মুল্লুকতাজ

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

তখনো অঘ্রানের শীত-শীত বিকাল শেষ হয় নাই – আমন ধানকাটার মৌসুম লেগেছে; ইরিধান, সরিষা, গোল আলু, মিষ্টি আলু, খেসারি ডাল রোপণের সিজনেই আবদুল কুদ্দুস আবারো বিভ্রান্ত হয়; – এর কারণ হচ্ছে, মুল্লুকতাজের যেই ছবিগুলো খুঁজছে, তা সে পাচ্ছেই না। তার সামনে তাইজুল মিয়া ওরফে মুল্লুকতাজের বিস্তৃত একটা জীবন আছে – সেখানে স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করা থেকে শুরু করে জীবনের অনেক দিক যুক্ত আছে। কত যুদ্ধ তার জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। নিজের পড়াশোনা নিজে-নিজে করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের বছরে তিনি নিজের হাতে কাপড় কেচেছেন, মাইলের পর মাইল হেঁটে-হেঁটে মুক্তিযোদ্ধার কান্ধে হাত রেখে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তার স্ত্রীর সঙ্গে ওই সময় দুইটার বেশি যে কথা যে বলে নাই, সে-সম্পর্কীয় কিছু ছবি থাকলে দারুণ হতো! এমনকি তিনি যখন কারাগারের ভেতর রক্তে-রক্তে ভিজে মরে পড়ে থাকলেন, তার রক্তে যখন দেশ ভেসে গেল, সেই ছবিটাও তো সে ম্যানেজ করতে পারছে না। মানুষটার মরামুখের ছবি কি আছে? ছবির সিরিয়াল হিসাব করে খুঁজতে গেলে মানুষটাকেই তো সে পুরোপুরি পায় না। তাহলে সে তথ্যচিত্রটা বানাবে কী করে?

এমনই একসময়ের সোহনপুরের ইতিহাসের দিকে নজর দেবো আমরা, – এবং তখনই আমাদের মনে হবে, সোহনপুরের ইতিহাসের সঙ্গে ছবি যুক্ত আছে, তার নাম তাইজুল মিয়া ওরফে মুল্লুকতাজ। সেই সময়টার সঙ্গেই তো মানুষটা মিশে আছে। তবে যেই সময়ে আবদুল কুদ্দুস মারফত আমরাও বিভ্রান্ত হই, এবং আমরা সোহনপুরের বিকাল দেখি, কাঁচা সোনার মতো রোদ দেখি, রোদের মজা-মজা ভাব দেখি, – এবং আমরা একটা সময়কে স্মরণ করি। মুল্লুকতাজ-প্রযোজিত এক-একটা খোয়াবের কথাও আমরা বলি। আসলে এই শীত-শীত বৈকালে আমরা তো আর কিছু পাই না। আমরা বদলে যাওয়া সময়কে বারবার পরখ করতে থাকি। আমরা সময়ের কাছের সময়ের মুল্লকতাজ-বিরচিত সেইসব সময় কামনা করি। আমরা বারবার সেইসব সময়ের কথা বলি, যেই সময়ে একদা শীতের সময়ে সরিষা হওয়ায় সারাগ্রাম কীভাবে হলুদে হলুদে সয়লাব হয়ে যেত। তা তো ছবিহীন আকারে সোহনপুরে ছড়িয়ে থাকে। হলুদ রঙের ফসলের প্রভাবে কী করে একটা জনপদের নাম সরিষাপুর হয়, আমরা তা নিয়ে গপসপ করি। সেই জনপদ একসময় সময়ের ভেজাইল্যে বাঁকে পড়ে। তার নামে বদল ঘটে, একাত্তরের শহিদ মোতালেবের নাম অনুসরণে তার নাম মুতালেবপুর হতে-হতেও হয় না। একটা লম্বা সময় আমরা নানাভাবে বদল হতে থাকা দেখি। সেই সময়ের মহারাজ হিসেবে আমরা মুল্লুকতাজকেই পাই। কেন তাকে আমরা মুল্লুকতাজ বলি? কেন তিনি তার বাপ-দাদার নাম হারান, তা একটা বচন বটে! আমরা দশজনকে জিজ্ঞেস করে সেই নাম যে তাইজুল মিয়া তা জানতে পারি, তা গবেষণা করি। গোটা একটা মানুষের নাম গোটা একটা সময়ের কাছে বান্ধা পড়ে? বিষয় কী! সময়কে সময়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার কোনো জাদু তার বুদ্ধিতে আছে মনে হয়। এমন বুদ্ধির কথা মনে পড়তে গিয়েই মানুষটার গোটা জীবনটা আমাদের সামনে ভাসতে থাকে। বিশেষ এক নক্ষত্রের মতো, রুহে আলেফের মতো, আমাদের মনের কোনায় তা জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে। আমরা জেনে নিই, তার জন্ম ব্রিটিশ রাজত্বের গর্ভেই হয়। শাসনের সেই গর্ভ যখন পাকতে থাকে, যখন সেই গর্ভ নিয়ে নতুন-নতুন লড়াকু-মানুষের জন্ম নেওয়ার কথা শুনি, তখন সোহনপুরের জন্মের ইতিহাস আমরা টের পেতে থাকি, আমাদের জাতীয় জীবনের সেই কালে মুল্লুকতাজ নামের মানুষটার একটা চরিত্র বোঝা যায়। সেই চরিত্র হয়তো আর সবার মতো হয় না।

