ইয়াহিয়ার এক সকাল ১৯৭০

আনিসুল হক

‘স্বয়ং প্রেসিডেন্টের ছিল মদ ও নারীভোগের নেশা। আর তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্নেল ছিলেন সমকামী…

বারবণিতা আর বেশ্যার দালালদের প্রেসিডেন্ট হাউসে যাতায়াত ছিল অঢেল ও অবাধ। নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার আর কি। তাদের কজন আবার বেশ হাই স্ট্যাটাস ভোগ করতেন। আকলিম আখতার, মিসেস কেএন হোসেইন ও লায়লা মুজাফফরের মর্যাদা ছিল সর্বোচ্চ। কুখ্যাত তবে মোহময়ী রমণীদের পাল ঘুরে বেড়াত ভবনের সর্বত্র। তারা ধূমপান করতেন, মদ পান করতেন, নেচে-গেয়ে হেলেদুলে হই-হুলেস্নাড় করতেন।

পুলিশ বাহিনীতে এসব নিয়ে গোপন হাসি-তামাশার কমতি ছিল না। তারা প্রেসিডেন্ট হাউসের নাম দিয়েছিলেন কাঞ্জারখানা (পতিতালয়), সামরিক সদর দপ্তরকে দঙ্গরখানা (পশুর আখড়া) আর নিজেদের পুলিশ লাইনকে লঙ্গরখানা (খাদ্যালয়)।’

… সরদার মুহাম্মদ চৌধুরী, (পাকিস্তান পুলিশের সাবেক আইজি), দি আলটিমেট ক্রাইম, কওমি পাবলিশার্স, ১৯৯৭, অনুবাদ : মশিউর রহমান মহসিন, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন ২০০২।

পি–র রাষ্ট্রপতিতালয়, যেখানে পতিতাগণের অবাধ গতায়ত, সেখানে ড্রেন দিয়ে পানি প্রবাহিত হয় না, বয়ে চলে মদের ধারা। সারাক্ষণ মদের গন্ধ ভুরভুর করে বেরুচ্ছে ড্রেন থেকে, ঘর থেকে, টেবিল থেকে, বেশ্যাদের মুখ থেকে, রাষ্ট্রপতিতের মুখ থেকে, মেহমানদের মুখ থেকে। ড্রেনে এত মদ বয়ে যায় যে, ওখানকার ড্রেনের পোকাগুলো পর্যন্ত হাঁটতে পারে না, টলমল করে তাদের পা, মাছিরা উড়তে পারে না, মদালস পাখা কীভাবেই বা মেলবে তারা। সুবিসত্মৃত বাগান আছে রাষ্ট্রপতিতালয়ের সামনে-পেছনে, সেখানে ফুলের গন্ধ নাই, আছে তামাকের ধোঁয়া। বেশ্যারা সারাক্ষণ আসছে, যাচ্ছে, তাদের গা থেকে বেরুচ্ছে হালাল সুগন্ধীর গন্ধ, যারা সারাক্ষণ ডুবে আছে মদে আর তামাকের ধোঁয়ায়, সুগন্ধীতে মদ থাকলে তাদের আবার চলে না, কারণ তারা হারাম পারফিউম গায়ে মাখতে পারে না, তারা ব্যবহার করে হালাল আতর। ফাঁকিস্তানের রাজধানী পি–। রাষ্ট্রপতি(ত) থাকে রাষ্ট্রপতিতালয়ে।

ইয়াহিয়া এখন তার কক্ষি। সেগুনকাঠের কারুকার্যময় দরজা ভেতর থেকে আটকানো। বাইরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন রাষ্ট্রপতিতালয়ের কর্মকর্তারা।

ক্রিং-ক্রিং। ফোন বাজছে।

সামরিক সচিব জেনারেল ইসহাক ফোন ধরলেন – ‘এমএস বলছি।’

‘প্রেসিডেন্ট কি বেরিয়েছেন? শাহ এখনি বেরুবেন। তাকে ফেয়ারওয়েল দিতে হবে। অলরেডি আমরা লেট।’

‘প্রেসিডেন্ট বের হননি।’

‘কখন বের হবেন?’

‘বলা মুশকিল। তিনি তার ঘরে। তিনি ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।’

‘এগিয়ে যান। তাকে ডাকুন। এটা রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রাম। ইরানের শাহের ফ্লাইট ছেড়ে দেবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট কখন আসবেন আর কখনই বা ইরানের শাহকে বিদায় জানাবেন?’

‘প্রেসিডেন্টের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।’

‘গিয়ে ধাক্কা মারুন।’

‘সেটা তো সম্ভব না।’

ক্রিং-ক্রিং।

‘প্রেসিডেন্ট কি বেরিয়েছেন?’

ক্রিং-ক্রিং। প্রেসিডেন্ট কি বেরিয়েছেন?

ক্রিং। ক্রিং।

ক্রিং-ক্রিং। প্রেসিডেন্ট কি বের হয়েছেন?

ক্রিং-ক্রিং। জি না, বের হননি। জি, আমি দেখছি কী করা যায়?

