ভারতবর্ষের সংগীতজগতে বাঙালির অবদান

সারোয়ার জামীল

ভারতবর্ষে সংগীত ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাঙালির অবদান সুবিদিত। দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা এসব বিষয়ে বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) সব সময়েই অগ্রগামী ছিল। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো সর্বপ্রথম এই অঞ্চল দিয়ে ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশের ফলে পাশ্চাত্যের শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রভাবে এই অগ্রগতি আরো ত্বরান্বিত হয়। এ-কারণেই বোধহয় ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদ গোখলে বলেছিলেন, ‘বাংলা আজ যেটা ভাবে, সমস্ত ভারতবর্ষ সেটা ভাবে তার পরদিন।’ এই বক্তব্যে আরো স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, আধুনিক ভারতীয় সংগীত, বিশেষভাবে উচ্চাঙ্গসংগীত এবং সর্বভারতীয় চলচ্চিত্র-সংগীতের জগতে বাঙালিদের অবদান নিরীক্ষণ করলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বাংলার সংগীতশিল্পীদের এই জয়যাত্রা অব্যাহত আছে। এই নিবন্ধে আমার আলোচনা বাংলার যেসব সংগীতশিল্পী সর্বভারতীয় উচ্চাঙ্গ ও চলচ্চিত্র-সংগীতে অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

ভারতবর্ষের সংগীতজগতে বাঙালি সংগীতশিল্পীদের অনুপ্রবেশ শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। এই সময় থেকে বাংলার ধনাঢ্য পরিবার, বিশেষ করে বর্ধমান ও বিষ্ণুপুরের রাজা এবং নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় বিশিষ্ট এবং প্রথিতযশা সংগীতশিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁদের রাজসভা ভারতীয় রাগপ্রধান সংগীতের প্রাণকেন্দ্র এবং বাংলার সংগীতস্রষ্টাদের জন্য ভারতীয় রাগপ্রধান সংগীতসৃষ্টির পাদপীঠ হয়ে ওঠে। এসব সংগীতস্রষ্টার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার সার্থক ফল হলো টপ্পা ধরনের সংগীত, যা বাংলা সংগীতশিল্পের বিভিন্ন ধারার পথ উন্মোচন করেছে। তাঁদের মধ্যে অগ্রগামী ছিলেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী রামনিধি গুপ্ত এবং তাঁর সমসাময়িক কালী মির্জা, যাঁর প্রকৃত নাম ছিল কালিদাস চট্টোপাধ্যায়। তাঁরা দুজনই অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে হুগলীতে জন্মগ্রহণ করেন। রামনিধি পরে সংগীতচর্চা করতে চলে যান বিহারের ছাপড়ায় এবং কালী মির্জা তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান বেনারস, লখনৌ এবং দিলিস্নর সংগীতাঙ্গনে।

