বাংলাদেশের ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ

মাহবুবুল হক

অশ্রম্ন ও শোণিত ভেজা এবং অঙ্গীকার ও সংগ্রামের অগ্নিগর্ভ দ্যোতনায় ভাস্বর মুক্তিযুদ্ধের আশ্চর্য অনুভূতি, অভাবিত প্রেরণা এবং অকুতোভয় আত্মত্যাগের নানা ঘটনা, অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির বহুমাত্রিক রূপায়ণ ঘটেছে বাংলাদেশের ছোটগল্পে।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর থেকে অতিক্রান্ত চার দশকেরও বেশি সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে অগণিত গল্প, প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি গল্পসংকলন এবং বেশ কয়েকটি গল্পগ্রন্থ। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম গল্পসংকলন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী-সম্পাদিত বাংলাদেশ কথা কয়। এটি প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, ১৯৭১-এর নভেম্বরে, কলকাতা থেকে। পরবর্তীকালে এর বাংলাদেশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। একাত্তরের মার্চ থেকে নভেম্বর – এই কালপর্বের মুক্তিযুদ্ধের নিকট-বাস্তবতার নানা খ-চিত্র ফুটে উঠেছে এ-গল্পসংকলনে। এতে সংকলিত হয় ষোলোটি গল্প। এগুলো হলো – বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘সাদা কফিন’, নির্মলেন্দু গুণের ‘শেষ যাত্রা নয়’, আবদুল হাফিজের ‘লাল পল্টন’, সুব্রত বড়ুয়ার ‘বুলি তোমাকে লিখছি’, ফজলুল হকের ‘চরিত্র’, আসফ-উজ-জামানের ‘রক্ত প্রজন্ম’, বুলবন ওসমানের ‘সোলেমান ভাই’, কামাল মাহবুবের ‘নীল নকশা’, অনু ইসলামের ‘শব্দতাড়িত’, আসাদ চৌধুরীর ‘কমলা রঙের রোদ’, সত্যেন সেনের ‘পরীবানুর কাহিনী’, ইলিয়াস আহমদের ‘অন্যের ডায়েরি থেকে’, জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’, কায়েস আহমদের ‘শেষ বাজি’, শওকত ওসমানের ‘আলোক অন্বেষা’ ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘রোদের অন্ধকারে বৃষ্টি’। এসব গল্পে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা ও প্রতিক্রিয়ার অভিব্যক্তি হিসেবে। পাশাপাশি তাতে ফুটে উঠেছে জনমানসের প্রতিরোধ-চেতনা।

এর এক দশকেরও বেশি সময় পরে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের গল্পকারদের লেখা মুক্তিযুদ্ধের গল্পের আরো দুটি সংকলন। সেগুলো হলো – আবুল হাসনাত-সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৮৩) ও হারুণ হাবীব-সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ : নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫)। মুক্তিযুদ্ধের গল্প গ্রন্থে সংকলিত গল্পগুলো হলো – শওকত ওসমানের ‘দুই ব্রিগেডিয়ার’, সত্যেন সেনের ‘পরীবানুর কাহিনী’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘কালিমদ্দি দফাদার’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘রূপান্তর’, জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘কেয়া, আমি এবং জার্মান মেজর’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘কথোপকথন : তরুণ দম্পতির’, শওকত আলীর ‘কোথায় আমার ভালোবাসা’, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘ঘরে ফেরা’, সুচরিত চৌধুরীর ‘নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত’, রাবেয়া খাতুনের ‘যে ভুলে যায়’, হাসান আজিজুল হকের ‘ঘর গেরস্থি’, রাহাত খানের ‘মধ্যিখানে চর’, মাহমুদুল হকের ‘কালো মাফলার’, জাহানারা ইমামের ‘উপলব্ধি’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অপঘাত’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, রশীদ হায়দারের ‘এ কোন ঠিকানা’, সেলিনা হোসেনের ‘ভিটেমাটি’, কয়েস আহমদের ‘আসন্ন’, রবিউল হুসাইনের ‘মাটির মেডেল’, বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘সাদা কফিন’, তাপস মজুমদারের ‘মাটি’, সিরাজুল ইসলামের ‘যাত্রার নায়ক’, আহমদ বশীরের ‘অন্য পটভূমি’, রিজিয়া রহমানের ‘ইজ্জত’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘প্রস্ত্ততি পর্ব’, মইনুল আহসান সাবেরের ‘কবেজ লেঠেল’।

মুক্তিযুদ্ধ : নির্বাচিত গল্প গ্রন্থে সংকলিত গল্পগুলো হলো – জহির রায়হানের ‘কয়েকটি সংলাপ’, রাবেয়া খাতুনের ‘প্রথম বধ্যভূমি’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘কাঁথা সেলাই হইছে নিশ্চিন্ত’, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘ফেব্রম্নয়ারি ১৯৬৯’, আবদুল হাফিজের ‘লাল পল্টন’, রশীদ হায়দারের ‘প্রথম দিনে’, আলমগীর সাত্তারের ‘আক্কেল আলী মিয়ার আগরতলা যাত্রা’, মাহবুব তালুকদারের ‘শরণার্থী’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘রোদের অন্ধকারে বৃষ্টি’, শওকত আলীর ‘পুনর্বার বেয়নেট’, মিন্নাত আলীর ‘রক্ত ঝরার দিনে’, মাহমুদুল হকের ‘বেওয়ারিশ লাশ’, বশীর আল হেলালের ‘শবের নিচে সোনা’, শওকত ওসমানের
‘জননী : জন্মভূমি’, হারুণ হাবিবের ‘গেরিলা’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘খতম’, শাহরিয়ার কবিরের ‘একাত্তরের যীশু’, হাসান আজিজুল হকের ‘ফেরা’, মইনুল আহসান সাবেরের ‘চার যুবক’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘আমাকে একটি ফুল দাও’, বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘দুনি চাঁদের পুনরুত্থান’, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘যে ঋণে দেউলিয়া’, হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিনী’, সৈয়দ ইকবালের ‘একদিন বঙ্গবন্ধু’, সেলিনা হোসেনের ‘যুদ্ধ জয়’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘পরবর্তী কাল’, রাহাত খানের ‘এই বাংলায়’ ও সৈয়দ শামসুল হকের ‘ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না বলে’।

