চন্দ্রাহত

রশীদ হায়দার

আমেনার মনেই ছিল না উঠোনে ধান শুকাতে দেওয়া আছে। মাঝখানে হাঁটার জন্যে চুলের সিঁথির মতো শুধু সরু একটা পথ, উঠোন পারাপার করে ঘরে ওঠার জন্যে, রান্নাঘর, পায়খানা, পেশাবখানায় যাওয়ার জন্যে, ধানের গা ঘেঁষে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে।

উঠোনে ধান যখন শুকানোর জন্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন বেলা পশ্চিম আকাশেই হাত দশেক হেলে পড়েছে। উঠোনে রোদটা শুধু ধানের গন্ধ শুঁকে যায়, তাপ দিয়ে যেতে পারে না। তাপটাই এখন বেশি প্রয়োজন। ধানের ভেজাটা খানিক বাতাসের সঙ্গী হলেও পুরোপুরি উঠে যায় না, ভেতরের টইটম্বুর রস ধানের গায়ে মিশে যেতে এ বিকাল তো গেলই, রাতও লাগবে। আগামীকাল দুপুর নাগাদ লেগে যেতে পারে।

সবে কাটা ধান আমেনার সব সময়ই প্রিয়। ভেজা ধানের গন্ধ তার কাছে শিশুর গায়ের গন্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। নতুন ধান এলেই মুঠো ভরে ধান তুলে নাকের কাছে ধরে ভাবে, ডান মুঠোর ধানের গন্ধটা বড় ছেলে নাজিমের মতো, বাম মুঠোর ধানগুলো ছোট মেয়ের কাছাকাছি। কোনটা যে সঠিক সে ঠাহর করতে পারে না। তার দুই হাতের ধানই তার কাছে সন্তানের মতো হয়ে গেলে সে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তুলে উঠোনেই ছড়িয়ে দিয়ে বলে, যা ধানে ধানে ভায়ে বোনে মিলে খেলা করগে। ছিটানো ধানে আমেনা স্পষ্টই দেখে রাজাপুরের ক্ষিতের ধান, কুশখালি চরের আর বাগবাড়ি বিলের ধান।

ধান নিয়ে আমেনা মনে হয় বাড়াবাড়ি একটু বেশিই করে। বছরে তিন দফা ধান আসে, এটা তার মনে পাকা হিসাব। আসার দিন যত কাছে আসে ততই তার ঘর-বার বেশি ঘনঘন হয়, শোবার ঘর থেকেই দক্ষিণের জানালা দিয়ে দেখতে পায় বড় রাস্তার ঢাল দিয়ে কমপক্ষে দুটি গরু বা মোষের গাড়িভর্তি ধান নিয়ে নামছে। ঢাল দিয়ে গরু বা মোষের গাড়ি নামার দৃশ্যটাই যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রূপ, নতুন ধানের গন্ধ যারা পায়নি তারা জানেই না ফসলের মাঠ থেকে সদ্য কেটে আনা ধানের গোছায় মাটির সঙ্গে তার কান্নাও মিশে থাকে। এই কথাটা আমেনা মানে। মানে বলেই সে অনেকক্ষণ ধরে ধানের গোছায় হাত বোলায়, নাকের কাছে নিয়ে মাটির গন্ধ শোঁকে।

আমেনার ধান শোঁকার অভ্যাস নিয়ে বাড়িতে হাসাহাসিও কম হয় না। নতুন বউ যেদিন ধানের গন্ধ শোঁকে, সেদিন স্বামী ও শাশুড়ি অবাক হয়ে বলে, ও আমেনা, কী করো?

ধানের গন্ধ নিই মা।

ধানের গন্ধ আবার একটা নেবার জিনিস হলো?

মা, ধানের চাল না হলে আমরা তাহলে খাবো কি?