ব্রিটিশ রাজত্ব ভেঙে তিনি ধর্মের নামে একটা জনপদ গড়ে ওঠার বিষয়ে দ্বিধান্বিত থাকেন। সোহনপুরের ইতিহাসে তিনি কলঙ্কযুক্ত হওয়ার বিষয়ে অতি সচেতন হন। তিনি সোহনপুরের মাটিকে ভালোবাসেন, এর আলাদা সীমারেখা চান, – তিনি বলেন, সেই সীমা হতে হবে নদী দিয়ে, মাটির গন্ধ দিয়ে, – তার চেয়ে বড়ো কথা, সেই সীমানার সঙ্গে মানুষের ঘামের একটা মায়া থাকতে হবে। সবকিছু ভুলে থাকলেও মানুষের ঘামের আলাদা একটা ইতিহাস আছে। তা তো ভুলে থাকা যাবে না! এমন কথাও তো সোহনপুরের অনেকেই এর আগে শোনে নাই। সোহনপুরের ধর্ম নিয়ে যারা চিন্তিত, তারা তো তা শুনেই নাই, এমনকি যারা ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’; ঢঙের চিল্লাহল্লা দিয়ে থাকে, তারাও শুনে না। ফলে তারা তাইজুল মিয়ার এই মনের বাসনাকে পাগলের প্রলাপ বলে ঠাট্টা-মশকরা করে। তারা ধর্মের নামে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের কথা বলে, পান-তামুক খায়, হিন্দুদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টা অতি বিষণ্ণতায় দেখে আর দেশটা কীভাবে গড়া যায় তার গবেষণা করে। তবে তাদের গবেষণা পরের বছরের ১৪ আগস্ট পর্যন্তও পৌঁছে না, – কারণ তার আগেই তারা টের পেতে থাকে যে তাদের হিসাব ভুল, লাখো ইনসান ভুখা হওয়ার হিসাব ভুল, বরং তাইজুল মিয়ার কথাই সত্য হয়। সে বলে যে, সত্য দিয়ে নানা ধরনের সত্যকে চিনে নিতে হয়। তার কাজই হয় সত্য দিয়ে সত্য আবিষ্কার করা। তার কথা যে সত্য তা তারা প্রকাশও করতে পারে না। কারণ তারা সহসাই বুঝতে পারে, তারা ভুল করেছে, তারা বুঝে যে নিজের ভাষায় ভাব প্রকাশ করার বিষয়েও ষড়যন্ত্র চলছে। তারা সোহনপুরের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে, পদ্মা-মেঘনা-যমুনাকে সাক্ষী রেখে, অচিরেই পথে-ঘাটে বলে বেড়ায় যে, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’! এই যে ওরা বলল, গানে যে ‘ওরা’ আওয়াজটি ব্যবহৃত হলো, ওই ওরা হচ্ছে সোহনপুরের শত্রু। ওরা উর্দুতে বাতচিত করে, সোহনপুরের পশ্চিমে থাকে, সেই পশ্চিমওয়ালাদের সঙ্গে সোহনপুরের অনেক ফেরাউন আর এজিদের গোষ্ঠী যুক্ত হয়েছে। তারা নদী চেনে না, বর্ষা চেনে না, তারা সোহনপুরের ঘামের গন্ধও বোঝে না। কারণ তারা রক্ত আর মাটিপিপাসু।

