আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতী

এম এম খায়রুল আনাম

প্রথমেই এখানে ধান ভানতে কিছু শিবের গীত গাওয়ার একটা প্রয়োজন আছে। যদিও বিষয়টি আমেরিকা, রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতীজনিত, তবু এ-বিষয়ে ভারতীয় এক প্রবীণ নেতা, লালা লাজপত রায়ের অনেক মৌলিক ভূমিকা আছে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যেসব ভারতীয় বিদ্রোহ করেছিলেন, সেই অগ্রজ রাজনীতিকদের মধ্যে লালাজি ছিলেন অন্যতম। তাঁকে পাঞ্জাব কেশরী (লায়ন অব পাঞ্জাব) বলা হতো। তাঁর প্রধান দুটি কীর্তি হলো, তিনি  ১. ‘ইন্ডিয়ান হোম লীগ অব আমেরিকা’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২. তিনি ১৯২০ সালে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু কে এই লালা লাজপত রায়?

লালা লাজপত রায়ের জন্ম আজকের পাঞ্জাবের ‘মোগা’ জেলার ‘ধুদিকে’ নামে একটি গ্রামে। পিতা মুন্সী রাধাকিষাণ আজাদ ও মাতা গুলাব দেবী। পিতার গোষ্ঠী ছিল বানিয়া আগরওয়াল। ১৮৮০ সালে লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজে আইন বিষয়ে পড়াশোনার সময় তিনি আরো দুজন ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা সংগ্রামী, লালা হংসরাজ ও পণ্ডিত গুরু দত্তের সংস্পর্শে আসেন। তিন বন্ধু মিলে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত ‘আর্যসমাজে’ যোগ দেন। ১৮৮৫ সালে আইন বিষয়ে পাশ দেওয়ার পর তিনি আর্যসমাজের সঙ্গে কংগ্রেসের কার্যকলাপেও যোগদান করেন। লালা লাজপত রায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান তিন হিন্দু জাতীয়বাদীর মধ্যে একজন ছিলেন। এই ত্রিরত্ন ‘লাল-বাল-পাল’ নামে অধিক পরিচিত ছিল। লালের লালা লাজপত ছাড়া অপর দুজন ছিলেন বালের বাল গঙ্গাধর তিলক ও পালের বিপিন চন্দ্র পাল। এঁদের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী গ্রম্নপ মনে করা হতো। মডারেট বা সহনশীল মধ্যপন্থী আর একটা গ্রম্নপ ছিল, যার প্রথম নেতা ছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখেল। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের সময় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বিপিন বিহারী পাল ও অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে লালা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে আন্দোলনকে সুদৃঢ় করেন। তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডির প্রতিবাদে পাঞ্জাব অংশের নেতৃত্ব দেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধীর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ ঘটলে মূলত হিন্দুভিত্তিক ‘কংগ্রেস ইন্ডিপেন্স পার্টি’ নামে একটি আলাদা দল গঠন করেন। ১৯২৮ সালে ব্রিটিশরাজ ভারতের সংবিধান সংশোধন করার ব্যাপারে সায়মন কমিশন পাঠালে দেখা যায় তার মধ্যে কোনো ভারতীয়কে মেম্বার হিসেবে নেওয়া হয়নি। এর প্রতিবাদে অনেক দলই শোভাযাত্রা করতে রাস্তায় নামে। লালা লাজপত রায়ও নিজে এমন একটা দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার শোভাযাত্রাকারীদের ওপর নৃশংসভাবে লাঠিচার্জ করে। এতে লালা লাজপত রায়ের মাথায় প্রচ- আঘাত লাগে (হেড ইনজুরি) এবং ওই সালের ১৭ নভেম্বর তিনি মারা যান।

লালাজি বিশ্বাস করতেন যে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন যখন সশস্ত্র আকারের দিকে চলে যাচ্ছে, তখন ভারতের এই পরিবর্তিত অবস্থানটি বুঝিয়ে বলার জন্য বিদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রপাগান্ডা দরকার। তাই ১৯১৪ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি ব্রিটেনে চলে যান। সে-সময় হঠাৎ প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধ বেধে যায় বলে তিনি ভারতে ফিরে আসতে পারেননি। অগত্যা তিনি সেখান থেকে আমেরিকা চলে যান ভারতের পক্ষে সমর্থন জোগাড় ও সুসংহত করতে। এই সময়ই তিনি ‘ইন্ডিয়ান হোম লীগ সোসাইটি অব আমেরিকা’ নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইয়াং ইন্ডিয়া নামে একটি বইও লেখেন। এতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের তীব্র সমালোচনা ছিল বলে বইটি প্রকাশের আগেই ইংল্যান্ড ও ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধ থামলে তিনি ভারতে ফেরত চলে আসেন।

