বাঁধন সেনগুপ্ত
একদা প্রাচীন হুগলী জেলার পশ্চিমে ছিল একটি গ্রাম – বনবিষ্টুপুর। আসল নাম বনবিষ্ণুপুর। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার সেই গ্রামেই ছিল শ্রীমতী রাজবালা দেবীর পূর্বনিবাস। চাটুজ্জে রাজবালার মতোই সেই গ্রামে ছিল একাধিক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের বসবাস। শতাব্দীর শেষভাগে ভয়াবহ এক ঝড়ের তান্ডবে বনবিষ্টুপুর গ্রামটি প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। শোনা যায়, জনৈকা ব্রাহ্মণ মহিলা ছিলেন সেই গ্রামের একমাত্র জীবিত বাসিন্দা। তিনিই অবশেষে ঝড়ের শেষে কোলের শিশুকন্যাটিকে নিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান এবং বসতবাড়ির বাইরে সারারাত জেগে কাটান। ভোর হওয়ার পর ঝড়ের শেষে অবশ্য তারও মৃত্যু ঘটে। দৈবক্রমে তাঁর কোলে আগলে রাখা শিশুকন্যাটি কোনোক্রমে বেঁচে থাকে। ঝড় থামার পর দেখা যায়, সেই ব্রাহ্মণ পরিবারটির বাড়িঘরও ঝড়ের তান্ডবে উধাও এবং পরিবারের সকলেই মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। জীবিত অন্য গ্রামের প্রতিবেশীরা এসে শিশুকন্যাটিকে মৃত ব্রাহ্মণীর কোল থেকে তুলে নিয়ে অবশেষে নিজের বাড়িতে এনে মানুষ করতে থাকেন। জীবিত প্রতিবেশীরা ছিলেন প্রধানত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত। ফলে বড় হয়ে ওঠার পর সেই কন্যাটিও বৈষ্ণব হিসেবেই পরিচিতি লাভ করতে থাকে। গ্রামের পরিজন হারানো কন্যাটিকে সকলে ‘পুঁটি বোষ্টমি’ বলে ডাকত। ‘পুঁটি’ নামটি অবশ্য সেই বৈষ্ণব পরিবারেরই দেওয়া। পুঁটির বয়স যখন এগারো, তখন গ্রামেরই মুখার্জি বংশীয় জনৈক সুশ্রী এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়। পুঁটি তখনই দেখতে ছিল অপূর্ব সুন্দরী। তার বৈষ্ণব স্বামী তাকে বিয়ে করে কিছুকাল পরেই বনবিষ্টুপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে পাথুরিয়াঘাট অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু বিয়ের মাত্র বছরতিনেক বাদেই পুঁটিরানীর স্বামীর অকালমৃত্যু ঘটে। এসবই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকের কথা।
অসহায় পুঁটি তখন কলকাতায় বাধ্য হয়ে পাথুরিয়াঘাট অঞ্চলের আশপাশে আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরতে থাকে। এই সময় প্রতিবেশী মুরলী আঢ্য নামে ধনবান এক ব্যক্তি বিধবা পুঁটিরানীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। তিনি মালোপাড়ায় পুঁটিকে মৃত্যুর আগে দুটি বাড়ি লিখে দিয়ে যান। পুঁটির পনেরোটি সন্তানের মধ্যে তখন চারটি সন্তান শুধু মুরলীর মৃত্যুর সময় বেঁচে ছিল। অবশ্য আশ্রয়দাতা মুরলী আঢ্যের মৃত্যুর কিছুকাল পরে পুঁটিরও মৃত্যু হয়।
মৃত পুঁটিরানীর জীবিত চারটি সন্তানের নাম যথাক্রমে হরিমতী, মতিবালা, তিনকড়ি ও রাজবালা। মায়ের মৃত্যুর সময়ে রাজবালার (জন্ম ১৮৮৭) বয়স ছিল মাত্র চার মাস। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মালোপাড়ায় পুঁটিরানী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল বলে জানা যায়।
