দইয়ের সরবত ও অন্যকিছু

আফসার আমেদ

কখন যে কোন গানটা মন থেকে গলায় উঠে আসবে, তা ভেবে-চিন্তে হয় না। আপনা-আপনিই আসে। বিশেষত রবীন্দ্রসংগীত। অন্য গান যে গুনগুনিয়ে ওঠে না তা নয়। তার ভালো থাকা তাতে একটু আরাম পায়। গানটা নিয়ে থাকে। সেটা মনোময়ই জানে। রণিতা তার ভালো থাকাটা টের পায়। মনোময়ের ভালো থাকা রণিতা হয়তো ভালোবাসে। কে জানে, সত্যিই কি তাই? বলতে পারবে না মনোময়। বারান্দা থেকে বেরিয়ে পাঁচিলঘেরা চিলতে জমিতে দু-চারটে লংকাগাছ থেকে দু-চারটে লংকা তুলতে গিয়ে রণিতাকে একা-একা পোশাক পরতে দেয়। সে ঘরের ভেতর থাকলে কোনো দোষের ছিল না। মেয়ে মিষ্টি একটু আগে বেরিয়ে গেছে স্কুলে। সে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। রণিতা স্কুলশিক্ষিকা। রণিতার প্রতিদিন ভালো ভালো শাড়ি পরার অধিকার আছে। কোনো ছুতোনাতা দেখাতে হয় না তাই। আর কোনো মেয়েমানুষ যখন ভালো ভালো শাড়ি পরার মনোরমতা পায়, তাহলে সে ভালো আছে বুঝতে হবে। মনের আরাম নিয়ে সে থাকতে জানে। শাড়ি পরার সময় মনোময় ঘরে থাকলে তার আপত্তি থাকত না। এই প্রশ্রয়ের সুধা কখনো-কখনো অসহ্য মনে হয়। আজ অসহ্য লাগেনি, অথচ সে বাইরে বেরিয়ে এলো।
কাছের সম্পর্কের সঙ্গে কখনো কখনো নিষ্ঠুরতা কিছু দেওয়া উচিত। কিছু না-এর ধ্বনি দিতে হবে। কিছু শূন্য সময় খুঁজে দিতে হবে। আত্মতাড়নার রসে তবে সিক্ত হবে মেয়েমানুষ। একটু কপাল উচকে দেখবে। ঘাড় ফেরানো, দৃষ্টিপাতের মধ্যে রণিতাকে আর-একরকম দেখা জুটবে।
একটু পরেই রণিতা স্কুলে রওনা দেবে। চলে যায়ই। প্রতিদিন এইভাবে চলে যাওয়ার ভেতর রণিতাকে বাধা দিয়ে না-যাওয়া জানায় না কখনো, বরং চলে যাওয়ার অসহ্য অপেক্ষা থাকে তার। অসহ্যই তো।
বারান্দায় বেরিয়ে এলো রণিতা। ‘তুমি আজ অফিস -’
‘যাব না।’ রণিতার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো মনোময়।
‘শাড়িটা -’
মুখ তুলে দেখল মনোময় রণিতাকে, ‘বেশ বেশ।’ মনোময়ের কণ্ঠে কথা শেষ করার আভাস।
‘ফ্রিজে মাছ আছে, গরম করে খেও।’
‘খাব, খাব। তুমি যাও।’
‘তাড়িয়ে দিচ্ছ যে?’
‘তোমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘একদম নয়। শাড়িটা -’
‘আমি কিনে দিইনি, তুমিই কিনেছ।’
‘তোমার দেওয়া টাকায় আমি কিনি। তোমার পছন্দ করে কিনে আনার দিন অনেক আগেই আমি হারিয়েছি।’
‘যাও, যাও।’
‘বললে না তো, আমাকে কেমন মানিয়েছে?’
‘আরে ঠিক আছে।’
‘যাও, তোমার সঙ্গে আমি কথা বলব না।’
‘বেশ বোলো না।’
‘এত নিষ্ঠুর তুমি?’
‘নিষ্ঠুর?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ।’
‘ভারি বেয়াড়া তো তুমি, আরে ট্রেন পাবে না।’
‘পরের ট্রেনে যাব।’
‘তবে দাঁড়িয়ে থাকো, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখি।’
‘আগের মতো দেখো তো না আর।’
‘কী দেখব আর?’
