অদ্বৈত মল্লবর্মণ : প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক

রহমান হাবিব
অদ্বৈত মল্লবর্মণকে (১৯১৪-৫১) পাঠক-সাধারণ কথাসাহিত্যিক হিসেবেই জানেন। তিতাস একটি নদীর নাম শীর্ষক প্রাকৃত ও লোকজীবন ঘনিষ্ঠ উপন্যাসের নিপুণ রচয়িতা হিসেবেই তিনি সুখ্যাত। উৎপল দত্ত এবং ঋত্বিক কুমার ঘটকের শিল্পশৈলীর সৌজন্যে এই উপন্যাসটির নাট্য (১৯৬৩) ও চলচ্চিত্ররূপের (১৯৭৩) কারণেও তিনি কথাকার হিসেবে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করে আছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর উপন্যাসটির শিল্পগুণ ও জীবন চিত্রায়ণের গভীরতর বোধের কারণেই কালজয়িতা অর্জন করেছেন। স্মর্তব্য যে, অদ্বৈত মল্লবর্মণের চারটি ছোটগল্প রয়েছে। গল্পগুলো হলো : ‘সন্তানিকা’, ‘কান্না’, ‘বন্দী বিহঙ্গ’ এবং ‘স্পর্শদোষ’। ‘বিদেশি নায়িকা’, ‘শুশুক’, ‘যোহার গান’, ‘ধারা শ্রাবণ’, ‘মোদের রাজা মোদের রাণী’ এবং ‘ত্রিপুরালক্ষ্মী’ নামে তাঁর ছয়টি কবিতাও রয়েছে। তিতাস একটি নদীর নাম শীর্ষক সুনামখ্যাত উপন্যাস ব্যতীত ভারতের চিঠি – পার্ল বাককে রচনাটিকে উপন্যাস না ধরলেও তাঁর আরো তিনটি (জীবন-তৃষা, রাঙামাটি, শাদা হাওয়া) শিল্পসফল উপন্যাস রয়েছে। উল্লেখ্য, তাঁর রচনাবলিতে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও আলোচনা শিরোনামে ২৪টি প্রবন্ধও রয়েছে। অচিন্ত্য বিশ্বাস-সম্পাদিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্র (কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ২০০০) অবলম্বনে আমি বর্মণের প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যসমালোচক দৃষ্টিভঙ্গিকে এ-প্রবন্ধে উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছি।
বর্মণের প্রবন্ধের মধ্যে চিত্রকলা, শিল্পকলা এবং ঋতু বিষয়ক প্রবন্ধ যেমন রয়েছে; তেমনি টিএস এলিয়ট এবং রোকেয়া-সম্পর্কিত তাঁর মূল্যায়নও প্রত্যক্ষযোগ্য। পল্লীগীতি, বাউলসংগীত, পালাগান, নাইওরের গান, পুতুল-বিয়ের ছড়া এবং বারোমাসি বিষয়ক বিভিন্ন লোকসংগীত সংকলনকে আমি প্রবন্ধ হিসেবে অভিহিত করতে চাই এজন্যে যে, তিনি শুধু এ-পল্লীগীতিকাগুলো সংকলন ও সংগ্রহই করেননি; বরং এই গীতিকাগুলো সম্পর্কে (শুধু অপ্রকাশিত বাউলসংগীত বাদে) মতামত, মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণও তাঁর গীতিকাসমূহে উপস্থাপিত করেছেন। বর্মণের প্রবন্ধসমূহকে আমি বিষয়নির্ভর, লোকসংগীতভিত্তিক এবং সাহিত্য সমালোচনামূলক – এই তিন ভাগে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করেছি।
উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের দেশে অনেক প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক রয়েছেন। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং প্রবল গভীর প্রাজ্ঞতাসম্পন্ন প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচকের সংখ্যা আমাদের দেশে খুবই কম। অদ্বৈত মল্লবর্মণের জৈবনিক অন্তর্দৃষ্টি, মূল্যায়ন-ক্ষমতা এবং মানুষের ও মানবতার জন্য মমত্ববোধ যে কত গভীর, তা তাঁর প্রবন্ধাবলি বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করি। প্রবন্ধ ও সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রেও বাংলা সাহিত্যে তিনি তাঁর কথাসাহিত্যের মতোই কালজয়ী আসন পেতে পারেন বলে আমি মনে করি।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের বিষয়নির্ভর প্রবন্ধ
বর্মণের প্রবন্ধরাজিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছি। তাঁর বিষয়নির্ভর প্রবন্ধের মধ্যে আমি তাঁর ‘নাটকীয় কাহিনী’ ‘প্রাচীন চীনা চিত্রকলার রূপ ও রীতি’, ‘ছোটদের ছবি অাঁকা’, ‘আম্রতত্ত্ব’, ‘বর্ষার কাব্য’ এবং ‘এদেশের ভিখারী সম্প্রদায়’কে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। ‘সাগর তীর্থে’ রচনাটিকে আমি ভ্রমণধর্মী প্রবন্ধ হিসেবে অভিহিত করতে চাই। জীবনের বিস্ময়বোধ ও মানবিকতা এবং ধর্মগত অনুধ্যানময় গভীরতার কথা এতে অভিব্যক্ত হয়েছে। মহামুনি কপিল যে তাঁর ‘তেজোদ্ভাসিত বদনমন্ডলে তপের কঠোরতা মাখিয়ে সগর্বে পদচারণা করে ধ্যানের আসনে গিয়ে বসতেন’ (অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্র, পৃ ৩৮) এবং ‘অসীম নিঃসঙ্গতার মধ্যে বসে তিনি ধ্যানের গহনতায় ডুব দিতেন’ (ওই, পৃ ৩৮), তা তিনি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে এই প্রবন্ধটিতে উল্লেখ করেছেন। এতে লেখকের অন্তর্দৃষ্টির ধ্যানময়তা স্রষ্টাকেন্দ্রিক অনুভাবনার সঙ্গে নিবিড়তায় সম্পর্কিত হয়েছে বলে আমি মনে করি।
‘নাটকীয় কাহিনী’ রূপটি বর্মণ কার্ল কাপেকের একটি লেখা অবলম্বনে রচনা করেছেন। বর্মণ নাটক না লিখলেও নাট্যকার, প্রযোজক, অভিনেতা, দর্শক প্রমুখের বিচিত্রমুখী দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে নাট্যকারের মননকে স্পর্শ করার প্রচেষ্টা এতে করেছেন। বর্মণ লিখেছেন, গ্রন্থকার, সমালোচক এবং জনসাধারণকে অর্থাৎ নাট্য-দর্শককে উপলক্ষ করেই তিনি এই প্রবন্ধটি রচনা করেছেন। ‘থিয়েটার আদতে কেউ বোঝেই না’ (ওই, পৃ ৪২) ভাষ্যমধ্য নিয়ে তিনি মূলত যুগপৎ নাট্যকার ও প্রযোজকের প্রতিভাহীনতার কথাই ব্যক্ত করেছেন। পরিচালক ও সমালোচকরাও যে প্রকৃত নাট্যসমঝদার নন, তাও তাঁর ভাষ্য থেকে; ‘যেসব পরিচালক চুল দাড়ি পাকিয়েছেন, তাঁরাও না, এমনকি সমালোচকরা নিজেরাও না।’ (ওই, পৃ ৪২) আসলে অদ্বৈত মল্লবর্মণ আমাদের দেশে প্রকৃত ও গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন নাট্যকার, প্রযোজক, গ্রন্থকার ও সমালোচকের অভাব বোধ করেছেন। আসলেই তাঁর এই অনুধাবনের মধ্যে সত্যতা আছে। নাট্যকার সেখানে বলেছেন, ‘দুঃখ, বেদনা ও মমতা মিশিয়ে গড়ে তুলেছি নাটকের আখ্যানবস্ত্ত’ (ওই, পৃ ৪৪) সেখানে অন্তঃসারশূন্য প্রযোজক বলছেন, একটা প্রহসনরূপে বঙ্গমঞ্চে এ নাটকটিকে দাঁড় করাতে হবে; শুধু তাই নয়, দুঃখজনকভাবে প্রযোজক বলেছেন : ‘একে নাট্যকার যে ধারণায় খাড়া করেছেন, তার থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে খাড়া করে তুলতে হবে।’ (ওই, পৃ ৪৪) নাট্যকারের জৈবনিকবোধের সারাৎসারকে যে নাট্যাভিনয়ে তুলে আনতে হবে – তা অন্তঃসারশূন্য প্রযোজক অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন।
