প্রবাল দ্বীপ

রেজাউর রহমান

সারেং বড় ট্রলারের ইঞ্জিনটি সৈকতভূমির আনুমানিক দূরত্ব থেকে সারেং থামিয়ে দিয়েছিল। ফলে ইঞ্জিনের কানফাটা শব্দও একটু-একটু করে কমে আসতে থাকে। বোরহান স্যার তাঁর দুকান থেকে হাত সরিয়ে হালকা হাসেন। ছাত্রছাত্রী মহলও উলস্নসিত হয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলে আচমকা অনেকেই টাল সামলাতে না পেরে একে অপরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অনন্তা বেসামাল হয়ে পড়ার পূর্বক্ষণে নওশের তাকে জাপটে ধরে ফেলে। অনন্তাকে সাগরপাড়ের সন্ধ্যালগ্নের ডুবন্ত সূর্যের আভায় লাজনম্র দেখায়। এই অবস্থায় যার-যার বেতাল অবস্থান নিয়ে হিমশিম খেতে থাকলেও সুমনের দৃষ্টি ছিল অনন্তা-নওশেরের দিকে। দৃশ্যটা তার জন্য কষ্টকর হয়ে ওঠে।

ট্রলার ধীরে-ধীরে প্রায় গতিহীন হয়ে এক হাঁটু লোনাজলের গভীরতায় এসে আটকে গেল। পাঁচ-সাতজন ছেলে ট্রলারের সামনের দিকে প্রস্ত্তত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কাঠের লম্বা বিটওয়ালা সিঁড়ি ঝপ করে পানিতে নামিয়ে দিয়ে তারা তরতর করে নেমে যায়। হাঁটুজলে। ততক্ষণে তারা তাদের প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত কেউ গুটাতে পেরেছে, কেউ পারেনি। এর মধ্যে মুশরীফ, নলিনী, সুমন, আযরফ ও তারেকরাই ছিল সবার আগেভাগে। আর পুরো স্টাডি টুরের দায়িত্বে ছিলেন দুজন জুনিয়র শিক্ষক আলফাজ ও অনীমা ম্যাডাম। প্রধান দায়িত্বে ছিলেন প্রফেসর মো. বোরহান খান। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের সর্বমোট ৩৫ ছাত্রছাত্রী ট্রেনে ঢাকা ছেড়েছিল জানুয়ারির ১২ তারিখ ২০১৪।

কক্সবাজারের এক দিন এক রাত বিরতি দিয়ে টেকনাফ। টেকনাফ থেকে তাদের গন্তব্যস্থল প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। টেকনাফ ধরে নাফ নদী, সেটাতে তখন ভাটির টান। কাদা, কাদার নিচের কোরাল পাথর, তাই জুতা-স্যান্ডেল হাতে নিয়ে কিছুটা পানি ভেঙে ট্রলারে গিয়ে উঠেছিল সবাই। সবার চোখে-মুখে আনন্দ-উত্তেজনার চমক। নাফ নদীর একদিককার পাড়ে ছাড়া-ছাড়া ম্যাংগ্রোভ বন, ওপারে ঢালু ধূসর পাহাড়। নদী বেয়ে ট্রলার বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়লে এসব তাদের দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। চতুর্দিকে তখন শুধু পানি আর পানি। ছোট-ছোট জলের ঢেউয়ে তখন সূর্যরশ্মির তীক্ষন বর্ণালির বিচ্ছুরণ।

সেন্টমার্টিনে পৌঁছে গেলে থেমে-যাওয়া ট্রলার থেকে জলে নেমে কিছুটা ভিজতে-ভিজতে সৈকতের বালিতে পা রাখে
মুশরীফ-নলিনীর অগ্রগামী দল। তারা হুর্রা করে, দু-আঙুলে ‘ভি-চিহ্ন’ দেখিয়ে উলস্নাসে মেতে ওঠে তারা। বাকি ছেলেমেয়েরা আনন্দ-কোলাহলের মধ্য দিয়ে তাদের অনুসরণ করে। সবার শেষে নামেন বোরহান স্যার। মুশরীফ-নলিনীর কোলে চড়ে। অনীমা ম্যাডাম নামেন অনন্তা-জাফরীনের কাঁধে ভর দিয়ে। অনেকটা চ্যাংদোলার ভঙ্গিমায়।

 