সোহনপুরকে ক্যাপচারে নেওয়ার জন্য তারা নানাবিধ পন্থার সন্ধান করে। তারা এ-মাটির ভিতর দোষ আছে বলে জানায়। এমনকি তারা মিলাদ পড়িয়ে মাটিকে পবিত্র করার কথা বলে। আবার জাত নিয়েও কথা বলে তারা। সোহনপুরের মানুষ অনেক কিছু হয়, অনেক রূপে নিজেদের চেনে, তাই বলে সারাজীবন ভোদাই থাকতে চায় না। তারা নিজেদের জায়গা-জমিন নিয়ে অনেক ভাবচক্করে পড়ে। তারা যে একটা গ্যাঁড়াকলের ভেতর আছে তা তারা বুঝতে পারে। তারা এক হওয়ার কথা ভাবে। ঠকানোর ধান্ধাবাজিতে তারা নিজেদের একটা অবস্থায় দেখার বিষয় নানাভাবে যুক্তি করে। তারা নদী আর জননীর কথা বলে। তারা নিজেদের জমিনে নিজেদের মতন করে চাষাবাদের কথা বলে। তারা আর পাখ-পাখালির জাত হয়ে থাকতে চায় না। এলেম শিক্ষার ব্যাপারে তারা অনেক কিছু চিন্তা করে। পশ্চিমের মানুষ কর্তৃক অত নির্যাতন তারা সহ্য করতে রাজি নয়। সোহনপুরের এই চেতাচেতিতে তাইজুল মিয়া একটা ফ্যাক্টর হয়। তার মাথায় নাকি দুনিয়ার চিন্তা আসে আর যায়। একটা মানুষ যে অত ভাবতে পারে, সোহনপুর নিয়ে চবিবশটা ঘণ্টা পড়ে থাকে, তাতে অনেকেই একেবারে বেকুব হয়ে যায়। এই লোকটার প্রতি তারা অনেক খেয়ালি হয়। তার কথার একটা দাম আছে বলে তারা মত প্রকাশ করে।

তবে সোহনপুর শুধু কথার ভেতর থাকে না। এই কথা সেই কথা বলে এর মানুষগুলি সময় লস করে না। তারা তাদের কথাকে একে একে যুক্ত করতে জানে। এক কথার সঙ্গে আরেকটা কথাকে ফুলের মালার মতো জোড়া লাগায় তারা। তাতে বাধা এলে তারা জানোয়ারের মতো চিল্লাহল্লা করে। তারা মানবস্বভাবের ভেতর হুঙ্কার জড়ো করতে জানে। তারা এইটুকু বুঝে যে বিনা চিল্লানিতে কিছুই পাওয়া যাবে না। তারা নিজেদের ক্ষমতা নিজের হাতে নেওয়ার মতো মত প্রকাশ করলেও পশ্চিমের মানুষগুলি তা নিয়ে এদের সঙ্গে ম্যালা বেইমানি করতে থাকে। তারা সোহনপুরের মানুষের হাতে ক্ষমতা ছাড়ার কথা পষ্ট করে না – মিটিংয়ের পর মিটিং করে। দেশের রাজাকে ওরা দুনিয়ার বদ-সল্লা দেওয়া শুরু করে। তারা সবই করে কিন্তু সোহনপুরের হাতে ক্ষমতা ছাড়ে না। সময় যায়, সময় পার করা হয়। তাইজুল মিয়ার দলের সঙ্গে ওদের কথা হয়, কিন্তু কথার কোনো মীমাংসা হয় না।

