রক্ত কিংবা অগ্নিবৃষ্টির গল্প

মোহাম্মদ আবদুল মাননান

ওদের দোষ দেওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়। ওরা সীমা ছাড়িয়েছে – তাও বলা যাবে না। যা দেখে এসেছে তার বিশেষ কোনো অন্যথা করেনি ইবন আর ইনিতা। হরহামেশাই দেখছে কাজিনে-কাজিনে সম্পর্ক। যেমন কাছের কাজিনের মধ্যে, তেমন কিছুটা দূরের কাজিনে-কাজিনেও। কোনো কোনো ধর্মে ফার্স্ট কাজিনের মধ্যে বিয়ে প্রচলিত নয়। এসব আবার কেউ মানছে, কেউ মানছে না। মেনেও ব্যতিক্রম দেখা যায়। হয়তো বিয়ে-টিয়ে হচ্ছে না; কিন্তু সম্পর্ক যে একটা জায়গা পর্যন্ত যায় না, তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেনি – কেবল বিয়েটা হয় না, এই যা। আর বিয়ে হলেই-বা কী? না হলে ধর্ম রক্ষা পায়, হলে ধর্ম মানা হয় না – কতভাবেই তো ধর্মীয় আচার মানা হচ্ছে না। কিন্তু
মুসলমান সমাজে নিকটবর্তী কাজিনে-কাজিনে – এই যেমন মামাতো, ফুফাতো, খালাতো, চাচাতো ভাইবোনের মধ্যে ভালোলাগা, ভালোবাসা অতঃপর প্রেম এবং বিয়ে দেদার হচ্ছে; সেটেল্ড ম্যারেজও হচ্ছে – সব দেশেই। মায়ের বোন হচ্ছে মায়ের প্রায় কাছাকাছি – তো তাকে শাশুড়ি বানানোর মজাই আলাদা। কেউ কেউ তেমনই মনে করে। এসব কারণে মুসলিম পরিবারে কাজিনে-কাজিনে বিয়ে দোষের কিছু নয় মোটেই। ইবন আর ইনিতা সে-পথেই এগোচ্ছিল – এর মধ্যে দোষের কিছু ছিল না। যদিও ওরা দুজনেই জানে, এ-ধরনের বিয়েতে কখনো কখনো সমস্যা দেখা দিতে পারে। যদি কাজিন ভাইবোনের কারো রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হয়ে পড়ে, বিপত্তি তখনই। কিন্তু ইবন আর ইনিতা জানে, ওদের কারো রক্তের গ্রুপই নেগেটিভ নয়। দুজনেরই ‘ও’ পজিটিভ। বয়সের দিক থেকেও কোনো সমস্যা নেই। ইবন ইনিতার চেয়ে দুবছরের বড়। একটা জুটির জন্য মানানসই বয়স; এ-সময়ে।

দুই
বিয়ের সাত বছরেও যখন বাচ্চা হলো না, তখন নীলিমার কাছে জগৎসংসার তুচ্ছই মনে হচ্ছিল। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ইমরানের চাকরি। নাদুস-নুদুস বেতন। নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট আর গাড়ি হতে খুব সময় লাগেনি এ-শহরে। কিন্তু নীলিমার কোনো কিছুই যেন ভালো লাগে না। সবকিছুই জ্বরাক্রান্ত রোগীদের মতো বিস্বাদ লাগে। ডাক্তারের কাছেও যেতে আর ভালো লাগে না – না নীলিমার, না ইমরানের। এ-টেস্ট, সে-টেস্ট – আবার একই টেস্টের পুনরাবৃত্তিই যেন রুটিন হয়ে যাচ্ছিল। বিব্রতকর টেস্টও আছে এ-চিকিৎসায়। ডাক্তার বদলেও দেখেছে – একই রকম। না অবস্থার উন্নতি, না নানা বিপত্তির উপশম; কোনোটারই কিছু হচ্ছিল না। নীলিমা এখন ডাক্তারের কথা শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের ধৈর্যই বেশি থাকে। কিন্তু নীলিমার সেটা ভেঙে গেছে। সেই একই কথা – কারো কোনো সমস্যা নেই, একসঙ্গে থাকতে হবে, উজান-ভাটা দেখে সময়কে কাজে লাগাতে হবে আর ধৈর্যধারণ। দিল্লি-কলকাতার ডাক্তারও নতুন কিছু বলে না। নীলিমা আশা ছেড়ে দিয়েছে। অথচ এ-শহরেই তার আরো তিন বোন ছেলেমেয়ে নিয়ে দিব্যি আছে। প্রবাসী বড়ভাইও নিঃসন্তান নন। তবে ধৈর্যটা এখনো ধীরলয়ে ধরে রেখেছে ইমরান।

তিন
রেহেনা ভাইয়ের বাসায় থাকছে। ভিক্টোরিয়া কলেজে পল-সায়েন্সে ভর্তি হতে পারত। বাবা-মা তা-ই চেয়েছিল। কিন্তু ইমরান হতে দেয়নি। নিজের কাছেই রেখেছে ছোট এ-বোনকে। ইসলামের ইতিহাসে অনার্স-মাস্টার্স করেছে ঢাবি থেকে। প্রেম করছে ভাবির ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। ফিজিক্সে পাশ করে বিদেশি ব্যাংকে কাজও পেয়েছে মঈন। সুতরাং ইমরান আর নীলিমার আপত্তি থাকতে নেই। তারপরও আপত্তি আছে ইমরানের। প্রবাসী এক কাজিনের সঙ্গে রেহেনার বিয়ের কথা হয়েছিল অনেক আগে, বাবা চলে যাওয়ার আগে সে-কথা একবার নাকি বলেছিলেন; আরো বলেছিলেন – কথা মানে তেমন পাকা কিছু নয়। সুতরাং ইমরান কিছুটা কম আগ্রহী নিজের শ্যালকের সঙ্গে বোনের জুটিতে – যদিও সেটি বাধা হওয়ার মতো শক্ত নয়। রেহেনাভাবির বিষিয়ে-ওঠা মনটা প্রতিদিন ইঞ্চি-দূরত্ব থেকে অবলোকন করে আসছে। ইমরানের কষ্টটাকেও কম উপলব্ধি করে না। রেহেনাই প্রস্তাবটা দেয়।
– ভাবি, আমাদের বিয়েটা দিয়ে দাও। ভাইয়াকে একটু বুঝিয়ে বলো। আর শোনো, আমাদের প্রথম বাচ্চাটা যদি তোমাদের…।
কথা শেষ করতে পারে না রেহেনা।
– কী বলছিস তুই। চেঁচিয়ে ওঠে নীলিমা। রেহেনা বোঝাতে চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারে না ভাবি কি করুণা মনে করছে, না অসম্ভব মনে করে চেঁচিয়ে উঠল।
রাতে ইমরানকে কথাটা বলে নীলিমা। ইমরান খানিকটা ভেবে বলে, সমস্যা কী! অনেকেই তো এখন এমনটা নিচ্ছে। তুমিও তো চাচ্ছ। বাইরের কারো না নিয়ে নিজেদের হলে… আর ও যখন নিজ থেকেই বলছে, কিন্তু তোমার ভাবি কি মানবে? তাছাড়া ওদের তো বিয়েই হলো না। বিয়ে, তারপর… কী হয় কেউ কি জানে! এক অজানা আশঙ্কায় ইমরানের মন দুরুদুরু করতে থাকে।
ইমরান আরো বলে, তোমার মেজবোনের তো একগাদা পোলাপান, কই তারা তো কখনো এমন বলেনি।
বোনের অনেক ছেলেমেয়ের খোটা খেতে অভ্যস্ত নয় নীলিমা। ঢাকায় বড় হয়েছে। তিন বোনই থাকার মতো ভালো আছে ঢাকায়। তাদের নিয়ে ইমরানের এমন কথা একদম ভালো লাগেনি নীলিমার। কিন্তু এমন বিষয়ে কথা হচ্ছে যে, ঝগড়াও করা চলে না। আবার বলতেও পারে না – তোমার বোনই কেবল নয়, যদি সত্যি হয় তবে সেখানে আমার ভাইয়েরও স্যাক্রিফাইস থাকবে।