‘প্রাচীন চীনা চিত্রকলার রূপ ও রীতি’ প্রবন্ধটির মধ্যে স্পষ্ট হয় যে, বর্মণের জীবনদৃষ্টি কত গভীর। চিত্রকলার মতো একটি আয়াসসাধ্য শিল্পকর্মকে তিনি চৈনিক ইতিহাস ও সভ্যতা বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন। পৃথিবীর সব দেশের লিখন ও চিত্রণ রীতি আলাদা হলেও চীনের লিখন-রীতির মূলটাই যে চিত্রণরীতি, তা তিনি স্পষ্টতার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। চৈনিক যুবক-শিল্পীরা ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জাপান থেকে সেখানকার চিত্রকলার রীতি ও পদ্ধতি শিখে এসে যে চীনে তারা তা প্রবর্তন করেছেন, তা তিনি লিখেছেন, ১৯২৩ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে চৈনিক শিল্পীরা নব্য ভাবধারায় সে-চীনের শিল্পকলা রূপায়িত ও রসায়িত করেন, তা স্পষ্টতার সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছেন। শাঙপিওকে তিনি নব্য চীনের শিল্পাচার্য হিসেবে অভিহিত করেছেন।
গ্রিক দর্শনে খাদ মেলানো কঠিন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। আসলে প্লেটো যেভাবে গ্রিস দেশে মানব-প্রজননের কথা বলেছেন, তাতে সভ্যতা রক্ষা পাওয়া তো দুঃসাধ্যতায় পর্যবসিত হয়। নৈতিক দিক থেকেও তাঁর এ-প্রজননভাবনা অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। সে-কারণে গ্রিক দর্শনের ঘাটতিও আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে। ভারতের উপনিষদের ঋষিদের ভাববাদী এবং আত্মা-পরমাত্মাবাদী দর্শনকে তিনি স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্কময়তার দর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন বলেই তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব হয়েছে : ‘ভারতের উপনিষদের ঋষিরা যা দিয়ে গেছেন, তাতে মিশ্রণ ঘটাবে কোন্ দেশের ভাবধারা?’ (ওই, পৃ ১১৫)
প্রকৃতির সঙ্গে চৈনিক শিল্পকলার গভীর যোগাযোগের কথা বর্মণ লিখেছেন। ইয়াংসি নদীর সীমাহীন প্রশান্তি, শান্ত মৌন মন্থরতা, জ্ঞানগম্ভীর নীরবতা এবং অবিরাম গতিশীলতাকে শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্মে চমৎকারভাবে উজ্জীবিত রেখেছেন। ‘চীনা শিল্পীরা প্রকৃতিকে যেভাবে দেখেছেন, সেইভাবে চিত্রিত করেছেন। বুদ্ধি দিয়ে তার অপ্রাকৃত সত্তাকে কোথাও ক্ষুণ্ণ করেন নি।’ (ওই,পৃ ১১৬) চৈনিক শিল্পকর্মের প্রকৃতির মধ্যে চৈনিক নিসর্গের মতোই ঝটিকা নেই, তার অন্তরেও উপলভাঙা চাঞ্চল্য নেই। কনফুসিয়াস ও লাউৎসের মতো আত্মবাদী, ভাববাদী ও স্রষ্টাবাদী অনুভববাদীদের মগ্নচৈতন্যের নিবিড়তার মতোই চৈনিক চিত্রকলার স্তব্ধতা ও মৌন নান্দনিকতা। পাশ্চাত্য শিল্পকলায় ইতালির স্থান যেমন উচ্চে; প্রাচ্য চিত্রকলায় সেই স্থান চীন পেতে পারে বলে শিল্পরসিকরা মনে করেন।
খ্রিষ্টজন্মের তিনশো বছর পূর্বে চীনে তুলির প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে সেখানে কাগজের প্রচলন হয়। তার আগে, কাঠের তক্তায় বা দেয়ালের গায়ে চুন দিয়ে ছবি অাঁকা হতো। যেগুলো এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। উপর্যুক্ত চিত্রাবলি চীনের ভাববাদী ও স্রষ্টাময়ী দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ কনফুসিয়াসের খুব প্রিয় ছিল।
ঋষি লাউৎসের মরমি ও আধ্যাত্মিক ভাবনা এবং তাঁর শিষ্যগণের বৃত্তান্তসহ গৌতম বুদ্ধের সৌম্যমূর্তি এবং অনন্তের পথে তাঁর প্রত্নগভীর মন্থরিত যাত্রা চৈনিক শিল্পীদের শিল্পকর্মে খুব admire বা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিস্ময়ের সঙ্গে স্থান পেত।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে চীনে landscape বা প্রাকৃতিক দৃশ্যময় ছবি অাঁকা শুরু হয়। ইউয়েন বংশের চিত্রশিল্পী চাও মেঙ-ফু ‘ওয়াঙ-চুয়াঙের দৃশ্য’ শীর্ষক ছবিটি অষ্টম শতাব্দীতে এঁকেছিলেন। ওয়াঙ-ওয়ে নদীর পাড়ে বাড়ি তৈরি করেছিলেন শিল্পী; অতঃপর তিনি এ-ছবিটি এঁকেছিলেন। প্রকৃতিময়তার সঙ্গে শিল্পীর অন্তরের একাত্মতাবোধের প্রকাশই যুগপৎ শিল্পীর চেতনায় ও শিল্পকর্মটিতে উপস্থাপিত হয়েছে।
কু ও হ্সি (১০২০-৯০) ‘প্রকৃতির কোলে প্যাগোডা’ শীর্ষক চিত্রটি এঁকেছেন। এ-ছবিটিতে landscape-এর অপূর্ব দৃশ্যময়তাসহ ভাবতন্ময় মিস্টিক ভাব এবং হালকা কুয়াশার বর্ণমধুর ব্যঞ্জনা স্পষ্টায়িত হয়েছে।
স্মর্তব্য যে, চীনের শিল্পকলার চরমোৎকর্ষ তেরোশো বছরের প্রাচীন। চৈনিক শিল্পীরা রঙের চেয়ে রেখার চমকের দিকেই অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। সোনালি রং তাঁদের খুব পছন্দের ছিল। বৌদ্ধযুগের চিত্রে রঙের প্রাধান্য ও রঙের চাতুর্য বেশি প্রত্যক্ষগোচর হলেও প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি অাঁকতে তাঁরা রেখাকেই অধিকতর প্রাধান্য দিয়েছেন।
চীনের একটি প্রবাদে আছে : ‘ছবি জিনিসটা একটা নির্বাক কবিতা মাত্র।’ (ওই, পৃ ১১৭) খ্যাতিমান শিল্পীদের অনেকে যশস্বী কবিও ছিলেন। একই ভাব, ভাবনা ও তন্ময়তা দিয়ে অবশ্যই চিত্রশিল্পী অাঁকবেন চিত্রকলাকর্ম এবং কবি লিখবেন শব্দের ক্যানভাসে জীবনের অপরাজেয়তার গান।
‘আম্রতত্ত্ব’ প্রবন্ধটি যেহেতু মূলত আম নামক ফল বিষয়ক সে-কারণে এটিকে বিষয়নির্ভর প্রবন্ধ বলা যায়। মধ্যপ্রাচ্যীয় খলিফা হারুন আল রশিদের আমলের একটি গল্পে ভারতের আম জয়যুক্ত হয়েছে বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের অন্তর্দৃষ্টি যে সুদূরপ্রসারী এবং আর্থনীতিকভাবে বাঙালি সমাজকে লাভবান করে তোলার পক্ষে, তা এই প্রবন্ধে স্পষ্ট হয়েছে। বাড়িতে আমের অধিক ফলন ঘটিয়ে আম বিক্রি করে এবং কাঁচা আম নষ্ট না করে তা শুকিয়ে ‘আমশি’ প্রস্ত্তত করে বিক্রি করলে সাধারণ গ্রামীণ জনতার আর্থনীতিক সচ্ছলতা সৃষ্টি হবে বলে বর্মণের মতো আমরাও মনে করি। বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত জায়গায় ‘কৃষি ফলাইলে নিজেদের প্রয়োজন মিটানো ছাড়াও দু-পয়সা আয় হইতে পারে।’ (ওই, পৃ ১২৩) বলে তিনি যে-ভাষ্য দিয়েছেন, এতে দারিদ্র্যক্লিষ্ট বাঙালির আর্থিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও স্পষ্টায়িত হয়েছে।
