আমি যে তাঁর মায়ের মতো

নাহিদা শারমিন

শুভ জন্মদিন বাবা’ – এই ছিল সূচনা, বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের। কিন্তু তখনো বাবার ছেলের সঙ্গে আমার আকদ্ হয়নি। তবে দু-পরিবারের মধ্যে সম্বন্ধের কথা পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল, তাই বাবাকে বাবা ডাকতে দ্বিধা করিনি। অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা নিয়ে বাবার সঙ্গে আমার কথা শেষ হয়। সেই দিনটি ছিল ২৩ জুন ১৯৯৯। বাবার ৭৭তম জন্মদিন। ২২ জুন বাবার নামে একটি পার্সেল পাঠিয়েছিলাম। আমার করা ব্লকপ্রিন্টের একটি চাদর ছিল জন্মদিনে শুভেচ্ছা উপহার। পার্সেলটি ২৩ জুন বিকেলেই বাবার হাতে পৌঁছে গিয়েছিল। আর আমি ফোন করেছিলাম সন্ধ্যা ৭টার পর। অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বাবা এবং আমি কথা বললাম প্রথমবারের মতো।

Shafiuddin Ahmed with his camera
Shafiuddin Ahmed with his camera

বাবা জানতে চাইলেন, চাদরটি কি তুমি করেছ? বললাম, জ্বি বাবা। বাবা বললেন, খুব সুন্দর কাজ হয়েছে। আমি যত্ন করে তুলে রেখেছি। পরে বাবার সান্নিধ্যে যখন আসার সুযোগ হলো তখন দেখলাম এবং বুঝলাম, যে কোনো ভালো কিছু যত্ন করে তুলে রাখা বাবার স্বভাবজাত ধর্ম। সে-রাতে কথা বলে আমি এই ভেবে খুবই স্বস্তি পাচ্ছিলাম, আমি শ্বশুরবাড়ি বলতে যেমনটি খুঁজছিলাম, তা-ই যেন আল্লাহ আমাকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। আমি কাজপাগল মেয়ে। মনে হলো, বাবা এবং পরিবারটি আমার কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে আমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। আজ এ-মুহূর্তে বলতে পারি, আমার চিন্তায় কোনো ভুল ছিল না।
২৯ জুলাই ১৯৯৯ সালে আমাকে পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করতে বাবা রওনা হয়েছিলেন আমার জন্মভূমি চট্টগ্রামে – আমার পিত্রালয়ে। ৩০ জুলাই দুপুরে তাঁর পুত্রবধূর সাজে প্রথমে মাকে (শাশুড়ি) এবং ছোট খালা শাশুড়িকে সালাম করলে দুজনেই এক এক করে আমাকে বুকে জড়িয়ে নেন। এরপর বসার ঘরে বাবাকে সালাম করে যখন বাবার পাশে দাঁড়াই তখন বাবা চোখে-মুখে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়ে আমার হাত দুটি ধরে বললেন, তুমি দেখতে আমার মায়ের মতো। সেই থেকে তিনি আমাকে ‘মা’ বলেই ডাকতেন। আমার মধ্যে বাবা তাঁর মাকে দেখতে পেতেন কি-না জানি না। তবে আমি যে তাঁর মায়ের মতো এ-কথাটির প্রমাণ পেয়েছি বাবার জীবনের শেষদিনটি ২০১২ সালে ১৬ মে বিকেলে ও রাতে বলে যাওয়া শেষ কথাগুলোয়।
আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ড্রইং ও পেইন্টিংয়ের ছাত্রী ছিলাম। আমার যাঁরা শিক্ষক ছিলেন শিল্পী আবুল মনসুর, মনসুর-উল-করিম, মিজানুর রহিম, আবার তাঁদের যাঁরা শিক্ষক ছিলেন, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী; তাঁদেরও শিক্ষক ছিলেন বাবা শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ – পরবর্তীকালে শিল্পগুরু সম্মানে ভূষিত হলেন যে মানুষটি; অত্যন্ত কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছিল মহান আল্লাহতালার কৃপায়।