অচিরেই এই চারটি সন্তান পুনরায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। কেননা, মুরলী আঢ্যের নিকটাত্মীয়রা এসে পুঁটিরানীকে দেওয়া মালোপাড়ার বাড়ি দুটো দখল করে নেয়। ফলে পুঁটির চারটি নাবালক সন্তান আশ্রয়চ্যুত হয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকে। মুরলীর দুটি পাকা বাড়ির মধ্যে কোনোমতে একটি পুঁটি বসবাসের জন্য রেখে অন্য বাড়িটি ভাড়া দিয়ে সে-সময় সংসার চালাত। গৃহতাড়িত আশ্রয়চ্যুত চারটি অসহায় সন্তানের দিকে তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন পাড়ার খুদিরানী নামে এক মহিলা। তাঁকে পল্লিতে সবাই ‘ছোটবাবু’ বলে ডাকত। খুদির আশ্রয়ে থেকে রাজবালা ও তার ভাইবোনরা ‘বড়সড়’ হয়ে উঠতে থাকে। তারা সারাদিন মালোপাড়ায় ঘুরে বেড়াত। খুদির স্নেহে তাদের দুধে-ভাতেই দিন কাটত তখন। আশ্রয়হীন চারটি ছেলেমেয়ে যখন রাস্তায় বাস্ত্তচ্যুত হয়ে দিন কাটাচ্ছিল, তখন খুদি দয়াপরবশত তাদের নিজের বাড়িতে এনে তুলেছিলেন। ছোটবাবুর পেশার কথা সকলেরই জানা ছিল। কিন্তু দুর্দিনে সেই খুদিরানীই একমাত্র সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে পুঁটির চারটি সন্তানকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যৌবনের আগমনে তাদের দিকে পাড়ার অনেকের নজর পড়তে শুরু করে। ক্রমশ বড় হয়ে-ওঠা বড় মেয়ে হরিমতীর সঙ্গে এ-সময় তাই রামবাগান অঞ্চলের জনৈক ব্যক্তির বিয়ের ব্যবস্থা করেন খুদিরানী।
প্রাচীন রামবাগান অঞ্চলকে তখন বলা হতো ‘রূপোগাছি’। পাশেই হাতিবাগান এবং অদূরে ভাল্লুকবাগান। ভাল্লুকবাগান পরে লোকমুখে ‘সোনাগাছি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। বিয়ের কিছুকাল পরেই অকস্মাৎ হরিমতীর স্বামীর মৃত্যু হয়। তখন হরিমতী জনৈক পুরুষের সঙ্গে গোপনে ঢাকায় পালিয়ে যায়। হরিমতী অবশ্য বিয়ের পর বোন মতিবালা, রাজবালা ও ভাই তিনকড়িকে স্বামীর সংসারে এনে আশ্রয় দিয়েছিল। হরিমতী ঢাকায় চলে যাওয়ার পর পুনরায় এই তিনজন অসহায় হয়ে পড়ে। হরিমতীর স্বামীর পরিবারের লোকজন তাদের দায়দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। বাধ্য হয়ে তাদের আশ্রয়ের সন্ধানে বেরোতে হয়।
ঘটনাচক্রে কলকাতায় সে-সময়ই ‘দি গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’ দল গড়ের মাঠে এসে তাঁবু ফেলেছিল। একে বলা হতো Bose’s Circus. ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রিয়নাথ বসু এর প্রতিষ্ঠা করেন। সার্কাসের দল নিয়ে তিনি প্রথমে ঢাকা, ঝালকাঠি, বরিশাল হয়ে শান্তিপুর, দাঁইঘাট, কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে সার্কাস প্রদর্শন করার পর কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন। তখন গড়ের মাঠেই সার্কাস দলের সদস্যরা অবস্থান করতেন। প্রিয়নাথের দাদা মতিলাল বসু ১৯১০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মারা যান মাত্র ৪৩ বছর বয়সে। মতিলাল অবশ্য ছিলেন চিররুগ্ণ এবং বহুমূত্র রোগী। তা সত্ত্বেও অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে তাঁকে ওই বয়সেই হারালেন দাদা প্রফেসর প্রিয়নাথ বসু। কলকাতায় অবস্থানকালে সেবার সার্কাস দলের পক্ষ থেকে শহরে পত্রপত্রিকায় ও বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে তাতে নতুন ছেলেমেয়ে নেওয়ার কথা জোরালোভাবে প্রচার করা হয়েছিল। অভাবের তাড়নায় বাস্ত্তচ্যুত আশ্রয়হারা দুই বোন মতিবালা ও রাজবালা এবং ছোট ভাই তেনা অর্থাৎ তিনকড়ি তাই বোসের সার্কাস