বর্মণের ‘ছোটদের ছবি অাঁকা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি শিশুদের ছবি অাঁকাকে তাদের মনের স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ গতিময়তার ওপর নির্ভর করে তাদের সৃষ্টিশীল চেতনাকে যাতে জাগ্রত করতে পারে শিক্ষকদের এমন মমত্ববোধসম্পন্ন ও দূরদৃষ্টি নিয়ে শিক্ষা দানের কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন। শিশুদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে যে তাঁর সুগভীর পঠন ছিল, এ-প্রবন্ধটিতে তাঁর অনুধাবন ও বিশ্লেষণের মধ্যে তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। শিশুদের একটি নিজস্ব ইচ্ছা ও কল্পনাশক্তি থাকে। স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের সে-কল্পনাময়তার মধ্যে বিরাজ করতে দিয়ে তাদের অাঁকানোর বা শেখানোর কাজটি অব্যাহত রাখতে দিলে তাদের সৃষ্টিশীলতার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটবে বলে বর্মণের মতো আমিও মনে করি। বারো-তেরো বছর বয়স থেকে শিশুদের ইমপ্রেশন বা ভাবকল্পনাভাবনা বিশ্লেষণমুখিতার দিকে অগ্রসর হয়। তাদের অাঁকতে বা শিক্ষাদান করতে গিয়ে তাদের ব্যর্থতার জন্য তাদের তিরস্কার না করে বরং তাদের ঘাটতিগুলো সহজভাবে ধরিয়ে দিয়ে সৃষ্টিশীলতার দিকে তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করা উচিত। শিল্পের প্রকাশের তিনটি ধারাকে লেখক কথাশিল্প, সুরশিল্প এবং চিত্রণশিল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। প্রত্যেকের শৈশবকাল তার কাছে স্মৃতি রোমন্থনের আনন্দময়তার সময়, যেহেতু তখন সে বিশ্বের বিচিত্র বিষয়কে কৌতূহল, বিস্ময়, সচেতনতা ও অন্তরঙ্গতা দিয়ে প্রত্যক্ষ করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ শিশুদের শিল্পমনকে সুস্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন বলেই শান্তিনিকেতনে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্কন ও বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ‘শিশুর প্রকৃতিদত্ত শিল্পবোধ যাতে উপযুক্ত পরিচালনায় বিকাশলাভ করতে পারে তার সর্ববিধ সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল’ (ওই, পৃ ১২০) শান্তিনিকেতনে। শিশুশিক্ষা সম্পর্কে বর্মণের অভিমত খুবই দূরদর্শী; তা নিম্নরূপ : ‘শিক্ষাকে এখন মুখস্থ করানোর মধ্যে আবদ্ধ রাখলে চলবে না। শিক্ষা বলতে এখন আত্মবিকাশ বলে মেনে নিতে হবে। এ বিকাশ তিক্ততার মধ্যে, জটিলতার মধ্যে, অনিচ্ছার মধ্যে হতে পারে না।’ (ওই, পৃ ১২০)।
বয়স্কদের এবং শিশুদের অভিজ্ঞতার জগৎ ভিন্নরকম। শিশুর শিল্প ও কল্পনা শক্তিকে শিশুর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বড়দের বিবেচনা করতে হবে। সহানুভূতি ও সমবেদনার আলোকে শিশুর মনের তলদেশ শিক্ষক যদি উদ্ঘাটন করতে পারেন, তবেই শিশুর সৃজনশক্তিকে তিনি সৃষ্টিশীল করতে সমর্থ হবেন।
শিশুদের চিত্রকলা শিক্ষা দিলে তারা সকলেই যে চিত্রশিল্পী হবে এমন নয়। শিক্ষার কারণে নিজের ও পরিবারের অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের সমস্যা যেমন মিটানো যায়; তেমনি শিল্পশিক্ষার মাধ্যমে মননকে গভীর এবং কামনা ও রুচিকে মার্জিত করে তোলা যায় বলে চিত্রশিল্প-শিক্ষণ শিশুদের সুকুমার বোধকে শানিত ও কল্যাণময় করে তুলতে পারবে বলে বর্মণের মতো আমিও মনে করি।
‘বর্ষার কাব্য’ প্রবন্ধটিতে সাহিত্যকর্মে বর্ষাঋতু ব্যবহৃত হবার বিষয়টি ভাষারূপ পেয়েছে। বর্ষা উপভোগের তিনটি যুগধারাকে লেখক এ-প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। কালিদাসের মেঘ যে বিরহীমনের আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, বিষাদ ও বিরহকে ধারণ করেছে, সেটি হলো একটি ধারা। বৈষ্ণব কবিগণ প্রিয়সুখবঞ্চিতা ও ব্রজাঙ্গনাগণের ব্যাকুলতা ও প্রতীক্ষমানতা নিয়ে যে শিল্পনিপুণ বর্ষাকাব্য রচনা করেছেন, তা দ্বিতীয় ধারার মধ্যে পড়ে। তৃতীয় পর্বটি হলো রবীন্দ্রনাথের বর্ষাভাবনা বিষয়ক। বৈষ্ণব ও রবীন্দ্রনাথ – উভয়ের বর্ষাভাবনার পার্থক্য সম্পর্কে লেখক-ভাবনা উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘বৈষ্ণব বর্ষাকাব্যের মূলতত্ত্ব ছিল পাওয়ার উৎকণ্ঠা বা গভীর আসঙ্গলিপ্সা। রবীন্দ্র বর্ষাকাব্যের পরমাত্মা পাওয়া না পাওয়ার হর্ষ দোলায় আন্দোলিত।’ (ওই, পৃ ১২৪) রবীন্দ্রনাথ বর্ষার সমগ্র রূপকে জীবনের সঙ্গে অভিন্ন করে উপলব্ধি করে মূলত ঔপনিষদিক স্রষ্টাচেতনার মধ্যে মানুষের বিরহচেতনাকে সমীকৃত করে তাঁর বর্ষাচিন্তার মধ্যে অনুলিপ্ত করেছেন।
বর্ষার চতুর্থ স্তর সম্পর্কে বর্মণ যা বলেন, তা বাংলার আপামর সাধারণ দরিদ্র জনতা যে বর্ষার কারণে কখনো প্লাবনে, কখনো ফসলহানিতে পর্যুদস্ত হয় – সে-কথা বলে দরিদ্র জনগণের প্রতি তাঁর অন্তরের প্রকৃত মমত্ববোধের কথাই চিত্রিত করেছেন।
‘এদেশের ভিখারী সম্প্রদায়’ প্রবন্ধটির মধ্যে বর্মণ হিন্দু ও মুসলিম – উভয় সম্প্রদায়ের কিছু ভিখারির কথা উল্লেখ করেছেন। ভিখারিদের নিয়েও যে প্রবন্ধ লেখা যায় – বর্মণের মানবিক মমত্ববোধ সেটিও সত্যতায় পর্যবসিত করলো। পূর্বকালের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা মনে করত, ভগবান মানুষের দ্বারে ভিখারি বা আর্ত ব্রাহ্মণের বেশে আসেন। সে-কারণে তাদেরকে খালি হাতে ফেরানো হতো না।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষ্ণব, বোষ্টম বা বৈরাগী হিসেবে ভগবানের কাজে তারা ব্যাপৃত – এ অনুধাবন মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তারা ভিক্ষাবৃত্তি করে। মাজারে মাজারে অনেক মুসলমান ফকির সেজে বা লালসালু পরিধান করে ভিক্ষাবৃত্তি করে। মানুষের কাছে হাত পেতে মানবতা ও মনুষ্যত্বকে কলঙ্কিত করার মতো এমন নিচু কাজ আর নেই। লেখকভাষ্য উদ্বৃতিযোগ্য : ‘কর্মহীন অলস জীবনযাত্রায় আর আত্মার ও দেহের অবমাননাকর ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যে ভগবানের কোনো সত্তাই যে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না একথা তাহাদিগকে বুঝাইয়া বলিবার দিন আজ আসিয়াছে।’ (ওই, পৃ ১১৩)