অবশেষে সোহনপুরের জীবনে এমন এক জীবন যুক্ত হয়, যার জন্য সোহনপুর তৈরি ছিল না। তাদের সঙ্গে পশ্চিমি এলাকার মানুষেরা জানোয়ারের মতো আচরণ করে – কামান-বন্দুক লেলিয়ে দেয়। তারা সোহনপুরের ওপর পাখির মতো গুলি করে। মানুষ সমানে মরতে থাকে। অঞ্চলের পর অঞ্চল আগুনে জ্বলে যায়। মা-বোনরা তাদের সম্ভ্রম হারায়। ঘরবাড়ি লুটপাট চলতে থাকে। সারা সোহনপুর একেবারে অবরুদ্ধ এলাকা হয়ে যায়। এর প্রতি ইঞ্চি জমিনে রক্তের চিহ্ন জমতে থাকে। সোহনপুরের অনেকেই নিজের দেশ ত্যাগ করে। তখন আমরা তাইজুল মিয়ার কথা শুনি। তিনি নাকি নিজে নিজে অনেক কাজ করার কথা বলেন। সোহনপুরের অনেক নেতার সঙ্গে তিনি কথাও বলেন। তবে তাদের লিডার তখন তাদের কাছে ছিল না। পশ্চিম অঞ্চলের সৈন্যের কবলে পড়েন তিনি। তাইজুল মিয়া তখন সোহনপুরের অনেকের সঙ্গে বুদ্ধি-পরামর্শ করেন। প্রতিবেশী দেশের অনেকের দ্বারে দ্বারে যান তিনি। কার্যত তিনি সোহনপুরের মানুষের জন্য ব্যাকুল হয়ে যান। তার ব্যাকুলতার কাছে অনেকেই নিজেদের সঁপে দেয়। এমনকি সোহনপুরের ভালোমন্দের অনেক কাজ নিজের বুদ্ধিতে সেরে নেন তিনি। তার রাত-দিন নিজের থাকে না। তিনি নিজেকে সোহনপুরের এক সজ্জন হিসেবে সর্বত্র নিয়োগ করতে থাকেন। এমনকি তার            স্ত্রী-সন্তানরা যখন তার সঙ্গে দেখা করতে আসে, দুই-চারটা কথা বলতে আসে, তখনো তাইজুল মিয়া ওদের সাথে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। তার চিন্তাও সেইদিকে নিয়োজিত হয় না। তার সময় যায় যুদ্ধের ময়দান আর অফিসের কাজ নিয়ে। এমনকি তাইজুল মিয়ার স্ত্রী যখন তাকে তার এতো পাগলামি নিয়ে কথা বলে, তাতেও মানুষটার কিচ্ছু হয় না। বেকুবের মতো তিনি হাসেন। তার স্ত্রীও এই হাসিটা অনেককাল ধরে দেখে আসছেন।