বিগত কয়েক দশকে কয়েকজন গল্পকারের কয়েকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বশীর আল হেলালের প্রথম কৃষ্ণচূড়া (১৯৭২) গল্পগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আটটি গল্প। গল্পগুলো হলো – ‘দুই কুত্তার গল্প’, ‘সাপ’, ‘বাংলার প্রাণ’, ‘নারকীয় নাটক’, ‘জলবন্দী’, ‘রণকৌশল’, ‘কলি’ ও ‘অভিধানগুলোকে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দাও’। আলাউদ্দিন আল আজাদের আমার রক্ত স্বপ্ন আমার (১৯৭৫) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সাতটি গল্প। এগুলো হলো – ‘বিস্ফোরণ’, ‘যুদ্ধ নয়’, ‘অচেনা’ (পরিবর্তিত নাম ‘আগন্তুক’), ‘রূপান্তর’,  ‘নীরবতা’, ‘আমার রক্ত’ ও ‘রক্ত আমার’।  হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫) গ্রন্থের সব গল্পই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। এগুলো হলো – ‘ভূষণের একদিন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’, ‘আটক’, ‘ঘর গেরস্থি’, ‘কেউ আসেনি’ ও ‘ফেরা’। আবু জাফর শামসুদ্দীনের রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা (১৯৭৭) গল্পগ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের গল্প আছে চারটি। এগুলো হলো – ‘চাঁদমারি’, ‘মাটি’, ‘প্রতিশোধ’, ও ‘চার দেয়াল’। তাঁর ল্যাংড়ী (১৯৮৪) গল্পসংকলনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয় হয়েছে ‘কলিমদ্দি দফাদার’, ‘ল্যাংড়ী’, ‘উস্টানি’, ‘গোশত’ ইত্যাদি গল্পে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্প সংকলিত হয়েছে এমন অন্যান্য গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : শওকত আলীর লেলিহান সাধ (১৯৭৭), সাদেকা সফিউল্লার যুদ্ধ অবশেষে (১৯৮০), শওকত ওসমানের জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৮৪), বিপ্রদাশ বড়ুয়ার সাদা কফিন (১৯৮৪), যুদ্ধ জয়ের গল্প (১৯৮৫) ও  মুক্তিযোদ্ধারা (১৯৯১), হারুণ হাবীবের লাল শার্ট ও পিতৃপুরু (১৯৮৫), বিদ্রোহী ও আপন পদাবলী (১৯৮৫) ও গল্পসপ্তক (১৯৯৭), জুবায়দা গুলশান আরার বাতাসে বারুদ – রক্তে নিরুদ্ধ উল্লা (১৯৮৬), খালেদা সালাউদ্দিনের যখন রুদ্ধশ্বাস (১৯৮৬), এহসান চৌধুরীর একাত্তরের গল্প (১৯৮৬), সৈয়দ ইকবালের একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প (১৯৮৬), রশীদ হায়দারের তখন (১৯৮৭), আবুবকর সিদ্দিকের মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৮৭), রাবেয়া খাতুনের মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী (১৯৮৬), মকবুলা মনজুরের মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৯১), কাজী জাকির হাসানের যুদ্ধের গল্প (১৯৯১) ইত্যাদি।

 

 

দুই

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্পগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর বহুমাত্রিক ছবি পাওয়া যায়। একদিকে একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহ, পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা, নির্বিচার লুণ্ঠন, ব্যাপক ধ্বংসলীলা, নির্মম নারী ধর্ষণ ও নিষ্ঠুর অত্যাচারের ফলে দেশের ভেতর কোটি-কোটি মানুষের নিরাপত্তাহীন সন্ত্রস্ত জীবন এবং আরো এক কোটি মানুষের অসহায় দেশত্যাগ, অন্যদিকে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ সংগ্রাম স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ছোটগল্পের উল্লেখযোগ্য উপাদান হয়ে আছে। এসব ঘটনা নানা গল্পে নানাভাবে প্রতিফলিত ও চিত্রিত হয়েছে।

একাত্তরের মার্চের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রচিত হয়েছে আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘বিস্ফোরণ’ (আমার রক্ত স্বপ্ন আমার, ১৯৭৫) গল্পটি। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও পাকিসত্মানিরা ক্ষমতা হসত্মান্তর না করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে সর্বস্তরের বাঙালির মনে যে-ক্ষোভ জমে তা একসময় রূপ নেয় লাখো জনতার বিস্ফোরণে। এ-গল্পে উদ্ভাসিত হয়েছে সেই রাজনৈতিক বাস্তবতা।

