আমার আব্বার স্মৃতি : তাঁর গান, বই আর লেখার জগৎ

তীব্র আলী

রক্ত আর মাংসের একজন মানুষ যখন আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যান তখন তাঁর স্মৃতি আমরা কীভাবে বাঁচিয়ে রাখব?

বিস্মৃতির অবধারিত অগ্রযাত্রার মুখে পরাজিত হয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভালোবাসাও। পরাজিত হতে হয় স্মৃতিতে ধরে রাখার দৃঢ়তম সংকল্পকে।

কিট্স্ (Kitsch) – এই শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো, কোনো চিত্রকলা বা শিল্প যা অগভীর, ভানপূর্ণ ও অসার।
চেক-ফরাসি ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা তাঁর এক উপন্যাসে বলেছিলেন, – ‘(আমাদের মৃত্যুর পরে) আমরা বিস্মৃত হয়ে যাবার আগে আমাদেরকে কিট্স্-এ রূপামত্মরিত করা হবে। অসিত্মত্ব ও বিলুপ্তির মাঝখানের স্টেশনটি হলো কিট্স্।’  (‘Before we are forgotten, we will be turned into kitsch. Kitsch is the stopover between being and oblivion’)

কুন্ডেরা এখানে ‘কিট্স্’ শব্দটি তার আভিধানিক অর্থে ব্যবহার করেননি। অস্ট্রিয়ান সাহিত্যিক হারম্যান ব্রখের কাছ থেকে ধার করা এই শব্দে কুন্ডেরা বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষের জীবনের যে জটিল ঐশ্বর্য ও বহুমাত্রিকতা আছে তাকে একটি বা দুটি বিধিবদ্ধ সেস্নাগানে পর্যবসিত করার অপর নাম কিট্স্। অর্থাৎ ভালোবাসা আর স্মৃতির সবচেয়ে বড় শত্রম্ন বা নেমেসিস হলো কিট্স্।

আজকে আমাদের সম্মুখে সমস্যাটা এইরকম – আমি কীভাবে আমার বাবার স্মৃতিকে কিট্সে পরিণত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারি?

এই প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট উত্তর আমার কাছে নেই। শুধু আছে কিছু ছন্নছাড়া চিমত্মা আর অনুভূতি। আপনাদের সঙ্গে আজকে আমি সেই ছন্নছাড়া চিমত্মাগুলোই শেয়ার করতে চাই।

মরমি কবি জালালুদ্দিন রুমি তাঁর এক কবিতায় বলেছিলেন – ‘তুমি যা ভালোবাসো, তুমি তাই।’

আমার বাবার খোঁজে আমি তাই শুরু করছি সেখানেই – আমার বাবা যা ভালোবাসতেন তার কয়েকটা নিয়ে।

গান আর রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার আববার ভালোবাসা ছিল গভীর ও সীমাহীন। আমার ছোটবেলার প্রথম স্মৃতিগুলোর মধ্যে একটি চিমত্মা-প্রক্রিয়ার কথা এখনো আমার প্রায়ই মনে পড়ে। আমার বয়স তখন তিন কি চার। আববা হারমোনিয়ামে গান গাইছেন – ‘তোরা  যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’, আর আমি সেই গানের অর্থোদ্ধার করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ‘সোনার হরিণ’টি যে একটি প্রতীক তা বুঝতে আমার আরো অনেকদিন লেগেছিল। পরে, বড় হয়ে, আমি, আমার বেশ কিছু বন্ধু আর অনেক পাড়া-প্রতিবেশী আববার কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছি। আববাকে একবার বলতে শুনেছি যে, তিনি যদি আর অন্য কিছু না করে শুধু গানই করতেন তাহলেই সবচেয়ে সুখী হতেন।

তিনি যেসব পুরনো দিনের রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পীদের পছন্দ করতেন তাঁদের মধ্যে দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন অন্যতম। অসুস্থতার কারণে আববা তাঁর জীবনের শেষ কয়েক মাস বই পড়তে পারতেন না। তখন আমি তাঁকে দেবব্রত বিশ্বাসের বই ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীতের অংশ পড়ে শুনিয়েছি।

আববা ধার্মিক ছিলেন না। অথচ রবীন্দ্রনাথের প্রেম আর পূজার গানগুলো তিনি যে রকম দরদ দিয়ে গাইতেন, তাতে বোধ হতো যে, কোনো এক বিশ্ব-আত্মার সঙ্গে হয়তো তাঁর কোনো গূঢ় যোগাযোগ ছিল।

আমার বাবা, তাঁর প্রজন্মের অনেকের মতোই বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ আর সাহিত্যে তাঁর পরিচয়ের ভিত গেড়েছিলেন। আমি জানি না বাংলাদেশ আজকে তাদের সেই স্বপ্ন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে কি না, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে আববার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে রবীন্দ্রসংগীত শিখিয়েছিলেন। বিদেশবিভুঁইয়ে থাকার সময়ে আমার যখন পথহারা, দেশহারা লাগে তখন আমি অনেক সময়েই আববার শেখানো রবীন্দ্রসংগীতগুলো গাই – আর সঙ্গে সঙ্গে প্রায়ই উপলব্ধি করি যে, সেই গানগুলিই আমার কম্পাস, আমার আবাসভূমি। আববার কাছে শেখা রবীন্দ্রনাথের সেই গানগুলি আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে, আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।

আর্জেন্টাইন লেখক হোর্হে লুইস বোরহেস একবার বলেছিলেন যে, তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাদি ছিল তাঁর বাবার পাঠাগার।

