একনজরে বাংলাদেশে নজরুল

আবিদ আনোয়ার

ব্রিটিশশাসিত ভারতের অখন্ড বঙ্গভূমির বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিলেও নন্দিত কবিপুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম আজ আমাদের জাতীয় কবি। রাজনৈতিক উত্থান-পতনে নানা ভৌগোলিক বিভাজনের সূত্রে এক অর্থে ভিনদেশি হয়েও  যে-কারণে তিনি আজ আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত, এর পেছনে রয়েছে তাঁর প্রতি ও তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং একই সঙ্গে এদেশের মানুষের সঙ্গে তাঁর নিজের সম্পৃক্ততা, সম্প্রীতি ও আক্ষরিক অর্থেই প্রেমের বন্ধন। তাঁর বিপুল রচনাকর্মেরও বেশকিছু পূর্ব বাংলায় বসে লেখা, পূর্ব বাংলাকে নিয়ে, পূর্ব বাংলার মানুষকে নিয়ে লেখা। এই সমীক্ষার উদ্দেশ্য বাংলাদেশে তাঁর আগমন, কর্মকান্ড ও এখানে বসে রচিত তাঁর সৃষ্টিকর্ম সম্বন্ধে পাঠকের কাছে একটি দ্রুতলেখ তথ্যচিত্র তুলে ধরা। বাংলাদেশে নজরুলের আগমন ও কর্মকান্ড নিয়ে বহু রচনা থাকলেও এগুলো অঞ্চলের ভিত্তিতে বিস্তৃত আকারে লেখা। স্বল্পপরিসরের কোনো লেখা আমার চোখে পড়েনি, যাতে এ-বিষয়ে মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ একটি চিত্র

পাওয়া যায়। নানা সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে, বিশেষ করে মাহবুবুল হক-প্রণীত নজরুল তারিখ অভিধান শীর্ষক তাঁর সামগ্রিক দিনলিপি থেকে খুঁজে-খুঁজে বাংলাদেশে নজরুলের আগমন ও কর্মকান্ড নিয়ে এ-লেখার আয়োজন।

নজরুলের জীবনালেখ্য পর্যালোচনা করলে জানা যায়, এদেশের ভূখন্ডে তিনি পা রাখেন তাঁর কৈশোরেই। দারিদ্র্যকবলিত পরিবারে জন্ম-নেওয়া এই কবি-কিশোর আসানসোলের মাথরুন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে কিছুদিন প্রসাদপুরের এক বাঙালি খ্রিষ্টান পরিবারে বাবুর্চির কাজ করেন। আবারও আসানসোলে এসে যখন তিনি একটি রুটির দোকানে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার পরিচয় পেয়ে কাজী রফিজউল্লাহ নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে পরিবারের সদস্যের মতো নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন। কিছুদিন পরই তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানায় দারোগা হিসেবে বদলি হলে নজরুলকেও সঙ্গে নিয়ে কাজীর সিমলা গ্রামে আসেন। ১৯১৪ সালের জানুয়ারি মাসে পার্শ্ববর্তী দরিরামপুর হাইস্কুলে নজরুলকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। নিজগুণেই নজরুল বিনাবেতনে লেখাপড়ার সুযোগ পান। বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান পেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে চঞ্চলমতি নজরুল কাউকে না-জানিয়ে তাঁর নিজ গ্রাম চুরুলিয়ায় ফিরে যান। কিন্তু কাজীর সিমলা গ্রাম ও দরিরামপুর স্কুলকে তিনি ভুলে যাননি। ১৯২৬ সালের ১৭-১৮ জানুয়ারি ময়মনসিংহে এক কৃষক-শ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমন্ত্রণ পেয়ে সম্মেলনে যোগ দিতে না-পারলেও কৃষ্ণনগর থেকে পাঠানো এক বাণীতে কবি লেখেন : ‘ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ঋণে ঋণী। আমার বাল্যকালের অনেকগুলি দিন ইহারই বুকে কাটিয়া গিয়াছে… আজও আমার মনে সেইসব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্বর হইয়া জ্বলিতেছে।’ পরিণত বয়সে আবারো ময়মনসিংহ অঞ্চলে নজরুল অনেক ঘুরেছেন। ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ঢাকা, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার বিস্তৃত অঞ্চল ছিল তাঁর নির্বাচনী এলাকা। জয়লাভ তো দূরের কথা, নির্বাচনে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ভোটপ্রার্থী হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হলেও কবি হিসেবে তিনি সর্বত্রই ছিলেন সমাদৃত। নজরুলের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য কাজী নজরুল ইসলামের নামে ময়মনসিংহে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে নানা কাজের সূত্রে, তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ও বহু সম্মেলনে যোগ দিতে নজরুল ইসলাম এদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যেখানে তিনি আজ চিরনিদ্রায় শায়িত, সেই ঢাকা শহর ও এর আশপাশের এলাকায় তাঁর কর্মময় দিনগুলোর দিকে তাকানো যাক।