আমি সে-সময় চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজে অধ্যাপনা করছিলাম। সে-সুবাদে চট্টগ্রামের শিল্পীমহলে প্রচার হয়ে গিয়েছিল আমার বিয়ের কথা এবং বাবা শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের চট্টগ্রামে আগমনবার্তা। এ-সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না, দ্রুত সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের আকদ্ অনুষ্ঠানের পর ৩০ জুলাই ১৯৯৯ সালের বিকেলে চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাবাকে সম্মান জানানো হবে। সেই বিকেলে কলেজ প্রাঙ্গণে তিনটি গাছ রোপণ করানো হলো – বাবা (সফিউদ্দীন আহমেদ), নবী স্যার (রফিকুন নবী) ও আলভী স্যারকে (আবুল বারক আলভী) দিয়ে, সঙ্গে ছিলেন সুবীর চৌধুরী, আমাদের সুবীরদা, আমার শিল্পী শিক্ষকগণ এবং আমার শিল্পী সহকর্মীরা। বাবার ভাগে ছিল সফেদা গাছ, তাঁর প্রিয় ফলের গাছ। এখন আমি যখনই চট্টগ্রামে যাই, সফেদা গাছটির সামনে দাঁড়াই, মজা করে সবাইকে বলি, এ-গাছটি লাগানোর বয়স যত আমার বিয়ের বয়স ততো। এ-বছর চট্টগ্রামে চারুশিল্পের চল্লিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগদানের পর ঢাকায় ফিরে বাবাকে গল্প করেছি। বলেছি, গাছটি বেশ লম্বা হয়েছে, আপনার মতোই ছিপছিপে লম্বা গড়ন – এ কথাই বলে সবাই। শুনে বাবা হাসলেন। ২০১২ সালের ৩০ জানুয়ারি যে-গাছের কথা শুনে বাবা হেসেছিলেন, আজ সে-গাছটি বাবার স্মৃতি বহন করছে চট্টগ্রামের চারুশিল্পীদের মনে।
আমার জীবনের যেদিনটি ধ্রুবতারার মতো সত্য মনে হয় গতকালেরই ঘটনা বলে, সেদিনটি হলো শ্বশুরবাড়িতে প্রথম পা রাখা, ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে। তার এক থেকে দেড় মাস পরেই ৩ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে আমার পিত্রালয় থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় এবং ৪ ডিসেম্বর ভোরে শ্বশুরালয়ে প্রবেশের চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু তার আগে বার্জার নবীন শিল্পী আর্ট কম্পিটিশনের পুরস্কার গ্রহণ করতে ঢাকায় আসতেই হয়েছিল ওই অক্টোবর মাসে। ঢাকায় পৌঁছানোর পর বুঝতে পারলাম, বার্জারের পুরস্কারের পাশাপাশি আরেকটি বড় পুরস্কার আমার জন্য রয়েছে; তা হলো, পরের দিন দুপুরে স্বামীবাগের স্বামীর বাড়িতে নেমন্তন্ন খাওয়ার বার্তা, শ্বশুর-শাশুড়ি, আমার একমাত্র ননদ রত্না, সেই সঙ্গে বাবার শিল্পী ছেলের প্রবল আগ্রহে আমার নেমন্তন্ন গ্রহণ উচিত কাজ বলে মনে হলো।
আমার মায়ের শত নিষেধ উপেক্ষা করতে হয়েছিল আমার শাশুড়ির একটি কথায় – এই বাড়িটি এখন তো তোমারও। তোমার আসল ঠিকানা। তুমি কোথায় থাকবে সে-বাড়িটি একবার দেখে যাবে না? এভাবে কজন শাশুড়ি বলতে পারেন, তা আমার জানা নেই। বাবা-মা দুজনেই আমাকে অনেক আপন করে নিয়েছিলেন। তাঁদের আশীর্বাদে আমার জীবন আজ পরিপূর্ণ। প্রথম দিনই বুঝতে পেরেছিলাম অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এবং চিন্তা-চেতনায় যথেষ্ট আধুনিক আমার শ্বশুরের পরিবারটি – এ ছিল আমার চিরকালের চাওয়া।
