জার্মান মহাকবি হাইনে : বাংলা অনুবাদে বাঙালির কাছে

প্রকৃতি চক্রবর্ত্তী

 

জার্মান কবি হেনরিখ হাইনের কবিতা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হওয়ার পরে বাংলা ভাষায়ও রূপামত্মর শুরম্ন হয়। বাঙালি কবিচিত্তে হাইনের কবিতা আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাই রবীন্দ্রনাথ থেকে অনুপম সেন পর্যমত্ম এ-কবির কবিতার আবেদন প্রবাদকেও ছাড়িয়ে যায়।

এক

হেনরিখ হাইনে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর ডুসেলডর্ফের এক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। হামবুর্গে নামকরা ধনী ছিলেন তাঁর কাকা সলোমন হাইনে। হাইনের ব্যবসায়ী পিতা পুত্রকে কমার্স পড়ার জন্য ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে কাকার তত্ত্বাবধানে হামবুর্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে পড়াশোনা কিছু সড়গড় হলে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন বন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন অগাস্টাস ভন শেস্নগেলকে। শেস্নগেল ছিলেন সাহিত্যের অধ্যাপক এবং জার্মান রোমান্টিসিজমের সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা। ১৮১৮-তে হাইনে যখন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন দর্শনের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন উইলহেম ফ্রিডরিখ হেগেলকে। তাঁকে বলা হয় জার্মান রোমান্টিসিজমের আত্মসমর্পিত উত্তরসূরি। হাইনের সাহিত্যভাবনায় যেমন শেস্নগেলের প্রভাব কম নয়, তেমনি তাঁর পরিপূর্ণ মানসগঠনে হেগেলও অবিস্মরণীয়।

হাইনের জন্ম হয়েছিল রোমান্টিক যুগের বিকাশ পর্বে। তাই সৌন্দর্যবোধ, প্রেম ও পরাজয়ের বেদনা, মোহময়তা রূপবৈচিত্র্য প্রভৃতি জার্মান রোমান্টিসিজমের অনুষঙ্গে বাঁধা পড়েছিল হাইনের যৌবনস্বপ্ন। তাঁর মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা কাতরতার মধ্যে রচিত দুঃখ-বেদনা ও কৌতুক প্রবণতায় ভরা অমর কবিতাগুলি রোমান্টিক যুগের সাফল্যের অবশেষ। অবশ্য অতি রোমান্টিকতা তিনি কখনো সমর্থন করেননি।

হাইনের কবিতা লেখার শুরম্ন যখন তাঁর বয়স ষোলো। ১৮২২-এ Youthful Sorrows নামে তাঁর একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। ব্যর্থ প্রেমের যত কষ্ট ছিল তাঁর মনে সমসেত্মর মধ্যে সবটুকু তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন তখনকার কবিতাগুলিতে। কিন্তু পাঠকের মনের সাড়া না পাওয়ায় সে-কাব্যটি সাহিত্যজগতে কোনো স্থান পায়নি। হাইনে পরাজয় মেনে না নিয়ে অনেক প্রস্ত্ততির পরে ১৮২৭-এ প্রকাশ করেন তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ Book of Songs। আর আগে প্রকাশিত Youthful Sorrows-এর কবিতাগুলি তিনি এই দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে আবার প্রকাশ করেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল হামবুর্গ থেকে। কি আশ্চর্য! Book of Songs প্রকাশিত হলে পুরো জার্মানি যেন আবেগে-উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। হাইনের আগে এমন করম্নণ, এমন মর্মস্পর্শী কবিতা জার্মানিতে যে আর কেউ লেখেননি। এ যেন ‘নিবিড় অমা তিমির হতে’ উদয় হলো পূর্ণচাঁদ। চোখের জলে ঝলমল করে উঠল জ্যোৎস্না। মুগ্ধ তরম্নণদের প্রাণমন Book of Songs-এর সুরের স্রোতে ভেসে গেল দূর সমুদ্রে। কবিতার এ-বই জার্মান কাব্যজগতে অভিনব যুবযাত্রার অভিজ্ঞান। বেদনাব্যথিত সকল মানব-হৃদয়ের ব্যাকুলতা যেন কবিতার ভাষা পেয়েছে এ-কাব্যে! ১৮২৭ থেকে ১৮৫২-এর মধ্যে কাব্যটির দশটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। কী বিপুল জনপ্রিয়তা!

Book of Songs-এর পরে ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর Pictures of Travel নামে গদ্যেপদ্যে রচিত একটি কাব্য। এ-কাব্যে ইংল্যান্ড ও ইতালি ভ্রমণের ওপর লেখা কবিতাগুলি বিশেষভাবে উলেস্নখ করা হয়েছে। তখন থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। জন্মভূমি জার্মানির জন্য যাঁর এত ভালোবাসা, তাঁকে জন্মের মতো ছেড়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তিনি চলে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে। শুধু জন্মভূমি নয়, এ-সময় জীবনের প্রতি আকর্ষণও তাঁর একেবারে কমে এসেছিল। ধীরে-ধীরে চলার শক্তিটুকু পর্যমত্ম হারিয়ে ১৮৪৮-এ তিনি শয্যা নিয়েছিলেন। জীর্ণ শরীর এবং ততোধিক হৃদয়ের কথা নিয়ে ১৮৫১-তে প্রকাশিত হলো তার Romancero কাব্যটি। কয়েক বছর পরে প্রকাশিত কাব্যে ১৮৫৩-১৮৫৪-তে লেখা কবিতাগুলি স্থান পেয়েছে। এরপরে লেখা সমসত্ম কবিতা Post Humous Poems নামে তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রম্নয়ারি প্রায় আট বছর রোগযন্ত্রণা সহ্য করে হাইনে মারা যান।

