ধাঙড়জীবন কথা

সুব্রত কুমার দাস
রামগোলাম

হরিশংকর জলদাস

প্রথমা
ঢাকা, ২০১২

৩২০ টাকা
হরিশংকর জলদাস (জন্ম ১৯৫৫) বাংলাদেশের উপন্যাসে নবাগত এক নাম, যদিও ঔজ্জ্বল্য আর দার্ঢ্যতায় পুষ্ট তাঁর আগমন। এই মাত্র সেদিন, ২০০৮ সালের বইমেলায় তাঁর প্রথম উপন্যাস জলপুত্রের আবির্ভাব এবং প্রথম সে-প্রয়াসেই বাংলাদেশের পাঠকের চিত্তজয়ী তিনি। লেখকের পারিবারিক পেশা এবং উপন্যাসের মানুষদের জীবনাচারের সাজুয্যের কারণে অদ্বৈত মল্লবর্মণের (১৯১৪-৫১) নামের সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে তাঁর নাম। জলজীবী সমাজের প্রতিনিধি অগ্রজ সে-লেখকের তিতাস একটি নদীর নামের (১৯৫৭) জনমানুষ যেন আশ্রয় নেয় একবিংশ শতাব্দীর শূন্য দশকের সে-উপন্যাসে। এ-ধারাবাহিকতাতেই ২০১০ সালে দহনকাল। সেটিও মৎস্যজীবীদের জীবনাশ্রিত। কিন্তু ঔপন্যাসিক ভুল করেননি তাঁর নির্বাচনে। একই লেখকের কলমে একই জীবনের চিত্র যে ক্লিশে হতে বাধ্য সে-উপলব্ধি থেকেই তিনি ২০১১ সালে লিখলেন কসবি – বেশ্যাজীবন কথা। আর এ-বছরের বইমেলায় রামগোলাম – মেথরজীবনের আখ্যান।
ব্রাত্যজীবন নিয়ে লেখা রামগোলাম পড়তে পড়তে পাঠকের নিশ্চয়ই স্মরণে আসবে সত্যেন সেনের (১৯০৭-১৯৮১) বিদ্রোহী কৈবর্ত (১৯৬৯), মহাশ্বেতা দেবীর (জন্ম ১৯২৬) চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর (১৯৮০) বা অভিজিৎ সেনের (জন্ম ১৯৪০) রহু চন্ডালের হাড় (১৯৮৫) বা গুণময় মান্নার (১৯২৫-২০১০) মুটের (১৯৯২) কথা। পেশাগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে থাকা এমন সব মানুষকে নিয়ে অমিয়ভূষণ মজুমদারের (১৯১৮-২০০১) মহিষকুড়ার উপকথা (১৯৮১) বা বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবীও (১৯৯৭) অসামান্য সৃজন। মহিষকুড়ার উপকথাতে বাথানের শ্রমজীবীদের কথা আর বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবীতে রয়েছে শূকরপালকদের জীবনচিত্র। সে-পৃথিবীর প্রধান মানুষটি তো পায়খানার গাড়ির ড্রাইভার হারান। হারানের সহযোগী চরিত্রটি? হ্যাঁ, তার মেয়ে চৌদ্দ বছর বয়সী তরু, যে-কন্যার পেটে পিতা হারানের সন্তান। এই যে নিম্নবর্গের জীবনালেখ্য তাঁর ইতিহাস বাংলা উপন্যাসে হ্রস্ব নয়। সতীনাথ ভাদুড়ীর (১৯০৬-৬৫) ঢোঁড়াই চরিতমানস (১৯৫৯) উজ্জ্বল এক উদাহরণ। আবার যদি জেলেজীবনের প্রসঙ্গেই আসি, যে-ঔপন্যাসিকেরা সামনে ভাসেন তাঁদের মধ্যে পদ্মানদীর মাঝির (১৯৩৬) জন্যে খ্যাত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-৫৬) বা কুরপালার (১৯৪৬) রমেশচন্দ্র সেন (১৮৯৪-১৯৬২) বা গঙ্গার (১৯৫৭) সমরেশ বসুর (১৯২৪-৮৮) কথা মনে পড়ে।