শাশুড়ি বোঝে নতুন বউ আর যাই হোক ধান-চালঅলা বাড়ির মেয়ে নয় বলে ধান নিয়ে এরকম শিশুমি করছে। নতুন বউয়ের বাড়ির
সহায়-সম্পত্তি থালা-বাসনের সঙ্গে ইশ্কুল মাস্টারের সিন্দুক নেই জানা সত্ত্বেও টিনের বাক্সটার খবরও সংগ্রহ করেছে। না, ওখানেও তেমন কিছু জমা নেই। তার পরেও এরকম একটা না-খাওয়া বাড়ির মেয়েকে বড় ছেলের বউ করে আনতে মনে কোনো আপত্তি আসেনি। কারণ আর কিছুই নয়। আমেনা মেয়েটি বড় সুন্দরী, বড্ড রূপসী। বিয়ের প্রথম দিনই পাশের বাড়ির বুড়ো দানেজ মোলস্না বলে ফেলে, এ না গোবরে পদ্মফুল। আমেনা ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছে। সে জানে এ কথার অর্থ কী। তার ঘরের বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো একটা সাধারণ আয়নায় আড়াল করে মুখটা দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়, তার গরিব বাপ-মা তাকে লেখাপড়া মোটেই বেশি করাতে না পারলেও সুন্দরী মেয়ে হিসেবে যে জন্ম দিতে পেরেছে, তাতেই সে খুশি। খুব খুশি।

সময়ের সঙ্গে বড় হওয়ার সঙ্গে একসময় নিজেই আবিষ্কার করে সে বড় হচ্ছে, বড় হওয়ার লক্ষণগুলো তার শরীরে ফুটে উঠছে, সে আরো সুন্দরী হয়ে নিজেকে মেলে ধরতে যাচ্ছে। কখনো-কখনো একটু বেশিই অবাক হয় আমেনা, ভাবেও, এই রূপ নিয়ে সে কার ঘরে যাবে, গরিব ঘরের মেয়ের ঘরই বা কী বরই বা কী। পেটপুরে দুটো ভাত আর বছরে দুটো মোটা কাপড় পেলেই যেখানে যথেষ্ট, সেখানে বড় ঘরের ছেলে তাকে পালকিতে চড়িয়ে সোনা-গয়না পরিয়ে বউ করে নিয়ে যাবে, সেই স্বপ্ন তাকে গভীর লজ্জাই শুধু নয়, আতঙ্কেও ফেলে দেয়। সেই সাধারণ আয়নাতেই সে কপালের প্রতিটি রেখা ও লেখা থেকে তার ভবিষ্যৎ পড়তে চেষ্টা করে। দেখলো কপাল শুধু কপালই, ভাগ্য নেই সেখানে।

এই ভাগ্যহীনা মেয়েটির জন্যেই বিয়ের প্রস্তাব আসে শহরের নামী অর্থবিত্তে ভারি এক বাড়ি থেকে। আমেনা তখন বাড়ির ছাগল দুটো কঞ্চি নিয়ে তাড়া করে-করে বাড়িতে ঢোকাচ্ছিল। তখনই সে দেখে বাড়ির সামনের রাস্তায় এক যুবক সাইকেলে মাটিতে পা ঠেকিয়ে বসে একমনে আমেনাকে খুঁটে-খুঁটে দেখছে। কে? লোকটি কে? আগে তাকে কোনোদিন এ-পাড়ায় দেখেনি, তার কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। সহসাই তার মনে হয়, তার রূপই ওই অচেনা লোকটিকে রাস্তায় মাটিতে পা আটকে ধরে রেখেছে। লজ্জায় আরো লাল হয়ে সে ছুটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়।

এবারই আমেনা প্রথম সাইকেলের লোকটিকে মনে-মনে খুঁটে দেখে। না, সে তেমন অপরূপ সুন্দর যুবক নয়, তবে শ্যামলা গাট্টাগোট্টা চেহারায় চোখে ধরার মতো বলেই কিনা মন থেকে তাড়াতে গিয়েও দেখল সে বারবারই ফিরে আসছে। পরদিন সকালেও লোকটি চোখে ভেসে আসে, আর তখনই তার স্পষ্ট মনে পড়ে লোকটি রাতে স্বপ্নে তার কাছে এসেছিল। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিন কাটে, রাত কাটে, রাতের চন্দ্র, দিনের সূর্যের আলোর মধ্যেও যে তার ছায়া ভাসে! এক সময় বিরক্তি ধরে আমেনার। কোথাকার কে, সে মনে আসার কে?

ঠিক এর চারদিন পরই আরেক অচেনা লোক আমেনার বাপজানের নাম ধরে বারদুয়েক ডেকে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে। আমেনা তখন পাড়ার সখীদের সঙ্গে উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলছে। অচেনা কণ্ঠে বাপজানের নাম শুনে আমেনা বাইরে এসে দেখে আরেক অচেনা লোক, তবে লোকটি আমেনার দিকে এমনভাবে হাসিমুখে তাকায় যেন সে তাকে চেনে, খুব ভালো করে চেনে। সে হেসে জিগ্গেস করে,

তোমার নাম কি আমেনা?