শ্বশুরালয়ে বউয়ের নিমন্ত্রণ – এ যে বিরল ঘটনা। যাওয়ার পথে টিকাটুলীর একটি মিষ্টির দোকান থেকে কয়েক বাক্স মিষ্টি নিয়ে প্রথম পা রাখলাম। ঢুকেই মনে হলো সবাই আমার অপেক্ষায়, বসার ঘরে খানিকটা সময় গল্পস্বল্প হলো। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, আর দেরি কেন? টেবিলে সাজানো হয়েছে সব পছন্দসই খাবার। আমার ঠিক মুখোমুখি বসেছেন বাবা। খাওয়া হচ্ছে, গল্পও চলছে। খাওয়া শেষে অভ্যাসবশত খালি প্লেটে খানিকটা পানি ঢেলে দিলাম আমার আম্মার শেখানো নিয়ম অনুযায়ী। বাবা তা খেয়াল করলেন। তখন বাবার লন্ডনে থাকার সময়ের একটি গল্প মনে পড়ে গেল এবং তা আমাকে বললেন – আমি মন দিয়ে শুনলাম। বুঝলাম অভ্যাসটি ভালো হিসেবে বিবেচিত হয়েছে বাবার কাছে। খাওয়া শেষে শুরু হলো মায়ের সঙ্গে বসে রত্নার ছানা থেকে মিষ্টি বানানোর গল্প। নিয়মিত মাকে মিষ্টি তৈরি করতে হতো – শুধু বাবারই জন্য। বাবা ভীষণ পছন্দ করতেন মিষ্টি জাতীয় খাদ্য।
খাবার শেষে বাবা আমাকে ডেকে নিলেন একটি ছোট্ট ঘরে। ছোট্ট পরিসরের ঘরটিতে সোফা পাতা আছে। আমাকে বসতে বললেন, আমি বসলাম। বাবা ভেতরে গেলেন। ভীষণ উৎফুল্ল মনে ফিরে এলেন হাতে ৪০-৪২টি কাজ নিয়ে, যা খুব যত্নসহকারে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখলেন এবং অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে একের পর এক কাজগুলো দেখালেন এবং লাইনের ব্যবহার সম্পর্কে বর্ণনা করলেন – অসাধারণ সব কাজ, যা বর্তমানে ‘ব্ল্যাক’ সিরিজের কাজ হিসেবে অত্যন্ত খ্যাত এবং সমাদৃত। তোমার কেমন লেগেছে মা? বাবা আমার মন্তব্য চাইলেন। এত বড়মাপের একজন শিল্পীর এত ভালো কাজের মন্তব্য করার ভাষা কী হবে তা ঠিক করা যে কোনো মানুষের জন্য কঠিন। কিন্তু সদালাপী এই মানুষটির স্নিগ্ধ হাসি এবং নমনীয় আচরণে আমি অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হলেও উত্তর দিয়েছিলাম সাবলীলভাবে, বলেছিলাম – অসাধারণ। সে-সময় আমি চারুকলা বিষয়ে অধ্যাপনা করছিলাম, অতএব এই শিল্পী পুত্রবধূর সঙ্গে ছবি বিষয়ে ভাববিনিময় খুবই সহজ হয়েছিল বাবার জন্যে। তেমনি অনেক বিষয় আলাপ-আলোচনায় অনেক সহজতর হয়েছিল আমার জন্য। মনে হতো, ধন্য আমার জীবন।
‘ব্ল্যাক’ সিরিজের কাজগুলো ড্রয়ারে তুলে রাখলেন। এরপর পাশের ঘরে রাখা একটি এচিং প্রেসের সামনে আমাকে দাঁড় করালেন। প্রথমে সেই প্রেসের ইতিহাস বর্ণনা করলেন, বললেন – এই দেশে এটিই প্রথম এচিং প্রেস যা কলকাতা থেকে আমি এনেছি। কলকাতার ভবানীপুরের বাড়ির স্টুডিওতে এই প্রেসে আমি কাজ করতাম। দেশভাগের সময় এক আত্মীয়ের বাড়িতে প্রেসটি জমা রেখে আমাকে পূর্ব বাংলায় চলে আসতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রেসটি বাংলাদেশে আনার সিদ্ধান্ত হলো এবং সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের পর কলকাতার সে-বাড়িটিতে বাবা যখন পা রাখলেন তখন শুনতে পেলেন, সেদিনই প্রেসটি সের দরে বিক্রির ব্যবস্থা প্রায় হয়ে গিয়েছে। সময়মতো পৌঁছানোতে রক্ষা পেল বাবার এচিং প্রেসটি। বাবা বললেন, এই প্রেসে আমি কাজ করেছি, খোকন কাজ করেছে, তোমাদের সন্তানও কাজ করবে। ট্র্যাডিশন ধরে রেখো মা। পরে প্রেসটির তাৎপর্য তুলে ধরে তা সংরক্ষণের জন্য শিল্পীপুত্র আহমেদ নাজিরকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন বাবা।
সংসার শুরুর দুমাসের মধ্যেই একদিন বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, তোমার ওপর আমার অনেক আস্থা। কথাটি আমার অন্তর ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমি বললাম, দোয়া করবেন। এভাবে বহুবার আমার মাথায় হাত রেখে বাবা আশীর্বাদ করেছেন, বহু উপদেশ এবং পরামর্শ দিয়েছেন। বাবা বলতেন, স্ট্রাগল করো, জীবনবোধ বাড়বে। আমি বাবার সঙ্গে একই মত পোষণ করতাম। বাবা বলতেন, মানুষ তিনভাবে শেখে – কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে শেখে আবার কেউ ভুল করে শেখে।