দলে গিয়ে নাম লেখাতে দ্বিধা করল না। সার্কাসের মালিক তখন প্রফেসর মতিলাল বসু। মতিলাল ছিলেন চবিবশ পরগনার জাগুলিয়া গ্রামের অধিবাসী। জাগুলিয়া হরিণঘাটা সংলগ্ন একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এ-গ্রামেরই সন্তান ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাস। মতিলাল অবশ্য কলকাতায় হাতিবাগান সংলগ্ন ভাল্লুকবাগানে বসবাস করতেন। তাঁর বাবা ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম এক কৃতী পুরুষ কবি ও নাট্যকার মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২)। মনোমোহন জন্মেছিলেন ১৮৩১ সালের ১৪ জুলাই যশোর জেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে। পিতা দেবনারায়ণ বসু। মনোমোহন মাত্র বছরতিনেক বয়সেই হারান পিতা দেবনারায়ণকে। মনোমোহনের কবিতা নিয়মিত সেকালে ছাপা হতো ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-সম্পাদিত সম্বাদ প্রভাকর পত্রিকায়। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম কবিতাও ছাপা হয়েছিল এ-পত্রিকায়। মনোমোহন ছিলেন বন্ধু কবি মাইকেল মধুসূদনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অনুরাগী। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন কলকাতায় জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় বন্ধু মনু অর্থাৎ মনোমোহন মাইকেলের পাশে উপস্থিত ছিলেন। মাইকেল মৃত্যুর আগে বন্ধু মনুর হাত দুটি ধরে অনুরোধ করে বলেছিলেন – If you have one bread, you must divide it between yourself and my children, if you say, I will, I deport with consolation. মনোমোহন মাইকেলের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পাদিত মধ্যস্থ পত্রিকায় মাইকেলের পরিচয়, কীর্তি ও মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে অবশেষে দেশবাসীর কাছে ‘কবি মাইকেলের নিরাশ্রয় পুত্রদ্বয়ের সাহায্যার্থে চান্দা’ প্রার্থনা করে অর্থ সংগ্রহের আবেদন জানিয়েছিলেন। তাতে সিরাজগঞ্জের মুসলিম অনুরাগীদের কাছ থেকে যথেষ্ট সাড়া মেলায় মনোমোহন অভিভূত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে, সিরাজগঞ্জের গোলাম রসুল খাঁ, নজাহেরউল্লা, আবদুল রহমান খাঁ, মৌলভী জিনতুল্লা খাঁ, নেজারতুল্লা খাঁ, মিছিল ইলিম খাঁর বিপুল সাহায্য প্রেরণের সংবাদ মধ্যস্থ পত্রিকা প্রকাশ করেছিল। মাইকেলের জন্যে সংগৃহীত সমস্ত অর্থই ডব্লিউসি ব্যানার্জির সাহায্য ফান্ডে মনোমোহন পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
মনোমোহনের তিন ছেলের নাম – প্রবোধ, মতিলাল ও প্রিয়নাথ। সেকালে মনোমোহন বসু হিন্দুমেলায় (এপ্রিল ১৮৭৩) জাতীয় ব্যায়ামশালায় প্রদর্শনীতেও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ দুই খন্ডে পদ্যমালা (১৮৭০) ছাড়াও ছোটদের জন্য লেখা ছড়া ও কবিতাগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তিনি ছিলেন বিবেকানন্দের বন্ধু ও সহপাঠী।