নজরুল প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন বিত©র্র্কত তারিখ ১৯২৬ সালের ২৪ জুন (!) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ২৭-২৮ জুনে অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের একটি অধিবেশনে যোগ দিতে। এখানে এসে প্রথমবারের মতো পরিচয় ঘটে কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের উদ্যোক্তা কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্ন ও অন্য অনেকের সঙ্গে। নজরুল সেই সম্মেলনে ইসলামি পুনর্জাগরণ বিষয়ে বক্তব্য রাখার পর গজল গাওয়া ছাড়াও তাঁর ‘খালেদ’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন এবং ‘খোশ আমদেদ’ নামে একটি নতুন গান পরিবেশন করেন। চট্টগ্রামের সাপ্তাহিক সম্মিলনী এবং মাসিক যুগের আলো পত্রিকার সম্পাদক দিদারুল আলম এ-সময়ে ঢাকায় আসেন। তাঁর অনুরোধে নজরুল আট পঙ্ক্তির প্রশস্তি লিখে দেন, যা যুগের আলোর একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে নজরুল আবারও ঢাকায় আসেন; ওঠেন ড. কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাসায়। এখানে বসে তিনি ‘এ বাসী আসরে আসিলে কে ছলিতে’ এবং ‘চল চল চল’ গানটি রচনা করেন, যা এখন আমাদের রণসংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। এ-সফরে তিনি পরিচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক প্রখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু এবং কাজী মোতাহার হোসেনের দূরসম্পর্কের বোন ফজিলতুননেসার সঙ্গে। ফজিলতুননেসা ছিলেন প্রথম মুসলমান নারী, যিনি গণিতশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এবং পরে সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিলেতে যান। ফজিলতুননেসার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে নজরুল তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং এ-বিষয়ে কাজী মোতাহার হোসেন ও ফজিলতুননেসাকে অনেক চিঠি লিখেন ও বই পাঠান। কাজী মোতাহার হোসেন একটি চিঠিতে ফজিলতুননেসার অনাগ্রহের কথা জানালে নজরুল অনুশোচনা করে এ-বিষয়ে বিরত হন। এরপর হঠাৎ করেই তিনি একই বছরের জুন মাসে আবারো ঢাকায় এলে ঘনিষ্ঠতা জন্মে রানু সোম নামে এক সুকণ্ঠী তরুণীর সঙ্গে, যিনি পরে বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী হওয়ার পর প্রতিভা বসু নামে খ্যাতি অর্জন করেন। সেবারের ঢাকা সফরকালে নজরুল রানু সোমকে তাঁদের বনগ্রামের বাসায় গানের তালিম দিতে শুরু করেন এবং তাঁদের বাসায় বসে তিনি ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন্ সোনার গাঁয়’ গানটি রচনা করেন। এ-সময়ে তিনি একদল গোঁড়া তরুণের আক্রমণের শিকার হন; তারা লাঠিসোটা নিয়ে নজরুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নজরুলের সঙ্গে তারা পেরে ওঠেনি। রানু সোম পরে কলকাতায় গিয়ে নজরুলের কাছে গান শেখেন এবং নজরুলের প্রচেষ্টায় তিনি গ্রামোফোনে ও বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ পান। নজরুলের সঙ্গে রানু সোম ওরফে প্রতিভা বসুর সম্পর্ককে ব্যঙ্গ করে শনিবারের চিঠি পত্রিকায় নজরুলের ‘কে বিদেশী মন উদাসী’ গানটির প্যারোডি ‘কে উদাসী বনগাঁবাসী’ ছাপা হয়।