‘বেশ।’ রাগত ভঙ্গিতে ঘরের ভেতর চলে গেল রণিতা। এখনই যে রওনা দিলো, তা নয়। ঘরের ভেতর কিছু একটা করে। সময়পাত ঘটায়। মনোময় বারান্দার রোদে কয়েকটা কাঁচা লংকা হাতের মধ্যে নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে রণিতার বেরিয়ে যাওয়ার। অথচ সারাটা দুপুর ও বিকেল একা-একা কাটানোর সময়ের অপ্রাণতা তার জন্য পড়ে আছে। তার জন্য থাকবে কিছু বিছানা-বালিশ, কিছু বই, কিছু চেয়ার-টেবিল, আলমারি ও ড্রেসিং টেবিল। তার মধ্যে জেগে ওঠা হয়তো থাকবে, বেঁচে ওঠা থাকবে না। এসব অতি-ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে, শেষমেশ টিভি খুলে জানালার পর্দা তুলে অথবা নামিয়ে শুয়ে-শুয়ে চ্যানেল ঘুরিয়ে যাবে শুধু, মনের মতো দেখার কিছু পাবে না। কোনোদিন পায় না। তবুও রিমোটটা নিয়ে কাটায়। কাটাবে।
বারান্দা থেকে চেঁচায় মনোময়, ‘কী হলো, গেলে?’
কোনো শব্দ আসে না ঘর থেকে। রণিতা চলে গেছে। নিঃশব্দে চলে যাওয়ার একটাই মানে ঘরেতে না থেকেও থাকার বিভ্রম খুঁজে দেওয়া। এই কষ্ট-সময় তার জন্য তৈরি করে বুঝিবা রণিতা। বিভ্রমের এত জোর? ভাবতেই পারে না মনোময়। বিভ্রম না ভাঙার নেশাও পায় তার। আর-একভাবে থাকা যায়। বারান্দায় উঠে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে, মন ঝুঁকে থাকে নিজের ভেতর। একটু নাড়াচাড়া করে তাকে। মনটা যেন প্রদীপশিখা, একটু হাওয়ায় নিভে যাবে। তাকে রক্ষা করে সে। রক্ষা করে যায়। এ-ঘর থেকে ও-ঘর যাওয়ার ভেতর। কাজহীন উদ্দেশ্যহীন এই হাঁটাচলার ভেতর তাকে জাগর রেখে চলে। ‘যৌবন সরসী নীরে…’ গানটা এবারো মনে ভেসে উঠল। তাকে আবার খুঁজে পেল। না-হলে কী নিয়ে থাকবে সে। পায়ের গোড়ালি ঘষা পাথরের হৃদয় তার। বড়ো ঘষটে ঘষটে চলে।
অতএব গানটাকে গলায় লালন করে সে। হাঁটাচলা করে। সিগারেট ধরায়। দীর্ঘ টানে ধোঁয়া খায়। রণিতা নেই, বেশ হয়েছে। অথচ খুঁজে দেখলে এই দুটি ঘর আর ডাইনিং বারান্দায় অথবা রান্নাঘরে রণিতা আছেও। বিছানা-বালিশে, মেঝেয় ও আরশিতে তার থেকে যাওয়া। রণিতার না-থাকার ভেতর তাকে পেয়ে যাওয়া। এমনটা চলতেই থাকবে।
টেবিলে রাখা মোবাইলটা বাজে। গা-সওয়া স্বরের মতো তাকে বাজতে দেয়। রণিতার ফোন। একটু বাঁকাচোখে দেখে নেয়। ঠিক তাই। তার মানে রণিতা স্কুলে পৌঁছে গেছে। পৌঁছে গিয়ে একটা ফোন করে প্রায়ই। মনোময় অফিসে গেলেও। রণিতার নিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খতায় ভরা। হৃদয় নিঃশেষ করে সে-সব দিয়ে ভরায়। তার নাম প্রেম-ভালোবাসা বোঝায় সে। প্রেমের এই বুড়িয়ে যাওয়া ধারণাকে বড়ো বেশি অনাস্থা মনোময়ের। যেন যন্ত্রের মতো। ঘষে ঘষে ক্ষয়ে যাওয়া যন্ত্রাংশ। মনোময় নিরুচ্চার এসব নিয়ে থাকে।
‘কী বলছ?’
‘স্নান করে খেয়েছ?’
‘স্নান করার তোড়জোড় করছি।’
‘খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।’
‘তুমি বোধহয় দেখতে পাও, ঘরেতে আমি কী করি।’
‘পাই তো বটে, নিজে কিছু করে নিতে পারো না যে!’
‘ট্রেনটা তাহলে পেয়েছিলে!’