বোসের সার্কাস দলে যোগ দেওয়ার পর পুত্র মতিলালের সময়ে রাজবালা সার্কাসে ট্রাপিজের ও ব্যালেন্সের খেলায় শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে অত্যন্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে সুনাম অর্জন করেছিল। তিনকড়ি ও তার দুবোন মতিবালা ও রাজবালা যখন বোসেস সার্কাস দলে যোগ দেয়, তখন দলে ম্যানেজের ছিলেন সার্কাস জগতের স্বনামধন্য মনসাবাবু অর্থাৎ মনসাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সার্কাস কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পরেও রাজবালার ঠিকানা ছিল ১৫/১ নং দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট পাথুরিয়াঘাট, কলকাতা। পুঁটিরানীর মৃত্যুর সময়ে এটাই ছিল রাজবালার প্রথম ঠিকানা। খুদিরানীর মৃত্যুর পর বিতাড়িত ভাইবোনরা গৃহহীন না, আশ্রয়হীন হলেও খুদিরানী বা ছোটবাবুর ঠিকানাই তারা ব্যবহার করত দীর্ঘকাল।
রাজবালার প্রদর্শিত অন্যতম জনপ্রিয় একটি খেলা ছিল আটটি টেবিলের ওপরে ধাপে ধাপে উঠে আসার ব্যালেন্সের খেলা। বোতলের ওপর রাখা একের পর এক আটটি টেবিলে ভর করে রাজবালা দেহটি ওপরে তুলে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে উলটে দিত। নিচের টেবিল থেকে তারপর সাবলীল ভঙ্গিতে মুখ দিয়ে প্লেট থেকে কাটলেট বা চপ তুলে নিয়ে রাজবালা তা খেয়ে ফেলত। তা দেখেই দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে যেত। তাকে সেকালে তাই বলা হতো boneless রাজু। খেলার নৈপুণ্যের গুণে ‘রাজু’ বা রাজবালা মালিক গ্র্যাজুয়েট মতিলালের নজরে পড়ে যায়। ক্রমশ মতিলাল রাজবালার সৌন্দর্য ও রূপে মুগ্ধ হয়ে তার পাণিপ্রার্থী হন। মতিলালের বয়স তখন ৪০। আর রাজবালার বয়স মাত্র ১১। অবশেষে সার্কাস দলের উজ্জ্বয়িনী সফরকালে সেবার উভয়ের সম্মতিতে সেখানকার এক কালীমন্দিরে গিয়ে মন্দিরের পুরোহিতের উপস্থিতিতে ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মালাবদল করে তাঁরা বিয়ে করেন। মাসকয়েক পরই নভেম্বর মাসের গোড়ায় (১৮ কার্তিক ১৩০৫ বুধবার) রাজবালার একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। মতিলাল-রাজবালা নবজাতিকার নাম রাখেন ইন্দুবালা। পরবর্তীকালে এই মেয়েটিই সংগীতসম্রাজ্ঞী নামে পরিচিত হয়।
সেবার সফর শেষে কলকাতায় ফিরে এসে বিবাহিতা রাজবালা মেয়েকে নিয়ে ২১নং দয়াল মিত্র লেনের বাড়িতেই বসবাস করতে থাকেন। মেয়ের টানে সার্কাসের প্রতি রাজুর আকর্ষণ ক্রমেই কমে আসতে থাকে। মতিলাল তাঁর নিজের সংসার ও সার্কাস নিয়েই তখন ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু কলকাতায় থাকলে তাঁর আদরের কন্যা ইন্দুকে দেখতে নিয়মিত আসতেন তিনি। ভাল্লুকবাগানের পৈতৃক বাসাতেই ছিল তাঁর আসল ঘর-সংসার। তাই বাধ্য হয়ে সার্কাস ছেড়ে রাজবালা এবার গানবাজনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। গানের গলাটি ছিল তার চমৎকার। ছোটবেলা থেকেই তাঁর নিয়মিত গান-বাজনার চর্চাও ছিল। সংগীত-সাধনার গুণে রাজবালা বাংলা পুরাতনী, কীর্তন ও টপ্পাঙ্গের গানে দ্রুত দক্ষতা অর্জন করতে সমর্থ হন। ফলে বিভিন্ন আসরে সংগীত পরিবেশনায় তার মুন্শিয়ানার খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘকাল সংগীত পরিবেশন করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে থাকেন রাজবালা। সেইসঙ্গে মেয়ে ইন্দুবালার অল্প বয়স থেকেই গান-বাজনার তালিম চলতে থাকে। বস্ত্তত বিয়ের বছরতিনেক বাদেই মতিলালের সঙ্গে রাজবালার সম্পর্ক শিথিল হতে শুরু করে। ফলে ইন্দুবালার সমস্ত দায়িত্ব তার ঘাড়ের ওপরই এসে পড়ে। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি মতিলালের মাত্র ৫৩ বছর বয়সে প্রয়াণ ঘটে। তার আগে শ্যালক তিনকড়িকে মতিলাল হাতিবাগান (ভাল্লুকবাগান) বাড়িতে ডেকে ইন্দুবালার খোঁজখবর নিতেন ও টাকা-পয়সা পাঠাতেন। কিন্তু রাজবালার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ আর লক্ষ করা যায়নি। ফলে রাজবালা সংগীতের মাধ্যমে তাঁর সংসার চালাতে বাধ্য হন। মতিলালের মৃত্যুর পর সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