১৯২৬ সালে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্যপ্রার্থী হিসেবে নজরুল নির্বাচনী প্রচারের কাজে ঢাকা হয়ে জয়দেবপুরে গিয়েছিলেন। পথে যেতে যেতে তিনি ‘চাঁদনী রাতে’ নামে কবিতাটি লেখেন। কবি আবদুল কাদিরের বিয়ে উপলক্ষে ১৯৩৪ সালের ২১ অক্টোবর কবি ঢাকায় আসেন এবং ‘বন্ধন’ শীর্ষক ‘অনন্তকাল এ অনন্তলোকে’ আশীর্বাণী রচনা করেন। নারায়ণগঞ্জ সংগীত সংসদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আববাসউদ্দীনসহ কয়েকজন শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে নজরুল ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জে আসেন ১৯৩৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর।

ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নজরুল ঢাকায় আসেন বুদ্ধদেব বসু ও একদল শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তাঁর রচনা ও পরিচালনায় ‘পূবালী’ নামে একটি সংগীত-বিচিত্রা প্রচারিত হয় ঢাকা বেতার থেকে। পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে আসার সময় রচিত ‘পদ্মার ঢেউ রে’ এবং নৌকায় ভাসমান বেদে সম্প্রদায়ের মেয়েদের দেখে লেখা ‘আমি পূরব দেশের পূরনারী’ গানগুলো সেই সংগীত-বিচিত্রার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪০ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত শচীন সেনগুপ্তের ‘ঝড়ের রাতে’ নাটকের সংগীত পরিচালনায় ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সংগত কারণে ঢাকায় কাটানো নজরুলের শেষ-জীবনের তথ্যাবলি এ-লেখার শেষাংশে তুলে ধরা হলো।

নজরুল প্রথমবারের মতো কুমিল্লায় আসেন ১৯২১ সালের ৪ এপ্রিল। আসার পথে ট্রেনে বসে তিনি লেখেন ‘নীলপরী’ নামে একটি কবিতা। দৌলতপুর যাওয়ার পথে তাঁদের যাত্রাবিরতি ঘটে কান্দিরপাড়ে, সফরসঙ্গী আলী আকবর খানের পরিচিত ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। ইন্দ্রকুমারের স্ত্রী বিরজাসুন্দরীর স্নেহে আপ্লুত হয়ে নজরুল তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন; পরে তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখেন ও তাঁর নামে বই উৎসর্গ করেন; সে-বাড়িতেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মে বিরজাসুন্দরীর দেবর বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ও গিরিবালা দেবীর মেয়ে আশালতার সঙ্গে, যাঁর ডাকনাম ছিল দোলন বা দুলি – নজরুল নিজে যাঁর নাম দিয়েছিলেন প্রমীলা। একই যাত্রায় একদিন পর দৌলতপুর গিয়ে ঘটে আরো এক নাটকীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে নজরুল পরিচিত হন আলী আকবর খানের পিতৃহীন ভাগ্নি সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে, নজরুল যার নাম দিয়েছিলেন নার্গিস। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে নার্গিসের গান শুনে ও রূপ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রেমে পড়েন। অল্পদিনের মধ্যেই দৌলতপুরে বসে অনেক কবিতা ও গান লিখে ফেলেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে : ‘অ-বেলায়’, ‘হার-মানা হার’, ‘পাপড়ি খোলা’, ‘অনাদৃতা’। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন নার্গিসকে তিনি বিয়ে করবেন। খবর পেয়ে কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদসহ কবির বহু সুহৃদ বিয়ের ব্যাপারে তাঁকে সাবধানে এগোতে পরামর্শ দেন। তাঁর ও নার্গিসের একান্ত আগ্রহে ১৯২১ সালের ১৭ জুন নজরুল-নার্গিসের ‘আক্ত’ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। অজ্ঞাত কারণে কনের মামা আলী আকবর খান কাবিননামায় শর্ত জুড়ে দেন, নজরুল নার্গিসকে নিয়ে কখনো দৌলতপুর ছেড়ে যেতে পারবেন না। এই অন্যায় আচরণ ও শর্তে মর্মাহত কবি পরের দিনই নার্গিসকে ফেলে রেখে হেঁটে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে পৌঁছেন। কিন্তু এরই মধ্যে দৌলতপুরে বসেই তিনি লিখে ফেলেন ‘বিদায়-বেলায়’, ‘বেদনা-অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক-প্রিয়া’, ‘মুকুলের উদ্বোধন’, ‘লাল সালাম’, ‘হারা-মণি’, ‘মানস বধূ’ ও ‘মনের মানুষ’ কবিতাগুলো। কান্দিরপাড়ে প্রমীলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকে কবি নার্গিসকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। জুনের শেষ সপ্তাহে তিনি কুমিল্লায় বসে ‘আজি রক্তনিশি ভোরে’, ‘ভিক্ষা দাও’ – এ দুটি দেশাত্মবোধক গান এবং ‘আমি এ-দেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তমা’ – এই প্রেমের গানটি রচনা করেন।