ভিখারিদের সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ কাজে যুক্ত হওয়ার কথা লেখক বলেছেন। গ্রামের হাট-বাজার ঝাড়ু দিলে দোকানদাররা খুশি হয়েই তাদেরকে পারিশ্রমিক স্বরূপ কিছু দেবে, এতে ভিক্ষাবৃত্তির মতো গ্লানি ও লজ্জাকর কাজের যেমন অবসান ঘটবে; তেমনি মানুষের মর্যাদাও কর্ম করার মধ্যে তৃপ্তি খুঁজে পাবে। গৃহস্থের বাড়িতে ধান ভেনেও ভিখারিরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। সস্তা দরে বাঁশ কিনে চুপড়ি, ঝাঁপি ইত্যাদি বানিয়ে বিক্রি করেও ভিখারিরা জীবনযাপন করে মানবমর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে পারে। মাথা গোঁজার ঠাঁই যে জমিটুকু ভিখারিদের আছে, সেখানে তারা লাউ, কুমড়া ও শিমগাছ লাগিয়ে তার ফলন দিয়েও জীবিকার প্রচেষ্টা চালাতে পারে বলে লেখক মন্তব্য করেছেন। লেখকভাষ্য উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘নির্ঝঞ্ঝাটে ভগবৎ আরাধনা করিতে চাও, বেশ ত কর না, কিন্তু পরের নিকট ভিক্ষা চাহিয়া করিও না। নিজের শ্রমের দ্বারা পেট চালাও, সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম উপাসনা যাহা করিতে হয় কর।’ (ওই, পৃ ১১৪)
অদ্বৈত মল্লবর্মণের লোকসংগীতনির্ভর প্রবন্ধ
বর্মণের সংগীতনির্ভর ১৪টি প্রবন্ধ রয়েছে। ‘অপ্রকাশিত বাউল সঙ্গীত’সহ সংগীতভিত্তিক রচনা ১৫টি। কিন্তু বাউল সংগীত বিষয়ক রচনাটি শুধু ছয়টি গানের সংকলন; এতে গানগুলোর কোনো আলোচনা নেই। কিন্তু বাকি রচনাগুলোতে গানের বিষয়বস্ত্ত, গানের অন্তঃসার, সমাজবাস্তবতা, পারিবারিক দুঃখ-নির্যাতন, ও প্রেম-ভালোবাসাজনিত ঘটনাসম্পর্কের বর্ণনাসহ বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও লেখকের অন্তর্জাত অনুধাবনও তাতে ভাষারূপ লাভ করেছে। এজন্যে এ-রচনাগুলোকে আমি লোকসংগীত সম্পর্কিত প্রবন্ধ হিসেবে অভিহিত করতে চাই। নিম্নে ১৪টি প্রবন্ধের নাম উল্লিখিত হলো : ‘অপ্রকাশিত পল্লীগীতি’, ‘ত্রিপুরার বারমাসী গান’, ‘দুইটি বারমাসী গান’, ‘পল্লীসঙ্গীতে পালাগান’, ‘শেওলার পালা’, ‘বরজের গান’, ‘জলসওয়ার গীত’, ‘নাইওরের গান’, ‘পাখীর গান’, ‘উপাখ্যানমূলক সঙ্গীত’, ‘ভাইফোঁটার গান’, ‘পরিহাস সঙ্গীত’, ‘মাঘমন্ডল’ এবং ‘অপ্রকাশিত পুতুল বিয়ের ছড়া’।
‘অপ্রকাশিত পল্লীগীতি’ রচনাটিতে একটি সারিগান এবং দুটো গাথা সংগীত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পল্লীসংগীত মনন, চিন্তা ও কল্পনা দিয়ে গড়া নয়; তা পল্লীবাসীর নির্ভেজাল মনের উৎস থেকে উৎসারিত বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। পল্লীগান মনের উৎসজাত হলেও এতে মননের, চিন্তার ও কল্পনাশক্তির খোরাক প্রাপ্তব্য বলে আমি মনে করি। বর্ষাকালে পূর্ববঙ্গের নৌকাদৌড় বা নৌকাবাইচ খেলার মধ্যে বৈঠা যেমন রংবেরঙের হয়ে থাকে; তেমনি যারা নৌকাবাইচের কুশীলব তাদের মনেরও রংবৈচিত্র্য একটি প্রত্যক্ষযোগ্য বিষয়। সারিগানটিতে রাধা কৃষ্ণের উদ্দেশে যেতে চাচ্ছেন; কিন্তু সমাজ, প্রতিবেশ ও পরিবারের লোকজন কর্তৃক তিনি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কৃষ্ণের জন্য তিনি অশ্রুবিসর্জন করছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুটো গাথা-সংগীতের একটিতে চাষির ছেলে বিনন্দের কোড়া পাখি শিকার করতে গিয়ে সর্পদংশনে মৃত্যু এবং অপরটিতে বুরুজ নামক এক ব্রাহ্মণ ‘ভুঁইমালী’ কর্তৃক জলপান করে এবং অতঃপর তাকে বিয়ে করে কীভাবে তার জাত নষ্ট করেছে সেকথা বলা হয়েছে।
‘ত্রিপুরার একটি বারমাসী গান’ লেখাটির মধ্যে প্রাবন্ধিক লিখেছেন, বারোমাসি গানে মূলত একজন স্বামী-বিরহিণী নারীর বারোমাসের বিরহ-বেদনার কারুণিক দৃশ্যই উপস্থাপিত থাকে। এই গানটিতে শান্তি নামক এক কন্যার, যার ধনী সওদাগরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল এবং বিয়ের পর বারো বছরের জন্য সওদাগর বাণিজ্য করতে গিয়েছিল, সে-কথা বলা হয়েছে। সওদাগর বুদ্ধি খাটিয়ে এগারো বছর বাণিজ্য করে এক বছর পূর্বেই চলে আসে। ছদ্মবেশে সেই সওদাগর শান্তিকে প্রবৃত্তির প্রলোভন এবং প্রেমের প্রস্তাব করে। কিন্তু সতীসাধ্বী ও প্রকৃত সৎ প্রেমিকা শান্তি এই অপরিচিত ছদ্মবেশীর প্রেমাকাঙ্ক্ষা ও কামাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করে না। পরিচয় পাওয়ার পর তারা বৈধ সংসর্গে সম্পর্কিত হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ মেয়েদের সতীসাধ্বিতার প্রমাণই আমরা শান্তির সৎচরিত্র সংরক্ষণের মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। শান্তির ছদ্মবেশী স্বামী শান্তিকে দেখে বলেছিল : ‘তোর যৌবন দেখে আমার চিত্ত নহে স্থির।’ (পৃ ৬৭); কিন্তু শান্তি ব্যক্তিত্বসম্পন্না ও সত্যনিষ্ঠ, সেজন্যে কঠোর জবাব তাকে নিম্নোক্তভাবে দেয় :
তুমি যেরে পরের ছাইলা, আমি পরের নারী
আমার কি রে শকতি আছে, দেখা দিতে পারি।
(ওই, পৃ ৬৭)
শান্তি যদিও বলে ‘অভাগিনী শান্তির যৈবন আঞ্চল বাইয়া পড়ে।’ (ওই, পৃ ৬৮) তবুও ‘কোটরা ভরি’ বিষ খেয়ে সে মরলেও তার সতীত্ব সে বিসর্জন দেবে না। তার স্বামীর প্রতি ভালোবাসা এতই প্রবল যে, তার স্বামীকে তালের পিঠা, গাভীর দুধ খাওয়ানোর কথা সে ভাবে।
‘দুইটি বারমাসী গান’ রচনাটির মধ্যে রাধার এবং সীতার বারোমাসি গান অভিব্যক্ত হয়েছে। রাধা হলো বাঙালির লোকপ্রেমের অবিস্মরণীয় নায়িকা; শ্যাম বা কৃষ্ণ হলো নায়ক। সীতা শুধু ভারতবর্ষের নয়, পৃথিবীর সতীত্বগর্বী যে-কোনো নারীর প্রতিনিধি। রাধা এবং সীতার বারোমাসের দুঃখবোধ গান দুটোতে অভিব্যক্ত হলেও মূলত এটি রূপক প্রকাশ।
বাংলার পল্লী অঞ্চলের যে-কোনো কুলবধূর অন্তরের বিরহতাপিত বেদনার প্রতীকী বেদনাবোধই গান দুটোর ভাবভাষ্যের মধ্যে ভাষারূপ লাভ করেছে।
