মা অন্নপূর্ণা কাঁদছেন

নীহারম্নল ইসলাম

পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। সেই কারণেই দেশজুড়ে প্রচ- দাবদাহ। সারা দেশ জ্বলছে। ইতোমধ্যে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে দুহাজার। এরকম আবহাওয়ার ভেতর আমি আমাদের আমবাগান থেকে টাউনের বাসাবাড়িতে ফিরছিলাম – হঠাৎ পিছু ডাক, মাস্টার! ও-মাস্টার! এই আগুনদিনে আগুন মাথায় করে কোত্থেকে আসছেন?
আমি থমকে দাঁড়াই। ঘুরে দেখি আমার প্রিয় কণ্ঠদাকে। পুরনো পোস্টাপিসের মোড়ে কানাইয়ের সরবতের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকছে। কিন্তু সে তো ‘আই অ্যাম নট ম্যাড, আই অ্যাম অ্যান এক্স আর্মি ম্যান’ বলতে-বলতে আপন খেয়ালে রাসত্মায়-রাসত্মায় টহল মেরে বেড়ানো মানুষ! তাহলে সে ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছে? তার ওপর আমাকে আবার ‘আপনি’, ‘মাস্টার’ সম্বোধন করছে! কেন? এতদিন তো নাম ধরে ‘তুই’-‘তোকারি’ করে কথা বলে এসেছে।
আমার কৌতূহল হয়। মনে প্রশ্নও জাগে। তাছাড়া এদিকে কণ্ঠদাকে আমি অনেকদিন দেখিওনি। এম.এন. অ্যাকাডেমির খেলার মাঠে সন্ধ্যার পর তার উপস্থিতি ছিল না। কেন? কী হয়েছিল তবে? জানতেই আমাকে তার কাছে এগিয়ে যেতে হয়। কণ্ঠদা আমার প্রিয়চরিত্র। লোকে তাকে পাগল বললেও আমার তাকে অন্যরকম মনে হয়। সেই অন্যরকমটা ঠিক কী, আমি জানি না। তাই বোধহয় সেটা জানতেই আমি তাকে এড়িয়ে থাকতে পারি না, যখনই দেখা হয় সে আমাকে ডাকুক না ডাকুক, আমি তার দিকে এগিয়ে যাই যেমন এখন যাচ্ছি।
আমাকে এগিয়ে যেতে দেখে কণ্ঠদা কানাইকে বলল, কানাই মাস্টারের জন্যে বরফকুচি দিয়ে ভালো করে একগেলাস ছাতুর সরবত বানিয়ে দে তো ভাই।
আমি বললাম, না না – আমি সরবত খাব না কণ্ঠদা। এই রোদের মধ্যে বাগান থেকে ফিরছি। এখন ঠান্ডা সরবত খেলে আমার সানস্ট্রোক হয়ে যাবে। দেখতেই পাচ্ছ – আবহাওয়ার যা হালচাল!
– আপনার সানস্ট্রোক হবে না মাস্টার। কণ্ঠদার আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর।
– কেন হবে না? আমি জিজ্ঞেস করি।
– শনির কৃপা আছে আপনার ওপর। সে আপনার কিছু করবে না।
– শনি বলতে শনিঠাকুর?
– না না, শনি গ্রহ।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাই। বলি, তা কণ্ঠদা – তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? দেখতে পাইনি যে!
– একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম।
ইতোমধ্যে কানাই আমার হাতে ছাতুর সরবতের গেলাস ধরিয়ে দিয়েছে। খাব না বলেও নিজের অজামেত্মই চুমুক মারতে শুরম্ন করেছি। চারপাশে কেমন আগুন-আগুন ব্যাপার অথচ
বরফকুচি-মেশানো সরবত আমার শরীর-মনে প্রশামিত্ম ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমি তা উপভোগ করছি। কিন্তু কণ্ঠদা তো রাসত্মায়-রাসত্মায় টহল মেরে বেড়ানো মানুষ! তাহলে সে আবার কোথায় ঘুরতে গিয়েছিল?
গেলাসের সরবত শেষ করে জিজ্ঞেস করি, কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলে কণ্ঠদা?