নিভৃতচারী এই মানুষটি যে মানসলোক, যে আদর্শে মহীয়ান হয়ে উঠেছিলেন সর্বস্তরের মানুষের কাছে, সেই আদর্শে আমি এবং আমরাও যেন উজ্জীবিত হতে পারি, মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে-প্রাণে সে-কামনা থাকলো।
আমি ফটোগ্রাফি করতে ভালোবাসতাম। ১৯৮১ সালে আমার আববার কেনা YESHICA ELECTRO 35 ক্যামেরায় তোলা হয়েছে আমার বড় ভাইবোনদের বিয়ের ছবি, আমাদের পারিবারিক ছবি – আমার স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরিজীবনের, এমনকি আমাদের বিয়ে, আমার শ্বশুরবাড়ির অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত, পরবর্তীকালে আমার দুই কন্যার জন্ম থেকে তাদের শিশুজীবন, বাবা স্টুডিওতে বসে ছবি অাঁকছেন, বাবার নিজ বাড়ি গ্যালারি চিত্রকের আঙিনায় অন্য শিল্পীদের সঙ্গে তোলা বহু স্থিরচিত্র ধারণ করেছি এই ক্যামেরাতেই। ছবি তোলার হাত আমার খুবই ভালো, কম্পোজিশন সেন্স বেশ ভালো – এই প্রশংসা বহু পেয়েছি। এভাবে প্রশংসা কুড়ালাম বাবার কাছ থেকেও। আমার ছবি তোলায় আশ্বস্ত হয়ে একদিন একটা ক্যামেরা বের করে বাবা বললেন, দেখো মা এটি জার্মানিতে তৈরি CONTAFLEX ক্যামেরা। পঞ্চাশের দশকে আমি বিলেতে যখন পড়তে যাই তখন ক্যামেরাটি কিনেছিলাম। সেই ক্যামেরায় তোলা বহু স্লাইড বাবা আমাকে দেখালেন। আফসোস করলেন, অনেক নষ্ট হয়ে গেছে বন্যায়। বাড়ির সামনে খুব সুন্দর ফুলের বাগান করেছিলাম, সেই ছবিগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। এরপর ক্যামেরাটির ব্যবহারের করণকৌশল সব আমাকে শিখিয়ে দিলেন। প্রশ্ন করলাম, এটি কি ভালো আছে? ছবি তোলা যাবে? বাবা বললেন, তুমি ব্যবহার করে দেখো। খোকনকে বলবে ফিল্ম এনে দিতে। আমি ফিল্ম লোড করে দেব। এই ক্যামেরায় এবার তুমি ছবি তুলবে। বহু সাহস সঞ্চয় করে প্রায় মাথায় তুলে রাখার মতোই অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সে-ক্যামেরায় ছবি তুলেছি। বাবা ও মায়ের ছবি, বাবার পেইন্টিংয়ের ছবি, পরিবারের ছবি, পরবর্তীকালে বাবার কোলে আমাদের বড় কন্যাসন্তান ফুলটুসি ও রত্নার ছেলে সাকিবের বেশকিছু ছবি তোলা হলো বাবার স্বামীবাগের বাড়ির আঙিনায়। ভীষণ কৌতূহল আমার ফলাফল কী দাঁড়ায়। প্রিন্ট দেখে প্রচলিত সেই কথাটির মতোই বলতে হয়েছিল, ‘Old is gold’। বাবার মতোই বাবার ক্যামেরাটিও।
১৫ নভেম্বর ২০০২ সাল, রমজান মাস, বাবার প্রথম নাতনি, আমাদের প্রথম সন্তানের প্রথম জন্মদিন। ইফতারের পর ঘরোয়া পরিবেশে পালিত হলো, সেই সঙ্গে অনেক ছবিও তোলা হলো। ভিডিও করাও বাদ যায়নি। বাবার সমস্ত স্মৃতি ধরে রাখবো, বাবার ওপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করবো – এরকম একটা স্বপ্ন থেকে আমি ২০০০ সালে চট্টগ্রাম বিপণি বিতান থেকে একটি ভিডিও ক্যামেরা কিনেছিলাম। গত ১২টি বছর ধরে বহু স্মৃতি ধারণ করা আছে সেই ক্যামেরায়। সেই রাতে বাবা আমাকে জানালেন, আগামীকাল সকালে ফুলটুসির প্রথম জন্মদিনে আশীর্বাদস্বরূপ একটি তুলি হাতে তুলে দেব। আমি চাই ফুলটুসি শিল্পী হবে। আমি আনন্দে আত্মহারা হলাম। ফুলটুসির আকিকার নাম হচ্ছে নাজিয়াহ্ আনিকা আহমেদ। আনিকা অর্থ সুন্দরী – নামটি দিয়েছিলেন বাবা। নাজিয়াহ্ অর্থ নিরাপদ – এটি দিয়েছিলাম আমি। আমাদের দুজনের দেওয়া এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে তৈরি হলো সুন্দর একটি নাম, যা সবাই পছন্দ করেছিল। আমাদের ছোট কন্যাসন্তানটির নাম নুসাইবা আনিকা আহমেদ। বাবা ওর হাতে তুলি তুলে না দিলেও দুই-আড়াই বছর আগে ওর অাঁকার হাত দেখে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ও তো শিল্পী হবে। আমি ওর নাম দিলাম শিল্পী। দোয়া চাই সবার কাছে – বাবার ইচ্ছেগুলো যেন পূরণ করতে পারি।