প্রবন্ধটির মধ্যে ভাটিয়ালি গানকে দুভাগে লেখক বিভাজন করেছেন। একটি হলো রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-বিরহমূলক এবং অপরটি হলো মানবজীবনের শেষ পরিণতি তথা স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক ও ভালোবাসাবিষয়ক। ভারতীয় ও বাঙালি সমাজের রাধা-কৃষ্ণের প্রেম শুধু পল্লীজীবনে কুলবধূদের বিরহ ও কষ্টময়তার প্রতীককেই প্রতীকায়িত করে না, অধিকন্তু ধর্মজীবনেও এর প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করি। মহাভারতে আমরা কৃষ্ণকে প্রভাবশালী চরিত্র হিসেবে পাই। মানবাত্মা যে পরমাত্মারূপ স্রষ্টার সঙ্গে সতত মিলনোন্মুখতা মহাভারতে বিশেষভাবে বিশ্লেষিত আছে। মানুষের আত্মা যে স্রষ্টারূপ পরমাত্মার প্রেমে সর্বদা ব্যাকুল এবং এটিই যে সৃষ্টির মর্মগত গভীরতর তাৎপর্য – তাও আমাদের অনুধাবন করতে হবে।
রাধার বারোমাসিতে আমরা প্রত্যক্ষ করি রাধার প্রচন্ড বিরহ-বেদনা; যেহেতু কৃষ্ণ রাধাকে পরিত্যাগ করে মথুরায় চলে গিয়েছেন। রাধা কলঙ্ককে সহ্য করে কৃষ্ণকে ভালোবাসলেও কৃষ্ণ তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। কলঙ্ককে সহ্য করে বাঙালি রমণীরা। বাঙালির শাশ্বত প্রেমের নায়িকা রাধাভাষ্য লক্ষযোগ্য : ‘কৃষ্ণ প্রেমে মইলাম আমি রাই।’ (ওই, পৃ ৭২) রাধা তাঁর নয়নের জল দিয়ে মৃত্তিকা লেপচে এবং ‘যেথায় গেছে প্রাণের কৃষ্ণ যাব সেই পথে।’ (ওই, পৃ ৭২) কৃষ্ণের বিরহে রাধা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রাধা ‘অফলা কদম্বপুষ্প’ সযতনে তোলেন, কারণ ‘তুই ফুলেরে দেখিলে আমার কৃষ্ণ পড়ে মনে।’ (ওই, পৃ ৭৩)
‘সীতার বারমাসী’ গানটিতে অশোক বনে অবস্থানকালে সীতার দুঃখ ও বেদনাবোধ কারুণিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সীতা তাঁর বনবাসের পূর্ব হতে চতুর্দশ বছরের শেষ পর্যন্ত তাঁর কষ্টের কথাগুলো এই গানটির মধ্যে অভিব্যক্ত করেছেন। দৈবের লেখনে রামচন্দ্র রাজা না হয়ে বনবাসে যান; রাজা হন তাঁর কনিষ্ঠ ভরত। শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ মৃগ শিকারে গেলে দুরাচার রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে এলো :
একেতে রাবণ রাজা দুষ্ট দুরাচার।
রথে তুইল্যা সীতা দেবী লঙ্কা করল পার।
(ওই, পৃ ৭৪)
বাঙালি রমণীরা স্বামী অন্তপ্রাণ। ‘যে নারীর পতি নাইরে পুষ্পের কি তার সাধ’ (ওই, পৃ ৭৫) ভাষ্যমধ্য দিয়ে স্বামীহীন অবস্থায় পুষ্পের প্রয়োজনীয়তা যে নিষ্ফলতায় ম্লান হয়ে পড়ে, তাই স্পষ্টভাষিত হয়েছে। এই গানটির রচয়িতা শ্রীধর বণিক। যাঁর ছেলের নাম ছিল প্রজাপতি। গানটির শেষে পিতা-পুত্রের উল্লেখ রয়েছে। এই সতী সীতার গানটি যে শোনে অথবা যে গায় – তার পাপ খন্ডিত হয় বলে গানটির শেষ লাইনটিতে উল্লিখিত হয়েছে। রামচন্দ্র সচ্চরিত্রবান; তাঁর স্ত্রী সীতাকেও রাবণ কলঙ্কিত করতে পারেনি, তাঁর সতীত্বের স্পর্ধার কারণে। পুণ্যবানদেব কাহিনি শুনলে অবশ্যই পুণ্যলাভ হতে পারে। কারণ :
পুষ্পের মধ্যে কনক-চাম্পা ধানের মধ্যে খাম
নারীর মধ্যে সীতা সতী পুরুষের মধ্যে রাম।
(ওই, পৃ ৭৬)
‘পল্লীসঙ্গীতে পালাগান’ রচনাটির মধ্যে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, কাঞ্চনমালা, মধুমালা, মালঞ্চমালা, মহুয়া প্রভৃতি কাহিনির অন্তর্গত জীবনসত্যকে হৃদয়বান সকল মানুষেরই মনে রাখতে বাধ্য। পল্লীগীতিকাসমূহের সংগ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও তাত্ত্বিক ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনকে লেখক খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। ‘পল্লীসঙ্গীতে পালাগান’ প্রবন্ধের মধ্যে তিনি ‘বিনোদের পালা’ ও ‘কটুমিঞার পালা’দ্বয় বর্ণনা করেছেন।
বিনোদের পালায় বিনোদ একজন পাকা কোড়া শিকারি। সংসারে তার মা, বউ এবং বোন রয়েছে। রাতে বর্ষাকালে শ্বাপদ পরিবেশকে অগ্রাহ্য করে কোড়া শিকার করতে যায় বিনোদ। একটি শিকারি কোড়ার মাধ্যমে বন্য কোড়াদের জীবন্ত ধরে আনে কোড়া শিকারি বিনোদ। কিন্তু সর্পের কামড়ে বিনোদ মারা যাওয়ার সময় আর্তনাদ করে বলে যে, সে তার মায়ের কাছে যেতে চায়। বিনোদের যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে বিনোদের বোন অর্থাৎ তার স্ত্রীর ননদ খুব ঝগড়া করে। কিন্তু স্বামীকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। তার স্ত্রী প্রতিবেশীর নিকট থেকে চাল ধার করে এনে তার স্বামীকে খাইয়ে অতঃপর কোড়া শিকারে পাঠায়। তার স্বামীর মৃত্যুসংবাদে তার জীবনের সব লক্ষ্যই শেষ হয়ে গেল :
অভাগিনী স্ত্রী কান্দে আর ত লক্ষ্যা নাই।
(ওই, পৃ ৮১)
ছেলের জন্য ‘মায়ের কান্দন যাবজ্জীবন’ (পৃ ৮১) বলে সন্তানের মৃত্যুর জন্য মায়ের সারাজীবন প্রচন্ড কষ্ট পাবার ব্যাপারটিই স্পষ্টভাসিত হয়।
‘কটুমিঞার পালা’টির মধ্যে পূর্ববঙ্গের এক মুসলিম কটুমিঞার জীবনের ট্র্যাজিক চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে। বিনোদের পালাতে আমরা দেখেছি, বিনোদের স্ত্রী বিনোদকে প্রচন্ডভাবে ভালো জানত। কিন্তু কটুমিঞার স্ত্রী ছিল চরিত্রভ্রষ্টা; তার প্রেমিকের মাধ্যমেই সে বিষ আনিয়েছে তার স্বামী কটুমিঞাকে হত্যা করার জন্য। কটুমিঞার সঙ্গে ঘরসংসার না করে তাকে তালাক দিতে পারত তার স্ত্রী। কিন্তু সেই নিষ্ঠুরা ও একটা নারী তার বৈধ স্বামীকে হত্যা করেছে। কটুমিঞা ‘ওজু করে নমাজ করে’ শ্বশুরবাড়ির দিকে যাত্রা করায় বোঝা যায় সে ধর্মপ্রাণ ছিল। অথচ ভাগ্যের এমনই ফের, তার স্ত্রীর তার সঙ্গে বিয়ের পূর্ব থেকেই একজনের সঙ্গে প্রেম ছিল, যার কারণে তার স্ত্রী কর্তৃক হত্যার শিকার হতে হয় তাকে। কটুমিঞা তার মাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তার স্ত্রী তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করিয়েছে, সেটি না বলে রোগে সে মারা গেছে, এটি তার মাকে জানাতে সে অন্তিম সময়ে বলে গেছে :
খবরিয়া খবর কইও আমার মায়ের কাছে।
তোমার ছাওয়াল মারা গেছে বেধের বেরামে।
(ওই, পৃ ৮২)
‘শেওলার পালা’ প্রবন্ধটির মধ্যে শেওলাবালা এবং কালাচাঁদের প্রেমের করুণ ট্র্যাজেডি চিত্রায়িত হয়েছে। শেওলাবালার সঙ্গে কালাচাঁদের বিয়ে হয়নি। বিয়ে হয়েছে দূরদেশের অচেনা একজনের সঙ্গে। শেওলা তার বিয়ে হয়ে যাবার পর কালাচাঁদকে বলেছে তার শ্বশুরবাড়ির বিন্নি ধানের ক্ষেতে কালাচাঁদ যাতে হরিণ সেজে আসে। সেখানে শেওলার সঙ্গে কালাচাঁদের দেখা হয়। লোকে সন্দেহ শুরু করে, শেওলা কেন এত ঘনঘন বিন্নি ধানের ক্ষেতে যায়। শেওলার দেবর গুলি ছুড়লে হরিণরূপী কালাচাঁদ মারা যায়। কালাচাঁদের মৃত্যুর কষ্টে শেওলা বিষপান করে মারা যায়; কিন্তু সে শোনায় যে সাপে তাকে দংশন করেছে। শেওলার বিয়ে হয়ে যাবার পর তার প্রেমিক কালাচাঁদকে ছেড়ে সে কীভাবে বাঁচবে, সে-সম্পর্কে গানের ভাষ্য :