– সন্ধ্যায় মাঠে আসেন। তখন সব বলব। এখন যাই। আমার একটু কাজ আছে। কানাইকে সরবতের দাম মিটিয়ে কণ্ঠদা চলে যায়। তার মাথায় সাদা পানামা হ্যাট। তার হাঁটার ভঙ্গি একই থাকলেও শরীরটা বেশ ঝরেছে। যে-কারণে তাকে একটু রম্নগ্ণ দেখাচ্ছে।
না, তাকে দেখলে আমার চলবে না। দুপুর গড়াতে চলল, বাসাবাড়িতে ফেরা দরকার। ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বাগানে যেতে হবে। কয়েক বছর পর এবার আমাদের বাগানে বেশ আম ফলেছে। আশপাশের বাগান যেখানে আমশূন্য। এই সময় বাগান ছেড়ে থাকা আমার চলবে না। চারপাশের যা অবস্থা, লুটপাট হতে কতক্ষণ!

দুই
টাউনে বাস করলেও গ্রামের সঙ্গে আমার আজো নিবিড় সম্পর্ক। তিন কিলোমিটার দূরে একটা গ্রামে আমাদের একটা বসতবাড়ি আছে। যদিও সেই বাড়িতে আমরা কেউ থাকি না। অল্পস্বল্প
জমি-জিরেত, ডিহি-ডববর, পুকুর-পুষ্করিণী ছাড়াও আমাদের একটা বিশাল আমবাগান আছে। চাকরি জোটেনি বলে সেসব দেখাশোনার দায়দায়িত্ব বর্তেছে আমার ওপর। অন্য ভাইয়েরা ব্যবসা করে। টাউনেই থাকে। গ্রাম, গ্রামের সম্পত্তি, বসতবাড়ি নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে আমার মাথাব্যথা আছে। মাঠ-ঘাট-বাগান দেখাশোনা করতে গিয়ে দিনের বেলা আমি এক-আধবার গিয়ে দাঁড়াই ওই বাড়ির সদর দরজার সামনে। সদর দরজার পুরনো পালস্নায় হাত বুলিয়ে মাকড়সার জাল ঝেড়ে ফেলি।
যারা বলে চাষবাসে কিছু নেই, শুধু-শুধু বেগার খাটা হয়। আমি তাদের দলে নই। নিজে শ্রম দিলে, দেখভাল করলে চাষবাসে এখনো বেশ মুনাফা আছে। তাছাড়া আজকের দিনে যখন সব খাবারই বিষে ভরা, তখন যতটা সম্ভব নিরাপদ খাবারটা খাওয়া যায়। আজকের বাজারেও প্যাকেটের পোলিশ চালের বদলে নিজের ফলানো ধানের চালের ভাত খাই আমরা। নিজের ফলানো গমের আটার রম্নটি খাই। শাকসবজির তো কথাই নেই। নিজেরা খেয়ে বাজারে বিক্রি করি। বেশ চড়া দাম পাই। পুকুরের মাছের কথা আর না-ই বা বললাম।
এসবের জন্য অবশ্য দিনের বেশিরভাগ সময়টা আমাকে ওই গ্রামেই কাটাতে হয়।
দুপুরের ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে যথারীতি আবার
ছুটেছিলাম গ্রামে। আমবাগানে কুঁড়েঘর বানানোর কাজ চলছিল। সেটার তদারকির ব্যাপার ছিল। তাছাড়া রাতে বাগান পাহারা দেওয়ার লোক ঠিক করার ব্যাপার ছিল। সেইমতো দুপুরে বাড়ি আসার আগে আমাদের বাড়ির পুরনো কাজের মানুষ ঝাবরাচাচাকে লোক মারফত ডেকে পাঠিয়েছিলাম।
আমার বাগানে যাওয়ার আগেই দেখি ঝাবরাচাচা এসে বসে আছে। তার চোখে কালো চশমা। হয়তো কড়া রোদের কারণেই! আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা – কেমন আছেন?