সময় পার হয়। ওই সময় তাইজুল মিয়া হয়ে গেছে মুল্লুকতাজ, সারা সোহনপুর তাকে এই নামে চিনে। তার হাসিটা এখনো আগের মতোই আছে। সেই যে সোহনপুরের পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-মাটির গন্ধ আর মানুষের ঘ্রাণে মেশামেশি করে আছে। তা যেন তার সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো লেগে আছে! মুল্লুকতাজের দলও পদ্মা-মেঘনা-যমুনা এমনকি মাটির গন্ধ, ওর মনের নরম নরম ভাবটা সহ্য করে, এমনকি তিনি যে জীবনের কোনো একসময়ে গান্ধীর মৃত্যুতে দুইদিন না-খেয়ে কান্নাকাটিটাও মেনে নিয়েছে! কিন্তু তার কথার ভেতর মানুষের ঘাম যুক্ত হলে তাদের অনেকেরই তা আর ভালো লাগে না। দেশটা স্বাধীন হবে, বাছা-বাছা মানুষের সঙ্গে কত কাজ হবে তাদের, সেখানে মানুষের ঘামের বিষয়টা কোত্থেকে আসে! এতেই তার বংশমর্যাদা নিয়ে ওরা ওদের প্যাঁচাইন্যে কথা কইতে শুরু করে। তার আচরণে কোথাও একটা ত্রুটি আছে। গরিবি বাসনার একটা চিন্তা আছে মনে হয়। মুল্লুকতাজের বউয়েরও এইসব মনে হয়। কিন্তু সোহনপুরের সর্বপ্রান্তে এতো মারামারি-কাটাকাটি লৌড়ালৌড়ির ভেতর মানুষের নিজের হাতে কাজ করার কথা নিয়ে বাড়তি কথা আর বলে না। তারা আসলে অনেক কিছু না বলেই মুল্লুকতাজের সর্বসময়ের সাথি আমিরুল আহমদের সঙ্গে কথা শেষ করে নিরলেই নিজের ডেরায় চলে যান।

তাইজুল মিয়ার কাছে সোহনপুরের অনেক খবর আসে, ওদের বাড়ির সামনের ব্রিজটির মেরামতের কাজ সেই কবেই বন্ধ হয়ে গেছে : রড, সিমেন্ট, ইট, এমনকি বালির স্তূপ নাকি রাজাকাররা নিয়ে গেছে। তাইজুল মিয়ার কাছে আরো অনেক ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংসের খবর আসে। পশ্চিমা জানোয়াররা নাকি তাদের এলাকাটি একেবারে মিসমার করে দিচ্ছে। পাঞ্জাবি সৈন্যরা কখনো ভৈরব, কখনো কিশোরগঞ্জ থেকে এসে সমানে পাবলিক মারছে। সোহনপুরের হরিসভার সামনে অনেক হিন্দুকে কেটে-কেটে টুকরা করে ফেলেছে। সিঅ্যান্ডবির ওপর একসঙ্গে বিশটা মানুষকে মেরে গেঁথে রেখেছে ওরা। হরিচরণ তো তখনো মরে নাই, মাটির ওপরে থাকা বাঁ হাতটা নাকি ম্যালা সময় নড়তে ছিল! আনন্দময়ী কালীমন্দিরকে তারা রাজাকার মঞ্জিল বানায়। সোহনপুরের নাম্বার ওয়ান নাট্যশালাকে আর্মিদের টেম্পোরারি ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। জওয়ান-জওয়ান মেয়েছেলেদের নিয়ে শয়তানি করে তারা। মেয়েছেলের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে ওরা। বাঞ্চোতদের সঙ্গে নাকি রাজাকার-আলবদররাও থাকে!

যুদ্ধ চলতেই আছে। সোহনপুরের প্রতিবেশী দেশও তাতে যুক্ত হয়। আকাশ, জল, স্থলপথ যুদ্ধের ক্ষেত্র হয়ে যায়। যারা ভেবেছিল যুদ্ধ তাদের নিয়তি; এই যুদ্ধ কতদিন চলে তার তো ঠিক নাই; তাদের দেশ তাদেরই স্বাধীন করা লাগবে, – তাদের নদী, তাদের জমিন, তাদের ঘ্রাণ তাদেরই পাহারা দেওয়া লাগবে। কিন্তু তারা আর একা থাকে না, – নিজেরা শুধু দেশ পাহারা দেয় না; অন্য দেশের অন্য মানুষও তাদের সঙ্গে থাকে। একসময় সোহনপুর পূর্ণ আকারে মুক্ত হয়।