চমকে যায় আমেনা। এই লোক তার নাম জানে কী করে। বলে, আপনি কে?

এটা মালেক মাস্টার সাহেবের বাড়ি না?

হ্যাঁ।

তোমার আববা আছে?

না, আববা তো হাটে। আপনি কে তা তো বললেন না।

আমি নাম বললেও তুমি চিনবে না। তবে যে আমাকে পাঠিয়েছে তার বাপের নাম বললে তোমার আববা ঠিকই চিনবে।

আমেনা সচকিত হয়ে দেখল তার এক্কাদোক্কা খেলার সখীরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

সখীদেরই একজন বলে, যে পাঠিয়েছে তার বাপের নাম কী? বলে যান। চাচা এলে আমরা বলব। এই আগমন দিয়েই শুরু সেই অচেনা লোকের। তার পরদিনও সে আসে। সেদিন আমেনার বাপজান আসরের নামাজ পড়ে জায়নামাজেই বসে ছিল, আসলে কানখাড়া রেখেছিল সেই লোক আবার এসে ডাকে কিনা।

রাতেই আমেনার বাপজান তার বউকে বলে রেখেছে,

ওই লোককে যে পাঠিয়েছে তাকে তুমি চেনো নাই?

নাম শুনেছি মনে পড়ে।

সে তো এই জেলার বড়লোকদের একজন। অনেক জমিজমা, সহায়-সম্পত্তি।

তা জেনে আমাদের কাম কী?

কিন্তু সেই লোক আমার কাছে লোক পাঠাবে কেন?

সহসা বিছানা ছেড়ে উঠে বসে আমেনার বাপ। বিড়বিড় করে বললেও আমেনার মা ঠিকই শুনতে পায় তার স্বামী বলছে,

আমার আমেনার বিয়ের কথা বলতে এসেছিল কি?

বিছানা ছেড়ে উঠে বসে আমেনার মাও। একটা ভারি শ্বাস ছেড়ে বলে, আমার মেয়ের কি আর সেই কপাল হবে?

আলস্নাহ মালুম।

আমেনার কপালে হয়েছে। শহরের কয়েক ধনীর মধ্যে এক ধনীর ছেলে লোক পাঠিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে।

আপনার মেয়েটাকে আমরা নিতে চাই।

শুনে খুশি হয় আমেনার বাপ, ভয়ও লাগে খানিক। দোনোমনো করতে থাকলে ঘটক আরো বলে,

আমাদের ছেলে আপনার মেয়েকে দেখেছে। দেখেছে বলেই পণ করেছে ওই মেয়ে ছাড়া সে বিয়েই করবে না। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। কোনো দেওয়া-থোয়া নেই। সে শুধু আপনার মেয়েটাকে চায়।

এত সুখ তার মেয়ের কপালে আছে চিন্তা করে মালেক মাস্টার খানিক আনন্দে ভেসে আবার ডুবে যায়, সত্যিই কি তার আমেনা এত সুখ পাওয়ার জন্যে জন্ম নিয়েছে? নিশ্চয়ই তাই। না হলে শহরের কয়েক ধনীর এক ধনীর ছেলে তার গরিব মেয়ের জন্যে উতলা হবে কেন?

আমেনা মাঝে-মাঝেই ঘটনাগুলো উলটেপালটে দেখে। বিশেষ করে যখন গরুর বা মোষের গাড়ি ভরে বস্তা-বস্তা ধান আসে, নতুন ধানের গন্ধ বাড়ি ভরিয়ে দিলে সে আর হুঁশে থাকে না। ধান মানেই তো জান। ধান অর্থই তো বাঁচা। গরিব ঘরে থাকার সময় তার মাঝে একথাটা বহুবার মনে হয়েছে, থালায় সাদা-সাদা ভাত মুক্তার দানা। যদিও সে সত্যি মুক্তা দেখেনি, একটা বইতে ছবিতে দেখেছে একটা মেয়ের গলায় মুক্তার দানার মালা ভাতের দানা হয়ে ফুটে আছে। মুক্তায় আর সাদা ভাতের দানায় কোনো পার্থক্য তার চোখে ধরা পড়ে না। এতদিনে তার কোল ভরে একটি ছেলে ও মেয়ে এসেছে, তাদের নিয়ে ভরা সংসারে যে-সুখ উথলে পড়ে তার কোনো তুলনাই তার চোখে সহজ হয়ে ধরা দেয় না, প্রায়ই ভাবে, তার বাপের বাড়িতে এই সন্তান দুটি থাকলে সে কি তাদের মুখে মুক্তার দানা তুলে দিতে পারত?