মতিলাল নিজেও সংগীতবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। বিয়ের পর রাজবালা তাঁর স্বামীর কাছ থেকেই প্রেরণা লাভ করেন। তাঁর কাছ থেকেই ধ্রুপদাঙ্গের বহু গান শেখার সুযোগ তিনি লাভ করেছিলেন। সম্পর্ক আলগা হওয়ার পর রাজবালা তার গানে সংগত করার জন্যে আমন্ত্রণ জানান সেকালের শ্রেষ্ঠ পাখোয়াজ-বাদক দুলী ভট্টাচার্যকে। রাজুর বাড়িতে আয়োজিত প্রাত্যহিক সান্ধ্য-আসরে যোগ দিতে উপস্থিত হতেন তখন গোবিন্দপ্রসাদ মিশ্র, লছমিপ্রসাদ সিংহ, গোবিন্দ গুরু, কেশবপ্রসাদ মিত্র, চন্ডি বন্দ্যোপাধ্যায়, রজনীবাবু, ছোটো ও বড়ো দুলী খাঁ, অন্ধ সাতকড়ি ওস্তাদ, গিরিবালা, বিড়ালহরির মতো সেকালের প্রথিতযশা শিল্পীরা। রাজুর মেহফিলের তখন খুবই সুনাম।
পাশাপাশি থিয়েটারজগৎ স্বামীর বিচ্ছেদপর্বে রাজবালাকে কাছে টানতে থাকেন। নিজেকে অভিনয়জগতের সঙ্গে এবার যুক্ত করতে আগ্রহী হন রাজু। গানের জগতে পরিচিত রাজবালার কাছে সার্কাস তখন অতীতের ক্ষতি। তাই মতিলালের মৃত্যুর এক বছর আগেই রাজবালা পেশাদারি থিয়েটারে যোগ দিতে এগিয়ে আসেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম মিনার্ভা থিয়েটারে যোগ দিয়ে গিরিশচন্দ্রের শঙ্করাচার্য্য নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন। গিরিশচন্দ্র তখন প্রফুলল, হারানিধি, বলিদান মঞ্চস্থ করে সুনাম অর্জন করলেও শাস্তি কি শান্তি তেমন সাফল্য না পাওয়ায় ভক্তিমূলক নাটক রচনায় হাত দিয়ে প্রথম লিখেছিলেন তাঁর বেদান্তবিষয়ক সফল নতুন নাটক শঙ্করাচার্য্য। রিহার্সেল শেষে গিরিশচন্দ্র স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায় কালীধামে চলে যান। মহলার দায়িত্ব দিয়ে যান তিনি রাধামাধব কর ও হরিভূষণ ভট্টাচার্যকে। যদিও একমাত্র পুত্র দানীবাবুই অর্থাৎ সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ কালীতে গিয়ে পিতা গিরিশচন্দ্রের কাছেই মহলা দিয়ে ফিরে এসে নাটকে অংশ নিয়েছিলেন।
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে মঞ্চস্থ শঙ্করাচার্য্য নাটকে ‘মহামায়া’র চরিত্রে অংশ নিয়েছিল রাজবালা। সেকালের বিশিষ্ট শিল্পীরা এতে অভিনয় করেন। যেমন – সরোজিনী (নেড়া), সরযুবালা, হেমন্তকুমারী, নীরদাসুন্দরী, সুবাসিনী, চারুশীলা, ছোট শ্রীমতী, তিনকড়ি প্রমুখ। ছিলেন দানীবাবু, প্রিয়নাথ, পান্নালাল, সতীশচন্দ্র, সাতকড়ি, প্রমথনাথসহ সেকালের বিশিষ্ট অভিনেতারা।
শিল্পী রাজবালা-অভিনীত অন্য নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল – ১. তপোবন (গিরিশচন্দ্র-রচিত) ১৯১১ ও ২. রৈবতক (মডার্ন থিয়েটার নাট্য সম্প্রদায়-পরিবেশিত) ১৯২৪। মাঝে তেরোটি বছর মেয়ে ইন্দুবালার অভিভাবিকা হিসেবেই রাজবালা ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং মেয়ের গানের আসরে উপস্থিত থাকার ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে মঞ্চে অনুপস্থিত থাকতে হয়েছে।
