওয়া ও বিশ্রাম পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু সন্ধ্যায় রবিদাকে দেখতে ওঁদের সঙ্গে নার্সিংহোমে কিছুতেই যাচ্ছে না। যাবে না। সুচরিতা বউদি রবিদার দায়িত্বটা নিয়ে নিক। এ নিয়ে তার আর কোনো ভাবনা থাকবে না। সে ব্যাপারে সে থাকবে অাঁকিবুঁকিহীন সাদা কাগজের মতো।
নিচে নেমে এলো সে।
মোবাইলটা কোথাও নেই। রিংটোন নেই। মিসড কল নেই। কারো সঙ্গে কথা বলার ঝক্কি-ঝামেলা নেই। সময়ও পন্ড হচ্ছে না। অফুরন্ত সময়। সুচরিতা বউদির কাছে না গিয়ে এই দুপুরে কোথাও পালিয়ে যেতে কি সে পারে না? কোথায় সে যাবে? যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, অনেক ভেবে দেখল। সব জায়গাতেই অনিচ্ছা। তাই যাবে সুচরিতা বউদির কাছে।
স্নানের জন্য পোশাক ছাড়ল সে। বাথরুমে আরশোলাদের ভয় তাকে তাড়া করল। অনেকক্ষণ ধরে সে স্নান করবে, অনেকক্ষণ ধরে সে গায়ে জল মাখবে। সাবান মাখবে। শ্যাম্পু দেবে। তার কাছে শ্যাম্পু ছিলই, কিন্তু মাখার মন ছিল না। দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ। অপেক্ষায় থাকুক। যে-ই আসুক না কেন? কে? প্রহর কি এলো? তমোঘ্ন কি এলো? নাকি মৌরি সেন? অপেক্ষা করবে, তার স্নান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। দরজার বাইরে থেকে স্নানঘরে জলপড়ার শব্দ নিশ্চয়ই শুনতে পাবে। সে এখন অত অধৈর্য হচ্ছে না, কে এসেছে জানার জন্য, খুলে দেওয়ার জন্য। আলমের আসার সাহস হবে না। নীরজা? বলতে পারা যায় না। সে তো এখন অজ্ঞাতবাসে। দুদিন আগে আলমদের বস্তিতে কাটিয়ে এসেছে। খাপছাড়া নেই, আড্ডা নেই, বন্ধুসমাগম নেই।
কড়া নাড়ার শব্দ আর হচ্ছে না। তাহলে কি চলে গেল? যাক। অত দুশ্চিন্তা করার কি আছে?
আবার কড়া নাড়ার শব্দ।
যাক, এখনো যায়নি।
এবার তাড়াহুড়ো করতে থাকে সেঁজুতি। তোয়ালে দিয়ে এখন সারা গায়ের জল মোছে। চুল ঝাড়ে। আয়নায় একপলক নিজেকে দেখে। একটু অপেক্ষা করল না হয়। তারপর পোশাক পরতে থাকে। একটা হাউসকোট পরে। এখন কোথাও বেরোনো নেই। নিরুদ্দেশ যাত্রাও তার নেই। তারপর তোয়ালেতে চুল মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে আসে। মুখে গানের কলি ‘আজি এ বসন্তে’ – কিন্তু ভাবল এখন আর বসন্ত নেই, বর্ষা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি এসে পড়ছে। মাঝে মধ্যেই আকাশে কালো মেঘের অভিসার। পাহাড়ে তো অনেক আগেই বর্ষা নেমে গেছে। তমোঘ্নরা এখন ঘোরতর বর্ষার মধ্যে আছে। কে এলো? একটু মন গুছিয়ে নিয়ে প্রস্ত্তত হয়ে দরজা খুলে ধরল সেঁজুতি।
হৃদয়ের মুখ।
‘এসো।’ হৃদয় তাকে ডাকতে এসেছে।
হৃদয়ের মুখে হাসিটা দেখে সেঁজুতির খুব ভালো লাগল। সেও একটা মিষ্টি হাসি দিলো হৃদয়কে।
হৃদয় তার হাত ধরে টানতে লাগল নিজের দিকে। (চলবে)