কবি রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালের শেষের দিকে আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন। আগে থেকেই লালা লাজপত রায় সেখানে অবস্থান করছিলেন ও ভারতীয়দের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ১৯১৬ সালের তাঁর এক লেখনীতে জানা যায়, ওই সময়, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমেরিকায় বহু ভারতীয়ের বসবাস ছিল। এই ভারতীয়দের সিংহভাগই ছিল হিন্দু, পাঞ্জাবি ও শিখ। অন্যদের মধ্যে ছিল কিছু বাঙালি, তার চেয়ে কম কিছু মাদ্রাজি। বাকিরা ছিল মুসলমান ও অন্যান্য সব জাতি। আমেরিকার ভারতীয় পপুলেশনের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র এক বা দুই শতাংশ। অবশ্য বাঙালি বলতে, বাঙালি মুসলমানরা আবার ওই গ্রম্নপের মধ্যে ছিল না। তখন বাঙালি মুসলমানরা, নিজেদের বাঙালির বদলে মুসলমান বলে পরিচিত হতে পছন্দ করত, আর বাঙালি হিন্দুরাও তাদের আলাদা গ্রুপ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত ছিল। তাই এটা বুঝে নিতে হবে যে, আমেরিকায় মুসলমানদের সংখ্যা বলতে সারা পৃথিবী থেকে আসা মুসলমানদের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে ভারতের মুসলমানরা আছে এবং তার মধ্যে আবার বাঙালি মুসলমানরাও আছে।

সংখ্যা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, মোটামুটিভাবে এটা জানা গিয়েছিল, সে-সময় আমেরিকায় প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলেই প্রায় দশ হাজারের মতো ভারতীয় ছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও খোদ ইংল্যান্ড যোগ করলেও সারা ইউরোপে ভারতীয়দের সংখ্যা আমেরিকায় ভারতীয়দের সংখ্যার চেয়ে কম ছিল। এসব ভারতীয়ের মধ্যে কিছু ছিল দিনমজুর, নিতান্তই অশিক্ষিত, নিরেট, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানরা। বেশি মজুরি পাওয়ার আশায় বা লোভে জাহাজে করে ভাসতে-ভাসতে তারা এই অজানা সমুদ্রতীরে এসে পৌঁছেছিল। কিছু ছিল ছাত্র বয়সী, ভদ্রঘরের ছেলেপুলে, যারা নানা ধরনের ছোটখাটো কাজ (অ্যাড‌ জব) করে পয়সা জোগাড় করত, থাকা-খাওয়া আর পড়াশোনার খরচ চালাতে। খুবই নগণ্যসংখ্যক বড়লোকের পোলাপান ছিল, যাদের বাড়ি থেকে পাঠানো টাকা পাওয়ার সৌভাগ্য ছিল। এছাড়া কিছু রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীও ছিলেন। ভেকধারী কিছু সন্ন্যাসীও ‘স্বামী’ পরিচয় দিয়ে সবখানে যথেচ্ছ বিচরণ করে বেড়াত। এই বিরাটসংখ্যক ভারতীয়ের মধ্যে যেসব ছাত্র নিজে উপায় করে নিজের পড়াশোনা ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন, তাঁদের উৎসাহ, উদ্দীপনা, অধ্যবসায় ও কর্মপটুতার জন্য সবাই খুব প্রশংসা করত। লাজপত রায় লিখেছেন, ‘আমার দুঃখ এই যে দেশে ফিরে এরা সেই রকম কর্মোৎসাহ দেখান না’।