২৫ মার্চ অতর্কিত আক্রমণ, নির্বিচার গণহত্যা ও বর্বরতার মধ্যে হানাদার পাকিসত্মানি বাহিনী-কবলিত রাজধানী ঢাকার অবরুদ্ধ মানুষের ভয়-ভীতি-উৎকণ্ঠার ছবি ফুটে উঠেছে কোনো-কোনো গল্পে। শওকত ওসমানের ‘দুই ব্রিগেডিয়ার’ (জন্ম যদি তব বঙ্গে, ১৯৮৪) গল্পে ফুটে উঠেছে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাত্রির বিভীষিকা। এ-গল্পে ফায়ার ব্রিগেডের অফিসার সদলবলে নিহত হন পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর লাগানো আগুন নেভাতে গিয়ে। তাঁর ‘অলোক অন্বেষা’ (জন্ম যদি তব বঙ্গে, ১৯৮৪) গল্পেও এ-দেশের সাধারণ মানুষের ওপর হানাদার বাহিনীর নির্মম বর্বরতার ঘটনা স্থান পেয়েছে। বুলবন ওসমানের ‘সে এবং সেদিন’ গল্পে কলকাতায় এক শরণার্থী মায়ের মুখ থেকে জানা যায় ২৫ মার্চ-পরবর্তী দিনগুলিতে শত্রম্নকবলিত বাংলাদেশে পাকিসত্মানি সেনাদের অত্যাচার, মুক্তিসেনাদের প্রতিরোধ লড়াই এবং
সহায়-সম্পদহীন হয়ে হাজার-হাজার লোকের দেশত্যাগের ঘটনা। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘কেয়া আমি ও জার্মান মেজর’ গল্পে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্যারিস দখল করার পর যেমন করে জার্মান সৈন্যরা ফরাসি যুবতীদের ধরে নিয়ে ফুর্তি করেছে, পাকিসত্মানি পাঞ্জাবি সেনারাও তেমনিভাবে অবরুদ্ধ ঢাকায় চরিতার্থ করেছে তাদের পাশব লালসা। ২৫ মার্চের কালরাতে হানাদার বাহিনী, অবরুদ্ধ ঢাকার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাময় ভয়াল পরিবেশের ছবি পাওয়া যায় রশীদ হায়দারের ‘প্রথম দিনে’ (তখন, ১৯৮৭) গল্পে। অবরুদ্ধ শহরে আতঙ্কগ্রস্ত জীবনের এমন ছবি পাওয়া যায় মাহমুদুল হকের ‘কালো মাফলার’ গল্পেও। সেইসঙ্গে পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতার কিছু দিক। সৈয়দ শামসুল হকের ‘কথোপকথন : তরুণ দম্পতির’ গল্পে অবরুদ্ধ নগরীতে সদ্যবিবাহিত তরুণ দম্পতির নিরুপায় অসহায়তা এবং অনিবার্য বিপর্যয়ের মধ্যে উদ্বেগ ও শঙ্কা ফুটে উঠেছে। বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘সাদা কফিন’ গল্পে পাওয়া যায় পাকিসত্মানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের মধ্যে একজন মায়ের প্রাণ বাঁচানোর দুর্বার চেষ্টার চিত্র। রশীদ হায়দারের ‘প্রথম দিনে’ গল্পে আছে বধ্যভূমিতে পরিণত হওয়া অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত ও ভীতসন্ত্রস্ত লোকালয়ের ছবি। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ ছিল যে, ঘরে ফিরে না আসা বোন রাবেয়ার খোঁজ নিতে ঘর থেকে বের হতে পারেনি বাদশা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ (জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, ১৯৯৬) গল্পে দেখা যায়, রসায়নের প্রভাষক ভীরু নুরুল হুদা মুক্তিযোদ্ধা না হলেও মুক্তিযোদ্ধা মনে করে তার ওপরে পাকিসত্মানি সৈন্যরা নিপীড়ন চালায়। মুক্তিযোদ্ধা শ্যালকের রেইনকোট পরে ভীরু নুরুল হুদার মধ্যে সঞ্চারিত হয় সাহস ও দেশপ্রেম। সমস্ত আঘাত সে সহ্য করে আনন্দে ও গৌরবে।