‘তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো তাহলে?’
‘হয়তো ভাবি।’
‘হয়তো কেন?’
‘বেশি কিছু বলতে পারব না।’
‘খেয়ে নাও।’
‘এতেই তোমার শান্তি? বেঁচে আছি কিনা জানতে চাও না?’
‘হাসালে!’
‘তোমার তো হাসি পাবেই।’
‘খেয়ে নাও। মাছটা গরম করে খেয়ো।’
‘বেশ।’
‘আমার ক্লাসে যেতে দেরি হচ্ছে।’
ফোনটা কেটে দেয় মনোময়। আয়নার সামনে দাঁড়ায়। এখনো নিজেকে দেখা ফুরিয়ে ফেলেনি। হয়তো রণিতাকে দেখাও ফুরিয়ে ফেলেনি। ওপর থেকে বল পড়ার মতো এসব কিছু। গড়িয়েই যায়। নিজে থেকে বেগ পায়। শক্তি খরচ করতে হয় না। মাঝবয়সের জীবন এমনই ধরি মাছ, না ছুঁই পানি। অভিমান ভাঙাতে হয় না। অভিমান নেই-ই। শারীরিক চাওয়া-পাওয়া কম। তা নিয়ে কোনো তুষ্টি অপেক্ষা করে থাকে না। একটা সরলরেখার জীবন। আলোছায়াময় নয়। সবটা সাদা, নয়তো সবটাই কালো। সকালের রাগ, রাতের রাগ আলাদা করা যায় না। হয়তো কোনো সংগীতই নেই। ভাঙা রেকর্ডের মতো একঘেয়েমি। বয়ে চলা, ভরিয়ে চলা নয়। সমস্যা তো আছেই, জীবন কাটানোয়। যেমন এই আরশির সামনে দাঁড়ানোয় আছে। ঘরে-দোরে রণিতার ঘ্রাণ লেগে থাকার মধ্যে আছে। মিষ্টির আদুরে কণ্ঠস্বরের মধ্যে আছে। সবকিছু ভেবে দেখতে পায়। বুঝে নিতে হয় না। অঙ্ক কম। যোগ-বিয়োগের মতো সোজাসাপটা।
সিগারেটের ছাই উড়ে গেল ফ্যানের বাতাসে। ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ছে। সন তারিখ। জানালার পর্দা উড়ছে হাওয়ায়। এইসব দেখাকে নিয়মিত রাখতে পারে এখনো মনোময়। দেখা ফুরিয়ে ফেলে না, এইটুকু নিশ্চিহ্নতা পেতে হয় না তাকে। এই অবশিষ্টাংশে বাঁচা তার। বেঁচে যায়। মরে যায় না। খুব আলগোছে বাঁচে। হয়তো একা-একা বাঁচার মধ্যে সখ্য থাকে। বুড়িয়ে যাওয়ার বিপ্রতীপে কিছু রচনা করে যায়। এখানে সালিশির কোনো দরকার হয় না। নিজের কাছে নিজেই অভিযুক্ত, নিজেই নিজের বিচারক। মন ক্লান্ত রাখার অভিপ্রায়ে মন ক্লান্ত হয়েই থাকে। অফিসে যেতে ইচ্ছে করে না, মাঝে মাঝে যাওয়ার ছেদ হয়। ছেদ ঘটায়। আগে হলে রণিতা মনে করত, তার প্রতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। এখন রণিতা মুচকি হাসে শুধু। যাক, বাঁচা গেল, বাড়িতে কেউ না কেউ থাকবে। মেয়ে আগে ফিরে আসে, তাকে দরজা খুলে দেবে। বলবে, খেয়ে নে। না খেলে বলবে, খাচ্ছিস না কেন? কত কথায় যাওয়া যায়। এসব নিয়ে রণিতার নিশ্চিন্তি। আর সে দেখে, অফিসের স্বার্থান্ধ কুচুটেপনা, নীচতার ঝুড়ি। কীভাবে অফিস যাওয়ার আনন্দ পায়। মাইনে কাটে। রণিতা ভালো মাইনে পায়, তার কেটে নেওয়া টাকার জন্য রণিতার ক্ষোভ থাকে না। অদ্ভুত একরকম নীচতাও। টাকার কষ্টটা প্রথম জীবনে ছিল, এখন নেই। থাকলে হয়তো ভালো হতো।
ভেবে দেখে কত কিছুই না, আগে ভালো ছিল। সে-ভাবনাকে খুঁজে পায় না খুব একটা। সে-ভাবনা মনকে খুঁড়ে খুঁড়ে আনতে হয়। কিন্তু বদহজমের মতো তা সহ্য হয় না। সিগারেটের মতো তা ফুরিয়েও যায়। আর একটা সিগারেট ধরানোর মধ্যে শান্তি।

‘হ্যালো। স্নান করেছ, খেয়েছ?’
