সফিউদ্দীন : মীনাক্ষী দর্পণে

মইনুদ্দীন খালেদ

দৃষ্টি যদি অন্তর্ভেদী না হয় তাহলে সৃজন কী করে সম্ভব। সব সৃষ্টিই তো আত্মার নিজস্ব অবলোকনকে জানান দেয়। ধ্যানস্থ চোখ পর্যবেক্ষণের জোরে উপরিতল খসিয়ে দিয়ে কেবলই তলান্তর বা স্তরান্তরের খবর জানিয়ে দেয়। দুচোখ গলিয়ে দেখলে বিষয়বস্ত্তর নাটকীয় রূপ আবিষ্কৃত হয়ে পড়ে। এই নাটকটা খুব প্রত্যাশিত ছিল শিল্পগুরু সফিউদ্দীনের। মিতভাষী অনুচ্চকণ্ঠ শিল্পীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁর ছবির গভীরে যে-উপস্থাপনের নাটকীয় কৌশল আছে তা অনুভব করতে পারিনি। কিন্তু তাঁর চোখের দিকে তাকালে বোঝা যেত তিনি কতটা চমকিত হয়ে নিজেকে প্রকাশ করে চলেছেন। কিন্তু চোখের দিকে তাকিয়ে আমরা বেশিক্ষণ কথা বলতে পারি না। আর দুচোখ যখন সৃষ্টির সংবেদে আকুল তখন সে অাঁখিতারার দিকে কে-ই বা তাকিয়ে থাকতে পারে। অনেকদিন অনেক কথাই হয়েছে শিল্পীর সঙ্গে। তাঁর ছবি দেখে আমার মনে হয়েছিল যে, শিল্পীর ছবির মর্মার্থ ভালো বোঝা যাবে যদি তাঁর চোখের দৃষ্টিবিধি নিবিড়ভাবে পাঠ করা যায়। সে-পাঠ বড় দুরূহ ছিল। অনেক আগেই আমি বুঝেছিলাম যে, সফিউদ্দীনের ছবি পরিণামে তাঁর দৃষ্টির বিবিধ জ্যামিতি। চোখ ও চোখের জল তার প্রধান অনুষঙ্গ। শিল্পীসত্তা খুব বেশি জলপ্লাবিত। নদী, নৌকা, জাল, মাছ – সবই তো তাঁর জললগ্ন বিষয়।
অন্তর্ভেদী হয়ে বিষয় আবিষ্কারের অনুশীলন তিনি শুরু করেন শিল্পার্থী জীবনের উদয়প্রহরে। তাঁর স্বামীবাগের বাসায় বসে প্রায় দুই দশক আগে শিল্পী আমাকে শিল্পের বিষয় উদ্ভাবন নিয়ে একটি ঘটনা বলেছিলেন। একদিন শিল্পী হাঁটছেন দুমকায়। খুব ভোরে যাত্রা শুরু করেছেন। এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, কিন্তু বিষয় ধরা দিলো না। মলিন তুলি-কলম নিয়ে শিল্পী ফিরে এলেন। পরদিন আবারো শিল্পের জন্য পথহাঁটা শুরু হলো। আবারো দ্বিপ্রহর বিদায় নিয়েছে। এমনি সময় দেখলেন শালগাছের মোটা কান্ড আর বড় বড় পাতা ভেদ করে বিদায়ী সূর্য শেষ আলো ঢেলে দিয়েছে। গাছের তল দিয়ে বনপথ ধরে ঘোড়ায় চড়ে, পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরছে সাঁওতালরা। সেই দিনের সেই সূর্যের আলোকটুকুর কাছে আজীবন ঋণী রইলেন শিল্পী। তিনি উদ্বোধিত হলেন সে-আলোয়। ভাবলেন, এই তো আমার বিষয়। শিল্পের রহস্যজালে জড়িয়ে গেলেন সৃজনতাপিত শিল্পী। গল্পটা শিল্পী শেষ করেছিলেন একটা গভীর কথায়। স্পষ্ট উষ্ণ উচ্চারণে পরম আশ্বাসে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘জানেন, প্রকৃতির কাছে গেলেই ছবি অাঁকা যায় না। বিষয় খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি যে প্রথম দিন কোনো বিষয় পেলাম না কেন তা জানেন? কথা হচ্ছে, প্রকৃতির সঙ্গে আপনার একটা সম্পর্ক তৈরি হতে হবে। প্রথম দিন প্রকৃতি আমাকে নেয়নি। পরদিন যখন আবারও হাঁটছি তখন আমি সেই প্রকৃতির কাছে আর অচেনা নই। এভাবে একটু একটু করে আমার তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলো এবং তখনই আমি তাকে চিনলাম সে-ও তাকে আমার সামনে মেলে দিলো। বুঝলেন, প্রকৃতির সঙ্গে আলাপ করতে হলে অনেকটা সময় দরকার।’ এই ঘটনার পর সফিউদ্দীনের সাঁওতাল-পর্বের ছবি আমার আরো ভালো লাগতে শুরু করে। দুমকাই তো জয়নুল, সফিউদ্দীন ও কামরুলের আর্কেডিয়া – শিল্পচারণভূমি। কালো মানুষ আর তাদের কালো শূকর-মহিষই তো জীবনের দর্শন পাঠ করাল রামকিঙ্করকে। শিল্পের অন্যতম শর্ত যদি হয় অভূতপূর্বকে প্রদর্শন করা তাহলে আমি সফিউদ্দীনকে শিল্পী দৃষ্টির পর্যবেক্ষণতার প্রশ্নে স্পষ্টত বিরল মৌলিকতায় আবিষ্কার করি। এ-শিল্পী পুরাতাত্ত্বিকের মতো ধীরে ধীরে দুচোখ মেলে খুঁড়ে দেখেছেন সাঁওতালিয়া জীবন – প্রকৃতিলীন মানুষের জীবনের অনাবিল স্রোত। তিনি কেবলই অন্তর্ভেদী থাকতে চেয়েছেন। উঁচু পাড় থেকে দেখেছেন ক্ষীণ ময়ূরাক্ষীর জলধারা এবং এ-ধারা পাশে মানুষের চলাচল তাঁকে আকর্ষণ করেছে। ওপর থেকে দেখার জন্য ময়ূরাক্ষীর গর্ভের গভীরতায় জীবনের গতি বোঝা তাঁর জন্য সম্ভব হয়েছে। এবং এভাবে দেখায় এক বিপুল নাটকীয়তার সূত্র যুক্ত হয়েছে তাঁর শিল্পে।
অন্তর্ভেদিতার টানে কখনো দৃষ্টি তাঁর তীরের মতো ছুটে গিয়েছে বনের ভেতর দিয়ে। কাঠের ত্বক ছেনে-কুঁদে বস্ত্তর অন্তর্লীন অপূর্ব বিন্যাসটা কাজে লাগিয়ে আলো-অন্ধকারের দোলাচলে তিনি ছবির জন্মটা অনুভব করেছেন। কাঠের ব্যবচ্ছেদের পাশাপাশি অম্লীয় দ্রবণ ঢেলে ধাতবপাতের অন্তর্গত জগৎটা উজিয়েও ছাপাই ছবিতে প্রকৃতি ও প্রান্তীয়জনের জীবন বিধুর করে এঁকেছেন। ছাপচিত্রে যে সফিউদ্দীন বিন্দুর বুনট ও রৈখিক পরিমার্জনায় শিল্পের তাৎপর্য খুঁজেছেন স্নিগ্ধ রূপায়ণে সেই শিল্পীই আবার বর্ণের ক্বাথে তুলি স্পর্শ করে রূপের মাধুরীতে শিহরিত থাকতে চেয়েছেন। এ-নিরীক্ষার শিল্পযাত্রা তাঁর শুরু চল্লিশের দশকে। ইংরেজের প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা আর্ট স্কুলে রেনেসাঁস-উত্তর তেলচিত্র রীতি বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে রপ্ত করেছিলেন সফিউদ্দীন। কিন্তু সেই কালচে, মেটুলি, বাদামি বর্ণজোজেটর প্রথাগত তৈলরীতিতে তিনি নিজেকে খুব বেশিদিন আকর্ষিত রাখতে পারেননি। মধ্য চল্লিশের দশক থেকে নিবিড় চর্চা শুরু করলেন ইম্প্রেশনিস্ট রীতিতে। রীতি এক হলেও শিল্প দেশ-কালের ভিন্নতা পায়। তাই গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশের রৌদ্রপ্লাবিত প্রকৃতি অপেক্ষাকৃত বেশি উতল রাগে রঞ্জিত হয় সফিউদ্দীনের তুলিতে। আলোর প্রাচুর্য বোঝানোর জন্য ব্যাপকভাবে সাদা ছোপ দিয়েছেন ছবিতে। ইম্প্রেশনিস্ট পিসোরো-সিসলে-মানে-মনেদের