হাইনের অনেক গুণ ছিল। তিনি ছিলেন মনস্বী। স্বদেশ এবং স্বজাতির মতো প্রিয় তাঁর কাছে কিছু ছিল না। তথ্য ও তত্ত্বে তাঁর রীতিমতো আসক্তি ছিল। তিনি ছিলেন দর্শনের গভীর অনুরাগী। পড়েছিলেন আইনও। নাটক লিখেছেন, গদ্য রচনাও নেহায়েত কম নয়; কিন্তু তাঁর অন্য কোনো দিক ভক্ত পাঠককে তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। যেমন পেরেছে কবিতা। অর্থাৎ এ-পৃথিবীর মানুষের মনে তিনি কবি হিসেবে কেবল প্রতিষ্ঠিত হলেন। শুধু কবি হিসেবে। তাই তাঁর মৃত্যুর পরে ভক্তেরা কবিতারই অনুবাদে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিশেষ করে ইংরেজিতে তাঁর কবিতা অনুবাদের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন এডগার আলফ্রেড বাউরিং। তিনি মূল জার্মান ভাষা থেকে হাইনের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ১৮৬৬-তে বইটি লন্ডনের Bell and Daldy থেকে প্রকাশিত হয়। সে-অনুবাদটিতে স্থান পেয়েছে Book of Songs থেকে Posthumous Poems পর্যমত্ম কাব্যের বিভিন্ন কবিতা। বাউরিংয়ের আগেও একবার Book of Songs কাব্যটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছিল। কিন্তু বাউরিংয়ের প্রকাশের আগে থেকে বইটি ছাপা পাওয়া যেত না। বাউরিং সে-বইটি দেখেননি। বলা যায়, হাইনের মৃত্যুর দশ বছর পরে প্রকাশিত বাউরিংয়ের অনুবাদটিই জগৎজোড়া খ্যাতি লাভ করে।

 

দুই

প্রথম প্রকাশের পরে পাঠকপ্রিয়তার কারণে বাউরিংয়ের অনুবাদের বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আর সে-বইটি তখন বাংলার কবি ও কবিতা প্রেমিক তরম্নণদের কাছে অত্যমত্ম আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাঁরা হাইনের কবিতার ভক্ত হয়ে ওঠেন। সেরকম একটি বই হাতে এসেছিল তখনকার তরম্নণ কবি রবীন্দ্রনাথের। সে-বইটি থেকে তিনি প্রথম বাংলায় হাইনের কবিতা অনুবাদ করেন। ইংরেজি অনুবাদের আঠারো-উনিশ বছরের মধ্যে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজি, ইংরেজি থেকে বাংলায় হাইনের কবিতার আবেদন পৌঁছে যাওয়া সত্যিই চমকপ্রদ। অনেক পরে ১৯২৪-এ চীন ভ্রমণের সময় এক নৈশভোজের বক্তৃতায় এ-বিষয়ের উলেস্নখ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – I also wanted to know German Literature and by reading Heine in translation, ‘I thought I had caught a glimpse of the beauty there.’ তিনি উলেস্নখ না করলেও ধরা যায় সে-বইটি ছিল বাউরিংকৃত হাইনের কবিতার অনুবাদ। রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন তিনি হাইনের কবিতার সৌন্দর্য সামান্যই ধরতে পেরেছিলেন, তা হয়তো নয়। অনুবাদগুলি পড়লে তাঁর অমত্মরে যে হাইনের ডাক পৌঁছেছিল তা বেশ বোঝা যায়।

তিনি হাইনের Book of SongsPictures of Travel কাব্য থেকে মোট নয়টি কবিতার অনুবাদ করেন। Book of Songs থেকে পাঁচটি, Pictures of Travel থেকে চারটি কবিতার বাংলা অনুবাদ ১৮৮৫ সালের এপ্রিল সংখ্যা সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আগেই উলেস্নখ করা হয়েছে, হাইনে তাঁর Youthful Sorrows-এর কবিতাগুলি Book of Songs-এ অমত্মর্ভুক্ত করেন। ১৮১৭ থেকে ১৮২১-এ লেখা বেশিরভাগ কবিতার কোনো শিরোনাম ছিল না। সংখ্যা ছিল এগুলির পরিচয়ের সূচক। অনেকগুলি ছিল মাত্র চার লাইনে লেখা। ওইরকম একটি কবিতা Book of Songs-এর Youthful Sorrows অংশ থেকে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেন। হাইনের কবিতা –

First methought in my affliction,

I can never stand the blow –

Yet I did – strange contradiction!

How I did, ne’er seek to know.

রবীন্দ্রনাথ কবিতার প্রথম লাইনটি শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেন। ‘প্রথমে আশাহত হয়েছিনু’ – এ-নামে তাঁর অনুবাদ –

 

প্রথমে আশাহত হয়েছিনু

ভেবেছিনু সবে না এ বেদনা

তবু তো কোনোমতে সয়েছিনু

কী করে যে সে কথা শুধায়ো না।

এছাড়া Book of Songs-এর চারসংখ্যক কবিতা ‘িআঁখিপানে সবে িআঁখি তুলি’, চবিবশসংখ্যক কবিতা ‘স্বপ্ন দেখেছিনু প্রেমাগ্নি জ্বালায়’, বত্রিশসংখ্যক কবিতা ‘নীল বায়লেট নয়ন। দু’টি করিতেছে ঢল ঢল’ নামে কবি অনুবাদ করেন। হাইনের হৃদয়ের অমত্মহীন দুঃখের কঠিন দহনই এ-কবিতাগুলির যেমন, তেমনি কাব্যটিরও মূলভাব। রবীন্দ্রনাথ হাইনের শিরোনামসহ কোনো কবিতা অনুবাদ করেননি। আবার দীর্ঘ কবিতাও বাদ দিয়েছেন। কিন্তু হাইনের কবিপ্রতিভার পরিচয় রবীন্দ্রনাথের কাছে এমনভাবে ধরা পড়েছিল যে, মাত্র কয়েক লাইনের কবিতায় তিনি কবির বেদনাবিধুর হৃদয়টি সকলের কাছে সহজে তুলে ধরতে পেরেছেন। তিনি বোঝাতে পেরেছেন, Book of Songs-এর ‘গভীর রাগিণী’ উঠে বাজি বেদনাতে’।

Pictures of Travel কাব্য থেকে রবীন্দ্রনাথ সাতচলিস্নশসংখ্যক কবিতা ‘বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা!’, ঊনপঞ্চাশসংখ্যক কবিতা ‘তুমি একটি ফুলের মতো মণি’, পঞ্চাশসংখ্যক কবিতা ‘রাণী, তোর ঠোঁট দুটি মিঠি’, দুশো উনিশসংখ্যক কবিতা ‘বারেক ভালোবেসে যে জন