অধ্যাপকরা এবং অনেক অধ্যাপকের স্ত্রীরাও ভারতীয় ছাত্রদের ধীরস্থির, বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল স্বভাবে মুগ্ধ হয়ে তাদের অনেক স্নেহ করতেন। কিন্তু সেসবের সংখ্যা খুবই কম, সেসব ব্যতিক্রম। সাধারণভাবে ভারতীয় ছাত্রদের দুঃখ-কষ্টের সীমা ছিল না। অনেকটা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি ব্যবহারের মতো, ভারতীয় হোটেল ছাড়া অন্য হোটেলে তাদের ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল। আর পাগড়ি থাকলে তো কথাই নেই। আমেরিকানদের চোখে ভারতীয় মানেই ‘হিন্দু’। হিন্দুদের ঘৃণার চোখে দেখার প্রথম কারণ হলো তারা পরাধীন জাতি। মিশনারিরা নানাভাবে প্রমাণ করেছে যে, হিন্দুরা অত্যন্ত কুসংস্কারবাদী জাতি। অস্পৃশ্যতা, সতীদাহ, পৌত্তলিকতা ইত্যাদি নানা ধরনের কুপ্রথায় বিশ্বাসী এক বর্বর জাতি। তাছাড়া আবার তাদের গায়ের রং ময়লা, মাথায় পাগড়ি পরে। এই বাহ্যিক কারণ ছাড়া অন্তর্নিহিত ভয় হলো, শিক্ষিত হলে কাজের জায়গায় এরা আবার কুশলী প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ভারতীয় ছাড়াও জাপান ও চীন থেকেও নানা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও নানা ধরনের প্রকল্প এবং ট্রেনিংয়ের জন্য অনেক লোক আসত। কিন্তু ইতোমধ্যে সে-সময় ‘ইমিগ্রেশন ল’ বলবৎ হয়ে গেছে। এই আইনের প্রধান লক্ষ্য ছিল এশিয়ানরা যাতে সহজে আমেরিকায় প্রবেশ না করতে পারে। এশিয়ানরা মনে করত, এই বিলটা হল সমগ্র এশীয় জাতির প্রতি আমেরিকানদের অবজ্ঞা ও ঘৃণার চরম অভিব্যক্তি। মজার ব্যাপার হলো, যদিও এই আইন সব এশীয়বাসীর জন্য প্রযোজ্য ছিল, তবু যেহেতু জাপান ও চীন স্বাধীন জাতি, তাই তাদের কিছুটা সম্মান ও সুবিধা ছিল। অন্যদিকে ইংরেজ শাসকরাও চাইত না ভারতীয়রা বেশি বিদেশে যাক। কারণ বিদেশে গেলে সেখানে রাজদ্রোহী কাজকর্ম চালাতে অপেক্ষাকৃত নানা ধরনের সুবিধা ও স্বাধীনতা থাকে। অতএব এই আইনে হিন্দুদেরই ক্ষতি হলো বেশি। এই আইনের নাম বার্নেট ইমিগ্রেশন বিল। এটি পাশ হওয়ার আয়োজন চলার প্রাক্কালে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন। এসব ব্যাপারে বিভিন্ন স্থানে তিনি তাঁর নিজস্ব মতামত জানিয়েছেন। এই আইন সম্পর্কে ভারতীয়রা খুবই ক্ষুব্ধ ছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, তারা তো আসলে কোনো বর্বর জাতি নয় বরং আর্যজাতি, যারা ইন্দো-এরিয়ান ভাষাভাষী ককেশীয় গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত। সেদিক থেকে তারা বরং আমেরিকান গোত্রের অনেক কাছে। সে-তুলনায় চীনা, জাপানি বা অন্যান্য এশীয় জাতি, তারা তো প্রধানত মোঙ্গলীয়, আর্যদের কাছাকাছিও নয়। তাই লালা লাজপত রায় সে-সময় আমেরিকান সিনেটরদের কাছে লিখেছিলেন :