আমিও আমার আববার বইয়ের সংগ্রহ সম্পর্কে একই কথা বলতে পারি। আমার বাবা বই খুব ভালোবাসতেন। সারাজীবন দেখেছি অফিস থেকে বাসায় এসেই, অফিসের কাপড় বদলেই, তিনি নিমগ্ন হতেন তাঁর বইয়ের জগতে। ছোটবেলায় মেহেদীবাগের ফ্ল্যাটের একতলায় হঠাৎ করে একদিন যখন বন্যার পানি এলো, আববার প্রথম চিমত্মা ছিল বইগুলোকে কীভাবে বন্যার পানি থেকে বাঁচানো যায়।

বহু বছর পরে আমি যখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অতি গরিব ছাত্র, তখন আমি ঘুরে বেড়াতাম ক্যামব্রিজ শহরের পুরনো বইয়ের দোকানে। খাওয়ার টাকা থাক আর না থাক, সিগারেট আর বই আমাকে কিনতে হতোই। সিগারেটের নেশা আমি অনেক আগে ছেড়ে দিয়েছি; কিন্তু বইয়ের নেশা ছাড়িনি, ছাড়ার চেষ্টাও করিনি।

বইয়ের প্রসঙ্গে আসায় আমি আববার একটি লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি না নিয়ে পারছি না। এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় কীভাবে বইয়ের মাধ্যমে তিনি প্রবেশ করেছিলেন জ্ঞান আর উদারচিমত্মার জগতে। উদ্ধৃতিটি ‘সব পাওয়া যাবে – জ্যাম-জেলি খাওয়ার নিয়মে’ লেখাটি থেকে :

স্কুলে পড়ার সময় (স্কুলের লাইব্রেরির) রেফারেন্স বই-টই নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামিয়েছি বলে মনে পড়ছে না। বইয়ে
থাকতে হবে অ্যাডভেঞ্চার (জুল ভার্নের ‘সমুদ্রতলে বিশ হাজার লিগ’), পাহাড় আর জঙ্গলের রহস্য (রাইডার হ্যাগার্ডের ‘রাজা সলোমনের খনি’), সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে সত্যের জয় (‘ছোটদের মার্চেন্ট অব ভেনিস’) ইত্যাদি। কল্পনার জগৎটাকে চোখের সামনে মেলে ধরতে পারে এমনসব বই। তারপর যতই দিন যেতে থাকে, আপনাআপনি পাঠকের উত্তরণ হয়ে যায় হালকা বইগুলো থেকে অন্য বইয়ের দিকে। পছন্দগুলো বদলে গিয়ে মন চলে যায় কাব্য-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সিরিয়াস বইয়ের দিকে। মোটকথা লাইব্রেরির বইগুলো বদলে দিয়েছিল আমাদের কালের অনেক ছেলেমেয়ের জীবন।

যখন ছোট ছিলাম আমি আববাকে জর্জরিত করতাম বিজ্ঞানবিষয়ক অগণিত প্রশ্ন দিয়ে। আববার পড়াশোনা ছিল আর্টসে আর ফিলোসফিতে আর হয়তো তাই সে-সময়ে তিনি যখন অফিসের কাজে গেলেন অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করতে, আমার জন্যে নিয়ে এসেছিলেন বাচ্চাদের পাঠ্য সায়েন্স আর টেকনোলজির এনসাইক্লোপিডিয়ার বিশ খ–র চমৎকার একসেট। এছাড়া যতদিন আমি দেশে ছিলাম তিনি আমার জন্য নিয়ে আসতেন বিজ্ঞানশিক্ষার বিবিধ জনপ্রিয় বই। আমি যে শেষ পর্যমত্ম বিজ্ঞানকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছি তার পেছনে আমার আববার ভূমিকাই সবচেয়ে বড়।

আমার এই বক্তব্য আমি শেষ করতে চাই আববার কলামনিস্ট হিসেবে মানবাধিকার আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি গভীর আস্থা সম্পর্কে একটি মমত্মব্য দিয়ে।

আমার আববার ছাত্রবয়সের বন্ধু সৈয়দ আহ্মদ হোসেন ছিলেন বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির (United Nations Association of Bangladesh বা UNAB) সেক্রেটারি জেনারেল। আহ্মদ চাচার কারণেই আববা অনেকদিন ধরে UNAB-এর বিবিধ প্রচারপত্র আর বইয়ের লেখা, অনুবাদ ও সংকলনের কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। আমার ধারণা, বহুদিনের এই নীরব শ্রমের ফলেই তাঁর সরকারি চাকরি-উত্তর জীবনের বিবিধ কলামে আর লেখায় দেখা যায় মানবাধিকার আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে এক বিশেষ স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি।

রাজনৈতিক দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের অধিকার লঙ্ঘনে সরকার আর বাঙালিদের ভূমিকা এই সবকিছুর বিরুদ্ধেই তিনি লিখেছেন তীক্ষন উপলব্ধিভরা অথচ সহজ, সাবলীল ভাষায় লেখা অনেক কলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সবচেয়ে উদার আর মহত্তম ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করতেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে কারো গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক দীর্ঘমেয়াদি মূল্য।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘গান হয়ে ডুবে যায় কোন কোলাহলে।’  আমি চাই না আমার বাবার স্মৃতি, তাঁর গান, ডুবে যাক আমাদের প্রগলভ কোলাহলে।