১৯২১ সালের ১৮ নভেম্বর নজরুল আবারও কুমিল্লায় আসেন এবং যথারীতি ওঠেন প্রমীলাদের বাসায়। সেখানে পৌঁছেই ‘বন্দনা গান’  নামে একটি গান লেখেন, যা পরে ‘বিজয় গান’ নামে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই সময়ে তিনি ‘নিশীথ-প্রীতম’ ও ‘বিজয়িনী’ নামে দুটি কবিতা লেখেন। ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত সফর উপলক্ষে দেশব্যাপী তখন হরতাল চলছে। কুমিল্লায় একটি মিছিলে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে তিনি সরকারবিরোধী গান গেয়েছেন, মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তরুণদের জন্য ‘জাগরণী’ নামে একটি নতুন কোরাস গান লিখে দিয়েছিলেন। সেই গান রচনা ও প্রচারের দায়ে একরাত তাঁকে থানায় আটকে রাখা হয়।

নজরুল তৃতীয়বারের মতো কুমিল্লায় আসেন ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এ-সময়ে তিনি প্রায় চার মাস প্রমীলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাটান। একশ্রেণির গোঁড়া হিন্দু ও উগ্র তরুণ একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে প্রমীলার এই সম্পর্ককে খারাপ চোখে দেখতে শুরু করে এবং এলাকায় এ নিয়ে বেশ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে নজরুল তাঁর ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘প্রিয়ার রূপ’ কবিতাগুলো এবং ‘শায়ক-বেঁধা পাখি’ ও ‘চিরচেনা’ গান দুটি রচনা করেন। প্রমীলার সঙ্গে তাঁর মেলামেশা নিয়ে এলাকাবাসীর উত্তেজনার কারণে জুন মাসের কোনো একসময়ে নজরুল কলকাতায় ফিরে যান। এরপর ২২ নভেম্বর প্রমীলা ও তাঁর মা গিরিবালা দেবীর সঙ্গে তিনি আবারও কুমিল্লায় আসেন এবং আসার পরদিনই পুলিশ তাঁকে আটক করে। প্রমীলার সঙ্গে সম্পর্কজনিত উত্তেজনার কারণে নয়, ধূমকেতু পত্রিকার সরকারবিরোধী ভূমিকার দায়ে তাঁকে আটক করা হয়। ট্রেনে করে পুলিশ তাঁকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যায়।

এক বছরের কারাদন্ড শেষে নজরুল জেল থেকে ছাড়া পেয়েই ১৯২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কুমিল্লায় চলে আসেন। কিন্তু প্রমীলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে এলাকার লোকজন বাড়াবাড়ি শুরু করলে তিনি গোপনে কুমিল্লা ছাড়তে বাধ্য হন। এর চার মাস পর ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতার একটি বাড়িতে প্রমীলার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কাজটি সম্পন্ন হয়।

নজরুলের বহুশিল্পিত রচনার জন্মভূমি চট্টগ্রাম। তিনি প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে আসেন ১৯২৬ সালের ২৬ জুলাই।  সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতা সেখানে রচিত হয়। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন হবীবুল্লাহ বাহার ও তাঁর বিদুষী ভগ্নি শামসুন নাহার মাহমুদকে, যাদের সান্নিধ্যে তিনি কাটিয়েছিলেন সেই দিনগুলো। ‘অ-নামিকা’, ‘গোপন প্রিয়া’, ‘শিশু যাদুকর’, ‘সিদ্ধু-প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তরঙ্গ’, ‘বাংলার আজিজ’ ও ‘কর্ণফুলী’ কবিতাগুলো তখন তিনি রচনা করেন। ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রায় পুরোটাই তিনি চট্টগ্রামে কাটান। কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে সীতাকুন্ড পাহাড়ে উঠে ও সাম্পানে চড়ে তিনি অত্যন্ত উল্লাসের মধ্যে সেই দিনগুলো কাটিয়েছেন। চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা তিনি সেখানে বসে রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’, ‘ওগো ও চক্রবাকী’, ‘বাদল রাতের পাখি’, ‘স্তব্ধ রাতে’, ‘নবীন চন্দ্র’ (অঞ্জলি পুরিয়া মম) ও ‘শীতের সিন্ধু’ কবিতাগুলো (পরবর্তীকালে ‘শীতের সিন্ধু’র নামকরণ করা হয় ‘সিন্ধু-চতুর্থ তরঙ্গ’)। এছাড়া ‘সাম্পানের গান’ (ওরে মাঝি ভাই), ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয়’ (যার মুদ্রিত রূপ ‘আমার এ না’ যাত্রী না লয়’), ‘কী হইব লাল বাওটা তুইল্লা’, ‘তোমার কূলে তুলে বন্ধু’ গানগুলোও তিনি এখানে বসে রচনা করেন।