সম্ভবত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে এলো কোরবানির ঈদ। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি চট্টগ্রামে কবে যাচ্ছো মা? বললাম, ১৮ তারিখে, কেন বাবা? বাবা বললেন, আমার অনেক দিনের ইচ্ছে কয়েকজন কাছের মানুষকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে চাই। যদি সম্ভব হয় তোমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করে দিনক্ষণ ঠিক করে নাও। মায়ের সঙ্গে কথা হলো, দিনক্ষণ ঠিক হলো ১৭ তারিখ সন্ধ্যায়। কাকে কাকে বলতে চান বাবা? ইচ্ছে হয় অনেককে বলি এবং তাঁদের স্ত্রীসহ। কিন্তু বসতে তো দিতে পারবো না, জায়গা কোথায়? ঠিক হলো এবারে সংক্ষেপে, পরে বড় আয়োজন করা হবে। আগের দিন থেকে প্রস্ত্ততি শুরু হলো। আমার প্রধান সাহায্যকারী হিসেবে মায়ের ট্রেনিংপ্রাপ্ত বাড়ির পাকা রাঁধুনি নীহার রান্নাঘরের সমস্ত কাজে ভালোই ভূমিকা রাখলো। বাজার-সদাইয়ের ক্ষেত্রে নীহারের স্বামী সোলেমান মাকে সাহায্য করলো। রান্নার মূল দায়িত্ব মা আমাকে দিলেন, রত্নার ভাগ্যে বরাবরের মতো ঘর ও টেবিল সাজানোর ভার পড়লো। সন্ধ্যার পর এক এক করে সবাই এলেন, বসলেন এবং ক্রমশ এক জমজমাট গল্পের আসরে পরিণত হলো বসার ঘরের পরিবেশটি। সবার ঝুলি থেকে মজার মজার সব গল্প বেরিয়ে এলো। বেশ খানিকটা সময় গল্পের বিষয়বস্ত্ত ছিলেন বুলবন ওসমান স্যার এবং ফয়েজ চাচা (সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ)। আমি এ-সুযোগটি হাতছাড়া করিনি। সবই ধারণ করেছি ভিডিওতে। এই গল্পের আসরে শরিক হয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় কিবরিয়া স্যার, কাইয়ুম স্যার, রফিকুন নবী স্যার, আলভী স্যার, মাহমুদুল হক স্যার, আবুল হাসনাত, সুবীরদা, সেই সঙ্গে গ্যালারি চিত্রকের মুনির ভাই ও জহির।
খাবার পরিবেশনে জহির মুখ্য ভূমিকায় ছিল। আনন্দের আতিশয্যে সবাইকে বিদায় দিয়ে বারান্দায় উঠে এসে আমার মাথায় হাত রেখে প্রথমে আমাকে আশীর্বাদ দিলেন, তারপর বললেন, তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিলে মা। বুঝলাম বাবা ভালোই টেনশনে ছিলেন। আমাকে আশীর্বাদ করেও যেন বাবার মন ভরলো না, পরদিন সকালে আমাকে একটা ড্রইং উপহার দিলেন। একটা প্রতিকৃতি চিত্র, মনে হলো লালনের প্রতিকৃতি। স্বপ্নেও কি ভেবেছি? মনে হলো এ বাবার অনুপ্রেরণা, ভালো ফলের জন্য ভালো কর্মের প্রয়োজন। পরবর্তীকালে আশীর্বাদস্বরূপ আরো দু-একটি ছোট ড্রইং বাবা আমাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যে-ঘটনাটি আমার মনে প্রচন্ডভাবে রেখাপাত করেছিল, যে-ক্ষণটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত, সেটি ২০০৮ সালের ঘটনা, গত সাত-আট দশক ধরে ভারতবর্ষের এবং বাংলাদেশের চারুশিল্পের জগৎকে যে-মানুষটি তাঁর শিল্পসৃষ্টির মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন, শিল্পের সাধক এই শিল্পগুরু মানুষটি