কর্ণফুলী ফোক ট্রিয়েনাল : শিল্পের সত্তায় সংস্কৃতির সেতুবন্ধ

সঞ্জয় চক্রবর্ত্তী

উনিশশো বাইশ সালে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপকালে ইংরেজি ‘কালচার’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সংস্কৃতি’ শব্দের ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রবীন্দ্রনাথ পূর্বে ‘কৃষ্টি’ শব্দটি ব্যবহার করলেও ওই বৈঠকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে বলেন যে, ইংরেজি ‘কালচার’ শব্দের বাংলা ‘সংস্কৃতি’ই যথার্থ। ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির উনিশশো ত্রিশের আগে তেমন একটা ব্যবহার লক্ষ করা যায় না। আজকাল এই শব্দের বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। শব্দটির উৎস অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঋগ্বেদে এই শব্দের ব্যবহার না থাকলেও ব্রাহ্মণ গ্রন্থে এর উলেস্নখ রয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে শিল্পদ্রব্য কী, সে-বিষয়ে উলেস্নখ করতে গিয়ে বলা আছে যে, ‘মনুষ্য-নির্মিত যেমন হসত্মী অর্থাৎ হাতির দাঁতের কাজ, কাংস বা ধাতবপাত্র, বিবিধ প্রকারের বস্ত্র, স্বর্ণনির্মিত অলংকারাদি, অশ্বতরীযুক্ত রথ ইত্যাদি সকল বস্ত্ত শিল্পের অমত্মর্গত। এই শিল্পসমূহ হচ্ছে আত্মার সংস্কৃতি, এগুলো দ্বারা সাধারণ গৃহস্থ নিজেকে ছন্দময় করে তোলেন।’ ভারতীয় উপমহাদেশে শিল্প বলতে পুরাকাল থেকেই বোঝানো হয়েছে জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল কর্মকা-ই শিল্পের অমত্মর্গত, এ-কারণেই রন্ধন থেকে শুরম্ন করে তরবারি চালনা, প্রসাধন থেকে তাঁত বোনা সকলই চৌষট্টিকলার অমত্মর্গত। এমনতর শিল্পকর্মকা- নিয়ে যখন কোনো জাতির সংস্কৃতি তৈরি হয়, তখন তার নিজের সংস্কৃতি নিয়ে আত্মসুখ উপলব্ধি কোনো অর্বাচীন বিষয় নয়। সংস্কৃতি একটি জাতির মধ্যে কীভাবে ক্রিয়া করে – এ-ব্যাপারে প–ত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলছেন, ‘সংস্কৃতির মূল প্রবৃত্তি হইল উত্তমমন্যতা (সুপেরিয়রিটি কমপেস্নক্স) নিজেকে সর্বব্যাপারে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা, অর্থাৎ অপর দশজনের উপর থাকার আকাঙক্ষাই মূলত সংস্কৃতিপরায়ণতার প্রেরণা যোগায়। এই উত্তমমন্যতাই স্বার্থপরতার জন্ম দেয়, এই নূতনের পিপাসা ও গতিশীলতাই মানুষের রম্নচি, প্রকৃতি ও প্রবৃত্তিকে সুষমা দান করে।’ সভ্য মানুষের বিবর্তনের যে-ধারাবাহিকতা তা বোঝার জন্য শিল্প-সংস্কৃতির কোনো বিকল্প নেই। যে-কোনো জাতি গড়ে ওঠে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এবং সেইরূপে তার সংস্কৃতিও গড়ে ওঠার পেছনে থাকে দীর্ঘ ইতিহাস। পৃথিবীর নানা প্রামেত্ম রয়েছে হাজার হাজার জাতি, উপজাতি এবং রয়েছে তাদের হাজার রকমের সংস্কৃতি। কোন জাতি কত বেশি উন্নত জীবনযাত্রার অধিকারী বা সাহিত্যবিশারদ যাকে বলছেন উত্তমমন্যতার অধিকারী তা নির্ধারিত হয় তার সংস্কৃতি পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে। আর সংস্কৃতি পর্যালোচনায় স্বাভাবিকভাবে চলে আসে সৃষ্ট শিল্প ও শিল্পকর্মকা- থেকে।