– এই তো বাপ, না মরে বেঁচে আছি। শুনলাম তুমি নাকি হামাকে ধুঁড়ে বেড়াইছো। তাই ছুটে এনু।
– হ্যাঁ চাচা, ঠিক শুনেছেন। আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম।
– তা কেনে বাপ? হামাকে ধুঁড়ছিলা কেনে?
– আপনাকে এবার আমাদের এই আমবাগান পাহারা দিতে হবে।
– আমবাগান পাহারা দিবো হামি! হামার সে-বয়স কি আর আছে রে বাপ? এমনিতে চোখে কিছু দেখতে পেছিলাম না। তাই অপরেশন করতে হলো। এই দ্যাখো চোখে চশমা পিনধ্যা আছি। এই অবস্থায় হামি আমবাগান পাহারা দিবো কী কর‌্যা? চারদিকে সব গিধ্নির পাল লুটেপুটে খাওয়ার লেগে ছোঁক-ছোঁক করছে। হামি একলা এই বয়সে অধের সুথে পারবো কী কর‌্যা? অধের আখুন মেলা ক্ষ্যামতা।
ঝাবরাচাচার কালো চশমা পরার কারণটা না হয় জানতে পারলাম। কিন্তু ঝাবরাচাচা না হলে আর কে আমাদের আমবাগান পাহারা দেবে? পুরনো কালের আমাদের বাড়ির কাজের মানুষদের মধ্যে একমাত্র ঝাবরাচাচা ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারছি না। জামসেদমামু-নেষেরচাচা বেঁচে নেই। জয়নালচাচা বেঁচে থাকলেও চলাফেরা করতে পারে না। যার্বেশচাচাও অথর্ব।
আমার বাবা-কাকা ছিলেন এদের বয়সী। আমার বাবা-কাকার মরা পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এক-দুজন বাদে এরা সবাই বেঁচে আছে। এরা সবাই আমার ঠাকুরদার ঘর-গেরস্থালিতে রাখালি থেকে শুরম্ন করে মাহিন্দার, মুনিশ-পাইট খেটেছে। এদের কোলেপিঠে চড়ে আমরা মানুষ হয়েছি। তাহলে এদের কথা ভুলে থাকি কী করে?
না, আমি ভুলে থাকতে পারিনি। তাই তো কয়েক বছর পর এবার যখন বাগানে ভালো আম ফলল, ঝাবরাচাচাকে মনে পড়েছে আমার। সেইমতো আজ তাকে ডেকে পাঠিয়েছি।
আমি বললাম, বয়সের সঙ্গে কী সম্পর্ক চাচা? আপনি যেমন বাড়িতে থাকেন, তেমনি এই বাগানেই থাকবেন। আপনাকে কিছু করতে হবে না। খালি মাঝেসাঝে হাঁক ছাড়বেন, তাহলেই হবে। দেওয়ান সরাইয়ের ইব্রাহিমকে মনে আছে আপনার? আমাদের বাড়িতে রাখালি করত। সেও থাকবে আপনার সঙ্গে। আর আম ভাঙার সময় প্রয়োজনমতো মুনিশ করে নেওয়া যাবে।
আমার কথা শুনে ঝাবরচাচা বললেন, তাই তো রে বাপ, আচ্ছা মুশকিলে ফেলস্ন্যা তো!