সোহনপুরের মানুষগুলি অতঃপর তাদের মানুষটির অপেক্ষায় থাকে। তারা আসলে মুল্লুকতাজের জন্যই অধীর অপেক্ষায় সময় পার করে। তবে তারা ক্রমে-ক্রমে বুঝতে পারে, দেশ চালানো অত সোজা কথা নয়। মুল্লুকতাজ তো আর বেয়াই বা শ্বশুরের বাড়িতে বেড়াতে যান নাই। সেখানে গপসপ মারতেও যান নাই তিনি। তিনি তো এখন চাইলেই সাইকেল মেরে সোহনপুর চলে আসতে পারেন না। তারা বুঝতে পারে, তাদের মুল্লুকতাজ শুধু তাদের নয়, সারা দেশের হয়ে গেছেন। দেশ কি আর দেশ আছে গো, পোড়া-আঙরা হয়েছে। রেলপথই হোক আর রাস্তাঘাটই হোক, সবই তো লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। তিনি এখন আর সাইকেল, রিকশা কিংবা ভ্যানে আসবেন না, তার জন্য এখন উড়োজাহাজ ফিট করা থাকবে। তবু তারা তাদের মুল্লুকতাজের জন্য অপেক্ষা করে। তাদের অনেক কাজ, – ভাঙাচোরা দেশটাকে গড়তে হবে, রাস্তাঘাট মেরামত করা লাগবে। পাঞ্জাবি খন্নাছদের কর্তৃক তছনছ করে রাখা নাট্যশালাকে মানুষ করা লাগবে, রাজাকার মঞ্জিল তো কবেই উদ্ধার করা গেছে, কিন্তু একেও তো পূজার উপযুক্ত করা লাগবে। তারা পাগলের মতো এদিক-সেদিক ঘুরে। তাদের মুল্লুকতাজ পাক্কা এক সপ্তাহ পর তাদের মাঝে ফিরে আসেন। তারা মনে কষ্ট নিয়েই তাকে সমাদর করে। তাদের মুল্লুকতাজ যে অনেক গুরুগম্ভীর হতে শুরু করেছেন, তা তারা বুঝতে পারে। দেশ চালালে মনে হয় এমন হওয়াই লাগে!

মুল্লুকতাজ দেশের অর্থকরী অবস্থা উন্নত করার দিকে মন দেন। তাকে সেই দায়িত্বই দেওয়া হয়েছে। টাকা-পয়সা তো খুবই ভেজাইল্যে জিনিস। যাকে তাকে দিয়ে তো আর সেইসব কাজ হয় না। মুল্লুকতাজের লিডারও সবাইকে আস্থায় নেন না। তবে সোহনপুরের মানুষেরা খেয়াল করে যে, মানুষটা দিনকে দিন আরো গম্ভীর হয়ে যাচ্ছেন। যারা কান্ধে কান্ধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল, তারা নিজেদের নিজেদের ভেতরই মারামারি করছে। থানা লুট হয়, লুটপাটও চলে দেশে। তা নিয়েই কী কী যেন তিনি ভাবেন। চ্যাংড়া পোলাপানের যন্ত্রণা আর তার কপাল থেকে যায় না। যুদ্ধের টাইমেও গোঁয়ার গোবিন্দ পোলাপানগুলি তার সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। একটা সেকেন্ড তারা মানুষটাকে শান্তি দেয় নাই। এখনো কী যে হয়, মানুষটা ক্রমে-ক্রমে যেন নিজের খোলসে ফিরে যাচ্ছেন। তবে তিনি তার লিডারের দিকে তাকানো বন্ধ করেন না। তবু একসময় তাদের মুল্লুকতাজ সোহনপুরের যাবতীয় হিসাব থেকে, এমনকি রাজনীতির মাঠ থেকে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নেন!