দুই

সাগরসৈকত থেকে বেশি দূরে নয়, ঊর্মিল জলরাশি যেখানে ভেঙে-ভেঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছিল – এরই জায়গায়-জায়গায় ছোট-ছোট গাঙচিলের দল বলয়াকারে জটলা পাকিয়ে উড়ছিল। আর ডাকছিল। রয়ে-রয়ে, ভেসে-ভেসে। অদ্ভুত এদের গলার স্বর। তা উলস্নাস, বিষাদ, নাকি কোনো প্রজনন সুখকষ্টের সংকেতবার্তা তা বোঝার জো নেই।

একটু সময় দিয়ে বোরহান স্যার ছাত্রছাত্রীদের ডাকেন। তাদের স্মরণ করিয়ে দেন – ‘আমার জানা মতে, এখানে থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা নেই। দোকানপাট, জনবসতিও নেহায়েত কম।’

এক দল গেল বাজারের দিকে। হোটেল-রেসেত্মারাঁর খোঁজখবর নিতে। প্রায় সারাদিন খাওয়া হয়নি কারো। পানীয়র ব্যবস্থার
কথাটাও মাথায় রাখতে হবে। টিউবওয়েল যে আছে এটা নিশ্চিত। সাগরের লোনাজল তো খাওয়া যায় না।

অন্য দলের আলফাজ স্যার ও ছেলেরা ফিরে আসেন। খবর খারাপ নয়। তারা জানালো, সীমারক্ষী বাহিনীর প্রধান হাবিলদার সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কথা শুনে সদয় হয়েছেন। তিনি তিন রাতের জন্য আশ্রয়ের, মাথা গোঁজার আশ্বাস দিলেন। আর নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছেন।

ছাত্রছাত্রীরা যার-যার ব্যাগেজ-কিট নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে তাদের রাতের আস্তানায় পৌঁছে গেল। সেটি লম্বা টিনের দোচালার মতো একটি ঘর, যার চতুর্দিক খোলা। বেড়া-আব্রম্নর কোনো বালাই নেই। মেয়েরা প্রথমটায় সামান্য ইতস্তত করলেও বোরহান স্যার তাদের আশ্বস্ত করেন। এটি বিডিআর এরিয়া। নিয়মিত সেন্ট্রি সিস্টেম রয়েছে।

ছোটখাটো একটা হোটেলে রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। জায়গা কম বলে দুই শিফটে খেতে হলো। মেন্যু সাদাসিধে। চাল-ডাল-আলুর মিশ্র খিচুড়ি। ডিমসিদ্ধও জোগাড় করা গেল না। দোকানি আশ্বাস দিলেন, নাস্তার সময় তা দেওয়া যাবে।

টর্চ-বাতি-হ্যাজাক-হারিকেন থাকলেও বোরহান স্যার স্থানীয় জলচর-স্থলচর প্রাণী সংগ্রহ করতে আজ রাতের মতো বারণ করলেন। স্থানীয় নিরাপত্তা প্রধান হাবিলদার সাহেবেরও মত তাই। এ সময়ে স্থানীয় বিষধর সাপগুলো শিকারের সন্ধানে বের হয়। সুতরাং আজ রাতের মতো সবার বিশ্রাম।

হাবিলদার সাহেব স্যারদের জন্য একটু সম্মান করেন। দুই স্যারের জন্য তাদের থাকার দালান ঘরের এক কোনায় একটা ব্যবস্থা করলেন। নিচে রয়ে গেলেন অনীমা ম্যাডামসহ বাকি সবাই। কিন্তু কে আর ঘুমায়? আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। অদূরে সাগরজলের ঢেউয়ের কাঁদুনে গোঙানি। ঢেউয়ের শব্দ কাছিয়ে এসে ফিরে-ফিরে যায়। জলের আওয়াজ সবল থেকে হালকা হয়ে আবার ফিরে আসে। দূরে একদল কুকুর একটানা ডেকে চলে। ফাঁকে-ফাঁকে নিশাচর দু-একটা অচেনা পাখিও ডাকে।

অনন্তা কি শব্দ করে হাসছিল! তাকে ঘিরে ছিল নওশের-নলিনী-তারেক। সুমন বন্ধুদের যে-জটলায় পড়ে গিয়েছিল তা থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারলো না। শুধু দূর থেকে সে শুনছিল অনন্তার মিষ্টি হাসির উচ্ছ্বাস।

 