‘পৃথিবীতে একমাত্র হিন্দু জাতিকেই, শুধু সে হিন্দু, এই অপরাধে আমেরিকায় ঢুকতে না দেওয়ায় এই জাতির প্রতি যে কটাক্ষ করা হয়েছে তা ঘোরতর অবিচার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের দ্বারা হিন্দুরা আর্য বংশসম্ভূত বলে স্বীকৃত হয়েছে… তাদের প্রাচীন ভাষা সংস্কৃত এবং বর্তমানের বহু চলতি ভাষাই সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত ইন্দো-এরিয়ান ভাষার শাখা। বাস্তবিক এশিয়া মহাদেশে যত জাতি বাস করে, তাদের মধ্যে পার্শিয়ান ককেশিয়ান এবং ভারতীয়রাই আমেরিকানদের নিকটতম গোত্র।’ আমেরিকায় প্রবেশের ব্যাপারে যারা সাদা চামড়ার বা আর্যজাতি হিসেবে গৃহীত, সেসব মানুষের প্রতি কোনো বাধানিষেধ ছিল না। এমনকি সাদা চামড়ার মুসলমানদের আর্যতুল্য আকৃতি ও বর্ণ থাকলে যেমন তুর্কিরা, তাদের জন্য হোটেল-রেস্টুরেন্টে ঢুকতে কোনো অসুবিধা ছিল না। এই দেখে কোনো-কোনো ভারতীয় নিজেরা যে আর্য তা প্রমাণ করার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন ও আমেরিকান নাগরিক হওয়ার অধিকার দাবি করেছিলেন। কিন্তু যুক্তি দিয়ে গোঁড়ামির মতো একটা সংস্কারকে কি খ-ন করা যায়? লাজপত রায় তাঁর আবেদনে বলতে চেয়েছেন যে, আমেরিকার এই আচরণ সমগ্র ভারতবাসীর জন্য অপমানজনক। তিনি সেটা সম্প্রসারিত করে বলতে চেয়েছেন যে, অপমানটা সারা মানবজাতিকে করা হয়েছে। তাঁর প্রতিপাদ্য হলো, যারা আর্য নয়, তারা কি মানুষ নয়? অর্থাৎ গায়ের চামড়ার রং, নাকের গড়ন বা দেহের গঠনের ওপর তাদের যোগ্যতা নির্ভর করবে? লক্ষ করার বিষয়, আমেরিকানদের নানারকম বৈষম্য কিন্তু তাদের নিজের দেশের কৃষ্ণাঙ্গ ও নেটিভ আমেরিকানদের প্রতিও ছিল। কিন্তু লাজপত রায় সে-বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল আমেরিকার ইমিগ্রেশন আইনের কারণে সেদেশে ভারতীয়দের অবস্থা বা দুরবস্থা। রবীন্দ্রনাথও নিজে আমেরিকান ইমিগ্রেশন আইনের মধ্যে মানুষের মধ্যে তারতম্যের প্রতিবাদ করেন। তাঁর মতে আমেরিকা তথা পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছ থেকে ভারতের অনেক কিছুই শেখার আছে। কিন্তু ভারতেরও পাশ্চাত্য সভ্যতাকে অনেক কিছু দেওয়ার আছে। পাশ্চাত্যের দম্ভ তাঁর পছন্দ হয়নি।

তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের মঙ্গল সাধনে প্রাচ্যেরও কিছু দেয় আছে। আমরা শিক্ষার্থীরূপে এদেশে যাদের পাঠাই তাদের ভিতর দিয়ে তা বোঝার চেষ্টা কোরো। তোমাদের সভ্যতার যা শ্রেষ্ঠ দান তাই তো তারা গ্রহণ করতে এসেছে, এবং সেজন্যই তাদের স্বদেশের যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা তোমাদের গোচরে আনতে পারলে তারা আনন্দিতই হবে। তোমাদের কাছ থেকে তাদের দূরে ঠেলে রেখো না… এদেশের আইনকর্তারা প্রাচ্য ছাত্রদের আমেরিকায় প্রবেশের পথ রুদ্ধ করার উপায় চিন্তা করছেন… কিন্তু এই শিক্ষার্থীদের দাবি কম এবং এরা এত বেশী দিতে উৎসুক… এরাই তো পূর্ব পশ্চিমের মিলন ঘটাবে। এই দেশ এমন বিরাট, এমন সম্পদে পূর্ণ, এমন মানব প্রীতিতে পস্নাবিত, এখানে সামান্য কয়েক বছরের জন্য যে ক’টি ছেলে মেয়ে তোমাদের মধ্যে শিক্ষা পেতে এসেছে, তাদের কি একটু সহ্য করে, এতটুকু আতিথ্য দিয়ে, তোমাদের সাম্যভাবের (ডেমোক্রেসী) একটু অংশ দিতে পার না?’