মজে’ – মোট চারটি কবিতা অনুবাদ করেন। এ কবিতাগুলিও সংখ্যা চিহ্নিত ছিল। Pictures of Travel কাব্যে হাইনের অপরিমিত জীবনযন্ত্রণার অভাবনীয় প্রকাশ ঘটেছে। এক নিবিড় ব্যথার সঙ্গে সে-কাব্যে অপর একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। তা হলো নিজেকে নিয়ে কৌতুক ও হাস্যরসের অবতারণা। কাব্যে এ-দিকটির স্রষ্টা হাইনে। নিজের কর্ম, মানুষের উপহাস, দুর্ভাগ্য, রোগের কষ্ট – এ সমসত্ম যে নিজের কাছেই হাসিঠাট্টার বিষয় হতে পারে, কবিতায় তা প্রথমে দেখালেন হাইনে। তাঁর ভক্তেরা অশ্রম্নসজল চোখেও যে হাসতে পারলেন, সে-কৃতিত্ব তাঁর। তাই তিনি শত-শত বছরের ব্যবধানেও কবিতাপ্রিয় মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার অসামান্য জাদুকর।

হাইনের জীবনে এত দুঃখ, এত বিষাদ নেমে এসেছিল কেন? তিনি নিজের জীবনের ওপর এক রকম বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন কেন, সে-কথা বলতে গিয়ে সবাই দু-দুটো ব্যর্থ প্রেমের কাহিনির উলেস্নখ্য করেছেন। তিনি প্রথম ভালোবেসেছিলেন অমালিকে। ১৮১৭-তে একেবারে তরম্নণ বয়সে। সে-ভালোবাসা স্থায়ী হয়নি। তিনি গভীর আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে তখন জীবন একেবারে অকিঞ্চিৎকর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অসাধারণ সব কবিতা রচিত হলো সে করম্নণ কান্নার উৎস থেকে। তরম্নণ রবীন্দ্রনাথ Book of Songs এবং Pictures of Travel থেকে এরকম কবিতার অনুবাদ করে হাইনের কবিমানসের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। এখানে Book of Songs থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া হলো।

হাইনের কবিতা –

My songs with poison and fainted

But how could it otherwise be?

My blossoming life thou hast poison’d

And made it hateful to me.

 

My songs with poison and fainted

But how could it otherwise be?

In my heart many serpents I carry

And thee, too, my dearest love thee.

আট লাইনের এ-কবিতাটির অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ, ‘গানগুলি মোর বিষে ঢালা’ নামে –

গানগুলি মোর বিষে ঢালা

কী হবে আর তাহা বই?

ফুটমত্ম এ প্রাণের মাঝে

বিষ ঢেলেছে বিষময়ী।

গানগুলি মোর বিষে ঢালা

কী হবে আর তাহা বই?

বুকের মধ্যে সর্প আছে

তুমিও সেথা আছ অয়ি।

And thee, too, my dearest love thee – হাইনের এ-হাহাকারের মধ্যে তাঁর সমসত্ম বেদনা ও পরাজয়ের দুঃখ ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ অনুবাদে সে-হতাশহৃদয়ের চিত্রটিই ফুটিয়ে তুলেছেন।

বছর কয়েকের ব্যবধানে হাইনে আবার ভালোবাসেন থেরেসাকে। অমালির ছোট বোন। দেখতে একেবারে অমালির মতো। হাইনের কথা সুধীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে দাঁড়ায় –

ভালো লেগেছিল ১৮১৭-তে

যে কিশোরীকে, সে হুবহু তোমার জোড়া,

আকারে প্রকারে এলানো খোঁপার স্রোতে,

তোমার মতোই অপরূপ আগাগোড়া

কবির ভালোবাসা আবার আবর্তিত হলো থেরেসাকে ঘিরে। কিন্তু এবারও তাঁদের সম্পর্ক অচিরে ভেঙে যায়। তার প্রথম কারণ হলো, হাইনের সঙ্গে থেরেসার বয়সের বিসত্মর ব্যবধান। দ্বিতীয়টি অমালির সঙ্গে থেরেসার চেহারার এত মিল যে তার মুখের দিকে তাকালে হাইনের মনে পড়ত প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বেদনা। ফলে থেরেসার সঙ্গে তাঁর ব্যবহার কখনো সহজ এবং সহৃদয় হয়ে উঠতে পারেনি। হাইনের কথা সুধীন্দ্রনাথের অনুবাদে –

তবু গূঢ় ক্ষেতে চোয়ায় স্মৃতির বিষ

তাকালে তোমার তরম্নণ মুখাবয়বে।

আর তৃতীয় যে-কারণটি ছিল ঘটনার নেপথ্যে তা হলো, হাইনের বোহেমীয় জীবনাচরণ। প্রথম প্রেমের ব্যর্থতায় হাইনের জীবনে যে বিষণ্ণ ঝড় বয়ে গিয়েছিল তার থেকে তিনি কোনোদিন মুক্তি পাননি। তার মধ্যে দ্বিতীয়বারও প্রেমের সার্থকতা আসেনি। এবার ক্ষোভের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠল পরিহাসপ্রিয়তা। নিজের ওপর এ-নিষ্ঠুরতায় অবাক হলো সবাই। রবীন্দ্রনাথ এরকম একটি কবিতা অনুবাদ করেছেন। হাইনের কবিতা –

He who for the first time loveth

Though his hopeless is a God!

But the man who hopeless loveth,

For the second time’s a fool,

I, a fool like this, and loving

Once more, with no love responsive;

Sun and moon, and stars are laughing

I, too, join the laugh and die.