পাক হানাদার বাহিনীর নির্মমতার চিত্র পাওয়া যায় আরো অনেক গল্পে। শওকত ওসমানের জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৮৪) গল্পগ্রন্থের নামগল্পে  একাত্তরের বর্বরতা ও আতঙ্কময় পরিস্থিতি বর্ণিত হয়েছে এক বৃদ্ধের জবানিতে। বশীর আল হেলালের ‘বাংলার প্রাণ’ (প্রথম কৃষ্ণচূড়া, ১৯৭২) গল্পে পাক হানাদার বাহিনীকে দেখা যায় জল্লাদের ভূমিকায়। তাদের অত্যাচার এমন নির্বিচার ছিল যে, তাতে মসজিদের ইমাম ও মুসলিস্ন পর্যন্ত বেঘোরে প্রাণ হারায়। তাঁর ‘নারকীয় নাটক’ (প্রথম কৃষ্ণচূড়া, ১৯৭২) গল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাক হানাদার বাহিনীর লুটপাট ও নারী-লোলুপতার নারকীয় ঘটনা। মিন্নাত আলীর ‘বারাঙ্গনা স্ত্রী’ (আমি দালাল বলছি, ১৯৭২) গল্পে স্থান পেয়েছে হানাদারকবলিত মহকুমা শহরে শিক্ষেত বাঙালি নারীর ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘যুদ্ধ নয়’ (আমার রক্ত স্বপ্ন আমার, ১৯৭৫) গল্পে জন নামে এক কুকুরের জবানিতে বর্ণিত হয়েছে একাত্তরের মার্চের কালরাতের নৃশংসতা ও নারকীয় গণহত্যার ঘটনা। হাসান আজিজুল হকের ‘ভূষণের একদিন’ (নামহীন গোত্রহীন, ১৯৭৫) গল্পে রিপোর্টাজধর্মী বর্ণনায় ফুটে উঠেছে ১৯৭১-এর এপ্রিলে পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার নির্মম চিত্র, যদিও দরিদ্র চাষি ভূষণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আহবান কোনো তাৎপর্য বয়ে আনে না। তাঁর ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’ (নামহীন গোত্রহীন, ১৯৭৫) গল্পে বর্ণিত হয়েছে পাঁচ তরুণ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা। এ-গল্পে আছে, পাকিসত্মানি সৈন্যদের হাতে গ্রামাঞ্চলে অগ্নিসংযোগ, নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা, ধর্ষণ, ধনসম্পদ লুটপাট ইত্যাদির মর্মামিত্মক ছবি। সেইসঙ্গে এতে পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী তৎপরতা ও রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের জীবন্ত চিত্র। বশীর আল হেলালের ‘সাপ’ (প্রথম কৃষ্ণচূড়া, ১৯৭২) গল্পে ব্যক্ত হয়েছে পাকিসত্মানি সেনাদের অত্যাচার ও সাধারণ মানুষের প্রতিরোধস্পৃহা। এই গল্পে নরপিপাসু ইয়াহিয়া খানকে দেখানো হয়েছে সাপের প্রতীকে।

কোনো-কোনো গল্পে দেখা যায়, পাকিসত্মানি বাহিনীর নির্মমতার ঘটনায় অনেক তরুণ প্রতিশোধস্পৃহায় যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে।  এমনটি দেখা  দেখা যায়, শওকত আলীর ‘পুনর্বার বেয়নেট’ (লেলিহান সাধ, ১৯৭৮) গল্পে। এ-গল্পে পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতায় চোখের সামনে পরিবারের লোকজনকে নৃশংসভাবে নিহত হতে দেখে প্রাণে বেঁচে যাওয়া একমাত্র যুবক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় এবং হানাদারদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেয়। একাত্তরের দিনগুলোতে আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে দেশত্যাগী হাজার-হাজার তরুণের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অনবদ্য ছবি ফুটে উঠেছে আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘রূপান্তর’ (আমার রক্ত স্বপ্ন আমার, ১৯৭৫) গল্পে। এই গল্পে এক গেরিলা যোদ্ধার আত্মকথনে বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে গেরিলা প্রশিক্ষণ ও গেরিলা তৎপরতার ঘটনা। সেইসঙ্গে এসেছে হানাদার বাহিনীর বর্বরতা ও নারী নির্যাতনের ঘটনা।

বেশকিছু গল্পে চিত্রিত হয়েছে নারীর অসহায়তা, মর্মযাতনা ও উৎকণ্ঠার ছবি। প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার অপেক্ষায় প্রেমিকার অব্যক্ত বেদনা জমাট বেঁধেছে শওকত আলীর ‘কোথায় আমার ভালোবাসা’ (লেলিহান সাধ, ১৯৭৮) গল্পে। এ-গল্পের নায়ক মাহমুদ তার বান্ধবীকে কথা দিয়েছিল পরীক্ষার পাট শেষ হলে সে বিয়ের ব্যাপারটি সেরে ফেলবে। কিন্তু হঠাৎ পাকিসত্মানি বাহিনীর অতর্কিত হামলা শুরু হলে মাহমুদ প্রেম-বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে ভবিষ্যতের রোমান্টিক স্বপ্নকে দূরে ঠেলে যুদ্ধে যায় দেশকে মুক্ত করার জন্যে। এরপর অনেক প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা এলো, কিন্তু মাহমুদ ফিরে এলো না। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রেমিকার দিন কাটে মাহমুদের ফিরে আসার অপেক্ষায়।

মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরির আদলে লেখা জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পে পাকিসত্মানি হানাদার জল্লাদ বাহিনীর নির্মম বর্বরতা ও জীবন বাঁচাতে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের পলায়নপরতার পাশাপাশি আছে বাঙালি মুক্তিসেনার রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারের ছবি।

মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রামবাংলার ছবি ধরা পড়েছে আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘কলিমদ্দি দফাদার’ (ল্যাংড়ী, ১৯৮৪) গল্পে। এতে আছে গ্রামাঞ্চলে হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর বর্বরতার ছবি। গ্রাম এলাকার আনসার-চৌকিদাররাও যে সরকারি দায়িত্ব পালনের আড়ালে বিভিন্ন কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন, সে-বাস্তবতাই শিল্পসত্য হয়ে দেখা দিয়েছে এ-গল্পে। মইনুল আহসান সাবেরের ‘কবেজ লেঠেল’ গল্পেও গ্রামবাংলার ছবি পাওয়া যায়। সুচরিত চৌধুরীর ‘নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত’  গল্পে পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর হাতে বাপ-মা হারানো এক নিরাশ্রিত ছেলে আশ্রয় পায় এককালের দাগি আসামির কাছে, যে একাত্তরে হয়ে যায় এক অদম্য মুক্তিযোদ্ধা। সুচরিতের ‘আলো নিরুত্তর’ গল্পটি লেখা হয়েছে হানাদার পাকবাহিনী ও তার দোসরদের হত্যাযজ্ঞ এবং অমানুষিক নির্যাতনের পটভূমিতে।