ইমরান হয়তো জানে না ইমরান আর নীলিমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার পরিকল্পনা দুজনে এক হয়েই কষেছে। মঈন পিঠাপিঠি বোন নীলিমার প্রতি অপেক্ষাকৃত বেশি দুর্বল, তা ইমরানও জানে। একজন ভাইয়ের না পাওয়ার বেদনাকে ভরিয়ে দিতে চায়। আরেকজন বোনের অতৃপ্ত হৃদয়কে খানিকটা স্বস্তি দিতে চায়। মন্দ কী, নিজেদের মতো করেই যখন মানুষ হবে। দুটো প্রাণের আর্তি আর হাহাকার দূর কিংবা কাছ থেকে দেখতে হবে না প্রতিদিন। নীলিমা কোনো জবাব দিতে পারে না। কল্পনায় নিকট দূরত্বে বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে।

চার
ইঙ্গিতা অনেক বেশি দায়িত্বশীল। কোনো মেয়ের প্রেম-ভালোবাসার ব্যারাম সচরাচর ছোট বোনই আগে জেনে যায় – নিদেনপক্ষে লক্ষণটা বুঝতে পারে। ইঙ্গিতার সঙ্গে বড় বোনের দূরত্ব দেড় বছর মাত্র। বাবা-মা দুজনেই এবার ছেলে চেয়েছিল। হলো না – এলো ইঙ্গিতা। ইঙ্গিতার বাবা বাদ সেধেছিল – বিশেষ করে স্ত্রীর আরো একবার সিজারে কী না কী হয়; ও-সময়ে নীলিমার অস্বাভাবিক ব্লাড প্রেসার নিয়ে মঈনের চিন্তার শেষ ছিল না। যদিও ইঙ্গিতা এখন সন্তানদের মধ্যে মঈনের বেশি কাছাকাছি আছে। ইঙ্গিতা অনেক চালু – ঠিক এ-সময়ের মেয়ে, সময়ের সঙ্গেই মানানসই, যাকে বলে স্মার্টনেস। বোনের ব্যাপারটা ওর টের পেতে দেরি হয় না। কিন্তু বোনকে দেখে আর চোখটিপে দিয়ে হাসে। বড়টাও জেনে যায় সেটা। কিন্তু এ নিয়ে দুবোনে বিশেষ কথা হয় না। বড়টা এসব ব্যাপারে একটু চাপা বলেই হয়তো। কিন্তু ইঙ্গিতার পছন্দের কথাটা বড় বোনকে জানাতে বিলম্ব করে না। বড় বোনের সাহায্যও যে দরকার।
– বাবা-মাকে এখুনি বলিস না আপু।
– ওকে। আমার ব্যাপারে কোথাও কিচ্ছু বলবিনে। সময় হলে আমিই বলব।
ইঙ্গিতা আপুর কথার অন্যথা করেনি, বিশ্বস্তই থেকেছে বরাবর।

পাঁচ
বাবার প্রয়াণের পর ইমরানের মায়ের শরীর ভালো যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝেই ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হতো। কখনো ইমরানের বাসায়, কখনো রেহেনার বাসায়। শরীর ভালো থাকলে কখনোবা নারায়ণগঞ্জে বড় ছেলের বাসায় এক-আধদিনের জন্য। আবার একটু ভালো বোধ হলেই কুমিল্লা – সেখানে বড় বউ তিন-চারটে নাতি-নাতনি নিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বড় মেয়ে স্কুলে শিক্ষকতা করে। স্কুলে যাওয়ার পথে ছোট মেয়েটাকে মায়ের কাছে রেখে যায়। এসব ছেড়ে ইমরানের মায়ের জন্য ঢাকা থাকা দায়। যদিও রেহেনা সববারই দেরি করিয়ে দেয় মাকে। নিজে না পারলে ইঙ্গিতাকে লাগিয়ে দেয়; নানুর সঙ্গে ওর ভাবটা যেন