উঠোনে পা দিয়ে ধান উলটেপালটে দিতে-দিতে আমেনা ভাবতে থাকে, এত সুখ, এত শান্তি তার জীবনে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। দুই মোষের গাড়িভর্তি ধান এসেছে কাল বিকেলে। ঠিকা কাজের বেটিরা নির্দিষ্ট সময়ে ধানগুলো শুধু ঝাড়তে পেরেছে, উঠানে শুকানোর জন্যে মেলতে পারেনি। সকালের জন্যে সত্মূপ করে রেখে গেছে। অমন পাকা ধানের সত্মূপকে আমেনার এক সময় মনে হয় সোনার গাদা, তাল তাল জমানো সোনা উঠোনের মাঝখানে জমা করে রেখেছে। আমেনা পরম আদরে ধানের গায়ে হাত বুলায়। তার অমন কা- দেখে কাজের বেটিরা হেসে বাঁচে না।

এত ধান শুকাতে পুরোদিন তো লাগবেই, রাতও লেগে যাবে। আমেনা এদিকে বড় সজাগ। ধানের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য সে রাত জেগে ধানের পাশেই বসে থাকতে পারে। মাঝে-মাঝে ধানকে তার তৃতীয় সন্তান মনে হয়।

আজ আমেনার স্বামী দুপুরে বাড়িতে খেতে আসেনি। আসতে পারে, নাও পারে এমন আভাস দিয়ে আমেনাকে বলে রেখেছিল,

আমার দেরি দেখলে তুমি খেয়ে নিও।

দুপুরের খাবার সময়টা আমেনার খুব প্রিয়। গৃহস্থবাড়ির বউ বাড়ির সবার খাওয়া শেষ হলে তবে খেতে বসবে, এই না দস্ত্তর। কিন্তু আমেনার স্বামী তা মানতে নারাজ। বাচ্চা দুটো জন্ম নেওয়ার পর থেকে কবে যে প্রথমে দুই বাচ্চাসহ, এবং পরে বউও একসঙ্গে খাবে নিয়ম করে ফেললে আমেনা খুশিই হয়। দুপুরে খেতে বসার আগেই আমেনা গোসল সেরে ফেলে স্নিগ্ধ শরীর ও মন নিয়ে যখন একসঙ্গে খেতে বসে, তখন সে মাঝে-মাঝে খেয়াল করে, তার স্বামী তাকে প্রায়ই আড়চোখে দেখে আর দেখে, তার মুখটা তখন আনন্দে কেমন যেন উজ্জ্বল দেখায়।

দুপুরে খেতে বসে আমেনা বোধ করে আজ সত্যি কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা, শূন্য-শূন্য লাগছে। একসঙ্গে খাবার সময় স্বামী যে নেই এই অভাবটা বুঝতে দেরি হয় না তার, সে মনকে বোঝায় কাজের মানুষ কাজ ফেলে আসতে পারছে না বলেই এই শূন্যতা, ফাঁকা-ফাঁকা। খাওয়া শেষে ঘর থেকে বেরিয়ে ওপরে তাকাতেই দেখল আজ আকাশটা একেবারে ঝকঝকে, তকতকে, কোথাও কোনো সাদা বা কালো মেঘের সামান্যতম ফোঁটাও নেই, আলস্নাহ যেন নিজ হাতে সব কিছু সাফসুতরো করে রেখেছে। ঠিক, হ্যাঁ, ঠিক তখনই তার মনে হয় আজ পূর্ণিমা, সন্ধ্যার সময়ই গোল চকচকে থালা হয়ে পুব আকাশে চাঁদ উঠবে, আসেত্ম-আসেত্ম দিগন্ত ছাপিয়ে গোটা আকাশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলবে। তার চোখ পড়ে উঠোনের ধানে। ধানের রং সোনালি। চাঁদের রংও তো সোনালি। তাহলে দুই সোনালি মিলে আজ উঠোনটা ঠিক সোনায় সোনায় ছেয়ে যাবে।

পৌনে দশটার দিকে বাড়ি ফেরে স্বামী। রিকশা থেকে নামতে-নামতেই ক্লান্ত গলায় বলে,

আমেনা, ভাত বাড়ো।

সব তৈরিই আছে। আগে এশার নামাজ পড়বেন না? ওজুর পানি দেবো?