তবে সময় তো চলেই, সোহনপুরের সময়কে তো মুল্লুকতাজ আটকে রাখতে পারেন না। তিনি আসলে দেশের এই সময়ে কিছুই করতে পারেন না। তিনি দেখেন যে, তার লিডারকে সময়ের ধারায় এক্কেবারে খুনই করে ফেলে। মুল্লুকতাজ প্রথমে  স্তম্ভিত হন। গোটা সোহনপুরকে যেই লিডার আবেগ দিয়ে ক্যাপচারে রাখতে চেয়েছিলেন, সেই দেশের সীমানায় তিনি শেষ হয়ে যান! তখন মুল্লুকতাজ আরো চুপচাপ হয়ে যান। তিনি অনেক কান্দেন, তার কান্দনের কথা নদী জানে, দেশের মাটি জানে আর জানে মানুষের ঘ্রাণ। এত কিছুর পরও নদী, মাটি আর ঘামের বিত্তান্তের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে রাখেন তিনি।

তাও তো তার কপালে সয় না। সেই সময়ের কোনো একদিন তাকে তার বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়। কোথায় যে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, তা প্রথম প্রথম সোহনপুরের মানুষ বুঝতে পারে না। তারা এইটুকু বুঝে যে সোহনপুরের মাটির সরলতা দিয়ে সব বোঝা যাবে না। তবে একসময় ডিমের কুসুমের মতোই স্পষ্ট হতে থাকে যে, তাকে জেলে পুরে রাখা হয়েছে। সেই কথাও মুল্লুকতাজের সোহনপুরের মানুষ আর স্ত্রী-সন্তানরা জানে কয়েকদিন পর। কুয়াশার মতো ঘষা থেকে তার সময় পার হয়। তার সাথে সোহনপুরের আরো তিন নেতাকে ঢুকানো হয়। মুল্লুকতাজের বাগানের খুব শখ। তিনি নর্দমার ওপরেই নিজে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে তাতে মাটি ফেলেন। বাগানও করেন তিনি।

মুল্লুকতাজের লিডার তাকে স্বপ্নে দেখা দেন। সময় তখন জেলখানার। সেই স্বপ্ন যেন মুল্লুকতাজের স্বপ্নের পাল্টাপাল্টি জবাব। সেখানে তার লিডার স্বপ্নের ভেতর দিয়েই নানা জনের মন-মাজারে ঢুকতে শুরু করেছেন! প্রথমেই চিকন রেখার মতোই রংধনুর ক্ষীণরেখার মতো করেই তিনি হাসেন। তিনি মুললুকতাজকে তার সঙ্গে চলে আসতে বলেন, তাকে আরো অনেক কথা তিনি বলেন। তাতে মুল্লুকতাজ বড়োই বেদিশা হন। তার অন্তরে ঝরনাধারার মতোই কান্না নামে। তিনি বলেন, লিডার, আমার তো এহোনো অনেক কাম পইড়া রইছে, আমি কেমনে যাই? লিডার তখন অনেক দূরের লঞ্চের মতোই সাইরেনের আওয়াজের ঢঙে বলেন, আমাদের আর কোনো কাজ নাইরে পাগল, চল আমার সাথে। তারপরেই লিডার তাকে এক অমীমাংসিত সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। তিনি যেন কূলহারা নদীর মতোই চরম ঝড়ের ভেতর পড়েন, – সেভাবেই তার সময় কেটে যায়! সোহনপুরের মানুষও হয়তো সেই ঝড়ের কবলে পড়ে। তারা এক-একটা খোয়াবের ভেতর অনেকগুলি খোয়াব জোড়াতালি নেয়। তারা খোয়াব নিয়ে অনেক জঞ্জালে পড়ে। কারণ কোনটা কার খোয়াব, তা তারা মেলাতেই পারে না। তবে তারা যেন রোজ কেয়ামতের আলামত পায়। তাদের কপালে ইস্রাফিলের শিঙ্গার এক-একটা আওয়াজ যুক্ত হয়ে যেতে থাকে! সূর্যের রংবাজিতে তারা অনেক মুশকিলে পড়ে। সূর্যের আবার কী হলো! বিষয় কী? তারা দুপুরের সূর্যকে সন্ধ্যার ম্লান-অন্ধকারের ভেতরও দেখে; তারা জ্বলন্ত ইটের মতোই টসটসা গজবে পড়ে; তা রক্তাক্ত হয়ে ছড়াতে দেখে। তাতে তারা এতই অবাক হয় যে, নিজেদের খোয়াবের ভেতর দিয়ে নিজেদের স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখতেও ভয় পায়। তারা ভয়ংকর ক্যাচালের ভেতর পড়ে। তারা কিছু বুঝে, কিছু বুঝে না। তারা সবকিছু আন্দাজও করতে পারে না। তাদের বিবেচনা শক্তিও যেন লোপ পেতে শুরু করেছে। একদিন তারা শুনে যে তাদের মুল্লুকতাজ আর নাই, জেলের ভেতর তাকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে ফেলা হয়েছে! তখন ম্যালা সময় পর তারা আবার সত্যিকারের ঝামেলা টের পায়। তার লাশ জেলখানার মাটিতেই পড়ে থাকে। তারা এও শুনে, তাদের মানুষটাকে মারার পর পাঞ্জাবি শয়তানরা বেয়নেটে বেয়নেটে খুঁচিয়ে ফালা ফালা করে ফেলে রেখেছে। জেলখানার মতো বেষ্টনমুখর জায়গায়ও তাদের মুল্লুকতাজ নিরাপদ ছিল না! তখন প্রত্যেকের জীবনকেই অনিরাপদ ভাবতে থাকে। তারা শুধু ভাবেই – নিজেরাও তা জানে না; তারা কী করে এত গর্দভের মতো হয়ে গেল। সবকিছু কত সহজে মেনে নিচ্ছে তারা! সবকিছু মেনে নেওয়াও তাদের যেন নিয়তিই!