এর আগে মাত্র ছয় বছর বয়সেই রামবাগানে মেয়েদের যাত্রাদলে রাজবালাকে ১৮৯৩ সালে গঙ্গা আনয়ন পালায় ভগীরথের ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করতে দেখা গেছে। হরিদাসী নামে এক মহিলা ছিলেন তাঁর পরিচালিকা। হরিদাসীর দলকে সেকালে রামবাগানে বলা হতো – ‘রাজা হরির দল’। এছাড়া বিশের দশকে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে গঠিত রামবাগানের বাঙালিনী থিয়েটারেও রাজবালা অংশগ্রহণ করেছিলেন। নাটকের নাম ছিল নরমেধ যজ্ঞ। রাজবালা ছিলেন যযাতির ভূমিকায়। অর্থ সংগ্রহ করে পরে তাঁরা গঠন করেছিলেন ‘রামবাগান নারী সমিতি’ (১৯২০)। জনসেবা ছিল এই সমিতির কাজ।
এর বছর দুই বাদে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে রাজবালার নেতৃত্বে গঠিত হয় রামবাগান ফিমেল কালী থিয়েটার। ‘ফিমেল কালী থিয়েটার’ রাজবালার অপূর্ব এক সৃষ্টি। দলের নামটিও বেশ মজার। মোট বারোটি নাটক এখানে মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। সম্পূর্ণ মহিলাদের দ্বারা অভিনীত দলের প্রথম দুটি নাটকের নাম ছিল বিল্বমঙ্গল ও হীরের দুল।
রামবাগান ফিমেল কালী থিয়েটারের বারোটি নাটকের মধ্যে আছে : ১. বিল্বমঙ্গল, ২. হীরের দুল, ৩. খাস দখল, ৪. নরমেধ যজ্ঞ, ৫. বরুণা, ৬. পলিন, ৭. হীরেমালিনী, ৮. কুঞ্জ দরজি ৯. আলিবাবা, ১০. রেশমী রুমাল, ১১. পরদেশী ও ১২. চন্দ্রগুপ্ত। এর মধ্যে মা ও মেয়ে একসঙ্গে ছয়টি নাটকে অংশগ্রহণ করেন। যেমন –
নাটক চরিত্র (রাজবালা) চরিত্র (ইন্দুবালা)
১. বিল্বমঙ্গল বিল্বমঙ্গল পাগলিনী
২. নরমেধ যজ্ঞ রাজা যযাতি কাত্যায়নী
৩. খাস দখল মোহিত গিরিবালা
৪. বরুণা পুন্ডরীক বরুণা
৫. পলিন হাসান পলিন
৬. আলিবাবা আলিবাবা সাকিনা
সেই রামবাগান ফিমেল কালী থিয়েটারের অর্থ অবশ্য জোগান দিয়েছিলেন কলকাতার সেকালের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী বদ্রীদাস ক্ষেত্রী। প্রতিবেশী জীবনকৃষ্ণ ঘোষও তখন এ-ব্যাপারে রাজবালাকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। তাঁর ছিল সোনা-রুপার দোকান। অসহায় রাজবালাকে মতিলালের অনুপস্থিতিতে তিনিই আশ্রয় দেন। তাঁর ব্যবসাতেই সর্বত্র আমন্ত্রণমূলক ‘কল-শো’র আয়োজন হতো। দল যখন সুনামের শীর্ষে, তখন একবার খড়গপুরে ‘কল শো’ করতে গিয়ে ফিমেল থিয়েটার প্রবল ক্ষতির সম্মুখীন হয়। চরম বিপদের দিনে বদ্রীদাসই দলকে সমস্ত ক্ষতিপূরণের হাত থেকে উদ্ধার করেন। কিন্তু তার কিছুকাল পরেই রামবাগান ফিমেল কালী থিয়েটার দলটি রাজবালা তুলে দিতে বাধ্য হন। দলের বয়স তখন ছিল দুবছর।
অবশ্য ১৯২৪ সালেই রাজবালা পুনরায় নতুন নাট্যদল ‘মডার্ন থিয়েটার’ গড়ে তোলেন। এরা কলকাতার আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে প্রথম মঞ্চস্থ করেছিল নবীনচন্দ্র সেনের লেখা বিখ্যাত নাটক রৈবতক। রাজবালা ‘সুলোচনা’র চরিত্রে অংশ নেন। অন্যদের মধ্যে ছিলেন – রবীন্দ্রনাথ বসু (অর্জুন), লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্র (বাসবী), প্রভাসচন্দ্র ঘোষ (শ্রীকৃষ্ণ), শরবিন্দু ঘোষ (দুর্বাসা), পান্নারানী (সুভদ্রা), তারাসুন্দরী (শৈলজা), সত্যবালাসহ (সত্যভামা) অন্য শিল্পীরা।