ডোম, হাড়ি, নিষাদ, বাগদী, কৈবর্ত, কোল, ধীবর প্রভৃতি ব্রাত্য পেশার মানুষেরা বাংলা উপন্যাসে জোরেশোরে উপস্থিত হতে শুরু করে কল্লোলের কাল থেকেই। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের বৈষম্য বিষয়ে সচেতনতা সে-লেখকদের দৃষ্টিভ্রম কাটিয়ে তাঁদেরকে উপস্থিত করলো নিম্নবর্গের সে-মানুষদের দোড়গোড়ায়। রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) বা শরৎচন্দ্রের (১৮৭৬-১৯৩৮) উপন্যাসে যে-নিম্নবর্গকে দূর থেকে দার্শনিক দৃষ্টিতে অবলোকন করা হয়, কল্লোলে এসে সে-দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষতা যুক্ত হলো, যার পরিণতিতে কয়লাখনির শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, মুটে, মুচি, পতিতা প্রভৃতি শ্রমদাসও এসে শামিল হয়। জগদীশ গুপ্তের (১৮৮৬-১৯৫৭) উপন্যাসগুলো যাদের পড়া আছে তারা নিশ্চয়ই সাহিত্যে নিম্নবর্গীয়ের স্থান নিয়ে বিতর্ক তুলবেন না। অস্পৃশ্য সে-মানুষগুলো স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সমাজে ক্রমে ক্রমে মূল জনস্রোতের সঙ্গে একীভূত। ১৯৪৭-এর ভারত-ভাগ, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষকে তাঁর সহস্র বছরের শ্রম-বিভাজিত সমাজ থেকে অনেকটাই মুক্তি দিয়েছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৮-১৯৭১) কালিন্দী (১৯৪০) বা কবি (১৯৮২) বা সন্দীপন পাঠশালা (১৯৪৬) প্রভৃতিও ছিল ভেদ-অভেদের চিত্রণ। অস্পৃশ্যতার ছুতমার্গে আটকে রাখা দলিত মানুষের যে-দীর্ঘশ্বাস তার সুগভীর ধ্বনি বাংলা উপন্যাসে শতাব্দী পেরিয়েও বর্তমান। রামগোলাম তেমন দীর্ঘশ্বাসেরই এক শীলিত, মথিত চিত্র।
রামগোলাম শুরু হয় নাম চরিত্রের মানুষটিকে দিয়েই। চট্টগ্রামের চারটি মেথরপট্টির মানুষদের সর্দার মান্যবর গুরুচরণের নাতি রামগোলাম তার এমন নামের পেছনের রহস্য জানতে ব্যাকুল। আর সে-ব্যাকুলতা নিরসনে সর্দারের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় আজন্ম ক্রোধ আর হতাশা। ‘হিন্দুসমাজে আমরা অচ্ছুত। বড় অপবিত্র জাতি আমরা। আমাদের ছোঁয়া তো দূরের কথা, আমাদের ছায়া মাড়ালেও হিন্দুরা, বামুনরা অপবিত্র হয়ে যায়।… তাদের দেখাদেখি মুসলমানরাও আমাদের ঘেন্না করে, মানুষ ভাবে না। জন্তুর মতো আচরণ করে আমাদের সাথে’ (পৃ ১১)। হিন্দু হরিজনদের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মের নামে নিচতর পেশার মানুষ হিসেবে অগ্রাহ্য করার এই ভাবনাই গুরুচরণকে ক্লান্ত করে, একই সঙ্গে অপরাধ বোধ জন্মায় রামগোলামের ভেতরে, যা সঞ্চারিত পাঠকহৃদয়েও।