‘তোমার আমাকে নিয়ে এত কীসের কথা?’
‘কী যা-তা বলছ? খাওনি? স্নান করোনি এখনো?’
‘এই তো বেশ আছি। তোমার থাকা নিয়ে কি কিছু বলছি?’
‘বলছ না তো, তাতে কী হলো? তুমি ঠিকঠাক না থাকলে -’
তোমার এই অদ্ভুত বেয়াড়াপনা!’
‘খেয়ে নাও, তারপর ঘুমিয়ে নাও।’
‘তুমি ক্লাসে যাও, আমি ঠিক আছি।’
‘এখন ক্লাস নেই।’
‘তাহলে কারো সঙ্গে গল্প করো।’
‘কারো সঙ্গে গল্প করছি, তা দেখতে পাও নাকি?’
‘হয়তো পাই। নম্রতাদি আছেন।’
‘বেশ বেশ। তাহলে পোস্তর পদগুলো শিখে নাও। আমার পোস্ত ভালো লাগে।’
‘আর কত শিখব বলো তো?’
‘কত কিছু শেখার আছে তোমার!’
‘আর কিছু শেখার নেই আমার।’
‘শেখো, শেখো।’
‘কণ্ঠস্বরে রাগ ভরে দিচ্ছ কেন? টিভিতে কোনো বেয়াড়া নিউজ দেখলে?’
‘হয়তো।’
‘টিভির শব্দ তো পাচ্ছি না।’
‘ভালোই গোয়েন্দাগিরি শিখেছ।’
হাসে রণিতা। হাসির মধ্যে নিজেকে জিতিয়ে নেওয়ার উপলব্ধি ধরে রাখছে। না জিতে চলে না রণিতার। মনোময় হেরেই যায়, হারতেই ভালোবাসে। সেই নিরুপায়তা আশ্রয় যেন তার। এই বিষণ্ণতা তার উপকারে লাগে। প্রাকসন্ধ্যার গোধূলির মতো ম্লান রং নিয়ে যেন এক ছেলেখেলা রচে মনোময়। ফোনটা রেখে দেওয়ার পরও রণিতার হাসিটা শুনতে পায় মনোময়। সে ফোনটা কেটে দিয়েছে, কিন্তু হাসিটা তার জ্যান্ত রেখেছে। নিজের ইচ্ছেমতো হাসিটাকে শুনতে পায় মনোময়। তার শব্দ ইচ্ছেমতো কমায় বাড়ায়। শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার প্রথম থেকে শোনে মোবাইলে রিংটোন শোনার মতো।
বাইরে তখন ঝকঝকে রোদ। ঘরে তখন সে ছায়াময়তায়। অপ্রসন্ন ছায়ায় একা হয়ে যাওয়ার মগ্নতায় নিরুচ্চার থাকে। ঘরের খুঁটিনাটিতে হাত দেয়, স্পর্শ রেখে রেখে যায়। যেন কোনো রূপকথার চরিত্রের ইচ্ছেপূরণ ঘটাতে চায়।
কাজের মেয়ে আরতিদি এলো। ঘর ঝাঁট আর ঘর মুছছে। সে আসে এভাবেই। একটু শব্দ থাকে শুধু। নীরবে কাজ করে চলে যাওয়াই তার স্বভাব। কোনো কথা তৈরিতে যায় না মনোময়ও। একটা নিপাট নৈঃশব্দ্য বিরাজ করে ঘরের মধ্যে। তাদের বেডরুমেই এটা-ওটায় ছোঁয়, দেখে। একাকী নিভৃত এ-নিয়োজন অদ্ভুত একা হতে দেয় তাকে।
পায়ের কাছ থেকে ঝাঁট দেয় আরতিদি। একটু সরে যায় মনোময়। আবার কাছে আসে আরতির ঝাঁটা। আবার সরে যায় মনোময়। আরতির দিকে না তাকিয়েই এরকম বাধ্য ও নীরব সহযোগিতা করে যায় মনোময়। একই ভঙ্গিতে ঘর মোছে আরতি। সে সরে সরে যায়। আরতি সরে সরে আসে। যেন আত্মতাড়িত হয় সে। নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যেন সে। বাইরে তখন দিনমানের অনাবিল উদারতা, রোদ আর নির্মল আকাশ আর বসন্তদিন খেলা করছে। সে কোনোটাকেই ধরে না, কোনোটাকেই ছোঁয় না। আরতিদি ক্রমশ পায়ের দিকে এসে পড়ে। তাকে সহযোগিতা দেয় সে। বারবার একই কথার মতো উত্তরোল ভঙ্গি। যেন অস্তিত্ব রক্ষার অনায়াস দায় বহন করে চলে সে।