আমি বললাম, মুশকিল-ফুসকিল কিছু না, আপনি
কাপড়-চোপড় নিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে বাগানে চলে আসেন। ইব্রাহিমও আসছে। সে যেমন রান্নাবান্না করবে, আপনারও খেয়াল রাখবে।
ঝাবরাচাচা বাড়ি চলে যায় কাপড়-চোপড় আনতে। আমবাগান নিয়ে আমার দুশ্চিমত্মা দূর হয়। আমি নিশ্চিমত্ম হই।

তিন
সন্ধ্যা গড়িয়ে টাউনের বাড়িতে ফিরছি। পুরনো পোস্টাপিসের কাছে আসতেই ঝুপ করে কারেন্ট চলে গেল। কানাইয়ের সরবতের দোকানে পুরনো দিনের হিন্দি সিনেমার গান বাজছিল, ‘মেরে দেশ কি ধরতি সোনা উগলে-উগলে হীরামতি…’, সেটা বন্ধ হয়ে গেল। যদিও সঙ্গে-সঙ্গেই ইনভারটারের সৌজন্যে আবার আলো জ্বলে উঠল। কিন্তু ওই গান আর বাজল না। আর আমার মনে পড়ে গেল কণ্ঠদাকে। সে আমাকে সন্ধ্যার পর এম. এন. অ্যাকাডেমির খেলার মাঠে আসতে বলেছিল।
পাশেই সেটা। আমি ঘুরে হাঁটতে শুরম্ন করলাম সেই দিকে। আকাশে সূর্য নেই। তবু দিনের থেকে এখনকার তাপমাত্রার হেরফের হয়নি তেমন। বাতাসে আগুনের হলকা বইছে। শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে।
এম. এন. অ্যাকাডেমির খেলার মাঠে প্রচুর মানুষ বসে আছে। গরমের গল্প ছাড়া আর কোনো গল্প নেই কারো মুখে। না, আছে, বিড়ি-সিগারেটের গনগনে আগুন! কিন্তু কণ্ঠদা কোথায়? আমি কণ্ঠদাকে খুঁজছি। মাঠে যারা বসে আছে, অনেকেই আমার পরিচিত। তাদের কেউ-কেউ জিজ্ঞেস করে – কী দাদা, কাকে খুঁজছেন?
আমি কোনো উত্তর করি না। এড়িয়ে যাই। যদি বলি কণ্ঠদাকে খুঁজছি, নিশ্চিত সবাই আমাকেও পাগল ভাববে। সবাই আমাকে পাগল ভাবুক, আমি তা চাই না। অগত্যা মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসি। অন্ধকার রাসত্মা ধরে হাঁটতে শুরম্ন করি বাড়ি ফিরব বলে। কারেন্ট আসেনি এখনো। তবু বাড়ি ফিরে জামা-কাপড় খুলে ছাদে উঠলে একটু স্বসিত্ম পাওয়া যেতে পারে। আমার এমনই ভাবনার মধ্যে হঠাৎ আবার কার ডাক শুনতে পাই, মাস্টার! ও-মাস্টার!
কণ্ঠদার ডাক, বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু কোথা থেকে আমাকে ডাকছে সে? আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকে খুঁজি। না, দেখতে পাই না। চারপাশ যে অন্ধকার! দেখব কী? অগত্যা আবার হাঁটতে শুরম্ন করি। কিন্তু না, এগোতে পারি না, আমার পথ আটকে দাঁড়ায় টর্চের তীক্ষন ফোকাস।
– কী মাস্টার, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? আপনার অপেক্ষায় মাঠে বসে বসে শেষ পর্যমত্ম আপনাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম আপনার বাড়ি। তা ওটা আপনাদের বাড়ি না কবরখানা? হাঁকডাক করে কোনো মানুষের সাড়া পেলাম না!
সত্যিই সন্ধ্যার পর আমাদের টাউনের বাড়িতে কারো সাড়া পাওয়া যায় না। যে-যার ঘরে টিভিতে মগ্ন থাকে। বাইরের
পৃথিবীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না। আসলে এটা আমাদের বসতবাড়ি নয়, এটা হলো আমাদের বাসাবাড়ি। বসতবাড়ি তো আমাদের গ্রামে। আমার ঠাকুরদা তাঁর যৌবনে একতলার পাকা ভিত গেঁথেছিলেন। সাতখানা ঘর। রান্নাশাল। অাঁতুড়ঘর। কুঠিঘর। আঙিনায় কুয়া। চারপাশে গাছপালা। সেই বাড়িতে এখন আর আমরা কেউ থাকি না। যদিও আমি সেখানে রোজ যাই। সদর দরজার পুরনো পালস্না ছুঁয়ে আসি। আমি এটা আজো কেন যে করি, জানি না। হয়তো আমি চাকরি পাইনি! হয়তো আমি আমার আর দুই ভাইয়ের মতো সফল ব্যবসায়ী হতে পারিনি! তাই হয়তো শেষ আশ্রয়ের অবলম্বনটুকু বাঁচিয়ে রাখতেই আমি যাই সেই বাড়ির দরজায়।
তবে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করি না। সদর দরজায় একটু দাঁড়িয়ে, সদর দরজায় পালস্নায় হাত বুলিয়ে ফিরে আসি। বাড়িটা এখন আমার কাছে ঠিক একটা পোড়ো মন্দিরের মতো। এই তো আমি আজ সারা বিকেল বাগান পাহারা দেবার লোক ঠিক করে সেই বাড়ির সদর দরজার পালস্না ছুঁয়ে বাসাবাড়িতে ফিরছি। না, রাসত্মায় দাঁড়িয়ে কণ্ঠদাকে এত কথা বলা সম্ভব নয়। অগত্যা আমি চুপ করে থাকি।
কণ্ঠদা আবার আমাকে জিজ্ঞেস করে, তাহলে আমার কথা আপনার মনে ছিল না বলেন? সন্ধ্যায় এম. এন. অ্যাকাডেমির খেলার মাঠে দেখা হওয়ার কথা ছিল যে! অবশ্য মনে না থাকারই কথা। আমাকে পাগল-ছাগল মানুষ ভাবেন। কিন্তু জেনে রাখবেন – আই অ্যাম নট ম্যাড, আই অ্যাম অ্যান এক্স আর্মি ম্যান।
আমি যে এম. এন. অ্যাকাডেমির খেলার মাঠ ঘুরেই আসছি, সে-কথা আর কণ্ঠদাকে বলতে সাহস পাই না। ব্যাপারটা মনে
থাকলেও সময় পাইনি এমন ভান করে বলি, আর বলো না দাদা – আমবাগান পাহারা দেবার লোক খুঁজে পাচ্ছিলাম না। লোক খুঁজতেই এত দেরি হয়ে গেল।
– আমবাগান পাহারা দেবার লোক খুঁজছিলেন? কেন, আমিই তো ছিলাম!
আমি চমকে উঠি। আমাদের আমবাগান পাহারা দেবে কণ্ঠদা? যে-বাগানের না আছে শুরম্ন, না আছে শেষ! আজন্ম যে-বাগান আমার রক্তে মিশে আছে, সেই বাগানে ঢুকলে আজো আমার দিঙ্নির্ণয় করতে ভুল হয়! সেই বাগান পাহারা দেবে কণ্ঠদা? আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি। হতবাক হয়ে চেয়ে থাকি অন্ধকারের দিকে।
কণ্ঠদা আমার নিশ্চুপ থাকা দেখে জিজ্ঞেস করে, আপনিও নিশ্চয় আমাকে পাগল ভাবছেন। কিন্তু আমি পাগল নই, আই অ্যাম নট ম্যাড, আই অ্যাম অ্যান এক্স আর্মি ম্যান। জানেন, গত রাত্রে আমি বৃহস্পতি গ্রহে ঘুরতে গিয়েছিলাম।
সাংঘাতিক গরম! রাসত্মায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমি দরদর ঘামছি। গত রাত্রেও এরকম আবহাওয়া ছিল। নাকি তাপমাত্রা এর থেকে কম ছিল? গতকাল কিছুই বুঝতে পারিনি। কয়েক বছর পর আমবাগানে এবার আম ফলেছে। আম বিক্রির টাকায় ঘরে আমি এসি লাগাতেই পারি। কিন্তু আমি সেটা করছি না বলে গত রাত্রে বউয়ের সঙ্গে আমার রীতিমতো ঝগড়া চলছিল। আমার আর বউয়ের ঝগড়ায় আমাদের কবরস্থানটা একটু হলেও নড়ে উঠেছিল। প্রতিবেশীদের কাছে অমত্মত প্রমাণিত হয়েছিল কবরেও মানুষ থাকে! তাহলে কণ্ঠদা গত রাত্রে বৃহস্পতি গ্রহে ঘুরতে গিয়েছিল তার কী প্রমাণ আছে?
থাকতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করি, বৃহস্পতি গ্রহে গিয়ে তুমি কী দেখলে কণ্ঠদা?