 

রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ –

বারেক ভালোবেসে যে জন মজে

দেবতাসম সেই ধন্য,

দ্বিতীয়বার পুনঃপ্রেমে যে পড়ে

মূর্খের অগ্রগণ্য।

 

আমিও সে দলের মূর্খরাজ

দু’বার প্রেমপাশে পড়ি;

তপন শশী তারা হাসিয়া মরে

আমিও হাসি – আর মরি।

আপাত লঘু হাস্যরসের মর্মে দু-দুবার প্রেমের ব্যর্থতার একটি ক্ষত লুকিয়ে আছে। সেখানে বাইরের হাসির মধ্যে ভেতরে চোখের জল বাধাহীন হয়ে উঠেছে। বাধা মানেনি কবির আত্মধিক্কারও। হাইনের হৃদয়ের এই মর্মামিত্মক কষ্টই রবীন্দ্রনাথের তরম্নণ হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।

 

চবিবশ বছর বয়সে হাইনের কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর কবিতার আঙ্গিক বা গঠনশৈলীতে রবীন্দ্রনাথ বেশ প্রভাবিতও হয়েছেন। অনেক পরে তিনি যখন লেখন কিংবা স্ফুলিঙ্গ কাব্যের ছোট-ছোট কবিতা লেখেন তখন স্বভাবতই হাইনের এ-ধরনের কবিতার কথা মনে আসে। রবীন্দ্রনাথ ক্ষণিকা কিংবা  শেষের কবিতায়ই নিজেকে নিয়ে যে-রকম ঠাট্টা করেছেন, মূল কারণ এক না হলেও তা হয়তো প্রথম বয়সে তিনি হাইনের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। তখন হাইনের কবিতা তাঁর এত ভালো লেগেছিল যে, বাউরিংয়ের অনুবাদে মন ভরেনি। তিনি মূল কবিতাগুলি পড়ার জন্য জার্মান সংস্করণটি জোগাড় করেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি একজন জার্মান মিশনারি মহিলা পেয়েছিলেন, যাঁর কাছে চেষ্টা করে ভাষাটি শিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের অধ্যবসায়ের ফলটি মনে হয় সারাজীবনের সঙ্গী হয়েছিল। এই দুই কবির মধ্যে মিলও ছিল। দুজনেই মৃত্যুর কয়েকদিন আগে পর্যমত্ম কবিতা লিখেছেন। মৃত্যুর পরে দুজনেরই কবিতার বই বের হয়েছে। হাইনের Posthumous Poems এবং রবীন্দ্রনাথের শেষ লেখা

 

তিন

রবীন্দ্রনাথের অনেক পরে আবার হাইনের কবিতার অনুবাদ করেন ত্রিশোত্তর যুগের নিরেট আধুনিকমনস্ক কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি অন্য অনেক বিদেশি ভাষার কবির সঙ্গে জার্মান কবি হাইনের কবিতাও অনুবাদ করেন। তিনি জার্মান ভাষা জানতেন বলে মূল থেকে কবিতাগুলি অনুবাদের সুবিধে হয়েছে। শুধু হাইনের নয়, বিদেশি ভাষার কবিতা অনুবাদের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন – ‘যখন বিদেশী ভাষার কবিতার অনুবাদ আরম্ভ করি তখন আমার কোন মতের বালাই ছিল না, কর্ম প্রবর্তনা পেয়েছিলুম সাময়িক ভালো লাগা থেকে।’

আবার জার্মান ভাষার দশ অক্ষর দিয়ে আঠারো অক্ষরের বাংলা লাইন তৈরিও তার কাছে বেশ শক্ত মনে হয়েছিল। তাই তাঁর অনুবাদ হাইনের চেয়ে বিশ শতকের সাবলীল বাংলা কবিতা হয়ে উঠেছে। অন্যান্য অনুবাদ কবিতার সঙ্গে হাইনের কবিতাগুলি তাঁর প্রতিধ্বনি (১৯৫৪) কাব্যে প্রকাশিত হয়।

 

সুধীন্দ্রনাথ হাইনের Book of Songs, Pictures of Travel, Romancero প্রভৃতি কাব্য থেকে মোট ষোলোটি কবিতা অনুবাদ করেন। তিনি বাঙালির কানে ভালো লাগার মতো করে এদেশীয় ঐতিহ্য এবং উপমা, অলংকার ব্যবহার করেছেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। হাইনের Romancero কাব্যের ‘Imperfection’ কবিতা থেকে –

The haughty peacock has but ugly feet

A women may be witty and discreet

And yet like Voltaire’s Henriada may weary

Or be, like Klopstock’s Famed Messiss, dreary.

 

সুধীন্দ্রনাথের অনুবাদ –

শিখীর পেখম জবর হলেও বীভৎস পা তার।

শকুমত্মলা কালিদাসের কাব্যকলার সার,

তার ভনিতাও সকল সময় সহ্য হবার নয়।

কাদম্বরীর বিপুল বহর স্বতঃই জাগায় ভয়।

অনুবাদটি এতটাই স্বাধীন যে, হাইনের কবিতা বলে না জানলেও বোঝার কোনো অসুবিধে হবে না।

 

তিনি মূল জার্মান সংস্করণটি ব্যবহার করলেও বাউরিংয়ের ইংরেজি অনুবাদে তাঁর অনূদিত সমসত্ম কবিতা আছে। আর কে না জানে, বাউরিং মূলের প্রতি আমূল বিশ্বসত্ম। এমনকি মাত্রা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। তিনি বলেছেন, ‘Translated into the original meters’। তাই সুধীন্দ্রনাথের অনুবাদগুলি আলোচনার বেলায়ও বাউরিংয়ের অনুবাদের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ অনুবাদে হাইনের মতো কবিতার পঙ্ক্তি বিন্যাস ও আঙ্গিক বজায় রেখেছেন। কখনো কবিতার শিরোনাম দিয়েছেন নিজের পছন্দমতো। যেমন – Pictures of Travel কাব্যের সাতসংখ্যক কবিতাটির নাম দিয়েছেন ‘গোধূলি’। ‘Then came the mists of evening’-এর তিনি অনুবাদ করেছেন ‘আকাশ বাতাস গোধূলি মাখে’। তিনি প্রেম ও বিরহের পাশাপাশি হাইনের অন্য কবিতারও অনুবাদ করেছেন। জীবনসংগ্রামে পরাজিত হাইনে ব্যর্থতার গস্নানিতে কষ্ট পেয়েছেন। বুক ভেঙে গিয়েছে, মনোবল ভাঙেনি। সে মনোবলই তাঁর অস্ত্র। Romancero কাব্যের কবিতা যখন লিখছেন তখন তাঁর রোগজর্জর শরীর। চলার শক্তিটুকুও নেই। সে-সময় রচিত হয়েছে তাঁর কবিতার অমর পঙ্ক্তিমালা –