তাঁর সর্বশেষ ছবিটি রচনা করতে পেরেছিলেন ২০০৮ সালে। ছবির বিষয়বস্ত্ত ছিল ‘মোরগশূন্য খাঁচা’। সে-সময় টেলিভিশনের সংবাদে বাবা দেখতে পেলেন বার্ডস ফ্লুর কারণে সমস্ত জীবন্ত মোরগ মাটিচাপা দেওয়া হচ্ছে। শিল্পীহূদয়কে তা ভারাক্রান্ত করলো। সেই অনুভব থেকে বাবার মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হলো সেই আবেগতাড়িত মনে বাবা তাঁর জীবনের শেষ ছবিটি রচনা করলেন। বিস্ময়ে আমার মন বিচলিত হয়। শেষ ছবিটি বাবা আশীর্বাদস্বরূপ আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন ছবিটি বিক্রি করে টাকাটি আমার ব্যবসার কাজে লাগাতে। ছবিটি আমি মাথায় তুলে নিয়েছিলাম। বাবাকে বলেছিলাম, আপনার আশীর্বাদ আমি পেয়ে গেছি। আমার উন্নতি হবেই হবে। তবে আপনার দেওয়া এই ছবি আমি বিক্রি করতে পারবো না। আমার ঘরেও আমি সাজাবো না। ছবিটি দেশের ও পৃথিবীর মানুষের জন্য আমি আপনার ছেলের হাতে তুলে দিলাম। ভবিষ্যতে আপনার নামের চিত্রশালায় তা সংরক্ষিত হবে। তখনও বুঝিনি এ-ছবিটিই বাবার শেষ কাজ হবে। এরপর বাবা আর ছবি অাঁকেননি। শূন্য খাঁচার মধ্য দিয়ে বাবা কি আর ছবি অাঁকবেন না এমনই একটা শূন্যতার ইঙ্গিত রেখে গেছেন? এ-বিষয়টি আমি লেখক শোভন সোমকে বর্ণনা করেছিলাম যখন কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন্দ্রে বাবার তৃতীয় একক প্রদর্শনীতে বাবার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করতে কলকাতায় যাই। সে-সময় এ-বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে – বড়মাপের লেখক শোভন সোমের লেখায়। বাবার শেষ কাজটি বেঙ্গল শিল্পালয়, কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেন্টার এবং গত ৫ জুন ২০১২ সালে বেঙ্গল শিল্পালয়ে পুনরায় প্রদর্শিত হয়েছে।
২০০০ সালের ৩ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো আমার শাড়ির প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন আমার স্বামী শিল্পী আহমেদ নাজির। প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁরই বন্ধু ওয়াদুদ কাফিল ও বিউটির গুলশানে অবস্থিত মঞ্জু আর্ট গ্যালারিতে। তখন আমার বিয়ের বয়স মাত্র এক মাস। নববধূ কদিন বাদেই হয়ে উঠল কর্মিবধূ। প্রদর্শনী উপলক্ষে আরো কিছু নতুন কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। প্রায় রাতে রাতে বাবা ও মাকে ডেকে বসার ঘরে প্রদর্শন করতাম নতুন কাজ কী করেছি। সে-রকমই একটি রাতে বাবা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমাকে বললেন, তোমাকে আমি একটা কাজ দেখাব, তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি। এই বলে বাবা রুমে গেলেন, আবার ফিরে এলেন সত্তরের দশকে দিল্লি থেকে কেনা জয়পুরী প্রিন্টের চাদর নিয়ে। সে-চাদরের প্রিন্ট কোয়ালিটি নিয়ে কথা বললেন, বললেন চাদরটির ডাই সম্পর্কে। পরিশেষে চাদরটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই চাদরটি আমি তোমাকে দিলাম, তোমার ডিজাইনে সাহায্য করবে। গত ১৩ বছরে বাবা কখনো চাদরটির খোঁজ করেননি; কিন্তু বাবার মৃত্যুর এক মাস আগে বাবা আমার কাছে জানতে চাইলেন চাদরটি আমার কাছে আছে কিনা। বললাম, আমার আলমারিতে আছে, আপনার লাগবে বাবা? উত্তরে বাবা বললেন, ওটা তোমার, তুমি যত্ন করে তুলে রেখো। বাবা যে কোনো ভালো কাজকে অনেক বড় করে দেখতেন। তাই আমি ছবি অাঁকার জগতের মেয়ে হয়ে পোশাক ডিজাইন করছি, এতে বাবার বিরূপ মনোভাব কখনো দেখিনি, বরং অনেক বেশি মানসিক সহযোগিতা বা অনুপ্রেরণা দেওয়াই ছিল বাবার কাজ। অনুপ্রেরণা হিসেবে অনেক সময় অনেক কিছু বাবা আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, যত্ন করে তুলে রাখতে বলেছিলেন। আমার ইচ্ছে, সে-সবই বাবার সংগ্রহশালায় সংরক্ষণের জন্য দিয়ে দেব, যা বাবার স্মৃতি হিসেবে সাক্ষ্য বহন করবে যুগের পর যুগ, কালের পর কাল।