গুরুচরণের দীর্ঘলালিত এমন ক্ষোভ থেকেই সিদ্ধান্ত আসে নাতির নাম হবে ‘রামগোলাম’, যে-নামের ভেতরে লুকিয়ে আছে হিন্দুদের দশ অবতারের প্রধান রামচন্দ্রের নাম এবং একই সঙ্গে ‘মুসলমানি’ শব্দ ‘গোলাম’। দাদুর ধারণা, এই নাম তার নাতিকে বাঁচিয়ে দেবে লাথি-কিল থেকে, ‘শালা-বানচোৎ’ গালি থেকে। কিন্তু দুইশো পৃষ্ঠা দীর্ঘ উপন্যাসটির শেষে পাঠক আবিষ্কার করেন, রামগোলামের মুক্তি হয়নি। বরং নিজ সমাজের নিজ পেশার মানুষদের মুক্তির সপক্ষে কাজ করতে গিয়ে মিথ্যা মামলায় চৌদ্দ বছর জেল হয় তার। জেল শেষে ফিরিঙ্গি বাজারের হরিজন পল্লিতে ফিরে আসে সে, অপেক্ষায় থাকে হরিজন মুক্তির আন্দোলনে নতুন নেতার আগমনের।
একুশটি অধ্যায়ে বিশ্লিষ্ট রামগোলাম উপন্যাসটি। একুশতমটি কিন্তু খুব ছোট – জেল-ফেরত রামগোলামের প্রত্যাশার কথা। বাকি বিশটি জুড়ে রয়েছে তিন প্রজন্মের কথা। গুরুচরণ-শিউচরণ-রামচরণ। তিন প্রজন্মের মানুষই কিন্তু একসঙ্গে দুই রুমের একই ঘরে বাস করে মেথরপল্লিতে। কাজ করে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে। আঠারো পেরোলেই তারা চাকরিতে যায়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। কাজও সবার প্রায় একই রকমের – ময়লা সাফ। কারও জন্যে পায়খানা পরিষ্কারের, কারো ভাগে রাস্তাঘাটের ময়লা। কেউ সেখানে ময়লা গাড়ির ড্রাইভার। বড় হৃদয়বান সে-ড্রাইভার, যার নাম গুরুচরণ। পুরো ধাঙড় সম্প্রদায়কে আগলে রাখে সে। সম্প্রদায়ের প্রতিটি নাগরিক তাকে মান্য করে।
রামগোলামের কাহিনি সেই গুরুচরণকে আশ্রয় করে। অথবা বলা যায়, উপন্যাসটি আসলে রামগোলামকে আশ্রয় করে যে কিনা প্রকৃতপক্ষে গুরুচরণেরই প্রতিভূ। অথবা আরো সহজ করে বলা যায়, এটি আসলে কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে আশ্রয় করে নয়, বরং গুরুচরণ বা রামগোলামের পরিবারিক পেশা মেথরবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত সকল মানুষকে আশ্রয় করে। আর সে-কারণেই উপন্যাসজুড়ে ওই মানুষদের নিয়ে হাহাকার যেন কিছুতেই থামে না।
সে-হাহাকার আর অসহায়ত্বের মাঝে কেউ কেউ জেগে ওঠে ব্যক্তিগত পরিচয়ে, লোকচক্ষুকে আড়াল করতে। কেউ কেউ সামষ্টিক জাগরণকে মুখ্য মনে করে। সকলকে সঙ্গে নিয়ে সামাজিক যে-লড়াই সে-লড়াইয়ের প্রধান পুরুষ গুরুচরণ, যে কিনা ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়নি কখনো। আর তেমন বোধকেই আশ্রয় করে দলের নেতা হয়েছিল মেথরপল্লির প্রথম এসএসসি পাশ করা ছেলে রামগোলাম। করপোরেশনে ছোট জমাদারের চাকরি নিয়েও সে বিক্রীত হয়ে যায়নি, অর্থ এবং লোভ তাকে তার সামাজিক দায়িত্ব থেকেও বিরত করতে পারেনি। চেতনার শাসন এমন তীক্ষ্ণ ছিল যে, চৌদ্দ বছরের জেলজীবনও তাকে খর্ব করেনি।