A post is vacant! All my wounds are gaping

One falls the other follows in his wake,

Unvanquish’d fall I from my hand escaping

My arms break not, my heart alone douth

break

‘আত্মপরিচয়’ নামে এ-কবিতা সুধীন্দ্রনাথের অনুবাদ –

অনাথ দূরামত্ম দুর্গ; রক্তগঙ্গা আহত প্রহরী।

বন্ধুরা নিহত, কিংবা অগ্রগামী; নচেৎ বিমুখ

মরণেও অপরাসত্ম, অবশেষে খাতে টলে পড়ি,

ভাঙেনি আমার অন্ত্র, শুধু জানি ফেটে গেছে বুক।

সুধীন্দ্রনাথের অনুবাদ সহজ সৌন্দর্যে ও বাংলা কবিতার স্বচ্ছন্দ প্রবহমানতায় সমর্পিত। তবে দুরূহ কঠিন এবং অপ্রচলিত শব্দের প্রতি তাঁর যে-আকর্ষণ অনুবাদেও তিনি তার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি হাইনের দীর্ঘ কবিতাগুলি বেশ কয়েকটি অনুবাদ করেছেন। তার মধ্যে শিরোনামসহ কবিতাও আছে।

 

চার

শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন হাইনের কবিতা অনুবাদে মনস্থ করেন তখন তিনি শুধু প্রেমের কবিতার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। তাঁর অনুবাদে মাঝে মাঝে হাইনের দেখা যাওয়া যায়। তবে তিনিই বাংলায় হাইনের কবিতা সবচেয়ে বেশি ভাষামত্মর করেছেন। মোট ঊনপঞ্চাশটি। Book of Songs কিংবা Pictures of Travel থেকেও তিনি বেশি কবিতা অনুবাদ করেছেন Romancero কাব্যের। তিনি শিরোনামসহ কবিতা যেমন অনুবাদ করেছেন, তেমনি শিরোনাম ছাড়াও। তবে তাঁর অনুবাদে কখনো মুন্শিয়ানা দেখা গেলেও সবসময় তাঁর সেরকম মনোযোগ দেখা যায় না। Book of Songs থেকে চার লাইনের একটি কবিতার রূপামত্মর করেছেন তিনি। এ-কবিতা রবীন্দ্রনাথও অনুবাদ করেছেন। আগে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ প্রসঙ্গে ইংরেজিসহ কবিতাটির উলেস্নখ করা হয়েছে বলে এখানে শুধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদটি তুলে দেওয়া হলো। তিনি কবিতাটির নাম দিয়েছেন ‘নষ্ট’।

নষ্ট হতে বসেছিলাম হতাশা নৈরাশায় –

এর চেয়ে আর কষ্ট কোথায়? এমনই অসহ্য।

সহ্য করতে পেরেছিলাম, করেছি অদ্যপি –

জিজ্ঞাসা করো না, আমি কীভাবে করছিলাম।

এ অনুবাদে হাইনের কবিতার আমত্মরিক যত্ন ও গাম্ভীর্য খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে অতুলনীয় রবীন্দ্রনাথের এ-কবিতার অনুবাদ। ভাষা, ছন্দ এবং পঙ্ক্তিবিন্যাসে কবিতাটি অনুবাদেও অসাধারণ।

Romancero কাব্যের যে-কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ ‘গোধূলি’ নামে অনুবাদ করেছেন, শক্তি চট্টোপাধ্যায় তার নাম দিয়েছেন কবিতাটির প্রথম লাইন নিয়ে ‘জেলে বুড়োর ঘরের পাশে’। এ- কবিতাটির বিষয়বস্ত্ত হলো একজন বুড়ো জেলের নাবিক জীবনের রোমাঞ্চকর গভীর অনুভব। সেদিক থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার নামকরণটি সঠিক। তাঁর এ-অনুবাদটিও ভালো হয়েছে। হাইনের ভাবটি তিনি ধরতে পেরেছেন। একটি উদাহরণ দিলে তা বোঝা যাবে। হাইনের কবিতা –

 

The air on the Ganges is balmy

And giant trees extend

And fair and silent mortals

Before the lotus bend

 

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ –

গঙ্গানদীর পাড় ভরে গাছ

দাঁড়িয়ে যেন দত্যি দানো

পদ্ম ফোটার সময় ওরা

প্রণাম করে তাও কি জানো?

এ-সত্মবকটির বাংলা করেছেন সুধীন্দ্রনাথ –

স্রোতে প্রতিভাত লক্ষ মালিক

মত্ত মলয় বকুলবনে।

গঙ্গার তীরে সৌম্যপুরম্নষ

সমাধিমগ্ন পদ্মাসনে।

 

সুধীন্দ্রনাথ যেন হাইনের কবিতা-অবলম্বনে স্বতন্ত্র একটি কবিতা রচনা করেছেন। অন্যদিকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদটি প্রায় মূলের অনুসারী। তবে তিনি সবসময়ে হাইনেকে সেভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি।

 

পাঁচ

হাইনের মোট চারটি কবিতা অনুবাদ করেছেন অনুপম সেন। তিনি বাউরিংয়ের অনুবাদটি নয়, ব্যবহার করেছেন অন্য একটি অনুবাদ। তবে তাঁর অনূদিত তিনটি কবিতা বাউরিংয়ের ইংরেজি অনুবাদে আছে। অন্যটি অনুবাদক তাঁর বইয়ে তুলে দেওয়ায় পাঠকের আর কোনো অসুবিধে হয় না। অনুপম সেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনেক কবির কবিতা অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুবাদের একটি বৈশিষ্ট্য যে, তিনি অনুবাদের পাশাপাশি উৎস-কবিতাটিও উলেস্নখ করেন। চারটি কবিতার মধ্যে একটি ছাড়া বাকি তিনটিতে হাইনেকে নতুন করে পাওয়া যায়। ‘New Spring’ নামে কবিতাটির মূলে কোনো শিরোনাম ছিল না। ইংরেজি অনুবাদক যে-নাম দিয়েছেন কবিতাটির অনুবাদে তা ব্যবহার করেননি অনুপম সেন। কবিতার একটি লাইনকেই তিনি শিরোনাম করেছেন। শুধু এই একটি কবিতায় হাইনের নৈরাশ্যের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। অন্য তিনটি কবিতা ভিন্নধর্মী।