২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে পড়ে গিয়ে বাবা পা ভাঙলেন। অপারেশনের পর বাবা হাঁটার চেষ্টাই করলেন না। শুধু ভয় আর ভয়। আমি তখন ধানমন্ডিতে ভাড়া বাসায় থাকি। আমার দুই শিশুকন্যা নিয়ে তখন জীবনযুদ্ধে আমার ব্যস্ততার শেষ নেই। সে-সময় জানতে পেলাম বাবার শারীরিক অবস্থা মোটেও ভালো যাচ্ছে না, কখন কী হয় বলা যাচ্ছে না। শুনে প্রচন্ড বিচলিত হলাম। ঠিক সেই সময় আমেরিকা থেকে আমার বড় ভাই (ডা. রাশেদ নিজাম) আমাদের সবার খবর জানতে ফোন করেছিল। আমি বাবার বিষয়টি ভাইয়াকে অবহিত করি। জানতে চাইল, বাবার ফিজিওথেরাপি হয়েছে কিনা? আমি বললাম, মনে হয় হয়নি। তখন ভাইয়ার পরামর্শে এবং বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান মাহবুবুজ্জামান আমার মামাশ্বশুর, তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত হলো বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা করা হবে। বাবার সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ করলাম, অনেক সাহস দিয়ে বললাম, আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। আমার কথা আপনাকে শুনতে হবে। বাবা সেদিন লক্ষ্মী ছেলের মতোই সাড়া দিলেন। এর কয়েকদিন পর জীবনে প্রথম অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে স্বামীবাগ গেলাম এবং আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম। পরে মামা আমাকে জানালেন, দীর্ঘ সময় থেরাপি করতে হবে, ধানমন্ডিতে তোমার বাসায় সফিউদ্দীনকে নিয়ে এসো। মাথায় এলো, এই তো সুযোগ, এবারে বাবার ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে তুলতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান, সেখানে লিফটের সুবিধা পাওয়া যাবে। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর একদিন আমরা দুজন স্বামীবাগের বাড়ি গেলাম। বাবার পাশে বসে অনেক কথাবার্তা হলো। একপর্যায়ে আমি বাবাকে প্রশ্ন করলাম, আমি আপনার ধানমন্ডির ফ্ল্যাটটি সাজাতে চাই, আপনি কি আমাকে সে দায়িত্ব দেবেন? বাবা উচ্ছ্বসিত হয়ে অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করে বললেন, তুমি দেবে মা? বললাম, জ্বি বাবা। তাহলে বলুন বাড়ির পর্দা কেমন হবে? বললেন, দশজনের চেয়ে আলাদা। এত সুন্দর ও সাবলীল উত্তর দিয়েছিলেন বাবা তা আজও আমার মনে গেঁথে আছে। বাড়ি সাজানো হলো। ২০০৭ সালের ২২ জুন দুই নাতনির হাত ধরে ফিতা কেটে হুইল চেয়ারে বসে নতুন গৃহে প্রবেশ করলেন বাবা। গৃহের দেয়ালে দেয়ালে বাবার বেশ কিছু ছবি ঝোলানো হয়েছিল, যা একটি গ্যালারির রূপ পেয়েছিল। সমস্ত ছবি একসঙ্গে দেখতে পান না বলে আক্ষেপ ছিল বাবার মনে। গৃহে প্রবেশ করে ছবিগুলো দেখে বাবার চোখে পানি এসে গেল। ছেলের মাথায় হাত রেখে বাবা দোয়া করলেন। তারপর হুইল চেয়ারে ঘুরে ঘুরে সাজানো বাড়িটির সবটুকু