শাহরিয়ার কবিরের ‘একাত্তরের যীশু’ গল্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিসত্মানি বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিবরণ পড়ে পাঠকের মন কেবল শিউরে ওঠে না, পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জাগে তীব্র ঘৃণা।

 

তিন

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বর্বর হানাদার ও তাদের দোসরদের ন্যক্কারজনক ভূমিকা চিত্রিত হয়েছে কিছু গল্পে। রক্তলোলুপ হানাদারদের মুখে ছিল ধর্মের বাণী। ইসলাম ধর্ম রক্ষার নাম করে তারা চালিয়েছিল নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। হানাদাররা ধর্মের দোহাই দিয়ে লিপ্ত হয়েছিল গণহত্যায় । আর তাদের বিরুদ্ধে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল বাঙালির প্রতিশোধের আগুন। কিছু গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের ঘৃণ্য তৎপরতার ঘটনা। শওকত ওসমানের ‘দ্বিতীয় অভিসার’ (এবং তিন মির্জা, ১৯৮৬) গল্পে রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর নারী লোলুপতার চিত্র ফুটে উঠেছে। এ-গল্পে জ্ঞাতিভাই রাজাকার ফরিদের সহায়তায় হানাদার বাহিনীর লালসার শিকার হয় জ্ঞাতিবোন মাজু। মেয়েটি কলঙ্কমুক্ত হওয়ার জন্যে ধলেশ্বরীর বুকে বিসর্জন দেয় জারজ সমত্মানকে। হানাদার বাহিনীর নারী লোলুপতার ঘটনা চিত্রিত হয়েছে শওকত ওসমানের ‘জননী : জন্মভূমি’ (জন্ম যদি তব বঙ্গে, ১৯৮৪) গল্পেও। বশীর আল হেলালের ‘দুই কুত্তার গল্পে’ (প্রথম  কৃষ্ণচূড়া, ১৯৭২) হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের তুলনা করা হয়েছে কুকুরের সঙ্গে। ধর্মের খোলসে স্বাধীনতাবিরোধী দালালদের মানবতাবিরোধী ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘রোদের অন্ধকারে বৃষ্টি’ (বাংলাদেশ কথা কয়) গল্পে। এমনিভাবে ধর্মের খোলসে পাকিসত্মানি বাহিনীর কূটকৌশল স্পষ্ট রূপ নিয়েছে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘আমার আল্লারে’ গল্পে।  মুক্তিযুদ্ধে পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর যারা দালালি করেছিল তাদের পরিবারের নারীসদস্যদের ইজ্জতও লুণ্ঠিত হয়েছিল পাকিসত্মানি নারী লোলুপ হায়েনাদের হাতে। সেলিনা হোসেনের ‘আমিনা ও মদিনার গল্প’ গড়ে উঠেছে এমনই একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মসজিদের পরহেজগার মুয়াজ্জিন আল আমিনের দুই কন্যাকে পাকিসত্মানি মিলিটারিরা তুলে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে। চরিতার্থ করে তাদের আদিম লালসা।

পাকিসত্মানপন্থীদের আক্রমণের মুখে অনেক হিন্দু কৌশল হিসেবে ধর্মান্তরিত হওয়ার পথ বেছে নিয়েছিল। অনেক হৃদয়বান মুসলমান সাময়িকভাবে তাদের এই পথ বেছে নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমন একটি আখ্যান পাওয়া যায় বশীর আল  হেলালের ‘রণকৌশল’ (প্রথম কৃষ্ণচূড়া, ১৯৭২) গল্পে।