যা বললাম তাই আগে করো, ভাত দাও।

কথার জবাব না দিয়ে আমেনা ভাতের আয়োজন করতে গেলে স্বামী শুধু হাত ধুয়ে ও কুলি করে খেতে বসে আমিনার ভাত বেড়ে দেওয়ার দৃশ্যটা দেখে। প্রতিদিন প্রতি থালাতেই খাবার দেওয়ার আগে স্বামী বউয়ের অপরূপ সুন্দর হাতটা দেখে, কিন্তু আজ কেন যে মনে হয় তার সুন্দরী বউটির দিকে কি আর কারো নজর পড়ে? বলা তো যায় না। মাঝে-মাঝেই তাকে কাজে বাইরে সারাদিন থাকতে হয়, আর আজ তো সারাদিন নয়, রাতেরও অনেকটা সময় কেটে গেছে। তার একবার মনে হয় বউকে জিগ্গেস করে কেউ এসেছিল কি না। কিন্তু না, কিছুই জানতে চায় না, তবু মনের ভেতরে প্রশ্নটা বারবার ঘুরপাক খায়, কেন খায়, ভাবতে-ভাবতে পুরো ভাত না খেয়েই উঠে পড়ে বলে,

নাহ্! ক্ষিদেটা মরে গেছে। বিছানার চাদরটা পরিপাটি করতে-করতেই স্বামী এশার ফরজ নামাজটাই শুধু পড়ে, সুন্নত পর্যন্ত যায় না।

আপনি এখনই শোবেন?

প্রশ্নটাতে কোনো প্রশ্ন নেই, কিন্তু স্বামীর মনে হয় প্রশ্নটাতে অন্য কোনো জিজ্ঞাসা আছে, এর আড়ালে আরেকটা আমেনা আছে। সেই আমেনা কোন আমেনা তাকে চিনতে স্বামী বিছানায় বারবার এপাশ-ওপাশ করতে-করতে একসময় ঘুমিয়ে যায়, ঘুমের মধ্যেই খাটটা একটু নড়ে উঠলে সে বোঝে বউ মশারি তুলে বিছানায় ঢুকলো। এই পর্যন্তই।

মনের প্রশ্ন পড়া যায় কিনা আমেনা জানে না, কিন্তু তার বুঝতে ভুল হয় না আজ স্বামীর ভেতরের স্বামীটা স্বাভাবিক নেই। ভেবে দেখেছিল আমেনা, আজ রাতে যে চাঁদ থাকবে সে চাঁদের নিচে শুধু তারাই থাকবে দুজন, পৃথিবীর ওই অপরূপ সৌন্দর্যের ভাগ শুধু তারা দুজনই উপভোগ করবে। এমন রাত তো তার জীবনে এর আগে কখনো আসেনি। রাতের অন্ধকার এসেছে, ঘুম এসেছে, স্বামীর আদর-সোহাগ জুটেছে, জানালার ফাঁক গলে চাঁদের আলোও এসেছে, সেইসঙ্গে বড় রাস্তায় গরুর গাড়ি চালকের ওঠানামা গলায় ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে এসে তাদের কানে আনন্দের আঘাতও দিয়ে গেছে। কিন্তু আজ কী হলো যে কোনো মনোমালিন্য নেই, অভিমান করার মতো সামান্য কারণও যেখানে ঘটেনি, সেখানে হঠাৎ স্বামী যেন থেকেও নেই হয়ে যাচ্ছে দেখে একবার মনে হয় ডেকে তুলে বলে, কী? কী হয়েছে আপনার?