তিন

ভোররাতের দিকে সাগরের তর্জন-গর্জন বাড়ছিল। সাথে ঠান্ডা হাওয়ার তোড়। বেসামাল গতিতে। বোরহান স্যার ওপর থেকে নেমে সবাইকে ডেকে তোলার উদ্যোগ নেন। তিনি সরব হয়ে বলে যান, ‘এটাই সময়। স্পেসিমেন কালেকশনের। ঢেউয়ে-ঢেউয়ে ভেসে আসবে সামুদ্রিক সব ছোট প্রাণী। এর কিছু ফিরে যেতে পারবে, কিছু বালির ভাঁজে আটকা পড়ে যাবে। সেগুলো আমাদের সংগ্রহ করতে হবে। তোমরা সবাই রেডি হয়ে যাও…।’

বড় স্যারের নির্দেশমতো আলফাজ স্যার ছেলেমেয়েদের ডেকে পাঁচ-ছয়জন করে একেকটা দল গঠন করে দেন। তারা তাড়াহুড়ো করে কালেকশন-কিটবক্স, ফরমালিন ইত্যাদি নিয়ে প্রস্ত্তত হয়ে বেরিয়ে যায়। এবার অনন্তা আর সুমন এক দলে পড়েছে। এতে সুমনের অন্তরাত্মা আনন্দে নেচে ওঠে। সে এমনই একটা সুযোগ চাইছিল। জার্নির প্রথম থেকে। সে মনে-মনে অনন্তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। তাকে দেখার প্রথম দিন থেকে। কিন্তু কখনো সে তা প্রকাশ করতে পারেনি।

স্যারেরা দুপুরের খাওয়ার পর সবার স্পেসিমেন কালেকশন নিয়ে আলোচনায় বসেন। তাঁরা সবাইকে তাদের সামুদ্রিক ফনা ও ফ্লোরা সংগ্রহের প্রশংসা করেন। তারা এর মধ্যে একটি সামুদ্রিক শিশু সাপ (সম্ভবত বিষধর), কয়েকটা হেমার হেড শার্কের বাচ্চা আর কয়েকটা প্রায় উভচর মাছ (পেরিওপথ্যালমাস) প্রজাতি পেয়ে উলস্নসিত। প্রফেসর বোরহান বলছিলেন, ‘এই মাছটি সাধারণত ম্যানগ্রোভ পস্ন্যানটেশনের অল্প পানির জলাশয়ে দেখা যায়। সময়-সময় এরা ডাঙ্গায়ও চলে আসে। কিন্তু এই মাছ নদী বেয়ে সাগর জলে চলে আসে এমন ইনফরমেশন আমার জানা নেই। ‘দ্যাট্স ইন্টারেস্টিং।’ প্রাণিজ সংগ্রহগুলোকে ভালোভাবে গুছিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়ে তিনি রাতের প্রোগ্রাম ঘোষণা করলেন।

‘সেন্টমার্টিনের সাগরপাড়ের জলে-স্থলের নিশাচর প্রাণীও যথেষ্ট কৌতূহলের বিষয়। বিশেষ করে বায়োলুমিনেসেন্স (অন্ধকারে প্রাণীর গা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়) অমেরুদ-ী প্রাণী ও সামুদ্রিক কচ্ছপ। এখনকার সবুজ কচ্ছপ প্রজাতি বিরল এক জলজ প্রাণী। কিন্তু রাতের বেলায় এগুলো চরাভূমির বালু খুঁড়ে ডিম পাড়তে আসে। এগুলো তোমাদের খুব সাবধানে ফলোয়াপ করতে হবে। অধুনা এই প্রাণীটি আসন্ন বিলুপ্ত প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

রাতের বেলায় শিক্ষা সফরের ছাত্রেরা সৈকত ধরে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ে। হাবিলদার সাহেব তাদেরকে সাবধান করেন। এ-সময়ে ছোট-বড় প্রাণীগুলো আধারের সন্ধানে বের হয়। এর মধ্যে বিষধর সাপগুলোই বেশি বিপজ্জনক।

সুমন-অনন্তা প্রায় কাছাকাছি হাঁটছিল। প্রায় গা ঘেঁষে। অনন্তার কণ্ঠ ভয়জড়িত।

‘সাপে আমার যা ভয়। ছোটবেলায় আমার নানার বাড়িতে অন্ধকারে একবার সাপের গায়ে পা পড়েছিল। কী ঠা-া শরীর …ওহ!’