প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব জেনারেল ইসহাক কী করতে পারেন?

কিন্তু এতবার ফোন আসছে। পররাষ্ট্রবিষয়ক কর্তারা এত অস্থির হয়ে গেছেন – তার একটা কিছু করা দরকার।

প্রেসিডেন্টকে ডিস্টার্ব করা যাচ্ছে না, কারণ তার কক্ষি নূরজাহান। পাকিস্তানের মালিকা-ই-তারান্নুম। প্রেসিডেন্ট যাকে আদর করে ডাকেন নূরি। গায়িকা এবং নায়িকা।

জেনারেল ইসহাক মুশকিলে পড়লেন। একটা উপায় হলো প্রেসিডেন্টের ফোনে কল দেওয়া। কিন্তু দেবেটা কে? কার ঘাড়ে দুইটা মাথা।

উপায় নাই। জেনারেল ইসহাক তার টেবিলের ওপরের লাল রঙের ফোনটা তুললেন। নম্বরে আঙুল দিয়ে ডায়াল ঘোরালেন। রিং হচ্ছে। কেউ ধরছে না।

জেনারেল ইসহাক বিপন্ন। প্রেসিডেন্ট হাউসের স্টাফরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে, কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

মহাকেলেঙ্কারি হতে যাচ্ছে। পিআইএর বিমানটা পি– এয়ারপোর্টে প্রস্ত্তত। ইরানের শাহ তার লটবহর নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছেন। এখন ফাঁকিস্তানের রাষ্ট্রপতি(ত) যদি না বেরন, তাহলে সারা পৃথিবীকে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।

হঠাৎ জেনারেল ইসহাকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার মনে একটা আশার সঞ্চার হয়েছে। তিনি একটা আলোর রেখা দেখতে পেলেন। একমাত্র জেনারেল রানি পারে তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।

রানির বালামখানা খুব দূরে নয়। জেনারেল ইসহাক মোটরগাড়িতে ছুটলেন সেই বালামখানার দিকে। দ্রম্নত ঢুকে গেলেন বাড়িতে। বাড়ির বাইরে পুলিশ প্রহরীরা জেনারেলের গাড়ি দেখে তাকে ঢুকতে দিলো। এই বেশ্যালয়েও নানা জাতের জেনারেলরা সব সময়ই আসা-যাওয়া করে। তাদের ঢুকতে দেওয়াই দস্ত্তর।

জেনারেল ইসহাক বললেন, মাতাজি, আপনাকে এক্ষুনি আমার সঙ্গে যেতে হবে।

রানি পরে আছেন একটা আঁটসাঁট কামিজ, নিচের দিকে ঢোলা ওপরের দিকে চিপা একটা স্যালোয়ার। তার ওড়না হাতে, পায়ের দিকে গড়াচ্ছে। তার ঠোঁট লাল, তার হাতভরা সোনার বালা।

রানি বললেন, তবিয়ত ঠিক আছে?

জি?

শরীর ঠিক আছে? কোনো বিমার হয়নি তো?

জি।

তাহলে মাথা ঠিক নাই।

তা একটু খারাপ আছে।

আমি সেটা শুরুতেই বুঝেছি – আমি কারো মাতাজি হই না। আমি সবার বন্ধু।

জেনারেল ইসহাক মনে-মনে বললেন, ছ-ছটা সন্তানের মা হয়েও তুমি কারো মা হও না। বটে। তবে তুমি আজকে আমার মায়ের চেয়েও বড় উপকারটা করতে পারো।

‘আপনাকে এক্ষুনি প্রেসিডেন্ট হাউসে যেতে হবে। প্রেসিডেন্ট দরজা বন্ধ করে আছেন। দু-চারবার টোকা দেওয়া হয়েছে। বার তিনেক ফোন করেছি। তিনি কিছুতেই সাড়া দিচ্ছেন না। এদিকে রাষ্ট্রীয় প্রোটোকলের ডাক। ইরানের শাহকে বিদায় দিতে হবে। আপনি আমার সঙ্গে চলুন। প্রেসিডেন্টকে বের করে আনুন।’

রানি হাসলেন। বললেন, ‘একটা মিনিট। আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাব। আমাকে একটু পোশাকটা পাল্টাতে দিন। একটু সাজতে দিন।’

‘মাতাজি আজকে আপনাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। আপনাকে একদম সাজতে হবে না। এই পোশাকটা তো খুবই শানদার। আপনাকে সেই রকম গর্জিয়াস লাগছে।’

‘দুষ্টু ছেলে। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’

রানি সাজপোশাকে বেশি সময় নিলেন না। তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি(ত)র বন্ধু বলে মনে করেন। বন্ধুর কাছে যাওয়ার জন্য তার বেশি প্রসাধনের দরকার নেই।