কবির অকৃত্রিম সুহৃদ কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদের পৈতৃক নিবাস সন্দ্বীপ। ২৮ জানুয়ারি তিনি জাহাজে ও নৌকায় চড়ে সেখানে যান। বিতর্ক থাকলেও জানা যায় : তিনি তাঁর ‘খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগরজলে’ গানটি তখন রচনা করেন। ১৯৩৩ সালের ৭ মে নজরুল আবারও চট্টগ্রাম জেলা সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। বিকেলের অধিবেশনে তিনি গান ও কবিতা আবৃত্তি করেন।

নজরুল প্রথমবারের মতো ফরিদপুরে আসেন ১৯২৫ সালের ১ মে, কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দিতে। তিনি সেই সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উপস্থিতিতে অসহযোগ আন্দোলনকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘চরকার গান’ এবং এর সঙ্গে ‘শিকল-পরা ছল’ ও ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ গানগুলো গেয়ে শোনান। এ-সময়ে ঘনিষ্ঠতা জন্মে কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে। দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালের ১০ মার্চ তিনি ফরিদপুরের মাদারীপুর আসেন। মাদারীপুরে নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মিলনীর তৃতীয় অধিবেশনে ‘ধীবর’ বা ‘জেলেদের গান’ শীর্ষক ‘আমরা নিচে পড়ে রইবো না আর’ উদ্বোধনী গান হিসেবে পরিবেশন করেন। গানটি অবশ্য কৃষ্ণনগরে বসে লেখা। সেই সম্মেলনে কুমিল্লা থেকে আগত রাজনৈতিক নেতা বসন্তকুমার মজুমদার ও তাঁর স্ত্রী নারীনেত্রী হেমপ্রভার সঙ্গে পরিচিত হন। নজরুল তখন হেমপ্রভাকে নিয়ে একটি দেশাত্মবোধক গান ‘কোন অতীতের অাঁধার ভেদিয়া’ রচনা করেন। নিজের নির্বাচনী প্রচারের কাজে নজরুল আবারো ফরিদপুরে আসেন একই বছরের ৩ নভেম্বর। এবার তিনি ওঠেন কবি জসীমউদ্দীনের বাড়িতে। পানীয় হিসেবে চা তখনো এদেশে সব মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। কলকাতা থেকে নিয়ে-আসা চা বানাতে দিলে এক বাড়ির মেয়েরা পেঁয়াজ-রসুনসহ রাজ্যের সব মশলা সহযোগে রান্না করে তা কবিকে খেতে দেয়। বিষয়টি বহুদিন বহু লোকের হাসির খোরাক জুগিয়েছে।

১৯৩৬ সালের ২৭ জানুয়ারি কবি ফরিদপুর আসেন জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে সভাপতি হিসেবে যোগ দিতে; ১৯৩৮ সালে ফরিদপুর সংসদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে এবং সবশেষে ১৯৪১ সালের ১২ আগস্ট ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দিতে। অবশ্য সেই সম্মেলনস্থলে ১৪৪ ধারা জারি হওয়ায় তা পন্ড হয়ে যায়। একটি মসজিদে ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নিয়ে নজরুল কলকাতায় ফিরে যান।

