সৈয়দ হক

আনিসুজ্জামান
সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এবং তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ তাসের সঙ্গে আমার সংযোগের কথা অনেকবার লিখেছি। তার পুনরাবৃত্তি না করে বরঞ্চ শোনা যাক ছন্দোবদ্ধ চরণে এ-বিষয়ে কী বলেছেন সৈয়দ হক :
কতই স্মৃতি ব্যক্তিগত, কত না হুল্লোড়,
আড্ডা দিতে দিতেই কত রাত করেছি ভোর।
পাকিস্তানের প্রথম সেই দিনগুলোতে দেখা,
আমরা তখন কেবল শুরু করছি যে-যার লেখা,
নামেই পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে যে জুটি –
আসলেই তো বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে উঠি।

সাহিত্যের সেই আন্দোলনে সেদিন আনিসের
সাংগঠনিক তৎপরতা স্মরণ করি ঢের।
আমার প্রথম বই বেরুবে – সংশোধনে আনিস –
দেখিয়ে দিলেন ভুল বানানে ‘ভূল’ লিখেছি – ইস!
তাতেই কি শেষ? মেকাপ-টেকাপ দেখিয়ে দেয়া তাঁর।
চুয়ান্ন সাল। তরুণ আমি হলাম গ্রন্থকার।
এই পর্বের অন্য প্রান্ত আরো তিন দশক পরে, লন্ডনে। সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন তাঁর প্রথম কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। আমিও তখন ওই মহানগরীতে আছি। আমাকেই প্রথম দিলেন পড়তে এবং আমার মন্তব্য শুনে মার্জনা করলেন তার শেষটা। ছাপা বই যখন এক কপি উপহার দিলেন, তখন দেখলাম, জ্বলজ্বল করছে তাঁর হাতের লেখায় : ‘আনিস – এই নাটকের প্রথম পাঠক – লন্ডনে’।
এসব কথা বলা শুধু আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে। শেষবারের মতো যখন তিনি হাসপাতালে, আমি তাঁকে দেখতে গেছি সস্ত্রীক – দ্বিতীয়বারে সঙ্গী আমাদের পুত্রও – তখন তিনি প্রশ্ন করলেন মধুসূদনের জীবনের এক বিশেষ পর্ব নিয়ে, সে-সম্পর্কে আমার জানা ছিল না, বলেছি, খোঁজ নিয়ে বলব। শেষবার জানতে চাইলেন, রোগী ও রুগি, ব্যাপারটা একই, তবে বানান ও উচ্চারণ দুরকম কেন? জবাব দিয়েছি আমার মতো করে, কিন্তু চমৎকৃত হয়েছি তাঁর জানবার আগ্রহ দেখে এবং ওই অবস্থায়ও যে নতুন নতুন লেখার পরিকল্পনা ঘুরছে মাথায়, তার প্রমাণ পেয়ে। মানুষটা সম্পূর্ণতই সাহিত্যে সমর্পিত – কুড়িতে যেমন, আশিতেও তেমনি।
সাহিত্যে আ-শির নিমজ্জিত না হলে পঞ্চাশের দশকের ঢাকায় কেউ সংকল্প করতে পারে – জীবিকানির্বাহের জন্যে চাকরি-বাকরি করবে না, লেখাকেই গ্রহণ করবে একমাত্র পেশা হিসেবে! পত্র-পত্রিকায়, বেতার-টেলিভিশনে, মঞ্চে-চলচ্চিত্রে – যেখানেই গেছেন তিনি, গেছেন মূলত কলমকেই সম্বল করে। যে-চ্যালেঞ্জ তিনি ছুড়ে দিয়েছিলেন নিজেকে, ষাট বছর ধরে তাতে বিজয়ী হয়ে গেছেন – এ কী কম কথা! অবশ্য যোগ্য সহযোদ্ধাও তিনি পেয়েছিলেন একজন – আনোয়ারা সৈয়দ হক।
কেবলই লেখার এই অদম্য বাসনা তাঁকে নিয়ে গেছে সাহিত্যের সদর রাস্তা থেকে কানাগলিতেও। কী না লিখেছেন তিনি!
ছোটোগল্প-উপন্যাস, খ- ও দীর্ঘ কবিতা, কাব্যনাট্য-গদ্যনাটক, প্রবন্ধ-কলাম, গান-চিত্রনাট্য। তারপর অনুবাদ-ছায়াবলম্বন, তাও শেক্সপিয়রের এবং দুর্দান্ত সফলতা সেখানেও! অবাক লাগে তাঁর বাঁক-ফেরা দেখে। যে-সময়ে আমাদের বড় কথাসাহিত্যিকেরা লিখছেন গ্রামজীবনকে কেন্দ্র করে, ঢাকা শহর যখনো নগর হয়ে ওঠেনি ঠিকমতো, সৈয়দ হকের অবলম্বন তখন নাগরিক জীবন – তার কতটা বাস্তব, কতটা তখনো অপেক্ষিত, সে-হিসাব কে নেবে, তবে তাতেই তাজ্জব আমরা। সেই সৈয়দ হক কাব্যনাট্য লিখছেন ১৯৭১-এ বাংলাদেশের গ্রাম নিয়ে, যে-গ্রাম সমগ্র বাংলাদেশেরই এক অনুবিশ্ব; লিখছেন ইতিহাসের পটভূমিতে কাব্যনাট্য, সে-ইতিহাস আমরা কজন জানতাম! আর তার ভাষা! অমন নাগরিক যে-লেখক, তিনি ব্যবহার করছেন আঞ্চলিক ভাষা, আর সে-ভাষাকে দিচ্ছেন এমন রূপ যা সকলের বোধগম্য! কবিতায় আধুনিকতার চর্চা করে এসেছেন তিনি, তাঁর হাতেই বড় বড় করে লেখা হচ্ছে পরাণের, গহীন, ভিতর – আর আমাদের বুক মুচড়ে দিচ্ছে তা।
লন্ডনেই একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন আমাকে, আচ্ছা, দেশবন্ধু, দেশপ্রিয় – এমনি উপাধি আর কী কী আছে বলো তো, বঙ্গবন্ধু বলতে হবে না। বললাম, রবীন্দ্রনাথ দেশনায়ক কথাটা ব্যবহার করেছিলেন সুভাষ বসুর প্রসঙ্গে। কদিন পর জানালেন, গণনায়ক লেখা হচ্ছে। তার পেছনে হয়তো আছে জুলিয়াস সিজার, শেক্সপিয়র আছেন নিশ্চিতই। আর সেটাই মেলালেন বাস্তবতার সঙ্গে – যেমন করে পায়ের আওয়াজ – নূরলদীন পরম বাস্তব হয়ে গেল। স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে জনতার মঞ্চে যাঁরা আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠে নূরলদীনের পাঠ শুনেছেন, তাঁদের মনে হয়েছে, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নয়, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দেয় এই নাটকের পাত্রেরা। এই যে সফলতা সৈয়দের, তা সামান্য নয়।
খেলারাম খেলে যা উপন্যাসের মূল বিষয়টা ব্যক্তিকে ঘিরে – তার কেন্দ্রীয় চরিত্রের নারীর আসঙ্গলিপ্সার কথাই আমরা জানতে পারি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা থেকে। তারই মধ্যে ঔপন্যাসিক ঢুকিয়ে দেন নিজের নাম – শেষের কবিতার বাইরে এমন কি আর পেয়েছি? তার চেয়ে বড় কথা, ষাটের দশকের বাংলাদেশের পরিবর্তমান রাজনীতির পটও চলে আসে এতে। অথচ রাজনীতির প্রতি ঔপন্যাসিক যে খুব আকৃষ্ট হয়েছিলেন তখন, এ-কথা বলা যাবে না। তার পরপরই আমাদের জীবনে দেখা দেয় মুক্তিযুদ্ধ আর সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা আর কথাসাহিত্য দুই-ই তিনি উপহার দেন আমাকে – কাব্যনাট্যের কথা আগেই বলা হয়েছে। নীলদংশন কী নিষিদ্ধ লোবান পড়তে আরম্ভ করলে শেষ না করে ওঠা যায় না, একটা ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি আমরা – সে-ঘোর ১৯৭১-এরই।
মুক্তিযুদ্ধের সূত্রেই রাজনীতিসচেতন হয়ে উঠলেন সৈয়দ হক, আমার তো তেমনি বিশ্বাস। এর পরও ব্যক্তি তাঁকে ভাবিয়েছে, কিন্তু তাঁর মধ্যে সমষ্টির একটা বড় স্থান হয়ে গেছে। তাঁর করোটিতে জায়গা করে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, তার পশ্চাদ্বর্তী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং তারও পশ্চাতের ইতিহাস – বাঙালির জাতিসত্তার ইতিহাস। তাই আমার পরিচয়ের মতো কবিতা বেরিয়ে আসে তাঁর হাত দিয়ে – মনে হয়, ছোটদের জন্যে লেখা, আসলে তা বড়দেরও পাঠ্য ও স্মৃতিতে সঞ্চয় করে রাখার মতো জিনিস।
সৈয়দ হকের ব্যবহৃত আঞ্চলিক ভাষার কথা বলেছি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে থাকে, এ-বিষয়ে তাঁর মধ্যে একটা সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু প্রমিত ভাষার ব্যবহারে তিনি ছিলেন খুবই সতর্ক। সেই সতর্কতা তরুণ লেখকেরাও অবলম্বন করুক, এই কামনায় তিনি লিখেছিলেন মার্জিনে মন্তব্য, হৃৎকলমের টানে, কথা সামান্যই। এসব লেখা সাহিত্যযশোলিপ্সু প্রত্যেক বাঙালির অবশ্যপাঠ্য।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেমন আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে, তেমনি বাস করে নগরের বাইরে। এ-সম্পর্কে সচেতনতাই কি সৈয়দ হককে প্রণোদিত করল নগরের বাইরে শেষ শয্যা রচনার? তাঁর চলে যাওয়ার সময় থেকে এ-প্রশ্নটা আমাকে ভাবায়। তার জবাব পাইনি, হয়তো পাব না। এমন একজন আত্মসচেতন মানুষ – ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে যিনি সবসময়ে মূল্য দিয়ে এসেছেন, নাগরিকতা যাঁর স্বভাবের অন্তর্গত – সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত যে নিলেন, তাও হয়তো তাঁর স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক একটা বিষয় হয়ে রইল।