ভয়ে অনন্তা সুমনের হাত ধরে।

‘ভয় পেয়ো না। আমার কাছে টর্চ আছে।’ আসেত্ম হাঁটে তারা। ছোট্ট একটা ঝাউঝোপের পাশে বসে পড়ে। অনন্তার হাত তখনো সুমনের মুঠোয়।

‘ছোবল যদি খেতে হয় তাহলে আমি আগে হাত পেতে নেব। আমার আগে তোমার মরণ হতে দেব না।’

অনন্তা হাসে।

‘মরণ কি কখনো কাউকে বলে আসে।’

‘পিস্নজ মরণের কথা বন্ধ করো। আমাদের জীবন তো মাত্র শুরু। …স্বপ্নময় জীবন। সুখ-সমৃদ্ধির…।’

‘তা ঠিক।’ অনন্তা সুমনের হাত কোলে তুলে নেয়।

সামনে তাদের সাগরসৈকতের অন্ধকার। আশেপাশে দু-চারটি ছিটেফোঁটা জোনাকির আলো। পানি ঢেউয়ে-ঢেউয়ে ফুলেফেঁপে এসে আবার ফিরে যেতে থাকে। সাগরজলের গোঙানির গভীরে কোথায় জানি একটা বিশাল ব্যাপ্তির সুখ-বেদনার সুর বাজতে থাকে। দূরে-কাছে দু-চারটি মাছধরা ট্রলারের লণ্ঠন বাতি জ্বলছে মিটিমিটি। আকাশে শেষ জ্যোৎস্নার স্তিমিত আলোর ছায়া।

তখনই তারা তাদের দিকে এগিয়ে আসা বালিকাটা খড়খড় শব্দে সচেতন হয়। অনন্তা তাকে প্রায় জাপটে ধরে। কোল ঘেঁষে থাকে। সুমন তার হৃৎস্পন্দন শুনতে পায়।

সুমন তাকে অভয় দেয়। ‘আমি থাকতে…।’

খড়খড় শব্দটা তাদের দিকে এগিয়ে এসে বাঁ দিকে চলে যায়। সুমন ভয় পাওয়া কাঁপা গলায় অনন্তার কানে-কানে বলে, ‘আমি ধরতে পেরেছি। এটি সবুজ কচ্ছপ। ডিম পাড়তে ডাঙায় উঠে এসেছে। আমি লক্ষ রাখছি। এদের ডিম সংগ্রহ করতে পারব।’

‘পারবে? স্যার বলছিলেন, এরা খুব গোপন জায়গায় বালির গর্তে ডিম দেয়। গভীর রাতে। নিভৃতে। এদের ডিম সংগ্রহ খুব কঠিন।’

ঘণ্টাখানেক পরে, কচ্ছপটি জলের দিকে নেমে গেল। সুমন ঝটপট উঠে দাঁড়ায়। অনন্তা তাকে ছাড়ে না।

‘আমার ভয় করছে।’

‘আমাকে ধরে রাখো।’

সুমন আনুমানিক একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। অনন্তাকে পাশে রেখে সে দুহাতে বালি খুঁড়তে থাকে। প্রায় আধঘণ্টা পরে সুমন উঠে দাঁড়ায়।

‘পেয়েছি অনন্তা।’

‘কী?’

‘কচ্ছপের ডিম। দাঁড়াও উঠিয়ে দেখাচ্ছি।’

অনন্তা তিনটা ডিম তার নিজের উড়নায় সন্তর্পণে গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নেয়।

সুমনকে আলতো চুমা খায় অনন্তা।

‘সাব্বাস…।’

রাতের আস্তানার দিকে ফিরে যেতে-যেতে সুমন বলে, ‘এমন একটা রাতের কথা কি ভুলে যাবে অনন্তা?’

‘না… তা কেমন করে হয়।’

‘আমি কিন্তু এ রাতের কথা জীবনে ভুলতে পারব না। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখি, আমি তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম না, মেয়েমানুষ যে এতো সুন্দর-আকর্ষণের বিষয় হতে পারে! এ-কয়টি বছর শুধু তোমাকে দূর থেকে দেখেছি। কাছে যাইনি। পাছে তোমাকে হারাই।’

‘তুমি এতো লাজুক। এ-যুগে কি সেই দূরের দেখা প্রেম… নীরব প্রেম চলে?’

‘কী জানি, সবাই কি সব পারে?’