হারে শেওলার বক্ষে ভাসে দুই না আইক্ষের জলেরে
(ওই, পৃ ৮৩)
শেওলার স্বামী কিন্তু শেওলাকে ভালোবাসত; তার স্ত্রীর মৃত্যুর করুণ অনুধাবনে তার স্বামীর ভাষ্য :
আপন সোয়ামিরে ধুলাতে লটাইল রে
এ জীবনে আর নি হইবে দেখা।
(ওই, পৃ ৮৬)
‘বরজের গান’ রচনাটিকে বরজ বা ব্রজের গান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পল্লীর প্রাচীন ও আধুনিক উভয় গানকে লেখক দুভাগে ভাগ করেছেন এ-প্রবন্ধে; ভাগদুটো হলো – প্রেমমূলক ও সাধনামূলক গান। এই দুই ধরনের গান ছাড়াও সমাজে যাতে অনাচার না ঘটে এবং সমাজশাসন যাতে সুনীতিময় হয়, সেই সত্য শুভ্রতাবিষয়ক গানও রয়েছে বলে বর্মণ উল্লেখ করেছেন। এক নিষ্ঠাপরায়ণ ব্রাহ্মণের ছেলে নিম্নজাতের ভুঁইমালি নন্দিনীর প্রেমজালে আটকে পড়ে তাকে বিয়ে করার কাহিনিকৃত নিয়েই বরজের গান উপাখ্যানটি নির্মিত হয়েছে। দূরদেশে যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণ-তনয় পথ চলতে চলতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ায় এক বাড়িতে উঠে জল প্রার্থনা করলে এক কন্যা তাকে জলপান করায়। অতঃপর জিজ্ঞাসা করে ব্রাহ্মণতনয় জানে যে, সেই কন্যা নিচুজাত ভুঁইমালির নন্দিনী। সে জাতিচ্যুত হয়েছে বলে সে আর তার গৃহে ফিরে যায়নি। ভুঁইমালিকে সে ভালোবেসেছে বলে তাকে নিয়েই তাদের বাড়িতে ঘরসংসার শুরু করেছে। ব্রাহ্মণ যদি তার ঘরে ভুঁইমালিকে নিয়ে গিয়ে অস্পৃশ্যতার অবসান ঘটাতে পারত তাহলে হয়তো ব্রাহ্মণের সংস্কার-উত্তীর্ণতার প্রশংসা প্রাজ্ঞজন করতে পারতেন।
‘জলসওয়া গীত’ প্রবন্ধে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান হিসেবে জলসওয়া বা স্ত্রী আচারকে দেখা হয়েছে। ‘বিবাহের বর এবং কন্যাকে স্নান করাইবার জন্য নিকটস্থ নদী বা পুষ্করিণী হইতে কয়েক কলসী জল তুলিয়া আনাই জলসওয়া।’ (ওই, পৃ ৯০) পল্লীর কতিপয় স্ত্রী ধানদূর্বা সাজিয়ে কলসি নিয়ে নদী বা পুষ্করিণীর ঘাটে যাওয়ার কালে একদল স্ত্রীলোক তাদের সঙ্গে গান গেতে গেতে চলতে থাকে – সে-গানগুলোকে জলসওয়া বা জলভরা গীত নামে অভিহিত করা হয়। মূলত রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের রূপকাশ্রমে এই গানগুলো রচিত হলেও পল্লীবধূদের দুঃখময়তার ও বিরহের সুরই এই গানগুলোর অর্থবক্তব্যে প্রতিভাত হয়। গানভাষ্য লক্ষযোগ্য :
জলে কালো রূপ আমি নিরখি
… … …
জলে ঢেউ দিও না, কথা গো রাখো।
(ওই, পৃ ৯০)
কৃষ্ণ যমুনাতীরের কদমগাছের ডালে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন বলে যমুনার জলে কৃষ্ণের ছায়া ভেসে উঠেছিল। জল আন্দোলিত করলে কৃষ্ণের ছায়া ভেঙে যাবে বলে রাধা জলে ঢেউ না দেওয়ার কথা বলেছেন। প্রিয় পুরুষকে দেখার তাঁর এ-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নারীহৃদয় যে পুরুষের জন্য কত কাতর থাকে, তা স্পষ্টায়িত হয়। রাধা কুলবধূ বলে গাছের ডালের দিকে চোখ করে কৃষ্ণকে তিনি দেখতে সমর্থ হন না; লোকলজ্জার ভয়ে। এতে একজন বাঙালি কুলবধূর পরকীয়ার কথা অভিব্যক্ত হয়েছে। ‘যমুনাতে যাবে বধূ ননদ করল আড়ি’ (পৃ ৯১) ভাষ্যের মধ্য দিয়ে ননদরা যে ভাবিকে পাহারায় রাখে, সে-কথা স্পষ্টতা পায়। ‘পন্থহারা হয়ে রাধা তখন ‘কৃষ্ণ বলে’ কান্দে।’ ‘কৃষ্ণের হাতেতে বাঁশী মুখেতে হাসি’ (পৃ ৯১) হলেও ‘রাখছে না গো শ্যামকালা’ (পৃ ৯১) বলে কৃষ্ণ যে রাধার চরিত্র নাশ করেছেন, সেই বিষয়টিও স্পষ্টতা পাচ্ছে। এই কৃষ্ণ আসলে মহাভারতের ভগবান কৃষ্ণ নন; এই কৃষ্ণ হলো লোকনায়ক ও লম্পট কৃষ্ণ।
‘নাইওরের গানে’র মধ্যে নববধূর স্বামীগৃহ হতে পিতৃগৃহে যাবার আকাঙ্ক্ষার অনুরণন অভিব্যক্ত হয়। ভাই বোনকে নিতে আসবে এ-আশায় বোন স্বামীগৃহে কালাতিপাত করে। ভাই বলে বোনকে :
আশ্বিন মাসে নিতে আসব পাটের টাকা পেয়ে।
আরো বলে :
অঘ্রানেতে নিতে আসব ধানের টাকা পেয়ে।
(ওই, পৃ ৯২)
কিন্তু ভাইয়ের আসা হয় না; অথচ ভাইয়ের মনে কষ্ট ‘এমন সুন্দরী ভইনকে পরে নিয়া যায়।’ (পৃ ৯২)
সরিষার টাকা পেয়ে মাঘ মাসে ভাই বোনকে নিতে আসবে; কিন্তু তার আসা হয় না। বোন শুধু পিতৃগৃহে যাবার আশায় ভাইয়ের অপেক্ষায় থাকে। একজন নববধূর তার মা, বাবা ও ভাইয়ের প্রতি যে প্রচন্ড ভালোবাসা কাজ করে, এ-বিষয়টিই নাইওরের গানে ফুটে উঠেছে।
‘পাখীর গান’ আসলে পাখি বিষয়ক গান নয়। প্রেমাস্পদকে পাখি কল্পনা করে এই গানগুলো রচনা করা হয়। পাখিকেন্দ্রিক গানগুলোকে লেখক প্রেমমূলক ও তত্ত্বমূলক গান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নারী তার প্রেমিকের জন্য বিরহকাতর – পাখি বিষয়ক গানে এটিই বেশি স্পষ্টভাসিত; কারণ প্রেমিকরা পাখির মতো উড়ে যায় তাদের প্রেমিকাদের বঞ্চিত করে। তত্ত্বমূলক গানে মনের সঙ্গে পাখির তুলনা করে মনের মানুষরূপী স্রষ্টার পরিচয় লাভের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। ‘পাখির দুই চরণ বান্ধিয়া রাখিতাম মাথার কেশ দিয়া’ (পৃ ৯৪) ভাষ্যমধ্য দিয়ে একজন নারী তার কেশ নিয়ে তার প্রেমিকের চরণ বেঁধে রাখত বলে তার অচরিতার্থ আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্ত করেছে।
‘ভ্রমর দূত’ শীর্ষক গানটিতে রাধা পিতা, মাতা, ভাই ও স্বজনদের ছেড়েই নয়, শুধু কলঙ্ককে সাথি করে কৃষ্ণকে প্রেমের ধন হিসেবে গ্রহণ করেন, সেই কৃষ্ণ কর্তৃক অবজ্ঞাত হয়ে দুঃখের প্রচন্ড বেদনাময়তা তাঁর জীবনকে আর্ত করে তোলার কথাই অভিব্যক্ত হয়েছে। ‘হলে শুচি মনে রুচি নামের শুচি চাইও’ (পৃ ৯৫) ভাষ্যমধ্য দিয়ে অন্তরকে পবিত্র করে প্রার্থিত মনোধনরূপ স্রষ্টাকে চাওয়ার কথাই ‘মেওয়া মিছরির গান’টিতে ভাষারূপ লাভ করেছে।