জেলটা হয়েছে কিন্তু নিজের সম্প্রদায়ের মানুষদের পেশাকে নিরাপদ রাখতে গিয়ে। করপোরেশন চেয়েছে মেথরদের বাইরের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধকে এমন কাজে সম্পৃক্ত করতে কিন্তু বাধা দিয়েছে ধাঙড়রাই। তাদের বক্তব্য, একজন ধাঙড়ের যেহেতু অন্য পেশায় যোগদানের কোনো সুযোগ নেই, তাই কেন ধাঙড়দের পেশায় অন্যরা ভাগ বসাবে। ঘুষ নিয়ে অন্য লোকদের চাকরিতে অনুপ্রবেশের পথে অন্তরায় ছিল রামগোলাম আর তার পেছনে হাজার পাঁচেক হরিজন। চাকরিপ্রার্থী হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ আর হরিজনরা মুখোমুখি হয়ে পড়লো। চেঁচামেচি, হট্টগোল, গালাগালি গিয়ে ঠেকলো মারামারিতে। খুন হলো যোগেশ। কাজটা করলো করপোরেশনের বড়সাহেব। কিন্তু কাজটার জন্য ওই বড়সাহেবই থানা থেকে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিলো রামগোলামকে। হত্যা মামলার আসামি হলো রামগোলাম আর হত্যার পরিকল্পনাকারী বড়সাহেব আবদুস সালাম হলো খুনের প্রত্যক্ষদর্শী।
এই যে খুনের মতো চূড়ান্ত ঘটনায় পৌঁছানো এর ক্ষেত্রটাই তৈরি হয়েছে উপন্যাসজুড়ে। সামাজিক অস্পৃশ্যতার অভিশাপের সঙ্গে বারবার যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন অনুষঙ্গ। ধাঙড়পল্লির স্কুলে ধাঙড়দের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাদের মন্দিরের পাশে কসাইখানা করা হয়েছে, যেখানে থেকে জবাই করা গরু-খাসির রক্তে ভেসে গেছে ধাঙড়দের চিরায়ত বিশ্বাস। এভাবেই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদের কোপানলে পড়েছে অশিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত সাধারণ চিন্তা-ভাবনার এই মানুষেরা। শত-সহস্র বছরের সামাজিক ক্লেদ স্বাধীন বাংলাদেশে এসে নতুন আঙ্গিকে ধাঙড়দের ওপর চড়াও হয়েছে।
বাঙালি তথা ভারতীয় সমাজে সামাজিক এই অনাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মেথর রাধা আর শক্তিচন্দ্র ভিন্ন কলোনিতে বাসা ভাড়া নিয়েছিল। পোশাক-পরিচ্ছদে প্রমাণ করতে আপ্রাণ হলো দুজনে; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি ওদের। আসন্ন সন্তানপ্রসবা রাধাকে বাড়িওয়ালা জহিরউদ্দিন ঘেন্নায় তাড়িয়ে দিয়েছে। তার আসন্ন মৃত্যুও কোনো প্রতিবেশী বাঙালি হিন্দু-মুসলমানকে ‘মানুষ’ বানাতে পারেনি।
এই যে সামাজিক অনাচার তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দরকার সামাজিক লড়াই। রামগোলাম হয়তো এমন ইঙ্গিতই দেয়। আর তাই মধ্যবিত্তের নাঁকিকান্নার উপন্যাস না হয়ে, এটি হয়ে পড়ে দার্ঢ্যের এই চূড়ান্ত চিত্রণ। যে-দার্ঢ্যের আপাত জয় নেই, কিন্তু জয়ের প্রত্যাশা আছে। সামষ্টিক সে-লড়াই তীব্র বলেই গুরুচরণের মৃত্যু হলে তাকে ‘মেথর’ বলে হিন্দুদের শ্মশানে পোড়াতে দিতে বাধে। আর সে-বাধার জয় হয় ঐক্যবদ্ধতার ভেতর দিয়েই। চতুর্থ অধ্যায়ে ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক যে ধারাবাহিক দন্ড মেথরদের ওপর তুলে দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে যূথবদ্ধ শক্তিতে বেরিয়ে আসছে যেন রামগোলামের মতো গোলামেরা।