কিন্তু তিনি জানেন, যে-মেয়ের প্রধান অস্ত্র তার শরীর, সে কোনো মেয়েই নয়। তারা বসন্তের ফুলের মতো। ফোটে এবং ঝরে পড়ে। তিনি কত জেনারেল, কত নেতা, কত অফিসারকে মেয়ে সরবরাহ করেন। কোনো মেয়েই তো কারো জীবনে স্থায়ী আসন গাড়তে পারল না। কিন্তু তিনি, রানি, জেনারেল রানি, রয়েই গেছেন। মক্ষিরানির মতো তাকে ঘিরেই সব। মেয়েরা সবাই ফুলের মতো হতে চায়। কিন্তু তাদের হতে চাওয়া উচিত কদবেলের মতো। বাইরেরটা শক্ত। ভেতরে মধু। ফুল ফোটে ঝরে যায়, দুনিয়ার রীতি। আজ যার শুরু হয়, কাল তার ইতি। কিন্তু ফল দুদিনের জন্য ফোটে না। বোঁটা ধরে অনেকক্ষণ ঝুলে থাকে।

জেনারেল ইসহাকের জিপেই উঠলেন রানি। গাড়ি ছুটতে শুরু করল। পেছন-পেছন তার নিজের গাড়ি এলো রাষ্ট্রপতিতালয় পর্যন্ত। তার গাড়ি এই বাড়িতে সকাল-বিকেল আসে। রাষ্ট্রপতিতালয়ের গেটে এই গাড়ি আসা মাত্রই ভেতর থেকে দরজা খুলে যায়।

রানি নামলেন রাষ্ট্রপতির খাসকামরার খুব কাছের পোর্চে। তাদের জিপ সেখানে পৌঁছা মাত্র আরদালিরা দৌড়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিলো।

জেনারেল ইসহাকও লাফ দিয়ে নামলেন জিপ থেকে। রানির হাত ধরে তাকে নিয়ে ছুটতে লাগলেন খাসকামরার দিকে।

তখনই, একটা দমকা হাওয়া এসে উড়িয়ে দিলো রানির ওড়নাখানি।

রানি এই বাতাসটাকে চেনেন। এ হলো তার সৌভাগ্যের হাওয়া। একদিন এমনি বাতাস ভেসে এসেছিল মারি পাহাড়ের তুষারশীতল চূড়া থেকে। সে আজ থেকে সাত বছর আগের কথা। আপাদমস্তক তিনি আবৃত ছিলেন বোরকায়। সেই হাওয়া তার মুখের নেকাব দিলো উড়িয়ে। ছটি সন্তানের মা আকলিম, তখনো তিনি রানী হননি, তখনো তিনি গুজরাটের সম্পন্ন ঘরের মেয়ে আকলিম, যার বিয়ে হয়েছে পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে, যিনি একের পর এক বাচ্চা বিয়োয়ে চলেছেন।

তার পুলিশ স্বামী বললেন, এটা কী ধরনের নাফরমানি। মুখের নেকাব কেন সরবে? তোলো নেকাব।

পাইনগাছের সারির নিচে পর্যটকের মন আর ফুর্তি নিয়ে হাঁটছিলেন আকলিম, ঠান্ডা হাওয়া তার মুখে যেন সেণহমাখা হাত বুলাচ্ছে, মুখের পর্দা সরিয়ে এতই ভালো লাগছিল তাঁর, স্বামীর    কথায় আমল দিলেন না, খিলখিল করে হেসে উঠে পাশের ঝাউগাছের পাতায় হাত বোলাতে লাগলেন।

‘এ কী করছ তুমি? মুখ ঢাকো বলছি। রাস্তায় কত মানুষ। এটা মলে যাওয়া-আসার পথ।’

আকলিম তখন ঘুরে দাঁড়ালেন স্বামীর দিকে। আসেত্ম-আসেত্ম চিবুকের নিচে বোরকার ফিতাটা খুললেন। তারপর বোরকাটা পুরোটাই খুলে ছুড়ে মারলেন স্বামীর মুখের দিকে।

তারপর হাসতে লাগলেন খিলখিল করে।

হাওয়া বইছে। সেই মত্ত হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গেল বোরকাখানি। ঝাউগাছের ওপর দিয়ে উড়ে গেল পাহাড়ের শানুদেশে। কোন অতলে, কোন গহিনে! চোখের আড়ালে।

পুলিশ স্বামী ভীষণ চটেমটে লাল। দূর পাহাড়ের গায়ে অস্তগামী সূর্যের লালও যেন হার মানবে স্বামীর রক্তিমাভ মুখের কাছে।

আকলিম বললেন, আর কোনোদিনও আমি এই বোরকা পরছি না।

স্বামী বললেন, আর কোনোদিনও তুমি আমার ঘরে জায়গা পাচ্ছ না। তিনি তার হাতের ছড়ি দিয়ে আঘাত করলেন আকলিমকে। ছড়ি এসে লাগল তার মাথার এক পাশে। চুলের নিচে সামান্য কেটে গেল। আকলিম হাত দিলেন, রক্ত।