‘উপাখ্যানমূলক সঙ্গীত’ অংশে ‘উদ্ধবের গান’ এবং ‘বানিয়ার গান’ নামক দুটো গানের বিশ্লেষণ লেখক করেছেন। গৃহকোণে আবদ্ধ এক তরুণী উদ্ধব নামক মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়ানো একজনকে ভালোবাসে। সেই ‘সোনাবন্ধু হাল চষে’ (পৃ ৯৬); কিন্তু ‘পোড়া ঘরের কাম সারিতে’ পারে না বলে তরুণী তার প্রেমিকের বাঁশি শুনতে এবং তাকে দেখতে যেতে পারে না। সন্ধ্যালগ্নে তরুণী উদ্ধবের উদ্দেশে গেলেও সেই ভ্রষ্টলগ্নে উদ্ধব তার বাড়িতে প্রত্যাবর্তিত হয়ে গেছে। গৃহ পরিত্যাগ করার সাহস তরুণী অর্জন করলেও খেয়াপারে নৌকা না পাওয়ায় তার প্রেমিকের সন্ধানে তরুণীটি যেতে পারে না। নারীর অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার এ প্রেমময়তা গানটিতে ভাষারূপ লাভ করেছে।
‘বানিয়ার গান’ প্রকৃতিচেতনামূলক গান। বালিকার দূরগ্রামে বিয়ে হয়ে গেলেও বানিয়ার প্রতি তার রিরংসা ও কামনাপ্রসূত যোগাযোগ থাকে বলেই নায়িকা তার পরকীয়া নায়ককে বলতে পারে :
তুমি যাইওরে বানিয়া সেই না দেশের পশারি রে,
… … …
শুইতে দিব ষোড় মন্দির ঘর রে।
রাত্রি নিশা কালেরে বানিয়া পানের বাটা সাজাবরে;
হাসি খুশি পশাইব রজনীরে।
(ওই, পৃ ৯৮)
স্বামী থাকা অবস্থায় ষোড় মন্দির ঘরে পূর্বের প্রেমিকের সঙ্গে হাসিখুশিভাবে রাত্রি অতিক্রম করার মধ্যে অনৈতিক ও প্রকৃতিতাড়িত প্রেমের ঘ্রাণই প্রকাশ পায়।
‘ভাইফোঁটার গানে’র বিষয়ভাষ্য হলো, ভাইফোঁটা শীর্ষক হিন্দু সম্প্রদায়ের এই উৎসবে বোন ভাইকে ফোঁটা দিয়ে তার সকল অমঙ্গল দূর করে দেবে। ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে যমের কপালে কাঁটা দিয়ে ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় বোন এই গানসমূহে উদগ্র হয়। বাটা ভরে দূর্বা তুলে এবং চন্দন পিষে বাটার মধ্যে ভরে বোন ভাইকে ফোঁটা দিয়ে তার জীবনের সমস্ত অমঙ্গলকে দূর করে দিতে চায়।
‘ভাইফোঁটার গানে’র মধ্যে মাতৃস্নেহ প্রকাশক তিনটি অপ্রকাশিত গান লেখক উদ্ধৃত করেছেন। ‘ভোজনের সুখ ভাল মায়ের হাতের খানা’ (পৃ ১০০) ভাষ্যমধ্য দিয়ে মায়ের হাতে খাদ্যগ্রহণ করতে সন্তানের সুখপ্রাপ্তির কথাই গানটিতে প্রকাশিত হয়েছে। শিবগৌরীর দারিদ্র্যপীড়িত দাম্পত্যের চিত্র নিম্নরূপ :
ওমা মেনকা, আমার মন চলে না
ভাঙড়া শিবের ঘরে।
(পৃ ১০০)
নায়িকার ‘বসন বিমা কাঁপে গাও’ (পৃ ১০০) ভাষ্যমধ্য দিয়ে নায়িকা যে বস্ত্রাভাবে শীতে কষ্ট পায়, সে-কথাই স্পষ্টভাষিত হয়।
‘পরিহাস সঙ্গীত’ অংশে ‘নাতীনের গান’ এবং ‘ঝিয়ারির গান’ শীর্ষক দুটো গানের বিশ্লেষণ করেছেন লেখক নাতনি তার বধূয়া কর্তৃক বহুদিন যাবৎ বিচ্ছেদে থাকায় নাতিনের অন্তর বিরহকাতর। বন্ধু ভাত খাবে বলে নাতনি ভাতসহ মাগুর মাছ রান্না করেছে, তাকে খাওয়ানোর জন্যে। তার বন্ধু ‘রঙ্গী চঙ্গী’ বলেই অন্য নারীর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়। নাতনিও যৌবন বেদনায় আর্ত; সে তার দিদিকে বলে :
কতকাল রাখিব যৌবন গো দিদি, বসনে বান্ধিয়া
(ওই, )
‘ঝিয়ারির গানে’র ঝিয়ারির সঙ্গে ‘তালৈ’র অসম সম্পর্কসূচক শরীরী-প্রেমের ব্যাপারে অশ্লীলতার ইঙ্গিত গানটিতে রয়েছে। ঝিয়ারি সাজপোশাকে টিপটপ। ঝিয়ারির যৌবনকে প্রথমে ‘তামা কাঁসা’ বললেও পরে যৌবনকে ‘মেঘের ফোঁটা’ বলে যৌবনের ক্ষণস্থায়িত্বের কথাই বোঝানো হয়েছে। যৌবনে পদস্খলিত না হবার আকাঙ্ক্ষাই গানটিতে অভিব্যক্ত। কারণ যৌবনের গর্ব করা ভালো নয় বলে গানটিতে উল্লিখিত আছে :
ঝিয়ারীর যৌবন মেঘের ফোঁটা দেশ বিদেশে রইল খোটা
আম কাঁঠাল তো আষাঢ়ের পর থাকে না –
এ যৈবনের গৈরব কথা ভাল না।
(ওই, পৃ ১০২)
‘মাঘমন্ডল’ রচনায় বলা হয়েছে, পূর্ববঙ্গ ও শ্রীহট্টের পল্লীর অবিবাহিত হিন্দু বালিকারা সূর্যব্রত অনুষ্ঠান করে তারা চন্দ্র-সূর্যকে প্রণতি জানায়। মেয়েরা আনন্দ, নিষ্ঠা ও ভক্তির সঙ্গে এই পূজা করে। পূজা শেষে সূর্য দেবের নিকট প্রণতি করে ‘বর’ প্রার্থনা করে। গানভাষ্য :
চান্দ পূজলাম চন্দনে/ সুরুজ পূজলাম বন্দনে
চান্দ পূজ্যা পাইলাম স্থান/ সুরুজ পূজ্যা স্বর্গধাম।
(ওই, পৃ ১০৪)
‘অপ্রকাশিত পুতুল বিয়ের ছড়া’ রচনাবেশে বালিকার পুতুলকে বিয়ে দেবার কথাচ্ছলে আসলে বালিকার প্রকৃতপক্ষে বিয়ে হয়ে যাবার কথাই অভিব্যক্ত হয়েছে। জামাইকে খাট, পালঙ্ক, তামা, কাঁসা, আসন, বসন, হাতি, ঘোড়া, দাসি, বাঁদি সবকিছু দেওয়া হলো; তবুও জামাই খুশি নয়। কন্যাও দেওয়া হলো, তবুও সে খুশি নয়। আসলে সে কন্যা তো পুতুলকন্যা। প্রকৃত কন্যার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সেই কন্যা তাঁর মায়ের ‘কান্দন’ শুনে; শুধু তাই নয়, কন্যার জন্যে –
ভাই কান্দে বাবা কান্দে গামছা মুখে দিয়ে
সোনামুখী বইনে কান্দে পন্থপানে চাইয়া
পেট-পোড়ানী মায়ে কান্দে ভূমিতে লুটাইয়া।
(ওই, পৃ ১০৭)
‘অপ্রকাশিত বাউল সঙ্গীত’ অংশে কোনো আলোচনা নেই; শুধু ছয়টি গান সংকলিত হয়েছে। বাউল গানে মূলত স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির প্রেমময়তার সম্পর্ক সন্নিবদ্ধ থাকে। ১নং গানে আছে : ‘দেহের মধ্যে থাকে যে মনোরায়’ (পৃ ১০৮)। এই ভাষ্যমধ্য দিয়ে দেহের মধ্যে মনরূপী তথা আত্মরূপী যে স্রষ্টার অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃত আধ্যাত্মিক গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্রষ্টাকে চেনার কথাই এখানে অভিব্যক্ত হয়েছে। ৫নং গানে যে বলা হয়েছে, দেশের জন্য সাধকের প্রাণ কাঁদে; বিদেশে সে ঘুরে মরছে – এই ভাষ্যমধ্য দিয়ে আসলে আত্মার দেশে এবং স্রষ্টাময় অস্তিত্বের প্রকৃত দেশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সাধনের মধ্যে অভিব্যক্ত হয়েছে; আত্মার দেশ ভিন্ন সাধারণলোকে তার অবস্থানকে সাধক মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। স্রষ্টার সন্ধানী যে হয়, মৃত্যু দেবতা যমের ভয় তার থাকে না; কারণ স্রষ্টাই তো তার বন্ধু; স্রষ্টার তো তার জন্য যথেষ্ট :
সেই দেশের যে দেশী হয় ঘোচে তার শমনের ভয়।
(ওই, পৃ ১০৯)

অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাহিত্যসমালোচনামূলক প্রবন্ধ