অসাধারণ সুখপাঠ্য এ-উপন্যাসের কয়েকটি দুর্বলতার দিকে এবার চোখ ফেরাতে চাই। যথার্থ বিবেচনা করলে সেগুলোর কিছু কিছু পরবর্তী সংস্করণে এড়ানোও সম্ভব বলে মনে হয়। প্রথম যে বৈশিষ্ট্যচ্যুতি পাঠকের চোখে পড়বে সেটি হলো মেথরদের ভাষা। যে-ভাষায় বঙ্গদেশে আশ্রিত হরিজনরা আলাপন করে থাকে তেমনটি হুবহু গ্রহণ করা না হলেও সেটির কাছাকাছি একটি ভাষাকে ধারণ করা ঔপন্যাসিকের কর্তব্য ছিল বলে মনে হয়। হয়তো সেটি গড়পড়তা বাংলাভাষী পাঠকের কাছে দুষ্পাঠ্য হবে আশঙ্কায় হরিশংকর সেটিকে এড়িয়েছেন, কিন্তু স্কুলশিক্ষক কুতুবউদ্দীনের মুখে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা বসাতে কিন্তু ঔপন্যাসিক পশ্চাৎপদ হননি। ভাষা-ব্যবহারের লেখকের এমন সিদ্ধান্তের কারণে মেথর সমাজের সকলের মুখের ভাষাই হয়ে যায় প্রমিত চলিত ভাষা। যার কারণে শিক্ষিত রামগোলামের সঙ্গে অশিক্ষিত সহজনদের ভাষাগত ভিন্নতা অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। আর তাই যখন এসএসসি পাশ রামগোলামের কথাবার্তার প্রশংসা করে বলা হয় ‘তুমি তো ভালো গুছিয়ে কথা বলো’ তখন তা পাঠকের কাছে মিথ্যে ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। অস্বাভাবিক এমন কথ্যভাষার পরিমিতিতে যখন কুতুবউদ্দীনের মতো মননশীল শিক্ষিত মানুষ বলেন, ‘নদী তো তোমরা চিন… কী সোন্দর হানি তার…’ (পৃ ১১৫), তখন কুতুবউদ্দীনের শিক্ষা এবং মননশীলতাকেই চপেটাঘাত করা হয় যেন।
এবার আসছি কাহিনির সময়কাল প্রসঙ্গে। উপন্যাসের শুরুতে গুরুচরণ যখন সর্দারের পদে আসীন, তখন যেন মনে হচ্ছিল সময়টা ভারত বিভাগের পরপরই। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে সেটি মুক্তিযুদ্ধের কাল অতিক্রম করেছে। করে অনেক বেশি দূর পর্যন্ত এসে গেছে যেন। কেননা, শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটির দিনও বলা হচ্ছে (পৃ ১০২)। এবং এরও পরে অনেক দিন পার হয়ে তবেই না চূড়ান্ত বিদ্রোহের ঘটনা যার পরিণতিতে রামগোলামের চৌদ্দ বছর জেল। এ-ব্যাপারে ঔপন্যাসিকের খানিকটা অনবধান কাজ করছে কি?
এ ছাড়া, আমরা তো প্রথম থেকে এমন ধারণাতেই ছিলাম যে, মেথরদের অন্য পেশায় যাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে রাধিকা ‘ভালো চাকরি’ (পৃ ১৪৯) পেল কীভাবে?
তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি রামগোলামের বাবা শিউচরণ এবং মা চাঁপারাণীর স্বপ্ন-সম্ভাবনা এবং স্বপ্নভঙ্গের ইঙ্গিত। চাঁপারাণীর স্বপ্ন ছিল ‘আমি কিন্তু আমার রামগোপালকে পড়াব। স্কুলে ভর্তি করাব তাকে…’ (পৃ ২৬)। সে-স্বপ্ন ভাঙতে থাকে যখন শিউচরণ বলে, ‘ওরা পড়তে দেবে না রামগোলামকে। ওরা মেথরদের পড়তে দেয় না…’ (পৃ ২৮)। অসাধারণ এক চিত্র। নবাগত শিশুকে নিয়ে পিতামাতার ঐতিহাসিক স্বপ্নযাত্রা যেন। কিন্তু একটা ফাঁক রয়ে গেছে এখানে। চাঁপারাণীও তো ওই পল্লিরই মানুষ, সেও তো ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছে পড়াশোনার অধিকার নেই মেথরদের। তাহলে অনধিকারের কথা শোনার পর বিস্মিত কেন সে?
বাংলাদেশের উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের ছড়াছড়ি। সে-জীবনের বহুধা বৈশিষ্ট্য আমাদের উপন্যাস-জগৎকে শাসন করে। মধ্যবিত্তের সামাজিক জঞ্জাল, ব্যক্তিক দ্বন্দ্ব, মানসিক খিন্নতা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসে প্রবল প্রতাপশালী। সে-প্রতাপে কাঁদো নদী কাঁদো, পুষ্প, বৃক্ষ এবং বৃহঙ্গ পুরাণ, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল বা উড়ুক্কু প্রভৃতির লেখকরা সংযোজন করেছেন অভিনবত্বের নিশান। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকে আশ্রয় করে বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, জীবন আমার বোন প্রভৃতির লেখকেরা সংযোজন ঘটান নতুন কাহিনির। কাঞ্চনগ্রাম, সংশপ্তক, আগুনপাখি, প্রদোষে প্রাকৃতজন, খোয়াবনামা, গায়ত্রী সন্ধ্যা, মধ্যাহ্ন, নূরজাহান বা জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণার কথাকাররা বাংলাদেশের উপন্যাসকে নিয়ে যান এক আকাঙ্ক্ষিত উচ্চতায়। কবে পোহাবে বিভারবী, পদ্মা মেঘনা যমুনা, অজগর বা নুহূলের মানচিত্র উচ্চমার্গীয় হয়েও অনাদৃত। আদৃত হওয়ার জন্য বিজ্ঞাপনী ভাষা হয়তো সেসব লেখকের নিউরনে কাজ করেনি। অসাধারণ রামগোলাম তাই হয়তো পাঠক-আকর্ষণ করতে ব্যবহার করে লিবিডোকে; আর সে-তাড়না উসকাতে বলা হয় ‘হরিজনদের প্রকাশ্যে স্পর্শ করতে বাধে, কিন্তু গোপনে ভোগ করতে দ্বিধা হয় না।’ বর্তমান আলোচকের সৌভাগ্য, বিজ্ঞাপনী সে-ভাষা গ্রন্থটি পাঠে তাঁকে প্রথম পর্যায়ে বিরত রাখলেও, সে-বিরতি শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। আর তার ফলেই সম্ভব হয় বাংলাদেশে রচিত বাংলা উপন্যাসের সাম্প্রতিককালের অন্যতম এক কারিগরকে নতুন অবলোকনে।
পাঠকের ভাগ্য যে, হরিশংকর ‘গোপন ভোগে’র কাহিনি ফাঁদেননি তাঁর রামগোলামে। বরং তিনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হরিজনদের জীবনচিত্র এঁকেছেন। ফাঁকি নেই তাঁর অঙ্কনে। মনন আর বোধের উচ্চমার্গেই হরিশংকর জলদাস। আর সে-কারণেই রামগোলাম হয়েছে বাংলা উপন্যাসের দেড়শো বছরের ইতিহাসে মূল্যবান এক যুগান্তকারী সংযোজন। 