একটু বেশিই। ইঙ্গিতার কথা ভেবে মঈনও শাশুড়িকে নিজের কাছে বেশি সময় রাখতে চায়। ওদের দাদিকে বড় বেশি পায় না এ-বাসায়। মাকে ততটা আটকে রাখতে পারে না ইমরান। পারে না নীলিমাও। নীলিমাদের বাসায় বড়জোর একবেলা ঠিকভাবে কাটাতে পারেন ইমরানের মা। এরপরই ছটফট করে মেয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য – সেটা মেয়ের চেয়ে দুনাতনির জন্য বেশি হয়তো। মা এবারই ব্যাপারটা লক্ষ করল – গতকাল সন্ধ্যার পরেই। মঈন, রেহেনা আর ইঙ্গিতা বাসায় নেই। মাকে আর ইনিতাকে রেখে একদিনের জন্য বাইরে বেড়াতে গেছে। মা আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন রাতে। শরীর-টরীর ঠিক আছে। কিন্তু মানসিক বৈকল্য মনে হচ্ছে তার। মৃত্যুকষ্টের বর্ণনা দেওয়া যায়, কিন্তু উপলব্ধি করা যায় না। মৃত মানুষ তো বিবরণ দিতে পারে না। কিন্তু ইঙ্গিতার নানুর মনে হচ্ছে এখন মৃত্যুর কষ্ট হচ্ছে, সে-সময়ের কষ্টটা এমনিই হবে বলে মনে হতে থাকে তার। অথচ তার শরীর এখন বেশ ভালো। কাল না-হয় পরশুই কুমিল্লা চলে যাওয়ার কথা তার। রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারেননি। মনে হচ্ছে ভূমিকম্প হতে পারে। কেয়ামতের মতো লন্ডভন্ড হয়ে যাবে সবকিছু। ইঙ্গিতার বড়বোনটাও এমন যে, সারাটা রাত নানুর একবার খোঁজ নেওয়া আবশ্যক মনে করেনি, অথচ ইঙ্গিতা ঘুমোয় নানুর সঙ্গে, নানু যে-কদিন থাকে ঠিক যেন তার সঙ্গেই লেপ্টে থাকে। নানু রাতে কয়েকবার পায়চারি করে মোবাইলে ইনিতাকে কথা বলতে শুনেছে। ভেবেছে, কত আর সর্বনাশা কথা বলবি নানু! শেষরাতে একটু ঘুম হলেও হতে পারে, কিন্তু মনের মধ্যে যে উথাল-পাতাল তাতে কিছুই আর মনে করতে পারছে না প্রায়-সত্তরের এ-বৃদ্ধা। সে কী কেয়ামতের কোনো আলামত দেখতে পেল কি-না তাই কেবল ভাবছে আর অপেক্ষা করছে কখন মঈনরা বাসায় ফেরে। একবার ছেলের বাসায় যাওয়ার কথা ভাবলেন তিনি। পরক্ষণেই মনে হলো ছেলে আর ছেলের বউও বেড়াতে গেছে। আজ সকালে ফিরবে তারা। মঈনদেরও রাতের ট্রেনে ওঠার কথা এবং বাসায় এসে সকালে নাস্তা করার কথা আছে ওদের। ওরা যে একসঙ্গে আরেক জায়গায় বেড়াতে গেছে তা টেনশনে এতক্ষণ ভুলেই ছিলেন গতকালের ঝড়ে পর্যুদস্ত এই ভদ্রমহিলা।

ছয়
ইঙ্গিতার নানি নিচে বলে রেখেছে ইমরানদের ওপরে উঠতে। এখানেই নাস্তা করে যাবে। নাতনিকে বলেছে মোবাইলে সেটা জানিয়ে দিতে।
ইমরান-নীলিমা এবং মঈন-রেহানা এখন মঈনদের বাসার ড্রয়িংরুমে। মা কিংবা শাশুড়ির নির্দেশ জরুরি – আর ভয়ানক কী কথা আছে সবার সঙ্গে। ওদের দেখে বৃদ্ধা অনেক শক্তি পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। রাতের অস্থির ভাবটা এখন প্রবল শক্তি হয়ে উঠেছে তার জন্য। নিমেষে দুপরিবারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে ভয়ানক কিছু লেগে যায় যেন। রেহেনা বলছে – তোমরা, তোমরাই বলেছ – কেউ যেন কোনোদিন না জানে। তুমি বলেছ, ভাবি বলেছে – বলো, বলোনি।