বর্মণের ‘রোকেয়া জীবনী’ রচনাটি সামসুন নাহার প্রণীত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনী-গ্রন্থের ভূমিকা। এটিকে আমি প্রবন্ধ হিসেবে অভিহিত করেছি লেখকের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন অভিমতের জন্যে। সমাজের ও পারিপার্শ্বিকতার প্রচন্ড বাধাবিপত্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে রোকেয়া তার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পেরেছিলেন বলেই বঙ্গীয় মুসলমান নারীসমাজ তাদের জাগরণ, শিক্ষাদীক্ষা ও আত্মমুক্তির পথ প্রশস্ত হওয়ার জন্যে রোকেয়ার নিকট চিরঋণী থাকবেন। বোরখার অন্তরালে অবরোধবাসিনী থেকে বঙ্গীয় নারীরা যে ক্লেশময় ও গ্লানিকর জীবনকে যাপন করেছে – রোকেয়ার প্রচেষ্টাতেই তারা আলোর মুখ দেখতে পেরেছে। জ্ঞানার্জনের স্পর্ধিত স্পৃহা রোকেয়াকে সমাজের রক্ষণশীলতার আগল ভেঙে নারীদেরকে অধিকার ও জীবনের কল্যাণময়তার বৃহত্তর বৃত্তে উপনীত করে দিতে সমর্থ করে তুলেছে বলে আমি মনে করি।
‘টিএস এলিয়ট’ অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি প্রাতিস্বিক ও প্রতিভাদীপ্ত সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। এলিয়ট কেন বড় ও মহৎ কবি এবং কীভাবে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যচিন্তাধারায় নবতর জাগরণ সৃষ্টি করলেন – সেই অনুদ্ঘাটিত প্রেক্ষাপটের দ্বারোন্মোচন করেছেন বর্মণ। এমন অন্তর্দৃষ্টিতে এলিয়টকে বিবেচনা করার সামর্থ্য বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অনেক শিক্ষকরাও রাখেন না বলে আমি মনে করি।
এলিয়ট ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মিসৌরির অন্তর্গত সেন্ট লুইনায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১২-১৪ পর্যন্ত তিন বছর এলিয়ট হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব এবং সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করেন। ১৯১৪-তে অক্সফোর্ডের মার্টন কলেজে গ্রিক দর্শন অধ্যয়ন করতে আসেন। এ-সময় তিনি ব্রহ্মবাদ সম্পর্কেও প্রবন্ধ শেখেন। ব্রহ্ম আসলে পরমাত্মা বা স্রষ্টারই প্রকাশরূপ। এলিয়ট ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ছিলেন। স্রষ্টার প্রতি ছিল তাঁর প্রচন্ড গভীর বিশ্বাসবোধ। সে-কারণেই নৈতিক অশুদ্ধতা, চারিত্রিক বিকার ও অবক্ষয়কে তিনি প্রচন্ড নেতিবাচক মনে করতেন। সভ্যতার মধ্যে গর্বকারী কিছু নেই বলে মন্তব্য করে এলিয়ট দেখিয়েছেন যে, মানুষ যেখানে অন্তঃসারশূন্য, সেখানে সভ্যতাও তো নেতিবাচকতার এবং অবক্ষয়েরই নামান্তর হবে।
একজন বড় ও মহৎ কবি পৃথিবীর যে কোনো দেশেরই মহৎ কবির স্বগোত্র। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের কথাই তিনি উচ্চারণ করেন।
রোমান্টিক কবিতা যখন কবিদের অন্তরাত্মা হাওয়ায় উড়িয়ে বেড়াচ্ছিল; এবং ব্যক্তিগত দুঃখবোধের নৈরাশ্যে যখন ব্যক্তি অতল গহবরে মজ্জমান হচ্ছিল; তখন এলিয়ট সমষ্টির দুঃখবেদনা, অভাব ও নৈরাশ্যকে প্রাজ্ঞতার দৃষ্টিতে সাহিত্যিক সমক্ষে উদ্ঘাটিত করে মানবতার ও প্রজ্ঞার প্রকৃত রূপকে স্পষ্টায়িত করতে সচেতন প্রয়াসী হলেন।
ত্রিশের দশকের পাশ্চাত্য বুদ্ধিবৃত্তি ভারতীয় বেদ ও উপনিষদের আত্মা-পরমাত্মা ও স্রষ্টাতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এলিয়ট নিজেও বেদান্ত প্রভাবিত ব্যক্তিত্ব। সে-কারণে ভারতীয় কালতত্ত্বের ভাববাদী দর্শন একটি শাশ্বত ও সূক্ষ্ম অনুভববাদী স্রষ্টাময়ী দর্শন – একথা প্রাজ্ঞজন স্বীকার করছেন। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও চিন্তাদর্শনের সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হলো, সে-সভ্যতা ত্যাগকে বিসর্জন দিয়ে ভোগবাদিতাকে বড় করে তুলেছিল। সে-কারণেই সেই সভ্যতায় ফাঁপা মানুষের জন্ম হয়েছে বেশি। ভারতীয় দর্শন ভোগবাদী নয়; মূলত ত্যাগবাদী দর্শন। এটিই আমাদের দর্শনের শক্তিমত্তাকে স্পষ্টায়িত করে।
পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজে যা নয়, তার চেয়ে বেশি বলে নিজেকে দাবি করে। এলিয়ট পাশ্চাত্য সভ্যতার অবক্ষয়, অন্তঃসারশূন্যতা, মেকিত্বকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার সভ্য মানুষগুলো যে কত অখাঁটি, কত অসার, কত ফাঁপা, কত অকিঞ্চিৎকর ও কত অন্তঃসারশূন্য, তা এলিয়ট স্পষ্টতার সঙ্গে উপস্থাপন করলেন।
এলিয়টের সভ্যতা ব্যবচ্ছেদে তাঁর মধ্যে নৈরাশ্য ও দুঃখবাদ প্রতীয়মান হলেও প্রচলিত মেকিত্ব ও ভন্ডামিপূর্ণ সভ্যতা-স্রোতের বিরুদ্ধে তিনি নৈতিকতা, ইতিবাচকতা, মূল্যবোধ, বিশ্বাসময়তা ও প্রশান্তির সুরকে জাগ্রত করার নিমিত্তে তখনকার বাহ্য ফ্যাশনবহুল কবিতাকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে তেজিত্বপূর্ণ, খাঁটি, অকৃত্রিম ও শোভন বোধকে উচ্চবিত্ত আনন্দময়তায় অবগাহিত করে তুললেন। তাঁর The Wasteland (১৯২২) সেই ভাষ্যেরই মননচিত্র।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে এলিয়টের Prufroch এবং ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের Poems-এর মধ্যে সে স্পষ্টভাষিত বিশ্বনিন্দাবাদের সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছিল; তা প্রচলিত চিন্তাচর্চার খুব বিরোধী হলেও বুদ্ধিজীবী মানসে তা নবচেতনার ও প্রজ্ঞার নব-উদ্দীপনার কারণে আন্দোলন ও আলোড়ন সৃষ্টি করতে শুরু করল। ভঙ্গুর সভ্যতাও জীবন্মৃত মানুষকে জাগ্রত করতেই তিনি বিশ্বাসময় শুভ্রতার সুর তাঁর কবিতায় সচেতনভাবে আমদানি করলেন।
বিপ্লবমুখী সমাজ-বিশ্লেষণ ও ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণী ভাবনার নৈরাজ্য যখন বিশ্বচিন্তারাজ্যকে জবরদখল করে তুলেছিল; তখন এলিয়টের সাহসী, নীতিবাদী ও স্রষ্টাবিশ্বাসী সুরের অমোঘ শক্তিমত্ততা সভ্যতার ইতিবাচকতাকে আলোর পথে প্রধাবিত করেছে বলে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের বিষয়নির্ভর, লোকসংগীতনির্ভর এবং সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধসমূহের অন্তর্গভীরে দৃষ্টিপাত করলে আমরা প্রত্যক্ষ করি যে, তাঁর জৈবনিক বোধের গভীরতা, জীবনদৃষ্টির তীক্ষ্ণতা এবং মানবের প্রতি মমত্ববোধের প্রগাঢ়তা এবং ভাষাশিল্পের আভিজাত্য তাঁকে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের একটি পরিণত জায়গায় সমাসীন করে। 