অনুগামী থেকেছেন তিনি কিছুকাল। তারপর দ্রুত পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্টদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বাড়তে থাকে। সফিউদ্দীনের জীবনে ১৯৪৬ সালটা বেশ গুরুত্ববহ। এ-বছর দেখি শিল্পী চেতনাবস্ত্তকে পূর্ণভাবে বর্ণে সমর্পণ করেছেন। বর্ণ শুধু সত্য, সত্য আর কিছু নয় – এই ইম্প্রেশনিস্ট বাণীর স্মারক হয়ে ওঠে তাঁর ছবি। আমরা আর তাঁর ছবিতে প্রকৃতির রূপ দেখি না – প্রকৃতির রং দেখি মাত্র।
কিন্তু রঙের স্বয়ম্ভু অবস্থা থেকে শিল্পী আবার ফর্মে ফেরেন। প্রান্তরেখার পুরুত্ব ও দৃঢ়তা এবং সেই সঙ্গে সংক্ষিপ্ত তুলিছোপ তাঁর ভাব প্রকাশের মোক্ষম উপায় হয়ে পড়ে। ভ্যান গঁঘীয় তাতানো অবস্থাটার কাছাকাছি চলে আসেন তিনি। কিন্তু ভ্যান গঁঘের মতো নিষ্ঠুর খড়খড়ে অমসৃণ বর্ণতল নয়, বরং চোখজুড়ানো শান্তরসের ছবিই অাঁকলেন সফিউদ্দীন। ’৪৭-এ অাঁকা ‘জড়-জীবন’ আর নয় বছর পর ’৫৬-য় অাঁকা ‘সূর্যমুখী’; – এই দীর্ঘ সময়জুড়ে তিনি সংক্ষিপ্ত অতর্কিত তুলিছোপ ও হলুদ, কালো ও লালের তুমুল বিরোধে ভ্যান গঁঘের মতো শিল্পভাষায় মজ্জমান থেকেছেন। কিন্তু ফর্ম বা রূপবন্ধের গুরুত্বটা তিনি মাপতে শুরু করেন পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। ১৯৫২ অাঁকা ‘ধানঝাড়া’য় জ্যামিতিক গড়ন ও ইম্প্রেশনিস্ট তুলিছোপ পরস্পরিত হয়ে আছে।
১৯৫৪ সালে সফিউদ্দীনের চিত্রসাধনা বড় একটি বাঁক নেয়। এ-সময় তিনি রূপের স্বরূপকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান তাঁর চিত্রতলে। আলো-ছায়ার বিনিময়ে ত্রিমাত্রিকতার বোধ তৈরি করা নয় – নয় পুরোপুরি কিউবিজমের নিরীক্ষা – বরং বর্ণের স্বভাব বিবেচনা করে পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট ভাষাটায় ঋজুতা নিয়ে এসেছেন শিল্পী। ‘শূন্য ঝুড়ি’, ‘শরবতের দোকান’ এসব নামের ছবিতে আমরা সেই বৈশিষ্ট্য সহজেই অনুভব করতে পারি। ‘কাঠমিস্ত্রি’ (১৯৫৬) কাজটি দেখে বিস্মিত হতে হয়। এখানে মানবদেহকে তিনি দীর্ঘায়িত করেছেন। কিন্তু প্রামাণ্যকে তিনি ভাঙলেন কেন? করাত হাতে কর্মরত কাঠমিস্ত্রির দেহের গতিটা অনুবাদ করার জন্যই কি তিনি এই শিল্পকৌশল অবলম্বন করলেন? হয়তো কারণ তা-ই। তবে প্রমাণ আয়তন ভেঙে তিনি যে শিল্পভাষায় নির্ভর করলেন তাকে আমরা কীভাবে শনাক্ত করব? মিস্ত্রির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রলম্বন ও নববিন্যাস আমাদের কিউবিক রীতির কথা মনে করিয়ে দেয়। গভীরতর অর্থে কাজটি স্পষ্ট জ্যামিতিক গড়নের বিন্যাস মাত্র। এভাবে জ্যামিতিকে উচ্চকিত করে বঙ্গজ বৈশিষ্ট্যপুষ্ট কিউবিকপ্রায় শিল্পভাষা সৃষ্টি করলেন সফিউদ্দীন। তাঁর এ-ভাবনার প্রয়োগ এ-সময়ের আরো অনেক কাজেই লক্ষ করা যাবে। মধ্য পঞ্চাশের দশকে আমাদের শিল্পচর্চায় যে