মাহমুদ আল জামান
সোমনাথ হোর জন্মেছিলেন ১৯২১ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে। শৈশবে দেখা চট্টগ্রাম তাঁর হৃদয়ে অমোচনীয় হয়ে গেঁথে ছিল। একদিনের জন্য তিনি চট্টগ্রামকে ভোলেননি।
সোমনাথ তাঁর চিত্রভাবনা নামে ছোট্ট আত্মজীবনীতে লিখছেন – ‘কিছুদিনের মধ্যেই তেতাল্লিশ বা পঞ্চাশের মন্বন্তর এল। তখনই কমিউনিস্ট চিত্রশিল্পী চিত্তপ্রসাদের সঙ্গে যোগাযোগ হল। উনি আমাকে রাস্তায় রাস্তায় হাসপাতালে সঙ্গে নিয়ে হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন – কী করে ভুখা এবং অসুস্থদের ছবি অাঁকতে হয়। আমি কাঁচা হাতে তাই করতে লাগলাম। পার্টি থেকে রঙ তুলি কাগজ কিনে দেওয়া হল। আমি পোস্টারে দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে বন্ধুদের সহায়তায় গ্রামে গ্রামে দেখিয়ে এক নতুন ধরনের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লাম। কমিউনিস্ট পার্টির জেলা কমিটি খুব উৎসাহ দিল। কিছু কিছু ছবি ‘জনযুদ্ধ’ ‘পীপ্ল্স্ ওয়ার’-এ ছাপাও হল। গণনাট্য সংঘের গান, আমাদের পোস্টার তখনকার দিনে এক নতুন হাওয়া তৈরি করল। আমরা লঙ্গরখানা খুললাম। সরকারি সাহায্যের সঙ্গে আমাদের আন্দোলনপ্রসূত জনতার উদ্যোগ এবং প্রেরণা লঙ্গরখানা চালিয়ে নিতে প্রভূত সাহায্য করল। এসবের মধ্য দিয়ে আমি চট্টগ্রাম শহরে পার্টির সদর দপ্তরে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করলাম। ছবি অাঁকা, পোস্টার করায় আমার অসীম উৎসাহ। কিন্তু তখনও আমি মৌলিক রচনায় স্বচ্ছন্দ নই।’
কলকাতা আর্ট স্কুলে অধ্যয়নকালে সোমনাথ হোর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাছে আঙ্গিকগত শিক্ষা পেয়েছিলেন। কিছুদিন ছাপাই সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন রমেন চক্রবর্তী ও সফিউদ্দীন আহমেদের কাছে। এ নিয়ে সোমনাথ হোরের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য : ‘আর্ট স্কুলে আবেদিন সাহেবের কাছে হাত মক্সো করার কাজ শুরু হল। প্রথম বার্ষিকে ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা খড়ি দিয়ে রেখাপ্রধান ছবি করতাম; খুব মনোযোগ সহকারে অাঁকতাম; আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, ভালো ছবি করতে হলে করণকৌশল আয়ত্ত করতে হবে। আমাদের পূর্বসূরিদের কাজ দেখে নিজের অভাববোধ প্রকট হতো। কেবলই মনে হতো – অমন করে কবে অাঁকব? অাঁকতে পারব কি?’
কলকাতা আর্ট স্কুলে অধ্যয়নের আগে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের ও তেভাগা আন্দোলনের যে-ড্রইং প্রকাশিত হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র স্বাধীনতা পত্রিকায়, তা তাঁর মানসযাত্রাকে বহুমাত্রিক করে তুলেছিল।
তাঁর কৈশোর অতিবাহিত হয়েছিল চট্টগ্রামে। এই স্মৃতি তাঁর সৃষ্টিকে করে তুলেছিল গহনতাসন্ধানী ও প্রাণময়।
চট্টগ্রাম ও রংপুরে করা ড্রইং স্মরণীয়তার মূল্য পেয়েছে ঐতিহাসিক কারণে। এই পর্বে চট্টগ্রাম ও রংপুরের কর্মপ্রবাহ তাঁর সৃজনে নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। একদিকে ছিল নিচুতলার অধিকারহীন শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের জীবনকে শোষণমুক্ত করার অঙ্গীকার। অন্যদিকে নিজের শিল্পীসত্তায় এবং সৃজনে এই মানুষদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ ও কষ্টকে বিম্বিত করার দায়। মানুষের প্রতি মমতা ও দায়বোধই তাঁকে সমগ্র জীবন এক মহৎ শিল্পীর মতো তাড়া করে ফিরেছে। আমৃত্যু তিনি এ-দায় লালন করেছেন।
তাঁর লেখা তেভাগার ডায়েরি এদেশের কৃষক আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য বই, যা নানাদিক থেকে হয়ে উঠেছে খুবই তাৎপর্যময়। এ বইয়ে তিনি পরম মমতায় কৃষকদের আন্দোলন ও অন্যদিকে জোতদারদের নির্মমতার কথা উল্লেখ করেছেন। সঙ্গে ছিল কিছু স্কেচ। এই স্কেচগুলোই আমরা প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিলাম এ-বইয়ে।