প্রথম যে-বাঙালি সত্যিকার অর্থে ভারতবর্ষ জুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি হলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তিনি বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে-সম্বন্ধে কোনো সঠিক তথ্য জানা নেই। তবে অনুমান করা হচ্ছে, ১৮৬০-৬২ সালের মধ্যে তাঁর জন্ম হয়। বহু বছর বাংলাদেশের ঢাকা, মুক্তাগাছা ও কলকাতায় কাটিয়ে অবশেষে তিনি পৌঁছেন ভারতের উত্তর প্রদেশের রামপুরে তাঁর গুরু ওস্তাদ আহমদ আলীর দ্বারে। এখানে তিনি রামপুরের নওয়াবের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন এবং বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এরপর আলাউদ্দিন খাঁ আশ্রয় নেন বিখ্যাত মাইহার ঘরানায় এবং সেখানেই তিনি তাঁর বাকি জীবন কাটান। আলাউদ্দিন খাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তিনি ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতকে গতানুগতিক রক্ষণশীলতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন। ১৯৩৫-৩৬ সাল থেকে তিনি ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতকে নানাভাবে উদ্ভাবিত করে একে অনেক গতিশীল করেন এবং বিশ্বের দরবারে আকর্ষণীয় করে তোলেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৭২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতের যে-মশাল জ্বালিয়েছিলেন, সেটাকে বহন করার দায়িত্ব নেন আরেক বরেণ্য শিল্পী প–ত রবিশঙ্কর। যদিও বাংলায় তাঁর জন্ম নয়, তবে তাঁর পিতা-মাতা দুজনই বাঙালি বংশোদ্ভূত। ১৯২০ সালে তাঁর জন্মকালীন তাঁরা বেনারসে বসবাস করছিলেন। ১৯৩৫ সালে  তাঁর বড় ভাই উদয় শঙ্করের সঙ্গে বিশ্বপরিক্রমার সময় রবিশঙ্কর ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সংস্পর্শে আসেন। এই সময় আলাউদ্দিন খাঁ রবিশঙ্করকে তাঁর শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হন এক শর্তে যে, রবিশঙ্কর তাঁর ভ্রমণ ছেড়ে মাইহারে চলে আসবেন। ১৯৪৪ সালে রবিশঙ্কর তাঁর প্রশিক্ষণ শেষ করেন। এরপর পরবর্তী সত্তর বছর ধরে রবিশঙ্কর চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত তৈরি থেকে সংগীতজগতে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেন। ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন এবং প্রতিষ্ঠা করার একক কৃতিত্ব রবিশঙ্করের। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথম যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। রবিশঙ্কর বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পী ইহুদি মেনুহিন, আন্দ্রে প্রেভিন, জর্জ হ্যারিসনসহ আরো অনেক খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞের সঙ্গে সংগীত পরিবেশন করেন। জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহে তিনি ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগীতানুষ্ঠান করেন।

রবিশঙ্কর ক্যামাটিক সংগীতের অনুকরণে দ্রম্নত তাল চালু করে ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের জগতে বৈপস্নবিক পরিবর্তন আনেন। ভারতীয় সংগীতের মৌলিক পরিবর্তন না করেও তিনি একে পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় করে তোলেন।

রবিশঙ্করের সমসাময়িককালে ভারতীয় সংগীতের আকাশে আর এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের আবির্ভাব হয়, যাঁর নাম ওস্তাদ আলী আকবর খান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি রবিশঙ্করের শ্যালক এবং ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পুত্র। ১৯২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুরে তাঁর জন্মের কিছুকাল পরেই আলী আকবর খানের পরিবার মধ্যপ্রদেশের মাইহারে স্থানান্তরিত হয়। তাঁর পিতা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তত্ত্বাবধানে শুরু হয় তাঁর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের কঠিন প্রশিক্ষণ। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন অত্যন্ত কঠোর এবং নিয়মানুবর্তী শিক্ষক।

আলী আকবর খান নিজেকে শুধু উচ্চাঙ্গসংগীতের জগতে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি অনেক ভারতীয় চলচ্চিত্রের সংগীত-পরিচালনাও করেছেন। বলিউডের অনেক নামকরা ছবি যেমন আঁধিয়া, সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেবী, মার্চেন্ট আইভরির দি হাউসহোল্ডার এবং তপন সিংহের ক্ষুধিত পাষাণ ছবির সংগীত-পরিচালক ছিলেন আলী আকবর খান। ক্ষুধিত পাষাণ ছবির সংগীত-পরিচালনার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ সংগীত-পরিচালকের উপাধি পেয়েছিলেন।