‘তাও হয়তো ঠিক।’ বলে গভীর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয় দুজনে।

 

চার

ফিরতি পথের প্রস্ত্ততি চলছে। ট্রলার রেডি হয়ে আছে সকাল থেকে। সকাল-সকাল সেন্টমার্টিন ছেড়ে যেতে পারলে দুপুর গড়িয়ে টেকনাফ পৌঁছে যাওয়া যাবে। এটাই ফিরতি পথের জন্য ভালো সময়। বিকালের দিকে আবার কখনো-কখনো সাগরের মাঝপথে পানি উছলে উঠতে চায়। তখন আবার ঢেউয়ের উপদ্রবও দেখা দেয়। ঢেউয়ের সাথে বাতাস বইলে ট্রলারের নিশানা ঠিক থাকে না। গতিহারা হতে চায়। এ ব্যাপারে বোরহান স্যারকে সারেং-মাঝিরা দু-একবার তাড়া দিয়েছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপার-স্যাপার অন্যরকম। ঢিলেঢালা। এই তৈরি হয়ে গেছি আর দেরি নেই – মাত্র পাঁচ মিনিট করতে-করতে দেরি করে ফেলে।

সবাই যখন ট্রলারে উঠে গেছে তখন সকাল প্রায় ১১টা। সারেং বিরক্তি হয়ে তড়িঘড়ি করে ইঞ্জিনের শিকল টানে। ট্রলার চলতে থাকে। বোরহান স্যার উচ্ছ্বসিত হয়ে তাঁর গলা বাড়িয়ে রসিকতা করছিলেন। এবারের সফরের প্রাইম ক্যারেক্টর অনন্তা সৈয়দা। সে-ই একমাত্র সবুজ কচ্ছপের ডিম কালেক্ট করতে পেরেছে। অনন্তা আহ্লাদিত হয়। সুমনও গর্ববোধ করে। তখন সুমন দেখে ট্রলারে তাদের বসার অবস্থা আসার সময়কার মতোই। অনন্তার পাশের নওশের। সে একটানা হাসি-হলস্নায় মাতিয়ে রেখেছে ট্রলারের সেদিকটা। সুমন কিছুটা আহত হয়ে সীমাহীন সাগরের দিগন্ত জোড়া জলরেখার দিকে চেয়ে-চেয়ে ভাবে, অনন্তার তার পাশে বসার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ সে নেয়নি। সুমনের বরাবরের সন্দেহটা আবার তার মনে চাড়া দিয়ে ওঠে। তার ধারণা, নওশেরের সাথে অনন্তার একটা কিছু আছে। কেননা, মেয়েদের আকর্ষণ করার মতো গুণাবলির অভাব নেই তার। সে বড়লোকের স্মার্ট ছেলে। দলেবলে চলে। ক্যাফে-রেসেত্মারাঁয় আড্ডায়, তার জুড়ি নেই। খেলার মাঠেও তার আনাগোনা যথেষ্ট।

একটু পরে সুমন নিজেকে নিজে প্রবোধ দেয়, এটা হয়তো তাড়াহুড়ার মধ্যে এলোপাতাড়ি বসার একটা ব্যবস্থা। সুনিয়ন্ত্রিতভাবে বসার সময়ই বা কোথায় ছিল তাদের?

গতরাতে অনন্তার যে ঘনিষ্ঠ-উষ্ণ আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, নিকটতম প্রেমালিঙ্গনের আবহ তৈরি হয়েছে, দুটি মন-দুটি প্রাণ মিশে গেছে এক হয়ে, তা কি মিথ্যে হতে পারে? তা মোটেও নয়। অনন্তার গভীরতম অন্তস্তলের শ্বাস, তার সুরভিত দেহের দুর্বার মদিরা আহ্লাদ ভুলে যাওয়ার নয়। তা সুন্দর এবং অনন্তকালের এক মানব-মানবীর কামনার ধন। এমন মনে হতে থাকলে সুমন হতাশার আঁধারে প্রজ্বলিত আশার আলো দেখতে পায়।

সুমন এমনভাবে ভাবতে পেরে শান্ত হয়। গতরাতের পর থেকে তাদের মধ্যে তো আর কোনো সামান্যতম পর্দার আড়াল দেখে না। সে ঢাকায় গিয়ে এই বলিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত ভালোবাসা-ভালো লাগার সূত্রটি আরো পাকাপোক্ত করে ফেলবে। তাদের যৌথ জীবনের
সুখ-স্বপ্নের এক অনন্য দিশা তার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।