কতগুলো গল্পে গ্রামে-গঞ্জে হানাদার পাকিসত্মানি বাহিনীর নৃশংসতা এবং আলবদর-রাজাকারদের গণবিরোধী ঘৃণ্য ভূমিকার পাশাপাশি পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের টুকরো-টুকরো ছবি। সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের অপারেশনের ঘটনার বিবরণ রয়েছে আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘আমার রক্ত’ (আমার রক্ত স্বপ্ন আমার, ১৯৭৫) গল্পে। এ-মুক্তিযোদ্ধাদের একজন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছিলেন প্রেমিকার আহবানে সাড়া দিয়ে। ঘটনাচক্রে তিনি নির্মম পরিণতির শিকার হন। স্বাধীনতাবিরোধী দালালদের অপতৎপরতার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মপ্রত্যয়ের ছবি ফুটে উঠেছে বশীর আল হেলালের ‘কলি’ গল্পে। সৈয়দ শামসুল হকের ‘ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে’ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন বাংলার আলেম সমাজের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন। এ-গল্পে মুক্তিযুদ্ধের বহু বছর পরে মসজিদের এক ইমামের স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাঁচজন খানসেনা ও পাঁচজন রাজাকার খতম হওয়ার ঘটনা। মাহবুব তালুকদারের ‘নীল নকশা’ গল্পে মুসলিম লীগের এক সুযোগসন্ধানী স্থানীয় নেতা নিজের বাড়িতে আশ্রিত মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মিলিটারি ক্যাম্পের হাবিলদারকে সদলবলে বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে নেতার ১৬ বছরের কন্যার ওপর তারা হামলে পড়ে। সে-মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন  শুরু হলে মুসলিম লীগ নেতাসহ হানাদাররা মারা যায়। সেলিনা হোসেনের ‘পরজন্ম’ (পরজন্ম, ১৯৮৬) গল্পে চলচ্চিত্রানুগ ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধে নিহত চার  মুক্তিযোদ্ধা সমত্মানের বীরত্বগাথা। তাঁর ‘শকুনের ছায়া’ (খোল করতাল, ১৯৮২) পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর দোসর রহমত আলীর সংহারের গল্প। কোনো-কোনো গল্পে ফুটে উঠেছে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী চেতনা। পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা ভাস্বর হুমায়ূন আহমেদের ‘উনিশ’শ একাত্তর’ গল্পে। এ-গল্পে পাকিসত্মানি একজন মেজর দলবল নিয়ে আজিজ মাস্টারকে জনসমক্ষে নগ্ন করে লাঞ্ছিত করে। কিন্তু মৃত্যুভাবনা উপেক্ষা করে আজিজ মাস্টার এই অপমানের বদলা নেয় মেজরের শরীরে থুথু নিক্ষেপ করে। হারুণ হাবীবের ‘গেরিলা’ গল্পে বর্ণিত হয়েছে পাকিসত্মানি সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের লড়াইয়ের ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধারা সফল অপারেশন করলেও পাকিসত্মানি বাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন। এ-গল্পে বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে যাঁরা গেরিলাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁদের আত্মদানের মহিমার দিকটি ফুটে উঠেছে।

১৯৭১-এ পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। লাখ-লাখ নারী ঘরের বাঁধন ছেড়ে ছুটে এসেছিলেন দেশের টানে, ছুটে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। তাঁদের মধ্যে কেউ ছিলেন মা, কেউ নববধূ, কেউ মেধাবী ছাত্রী, কেউ রাজনৈতিক কর্মী। সত্যেন সেনের ‘পরীবানু’ গল্পের পরীবানু দেশপ্রেমের মহিমায় ভাস্বর এক উজ্জ্বল নারীচরিত্র। এ-গল্পে নারী তাঁর নারীত্বকে বিসর্জন দেন মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থে। পরীবানুর মধ্য দিয়ে সে-আত্মত্যাগ মহিমা পায়। রাজিয়া খানের ‘ইজ্জত’ গল্প এর বিপরীতধর্মী। ইজ্জত রক্ষার জন্য নায়িকা মৃত্যুর পথ বেছে নেয়। এ-গল্পের পরিণতিও হৃদয়স্পর্শী। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘নীরবতা’ (আমার রক্ত স্বপ্ন আমার, ১৯৭৫)  বাঙালি নারীর সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার গল্প। এ-গল্পে আছে হানাদার বাহিনীর নারী-নির্যাতনের চিত্র। একটি নদীর জবানিতে রচিত এ-গল্পে তুফানী নামে এক নারী দখলদার বাহিনীর লালসার শিকার হন। কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্দীপিত তুফানী এক মেজরকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। তার সঙ্গে মেজরও খরস্রোতে ভেসে যায়। রাবেয়া খাতুনের ‘একাত্তরের ভুলে যাওয়া একটি দিন’ গল্পে বিপদ মাথায় নিয়ে খান সেনাদের হাত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে নারীকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। এ-গল্পে দুঃসহ ও চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে গৃহকর্ত্রী মরিয়ম বেগম উপস্থিত বুদ্ধি ও অভিনয়ের জোরে ঘরে আশ্রয় নেওয়া দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে রক্ষা করেন।