এ ভিন্নধর্মী কবিতাগুলিতে তখনকার জার্মানির সামাজিক সংকট, সমস্যা, অবক্ষয় আর রাজনৈতিক অবস্থায় কথা আছে। হাইনে ছিলেন গভীরভাবে জীবন ও সমাজমনস্ক কবি। তাই সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা সমাজ সংসার সবকিছুই তাঁর কাছে জীবনের অমত্মর্গত। কোনোটিকে এড়িয়ে চলার উপায় নেই। সেই গভীর জীবনবোধ ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়। অনুপম সেন হাইনের দেশ, রাষ্ট্র ও সমাজভাবনাপূর্ণ কবিতাগুলি অনুবাদ করে এক অজানা হাইনেকে সকলের সামনে নিয়ে এসেছেন। একশ ষোলো বছর ধরে এই দেশে এমনকি হাইনের নিজের দেশেও তিনি যেভাবে প্রিয় ও পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তার থেকে আলাদা এক কবিকে সামনে এনেছেন অনুপম সেন। একফোঁটা শিশিরের ওপর যেন বিশাল আকাশের প্রতিবিম্ব। সম্পূর্ণ, স্বতন্ত্র, সুন্দর এবং অসীম। ইউরোপীয় রেনেসাঁস, রিফরমেশন ও জার্মানির রোমান্টিক আন্দোলন সম্পর্কে অনুপম সেনের ধারণা খুবই স্পষ্ট। তাঁর অনুদিত চারটি কবিতার প্রথমটিতে জার্মান রোমান্টিকতা সম্পর্কে হাইনের মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। এক সময় জার্মানিতে রোমান্টিকতা এমন সর্বনাশা রূপ লাভ করেছিল যে, সেখানে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। বিশেষ করে Sorrows of Young Werther (1774) বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর। আতঙ্কিত ডেনমার্ক এবং নরওয়েতে বইটি কিছুদিনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এরকম বিপজ্জনক প্রবল আবেগ থেকে জার্মানিকে মুক্ত থাকার কামনা করেছেন হাইনে। ‘Sing and Praise Freedom’ কবিতায় তাঁর এই ইচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে। তিনি চেয়েছেন সংগীতে রণ-উন্মাদনা যা ফরাসি বিপস্নবের সময় গণসংগীতে সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু রোমান্টিকতার চর্চা নয়, দেশ ও মানুষের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসাই মানুষকে সত্যিকার মুক্তি দিতে পারে। তারই সাধনা করা মানুষের কর্তব্য। স্বদেশ এবং স্বজাতির প্রতি এটিই ছিল হাইনের বার্তা। স্বাধীনতার গানে মানবসত্তার গভীর উদ্বোধন কামনা করেছেন তিনি। অনুপম সেন হাইনের এ গভীর দেশপ্রেমমূলক কবিতাটি অনুবাদ করেছেন।

হাইনের কবিতা –

 

German Singer! Sing and Praise German

Freedom, Let

your song take possession of our souls inspire

us to deeds as the Marecillaise does.

 

অনুপম সেনের অনুবাদ –

 

হে গায়ক জার্মানির! গাও তুমি স্বাধীনতার গান।

তোমার কণ্ঠের গান সত্তারে জাগাক অবিরত

কর্মে কর্মে খুঁজে যেন পাই মুক্তির প্রেরণা

মার্সেইর সঙ্গীতের মতো।

 

অনুপম সেন যখন কবিতার অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন, তখন দেশবাসী যেভাবে মানবতা-লাঞ্ছিত হয়েছিল তার থেকে মুক্তির জন্য এ-কবিতার ভিতর যে-আহবান আছে তা হয়তো তাঁর কাছে একটি উপায় মনে হয়েছিল। কামনা করেছিলেন দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও প্রীতির বিস্তার।

হাইনে যখন বলেন –

Blowing our, thunder daily, until the last oppressor

Flees-point your song in this direction, but

keep your words as general as possible.

 

 

অনুপম সেনের অনুবাদে তার দৃপ্ত প্রতিধ্বনি শোনা যায় –

 

বিদ্যুতের ভীষণ আঘাতে কাঁপাও পৃথিবী

ধ্বংস কর, হত্যা কর,

গাও মহাপ্রলয়ের গান

তোমার কণ্ঠের বজ্রধ্বনি

ছিন্ন করে উড়াক অম্বরে

শেষ অত্যাচারীর নিশান।

অনুপম সেন Book of Songs-এর We have thirtysix Rulers কবিতাটি অনুবাদ করেছেন। এ-কবিতায় হাইনে চেয়েছেন রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামমত্মবাদের অপশাসনের অবসান। রোমান সাম্রাজ্যের পতন ও জার্মান রাষ্ট্রের আবির্ভাব-সময়ে জার্মানিতে একটি নতুন সমাজব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। এ সমাজব্যবস্থাই সামমত্মতন্ত্র।  জার্মানরা তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য ছাড়েনি বটে কিন্তু তারা বিজিত জাতিগুলির রীতিনীতি ও শাসনপদ্ধতি গ্রহণ করে। হাইনে তা পছন্দ করেননি। তাঁর মনে হয়েছে প্রতিটি ঐতিহাসিক যুগের আছে নিজস্ব সহজাত মূল্য ও স্বতন্ত্র তাৎপর্য। আর প্রত্যেক জাতিরই আছে একামত্ম স্বাভাবিক জীবনদৃষ্টি। সেজন্য We have thirty six Rulers কবিতায় স্বজাতির প্রশংসাসূচক জীবনগাথা রচনা করেছেন। জার্মান জাতির গৌরবময় বৈশিষ্ট্যের উলেস্নখ করে তিনি লিখেছেন –

 

We sleep just as Brutus slept but he awake

and

buried the cold knife deep in

Caesar’s breast! The Romans were great

devourers of Tyrants

 

এ কবিতাটির অনবদ্য অনুবাদ করেছেন অনুপম সেন।

 

‘আমাদের ছত্রিশজন শাসক আছে’ – এ-নামে অনুবাদটির প্রথম সত্মবকের উলেস্নখ করা হলো –

আমরা ঘুমোই যেভাবে ব্রম্নটাস ঘুমিয়েছিল, কিন্তু সে জেগে

উঠেছিল

এবং তার ঠান্ডা ছুরিটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল সিজারের বুকের

গভীরে।

রোমানরা ছিল স্বৈরাচারীদের বিরাট রাহু।

 