১৯২৭ সালের ১৫ থেকে ২০ জুন তিনি  উষ্ণ সংবর্ধনা পান নোয়াখালিতে। আটটি ঘোড়ায়-চালিত এক শৌখিন গাড়িতে চড়িয়ে সোনাপুর রেলস্টেশন থেকে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় খাদেমুল ইসলাম অফিসে; পথে পথে নির্মিত হয়েছিল সুসজ্জিত বহু তোরণ: এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁকে উপহার দেওয়া হয় সোনার তৈরি দোয়াত ও কলম; লক্ষ্মীপুরের জেলেরাও তাঁকে সংবর্ধনা জানান। সেখানে তাঁকে উপহার দেওয়া হয় রুপার তৈরি মালা ও বাটি। এমন প্রাণঢালা সংবর্ধনা পেয়েছেন তিনি সিলেটেও ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে। সেখানকার পর্দাপ্রথার কঠিন নিয়ম ভঙ্গ করে বহু মুসলমান নারী তাঁর অনুষ্ঠানে যোগ দিলে গোঁড়া মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে; কিন্তু দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ও অন্য তরুণদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

আমাদের উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের এবং পশ্চিম সীমান্তের জেলাগুলোতে নজরুল প্রায়ই আসতেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩২ সালের বিভিন্ন সময়ে তিনি দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর ও বাকেরগঞ্জে এসেছেন একাধিকবার। বিভিন্ন সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যোগদান কিংবা তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা উপলক্ষে এসব সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছেন কবি। এসব সফরের সময় রচিত কোনো কবিতা বা গানের কথা আমাদের জানা নেই। তবে ১৯২৮ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি রংপুরের হরগাছায় বসে ‘ভোরের পাখী’ কবিতাটি লিখেছেন।

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়ে যে-নজরুল এতকিছু লিখেছেন, কারাবরণ করেছেন, জাপানকে পরাজিত করার কাজে সহায়তা করলে ব্রিটিশরা চলে যাবে সে-আশ্বাসে ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধেও গিয়েছেন, সেই তিনি ১৯৪৭-এর বিতর্কিত স্বাধীনতা ও ১৯৭১-এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা কিছুই দেখে যেতে পারেননি, যদিও শারীরিকভাবে তিনি বেঁচে ছিলেন। এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪২ সাল থেকেই তিনি বোধশক্তি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তবে, বলতে গেলে এরপরই বাংলাদেশে নজরুল-চর্চা আরো বেগবান হয়ে ওঠে। বাংলা একাডেমীসহ বহু প্রকাশনা সংস্থা থেকে নজরুলের বইগুলোর নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হতে থাকে এবং বিভিন্ন জায়গায় তাঁর জন্মজয়ন্তী উদযাপিত হতে শুরু করে। ১৯৬৩ সাল থেকে বেতারে তাঁর গান ‘নজরুল গীতি’ হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদা পায়। ১৯৬৪ সালের ২৪ মে ঢাকায় নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালে নজরুলের জীবন ও কর্ম নিয়ে আমাদের দেশে সরকারি উদ্যোগে বিদ্রোহী কবি নামে প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়।

১৯৭১ সালে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় বোধশক্তিহীন নির্বাক কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০-বি ভবনটি এবং একটি গাড়ি কবির নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ডাক্তার-নার্সসহ সেবা-শুশ্রূষার সবরকম ব্যবস্থা করা হয়। ভবনটির নতুন নাম রাখা হয় ‘কবিভবন’ যা এখন আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউট। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। একই বছর তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় এবং ‘চল চল চল’ গানটি আমাদের রণসংগীতের মর্যাদা পায়।

স্থায়ীভাবে এদেশে আসার পর প্রতি বছর কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কবিকে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছেন এদেশের মানুষ। কিন্তু সেসব ‘ফুলের জলসায়’ও নীরব ছিলেন কবি। অবশেষে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কবিকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।  বিশেষ মেডিকেল বোর্ড গঠন করে কবির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর কিছুদিন পরে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশের মানুষ কবির শেষ ইচ্ছাও পূরণ করেছে। ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’ গানটিকে স্মরণে রেখে স্মরণাতীতকালের এক বিশাল জানাজা শেষে একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সামরিক মর্যাদায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু নেই; এদেশের শিল্প-সংস্কৃতির মূলধারায় নজরুলের সৃষ্টিকর্ম হারাবে না তার চিরন্তন প্রবহমানতাকে। আজও তিনি বেঁচে আছেন বেঁচে থাকবেন বহুকাল তাঁর কবিতায়, আর গানে গানে। r