মাইহার ঘরানার আরেকজন প্রথিতযশা বাঙালি সংগীতশিল্পী হলেন নিখিল ব্যানার্জি। তাঁর জন্ম কলকাতায় ১৯৩১ সালে। কিন্তু প্রথম জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন তিনি বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। সেখানে গৌরীপুরের জমিদার বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর কাছে তিনি সংগীত শিখতেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং সরোদ শেখার জন্য তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মাইহারে প্রশিক্ষণের পর বিভিন্ন সংগীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য নিখিল ব্যানার্জি পৃথিবীর বহু দেশে ঘুরে বেড়ান। নিখিল ব্যানার্জি অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রশিল্পীর সঙ্গে প্রায়ই ইউরোপ-আমেরিকার বহু জায়গায় সংগীত পরিবেশন করেছেন। তাঁর সংগীতের মধ্যে বাংলার আরো দুজন সংগীতশিল্পী ছিলেন – তাঁরা হলেন বিখ্যাত তবলচি স্বপন চৌধুরী এবং অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। দুর্ভাগ্যবশত মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালে নিখিল ব্যানার্জি মৃত্যুবরণ করেন।

শুধু উচ্চাঙ্গসংগীত নয়, সংগীতের অন্য ধারাগুলোতেও বাঙালিরা জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠেন। এসব শিল্পীর অগ্রপথিক ছিলেন শচীন দেব বর্মন। কয়েক দশক ধরে সংগীতজগতে তিনি একাধিপত্য বিস্তার করেন। গায়ক এবং সংগীত-পরিচালক হিসেবে তাঁর তুলনা নজিরবিহীন। ১৯০৬ সালে বাংলাদেশের কুমিলস্নায় ত্রিপুরার রাজপরিবারে তাঁর জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করলেও লেখাপড়ার প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। এসব ছেড়ে তিনি বিখ্যাত সঙ্গীতগুরু কে সি দে-র কাছে সংগীতশিক্ষা শুরু করেন। শুরুতে তাঁর সংগীত বাংলার লোকসংগীত দ্বারা প্রভাবিত ছিল। অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে তিনি বাংলার ভাটিয়ালি, সারি, ধামাইল ইত্যাদি লোকসংগীতের সঙ্গে আধুনিক এবং চলচ্চিত্রের গানের সংমিশ্রণ ঘটান। রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুলগীতিও তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।

১৯৪৪ সালে শচীন দেব মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ করেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় নববইয়েরও অধিকসংখ্যক চলচ্চিত্রে সুরারোপ করেন। শচীন দেবের সংগীতসৃষ্টি ছিল অনন্য। যেভাবে তিনি পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র যেমন গিটার, পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান, বিশেষ করে মাউথ অর্গানের সঙ্গে ঢোল, সারেঙ্গি, তবলা এসব দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন তেমনটি আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৯৭৫ সালে শচীন দেব বর্মন ইহলোক ছেড়ে চলে যান।

শচীন দেবের সমসাময়িক আরো একজন যশস্বী সংগীতবিদ ছিলেন অনিল বিশ্বাস। বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় তাঁর জন্ম এবং সেখানেই তাঁর শিক্ষা এবং সংগীত-প্রশিক্ষণ শুরু। যদিও তিনি ব্যাপক প্রচার পাননি, তবে এটা সত্যি যে, এই প্রতিভাশালী

সংগীত-পরিচালক ছিলেন চলচ্চিত্রসংগীতের ক্ষেত্রে অর্কেস্ট্রা এবং কোরাসের প্রবর্তক। অনিল বিশ্বাস পাশ্চাত্যের সংগীতের ধাঁচে বিপরীতধর্মী মেলোডির প্রচলন করেন। ২০০৩ সালে অনিল বিশ্বাসের মৃত্যু হয়।