মুক্তিযুদ্ধের কোনো-কোনো গল্পে পাঠক অভাবনীয় পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত হন। শওকত ওসমানের ‘একা’ (ল্যাংড়ী, ১৯৮৪) গল্পে বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিপন্ন স্বদেশত্যাগী নিঃসঙ্গ প্রীতিলতার একাকিত্ব। তাঁর ‘গোশত’ (ল্যাংড়ী, ১৯৮৪) গল্পে পাঠক পরিচিত হন একাত্তরের নরঘাতক আবু নাসেরের মানস প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে। মিন্নাত আলীর ‘আমি দালাল বলছি’ (আমি দালাল বলছি, ১৯৭২) গল্পে জনৈক দালালের জবানিতে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে দেশত্যাগী শরণার্থী এবং দেশে অবস্থানরতদের মানসিকতাকে। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ (জীবন জমিন, ১৯৮৮) এমনি একটি গল্প। এ-গল্পে মৃত ভেবে আহত গেরিলা কমান্ডার ওমরকে ফেলে রেখে চলে আসে সহকারী কমান্ডার হায়দার। ঘটনাচক্রে ওমর প্রাণে বেঁচে যায়। সে নিজের এলাকায় ফিরে আসে। কিন্তু
পরিবার-পরিজনের কাছে নিজের পরিচয় গোপন রেখে আপন কন্যাকে একটি ফুল উপহার দিয়ে মিশে যায় জনারণ্যে।  রশীদ হায়দারের ‘এ কোন ঠিকানা’ গল্পে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতায় মাজেদ পাকিসত্মানি মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে ও নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়। যুদ্ধের কয়েক বছর পর ছোট ভাই বাসেতের স্মৃতিচারণে বর্ণিত হয় একাত্তরের সেই রক্তাক্ত দিনের কথা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে চরিত্রের মানস প্রতিক্রিয়াকে মূর্ত করেছেন ‘অপঘাত’ (দোজখের ওম, ১৯৮৯) গল্পে। মিলিটারির ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত বাবা চরম বিপদের মধ্যেও কীভাবে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সমত্মানের কৃতিত্বে হঠাৎ সাহসী হয়ে ওঠেন, এ-গল্প তারই আলেখ্য। এহসান চৌধুরীর ‘পরাজিত পদক্ষেপ’ শত্রম্ন-মিত্র ভেদে বিপন্ন মানবতাকে সমচোখে দেখার বিষয়টি অভিব্যক্তি পেয়েছে। উন্মত্ত বর্বর খান সেনারা স্থানীয় অবাঙালিদের নিয়ে স্কুলশিক্ষক রেজার ভাইবোনকে হত্যা করলে রেজা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। একসময় মুক্তিবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে পাকিসত্মানিদের হাত থেকে নিজের শহর দখলমুক্ত করে সে। শহরের অবস্থা সরেজমিন দেখতে গিয়ে সমত্মান-হারানো এক অবাঙালি মায়ের কান্না শুনে তার মনে পড়ে যায় নিজের মায়ের কান্নার কথা।

কিছু-কিছু গল্পে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির চিত্র প্রধান হয়ে উঠেছে। শওকত ওসমানের ‘ওয়াগন ব্রেকার’ (জন্ম যদি তব বঙ্গে) গল্পে পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী কঠিন বাস্তবতার ছবি। সে-বাস্তবতায় একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাকে বেছে নিতে হয় দুর্বৃত্তের জীবন। আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘উস্টানি’ (ল্যাংড়ী, ১৯৮৪) গল্পে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক-সামাজিক সংকট, তারুণ্যের অবক্ষয় ও দুর্বৃত্ত শক্তির উত্থানের বাস্তবতা। আবুবকর সিদ্দিকের ‘রক্তগর্জন’ (মরে বাঁচার স্বাধীনতা, ১৯৮৭) গল্পে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধার চোখে দেখা হয়েছে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের অনভিপ্রেত বাস্তবতাকে, যেখানে সার্টিফিকেটধারী ভ- মুক্তিযোদ্ধারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী। তাঁর ‘এই সেই জয় বাংলা’ (মরে বাঁচার স্বাধীনতা, ১৯৮৭) গল্পে তুলে আনা হয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সংকটের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়-সম্বলহীন দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে। রাহাত খানের ‘মধ্যিখানে চর’ গল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্র গভীর আবেগে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তারা চলে যায় অস্বাভাবিক জীবনের পথে। রাহাত খানের ‘এই বাংলায়’ গল্পে চিত্রিত হয়েছে একাত্তরের নারী ধর্ষণের পাশবিকতা। কলেজপড়ুয়া রোজিনা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করায় রাজাকাররা তাকে তুলে দেয় পাকিসত্মানি হায়েনাদের হাতে। তার সম্ভ্রম লুট করে হায়েনারা তাকে হত্যা করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে। লেখক দেখিয়েছেন নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা এলেও ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে নস্যাৎ করা হয়। এমনি আর একটি গল্প তাঁর ‘মুক্তিযোদ্ধার মা’। এ-গল্পে যে মুক্তিযোদ্ধা আবু চান হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে বীরের মৃত্যুবরণ করেছিলেন, যুদ্ধের পর সেই চানের মাকে একসময় বেছে নিতে হয় ভিক্ষাবৃত্তি। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার মা বলে পরিচয় দেওয়ায় তাকে হতে হয় লাঞ্ছিত। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোঁয়ারি’ (খোঁয়ারি, ১৯৮২) গল্পে স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক সংকট, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর তা-ব ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে ওই সময়কে দেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নভঙ্গের অধ্যায় হিসেবে। তাঁর ‘মিলির হাতে স্টেনগান’ (দুধেভাতে উৎপাত, ১৯৮৩) গল্পে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, লুটপাট ইত্যাদির পরিস্থিতি  দেখা হয়েছে আববাস পাগলার চোখ দিয়ে। গল্পে মিলি হয়ে উঠেছে নবতর সংগ্রাম ও মুক্তিচেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষের প্রতীক। সেলিনা হোসেনের ‘ভিটেমাটি’ মুক্তিযোদ্ধার অসীম সাহসিকতা ও আত্মবিসর্জনের আলেখ্য। এ-গল্পে হাফেজ মিয়া মুক্তিযুদ্ধে পুত্রহারা শোকগ্রস্ত পিতাদের প্রতিনিধি। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার সুকৌশলে সমাজবিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়। তাঁর ‘ঘৃণা’ (খোল করতাল, ১৯৮২) গল্পে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সমাজ ও রাষ্ট্র-উপেক্ষেত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ, যন্ত্রণা, মানসিক পীড়নের মনোজাগতিক ভাবনা প্রধান হয়ে উঠেছে। এমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দারিদ্র্য, অভাব-অনটন, হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বাস্তবতা পেয়েছে বুলবুল চৌধুরীর ‘নদী জানে’ গল্পটিতে। হুমায়ূন আহমেদের ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ গল্পে সেসব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি তোলা হয়েছে, যারা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের হত্যার জন্যে দায়ী। ইমদাদুল হক মিলনের ‘প্রস্ত্ততি পর্ব’ গল্পে গ্রামের অশিক্ষেত তিন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ শেষ হলেও আবার নতুন করে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হয়।