রোমের সিনেট অধিবেশন চলাকালে ব্রম্নটাস ও কেসিয়াসের ছুরির আঘাতে জুলিয়াস সিজারের মৃত্যু হয়। হাইনের কাছে এ-ঘটনাটি অমানবিক এবং নিষ্ঠুরতার চূড়ামত্ম মনে হয়েছিল। তিনি তাঁর কবিতায় বিষয়টি সেভাবেই উলেস্নখ করেছেন। এ-কবিতা অনুপম সেনকে খুব আলোড়িত করেছে। সিজারের হত্যার মধ্য দিয়ে তিনি হয়তো ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনকের নৃশংস হত্যার ছায়া দেখেছেন। হাইনে যেমন অপশাসনের অবসান চেয়েছেন, অনাকাঙিক্ষত হত্যা নয়, তেমনি অনুপম সেনও শামিত্ম, কল্যাণ, মানবতার বিকাশ, দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং স্বাধীনতার সমুন্নতি কামনা করেছেন কিন্তু মানতে পারেননি প্রিয় নেতার হত্যা। এ-কবিতার অনুবাদে অনুপম সেনের এ-ভাবেরই যেন প্রকাশ ঘটেছে। হাইনে সব সময় নির্মমতার প্রতি নিরাসক্তি ও জার্মান জাতির ইতিহাস, ঐহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তাঁর অসহিষ্ণুতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে যখন তিনি রোমানদের গলাকাটার জাতি বলে উলেস্নখ করেছেন। অনুপম সেন অনুবাদে হাইনের কবিতার অনালোকিত একটি দিকের ওপর আলোকপাত করে এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন।

তাঁর অনূদিত তৃতীয় কবিতাটি হাইনের প্রেমের কবিতা।  Book of Songs-এর এ-কবিতায় নববসমেত্মর আনন্দের মধ্যেও স্বপ্নে ছড়িয়ে পড়ে বেদনার বিষণ্ণ সুর। হাইনের বিরহের কবিতার বিষাদময় রূপকল্প অনুবাদেও উপস্থিত। ইংরেজি শিরোনাম ব্যবহার না করে অনুবাদক কবিতার একটি লাইনকে শিরোনাম করেছেন, ‘না থাকুক সখ্য আননে’। তাতে নতুন বসমেত্মর উচ্ছ্বাসের মধ্যেও ব্যথাজীর্ণ জীবনসম্ভাবনা জেগে ওঠে। একটি লাইনে পুরো কবিতার মোটিভ তুলে ধরার এ-কৃতিত্ব অনুপম সেনের। তিনি কবি বলেই তাঁর পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে।

সমাজতাত্ত্বিক দার্শনিক অনুপম সেন-অনূদিত চতুর্থ কবিতা হলো হাইনের সময়ের জার্মানির সমাজবাসত্মবতার নিরিখে লেখা। কবিতাটির ইংরেজি শিরোনাম বাউরিংয়ের অনুবাদে Degeneracy। Book of Songs-এর কবিতা। অনুপম সেন ব্যবহৃত অনুবাদে শিরোনাম Degeneracy। এ কবিতায় জার্মানির অধঃপতিত সমাজের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘অধঃপাত’ নামে কবিতাটির অনুবাদ করেছেন।

হাইনের কবিতা –

 

Has nature too grown bad, and is she

adopting

human faults? It seems to me that plants

and animals now tell lies like every one else.

 

অনুপম সেন ‘ক্ষয়’ নামে কবিতাটির অনুবাদ করেছেন –

প্রকৃতি কি হয়েছে খারাপ

নিয়েছে কি মানুষের পাপ?

মানুষেরই মতো আজ মিথ্যে বলে

গাছ ফুল জন্তু জানোয়ার?

তখনকার সমাজ পরিবেশের আয়না কবিতাটি। সমাজের ক্ষয়িষ্ণু রূপের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এখানে। সত্য, ন্যায়-নীতি ও আদর্শের যে সকল ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটেছে হাইনে এ-ব্যাপারে ছিলেন অতিমাত্রায় সচেতন। তাঁর দেশ ও সমাজভাবনা কেউ যেন সেভাবে লক্ষই করেনি। কিন্তু একজন সমাজবিজ্ঞানীর তা নজর এড়ায়নি। তিনি হাইনের কবিতার এদিকটি লোকচক্ষু গ্রাহ্য করে লোকমানসে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এক কথায় অনুপম সেনের অনুবাদ হাইনে সম্পর্কে প্রচলিত ধারণায় পরিবর্তন এনেছে। এখানেই অনুপম সেনের স্বাতন্ত্র্য। তাঁর অনুবাদ সংখ্যায় নয় মূল্যবোধে আলাদা, গুণে অনন্য।

 

ছয়

রবীন্দ্রনাথ যখন হাইনের কবিতা অনুবাদ করেন, তখন তিনি উনিশ শতকের কবি ভাষার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির প্রচলিত মুখের ভাষাও ব্যবহার করেন। বশিষ্ট ও বিশ্বামিত্রের বিরোধের কাহিনিটি হাইনেকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। এ নিয়ে তাঁর ব্যঙ্গধর্মী পরিহাসমূলক একটি কবিতা আছে। Pictures of Travel থেকে এক অপূর্ব ভাষায় রবীন্দ্রনাথ সে-কবিতাটি অনুবাদ করেছেন।

বিশ্বামিত্র বিচিত্র এ লীলা!

দিবেরাত্রি আহার নিদ্রে ছেড়ে

তপিস্যে আর লড়াই করে শেষে

বশিষ্টের গাইটি নিলে কেড়ে।

 

তবে ছন্দের ক্ষেত্রে হাইনের Trochaic Hexameter-এর কাছাকাছি বাংলা ছন্দ ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। যেমন –

িআঁখি পানে যবে/ িআঁখি তুলি ৬+৪

দুখ জ্বালা সব/ যাই ভুলি ৬+৪

অধরে অধর/ পরশিয়া ৬+৪

প্রাণমন উঠে/ হরষিয়া ৬+৪

অন্যদিকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত Iambic Pentameter-এর কাছাকাছি পঞ্চমাত্রিক মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন –

হাতের সুখে/ ঢাকের কাঠি/ নেড়ে ৫+৫+২

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রাধান্য। একটি কবিতার ছন্দ উলেস্নখ করে তা বোঝানো যেতে পারে।

 

জাহাজ ডুবির গল্প/ কইছি ৮+২

ঝড়ের মধ্যে নাবিকি/ দিন ৮+২

উপর নিচ আকাশ ও/ জল ৮+২

 

