শিল্পে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের বিজয়গাথা

এস এম সাইফুল ইসলাম

Art Work
Art Work

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অধ্যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং লাখো প্রাণের আত্মত্যাগে অর্জিত বিজয়। যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের মানুষ সত্যিকার অর্থেই যুগলভাগ্য তাঁদের। কারণ একই সূত্রে তাঁদের অর্জনে রয়েছে বেদনা ও শোক এবং বিজয় ও আনন্দ। এরকম গভীর অনুভব ও অভিজ্ঞতা অর্জন যুগপৎ অমূল্য ও অতুলনীয়। মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের একজন তিনি, বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের ভয়ঙ্কর দুঃসময়, জন্ম-যন্ত্রণা ও অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে পোড় খেয়ে নবীন বয়সেই গ্রহণ করেছেন জীবনের পাঠ। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের পলল মাটি ও শ্যামল শ্রী তাঁর চিত্তে এঁকে দিয়েছে সুন্দরের ছবি। বৈরী জীবন ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামী মানুষ তাঁকে জুগিয়ে চলেছে সামনে যাওয়ার প্রেরণা। জীবনের সমুদয় অভিজ্ঞতাকে শিল্পের দেবীর চরণে নিবেদনের জন্য একান্ত সাধনা ও নিষ্ঠ শ্রম তাঁকে দিয়েছে চারুময় ঋদ্ধি – তিনি শাহাবুদ্দিন আহমেদ। আমাদের সময়ের একজন অত্যন্ত কৃতী চিত্রশিল্পী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের চার দশক পূর্তি উপলক্ষে প্যারিস প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিন সম্প্রতি দেশে ফিরে মাসখানেক ধরে নিভৃতে এঁকেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি। জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারি সেই চিত্রকর্মগুলো দিয়ে গত ১৮-২৮ ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত আয়োজন করে ‘বিজয়ের চার দশক’ শীর্ষক একটি বিশেষ চিত্রপ্রদর্শনী। শাহাবুদ্দিনের ছবির প্রধান বিষয় গতিশীল মানুষ। সৃষ্টির মগ্নতায় তিনি দেখেন মানুষ ও মনুষ্য শরীরের বিচিত্র আবির্ভাব। চিত্রের জমিনের নানা প্রান্ত ছুঁয়ে তারা সহসা প্রকাশিত হয়। কখনো দুর্বার সেনার মতো সেই মানুষ শুভ্র শূন্যতা অতিক্রম করে ধাবমান ভূমির দিকে। কখনো মানুষগুলো উল্কার মতো, সেই শূন্যতায় দ্রুত বিলীয়মান। বোধ করি, শিল্পীর সবচেয়ে প্রিয় সে-মানুষটি – চৌকো চিত্রপটের এক কোণে একটি পা রেখে তির্যক রেখা বরাবর ছুটে যেতে চায় বিপরীত কোণে। বস্ত্তত এইভাবে মনুষ্য শরীর অদম্য বেগের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে তাঁর শিল্পে। আদতে ওই মানুষগুলো দূর অতীত থেকে মুক্তির স্পৃহায় লড়ছে। তারা ছিল প্রাগৈতিহাসিককালে এবং ঐতিহাসিক যুগে। জাতিগত সত্তার সংকল্প, স্বপ্ন ও সাধে তারা ১৯৭১-এ মুক্তি সংগ্রামী হয়ে শত্রুকে তাড়িয়ে বেড়ায়। গেরিলার রূপ ধারণ করে স্বদেশের শ্যামল প্রকৃতিতে মিশে থাকে। খুব নিবিড়ভাবে পাঠ করলে শাহাবুদ্দিনের চিত্রের মানুষের মধ্যে আবহমান কালের বাঙালির অজস্র সংগ্রাম ও স্বপ্নে বোনা বাঙালির ইতিহাস প্রতিভাত হয়। জাতিতাত্ত্বিক রূপের প্রতীকী একটি অভিব্যক্তি আছে শিল্পীর চিত্রে। সেই প্রতীক সবচেয়ে উজ্জ্বল ও বিশ্লেষিত হয়েছে ১৯৭১-এর মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এইভাবে আবহমানকালের বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্কের সূত্র অন্বেষণ করা