– না করেছি সেটা কৌশলগত কারণে। জানলে কী আর মেনে নিত? কিন্তু এতোবড় সর্বনাশ…। ডুকরে কেঁদে ওঠে ইমরান। নীলিমা যেন নির্বাক হয়ে পড়েছে। মঈন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কেবল – কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।
– বরাবর ভাইবোনের মতোই চলতে দেখেছি। ইমরান কাঁদতে কাঁদতে বলে।
– কেয়ামত, কেয়ামত আসছে – বলে ইঙ্গিতার দাদি চিৎকার করছেন।
রাগ আর ক্ষোভের সমষ্টি আছড়ে পড়ছে মেয়ের ওপর।
– পরথম পোলাডারে কেন দিতে গেলি?
রেহেনা বলতে পারে না, কেন তুমিই না তখন বলেছিলে ভালোই করেছিস, ইমুর বাসাটা কেমন খালি খালি লাগে।

সাত
নিষিদ্ধ কাজে গোপনীয়তা ভালো। গোপনীয়তা ভয়াবহ বিপদও ডেকে আনে। গোপনীয়তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেই বিপত্তি। কখনো কখনো তা অসম্ভব কিছু ঘটিয়ে দিতে পারে। কালকে অন্য কাউকে মারার জন্য আজ রাতে ঘরের মধ্যে বোমা লুকিয়ে রাখলে বাসার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী সে-বোমার শিকার হতেই পারে; না জানার কারণে। সত্যকে গোপন করার মধ্যেই মিথ্যা ঘুমিয়ে থাকে, আর এর থেকে জন্ম নেয় পাপের। ইমরান আর মঈনদের জন্য ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। চূড়ান্ত হতে বাকি মাত্র। যতখানি হয়েছে সেটার জন্য সে-গোপনীয়তাই দায়ী – আজ সব ঘটনার নেপথ্যে নায়কের ভূমিকায় যে, তার নাম গোপনীয়তা। ধ্বংসের শেষটা হতে পারেনি – সেটাও এখুনি জানা গেল। জড়িয়ে ধরা আর চুমুটুমু খাওয়াতেই আটকে আছে চূড়ান্ত আবেগ। কালকে ইবনের এক বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা দুজনেরই। বন্ধু একাই থাকে, ওদের জন্য বাসা ছেড়ে দেবে বলেছে। সেখানে শরীর ঘাঁটাঘাঁটির একটা ব্যাপার হয়ে যাওয়া দুরূহ নয় মোটেই, যদিও ইনিতা এ-ব্যাপারে বরাবরই প্রচন্ড আত্মপ্রত্যয়ী – বিয়ের আগে এসব কোনোভাবেই নয়; ‘তা তুমি কাজিনই হও, আর প্রেমিকই হও’। কিন্তু উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ এ-বয়সের দুজন ছেলেমেয়েকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা হয়তো ইনিতা এখনো জানে না। ইনিতাই সেসব জানাল। আজ আর কোনো রাখঢাকের কারণ নেই ওর মধ্যে। সেও জেনে গেছে কী ভয়ানক বাড়াবাড়ি হতে যাচ্ছিল। কম কথা বলার ইনিতা আজ সবই বলছে দ্রুততার সঙ্গে – এ যেন অন্য এক ইনিতা। ইঙ্গিতার কাছে ইনিতাকে আজ অচেনা লাগছে। ব্যাপারটা গতকালই প্রথম – এই একটু জড়িয়ে ধরা আর ইবনের ঠোঁটের ছোঁয়া ইনিতার গালে। ভেজানো দরজার ফাঁকে নানুর সন্ধানী চোখজোড়া না থাকলে ইবনের ঠোঁট গাল থেকে অপর ঠোঁট অবধি অনায়াসেই পৌঁছতে পারত।