তাম্রতক্ষণ, ভাস্কর্য, ছাপাই ছবি এবং ড্রইং যখন শিল্পমূল্যে, প্রকরণে ও শিল্পশৈলীতে অসামান্য হয়ে উঠেছে, তখনো তিনি এই মানুষজনকে উপজীব্য করেই তাঁর সৃজনাবেগকে আরো তীব্র ও তীক্ষ্ণ করে তুলেছেন। এই মানুষজনের মধ্যে যে-ক্ষত প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি, তা-ই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নানা মাধ্যমের কাজে। বিশেষত ব্রোঞ্জে করা কিছু কাজে সাধারণ মানুষের দহন ও যন্ত্রণা নানাভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর অভিজ্ঞতায় মানুষের জীবনের ক্ষত অমোচনীয় হয়ে গেঁথে গিয়েছিল। তাঁর শিল্পীসত্তায় এ হয়ে উঠেছিল সৃষ্টির উদ্যানে এক অবলম্বন। লাঞ্ছিত মানবতার নানামুখী ক্ষত প্রতিকারহীন যন্ত্রণার মতো হয়ে উঠেছিল এই বিবেকী শিল্পীর হৃদয় ও মনে। এই কাজগুলো নিয়েই নিভৃতে এবং কিছুটা প্রচ্ছন্নে তিনি সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেছেন। আর্ট কলেজে ভর্তির আগে এক দায়বোধ থেকে তাঁর সৃজনে প্রচারধর্মিতা প্রাধান্য পেয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁর কাজে শিল্পমুক্তির আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। সেজন্য বোধকরি তিনি আর কোনোদিন কোনো একটি বিশেষ গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চাননি। দারিদ্র্য, ক্ষুধা দেখেছিলেন পঞ্চাশ বছর আগে; এই প্রত্যক্ষণই তাঁর সৃষ্টির বিষয় হয়ে থাকে আমৃত্যু। মানবের ট্র্যাজেডি এবং ক্ষত তাঁর অন্তরে এমনভাবে প্রবেশ করে যা তাঁর জীবন, মনন ও সৃষ্টিতে ছাপ ফেলে যায়। দর্শকদের অশান্ত করে, আবার আমরা বিমোহিতও হই শিল্প-সৃষ্টির আধুনিক মনের প্রকাশে। এরকম দৃষ্টান্ত বোধকরি দ্বিতীয়টি নেই।
তাঁর সমাজ অঙ্গীকার প্রসঙ্গে গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি : সোমনাথদা আর রেবাদির সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার মাঝে গড়িয়ে গেল অনেকগুলো বছর। আমার বর্তমান দায়িত্বে যোগ দেবার পর আমার স্ত্রী তারা ও আমি সেবার প্রথম শান্তিনিকেতন গিয়েছি। ২২ জানুয়ারি ২০০৫ তারিখে আমার দিনলিপি বলছে : ‘সোমনাথ হোরের সঙ্গে সাক্ষাৎ। ৮৪-তে পৌঁছে তিনি অশক্ত, কিন্তু মন ও কথাবার্তা স্বচ্ছ। পোখরান ২-এর ঘটনাকে স্মরণ করে তাঁর করা কালোব্রোঞ্জের একটি ভাস্কর্য দেখালেন। একটি মানুষ, একটি কুকুর, একটি গাছ ও একটি পাখি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে – সকলেই মৃত – আণবিক শৈত্যে মৃত্যু হয়েছে ওদের। অনির্বচনীয় এর শক্তি, একটি মাস্টারপীস! মহান শিল্পীদের মধ্যে তুলনা করার আমি কে, কিন্তু আমার মনে হয় এই কাজটি পিকাসোর গ্যের্নিকার থেকেও এগিয়ে রয়েছে। আমি মনে করি এটি জাতিপুঞ্জের সংগ্রহ করা উচিত। আণবিক পরিকল্পনার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে উনি বললেন, ‘আমরা উন্মাদ হয়ে গিয়েছি।’
পরবর্তীকালে সোমনাথ হোর তাঁর বহুমাত্রার সৃজনধারার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের একজন আলোচিত শিল্পী হয়ে উঠলেও তিনি প্রচারবিমুখতাকে এড়িয়ে চলেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালি যেভাবে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হয়েছিল তা সোমনাথ হোরকে বিচলিত করেছিল। ব্রোঞ্জে করা ভাস্কর্য তাঁর অভিব্যক্তি ও বাংলাদেশের মানুষের অসম সাহসী যুদ্ধের এ এক আলেখ্য হয়ে আছে।
সোমনাথ হোরের জীবনের উজ্জ্বল ও পরিণত সময় শান্তিনিকেতন পর্ব। কলাভবনে তিনি শিক্ষকতা করেন, একই সঙ্গে নিভৃত সৃজনে এমন কিছু ফসল ফলিয়েছেন, যা সর্বার্থে হয়ে উঠেছিল শিল্প-অভিব্যক্তি ও বৈশিষ্ট্যে অনন্য।
শান্তিনিকেতনে তিনি ক্ষত সিরিজে কিছু ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য করেন। এসব সৃষ্টি শিল্পমূল্যে অসামান্য কাজ বলে বিবেচিত হয়েছে। নিভৃতে তিনি এসব কাজ করেছেন। এই ব্রোঞ্জের কাজগুলো তাঁকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যায়।
ভারতবর্ষের শিল্প-আন্দোলনের ইতিহাসে এই অনন্য মানুষটির কোনো তুলনা নেই।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.