বাংলার আকাশের আর এক তারকা ভারতবর্ষের সংগীতজগৎকে উদ্ভাসিত করেছিলেন তিনি হলেন হেমন্ত মুখার্জি, হিন্দি চলচ্চিত্রজগতে যিনি হেমন্ত কুমার নামে পরিচিত। ১৯২০ সালে উত্তর প্রদেশের বেনারসে জন্মগ্রহণ করলেও হেমন্ত মুখার্জির মা-বাবা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী এবং তিনি তাঁর শৈশব ও শিক্ষাজীবন কাটান কলকাতায়। গায়ক এবং সংগীত-পরিচালক হিসেবে বাংলায় তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করার পর ১৯৫১ সালে হেমন্ত মুখার্জি মুম্বাই পাড়ি জমান। মুম্বাইয়ে তিনি সংগীত-পরিচালকের চেয়েও গায়ক হিসেবে বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বাংলার দুই প্রতিভাবান সংগীত-পরিচালক শচীন দেব বর্মন এবং সলীল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত কুমার বিভিন্ন চলচ্চিত্রে প্রচুর জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দেন। এর মধ্যে জাল, বাত এক রাত কি, সোলভা সালের গান পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সমগ্র ভারতবর্ষের লোকের কণ্ঠে অনুরণিত হতো। এর পর ১৯৫৪ সালে বিখ্যাত নাগিন চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত-পরিচালনা করে হেমন্ত কুমার দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এর জন্য ১৯৫৫ সালে তাঁকে শ্রেষ্ঠ সংগীত-পরিচালক হিসেবে অত্যন্ত সম্মানজনক ফিল্মফেয়ার পুরস্কার দেওয়া হয়। হেমন্ত মুখার্জির মৃত্যু হয় ১৯৮৯ সালে।

হেমন্ত মুখার্জির পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরো একজন বহুমুখী প্রতিভাধারী সংগীতশিল্পী আবির্ভূত হন ভারতীয় সংগীতাঙ্গনে। তিনি হলেন সলীল চৌধুরী। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সবাই তাঁকে সলীলদা বলে ডাকতেন। পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রাম সোনারপুরে তাঁর জন্ম হলেও শৈশবকালের সবচেয়ে ভালো সময় তিনি কাটিয়েছেন আসামে, যেখানে তাঁর পিতা এক চা-বাগানের ডাক্তার ছিলেন। তাঁর পিতার পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গসংগীতের এক বিশাল সংগ্রহ ছিল, যেটা কিশোর বয়সেই সলীল চৌধুরী অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে শুনতেন। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হলো সলীল চৌধুরীর সংগীত ইউরোপিয়ান ক্লাসিক্যাল সংগীত দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল এবং তাঁর গানে খুব সৃজনশীলতার সঙ্গে তিনি এর প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর কিছু বিখ্যাত চলচ্চিত্রের গান ছিল পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যাল সংগীতের সরাসরি অভিযোজন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ছায়া নামক চলচ্চিত্রের ‘ইতনা না মুঝ সে তু প্যায়ার বাড়া’ গান, যেটা মোৎজার্টের ৪০ সিম্ফনির হুবহু নকল এবং অন্নদাতা ছবির ‘রাতো কে ছায়া ঘনে’ তৈরি করা হয়েছিল চোপিনের সংগীতের ওপর ভিত্তি করে।

মূলধারার হিন্দি ছায়াছবির সংগীতসৃষ্টিতে সলীল চৌধুরীর প্রথম সাফল্য মধুমতি চলচ্চিত্রের স্পন্দন-জাগানো গানগুলো। তবে বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লতা মুঙ্গেশকরের মতে ‘না যেও না, রজনী এখনো বাকি’ সলীল চৌধুরীর দেওয়া সবচেয়ে মধুর সুর। সুরকার হিসেবে সলীল চৌধুরীর আরো একটি বিশেষত্ব হলো, সংগীতের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলোর অভিনব এবং নিপুণ সংমিশ্রণ। ১৯৯৫ সালে কলকাতায় সলীল চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলার আরেক দীপ্যমান সংগীতসাধক, যিনি বলিউড চিত্রজগতে পেস্নব্যাক গায়ক হিসেবে প্রচুর সম্মান অর্জন করেছেন, তিনি মান্না দে। ১৯১৯ সালে কলকাতায় তাঁর জন্ম হয়। তার পারিবারিক নাম ছিল প্রবোধ কুমার দে; কিন্তু সবার কাছে তিনি মান্না দে নামেই