বিশের প্রায় পুরোটা শতক জুড়ে সারা পৃথিবী ছিল আধুনিকতার মোহে আবিষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে আধুনিকতা এই উপমহাদেশে ইউরোপপ্রীতি ছাড়া আর কিছু দিয়েছে কিনা সন্দেহ। শিল্পচর্চায় যার প্রভাব পড়েছে গুরম্নতর, আত্মসচেতন ইউরোপীয় আধুনিকতা শুধু যে শিল্পীকে সমাজবিচ্ছিন্ন করেছে তাই নয়, শিল্পীর শিল্পচর্চাকে করেছে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। সমাজ ও শিল্পীর সম্পর্কের কারণে যে-কোনো সমাজে শিল্পীর সমাজের প্রতি যে-দায়বদ্ধতা থাকে, তা বিস্মৃত হয়েছে প্রবলভাবে। অনেকে অবশ্য এর জন্য দায়ী করেছে অন্ধ পাশ্চাত্যপ্রীতিকে। ফলে আধুনিক ইউরোপে শিক্ষাগ্রহণে আত্মসচেতন শিল্পীর শিল্পচর্চা হয়ে উঠেছে শুধু ক্যানভাসকেন্দ্রিক। লক্ষ করলে দেখা যায়, সত্তর আর আশির দশকে শিল্পীদের দ্বারা সমাজ পরিবর্তনের তেমন কোনো উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি বঙ্গদেশে। ফলে যে-আধুনিকতার মানদ– নববইয়ের দশকের আগে দক্ষিণ এশীয় শিল্পচর্চাকে দেখা হতো তা ধীরে-ধীরে পরিবর্তন হতে শুরম্ন করে একুশ শতকের ঊষালগ্নে এসে। এডওয়ার্ড সায়ীদের প্রাচ্যকে দেখার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আর রাষ্ট্র, ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিকে বোঝার জন্য মিশেল ফুকোর মতো দার্শনিকের নতুন দিশা একুশ শতকের মানুষের ভাবনাকে অনেকটাই পালটে দিয়েছে। পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক চিমত্মার থেকেও মানুষ অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠছে নিজস্ব শিল্পসংস্কৃতি চর্চার চরিত্র অনুসন্ধানে।

নতুন সময়ের পরিপ্রেক্ষেতে এ-ধরনের সচেতনতা পালটে দিয়েছে নতুন পৃথিবীর শিল্পকর্মকা-কেও। লক্ষ করলে দেখা যায়, নববইয়ের দশক পর থেকে সমগ্র পৃথিবীজুড়ে আমত্মর্জাতিক প্রদর্শনীগুলো পৃথিবীর নানা স্থানে ছড়িয়ে গেছে। আমত্মর্জাতিক বিয়েনাল প্রদর্শনীগুলো আয়োজিত হচ্ছে আফ্রিকা, জাপান, কোরিয়া, সৌদি আরব, ভারতসহ পৃথিবীর নানা প্রামেত্ম। উত্তরাধুনিক শিল্পচর্চার পাশাপাশি ঐতিহ্যগত শিল্প সংরক্ষণের ও প্রদর্শনীর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে প্রতিটি দেশ। বিশ্বদরবারে প্রত্যেক জাতি তার সংস্কৃতির মৌলিকতা প্রদর্শনে হয়ে উঠছে অনেক বেশি সচেষ্ট। যে-সকল দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছে, তারা যত্নশীল হচ্ছে  তার সংস্কৃতি সংরক্ষণে। এ-প্রসঙ্গেও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের একটি উক্তি খুব প্রাসঙ্গিক, – ‘সংস্কৃতির জন্ম-প্রেরণা যেখান হইতেই আসুক না কেন, সংস্কৃতির উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসার পরিবেশ-নিরপেক্ষ নহে। এই পরিবেশের প্রধান উপাদান ঐতিহ্য। ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার অর্থ ভিত্তিকে অস্বীকার করা। মাটি ভিত্তি করিয়া তাজমহল দাঁড়াইয়া আছে। সেই মাটির গুরম্নত্ব অনেকখানি। ইহা ছাড়া তাজমহল তৈরি সম্ভব ছিল না। তেমনি ঐতিহ্য-সম্পর্কবিহীন সংস্কৃতি-সাধনাও অসম্ভব।’ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যতই আসুক না কেন, একটি জাতি তার সংস্কৃতির চর্চা ছাড়া কখনোই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। ফলে অর্থনৈতিকভাবে সকল স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি তার সংস্কৃতি বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়, এই ভাবনাকে মাথায় রেখেই দীর্ঘ ষোলো বছর ধরে চট্টগ্রামের আর্ট অরগানাইজেশন ‘সমত্মরণ’ কাজ করে যাচ্ছে। ‘মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য শিল্প’ সেস্নাগানে সমত্মরণ এ-পর্যমত্ম যে-সকল শিল্পকর্মকা- আয়োজন করেছে তার মধ্যে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দেশীয় সংস্কৃতির উৎস অনুসন্ধান ও তার সঠিক চর্চা। সমত্মরণ বিশ্বাস করে নিজস্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও চর্চা ছাড়া কোনো জাতির বৌদ্ধিক উত্তরণ সম্ভব নয়।

ষোলো বছরের অর্ধশতাধিক শিল্পকর্মকা–র ধারাবাহিকতায় ‘সমত্মরণ’ এবার ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ আয়োজন করে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে প্রচলিত থাকা শত বছরের ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যবাহী প্রায় আটটি চিত্রশিল্পধারাকে নিয়ে চট্টগ্রামের প্রথম ‘কর্ণফুলী ফোক ট্রিয়েনাল’। এই শিল্পকর্মযজ্ঞে প্রদর্শিত ঐতিহ্যবাহী শিল্পের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হলো লোকশিল্পবিষয়ক সেমিনার ও লোকশিল্পকেন্দ্রিক সংগীতকলা এবং লোকচিত্রকলা নিয়ে কর্মশালা। ট্রিয়েনালের সম্পূর্ণ আয়োজনে ছিল দুটি পর্ব। প্রথম পর্ব আয়োজিত হয় সপ্তাহজুড়ে চট্টগ্রামে এবং দ্বিতীয় পর্ব ঢাকায়। চট্টগ্রাম পর্বের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারম্নকলা ইনস্টিটিউটের ‘রশিদ চৌধুরী গ্যালারি’তে এবং কর্মশালা হয় একই ইনস্টিটিউটের সেমিনার হলে। চট্টগ্রাম পর্বের আরেকটি উলেস্নখযোগ্য বিষয় ছিল সেমিনার ও প্রেজেন্টেশন, যা অনুষ্ঠিত হয় ‘বিসত্মার-আর্ট কমপেস্নক্সে’। দ্বিতীয় পর্বে ঢাকাতে প্রদর্শনী ‘ঢাকা শিল্পকলা একাডেমীতে’, কর্মশালা ‘চর্চা’ আর্ট গ্যালারিতে এবং সেমিনার ও প্রেজেন্টেশন ‘ওরিয়েন্টাল স্টাডি গ্রম্নপে’র তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারম্নকলা অনুষদের লেকচার থিয়েটার হলে। যেসব ঐতিহ্যবাহী মৌলিক শিল্পধারা এ-প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত হয়েছে তার মধ্যে ছিল নেপালে থানকা/ পবা চিত্র ও মিথিলা লোকচিত্র, ভারতের মধুবনী, মেদনীপুর পটচিত্র, বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস এবং বাংলাদেশের সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং, রিকশা-অ্যাপিস্নক ও আলপনা চিত্র।

হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের ভাষা, জীবনযাত্রা ও এর সংস্কৃতি। এই উপমহাদেশে এমন জায়গা খুব কমই পাওয়া যাবে, যেখানে বাঙালি ও পাহাড়ি সংস্কৃতি দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকতায় পাশাপাশি প্রবাহিত হয়েছে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতি চট্টগ্রামের বুকে চর্চা হয়েছে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে। ফলে চট্টগ্রামের লোকশিল্প এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চা