আঙ্গিকগত পরিবর্তন ঘটে বা বলা যায় একটা বড় রকমের পালাবদল ঘটে, তার এক প্রধান সারথি সফিউদ্দীন। কর্মপ্রধান ওই কিউবিকপ্রায় ভাষাটা এ-দশকে জয়নুল, কামরুল এবং এই গুরুদের শিষ্য আমিনুল, রাজ্জাক, কাইয়ুম, মুর্তজা বশীর প্রমুখ অনুসরণ করেছেন। কেউ ইউরোপীয় রীতিতে মুক্তি খুঁজেছেন, কারো-বা ধ্যান ছিল বাংলার লোকরীতির সঙ্গে পশ্চিমের জ্যামিতিক হিসাবের মেলবন্ধ হোক। এই ভাঙাগড়ার চর্চায় প্রথম নিয়োজিত হয়েছিলেন জয়নুল ও সফিউদ্দীন। জয়নুল নির্ভর করলেন ময়মনসিংহের লম্বাগলা পুতুলের গড়নে এবং তিনি ফর্মপ্রিয় বলে পুতুলের ভাস্কর্যসুলভতাও তাঁকে সৃজনের নতুন পথ চিনিয়ে দিলো। অন্যদিকে সফিউদ্দীন পশ্চিমের বাস্তববাদী শৈলীর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চাইলেন। নিপাট সমতলীয়তা ও পুরু রেখার জ্যামিতির প্রয়োগে সফিউদ্দীন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন।
মানুষ বলি, প্রকৃতি বলি, সবই জ্যামিতিক বিন্যাস। এ-সত্য পরম জেনে কেবলই নিরীক্ষানিষ্ঠ থেকেছেন সফিউদ্দীন। পঞ্চাশের দশকে প্রাণিজ ও প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ শৈলীকৃত করে এদেশে নকশাপ্রধান শিল্পভাষার জন্ম হয়। এ-ভাষার সঙ্গে নিবিড় যোগ ছিল এদেশের লোকশিল্পের। সফিউদ্দীন এ-দশকেই জাল, মাছ, পাতা-পতঙ্গের রূপের সমন্বয়ে সেই দ্বিতলীয় জমিনে নিজের নিয়মে ছবি অাঁকেন। জাল-জালিকা, মাছ, পাতা-পতঙ্গের রূপোস জগৎ চিত্রিত করে তিনি বাংলার নিসর্গের মায়াটাই পরিমিত জ্যামিতিতে চিত্রার্পিত করেছেন। ‘মাছ ধরার জাল’ (১৯৭৫) ছবিটির দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলার লোকশিল্পের ফর্ম ও অন্যান্য জ্যামিতিক গড়নের ঘনিষ্ঠ মিতালি।
জ্যামিতিক স্বচ্ছতা আর ঋজুতা; – এই দুই ভাবনা সফিউদ্দীনের চৈতন্যে আমৃত্যু জাগর ছিল। তাঁর এই উপলব্ধির প্রমাণ তাঁর শিল্পের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তাঁর বেশিরভাগ শিল্পই লম্বমানতা গ্রাহ্য করে অাঁকা। এটা তাঁর অনমনীয় আত্মবিশ্বাসেরই প্রতিফলন; – এমন ভাবা যেতে পারে। রেখাধর্মিতা আর গড়নের প্রাধান্য দিয়ে তিনি কম্পোজিশন তৈরি করেছেন। একসময় পশ্চিমের বাস্তববাদী শৈল্পীতে ঈর্ষণীয় পারমিতা আয়ত্ত করলেও তিনি বারবার বিবর্তিত হয়েছেন দ্বিমাত্রিকতার শক্তিকে অনুভব করে। তাঁর ছবিতে যত না মানুষি দেহের উপস্থিতি, তার চেয়ে বেশি প্রকৃতি ও অন্য বস্ত্তর অস্বভাবী উপস্থিতি রয়েছে। সব শেষে মানুষ বা প্রকৃতি, কেউ-ই নেই আর; আছে শুধু রং। নীল সন্ধ্যায় বা কালো রাত্রির বুকে আলো জ্বলছে যেন – এমন রূপ নিয়েছে তাঁর ছবি। রং দিয়ে ধ্বনি অাঁকা যায় কি না, গড়নের বৈচিত্র্যে সুরের ইন্দ্রজাল প্রতিভাত করা যায় কি না, এ নিয়ে ব্যাপক ভেবেছেন তিনি। সংগীতপ্রিয় সুরমথিত সফিউদ্দীনের হাতে যখন রং তখন তো তিনি সংগীতকেই চিত্রার্পিত করতে চাইবেন। সুরকে রঙের ব্যঞ্জনায় ধরতে চাইবেন; – এটাই স্বাভাবিক।