আকলিম বললেন, এই খুনের শপথ, আমি তোমার ঘরে আর কোনোদিনও ফিরছি না।

রাগে তার সমস্ত সত্তা কেঁপে-কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি গিয়ে তিনি ওই বাবার বয়সী লোকটার মাফলার কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে ফেলেন, তার মুখ আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দেন। কিন্তু রাস্তাটা গিয়ে মিলেছে মলে, লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে, তাদের সামনে এই লোকটাকে মারধর করাটা ঠিক হবে না।

তারা ছুটি থেকে ফিরলেন তাড়াতাড়ি। আকলিম তার ছটি বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন স্বামীর ঘর থেকে। সেই যে বেরুলেন, আর ফিরলেন না।

সেই হাওয়াটাই যেন আজকে বইছে রাষ্ট্রপতিতালয়ে। তার সৌভাগ্যের বাতাস।

যে-স্বামীকে তিনি ছেড়ে এসেছেন, তিনি কোথায় পড়ে রইলেন, কোন অজানা অন্ধকারে! আর তিনি কোথায়? আকলিম থেকে তিনি আজ রানি। জেনারেল রানি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার দহরম-মহরম।

অবশ্য আকলিমের এই উন্নতির পেছনে পুলিশ-কর্তা স্বামীর সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে। তার স্বামীর সূত্রেই তিনি দেখেছেন দেশের বহু ক্ষমতাবানকে। বুঝেছেন, এরা দেশের জন্য খাটতে-খাটতে এতই হয়রান যে, এদের দরকার হয় একটুখানি আমোদ-ফুর্তি। তা না হলে এরা দেশের জন্য কাজ করবেন কী করে? এজন্য এদের দরকার হয় মেয়েমানুষ। সেরকম মেয়েমানুষ, যাদের ওপর নির্ভর করা যায়। যারা গোপনীয়তা বজায় রাখবে, আর যাদের আছে আভিজাত্য। আকলিম সেই রকম মেয়েমানুষদেরকেই জড়ো করেছেন। কাকে কার কাছে পাঠাতে হবে, এটা তার মতো আর কেউ ভালো জানে না, পারেও না।

পুরুষ মানুষের হাতেই যত ক্ষমতা। কিন্তু সেই ক্ষমতার খেলায় পুরুষকে বন্দি করতে পারে একমাত্র মেয়েমানুষ। পুরুষের সমস্ত ক্ষমতাবুদ্ধি লোপ পাবে, যদি তার দুপায়ের জোড়ের ওই জায়গাটার তুমি দখল নিতে পারো। পুরুষদের খেলায় পুরুষদের নিয়ম দিয়ে তিনি পুরুষদের ঘায়েল করতে সমর্থ হয়েছেন।

কত-কত জেনারেল, রাজা-উজির, অফিসার, ব্যবসায়ী আজ তার পায়ের কাছে এসে বসে থাকে। তার একটুখানি নেক-নজরের আশায়।

কাজটা শুরু করতেও আকলিম আখতারকে বুদ্ধি খাটাতে হয়েছিল। তিনি করাচি, রাওয়ালপি–, লাহোরের নাইট-ক্লাবগুলোতে যাওয়া শুরু করেছিলেন। না গিয়ে তার কোনো উপায় ছিল না। ঘরে তার ছয়টা মুখ। তাদের পেট ভরাতে হয় তাকেই। সেসব
নাইট- ক্লাবেই তিনি দেখা পান জেনারেলদের, সরকারি অফিসারদের আর ব্যবসায়ীদের। তিনি বুঝতে পারেন, এদের জন্য করাচির ন্যাপিয়ের রোড কিংবা লাহোরের হীরা মান্দির মতো বেশ্যাপাড়া দিয়ে চলবে না। এরা এত ছোট নয় যে, বাজারি মেয়েমানুষের কাছে যাবে। এদের দরকার হবে উঁচু শ্রেণির মেয়েমানুষ। আকলিম রাওয়ালপি– গেলেন। সেখানকার সবচেয়ে দামি ও বিখ্যাত নাইট-ক্লাবটির সঙ্গেই তিনি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করলেন। এখান থেকেই তার সৌভাগ্যের সূত্রপাত। ওই ফ্ল্যাটে ক্ষমতাবানেরা আসতে শুরু করল। তিনি তাদের দিলেন অভয়ারণ্যের নিরাপত্তা আর নিশ্চিতি। দিলেন স্বর্গের সুখ – শরাব আর সাকি।

ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার প্রথম দেখার দিনটিতেও বইছিল সৌভাগ্যের বাতাস।

শিয়ালকোটের হাসপাতালে। ডেটলের গন্ধ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বাগান থেকে ভেসে আসা গোলাপফুলের গন্ধযুক্ত বসন্তবাতাস।

কেবিনে ছিলেন তিনি। পেটের ডানপাশে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ডাক্তার ভয় দেখাল, অ্যাপেন্ডিসাইটিস। অপারেশন না করলে অ্যাপেন্ডিস পেটের ভেতরেই যাবে ফেটে। ভর্তির পরই এক্স-রে, বস্নাড টেস্ট নানা কিছু করা হতে লাগল। সেসবের রিপোর্ট আসার আগেই ব্যথা গেল সেরে। কিন্তু আকলিম তখনও কেবিনে বন্দিনি।