সাংবাদিক বা পত্রপত্রিকার গণ্ডি পেরিয়ে কবি অনেক উচ্চ শ্রেণির মানুষ ও চিন্তাবিদদের সঙ্গেও এ-ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ-আলোচনা করেছেন। হেনরি ফোর্ডের সঙ্গে তাঁর আলাপ তখনকার নিউইয়র্ক সিটি ইভনিং পোস্টে এভাবে ছাপা হয় :

‘আমি হেনরি ফোর্ড-এর সঙ্গেও পরজাতি পীড়ন, দুর্বল জাতির শোষণ সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলাম। শ্রীযুক্ত ফোর্ড আমার বন্ধু। আমার বিশ্বাস তিনি আদর্শবাদী। যে বিপুল প্রচেষ্টায় ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি মানুষের বিরাট সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন, আমি তার প্রশংসা করি। কিন্তু যখনই তাঁর সঙ্গে আমি পরপীড়ন প্রসঙ্গটি তুললাম এবং এশীয় জাতির সঙ্গে তোমাদের দুর্ব্যবহারের প্রশ্ন তুললাম, আমার মনে হয় আমার বক্তব্য তাঁকে আমি বোঝাতে পারলাম না। তোমাদের জাতীয় চরিত্রের এইটাই অন্ধকার দিক… এবং অন্ধকার দিক থেকেই বিপদ আক্রমণ করে।… যেসব এশীয় ছাত্র এখানে শিক্ষা নিতে আসছে তাদের পথ বন্ধ না করাই কর্তব্য। কারণ শিক্ষাই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ দান যা তোমরা জগৎকে দিতে পার। আমি তোমাদের বলতে এসেছি যে আমাদেরও কিছু দেওয়ার আছে, আমরা কেবলি নিতে চাই না।’

মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা অনুযায়ী ‘পরবর্তীকালে এই উদ্দেশ্যেই বিশ্বভারতী স্থাপিত হয়েছিল – যত্র বিশ্ব ভবেত্যক নীড়ং – যেখানে বিশ্ব এক নীড় হবে। যেখান থেকে ভারতবর্ষ আপনার শ্রেষ্ঠ দান বিশ্বের কাছে পাঠিয়ে সমস্ত জগতের যা কিছু শ্রেষ্ঠ তালাশ করবার অধিকারী হবে।’

আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ‘নেশনতন্ত্র’, ‘ন্যাশনালিজম’ বা ‘কাল্ট অব ন্যাশানালিজমে’র ওপর যে বক্তৃতাগুলো দেন, তার আলোচনা ও সমালোচনা, দুটোই হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ এর ওপর বিরূপ মনোভাব পোষণ করলেও, উচ্চশিক্ষিত ও মার্জিত রুচির আমেরিকানরা কবির সহজ-সরল অথচ গভীর চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। মডার্ন রিভিয়ু পত্রিকা অনুযায়ী লালা লাজপত রায় আমেরিকা থেকে লিখেছিলেন, ‘এদেশের যথার্থ শিক্ষিত লোকেরা যেসব আধুনিক কাব্য পড়েন তার মধ্যে রবীন্দ্রকাব্য থাকবেই… ’। ক্যালিফোর্নিয়া রিপাবলিকান পত্রিকা অনুযায়ী আমেরিকায় তাঁর যে সমস্ত অনুরাগী সৃষ্টি হয়েছিল, তাদের ভাষ্য নিম্নরূপ :

‘আমরা আমেরিকাবাসীরা প্রধানতঃ পাঁচটী কারণে ঠাকুরকে ভালবেসে ফেলেছি।  প্রথমতঃ তিনি আমাদের বুদ্ধির চেয়ে হৃদয়েরই বেশি কাছে এসেছেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি পাশ্চাত্ত জীবনের শূন্যতা পূরণ করেন, … আমাদের বাকী অংশ তিনি সম্পূর্ণ করেন। পশ্চিমের প্রাচ্যকে প্রয়োজন – প্রাচ্যেরও পশ্চিমকে প্রয়োজন।