একসময় ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আরতি। মনোময় মনে করে তার আক্রান্তদশা ঘোচে। আর নিজের মধ্যে আক্রমণাত্মক হওয়ার সাধ পায়। স্টিল আলমারির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। খুলে ফেলে দুটো পাল্লাই। মাসের শেষ, কিছু টাকা দরকার। একটু পরে বা বিকেলে বেরুতে পারে সে। নিজের টাকা নিঃশেষ, তাই রণিতার টাকায় সে হাত দেবে। এরকমটা প্রতিমাসেই করে সে। আর রণিতা সেভাবেই রেখে যায় হাতের কাছে চার-পাঁচশো টাকা। বেশি টাকা অন্যত্র রেখেছে, যা সে খুঁজে পাবে না, নাগালে আসবে না। এই অলিখিত চুক্তি যেন তার আর রণিতার মধ্যে। একটা পাঁচশো টাকার নোট পায়। সেটা হাতের মধ্যে গুঁজে নেয়। একটা নতুন প্যাকেট আলমারির মাঝের তাকে গোঁজা দেখে সে। এটা আলমারির নতুন অতিথি। খুলে দেখতে ইচ্ছে হলো তার, এতে কী আছে, এতে কী কিনে রেখেছে রণিতা? খুলে দেখে, অনেকগুলো রঙের কিছু। একি একতাড়া ব্রা। প্রায় ডজনখানেক। সবগুলো আলাদা রঙের। মাথার ভেতরটা কেমন ঝিমঝিম করে এলো।
আলমারির দরজা খুলে রেখেই প্যাকেটটা নিয়ে বিছানায় এসে পড়ে সে, এসে পড়ে উবু হয়ে বসে। দেখতে থাকে। একটা একটা করে সাজায় বিছানার ওপর। অনেকটা জায়গা জুড়ে সাজাতে হয়। আসলে অনেকটা জায়গা লাগে। তেরোটা ব্রা। এতগুলো ব্রা রণিতা কোনোদিন কেনেনি। এমন মতিভ্রম হলো কীভাবে রণিতার? আলাদা আলাদা রং শুধু নয়, আলাদা আলাদা স্টাইলের। বেশ দামি। মেয়ে মিষ্টির নয়তো? না মিষ্টির নয়, মেয়ের আলাদা আলমারি। কবে কিনল রণিতা। রণিতা নিজের জন্য যা কেনে, সবই তো তাকে দেখায়, দাম যাচাই করে নেয়, ঠকল কিনা। রণিতা এতগুলো ব্রা কিনল, দেখাল না কেন? সবই তো বলে, সবই তো দেখায়। এমনকি একপাতা টিপ কিনলেও দেখায়। শাড়ি তো সঙ্গে সঙ্গে দেখায়। লুকিয়ে রাখার মতো আলমারিতে রেখেছে। তার মানে? ব্যাপারটা কী। বুঝে উঠতে পারে না মনোময়। মনের ভেতরটা কেমন করে ওঠে তার। সে দুর্বল মানুষ। খুব সহজে কষ্ট পায়। নিজের কষ্টকে ছুঁয়ে দেখল। সত্যিই কষ্ট পাচ্ছে সে।

স্নান খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ে মনোময়। স্নান করে, সাবান মাখে না, শ্যাম্পুও করে না। মাছও গরম করে খায় না। একটু দেরি করে খাওয়ার জন্য সব ঠান্ডা পায়। খায়ও। খাওয়ার পর নিজের কাছে চলে যায়। আরামের ইশারায় নিমগ্ন হয়। তারপর নিপাট ঘুমিয়ে পড়ে, উপুড় হয়ে শুয়ে। তার চারপাশজুড়ে অসংখ্য ব্রা, অসংখ্য রঙের। যেন তার চারপাশে উড়ছে। একরাশ প্রজাপতির মতো। ব্রাগুলো প্রজাপতি হয়ে যায়। সেগুলোকে ধরতে চায় মনোময়, ধরতে পারে না। যেমনভাবে বিছানায় রণিতার সঙ্গে শুয়ে রণিতা অধরা থেকে যায়, তেমন রকম ব্রাগুলোও ধরতে পারে না। জাপটে ধরার অপারগতার ব্যর্থতা নিয়ে থাকে। চেষ্টা থাকে, তেমনি অসফলতাও থাকে। ব্রাগুলো প্রজাপতি তো, তারাও সপ্রাণ। রণিতাও প্রাণের আরামে তার পাশে থাকে।