ইয়াহিয়া খান তখন ওই অঞ্চলের কমান্ডিং অফিসার। হাসপাতাল পরিদর্শনে এসেছেন। কেবিনের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন আকলিম। একটা লাল রঙের কামিজ পরা ছিলেন, ইয়াহিয়া খান পরে তাকে বলেছিলেন, তার মনে হয়েছিল, বারান্দায় গোলাপ ফুটে আছে – বসরার গুলবাগানের গোলাপ।

ইয়াহিয়া খান পূর্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন আকলিমের দিকে, আর আকলিমও ততদিনে জেনে গেছে, কোনো পুরুষকে পটাতে হলে তার চোখের দিকে তাকাতে হয়, তাকিয়ে হাসি দিতে হয়, হেসে লজ্জা পেতে হয়, কিন্তু চোখ সরাতে হয় না।

ইয়াহিয়া খান চলে এলেন তার কাছে।

জিগ্যেস করলেন, কেমন আছেন? হাসপাতালে আপনার যত্ন ঠিকভাবে নেওয়া হচ্ছে তো?

আকলিম বললেন, একটু বেশিই যত্ন নিচ্ছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, অনেক বেশি যত্ন অনেক সময় মনে হয় জিঞ্জির। পাখি খাঁচার যত্ন চায় না, চায় খোলা আকাশ!

ইয়াহিয়া খান বললেন, আপনার কথা আপনার চেহারার মতোই সুন্দর। যেন কবিতা।

আকলিম বললেন, হ্যাঁ। এটা কবিতাই। আমার নিজের লেখা।

ইয়াহিয়া খান বললেন, আপনার কবিতা তো তাহলে শুনতে হয়।

আকলিম বললেন, বাঁদি সে-সুযোগ পেলে ধন্য হয়ে যাবে।

হাওয়া বয়, হাওয়া ঝাপটা দেয়, বুকের দোপাট্টা খসে পড়ে, বাগানের গোলাপ তার সুগন্ধীতে মাতিয়ে তোলে হাসপাতালের বারান্দা, কেবিন, ওয়ার্ড, চত্বর।

ইয়াহিয়া ভাবেন, আমার বড়শিতে এইমাত্র একটা মাছ গাঁথা হয়ে গেল।

আকলিম ভাবেন, তোমাকে গেঁথে ফেলেছি, আগাজি, তুমি আবার আমার কাছে আসবে। সুতোয় টান দেওয়া মাত্র।

কে যে শিকার আর কে যে শিকারি! শিকারের এই খেলায় তা স্পষ্ট নয়। এখানে বাঘ তার বুক পেতে দেয় বন্দুকের সামনে, আর শিকারি তার মাথা ঢুকিয়ে দেয় বাঘের হায়ের মধ্যে।

ইয়াহিয়া খানই যোগাযোগ করলেন আকলিমের সঙ্গে।

আকলিম তখন তার ফ্ল্যাটবাড়িতেই ছিলেন।

তখনই এলো ফোন।

আকলিম ফোন ধরলেন। হ্যালো, আকলিম আখতার বলছেন?

জি জনাব।

আমি ইয়াহিয়া।

আগাজি। আপনি ফোন করেছেন! নম্বর পেলেন কোথায়?

আন্তরিকভাবে চাইলে পৃথিবীর যে-কোনো কিছুই কি পাওয়া যায় না?

তা ঠিক। তবে আমি তো এই বাসায় থাকি না। মাঝেমধ্যে আসি।

হ্যাঁ। আমি আরো দুবার আপনাকে কল করেছিলাম। পাইনি।  তৃতীয়বারের চেষ্টায় পেলাম।

হায় খোদা। আমি আপনাকে এত কষ্ট দিয়েছি।

না কষ্ট কিসের।

কষ্ট করেছেন। এবার আমি আপনার সেবা করে তা শোধ করে দিতে চাই। আপনি কি দয়া করে একবার এই বাড়িতে পদধূলি দেবেন।

ইয়াহিয়া বেশি দেরি করেননি আকলিমের আতিথ্য গ্রহণ করতে।

তাকে তিনি বাইরের ঘর থেকে নিয়ে গেলেন ভেতরের ঘরে। সেখানে তাকিয়ার পাশে বই। বারান্দায় টবভরা গোলাপ। আকলিম আগাজির জন্য তৈরি করে রেখেছিলেন সবচেয়ে দামি স্কচ হুইসকি। রুপার গেলাসে, পরিপাটি করে সাজিয়ে, বাদাম-আখরোট সহযোগে তিনি নিজ হাতে পরিবেশন করলেন সেই শরাব।

শোনাতে লাগলেন নিজের লেখা শের :