কোনো-কোনো গল্পে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে নতুন জিজ্ঞাসা উত্থাপিত হতে দেখা যায়। হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫) গল্পগ্রন্থের ‘আটক’, ‘ঘর গেরস্থি’, ‘কেউ আসেনি’ ও ‘ফেরা’ – এ-ধরনের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের অমিত্মম পর্বের ঘটনাকে নিয়ে রচিত ‘আটক’ গল্পে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর  যৌথ আক্রমণে পর্যুদস্ত পাকিসত্মানি বাহিনীর নাজুক অবস্থা দেখানোর পাশাপাশি দেখানো হয়েছে, বোমাবর্ষণে কেবল পাকিসত্মানি সেনারা নিহত হয়নি, সাধারণ মানুষও মৃত্যুর শিকার হয়েছে। এ-গল্পে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়োল্লাসকে আচ্ছন্ন করা হয়েছে মিত্র শক্তির হাতে সাধারণ মানুষের মৃত্যুকে সামনে এনে।  হাসানের ‘ঘর গেরস্থি’ গল্পের রামশরণ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ধর্মান্ধ স্বার্থপর গোষ্ঠীর অত্যাচারে উচ্ছেদ হয় ভিটেমাটি থেকে। আশ্রয় নেয় ভারতে। দেশ স্বাধীন হলে অনেক আশা অনেক স্বপ্ন নিয়ে সে দেশে ফেরে। কিন্তু সর্বত্রই ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সমত্মান হারানোর বেদনা হয় তার নিত্যসঙ্গী। অনেক কিছু হারিয়ে, অনেক ভোগামিত্ম সয়ে আশাভঙ্গের বেদনায় সে স্বাধীনতার কোনো মানে খুঁজে পায় না। ‘কেউ আসেনি’  গল্পেও রয়েছে স্বাধীনতার প্রাপ্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা। যুদ্ধফেরত গফুর সহমর্মিতাবশত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আসফ আলীর দেখাশোনা করতে হাসপাতালে থেকে যান। পরনে খাকি পোশাক ও হাতে রাইফেল নিয়ে আসফ আলীর মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেন। তার মনে প্রশ্ন জাগে, মুক্তিযুদ্ধ করে কী পেল আসফ? কী পেল সে নিজে? ‘ফেরা’ গল্পে হাসান আজিজুল হক স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যুদ্ধ শেষে আলেফ প্রত্যাশা করেছিল মুক্তিযুদ্ধ করায় তার অবস্থার উন্নতি হবে। সরকার তাকে ডাকবে। তার ভিটের চেহারা বদলাবে। তাকে আর একটু জমি দেবে। কিন্তু তার বদলে সরকার থেকে নির্দেশ আসে অস্ত্র জমা দেওয়ার। আলেফ অনুভব করে এখনো প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি। তাই সে অস্ত্র জমা না দিয়ে লুকিয়ে রাখে ডোবার মধ্যে। কারণ আবার হয়তো অস্ত্র দরকার হবে তার। হাসানের আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৯) গল্পগ্রন্থের নামগল্পে রয়েছে উগ্র বামপন্থী রাজনীতির প্রতি সহানুভূতি। এই গল্পে রুনু ও তার সঙ্গী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও স্বাধীনতার আট বছর পরে তারা অনুভব করে, গণমানুষের মুক্তি আসেনি। তাই তারা  বেছে নেয় উগ্র বিপস্নবী বাম রাজনীতির পথ।

 

চার

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্পগুলো সমকালীন সময়ের সাক্ষী। এসবের মাধ্যমে সংঘটিত জনযুদ্ধের একটা ছবি ফুটে ওঠে পাঠকের মনে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এসব গল্পের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আনুষঙ্গিক নানাদিকও পাঠকের চোখে মূর্ত হয়ে ওঠে। কখনো-কখনো তা হয় ব্যঞ্জনাময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। কখনো-কখনো মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গল্পকারের নিজস্ব আবেগও সঞ্চারিত হয় পাঠকের মনে।

গল্পে বর্ণিত হানাদারদের অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের বিবরণের মধ্য দিয়ে একদিকে চরম মানবিক বিপর্যয়ের ছবি আমরা পাই, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অঙ্গীকার ও আত্মত্যাগ, বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় মনোভাব রূপায়ণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনীন চেতনার অভিপ্রকাশ ঘটে। টুকরো-টুকরো ঘটনার মধ্য দিয়ে পাঠকের অনুভবের মধ্যে সঞ্চারিত হয় মুক্তিযুদ্ধের উত্তেজনা ও উত্তাপ। এসব গল্পের সবই হয়তো শিল্পসফল নয়। তবে কিছু-কিছু গল্প যে কালোত্তীর্ণ মহিমা পাবে তাতে সন্দেহ নেই।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত হচ্ছে নতুন-নতুন ছোটগল্প। সেগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ নতুন প্রজন্মের সামনে ভাস্বর হচ্ছে নিত্যনতুন তাৎপর্য নিয়ে।