স্বেচ্ছায় এরপর সাধারণ রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে সরে আসেন রাজবালা। মেয়ে ইন্দুবালা তখন প্রতিষ্ঠার চূড়ায়।
অবশ্য এরও বছরদশেক পরে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজবালা একটি বাংলা ছবিতে অভিনয়ে অংশ নেন। ছবির নাম – রাতকানা। এ-ছবির প্রযোজক ছিলেন বজরঙ্গলাল খেমকা। ডবল ভার্সানের এই রাতকানা ছবিতে রাজবালা কালো বউয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেকালের বিখ্যাত সিনেমা পত্রিকা দীপালীতে ১৯৩৫ সালের ৮ আগস্ট এ-ছবির চরিত্রলিপিসহ অন্যান্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে আছে –
রাতকানা
(বাংলা ও হিন্দিতে Double Version)
গল্প : রায় শ্রীনির্ম্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায় বাহাদুর
প্রযোজক : বি এল খেমকা
আলোকচিত্র ও পরিচালনা : শ্রীযতীন দাস
মুক্তিপ্রাপ্ত : ৩ আগস্ট ১৯৩৫, রূপবাণী
অভিনয়াংশে : রঞ্জিত রায়, কেষ্ট মুখোপাধ্যায়, সুহাস সরকার, রাজবালা, দুনিয়াবালা, পূর্ণিমা দেবী, ইন্দুবালা, নগেন্দ্রবালা ও কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায়।
রাতকানা ছবির বিশ্রামপর্বে একটি প্রেস কনফারেন্সে আমন্ত্রিতদের জলযোগে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বলে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সমালোচকরা এ-ছবির রিভিউতে রাজবালাকে কখনো ‘রাজুবালা’ বা ‘ইন্দুবালার মাতা’ অথবা ‘রাজু’ বলেও উল্লেখ করেছেন। রিভিউতে খেয়ালী পত্রিকা লিখেছিল, চিত্রামোদীদের কাছে আমরা একটি মজার খবর জানাচ্ছি। খবরটি হচ্ছে, শ্রীমতী ইন্দুবালার মা এই ছবিতে একটি ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য মনোনীত হয়েছেন। দেখা যাক, এবার মা হারে, কি মেয়ে হারে!
নাট্যমঞ্চ থেকে অবসর নেওয়ার পর বিস্মৃতপ্রায় প্রতিভা রাজবালা বেঁচেছিলেন আরো প্রায় অর্ধশতককাল। এমনকি, রাতকানা ছবির পরেও সার্কাসের এই বিস্ময়বালিকা রাজু বেঁচেছিলেন আরো প্রায় ৩৪টি বছর। অবশেষে ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২১ যোগেন দত্ত লেনে তাঁর মেয়ে সংগীতসম্রাজ্ঞী ইন্দুবালার বাড়িতে উত্তর কলকাতায় রাজবালা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। তখন তাঁর বয়স প্রায় ৮২। বিনোদিনী মারা গিয়েছেন মাত্র ১৫ বছর আগে নিঃশব্দে-নীরবে। রাজবালাও অর্ধশতাব্দীকাল কাটিয়েছিলেন – নিঃশব্দে, আড়ালে। নটীবিনোদিনীর মতোই জীবিতাবস্থায় বা তার পরে কেউ তাঁদের পুরস্কৃত করেনি বা মনে রাখেনি। অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনে তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা কন্যা প্রতিভাময়ী গায়িকা, অভিনেত্রী ইন্দুবালার জন্যে গর্ব ও অহংকার। সেই অহংকারই তাঁকে দীর্ঘজীবী করেছিল।
প্রয়াণের আগে রাজবালার সঙ্গে প্রায় এক দশকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, আলাপ ও হৃদ্যতার মাধ্যমে পেয়েছিলাম তাঁর আশীর্বাদ ও স্নেহ। তাঁকে ডাকতাম ‘বড়মা’ বলে। আপনি বলে তাঁকে তাই কখনো সম্বোধিত করিনি। এ-রচনায় সেই স্মৃতির দায় মাথায় নিয়েই আপনি বর্জন করেছি সচেতনভাবেই। কেননা, ইন্দুমা ও বড়মা রাজবালা যে অজান্তে স্বজনে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন সানন্দে ও স্বেচ্ছায়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.