প্রিয়তম, তোমাকে আমি যখন আমি মদ ঢেলে দিই,

তখন জেনে রেখো, আমার নিজেকেই ঢেলে দিই গেলাসে।

নাচ আর গানের ব্যবস্থা ছিল। আকলিম তার সংগ্রহের সবচেয়ে নিপুণা তরুণীটিকেই আনলেন ইয়াহিয়ার সম্মানে। তামান্না নামের আঠারো বছরের মেয়েটি যেমন ভালো নাচতে পারে, তেমনি পারে ইংরেজিতে কথা কইতে।

আগাজি সেদিন পরে এসেছিলেন লম্বা কুর্তা আর সালায়ার। তা ছিল সাদা রঙের। তার ভরাট মুখখানি আকলিমের কাছে মনে হয়েছিল পূর্ণ চাঁদের মতো। মনে হচ্ছিল শরতের আকাশে সাদা  মেঘের ফাঁকে উদিত হয়েছে গোল চাঁদ। আকলিম মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিলেন আগাজির মুখের দিকে। ইয়াহিয়া নাচ দেখছিলেন, গান শুনছিলেন, তাকে মদ ঢেলে দিচ্ছিলেন আকলিম, নিজের হাতে, কিন্তু তার চোখ ছিল ইয়াহিয়ার চোখের দিকে। ইয়াহিয়ার চোখ উঠছে-নামছে, তিনি তামান্নার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন, মুখের দিকে, বুকের দিকে, নাভির দিকে, তামান্নার খাগড়া সরে গেল, তার ঊরুতে আছড়ে পড়ছে ঝাড়বাতির আলো, ইয়াহিয়ার চোখ নামল, তামান্না কার্পেটে বসে পড়েছে, তার বুক উপচে পড়ছে কাঁচুলি থেকে, তামান্নার স্তন তত বড় নয়, ইয়াহিয়ার চোখ নিচে, তারপর তামান্না উঠল, ইয়াহিয়া হাত বাড়িয়েছেন আকলিমের দিকে, আকলিম তার হাত মুঠোয় পুরল, তারপর ইয়াহিয়ার হাত তার পিঠে, তারপর তার চোখ চলে এলো আকলিমের দিকে, আকলিম চোখ সরাচ্ছে না। আকলিম জানেন, মেয়েদের সবচেয়ে বড় যৌনাস্ত্র হলো চোখ। গ্রামোফোনে গান বাজছে… উর্দু ছবির গান… খাড়ি নিম কে নিচে। ইয়াহিয়া আকলিমকে কাছে টেনে নিলেন। আকলিম তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, আমি তোমার কত কাছে, তবু কত দূর… ফিসফিসিয়ে বললেন, নিজের লেখা শায়েরি থেকে, তার কথার সঙ্গে শ্বাস মেশানো, সেই শ্বাস উষ্ণ, ইয়াহিয়ার কানে তা দিলো গরম ভাপ, আকলিমের শরীরও উষ্ণ, একটা কবুতরের বুকের মতো নরম আর উত্তপ্ত, ইয়াহিয়া গেলাসে আরেকটা চুমুক দিলেন। তারপর শরাব এগিয়ে দিলেন আকলিমকে। আকলিম বললেন, আমি আলাদা গেলাসে নিচ্ছি আগাজি।

ইয়াহিয়া বললেন, কেন? আলাদা গেলাসে নিতে হবে কেন?

আকলিম বললেন, ওটা আপনার গেলাস। আপনার গেলাসে চুমুক দেওয়া আমার জন্য হবে বেয়াদবি। তিনি হাত বাড়িয়ে আরেকটা গেলাসে হুইসকি ঢেলে নিলেন নিজের জন্য।

ইয়াহিয়া ধরে আসা গলায় বললেন, আমার গেলাস থেকে শরাব নিলে সেটা তোমার জন্য বেয়াদবি হবে? কিন্তু তোমার ঠোঁট থেকে আমি যদি মদিরা নিই, তাহলে তো কোনো অভব্যতা হবে না। তিনি আকলিমের মুখে মুখ লাগিয়ে ভেতরের শরাব নিজের মুখে শুষে নিতে লাগলেন। এত স্বাদু মদিরা তিনি এর আগে আর কখনো পান করেননি। ‘এটা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু শরাব’ – তিনি আকলিমের কানে মুখ দিয়ে বললেন।

গ্রামোফোনে গান বেজেই চলেছে, তামান্নার ঊরু যেন মোম, আলো ঝলকাচ্ছে, আর নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে-থাকা নারীটির মনোবেদনা নূপুর-নিক্বণে উবে যেতে বসেছে –

খাড়ি নিমকে নিচে

হুঁ তো হাইক লে যাত্র

ওয়াতারো মানরা ছানি

মানি দেখ লে

 

সেই ইয়াহিয়া এখন দেশের প্রেসিডেন্ট। আর সেই আকলিম এখন জেনারেল রানী। আগাজি তার রুম থেকে বেরুচ্ছেন না। তাকে বের করতে হবে। এটা এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুতর রাষ্ট্রীয় সংকট। শুধু রাষ্ট্রীয় বললে কম বলা হবে। এটা এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংকট। দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের মধ্যে সম্পর্ক কেমন যাবে ভবিষ্যতে, তা নির্ভর করছে প্রেসিডেন্টকে কত তাড়াতাড়ি তার রুম থেকে বের করা যাবে, তার উপরে।