পরিচিত। সংগীতের ক্ষেত্রে তাঁর হাতেখড়ি হয় তাঁর পিতৃব্য বিখ্যাত সংগীতশিল্পী কে সি দে-র কাছে। ১৯৪২ সালে কে সি দে-র সঙ্গে মান্না দে মুম্বাই আসেন। সেখানে তিনি সংগীতের আর এক দিকপাল শচীন দেব বর্মনের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। মান্না দে বিভিন্ন ভাষায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেন। অবশ্য তাঁর সাড়াজাগানো গানগুলো ছিল মহম্মদ রফি, লতা মুঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলের সঙ্গে গাওয়া দ্বৈত সংগীতগুলো। তবে বলিউড সংগীতজগতে মান্না দে বিশেষ আসন দখল করে আছেন তাঁর গাওয়া কাওয়ালির জন্য। বরসাত কি রাত ছবির ‘না কারওয়া কী তালাশ হ্যায়, না হামসফর কী তালাস হ্যায়’, ওয়াক্ত ছবির ‘আ মেরি যোহরা জাবিন’ এবং দিল হি তো হ্যায় ছবির ‘লাগা চুনড়ি মে দাগ’ জাতীয় কাওয়ালিগুলোর জন্য মান্না দে অমর হয়ে থাকবেন।

ভারতীয় সংগীতজগতের অনুকরণীয় আরেকজন শিল্পী হলেন কিশোর কুমার। ১৯২৯ সালে পূর্ব বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার (বর্তমান বাংলাদেশ) বিখ্যাত গাঙ্গুলী পরিবারে তাঁর জন্ম। তবে জন্মকালে তাঁদের পরিবার ভারতের মধ্যপ্রদেশে বসবাস করত। বিখ্যাত চিত্রাভিনেতা অশোক কুমার ছিলেন কিশোর কুমারের বড়ভাই। গায়কিতে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী স্টাইলের সূচনা করেন। ছোটকাল থেকেই তিনি সেকালের সংগীতসম্রাট কে এল সায়গলকে অনুসরণ করে গাইতেন। কিন্তু শচীন দেব বর্মন তাঁকে তাঁর নিজস্ব স্টাইল উদ্ভাবনে উৎসাহ দেন এবং সেটাই তাঁকে কণ্ঠসংগীতের ক্ষেত্রে অনন্য অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে। কিশোর কুমারই প্রথম ভারতীয় কণ্ঠসংগীতে ইয়ডলিং (গানের মাঝখানে কাউকে ডাকার মতো গীতিময় ধ্বনি) প্রথা চালু করেন; কিন্তু কিশোর কুমারের এই প্রতিভাকে সুন্দর ছাঁচে ঢেলে তাকে কণ্ঠশিল্পীদের পুরোভাগে আনেন শচীন দেব বর্মন। তাঁর দেওয়া সুরে মুনিমজি, ট্যাক্সি ড্রাইভার, ন দো গেয়ারো, গাইড, প্রেমি পূজারি এসব ছবির প্রাণমাতানো গানগুলো দিয়েই কিশোর কুমার সবার মন জয় করেছেন। আরাধনা ছবির গান দিয়ে কিশোর কুমার খ্যাতির শীর্ষে উঠেছেন। এই ক্ষণজন্মা গায়ক মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ১৯৮৭ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

কিশোর কুমারের মৃত্যুর পর তাঁর সাফল্যের মশাল কাঁধে তুলে নেন অন্য এক বাঙালি, যিনি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কিশোর কুমারের গানের স্টাইলকে অনুকরণ করেন। এই শিল্পী হলেন কুমার শানু। ১৯৫৭ সালে কলকাতায় কুমার শানুর জন্ম হয়। তাঁর মাতা-পিতা তাঁর নাম রাখেন কেদারনাথ ভট্টাচার্য। ১৯৮৭ সালে মুম্বাই যাওয়ার পর বিখ্যাত সংগীত-পরিচালক যুগল কল্যাণজি-আনন্দজি জাদুগর ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ দেন এবং তাঁর আসল নাম পরিবর্তন করে কুমার শানু নাম গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। শিগগিরই বলিউডে গায়ক হিসেবে কুমার শানুর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় এবং অনেক ছবির গানে তিনি কণ্ঠ দেন। গানের জন্য কুমার শানু পাঁচবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান, যা সংগীতজগতে একটা রেকর্ড।