ছাত্রছাত্রীভর্তি ট্রলারটি চলছে এর স্বাভাবিক গতিতে। মাঝবয়সী মাস্টার সারেং সামনে বসে দিকনির্দেশনার হাল ধরে আছেন। নিবিষ্ট মনোযোগ দিয়ে। লক্ষ্য সটান সম্মুখ দিক। মাঝেমধ্যে আড়চোখে ছেলেমেয়েদের ভ্রমণের আনন্দঘন উচ্চস্বরের কথাবার্তা হইচইও উপভোগ করছেন। ট্রলারের বাকি কর্মচারীরা যে যার রুটিন কাজ করে চলেছেন। একজন বলিষ্ঠ যুবক লুঙি কাছা মেরে এক কোনা দিয়ে ট্রলার চুইয়ে ওঠা জল সেচে চলেছে।

গনগনে উজ্জ্বল সূর্য আকাশের মধ্যরেখা ছুঁয়ে, পশ্চিমে টাল খেতে শুরু করেছে মাত্র। তখনই হাল ধরে রাখা তীক্ষন চোখের সারেঙের চোখে পড়ে, সাগরের উত্তর-পশ্চিম কোনা বরাবর জলের ঢেউ কিছুটা উত্তাল হয়ে উঠছে। সঙ্গে ঝড়ো বাতাসেরও যেন এক আবহ মেতে উঠতে শুরু করেছে। সারেং সজাগ হন। নড়েচড়ে শক্ত হাতে হাল ধরেন। সাধারণত শীতকালে তিনি এমনটা হতে দেখেননি খুব একটা। হয়তো এটা এমন কিছু নয় ভেবেও তিনি ট্রলারের গতি বাড়িয়ে দেন। তাঁর হিসাব, এই জেগে ওঠা জলোচ্ছ্বাসটা হয়তো এমনি মিলিয়ে যাবে। নয়তো এই গতিতে চলতে থাকলে এটা তাঁদের ধরে ফেলার আগে তাঁরা এটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবেন। তবুও তিনি সবাইকে সজাগ করেন, সামনে সাগর একটু অশান্ত দেখা যাচ্ছে। সবাই যেন সেটা খেয়াল রেখে নিরাপদ জায়গায় বসেন। বোরহান স্যারও সবাইকে সাবধান করেন।

মিনিট বিশেক পর হালধরা সারেং হালকা হয়ে বড় গলায় ঘোষণা দেন, ‘আলস্না-রসুলের শুক্কুর গুজারি করিবেন… বিপদ কাডি গিয়ে গৈ।’ ট্রলার দ্রম্নতগতিতে বাঁয়ে কেটে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সাগর জলের উচ্ছল ঢেউয়ের শেষ মাত্রার ধাক্কাটা ট্রলারের পেছনের দিকটা ছুঁয়ে গেল। ট্রলারটা সামান্য বেতাল হয়ে যেতে চাইলেও সারেঙের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার কারণে তিনি তা সামলে নিলেন।

অনন্তা, নওশের ও আরো কয়েকজন উলস্নাসধ্বনি তুলে লাফিয়ে ওঠে। আর তখনই অনন্তা-নওশের ব্যালেন্স হারিয়ে পানিতে পড়ে যায়। সারেং ট্রলারের ইঞ্জিন থামিয়ে দেন। অবস্থা বেগতিক দেখে লাইফ-বয়া নিয়ে দুজন কর্মচারীও সাগরে লাফিয়ে পড়ে। আর এদিকে অনন্তাকে পড়ে যেতে দেখে সুমন পানিতে ঝাঁপ দেয়। সে ভালো সাঁতারু। কিন্তু এটা সাগর। নদী নয়। সুমনের অবস্থা দেখে আর-একজন কর্মচারী দুটো লাইফ-বয়া ভাসিয়ে জলে লাফিয়ে পড়ে।

ছাত্রছাত্রী মহলে হই-হুলেস্নাড়, কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। স্যারেরা সাবধানে দাঁড়িয়ে গেছেন। তাঁরা সারেংকে সবিনয় অনুরোধ করেন, ‘তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা নিন। তিনটা ছাত্রছাত্রী তলিয়ে যাচ্ছে।’

সারেংসহ ট্রলারের সকল কর্মচারী মহল প্রবল উত্তেজনা-শঙ্কায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের নানামুখী তৎপরতার কমতি নেই। পানিতে পড়ে যাওয়া কর্মচারীদের উচ্চকণ্ঠে নানা নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন বয়স্ক সারেং।

অনন্তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ফেরদৌসী স্যারদের কাছে দৌড়ে যায়। ‘স্যার অনন্তা সাঁতার জানে না।’

বোরহান স্যার উদ্বিগ্ন হয়ে সারেংকে খবরটা জানান।

‘আপনারা মাথা ঠান্ডা রাখবেন। আলস্না-আলস্না করেন। এইসব আবদারের এখন আমার সময় নাই। এক্ষুনি আমারে ট্রলার ছাড়তে অইবো। আর একটা ঢেউ আইতে লাগছে। তোরা সব পানির থনে উঠ… যে যেমনে পারছ। না অয় সবাইকে আইজ মরতে অইবো এক সাথে…।’

সারেং ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে দেন। সাইডে মোটা কাছি দড়ি ছাড়া ছিল। দড়ি ধরে উঠে আসে দুজন হেলপার কর্মচারী। কাঁধে তাদের নওশের ও সুমন। তারা তখন জ্ঞানহারা। চোখমুখ বন্ধ। জীবিত না মৃত বোঝার জো নেই।

ফেরদৌসী হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে – ‘অনন্তা ওঠেনি?’ সাগরের ঢেউ ঠেলে উঠে আসা কর্মীরা শীতে কাঁপতে-কাঁপতে হতাশা ব্যক্ত করে। ‘আর কাউকে পাওয়া যায়-নো। হয়ত পাওয়া যাইবো নাও। জলের স্রোত জববর বেশি।’

‘…আমাদের একজন… অনন্তা… সারেং ভাই একটু থামান।’ সারেং কারো কাকুতি-মিনতি শুনলেন না।

‘আগে নিজেরা বাঁচেন। …সবাই যাইবেন তলাইয়। কথা কম কন।’ ধমকে ওঠেন সারেং।

সুমন-নওশেরকে উপুড় করে ঘনঘন পিঠ চেপে পেটের পানি বের করতে থাকেন আলফাজ স্যার। নলিনী, মুশরীফ। অন্যদিকে হয়তো-বা সলিলসমাধি হয়ে গেল অনন্তার।

 

পাঁচ

সন্ধ্যার আগেভাগে তারা সবাই টেকনাফ এসে পৌঁছায়। বোরহান স্যার কয়েকজনকে নিয়ে থানায় ছুটে যান। থানার ওসি ভারাক্রান্ত হয়ে সব শুনলেন।

‘মেয়েটির বাসার টেলিফোন নম্বর আছে কারো কাছে?’

তারেক দৌড়ে ট্রলারের দিকে যায়।

‘ফেরদৌসীর কাছে থাকতে পারে।’

তারেক-নালিনীর সাথে ফেরদৌসীও ছুটে আসে। ওসি সাহেব বোরহান স্যারের দিকে টেলিফোন এগিয়ে দেন।

‘আগে মেয়েটির বাসায় যোগাযোগ করেন। একটা খবর অন্তত দেন। তবে নেগেটিভ কিছু না বলাই ভালো।’

বোরহান স্যার সাবধানে কথা বলেন।

অনন্তার মা টেলিফোন ধরেন।

স্যার মাকে সালাম দিয়ে জানান, ‘সাগরপথে আমাদের একটু অসুবিধা হয়েছিল। কয়েকজন ছেলেমেয়ে পানিতে পড়ে যায়। উদ্ধার কাজ চলছে। চিন্তা করবেন না। আলস্নাহ সহায়।’

ওসি সাহেব ভারী কণ্ঠে আরদালিকে চা দিতে বলেন। ‘আপনারা আমাকে একটু সময় দিন। স্থানীয় নৌবাহিনীর সাথে কথা বলে দেখি।’

বোরহান স্যার অস্থির হয়ে ওঠেন।

‘পিস্নজ একটু দেখেন না! অন্তত লাশটা যদি…।’ ফেরদৌসী গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকে। চোখের জল ফেলে তারেক-নলিনীও।

আজ সন্ধ্যায় তাদের কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা। বাস ঠিক করা ছিল। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা রওনা দেয় সকালে। স্থানীয় এক স্কুলঘরের ফ্লোরে তাঁরা রাত কাটায়। কিন্তু এটাকে তো ঘুম কাবারে রাত কাটানো বলা চলে না। অনন্তার জন্য সবাই প্রায় কেঁদে-কেটে রাত কাটায়। এর মধ্যে পানিতে পড়ে যাওয়া নওশেরের অবস্থার উন্নতি হলেও সুমন রুগ্ণ কাতর হয়ে ঝিম মেরে পড়ে থাকে। তাকে বোরহান স্যার স্থানীয় এক ডাক্তার দেখান। তিনি ওষুধ দেন। তাতেও তার আকস্মিকতার ঘোর কাটেনি। অনন্তাকে তারা ফেলে এসেছে তা সে ভাবতে পারে না। ঘরের সিলিংয়ের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে শুধু। অনেকটা মৃতজনের মতো।