জেনারেল রানি ছুটছেন।  জেনারেল ইসহাক তার আগে-আগে। জেনারেলের বুট রাষ্ট্রপতিতালয়ের মর্মর-পাথরে ঠকঠক আওয়াজ তুলছে। রানীর রেশমি দোপাট্টা আর সেলোয়ার-কামিজ শব্দ তুলছে খসখস। তার হাইহিলও খটখট শব্দ তুলছে অশ্বখুরের মতোনই। বাতাসে সেই হিসহিসানি, অনেক দিন আগের মাউরির পাহাড়ি পথে যা তার দোপাট্টা উড়িয়ে নিয়েছিল, খুলে দিয়েছিল নেকাব।

তারা দরজা ঠেলে ঢুকলেন প্রথম হলঘরটিতে। ছাদ থেকে ঝুলছে ঝাড়বাতি। মেঝেতে ইরানি গালিচা। দেয়ালে তেলচিত্র। তারা এরপর উঠতে লাগলেন ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে। রাষ্ট্রপতি(ত) দোতলার খাস-কামরায়।

প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান। আরদালিরা সরে যাচ্ছে। নিরাপত্তারক্ষীরা উৎকণ্ঠিত মুখে ক্ষিপ্রভঙ্গিতে খুলে দিচ্ছে একের পর এক বিশাল কারুকার্যময় কবাট।

অবশেষে তারা পৌঁছলেন খাস-কামরার সামনে।

ইসহাক বললেন, রানিজি। এরপর যা করার আপনি করুন। আমি একটু দূরে থাকি।

আপনি কেন দূরে থাকতে চান?

আমার চাকরি ও ইজ্জত দুটো নিয়ে দূরে থাকাই কি উচিত কাজ হবে না?

আচ্ছা। যান দূরে যান। আমি দেখছি।

আপনার সাফল্যের ওপরে নির্ভর করছে ফাঁকিস্তান ও পারস্য দেশের কূটনৈতিক সুসম্পর্ক। আমি আপনার সাফল্য কামনা করি।

জেনারেল রানি দরজায় টোকা দিলেন।

সেই টোকার শব্দ বহুগুণে বেড়ে ছড়িয়ে পড়ল লম্বা করিডোরে, সিঁড়িঘরে, প্রতিধ্বনিত হতে লাগল দেয়ালে-দেয়ালে, ছাদে আর মেঝেতে।

কিন্তু রাষ্ট্রপতি দরজা খুলছেন না।

তিনি আরো জোরে টোকা দিলেন। ধাক্কা দিলেন।

চিৎকার করে উঠলেন, আগাজি। আগাজি…

কোনো সাড়াশব্দ নাই।

তিনি এবার ঠিক করলেন দরজা খুলে ফেলবেন। তিনি দুহাত দিয়ে দরজার কবাটে জোরে চাপ দিতেই দরজা গেল খুলে। বাইরে আলো ছিল, মাথার ওপরে ঝুলন্ত দুটো বাতি, ভেতরটা কি একটু অন্ধকার?

জেনারেল রানির চোখে প্রথমে খানিকটা অন্ধকারই আঘাত করল। তবু মানুষ পুরো নিকষ অন্ধকারেও দেখে, দিনের বেলা, ঘরের এককোণে জ্বলছে স্ট্যান্ডবাতি, মখমলের পর্দা ফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে বাইরের আলো, জেনারেল রানি তো মুহূর্ত কয়েক পরেই দেখতে পেলেন।

দেখতে পেলেন তার আগাজির সমস্তটা দেহ, পাশ থেকে, সেই কলপ-মাখানো চুল, এলোমেলো, উঁচু নাক, কোটরাগত বড় চোখের একটা পাশ, ইলেকট্রিক লাইটের হলদে আলোতেও লাল, তার সেই ললাট, উন্নত, কিন্তু ভাঁজের দাগ সমেত, ঝুলে পড়া ঠোঁট, তার গ্রীবা, গ্রীবার নিচ থেকেই তার সাদাপাকা রোমরাশি, বুকভরা, পেটটা খানিকটা ঝুলন্ত, একটুখানি ভুঁড়ির লক্ষণ সমতে, নাভির নিচটা, তারপর তলপেট, খানিকটা রোমশ, তার নিচে নূরজাহানের মুখম-ল, হাত দুটোও, হাতদুটোর আড়ালে, আর নূরির মুখের ভেতরে আগাজির শিশ্নটা আছে, সেটা কল্পনা করা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না, আগাজির হাত নূরজাহানের মাথার পেছনে একটা, আরেকটা বোধহয় ঝুঁকে পড়ে তার স্তন মর্দন করতে চাইছে, আগাজির নিতম্ব একবার সামনে একবার পেছনে ঝুঁকছে, তিনি আহ্-আহ্ বলে উঠছেন, নূরির পিঠে একটা স্বর্ণরেখা, রোমের নাকি আলোর, তিনি হাঁটু গেড়ে বসা, ফলে তার স্তন ঝুলন্ত, তার পেটটাও ঝুলে আছে, একটু কদাকারই লাগছে দেখতে, হাঁটু গেড়ে বসায় তার নিতম্ব বেশ ভারি, ফলে ডুলির মতো লাগছে, সৌন্দর্যবোধের চেয়েও রানির মনে সেটা বিবমিষার বোধ জন্ম দিচ্ছে, কারণ কি ঈর্ষা! নাকি তার কবিজনোচিত সৌন্দর্যবোধ ও রুচি! নূরির মাথাটা দেয়ালঘড়িটার পেন্ডুলামের মতো এদিক-ওদিক দুলছে।