সময়ের হাতে সময় নিজেকে ন্যস্ত করে সময় বয়ে যায়। আবার মুল্লুকতাজ হয়তো খোয়াবের ভেতর দিয়ে আসেন, – হয়তো নদীর গপসপ করেন, নদী তো কেবল সাগরে যায় না, পাহাড়ে যায়, চরে যায়, ভাটিতে যায়, এমনকি পাখির সাথে এর চলাচলের মিল আছে। চান্দের আলোর মতোই তা প্রকাশমান হতে থাকে। কাজেই নদী, মাটি আর মানুষের ঘ্রাণকে সীমানার ভেতর আটকে রাখলে তো তা শুকিয়ে যায়। তাই হয়তো মানুষটা জানান। তাদের মুল্লুকতাজ আসা-যাওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়তো তার জীবনের ভেতর দিয়েই করে রেখে গেছেন। তবে সোহনপুরের মানুষেরা তাকে যে একেবারে ছবি যোগ করে-করে নির্মাণ করতে পারে না। আমরা আবারো আবদুল কুদ্দুসের পরিকল্পনার কাছে যেতে চাই। কারণ সে সোহনপুরকে তাই বোঝায়। সে বলে, এই যে মানুষটা গান্ধীর মৃত্যুতে কান্নাকাটি করলেন, ভাষার জন্য অতো দরদ দেখালেন, তার লিডারের কাছে নিজেকে একেবারে বন্ধক দিয়ে রাখলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য একফোঁটা বিশ্রাম পর্যন্ত নিলেন না, নিজের কাপড় নিজে পরিষ্কার করলেন, দেশ স্বাধীনের পর সোহনপুরের টাকা-পয়সার যাবতীয় হিসাব রাখলেন, এমনকি তিনি দেশ-বিদেশ করলেন – সেই মানুষটা নিজের সুবিধা হিসাব করে কিছু করলেন কী? তিনি তো নিজের ছবিটা পর্যন্ত ঠিকমতো নেন নাই। এমনকি তিনি ছবি তোলার সময় নিজেকে লুকায়ে রাখতেন। তখন তিনি বলতেন, ‘আমার ছবি থাকার দরকার কি? আমার ছবি তো জনগণই বানাবে!’ তবে আবদুল কুদ্দুস বুঝতে পারে যে, সোহনপুরের প্রতিটা বুকে একজন একজন করে মুল্লুকতাজ আছে। ওদের বুক খুঁড়ে খুঁড়ে অনেকগুলি মুল্লুকতাজ অাঁকা যেতেও পারে!