‘জলের নিনাদ’ নামে একটা ছবি এঁকেছিলেন শিল্পী। তাতে আমরা দেখেছি অজস্র গড়ন, বিচিত্র রেখাজাল আর রাশি রাশি বিন্দুর বুনটের টেক্সচার। অনেক সুর ও ধ্বনিতে তিনি অর্কেস্ট্রা রচনা করেছেন। অনেক বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনির দৃশ্যমানতা এ-ছবিতে পাঠ করা যায়। এ-ছবিতে যেন পশ্চিমের সংগীতই চিত্রল রূপ পেয়েছে। অপরপক্ষে ‘নীলের নিনাদ’, ‘নীল সংগীত’ এসব ছবিতে ভারতীয় বাগ-রূপ অনূদিত হয়ে থাকবে, এমন ভাবা যেতে পারে। সফিউদ্দীনের চিত্রসাধনার স্বরূপ নিবিড় ব্যবচ্ছেদে বুঝতে হলে সংগীত ও বিমূর্ত শিল্পের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে হবে। এ-বিষয় বিদগ্ধ চিত্রজ্ঞ ও সংগীতজ্ঞ গবেষণায় নিয়োজিত হতে পারেন। সুর ও ধ্বনির সঙ্গে চিত্রকলার কী সম্পর্ক এ নিয়ে বিশেষ ভাবনা ছিল সফিউদ্দীনের। এজন্যে তাঁর স্পেসের মধ্যে রেখা ও ফর্ম অনেকটা সংগীতের নোটেশন বা স্বরলিপির মতো দ্রষ্টব্য মনে হয়।
মাছ ও চোখের মোটিফ সফিউদ্দীনের প্রধান অবলম্বন। মন ও মস্তিষ্কের অনুরণন চোখকে কম্পিত করে। চোখের তারা বিবিধ সুখে-দুঃখে নানা জ্যামিতির জন্ম দেয়। চোখের মতি ও পাতার চাঞ্চল্যে জীবনের অনেক জোয়ার-ভাটা অনুভববেদ্য করে তুলেছেন শিল্পী। যে-গড়নটি তাকে গহনে টান দিয়েছে তা মাছ। আবার এই মাছের রূপই তো চোখ। কোনো অতল মীনাক্ষীর ডাক কি তিনি শুনতে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার মতো?
বড় বিস্ময় লাগে তাঁর সাদা মাছের এচিংটি দেখলে। এ-কাজে অবলোকনমাত্র বিমোহিত হতে হয়। তীর্যক বেগ দুটি মাছের। কিন্তু এখন তারা স্তব্ধ। যেন লক্ষ বছর আগের কোনো লুপ্ত সাগর থেকে মাটি খুঁড়ে মাছের স্নিগ্ধ ফসিল আবিষ্কার করা হয়েছে। শুভ্রতা ও শুচিতার কোনো এক শেষ গন্তব্য সফিউদ্দীনের সাদা মাছ।
সফিউদ্দীন একই সঙ্গে ঋজু ও কাতর। মর্মাহত হৃদয়ই শিল্প রচনা করে। যে কাঁদেনি সে কি কখনো সৃষ্টি করতে পেরেছে? অনেক কান্নাকে চিত্রিত করেছেন এ-শিল্পী। চোখ যার প্রধান বিষয় তখন সঙ্গী তো অশ্রুই হবে। দুঃখ ছাড়া কি চোখের বৃত্তান্ত বোঝা যায়? প্রকাশ কি পায় অন্তরের কান্না অাঁখিতারার মরণ নৃত্য ছাড়া। কোনো এক অন্তঃগূঢ় কান্নাই হয়েছিল কি সফিউদ্দীনের প্রধান বিষয়? শিল্পী তো শেষাবধি নিজেকেই লিখে যায়, এঁকে যায়। আত্মপ্রতিকৃতির মধ্যেই আত্মকথা থাকে চিত্রশিল্পীদের যেমন আছে রেমব্রান্ট, ভ্যান গঁঘ, রবীন্দ্রনাথ ও বেকনে। সফিউদ্দীনও নিজেকে এঁকেছেন অাঁখিতারা ও অশ্রুধারায় নিজেকে সমর্পিত করে। নিজেকে এঁকেই সংগীতপ্রিয় শিল্পী অন্তিম চিত্রল সংগীত শুনিয়ে গেলেন। চোখ দিয়ে সুর শুনতে না পারলে সফিউদ্দীন-অনুভব অপূর্ণ থেকে যাবে। 