কিশোর কুমারের আরেকজন সমসাময়িক শিল্পী ছিলেন শচীন দেব বর্মনের পুত্র রাহুল দেব বর্মন। রাহুল দেব বর্মনের জন্ম ১৯৩৯ সালে কলকাতায়। যদিও রাহুল দেব বর্মন খুব অল্পসংখ্যক গান গেয়েছেন; কিন্তু বলিউড চলচ্চিত্রজগতে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন সম্পূর্ণ অগতানুগতিক ভিন্নধর্মী সংগীত রচনা করার জন্য। বিভিন্ন ধরনের সংগীত থেকে মশলা নিয়ে রাহুল দেব একটা মিশ্রসংগীত তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন। পাশ্চাত্যের রক, ডিসকো, পপ মিউজিকের সঙ্গে বাংলার লোকগীতির সুরের সমন্বয়ে তিনি অভূতপূর্ব সংগীতসৃষ্টি করেছেন। কিশোর

কুমার এবং আশা ভোঁসলের সঙ্গে একত্রে কাজ করে ষাট এবং সত্তরের দশকে রাহুল দেব বর্মন জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিলেন। পরবর্তীকালে আশা ভোঁসলে তাঁর জীবনসঙ্গিনী হয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে রাহুল দেবের জীবনাবসান হয়।

সত্তর এবং আশির দশকে বাংলার সংগীত-প্রাঙ্গণে রাহুল দেব বর্মনের প্রতিভূর মতো অবতীর্ণ হন বাপ্পি লাহিড়ী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে বাপ্পি লাহিড়ী ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তাঁর নাম দেওয়া হয় আলোকেশ লাহিড়ী। তার পিতা অপরেশ লাহিড়ী এবং মাতা বাঁশরী লাহিড়ী দুজনই ছিলেন নামকরা সংগীতশিল্পী, বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ এবং শ্যামা সংগীতজগতে। অশোক কুমার, কিশোর কুমার এঁরা ছিলেন তাঁর মামা। সংগীতের ক্ষেত্রে তাঁর হাতেখড়ি হয় তাঁর মা-বাবার কাছে। মাত্র তিন বছর বয়স থেকে বাপ্পি লাহিড়ী তবলা বাজানো শুরু করেন।

ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বাদ্যযন্ত্রের সুরসৃষ্টি করে সংগীত রচনাকে ভারতীয় চলচ্চিত্রসংগীতে তিনিই জনপ্রিয় করেন। দ্রম্নততালের ডিসকো নাচের জন্য সংগীতসৃষ্টিতে বাপ্পি লাহিড়ীর জুড়ি নেই। বলিউড চিত্রজগতে এর জন্য তাঁকে ‘ডিসকো রাজা’ উপাধি দেওয়া হয়। সংগীত-পরিচালক হিসেবে তিনি প্রথম স্বীকৃতি পান চলতে চলতে ছবির গানের জন্য। এর পরে তিনি পাঁচশোর বেশি ছবির জন্য পাঁচ হাজারের ওপর গানে সুর দেন। ১৯৮৬ সালে ৩৩টি ছবিতে ১৮০টি গানের সুর রচনা করার জন্য গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