নিজস্ব চরিত্র নিয়ে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। সমত্মরণের এই আয়োজনের পেছনে একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল, চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকে আমত্মর্জাতিক পরিম-লে পরিচিত করানো। শিল্পের হাজারো উপকরণের ভেতরে যে চট্টগ্রামবাসীর জীবনধারণ তাকে নতুন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন আবহে উপস্থাপন এবং তারই পাশাপাশি বাংলাদেশের লোকশিল্পের দীর্ঘ পরম্পরার সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের লোকশিল্পের সেতুরচনা। যেমন রিকশা-অ্যাপিস্নক এই ট্রিয়েনালের একটি উলেস্নখযোগ্য প্রদর্শিত শিল্পকর্ম। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার মতো চট্টগ্রামে রিকশাকে ঘিরে যে-শিল্পকর্ম দেখা যায়, তার ধারাবাহিকতা প্রায় গত অর্ধশতকের। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে রিকশাশিল্পের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, কিন্তু কিছু জিনিস অপরিবর্তিত থেকে গেছে কালের প্রবাহে। রিকশাশিল্পের নানা ধরনের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য রিকশাকে ঘিরে তৈরি হওয়া নানা রঙের পস্নাস্টিক দিয়ে করা রংবেরঙের অ্যাপিস্নকের কাজ। চট্টগ্রামে গত প্রায় চার দশক ধরে বিচিত্র এই অ্যাপিস্নকের কাজ করছেন শিল্পী মদন মিস্ত্রি। তাঁর কাজ এতই জনপ্রিয় যে, একসময় তাঁর মৌলিক ধরনের নকশা ‘মদন হুড’ নামে চট্টগ্রামে প্রচলিত ছিল। তাঁর কাছ থেকে কাজ শিখেছেন অর্ধশতাধিক শিল্পী, যাঁরা বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রামের নানা জায়গায় রিকশার অলংকরণের কাজ করছেন। এই শিল্পীরই করা শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে সমত্মরণের এই আয়োজনে। রিকশা-অ্যাপিস্নক ছাড়াও চট্টগ্রামের উলেস্নখযোগ্য আরেকটি যে-চিত্ররীতি এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে তা হলো আলপনা চিত্রকর্ম। আলপনা বা রঙ্গোলি ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় লক্ষ করা যায়, অনেক বিখ্যাত তাত্ত্বিক তো ভারতীয় গুহাচিত্রের সঙ্গে এর প্রাচীনত্ব প্রমাণেও কাজ করেছেন। ভারতবর্ষের যে-কোনো অঞ্চলের মতো তাই নিঃসন্দেহে চট্টগ্রামের আলপনাকে শিল্পের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করা যায়। প্রথমবারের মতো তাই চট্টগ্রামের আলপনা প্রদর্শিত হচ্ছে ‘কর্ণফুলী ফোক ট্রিয়েনালে’। এখানে যে-শিল্পীর কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পশ্চিম শাখপুরা গ্রামের শিল্পী সাথী চক্রবর্তী। বাংলাদেশের তৃতীয় যে-শিল্পধরনটি এ-প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে তা হলো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং। প্রথম প্রজন্মের যেসব শিল্পীর দ্বারা ঢাকায় ব্যানারচিত্র শুরম্ন হয়েছিল তাঁদের মধ্যে আবদুল ওয়াহাব, মোহাম্মদ সেলিম উলেস্নখযোগ্য। এঁদের সঙ্গেই যুক্ত হন স্থানীয় স্বশিক্ষিত কিছু শিল্পী, যাঁদের মধ্যে ছিলেন পিতল সুর, এ.জেড. পাশা, সুভাষ দত্ত, সুতেন সরকার প্রমুখ। মোহাম্মদ সেলিমের কাছ থেকে কাজ শিখে বিখ্যাত হয়েছেন যে-কজন তাঁদের মধ্যে গুলফাম হোসেন উলেস্নখযোগ্য। গুলফাম হোসেনের একামত্ম কাছের শিল্পী ছিলেন গিরিন দাস এবং যে-শিল্পীর কাজ কর্ণফুলী ফোক ট্রিয়েনালে প্রদর্শিত হয়েছে তিনি হলেন গিরিন দাসের শিষ্য শিল্পী মোহাম্মদ হানিফ পাপ্পু। সত্তর ও আশির দশকে শিল্পী পাপ্পু ছিলেন ব্যানারশিল্পে ঢাকার একজন উলেস্নখযোগ্য শিল্পী।