বোরহান স্যারের তাড়াহুড়ার নির্দেশ : ‘তোমরা যার যার মাল-সামান, ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে বাসে উঠে যাও। দুপুরের আগেভাগে কক্সবাজার পৌঁছুতে পারলে, সামান্য বিরতিতে আবার আমরা সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশে বাসে চড়ে বসবো।’

তারেক-নলিনী স্যারের আদেশ পালনে তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের সাথে যোগ দেয় আরো কেউ-কেউ। একসময় প্রায় সবাই বাসে ওঠার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে। শুধু চিত হয়ে পড়ে থাকে সুমন। আগের মতোই শূন্যে চোখ মেলে। অনন্তার ঘনিষ্ঠতম বান্ধবী ফেরদৌসীও হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে। নলিনী এসে তাকে ধরে ওঠায়। তার ব্যাগেজ কাঁধে তুলে নেয়। ফেরদৌসী একবার সুমনের দিকে চেয়ে নলিনীকে অনুসরণ করে। তারেক সুমনের দিকে এগিয়ে যায়।

‘চল সুমন… ওঠ।’

সুমনের মুখে কথা নেই। সে আগের মতোই নিষ্পলক চেয়ে থাকে সিলিংয়ের দিকে।

‘স্যার তাড়া দিচ্ছেন। তাড়াতাড়ি কর।’

সুমন কষ্টে মুখ খোলে।

‘তুই যা… আমি আসছি।’

তারেক সুমনের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যায় বাসের দিকে। তাড়াহুড়া করেও সবার বোচকা-বুচকি, বাবুর্চির হাঁড়িপাতিল উঠিয়ে পুরোপুরি তৈরি হতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় কেটে যায়। কক্সবাজারে রওনা দেওয়ার পূর্বমুহূর্তে বোরহান স্যার আবার সবাইকে সাবধান করে : ‘তোমরা শেষবারের মতো আবার দেখে নাও সবার সব ঠিকঠাক আছে কি না? কক্সবাজারে পৌঁছে যেন না শুনি…স্যার আমার ব্যাগ খুঁজে পাচ্ছি না, আমার কালেকশন জার… ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন কিন্তু তাকে আমরা রেখে চলে যাবো। আমাদের সামনে নানা জানা-অজানা বিপদ… অনন্তার মৃত্যু আরো কত কি – কে জানে? জবাবদিহি তো করতে হবে… তার বাবা-মা, বিশ্ববিদ্যালয় অথরিটি…। …মুশরীফ-নলিনী তোমরা মাথা গোনো।’

গণনা শেষ হলে মুশরীফ জানায়, ‘একজন কম পড়ছে।’

নলিনী আবার গোনে। ‘তাই তো!’

তখন তারেকের মনে পড়ে, ‘স্যার, স্কুলঘরটা আবার দেখে আসি। সুমন কোথায়?’

মুশরীফ-তারেক বাস থেকে দৌড়ে নামে। স্কুলঘরে সুমনকে না পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে টেকনাফ ট্রলার ঘাটের দিকে ছুটে যায় তারা। সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিতে থাকা একটি ট্রলারে উঠে তারা সারেঙের কাছে সুমনের ব্যাপারে খোঁজ করে। ব্যস্তসমস্ত সারেঙের বেশি কথা বলার সময় নেই। তারপরও তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ অসুস্থ ছাত্রমতো একজন তো আমার ট্রলারে উঠছিল। আমার দেরি দেহি, আগের ট্রলারে চলে গিয়ে। হেই ট্রলারও খুব বেশিদূর যাইন। ওই ত দেহা যায়…।’

মুশরীফ-তারেক দেখে, ছেড়ে-দেওয়া ট্রলারের গলুইয়ের কাছে সুমন মাথা নিচু করে বসে আছে।

বিকট-যান্ত্রিক শব্দে সাগরজলে ঢেউ তুলে এগিয়ে চলেছে ট্রলার। একটু পরেই তা সামান্য বাঁক নিয়ে এগিয়ে যাবে সীমাহীন সাগরজলের গভীর বিস্তারে।