ডাকতে সাহস পায় না। সারাদিন খাটাখাটনি করে এসেছে, এটাই বর্তমান বাস্তব। অন্ধকারে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে একসময় ঘুমিয়েও যায়, স্বপ্নে দেখে তার ছোটবেলা আনন্দে উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলে বেড়াচ্ছে, সখীদের সঙ্গে গোল হয়ে বসে ঘুঁটি খেলছে, সম্মিলিত সুরে ছড়া বলছে ‘ফুলো ফুলো ফুলো, একে দোগান’, দুই? দুইয়ে যেন কী কিছুতেই মনে না আসায় তার ছোটবেলা ছুটে যায়, ঘুঁটি খেলার সাথীরা হারিয়ে যায়, শুধু দেখতে পায় জানালা দিয়ে চাঁদের তীব্র আলো তাকে শুধু ডেকে যায়, আমেনা, ওঠো, ওঠো, বাইরে যে বাঁধভাঙা চাঁদের আলো তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।

একই সঙ্গে এই স্বপ্নটাও যে কেন জুড়ে গেল বুঝতে পারে না আমেনা। স্বপ্নেই বোঝে আকাশভরা চাঁদের আলো নয়, মেঘ, আকাশের এ-মাথা ও-মাথা ছেয়ে রাজত্ব করে যাচ্ছে কালো মেঘ, ভারি মেঘ, আর বৃষ্টিভর্তি পেটফোলা মেঘ। এখনি সে পেট ছেড়ে দেবে। আর ছাড়লেই শুকনো ধান ভিজে একশা হয়ে যাবে। তক্ষুনি আমেনা তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। বসাটা জোরের সঙ্গেই ঘটে বলে খাটটাও দুলে ওঠে, দুলুনির সঙ্গে স্বামীরও ঘুমটা ছুটে যায়।

আধভাঙা ঘুমের মধ্যেই স্বামী বুঝলো আমেনা পায়ে স্যান্ডাল গলালো, ব্যস্ত হাতে ঘরের ছিটকিনি খুলল এবং সিঁড়ির দিকে গেল। স্বামী বুঝে নেয় আমেনা পায়খানা বা পেশাবের বেগে ব্যস্ত পায়ে ঘরের বাইরে বেরিয়েছে। প্রয়োজন শেষেই সে শিগগির বিছানায় ফিরে আসবে। তখনই সে বোঝে, তার যৌনকামনা বোধ হচ্ছে এবং এখনই তা পূরণ করতে হবে। অপেক্ষা করে আমেনা এখনই আসবে। অপেক্ষায় থাকে এই এলো আর কি। প্রতীক্ষায় থাকে আমেনা এসেই তাকে জড়িয়ে ধরে মুখে কিছু না বলে শুধু নিঃশ্বাসে আকুতি জানাবে, প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করবে। সময় বয়ে যায়, বিছানায় চাঁদের আলো ক্রমে সরে যায়, রাত আরো গাঢ় হয়, আমেনা আসে না। ছিটকে উঠে বসে স্বামী। তাহলে তার ধারণাই ঠিক? আমেনা অপেক্ষা বা প্রতীক্ষা তার জন্যে করে না, করে আর কারো জন্যে? দ্রম্নত বিছানা থেকে নামে। নেমেই হাট করে দরজা খুলেই দেখতে পায় উঠোনে চাঁদের আলোরা হাত ধরে নাচানাচি করছে, গাছের ডালে চাঁদ, টিনের চালে চাঁদ, পাতকুয়ার গা ধুয়ে চাঁদ বলে যায়, এখনই পরী নামবে, ধবধবে চাঁদের আলোয় পরীরা দলবেঁধে নাচে। স্বামী চোখমুখে পানি না দিয়েও চোখ মুছে দেখল আমেনা পায়খানা-পেশাবখানায় নয়, উঠোনে নামার সিঁড়ির ওপরের সিঁড়িতেই বসে বারান্দার খাম্বায় হেলাল দিয়ে বসে আছে। আমেনার চোখ তখন বন্ধ।

চাঁদের আলো আমেনার খুব প্রিয় জেনেও সে চাঁদের আলো না দেখে ঘুমায় বুঝতে পেরেই স্বামীর চাঁদের পরীদের নাচ দেখার সাধ উবে যায়, সে আমেনার চুলের মুঠি ধরে এক হ্যাঁচকা টানে টেনে তুলে বলে,

এই শালি! এই তোর পায়খানা-পেশাব?

চাঁদ! চাঁদ!!

চাঁদ তোর নাঙ? নাগরের জন্যে বসে আছিস?

আমেনা আবার চাঁদের আলোর মোহের কথা বলতে যেতেই স্বামী আর হাত ব্যবহার করে না, পা ব্যবহার করে উঠোনে নামিয়ে দেয়। সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে-গড়াতে, নামতে-নামতে আমেনা বিড়বিড় করে শুধু বলে,

আমার কী দোষ? এত সুন্দর চাঁদ!