কর্ণফুলী ফোক ট্রিয়েনালের উলেস্নখযোগ্য অংশগ্রহণকারী দেশ ভারত। ভারতের যেসব লোকচিত্রকর্মের ধরন এই আমত্মর্জাতিক প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত হয় তার মধ্যে আছে মধুবনী অঞ্চলের চিত্রকর্ম যা ‘মধুবনী চিত্রকলা’ নামে অধিক পরিচিত। যেসব শিল্পীর কাজ এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে আছেন বিমলা দেবী, ববিতা শাহ, রণজিত ঝা এবং পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের গণেশ চিত্রকর, জয়দেব চিত্রকর, আনোয়ার চিত্রকর এবং মনিমালা চিত্রকরের কাজ। এছাড়া প্রদর্শিত হয়েছে বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত শিল্পী বিদ্যুৎ ফৌজদারের দশাবতার তাস। আমত্মর্জাতিক এই শিল্প-আয়োজনের প্রধান দেশের ভূমিকা পালন করেছে নেপাল। নেপালের তঙ্খাশিল্পী দরজে গুরম্ন লামার তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের তঙ্খাচিত্রের কর্মশালা। দরজে গুরম্ন লামার উলেস্নখযোগ্য তঙ্খাচিত্রও ছিল প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ। দরজে গুরম্নর পাশাপাশি নেপালের যেসব শিল্পীর কাজ প্রদর্শিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে ছিলেন সমুদ্র মান সিং শ্রেষ্ঠা, উজয় বজ্রচার্য, সনজীব শাক্য, শ্যাম সুন্দর যাদব, এস.সি. সুমন, মিথিলা দেবী, কৃষ্ণা তামাং, রাম প্রকাশ শ্রেষ্ঠা, লোকচিত্রকর, পাসাং হোজের লামা, প্রচ- চিত্রকর প্রমুখ।

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে লোকশিল্পকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এমন আমত্মর্জাতিক প্রদর্শনী নিঃসন্দেহে এই প্রথম। লোকসংস্কৃতি, লোকসংস্কার ইত্যাদির চর্চা আধুনিক সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে খুব প্রাসঙ্গিক, কেননা প্রযুক্তির কারণে আজ বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয়। যোগাযোগ একদিকে আমাদের যেমন সমসাময়িক বিশব সম্পর্কে দ্রম্নত অবগত করছে, তেমনি  বহিঃসংস্কৃতির প্রভাবে দ্রম্নত   চর্চা। তবে এটাও ঠিক, এই দ্রম্নত যোগাযোগ প্রত্যেক মানুষকে তার স্বীয় পরিচয় সম্পর্কে সচেতন করে তুলছে সমানভাবে। কেননা, যে-কোনো সুশিক্ষিত জাতির বিশ্বদরবারে উন্নত শিরে নিজেকে উপস্থাপনের জন্য সাংস্কৃতিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। সংস্কৃতি একটি জাতির চেতনার হৃদস্পন্দন, তাই একে সঠিকভাবে ধারণ ও পোষণ করা খুব প্রয়োজন। ‘সমত্মরণ’ তাঁর আয়োজিত এই বিশাল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে চট্টগ্রামের শিল্পচর্চার এক নতুন দিগমত্ম উন্মোচন করেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্ম সচেতন থাকবে তার আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে।