দুই স্রষ্টাকে নিয়ে সামান্য কথা

আহমাদ ইশতিয়াক

মাথাভর্তি উদ্ভ্রান্তের মতো চুল, বহুদিন খুরের আঁচড় না পড়া চুপসে যাওয়া গালে খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটে বিড়ি আর হাতে বাংলা মদের বোতল। পরনের পাজামা-পাঞ্জাবি ময়লায় মলিন আর চোখভর্তি স্বপ্ন! চোখের কালো ফ্রেমের চশমাটায় এক অবিন্যসত্ম দৃষ্টি! জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, এক মাতালের ধারে এসে পড়লে যা হাল হয়। দূর থেকে দেখলে নিতান্তই অপরিচিত ঠেকবে ঋত্বিক ঘটককে!

অন্যদিকে চোখদুটো বাজপাখির মতো। পুরো ফ্যাশনেবল, চুল পরিপাটি আর ঠোঁটের কোণে গুঁজানো সিগারেটের অংশটুকু যেন পুরোই বিপরীত! শেষদিকে এসে চশমা নিয়েছিলেন! অথচ তাঁর পরিচয় কিন্তু একটি নয়, দুটো। সাহিত্যিক ধরলেও কম হবে না বইকি। মানিকদা এককথায় ধরলে নজরে পড়ার মতোই। অথচ স্বপ্ন যেখানে এসে মিলে দাঁড়ায়।

’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ এবং ’৪৭-এর দেশভাগের পর শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় চলে যেতে হলো ঋত্বিক ঘটকের পরিবারকে, যা পরবর্তীকালে তাঁর কর্মে প্রকাশ পেয়েছে দারম্নণভাবে। ’৪৬ সালে কেবল আইএ পাশ করেছেন ঋত্বিক। যদিও বাবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।  অন্যদিকে কৈশোরের সংগ্রামটি পোহাতে হয়েছে  সত্যজিৎকে। বাবা সুকুমার রায় বিখ্যাত সাহিত্যিক। কিন্তু তিন বছর বয়সেই বাবাকে হারানো এবং মা সুপ্রভা দেবীর কষ্টের দিকপাল। দুজনের দিকটা এক বিন্দুতে মিলে যায়।

ঋত্বিক প্রথম নাটক লেখেন ১৯৪৮ সালে, তথা দেশভাগের পরের বছর। কলকাতায় তখন তিনি বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের বিএর ছাত্র। অন্যদিকে সত্যজিৎ শামিত্মনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর ছাত্র।  রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়স। ’৪০ সালে ভর্তি হলেন, ’৪৩ সালে শামিত্মনিকেতন ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই। বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইনের কাজ নিলেন ডিকে গুপ্তের সিগনেট প্রেসে। বলে রাখা ভালো, সত্যজিৎ কিন্তু ঋত্বিক ঘটকের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। সত্যজিতের চলচ্চিত্রের যাত্রার পথটা শুরম্ন হয় ’৫০ সালে, যখন ডিজে কিমার সত্যজিৎকে লন্ডনে পাঠালেন। তিন মাস ছিলেন, তিন মাসে ৯৯টি সিনেমা দেখা এবং বাইসাইকেল চোর দেখার পরেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সিনেমায় হবে পথ চলা। অন্যদিকে বয়স অনুসারে ঋত্বিক আগেই চলে এলেন। তখন তিনি নাটক লেখেন, রচনাবলি অনুবাদ করেন। ঋত্বিকের যাত্রা শুরম্ন হলো নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল সিনেমার মধ্য দিয়ে। একাধারে অভিনেতা আবার অন্যদিকে তিনি সহকারী পরিচালক। তবে মূল পরিচালকের যাত্রাটি ’৫৩ সালে নাগরিক মুক্তির মাধ্যমে। প্রথম দুটো সিনেমাই চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারাকে ঝাঁকুনি দিলো।

অন্যদিকে সত্যজিৎ প্রথম দিকে হোঁচট খেতে-খেতে এগোলেন। পথের পাঁচালীর মাধ্যমে শুরম্ন। নিজের জমানো টাকা দিয়ে শুরম্ন করলেন, ভেবেছিলেন কেউ দৃশ্যগুলো দেখলে হয়তো টাকা ঢালবে কিন্তু কোনো ধরনের সাহায্য পাননি। তাই তিন বছর ধরে চলল পথের পাঁচালীর দৃশ্য গ্রহণ। এই টাকা আসে তো কাজ শুরম্ন, টাকা নেই তো কাজ বন্ধ। শেষমেশ পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ঋণ নিয়ে ছবি শেষ করলেন। এবং ’৫৫ সালেই পথের পাঁচালী মুক্তি পেল। এমনকি  পথের পাঁচালীর নির্মাণের সময়ও অর্থের বিনিময়ে চিত্রনাট্য বদলের জন্য কোনো অনুরোধই সত্যজিৎ রাখেননি।

’৫৩ সালের পর তথা নাগরিক মুক্তির পর ঋত্বিক নাটক এবং অনুবাদের কাজে মনোনিবেশ করলেন। ’৫৭ সালে তাঁর লেখা এবং পরিচালনায় প্রদর্শিত হলো তাঁর শেষ নাটক জ্বালা। ’৬০ সালের আগ পর্যন্ত আর কোনো চলচ্চিত্র মুক্তি পেল না। ’৬০ সালে এলো বিখ্যাত চলচ্চিত্র মেঘে ঢাকা তারা

অন্যদিকে পথের পাঁচালীর পর ’৫৭ সালে মুক্তি পেল সত্যজিতের পরবর্তী ছবি অপরাজিত, যা পথের পাঁচালীর চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলে রায় দিয়েছেন মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকরা। তখনো অপু ত্রয়ীর চিমত্মা মাথায় আসেনি সত্যজিতের। তাই অপুর সংসারের আগেই মুক্তি পেল পরশ পাথর এবং জলসাঘর

অপরদিকে ত্রয়ী কিন্তু ঋত্বিকের চলচ্চিত্রেও প্রভাব ছিল। পরপর তিন বছরে মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার এবং সুবর্ণ-রেখা মুক্তি পেল!

দৃশ্যায়ন, এবং তাঁদের দৃষ্টি বহু দূরে এগিয়ে গেল। ঋত্বিক ঘটকের অযান্ত্রিক (১৯৫৭) দৃশ্যায়নে যে-গাড়িচালকটিকে ব্যবহার করলেন তাকেই সত্যজিৎ দেখলেন অভিযান (১৯৬২) চলচ্চিত্রে।

অন্যদিকে সত্যজিৎ যেখানে ছিলেন আখ্যান প্রেমিকে, ঋত্বিক ছিলেন নিরভিমানে। তা না হলে পথের পাঁচালীতে (১৯৫৫) দুর্গার একটি বৃষ্টিভেজা দৃশ্য কেন আবর্তিত হয়েছে মেঘে ঢাকা তারার (১৯৬০) নিতার মধ্যে। মিল খোঁজা দুরূহ। এখানে মিলের প্রশ্ন নয়। সৃষ্টির দিকপাল কখনো মিলে যায় আমরা জানি; কিন্তু ভাবনা তাঁদের এক অদ্ভুত রকমের সাবলীল। অন্যদিকে যে নৈশাভিযান সুবর্ণ-রেখায় (১৯৬২) ঈশ্বরের, আবার তারই সঙ্গে জনঅরণ্য (১৯৭৫) চলচ্চিত্রের সোমনাথে পার্থক্য মৌলিক। একজন যদি অভিযাত্রী হন, অন্যজন তবে দৃশ্যপ্রতিমা। কেমন এক অদ্ভুত মেলবন্ধন অথচ কাহিনিসংক্ষেপে কতই ব্যতিক্রম। শাপমোচন এবং পথের পাঁচালী একই বছর মুক্তি পেল। তবে হ্যাঁ, যখন দেখবেন অযান্ত্রিকের বিমল এবং অপরাজিতের অপূর্ব কুমার রায়ের গঠনে মিলাতে যাবেন।

সত্যজিৎ এবং ঋত্বিক ভিন্নভাবে অনুমান করতেন। আবার মিল থাকাটিও অস্বাভাবিক নয়। অপরাজিতের অপূর্ব কুমার রায় এবং
সুবর্ণ-রেখার ঈশ্বর চক্রবর্তীর দিকটি একবার দেখুন। বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে থাকা বা দুসত্মর পার্থক্য। সুবর্ণ-রেখার প্রতিটি কথামালা ষাটের দশকের ভাবনা। যেখানে ঋত্বিক নিবেদন করেছেন রম্নক্ষতা, জনপরিসরে ঘাটশিলার স্টেশন। ফলে রামচন্দ্রের মাতৃ দর্শন মহাকাব্যের গঠন নয় বরং যা ক্ষতমুখ খুলে দিলো। অন্যদিকে সত্যজিৎ ছিলেন সংশোধন-প্রত্যাশী এবং মানবতাবাদী। শতরঞ্জ কে খিলাড়িতে লর্ড ডালহৌসি সেনাদলের প্রতি তাঁর অনুচ্চারিত অভিমান ইতিহাসের বাইরে। দিগন্তরেখার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা এক অসহায় বালকের দৃষ্টিতে।

এবার ভাবনাটুকু সম্প্রসারণ করম্নন। তাঁদের বন্ধন বা সৃষ্টি  মৌলিক। আবার তাঁদের সৃষ্টিতে মিল খুঁজে পাবেন ভিন্নভাবে। বিনোদ বিহারীকে নিয়ে সত্যজিৎ সৃষ্টি করলেন দি ইনার আই (১৯৭২) এবং রামকিঙ্কর বেইজকে নিরভর করে ঋত্বিক ঘটকের অসমাপ্ত তথ্যচিত্র (১৯৭৫) দৃশ্যবিন্যাস নিয়ে। দুজনের ভাবনা আলাদা এবং মৌলিক। কিন্তু সত্যজিৎ আগ্রহী হলেন বিনোদ বিহারীকে নিয়ে, যেখানে এক নিসত্মব্ধ নীরবতা আবার ঋত্বিকের দৃষ্টিতে গতির সঞ্চার এনে দিলো অসমাপ্ত রামকিঙ্করের পথচলা।

আমরা পাই সত্যজিতের বিনোদ বিহারী তথ্যচিত্রে মৌলিকতা, তথ্যের রকমফের, এবং দর্শন। অথচ সত্যজিৎ কিন্তু বিনোদ বিহারীর জীবন যাপনের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে তিনি একজন শিল্পী। প্রতিটি দৃশ্যপট তিনি সাজাবেন নতুনভাবে। বিনোদ বিহারী সত্যজিতের বিশ্বভারতীতে শিক্ষক ছিলেন ঠিকই কিন্তু এখানে তিনি হয়ে এলেন নিরাভাবে। তিনি ছিলেন ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন আবার সত্তরের দশকে তিনি দৃষ্টিহীন। হয়তো সত্যজিৎ এতে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলেন।

The Inner Eye-তে সত্যজিৎ বাসত্মবিক জ্ঞান এবং চারপাশকে বুঝতে পেরেছিলেন বিনোদ বিহারীর মধ্য দিয়ে। তাঁর দৃশ্যভাষার অন্যতম উৎস ছিলেন বিনোদ বিহারী। আবার সত্যজিৎ যখন পড়াশোনা শেষ না করেই বিশ্বভারতী ছাড়লেন, তখন তাঁর বিশ্বভারতীর প্রতি আস্থা ছিল না। একটুখানি বোধহয় অবজ্ঞাও ছিল, কিন্তু ভর্তি হলেন রবিঠাকুরের প্রতি সম্মানবোধ এবং মায়ের অনুরোধ রক্ষার জন্য। শিক্ষকদের মধ্যে নন্দলাল বসুর প্রতি আকর্ষণ টের পেয়েছিলেন সত্যজিৎ। চারম্নকলায় স্থির চিত্রকলা এবং সাধারণ একটি ছবি কীভাবে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে বুঝতে পেরেছিলেন সত্যজিৎ, যা তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রের ফুটে উঠেছে দারম্নণভাবে।

এই ঘটনাটি পড়েছিলাম বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের এক লেখায়। ১৯৭৫ সাল, ডিসেম্বরের প্রথম রোববার। ঋত্বিক একজন আগ্রহী ক্রেতাকে রামকিঙ্কর তথ্যচিত্রের রাশ দেখাবেন। তখনো শব্দ যুক্ত হয়নি। সস্ত্রীক ঋত্বিক ঘটক এবং সেই ভদ্রলোক প্রথম সারিতে। পেছনে কবি অনন্য রায় মহেন্দ্রকুমার এবং সঞ্জিব মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, দেখেছিলাম রামকিঙ্কর বেইজ ও ঋত্বিক ঘটক কি নিঃশব্দে পরীক্ষা করে চলেছেন দৃশ্যকলার    রূপকথা। হঠাৎ আমার চোখে পড়ে সেই অলৌকিক মুহূর্ত, ঋত্বিক ঘটককে ঈষৎ উত্তেজিত দেখাল। তিনি সোজা হয়ে বসলেন এবং তাঁর তর্জনী পর্দার দিকে নির্দিষ্ট। আলোর অবিশ্বাস্য বিন্যাস এসে রামকিঙ্করের ক্লোজআপ গঠন করেছে।

রঁদ্যা বলেছিলেন, শ্রাব্য আয়তন এবং বেঠোফোনের প্রসঙ্গে, শব্দহীন শব্দের জগৎ প্রকৃতপ্রস্তাবে ঋত্বিক রামকিঙ্করের মাঝে খুঁজে  পেয়েছিলেন আগুনের বীজ, যা নিজেকে প্রথা থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং নিজের মধ্যে এক মৌলিকতার সৃষ্টি হয়। দেখুন, সকল নিয়ে যিনি বসে আছেন সর্বনাশের আশায়, শামিত্মনিকেতন যাকে নিরাপত্তা দিতে পারে না ওই তপোবনে যিনি পবিত্র অসঙ্গতি তাঁকেই ঋত্বিক এক মহত্ত্ব দান করলেন ক্লোজআপে।

প্রকৃত বাসস্থান বলে কিছু নেই। ঋত্বিক রামকিঙ্করকে পেয়েছিলেন শামিত্মনিকেতনের বাইরে এক টালির ঘরে। তিনি জানতেন বলেই ঋত্বিকের ক্যামেরা ক্রমাগত জোর দিতে থাকে, রামকিঙ্করের প্রাণে। ঋত্বিক বিশ্বাস করতেন, নিম্নবর্গীয় রামকিঙ্কর সভ্যতার অধিক বয়সী এবং আদিম। আশির পদনখে সভ্যতার বিচারক হওয়া তাঁর নিয়তি। এজন্যই ষাটের দশকের শুরম্নতে সাঁওতাল রমণীদের পায়ের তালে-তালে এগিয়ে আসার অনুষঙ্গে সুবর্ণরেখায় রামকিঙ্করের ‘চাল কলের ডাক’ নামের শিল্পকর্মে চকিত বিদ্দুলøতার মতো উপহার দেন তিনি। রামকিঙ্কর যে অন্তরতমকে একা দেখার জন্য মদ ও নারীকে বেছে নিয়েছিলেন, তা কিন্তু ঋত্বিকের চোখ এড়ায়নি। সকল লোকের মাঝে বসেও একান্ত যে দুঃসাহস, পরিশীলনের হাস্যকর পরিম-ল থেকে সুদূর হয়ে যাওয়ার যে-কারম্নবাসনা, রামকিঙ্করকে আলাদা করে দিয়েছিল তা ঋত্বিকের ঈর্ষা ও ভালোবাসা ছিল। রামকিঙ্কর কিন্তু শুধুমাত্র তথ্যচিত্রের প্রয়োজনে আসেননি, রামকিঙ্করের রেখায়  যে উন্মাদ, বক্রিমার সীমা ছাড়ানোর ডাক যা বোলপুরের নিজস্ব নিসর্গচিত্র, তাঁকে ঋত্বিক প্রাণাধিক আদরে চিনতে পেরেছিলেন। অযান্ত্রিক, মেঘে ঢাকা তারায় যে-প্রকৃতি তা মানুষ-নিরপেক্ষভাবেই সংযুক্ত। ছবিতে আমরা নিথর বুদ্ধদেবকে দেখতে পাই কিন্তু এই বুদ্ধ তো প্রতিটি শিল্পীর আরাধ্য। গায়ে শ্রমবিন্দু কোনো ইশারা নেই বুদ্ধকে বিচলিত করতে পারে না। যা রামকিঙ্কর, ঋত্বিককেও টলাতে পারেনি।

সুইস পার্কে সেদিন ছবির শেষে ঋত্বিক তাঁর ভক্তদের তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন কিঙ্করদার কাছে একটাই জিজ্ঞাসা art কোথা থেকে আসে। রামকিঙ্কর কী বলেছিলেন জানা নেই, তবে প্রায় সবাই ভাবতে পারে তাঁর দৃষ্টি কোথায় উঁকি দিচ্ছে। রামকিঙ্করকে অসাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ক্ষমতা ঋত্বিকের ছিল। যেখানে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ছাড় দিতে রাজি নন।

সত্যজিতের ব্যাপারটি দেখুন, বিনোদ বিহারীকে উপলক্ষ করে সত্যজিৎ মন্তব্য করে চলেছেন দৃশ্যশিল্পের অবিন্যসত্ম পটভূমি।  সৌন্দর্যের জন্য তাঁকে দূরে হাত পাততে হয়নি। কলকাতার মাঝ থেকেই বের করে এনেছেন সবটুকু গল্পের কারিগর। সেটি হোক মহানগর চলচ্চিত্রের আরতি এবং ভোম্বলের চোখের স্বপ্ন, অথবা নায়ক চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তার হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা। দুটোতেই তিনি বোঝাতে পেরেছেন একজন পরিচালকের মুন্শিয়ানা। পথের পাঁচালীতে বৃষ্টিভেজার দৃশ্যটি বা একটি শিশির বিন্দুর প্রতীক্ষায়। এখানে বলে রাখা ভালো যে, সত্যজিৎ বৃষ্টির কল্পনার জন্য মেঘদূতের কাছে তাঁকে হাত পাততে হয়নি। তাঁকে পরাবাসত্মবের কাছে ঘেঁষতে হয়নি, তিনি বাসত্মব দৃশ্যটুকুই তুলে এনেছেন সুনিপুণ মাধুর্যে।  যেখানে পরাবাসত্মবের কোনো অবস্থান ছিল না।

সত্যজিৎ কেন বাকি সবার চেয়ে অনন্য সে-প্রশ্ন করার আগে তাঁর সৃষ্টি এবং মৌলিকতা দেখতে হয়। চারম্নলতার বিখ্যাত সিকোয়েন্সে চারম্ন যেভাবে ধনী গৃহে আসবাপপত্রের ঘনত্ব খুঁজে পায়। চারম্নর স্বামী ছিল চারম্নর সম্পূর্ণ বিপরীত। গল্পের পটভূমি দেখুন। প্রতিটি দৃশ্যের সঙ্গে কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। আবার সীমাবদ্ধে দেখুন টুটুল এবং মিস্টার মুখার্জির দৃশ্যগুলো। সময়ের সাথে সঙ্গে কেমন বদলে গেছে। আবার পথের পাঁচালীতে দেখুন। ডিটেলসের অপূর্ব ব্যবহার, ঝড়ের পর মেঘের উল্টো মৃতদেহ, কাশবনের সাদার মাঝে  রেলগাড়ির কালো ধোঁয়ায় সাদা কালোর দ্বন্দ্ব মেখে কী বোঝাতে  চেয়েছেন সত্যজিৎ? একটি ধাক্কা, আপনার দেখাকে প্রসারিত করবে নিশ্চিতভাবেই। রেলগাড়ি যাচ্ছে আর দুর্গা আর অপু কাশবনের মাঝ দিয়ে দৌড়াচ্ছে এবং যেখানে দুর্গা পিছিয়ে যাচ্ছে! কী এক দারম্নণভাবে ফ্রেমবন্দি! আবার প্রচ- বৃষ্টিতে ভাইবোন জড়িয়ে ধরছে একে অন্যকে। ভালোবাসা তথা নির্ভরতার এক প্রতীক। আবার  দেখুন হরিহর পাড়ি জমিয়েছে বেনারসে কদিন বাদে চিঠি আসে এখনো জীবিকার কোনো ব্যবস্থা হয়নি, তাহলে খাওয়া জুটবে কীভাবে উত্তরটা পরবর্তী দৃশ্যের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। দর্শকের চোখে এক আকুতি কি হবে এরপর। আবার প্রকৃতির ক্ষমতা ফুটিয়ে তুলেছেন দুর্গার জ্বর, ঝড় বইছে আর একটি পর্দা দুলছে দুর্গা মারা যাচ্ছে। ইন্দিরা ঠাকুরণের মৃত্যুর আগে ট্রেনের হুইসেল কি ভাবনা দিচ্ছে? সত্যজিৎ কিন্তু বাসত্মবকে উপেক্ষা করেননি।

আবার ঋত্বিকের দিকে দেখুন। নাগরিক চলচ্চিত্রে দেশভাগ- পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা একটি রিফিউজি পরিবারের জীবনধারণের যুদ্ধ। রামু স্বপ্ন দেখে চাকরি করে জীবনকে সাজানোর,  প্রেমিকা উমাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। চাকরি নামক সোনার হরিণের  পেছনে ছুটছে সে অবিরাম কিন্তু তা ধরা দেয় না। শেষে ভগ্ন রামু পরিবার নিয়ে বসিত্মর উদ্দেশে নিরম্নদ্দেশ যাত্রা; সঙ্গে আশা এবং  বেঁচে থাকার স্বপ্ন। চলিস্নøশের দশকের মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনচিত্র,  বেকারত্ব, শরণার্থীদের যন্ত্রণা, নাগরিক জীবনের অনিশ্চয়তা প্রভৃতি। আবার এখানে ঋত্বিক ঘটকের নিজের জীবনের সঙ্গেও একটি মিল রয়েছে। ঋত্বিক নিজেও কিন্তু শরণার্থী হয়ে কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছেন। সুতরাং এখানে নিজেকে খুব কাছ থেকে দেখা এবং নিজের জীবনের একটি গল্পও বটে। ঋত্বিকের সিনেমায় সরলরৈখিক নয় বরং ঋত্বিক নিজেই একটি বৃত্ত রচনা করেন, যেখানে দর্শনের সঙ্গে আত্মবেদনা, সময়ের সঙ্গে যোগ এমনকি বাসত্মবতার সবচেয়ে বড় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অযান্ত্রিক চলচ্চিত্র নিয়ে আগেই বলেছি। সত্যজিৎ তো বলেই দিয়েছিলেন, ঋত্বিকবাবু, সিনেমাটি সময়মতো রিলিজ করলে আপনি পথিকৃৎ হতেন। তখন কিন্তু ঋত্বিকের কেবল শুরম্ন। তিনি তো পথিকৃৎই। ঋত্বিক এবং সত্যজিতে একটি মিল পাওয়া যায়। প্রতিটি ছবিতেই শিশু এবং নারী চরিত্রগুলো গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাড়ি থেকে পালিয়েতে একটি শিশুর দৃষ্টি দিয়ে তিনি দেখালেন। বাবার ভয়ে ট্রেনে চড়ে পালিয়ে গেল কলকাতায়। চারদিকের অভাব, হতাশা, দুঃখে সে-স্বপ্নের নগরের মিল খুঁজে পায় না। এই দৃশ্যটি ভাবনার প্রকাশ ঘটায়। চানাচুরওয়ালা হরিদাসের কাছে সরল প্রশ্ন – ‘এ শহরে এত দুঃখ কেন?’

ঋত্বিক বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেখিয়েছেন যে, আবদ্ধ থেকে নিজের পরিধি বাড়ানো যায় না। ঋত্বিক তাই গ–বদ্ধ নন। সিনেমার দর্শনের ব্যাপারে ঋত্বিকের ভাবনা ছিল, ‘সিনেমা কোনো গূঢ় ব্যাপার নয়, আমি মনে করি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই সিনেমা নির্মাণ শুরম্ন হয়। আর কারো যদি নিজস্ব দর্শন না থাকে তার পক্ষে সৃষ্টি সম্ভব নয়!’  বাসত্মবতার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা তাঁর প্রতিটি সিনেমায় আমরা  দেখতে পাই। ঋত্বিকের নিজের ভাষায়, বাংলা ভাগটাকে আমি কিছুতেই গ্রহণ করতে পারিনি, আজো পারি না। ইতিহাস যা হয়েছে তা পাল্টানো যায় না আর সেটি আমার কাজ নয়। সাংস্কৃতিক মিলনের পথে যে-বাধা, যে-ছেদ, যার মধ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি, সবই এসে পড়ে। যা ঋত্বিককে প্রচ- কষ্ট দিয়েছিল।

ঋত্বিক যে কোথা বলেছেন তিনি তা তুলেও এনেছেন কোমল গান্ধার চলচ্চিত্রে। আজীবন দেশভাগের যে-যন্ত্রণা ঋত্বিক সহ্য করেছেন এ যেন তারই নৈবেদ্য।

তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রটি পদ্মা নদী ধরলে ঋত্বিকের জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। ঋত্বিক নিজেই বলেছিলেন, তিতাস উপন্যাসের পিরিয়ডটি আমার ভীষণ চেনা। ফলে তিতাস সম্মান  গোছের। ঋত্বিকের শৈশবের সঙ্গে ‘তিতাসে’র বহু ঘটনা জড়িয়ে আছে। ত্রিশ বছরের মাঝে ফাঁকা। ত্রিশ বছর পরে যেন আমি পূর্ব বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। পেস্নøনে করে ঢাকা যাচ্ছিলেন ঋত্বিক, পাশে সত্যজিৎ রায় বসে। যখন পদ্মার ওপর দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। ঋত্বিক নিজেই বলেন, সে-বাংলাদেশ আপনারা দেখেননি, সেই প্রাচুর্যময় জীবন, সেই সুন্দর জীবন –  আমি যেন সেই জীবনের পথে চলে গেছি। এই বোকামি, শিশুসুলভ মন নিয়ে তিতাস শুরম্ন। অথচ ছবি করার সময় সেই আবেগটুকু নেই। ইতিহাস ভয়ংকর নিষ্ঠুর। কিচ্ছু নেই। ছবির স্ক্রিপ্ট লেখা থেকে শুটিংয়ের অর্ধেক পর্যন্ত ঋত্বিক মানুষের সংস্পর্শে আসেননি। ঋত্বিক নিজেই বলেছেন, ঢাকায় আমি থাকতাম না। কলকাতা থেকে ঢাকায় টাচ করে চলে যেতাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয়তো কুমিলস্নøv, কখনো আরিচাঘাট নয়তো নারায়ণগঞ্জর মানে গ্রামগঞ্জে ছবি তো গ্রামনদী নিয়েই। কাজের  সমসত্ম সময় গ্রামে থেকেছি। ছবি করার প্রথম অর্ধেক পর্যন্ত এখানকার চেহারা থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিলাম। তারপর ঢাকায় গিয়ে থাকতে হলো ছবির এটা ওটার জন্য তখন ক্রমশ দেখলাম সমসত্ম জিনিসটা ফুরিয়ে গেছে। আর ফিরবে না। এটি খুব দুঃখজনক আমার কাছে। কিন্তু দুঃখ পেলে কী হবে, ছেলে মারা গেলে লোকে শোক করে।

ঋত্বিকের আবেগটি ক্যামেরার পেছনে এসে থমকে দাঁড়ায়।  যেমনটি সত্যজিতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুজনের চলচ্চিত্রেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রভাবটি প্রায় একই রকম। শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগের ব্যবহার সত্যজিতের প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রে এনেছে নতুন মাত্রা। ঋত্বিক যেমনটি ব্যবহার করেছেন, তেমনটিতে মিল না  খোঁজাই ভালো। দুজনই স্বতন্ত্র। ঋত্বিকের রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার ছিল অতুলনীয়।

সত্যজিৎ এবং ঋত্বিকের সবচেয়ে বড় মিল, তাঁরা দুজনে স্বতন্ত্র ভাবে বাংলা চলচ্চিত্রকে যে-উচ্চতায় তুলে ধরেছেন তা আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। দুজনের মধ্যে দারম্নণ বন্ধুত্ব ছিল।

একটি মজার ঘটনা বলি, ১৯৬৫ সালের দিকে বাংলা মদ খাওয়া ধরলেন, এমনকি গোসল করাও ছেড়ে দিলেন। তাঁর এমন জীবনযাত্রার ফলে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হলেন।

এক রাতে ঋত্বিক বাড়ি ফিরছেন, ঠিক হেঁটে ফেরার অবস্থায় ও  নেই তখন। ট্যাক্সি নিলেন অথচ পকেটে টাকা নেই।

নেমে যাওয়ার সময় ড্রাইভার ভাড়া চাইল।

আমার কাছে টাকা নেই। তুমি এক কাজ করো, এখান থেকে  সোজা ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোডে চলে যাও। সেখানে গিয়ে দেখবে, একজন লোক দরজা খুলবে। বলবে ঋত্বিক ঘটক ট্যাক্সি করে ফিরেছে সঙ্গে টাকা ছিল না। ও টাকা দিয়ে দেবে।

সেই দীর্ঘকায় লোকটি যা শোনা যায়, সেবার এবং বারবার ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছিলেন। ঋত্বিক তাঁকে উত্ত্যক্ত করতেন, কিন্তু সেই ভদ্রলোক মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেন, ভারতবর্ষে সবচেয়ে ঠিকঠাক ক্যামেরা বসাতে জানে সেই মাতাল লোকটিই। অবশ্য শেষে যোগ করতেন, আমিও কিছুটা জানি। লোকটি আর কেউ নন! কিংবদমিত্ম সত্যজিৎ রায়!