আগাজি বললেন, রইন, অসময়ে! এসো। জয়েন করো।

রানি বললেন, আগাজি, ইরানের শাহের বিদায়ের অনুষ্ঠান অলরেডি এক ঘণ্টা লেট হয়ে গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ুন। নূরিজি, আপনি মাথাটা সরান। ওকে ছাড়ুন।

আগাজি বললেন, আরেকটু দিলেই কিন্তু হয়ে যাবে।

রানি বললেন, আরেকটুর সময় নেই আগাজি। আপনি অলরেডি লেট।

নুরি ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

জেনারেলের শিশ্নচূড়া  বিদ্যুৎবাতির আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে।

কার্পেটে তার দীর্ঘ ছায়া পড়েছে।

নূরি তার অন্তর্বাস খুঁজছেন। সালোয়ারের সত্মূপ থেকে সেটা এই সময়ে খুঁজে না পাওয়াই স্বাভাবিক।

ইয়াহিয়া বললেন, আমার গাউনটা কই?

রানি বললেন, আগাজি, এখন আর গাউন পরতে হবে না। একবারে বাইরে যাওয়ার কাপড় পরে নিন। কোনটা পরার কথা। আমি পরিয়ে দিচ্ছি।

ওই ওয়াড্রোবে কাপড় রেডি করা আছে। টাই পর্যন্ত।

রানী নিয়ে এলেন। আন্ডারওয়ার। আগাজির সামনে বসে বললেন, পা ঢোকান।

আগাজি বললেন, একবার একটু চুষে দাও।

রানি কঠোর গলায় বললেন, পা ঢোকান।

আগাজি বললেন, একটু অন্তত চুমু দিয়ে দাও।

রানি বললেন, মাতলামো করবেন না, অনুগ্রহ করুন। দুই দেশের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।

ইয়াহিয়া আন্ডারওয়ারে পা ঢোকালেন।

এবার মাথাটা ধরুন। প্যান্টে পা ঢোকান।

ইয়াহিয়ার পা কাঁপছে। তিনি পুরো ওজন রানির মাথার ওপরে চাপিয়ে দিলে রানি বললেন, উফ পড়ে যাব তো। ওই চেয়ারটা ধরুন এক হাতে। হ্যাঁ এবার পা ঢোকান।

কোথায় পা ঢোকাব, ডার্লিং।

এই নরকে। এখানে ঢোকান।

রানি তার প্যান্টের জিপার লাগালেন।

জেনারেল রানি তাকে শার্ট পরালেন। শার্ট প্যান্টের ভেতর ঢুকিয়ে তার বোতাম লাগালেন। তার বেল্ট ঢোকালেন। ততক্ষণে নূর জাহান তার কাপড়চোপড় পরে নিয়েছেন।

রানি ইয়াহিয়ার কোট পরালেন। তার টাইয়ের নট বেঁধে দিলেন। তার মনে পড়ে গেল তার ফেলে আসা স্বামীর কথা। একদিন তিনি এইভাবে তার স্বামীর টাইয়ের নটও বেঁধে দিতেন। তারও দুই বাহু পাখির ডানার মতো উড়িয়ে দিয়ে তাকে পরিয়ে দিতেন কোট।

আগাজি তাকে চুম্বন করলেন কপালে।

এতক্ষণে ঘরে রাষ্ট্রপতির(ত) আরদালি খানসামা প্রবেশ করতে পেরেছে। তারা তাকে জুতা পরাল।

রানি বললেন, আপনি একটু বাথরুমে যান। পেশাব সেরে নিন। না হলে আবার তেহরানে যা করেছিলেন, তা করতে পারেন।

তেহরানে কী করেছিলাম?

গাড়ির পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে সবার সামনে পেশাব করেছিলেন। আর তা করেছিলেন রাষ্ট্রীয় সফরের সময়।

আরে আমি তো তখন মদে চুর হয়ে ছিলাম। পেট মদে ছিল ঠাসা। কিডনি ফেটে যাচ্ছিল। আমার নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আর তখন আমার হুঁশও ছিল না। বেহুঁশ লোক কী করে তা নিয়ে পরে কথা বলা উচিত নয়।

আপনি এখনো বেহুঁশ। চলুন আপনাকে আমি বাথরুম করিয়ে আনি।