আনন্দ ভয় তানপুরা/ বীণ ৮+২

অনুপম সেন যে ইংরেজি অনুবাদটি ব্যবহার করেছেন তা গদ্যছন্দে লেখা। তবে তিনি একটি মাত্র কবিতায় (আমাদের ছত্রিশজন শাসক আছে) গদ্যছন্দের ব্যবহার করেছেন। গদ্যছন্দ নির্মাণে তাঁর চমৎকার কৃতিত্ব দেখা যায় এ-কবিতায়। বাকি তিনটি কবিতা প্রবহমান অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লিখেছেন তিনি। একটি উদাহরণ –

হে গায়ক জার্মানির/ গাও তুমি স্বাধীনতা/ গান ৮+৮+২

তোমার কণ্ঠের গান/ সত্তারে জাগান অবিরত ৮+৮+২

কর্মে কর্মে যেন পাই/ খুঁজে মুক্তির প্রেরণা ৮+৮+০

মার্সেইর সঙ্গীতের মত। ৮+০

রবীন্দ্রনাথ অনুবাদে আধুনিক ভাষা, প্রচলিত এবং পরিশীলিত দুরকম শব্দাবলি ব্যবহার করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ কঠিন-কঠিন অপ্রচলিত শব্দের সঙ্গে কিছু লোকজ শব্দের ব্যবহার করেছেন। কোনো কোনো শব্দের স্রষ্টা তিনি নিজেই যেমন – বিস্ফুলিঙ্গ (প্রত্যাবর্তন), বিরঞ্জন (প্রমারা), নিদুটি (মহাকাব্য) ইত্যাদি। এরকম আরো আছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সুধীন্দ্রনাথের গুরম্নগম্ভীর ভাষা নয়, আগাগোড়া সত্তরের দশকের কলকাতার প্রচলিত ভাষারীতি ব্যবহার করেছেন। তবে বেশ সাধারণ কিছু শব্দের ব্যবহার আছে তাঁর অনুবাদে। সেরকম কয়েকটি উলেস্নখ করা গেল, কাঁকই, ছানছে (লোরেলাই : তাঁর গান), মুখচ্ছিরি (চোখের চাওয়া) গেরসত্মঘর (কারনেশনের গন্ধ) ইত্যাদি। অনুপম সেনের অনুবাদের ভাষা সাবলীল ও প্রাঞ্জল। তিনি একুশ শতকের কবিভাষা ব্যবহার করেছেন। তাঁর শব্দব্যবহার কাব্যধর্মী ও নিপুণ।

 

সাত

রবীন্দ্রনাথ থেকে অনুপম সেন পর্যমত্ম হাইনের কবিতার অনুবাদের মধ্যে একটি সমসাময়িক পরিবর্তন লক্ষ্যযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ হাইনের প্রেম পরিহাস ও গভীর বেদনাময় কবিতার অনুবাদ করেছেন। তখন এদেশের কবিতাপ্রিয় মানুষের কাছে তিনি এভাবেই পরিচিত ছিলেন। তার পঁয়তালিস্নশ বছর পরে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যখন হাইনের কবিতাকে বাংলা কবিতা করে তোলার চেষ্টা করেন, তখন তিনি কোনো একটি বিষয় নিয়ে কাজে হাত দেননি। তিনি ভিন্ন-ভিন্ন ভাবের কবিতা অনুবাদ করেছেন। সুধীন্দ্রনাথের অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় পঁচিশ বছর পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আবার হাইনের প্রেমের কবিতা অনুবাদ করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের তেইশ বছর পরে প্রকাশিত হয় অনুপম সেনের অনুবাদ। তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন হাইনের দেশ ও সমাজের প্রতি মনোযোগের বিষয়টি। দেখা যায়, অনুবাদকেরা তাঁদের সমসময়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। কোনো না কোনোভাবে সমকালের একটি ছায়া পড়েছে অনুবাদের ওপর।

হাইনের কবিতার বিশেষত্ব এই যে, তিনি দেশ-বিদেশের মনীষী, কবি, নিজের বন্ধু-বান্ধবী, কোনো ঘটনা, কোনো দেশের নদী (যেমন গঙ্গা), ফুল (যেমন পদ্ম) কিংবা গান (যেমন ফরাসি বিপস্নবের গণসংগীত) প্রভৃতির উলেস্নখ করেছেন। বাউরিং অনুবাদের সময় এসব উলেস্নখের উৎস নির্দেশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পর্যমত্ম এরকম পাদটীকা দেখা যায় না। অনেক পরে অনুপম সেনের অনুবাদে আবার তা দেখা যায়। তাঁর ব্যবহৃত বইটিতে না থাকলেও তিনি নিজে থেকে উলেস্নখ করেছেন।

কবি হিসেবে হাইনে ছিলেন অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী। জীবনের শেষদিকে তিনি তাঁর উদার কবিমন দিয়ে সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তিনি যেন ক্ষমা করে দিয়েছিলেন নিজেকেও। তাঁর জীবনব্যাপী দুঃখ, কষ্ট, হতাশা এবং গস্নানির যেন অমত্ম হয়েছিল। তাই তাঁর শেষদিকে লেখা কবিতাগুলি এক অপূর্ব স্বর্গীয় সুষমায় ম–ত। এ সমসত্ম কবিতার ভাব মন্ত্রের মতো সংহত ও সর্বব্যাপী। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, এ তাঁর ‘নূতন জন্ম’। এখানেই তিনি অতিক্রম করেছেন তাঁর কাল, জীবন ও দেশ। তিনি হয়ে উঠেছেন পৃথিবীর সকল দেশের, সকল কালের কবিতাপ্রিয় মানুষের কবি। কবিতার অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ থেকে অনুপম সেন তাঁর সে-বিশ্বজনীন অপরূপ আলোকোজ্জ্বল মূর্তি নির্মাণ করেছেন।

 

পরিশিষ্ট

কবি বিষ্ণু দে অনেক দেশের, অনেক ভাষার (যেমন জাপান, ফ্রান্স, চীন, ইংরেজি) কবির কবিতার সঙ্গে হাইনের কয়েকটি
ছোট-ছোট কবিতা অনুবাদ করেছেন। কবিতাগুলি অনুবাদের চেয়ে বেশি স্বাধীন।