যেসব বাঙালি নারী-সংগীতশিল্পী ভারতবর্ষ জুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তাঁদের অগ্রদূত ছিলেন গীতা দত্ত। ১৯৩০ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরের এক জমিদার-পরিবারে গীতা দত্তের জন্ম হয়। জন্মকালে তাঁর নাম ছিল গীতা ঘোষ রায়। বিখ্যাত অভিনেতা ও চিত্রপরিচালক গুরু দত্তের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি গীতা দত্ত হিসেবে পরিচিত হন। ১৯৪২ সালে পরিবারের সঙ্গে মুম্বাইয়ে স্থানান্তরিত হওয়ার পর গীতা দত্ত কিছু নামকরা সংগীত-পরিচালকের সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন শচীন দেব বর্মন। শচীন দেবের দেওয়া সুরে গীতা দত্ত বেশকিছু মধুর গান রেকর্ড করেন। এর মধ্যে দো ভাই ছবির ‘মেরে সুন্দর সপনা বিত গ্যায়া’, বাজি চলচ্চিত্রের ‘তকদির সে বিগরি হুই তকদির’, কাগজ কে ফুলের ‘ওয়াক্ত নে কিয়া ক্যায়া হাসি সীতম’ জাতীয় গান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আর একজন প্রতিভাশালী শিল্পী সুমন কল্যাণপুরের বাঙালি-পরিচিতি কখনো বহুল প্রচার পায়নি, যদিও ১৯৩৭ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় তাঁর জন্ম। সুমন কল্যাণপুর তাঁর সমকালীন সব সংগীত-পরিচালকের দেওয়া সুরে গান গেয়েছেন এবং সাতশো চলিস্নশটি ছবিতে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। ষাটের দশকে সুমন কল্যাণপুরকে তাঁর সুললিত কণ্ঠের জন্য লতা মুঙ্গেশকরের সমকক্ষ মনে করা হতো।

গজল যদিও বাঙালিদের সংগীত নয়; কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ভারতীয় সংগীতজগতের সবচেয়ে নামকরা নারী গজলশিল্পী একজন বাঙালি। তিনি হলেন চিত্রা সিং, বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় যাঁর জন্ম। চিত্রা সিংহের কোনো আনুষ্ঠানিক সংগীত-প্রশিক্ষণ ছিল না, তবে তাঁদের পরিবারে সংগীতচর্চার একটা ঐতিহ্য ছিল। মুম্বাইয়ে চিত্রার সঙ্গে পরিচয় হয় গজলের রাজা জগজিৎ সিংয়ের। প্রথমে তাঁরা বিজ্ঞাপনের জন্য তৈরি ছবিতে কণ্ঠ দিতেন। পরে জগজিৎ সিংয়ের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি গজল গাইতে শুরু করেন। তাঁর শ্রম্নতিমধুর কণ্ঠ গজলের ভুবনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে এবং তাঁর কণ্ঠ ছিল অদ্বিতীয়।

সাম্প্রতিককালে ভারতীয় সংগীতজগতে বাংলার অবদান হলো শ্রেয়া ঘোষাল। ১৯৮৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে এই নবীন শিল্পীর জন্ম হয়। ভারতের একটি জনপ্রিয় সংগীতের প্রোগ্রাম ‘সা রে গা মা পা’ দেখতে গিয়ে বিখ্যাত চিত্র-পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানশালি শ্রেয়া ঘোষালকে আবিষ্কার করেন এবং ২০০০ সালে তাঁর দেবদাস ছবিতে পারুর গানগুলোতে কণ্ঠ দেওয়ার সুযোগ দেন। শ্রেয়া এই ছবিতে পাঁচটি গানে কণ্ঠ দেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে সংগীতজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেন। শ্রেষ্ঠ পেস্নব্যাক

গায়িকা হিসেবে তাঁকে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার দেওয়া হয়, নতুন

সংগীত-প্রতিভার জন্য আর ডি বর্মন পুরস্কার এবং ‘বৈরী পিয়া’ গানটির জন্য তাঁকে জাতীয় ফিল্ম পুরস্কার দেওয়া হয়। শুধু নিজ দেশে নয়, বিদেশেও শ্রেয়া ঘোষাল ভীষণ সম্মানিত হন। আমেরিকার ওহাইও স্টেটের গভর্নর টেড স্ট্রিকল্যান্ড ২৬ জুনকে ‘শ্রেয়া ঘোষাল দিবস’

ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আরো অনেক সংগীতশিল্পী বিশ্বের সংগীতাঙ্গনে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করছেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা তাঁদের অগ্রজদের মতো বিশ্বের দরবারে বাংলার সম্মান আরো বাড়িয়ে দেবেন।