তৃতীয়তঃ ঠাকুর হোমারের মত সহজ, পার্বত্যনদীর মত স্বচ্ছ, সূর্যোদয় ও সূর্যাসেত্মর মত স্বাভাবিক এবং এ সমস্তরই মতন অর্থের ভিতর নিহিতার্থে গুহায়িত গভীর (এন্ড অল দিজ অ্যাজ ডিপ দে আর উইথ মিনিং বিনিথ মিনিং)। ঠাকুর স্বদেশপ্রেমিক এবং বিশ্বপ্রেমিক। তিনি ভারতবর্ষকে ভালবাসেন, তার মুক্তির কামনা করেন, ইংরেজকেও ভালবাসেন, আমাদেরও ভালবাসেন এবং জাতির চেয়ে মনুষ্যত্বই তাঁর কাছে বড় – তাই তাঁর বাণীতে এ যুগের মহত্তম ভাব ভাষা পেয়েছে। পঞ্চমতঃ ঠাকুরের মধ্যে অহংকার নেই, তিনি বাক সর্বস্ব নন, তিনি যেমন সুন্দর কাব্য রচনা করেছেন তেমনি সুন্দর তাঁর জীবন রচনা। শুনতে বিষ্ময় বোধ হয় যে শুধু দেশপ্রেম কাব্য ইত্যাদির জন্যই তাঁর খ্যাতি নয়, তাঁর দৈহিক সৌন্দর্যের যশও তেমনি ছড়িয়ে পড়েছে। খ্রীষ্টের কল্পিত ছবির সঙ্গে তাঁর আকৃতির বিষ্ময়কর সাদৃশ্য আছে।’

সুধীন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন, ‘আইওয়াতে রবীন্দ্রনাথের ভাষণটির অপুর্ব জ্যোতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ কীর্তিরূপে স্মরণ থাকবে’। কবি কয়েকদিনের জন্য ইলিনয়ের শ্যাম্পেন-আরবানা শহরে বিশ্রাম নিতে গিয়েছিলেন। আরবানাবাসী লেখিকা মিসেস আর্থার সেমুর কবির সান্নিধ্যে আসেন এবং ‘কবির বিশ্রাম’ নামে যে-প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সেটা মডার্ন রিভিয়ুতে ১৯১৭ সালের ফেব্রম্নয়ারি সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। আরবানায় কবি নিজে তাঁর সন্ন্যাসী নাটকটি পড়ে শুনিয়েছিলেন। তা শুনে মিসেস সেমুরের মনে হয়েছিল, দেবতারা স্বর্গে থাকেন। কিন্তু তিনি যে এই ছোট্ট তৃণভূমি (প্রেরী)-তে আসতে পারেন, তা কি কেউ বিশ্বাস করবে?

দি ইভনিং উইসকনসিন পত্রিকা তাঁর বক্তৃতা সম্বন্ধে লিখেছিল। ‘…পরিষ্কার শুদ্ধ উচ্চারণের মধ্যে একটি নরম মধুর সুর, সুকুমার শিশুর মত একটি ললিত ধ্বনি মাঝে মাঝে বেজে ওঠে, যেমন ওড়নার আচ্ছাদনে মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ে সুন্দর নিখুঁত সুগঠিত মুখের ভাস্কর্য লাবণ্যময় হয়, তেমনি তাঁর উচ্চারণকে সুন্দরতর করে তুলছিল।’ এসব বর্ণনা পড়ে মনে হতে পারে যে, সাংবাদিকরাও কি তাহলে কবি বনে গেল? অভিভূত সাংবাদিক কবির বক্তব্য যেমন শুনেছেন বা অন্তরে উপলব্ধি করেছেন, সেভাবে লিখেছেন, ‘দেখ আমি বিধাতার বিধানে বিশ্বাস করি – নিজেকে প্রস্ত্তত ও শান্ত রেখে আমি অপেক্ষা করি বিধাতার ইচ্ছা যেন আমার মধ্যে ব্যাহত না হয়। তাই যখন বিদেশের নিমন্ত্রণ পেলাম, বারে বারে ডাক এল, আমি মনে করলাম এ আহবানে আছে বিধাতার আদেশ – তোমাদের কাছে আমার কথাটি বলা চাই – আমি জানতাম না কি বলব। যখন লিখতে বসি জানি না কি লিখব, কি কথা প্রকাশ হবে। আমি অপেক্ষা করে থাকি, তারপর যা প্রকাশ পেতে চায় তাকেই ভাষা দিই… ’ কবি যখন এভাবে বলে যাচ্ছিলেন তাঁর শ্রোতার মনে হচ্ছিল, কবির গানে ও কাব্যে কোনো পার্থক্য নেই।

কৃতজ্ঞতা : ১. বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ২. অন্তর্জাল ৩. বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ, মৈত্রেয়ী দেবী। [শিকাগো, যুক্তরাষ্ট্র]