যায় শাহাবুদ্দিনের শিল্পে। বস্ত্তত স্বাধীনচেতা বাঙালির সংগ্রামী প্রতীক-ই তাঁর ছবি। শিল্পী ও ব্যক্তি শাহাবুদ্দিন গভীরতর অর্থে অভিন্ন মানুষ। মানুষের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন – প্রীতি ও বন্ধুত্বের মনোভঙ্গি থেকে। প্রিয় লালশার্টধারী একষট্টি বছরের চিরযুবক শিল্পী শাহাবুদ্দিন হৃদয়ের গভীরে বিশেষ মনোযোগের সঙ্গে লালন করেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। রাজনৈতিক পিতার আদর্শ ও দেশাত্মবোধের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজে উল্লসিত থাকতে ভালোবাসেন এবং অন্যকে প্রাণিত করেন। সাম্প্রতিক প্রদর্শনীর ‘অমরতা’ শীর্ষক চিত্রে দেখা মেলে নিহত বঙ্গবন্ধুর শান্ত-সৌম্য প্রতিকৃতি। মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে অমরতা পেয়েছেন, মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছেন। শিল্পীর চিন্তা ও সৃজনে চমৎকার ব্যঞ্জনা পেয়েছে চিত্রকর্মটি। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন ও শিল্পে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় এবং অসীম প্রেরণার উৎস। এ প্রসঙ্গে সদ্যপ্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কথা যুক্তিসংগত – ‘শাহাবুদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বিশেষ আকর্ষণ করে তাঁর একটি মুখ্য পরিচয়ের জন্য। তিনি সর্বতোভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধাশিল্পী। তরুণ বয়সে তিনি বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বলেই তিনি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাশিল্পী নন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর শিল্পকর্মের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত, তাঁর শিল্পকর্মের প্রধান উৎস ওই মুক্তিযুদ্ধ, মূলত সে কারণেই তিনি অর্জন করেছেন মুক্তিযোদ্ধা শিল্পীর অভিধা।’ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বাস্তববাদী শৈলী তাঁর প্রেরণার উৎস। শিল্পী এস এম সুলতানের জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং বাংলার কৃষিজীবী মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রামের সঙ্গে শাহাবুদ্দিনের যোদ্ধা মানুষগুলোর সম্পর্ক ভীষণ গভীর। বলা যায়, সুলতানের কৃষক মানুষের সঙ্গে শাহাবুদ্দিনের যোদ্ধা মানুষগুলোর একটা যোগসূত্র আছে, যা বাঙালির ইতিহাসের সংগ্রামী ও বিজয়-চেতনা বিশ্লেষণ করে। বোধ করি, সেই অর্থে সুলতান ও শাহাবুদ্দিন অভিন্ন। সত্তরের দশকের শুরু পর্যন্ত শিল্পী শাহাবুদ্দিন আধুনিক চিত্রধারার প্রথাতেই ছিলেন। তারপর যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় বিষয়ের পালাবদল ঘটেছে। প্যারিসে দীর্ঘকাল বসবাসের পরেও পাশ্চাত্যের আধুনিকতা তাঁকে আকর্ষণ করেনি। এ প্রসঙ্গে শিল্পী নিসার হোসেনের বরাত দিয়ে উল্লেখ করতে হয় – ‘গত শতকের ষাট ও সত্তর দশকের শিল্পীরা পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্পকলার অনুপ্রেরণায় আমাদের শিল্পকলাকে যে পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন তাঁদের বিপরীত গন্তব্যে যাত্রা করেও খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছেন।’ তিনি তখন থেকে এখনো পর্যন্ত ভীষণভাবে আক্রান্ত স্বদেশ ও স্বদেশের সবচেয়ে মহান ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে তাঁর ক্যানভাসে যোদ্ধা মানুষের শরীর ক্রমাগত গতিশীলতার ব্যঞ্জনা পেতে শুরু করে। উল্লেখ্য, ইউরোপীয় সমঝদাররা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব না চিনলেও ওই গতিশীল সাহসী মানুষেরা শিল্পানুরাগীদের হৃদয়ে নাড়া দেয়। দর্শক ওই মানুষগুলোর পরিচয় জেনে নিতে চায়। শাহাবুদ্দিনের ভেতরের মুক্তিযোদ্ধা গর্ব ও প্রেরণায় ঘুরে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেন, বাংলাদেশের মানুষ। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ সংগ্রামের যোদ্ধা এরা। এই যে আমি, ওই যুদ্ধের সৈনিক। এভাবেই শাহাবুদ্দিনের আত্মোপলব্ধি এবং নিজেকে আবিষ্কার করা। শিল্পের আন্তর্জাতিক বিবেচনায় প্যারিসে তিনি গ্রহণযোগ্য হলেন। ওখানে আরো অনেক নিরীক্ষাপ্রধান অবয়বধর্মী বা ফিগারেটিভ কাজের শিল্পী থাকা সত্ত্বেও শাহাবুদ্দিন তাঁদের কাতারে দাঁড়িয়ে আলাদা হয়ে যান, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন। তাঁর যোদ্ধা মানুষগুলো ইউরোপীয় শিল্পীদের মতো নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত অস্তিত্বের দহনে ভাঙেনি। স্বাধীনতার স্পৃহায় তাঁর মানুষ দুমড়ে-মুচড়ে ঘুরপাক খেয়ে গতি ও শক্তির স্মারক হয়, সংগ্রামী চেতনার প্রতীক হয়। সাম্প্রতিক প্রদর্শনীর ‘আহত মুক্তিযোদ্ধা’ শীর্ষক চিত্রকর্মে তেমনটি দেখা মেলে। আহত কিন্তু অপরাজেয় এক মুক্তিযোদ্ধার আর্তচিৎকার যেন প্রতিধ্বনিত হয় ওই চিত্রপটে। প্রদর্শনীতে ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলার বাঘ’ ও ‘বিজয়’ সিরিজের চিত্রকর্মের পাশাপাশি ভারতের অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতিকৃতির দেখা মেলে। অন্যান্য চিত্রকর্মের মধ্যে ‘অভিযাত্রা’, ‘ধাবমান’, ‘তীর্থযাত্রী’, ‘রণক্ষেত্র’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’, ‘প্লাটুন’, ‘বধ্যভূমি’, ‘নিরীহ’, ‘যুদ্ধ’, ‘আমার পতাকা’, ‘যুগল’ ও ‘যমুনাবতী’ শীর্ষক ছবিগুলোতে প্রতিভাত হয়েছে শাহাবুদ্দিনের সেই চিরচেনা গতির ব্যঞ্জনা এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর যোদ্ধা মানুষের শরীর ও প্রতিকৃতি। আঙ্গিকগত দিক থেকে তাঁর চিত্র পাশ্চাত্যের শিল্পী উইলিয়াম ডি-কুনিং এবং ফ্রান্সিস বেকনের কাজ মনে করিয়ে দেয়। বিশেষত মানুষের মুখাবয়ব ও শরীরের বিকৃত রূপায়ণের সঙ্গে বেকনের কাজের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়। রেনেসাঁর মহান শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর কথাও মনে আসতে পারে। হতে পারে এই শিল্পীরাও শাহাবুদ্দিনের প্রেরণার অংশ। তাঁর শিল্পে যে ডিসকোর্স ও জাতীয়তাবাদী চেতনা আছে, তা শিল্পীর বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা, নিরলস ধ্যান ও শ্রমের মধ্য দিয়ে অর্জিত। মুক্তিযোদ্ধার বিশ্বাস, প্রেম ও দ্রোহের শক্তিতে তিনি ক্যানভাসে রংভর্তি ব্রাশের স্ট্রোক দেন একের পর এক। তারপর রঙের পরতে পরতে বিশোধিত শিল্পকর্মকে তিনি এমন একটা স্তরে নিয়ে যান, যখন তা নিজস্ব আলোয় দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। এই দ্যুতিময় চিত্রপট কেবল শিল্পের সংজ্ঞায় থেমে থাকে না, তা হয়ে ওঠে মানুষের স্বপ্ন ও মুক্তির চিরায়ত লিফলেট। হয়ে যায় সংগ্রামী মানুষের অন্তরের অনির্বাণ আগুন ও স্বাধীনতার প্রতীক। ‘জয় বাংলা’ মন্ত্রে দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিনের বিশালত্ব ও বিশিষ্টতা এখানেই।