– দেখলাম ভয়ংকর এক দৃশ্য! গোটা বৃহস্পতি জুড়ে ধানের চাষ। যেন তোমাদের ডোমকুল মাঠ। চারধার সবুজে সবুজ। বাতাসের দোলায় মা অন্নপূর্ণার অাঁচল উড়ছে গোটা বৃহস্পতিময়। কিন্তু মা অন্নপূর্ণা নিজে একলা বসে-বসে কাঁদছেন।
– মা অন্নপূর্ণা একলা বসে-বসে কাঁদছেন! কেন কাঁদছেন মা অন্নপূর্ণা?
– আমিও তাঁকে এই কথাটাই জিজ্ঞেস করলাম।
– কী বললেন তিনি?
– বললেন, কাঁদছি আমার সমত্মানদের জন্যে, তোদের জন্যে রে পাগল। ওই দ্যাখ শনি কেমন আক্রোশ নিয়ে ধেয়ে আসছে সবকিছু ছারখার করবে বলে। এই ধান, এই মাঠ কিছুই রাখবে না। সবকিছু ছারখার করে ছাড়বে।
কণ্ঠদা ঠিক কী বলতে চাইছে আমার বোধগম্য হয় না। আমি অন্ধকারে তার মুখটাকে দেখবার চেষ্টা করি। দেখতে পাই না। বদলে মা অন্নপূর্ণাকে দেখি। স্পষ্টতই দেখি। সত্যিই তিনি কাঁদছেন। কিন্তু তিনি কেন কাঁদছেন?
বুঝতে না পেরে আমি কণ্ঠদাকে জিজ্ঞেস করি, মা অন্নপূর্ণার এমন কী হলো যে তিনি কাঁদছেন?
কণ্ঠদা বলল, মাস্টার মানুষ হয়েও আপনি বুঝতে পারছেন না মা অন্নপূর্ণা কেন কাঁদছেন? প্রথমে অবশ্য আমিও বুঝতে পারিনি। কিন্তু কাল যখন মা অন্নপূর্ণা আমাকে বললেন, ‘ওই দ্যাখ, শনি কেমন আক্রোশ নিয়ে ধেয়ে আসছে সবকিছু ছারখার করবে বলে। এই ধান, এই মাঠ কিছুই রাখবে না। সবকিছু ছারখার করে ছাড়বে।’ ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হয়। আমি আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারি এই যে নদীর ভাঙনে মাঠের পর মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাতে গড়ে উঠছে একটার পর একটা ইটভাটা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিমেন্ট কারখানা। আমাদের ভোগবিলাসের জন্যে আরো কতকিছুর কারখানা যে গড়ে উঠছে, তার ইয়ত্তা নেই। আর সেইসব কারখানার কর্মীদের বসবাসের জন্য যেসব বহুতল নির্মাণ হচ্ছে, তার কারণে খাল-বিল-পুকুর, ঝোপজঙ্গল, গাছপালা – সব হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁজছি তা টের পাচ্ছি না। অথচ মুখে বলছি আমাদের ওপর শনির কু-নজর পড়েছে। তাই শনিবার-শনিবার আমরা শনির পূজা দিচ্ছি…
অসহ্য গরমে তখন আমার কাহিল অবস্থা। কণ্ঠদা কী বলছে কিছুই আমার মাথায় ঢোকে না। কণ্ঠদার কথা পাগলের প্রলাপ বলে মনে হয়। তাহলে এই গরমের মধ্যে অন্ধকার রাসত্মায় দাঁড়িয়ে পাগলের প্রলাপ শোনার অর্থ কী? না, আমি কোনো অর্থই খুঁজে পাই না। অগত্যা সেখান থেকে চুপিসারে কেটে পড়ার মতলব করি। কিন্তু কীভাবে? দেখি অন্ধকার রাসত্মায় তখন মানুষের ঢল নেমেছে। আজ শনিবার। পার্শ্ববর্তী মনসাতলার শনিমন্দিরের নিশ্চয় শনিপূজা শেষ হলো। মন্দির থেকে প্রসাদ নিয়ে যে-যার বাড়ি ফিরছে। কণ্ঠদার প্রলাপ থেকে বাঁচতে আমি অন্ধকারে মানুষের সেই ঢলে মিশে যাই।
মানুষের সেই ঢলে না মিশে আমার উপায় থাকে না।