গোধূলির ছায়াময় আলোর আভা হয়তো ঘরের বিছানায় ধেয়ে আছে এখনো। তার মধ্যে ঘুমায় মনোময়। আরতিদি জলখাবারের আয়োজন করছে। মিষ্টি স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। এসব ঘুমের মধ্যে টের পায় মনোময়।
আবার প্রজাপতিরা আসে। আসতেই থাকে। হাতছোঁয়া তাদের ওড়াউড়ি। কিছুতেই ধরতে পারে না, ছুঁতে পারে না।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ঘুম ভেঙে যায় মনোময়ের। বাথরুমে জলপড়ার শব্দ। তার মানে মিষ্টি বাথরুমে আছে। রান্নাঘরে ছ্যাঁক-ছুঁক শব্দ, তার মানে আরতিদি রান্নায় ব্যস্ত। বাইরের দরজায় নাগাড়ে কড়া নাড়ার শব্দ, তার মানে রণিতা এসেছে।
উঠে গিয়ে দরজা খুলে ধরে মনোময়।
মুখোমুখি রণিতা।
‘ওমা, তুমি এখনো ঘুমোচ্ছিলে?’
কিছু বলল না রণিতাকে মনোময়। বিছানায় ফিরে এসে বালিশ অাঁকড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। আবার যেন ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু ঘুমোতে পারে না। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে।
‘একি ঘুমকাতুরে বাবা!’
রণিতার কণ্ঠে গুনগুন। পোশাক বদলাচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলে মৃদু শব্দ। শাড়ির খসখস শব্দ। সব শব্দ মৃদু, অনুচ্চ। পায়ের পাতা ফেলার শব্দও।
‘অফিস তো যাওনি, ঘরে কী করছিলে শুনি। এত ঘুমিয়েও -’
কথার কোনো উত্তর দেয় না মনোময়। অথচ ঘুমোয় না সে, জেগে পড়ে থাকে। প্রজাপতিদের মনশ্চক্ষে দেখতে পায়। আর তাতে রণিতার গায়ে মাখা ক্রিমের গন্ধ মেখে ওঠে। প্রজাপতিরা ঈর্ষণীয় মানবী হয়ে ওঠে। প্রজাপতি ও রণিতা সমার্থক যেন।
আক্রমণ রোখার মতো করে বিছানায় উঠে বসে মনোময়। রণিতাকে দেখে, রণিতা শাড়ি বদলে ফেলেছে।
বিছানা থেকে নামে মনোময়।
রণিতা তার দিকে ধেয়ে আসছে দেখে, মনোময় বাথরুমে ছুটে যায়। বাথরুমে মুখে-হাতে জল দেয়।
বাথরুমের দরজায় রণিতার কণ্ঠস্বর, ‘তুমি কি দইয়ের সরবত খাবে?’
কোনো উত্তর করে না মনোময়। রণিতা আজ খুব বেশি স্বামীপ্রেমে মুখর হয়ে উঠছে। আজ এ-মুহূর্তে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় এসে বসে, গামছায় হাত-পা মোছে মনোময়।
রণিতা কাছে আসে।
মনোময় বলল, ‘কী বলছ?’
‘দইয়ের সরবত খাবে তো।’
‘না।’
‘কেন?’
‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘দইয়ের সরবতে তোমার কবে অরুচি হয়েছে? তোমার তো ফেভারিট। শরীর কি খারাপ?’
‘না, যাও।’
‘ফোঁস করছ যে?’
‘তুমি যাও।’
‘কী হয়েছে তোমার?’
দইয়ের সরবতের গ্লাস হাতে ডাইনিংয়ে ফিরে যায় রণিতা।
মনোময় জানালার কাছে এসে দেখল বিষণ্ণসন্ধ্যা ম্লান হয়ে এসেছে। বাইরে হাওয়াও বইছে। নিজের মধ্যে ক্লান্তি প্রচুর, শ্লথতাও। খুব একটা হাঁটে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়েই থাকে।