না, ইনিতাকে দোষ দিচ্ছে না কেউ। ইবনকেও নয়। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে এবং জেনেও আসছে ফুফাতো-মামাতো ভাইবোন। বয়সও কাছাকাছি। দুজনই নর্থসাউথে যায়। এক ইয়ার আগে ও পরে – এটুকুই পার্থক্য।

আট
কয়েক সেকেন্ডে এসব ইথারে ভেসে চলে যায় ইবনের কাছে। ইবন বাসায় অপেক্ষা করছিল বাবা-মায়ের জন্য। শনিবার হলেও ওর ডিপার্টমেন্ট খোলা। আজ সেমিস্টার ফি দিতে হবে। টাকার জন্য এখনো বাসায় আছে সে। হাঁটতে-হাঁটতে ছাদে যেতে আবার ইঙ্গিতার ফোন।
– ভাইয়া। সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল। আপু সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে…। আববু দেখে ফেলেছে। কোনো বিপদ হয়নি। তবে শরীর খুব খারাপ – মনে হয় হাফসেন্সে আছে, কীসব বকছে।
একটু আগে চরম সত্যটা ইঙ্গিতাই জানিয়েছিল। এখন অন্য কারো সময় নেই ইবনের সঙ্গে কথা বলার।
ইবন খোলা আকাশ দেখে – কী বিশাল তার পরিসর। একবার মনে হয় ছাদ থেকে লাফ দিতে। নিজেকে আবার সামলে নেয় – ইঙ্গিতার মতো বোন আছে তার; ওর জন্য হলেও বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়। মনে মনে ভাবে, বোনকে বড় ভাই চুমু খেতেই পারে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে – ওটা তো ভাইবোনের মধ্যে ছিল না; ছিল প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে। দুটোর অনুভূতি এক নয়, উপলব্ধিও আলাদা আর সমস্যা এখানেই। গা শিউরে ওঠে ইবনের।
আকাশে মেঘ। একটু পরেই বৃষ্টি হতে পারে। ইবনের মনে হচ্ছে আজ রক্তবৃষ্টি হবে – রক্ত থেকেই আদম সৃষ্টি। আজ সে-রক্তে ভিজে পবিত্র হবে সে। আবার ভাবে, না আজ অগ্নিবৃষ্টি হলেই ভালো। অগ্নিবৃষ্টিতে পুড়ে-পুড়ে খাঁটি হয়ে যাবে সে। এমন না হলে কী করে ইনিতার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে! নাকি চলে যাবে দূরে কোথাও, যেখানে ইনিতার চোখ কোনোদিনই যাবে না! কোনো ভাবনাই ইবনের মধ্যে থিতু হচ্ছে না।
এখন কেমন আছে ইনিতা? ভালোবাসার ছোট বোন – একই মায়ের রক্তে; ইঙ্গিতাও। তিনজনের দেহে বইছে একই জিন। তিনজনের নামের শুরুতেই ‘ই’। অথচ…। ভাবতে পারে না ইবন, মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে তার। ততক্ষণে মুষলধারে আষাঢ়ের বৃষ্টি নেমেছে ইবনদের অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে। 