দেখে নিজের শোয়ার ঘরে প্রবেশ করলেন। বাবাকে প্রশ্ন করলাম, সবকিছু আপনার পছন্দ হয়েছে? বাবা আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন, বললেন, তুমি যদি সাজিয়ে না দিতে, আমার কখনই এ-বাড়িতে ওঠা হতো না। পরের দিনই ছিল ২৩ জুন, বাবার জন্মদিন। ছড়িয়ে গিয়েছিল ধানমন্ডির বাড়িতে বাবার আগমনের খবরটি – সকাল থেকে এ-বাড়িতে বাবাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন সমাজের সবমহলের বিশিষ্টজনেরা।
মার্চ ২০০৯, কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেন্টারে বাবার তৃতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাকে, সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ আজিজুল হক, যিনি বাবার কর্মজীবনী লেখার জন্য বেঙ্গল শিল্পালয় থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং বেঙ্গল শিল্পালয়ের পরিচালক সুবীর চৌধুরী। আমার স্বামী শিল্পী আহমেদ নাজির শারীরিক অসুস্থতার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন প্রদর্শনী শেষে ছবি ফেরত আনতে যাবেন, তাই আমাদের সঙ্গে যাওয়া হলো না তাঁর। কলকাতায় পৌঁছে সে-রাতে আমরা গেলাম আর্ট গ্যালারি ‘আকার প্রকারে’। পরিচিত হলাম স্বনামধন্য লেখক নীহাররঞ্জন রায়ের ছেলে আরেক লেখক প্রণবরঞ্জন রায়ের সঙ্গে। যে-বিষয়গুলো মাথায় রেখে কলকাতায় রওনা হয়েছিলাম তার একটি হচ্ছে, ভবানীপুরে বাবার স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়ি দর্শন, যে-বাড়িতে বাবার জন্ম, যে-বাড়িতে তাঁর মা-বাবা আর একমাত্র বোনের সঙ্গে বাবা বেড়ে উঠেছিলেন। বাবার মুখে পূর্বসূরিদের বহু গল্প শুনেছি, অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত-বনেদী পরিবারের উত্তরসূরি ছিলেন বাবা, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সে-বাড়ির খোঁজ মিলবে কী করে? বাড়ির নম্বর বাবা ভুলে গিয়েছেন, শুধু আমাকে এইটুকুন বলেছিলেন, নন্দন রোড আর বেচু ডাক্তার লেন যেখানে মিশেছে, সেখানে প্রথম বাড়িটি আমাদের ছিল, সেই সময় সবই ছিল ইট-সুড়কির বাড়ি। বাড়ির বর্ণনা আরো আগেও বাবার মুখে শুনেছি, সেই সঙ্গে পারিবারিক মসজিদ এবং মসজিদের ভেতর বাবার দাদা-দাদি ও ফুপুর কবর বাঁধানো রয়েছে। এসব গল্প বাবার মুখে আগেই শুনেছি। যা-ই হোক, কলকাতাবাসী বড় লেখক প্রণবরঞ্জন রায় আমার ভীষণ উপকারে এলেন। তিনি তাঁর এক পরিচিত ব্যক্তি, যিনি নন্দন রোডে বাস করেন, তাঁকে ফোন করলেন এবং সেই ব্যক্তির নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদেরকে বেচু ডাক্তার লেনে যাওয়ার পথ বাতলে দেন। আর একটি বেলাও দেরি নয়। পরদিন সকালে নাস্তাশেষে আমরা তিনজনই রওনা হলাম। ঠিক ঠিক পৌঁছে গেলাম। একেবারেই দূরের রাস্তা নয়। অনেক নামিদামি লোকের বাড়ি সেখানটায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িও একই এলাকায় – এ-গল্প বাবাই একসময় করেছিলেন। স্বামীবাগের বাড়িতে তিরিশের দশকের শেষের দিকে অথবা চল্লিশের দশকের শুরুতে নির্মিত অনেক পুরনো একটা বাংলা ছবি দেখতে গিয়ে পাশের ঘর থেকে আমাকে ডেকে নিলেন বাবা, দেখো, এই যে লোকটি অভিনয় করছেন, তিনি আমাদের এলাকায় বাস করতেন। একবার একটা ছবিতে হাসির চরিত্রে অভিনয় করে ভীষণ বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল তাঁকে। ঘর থেকে বার হবার উপায় নেই, সবাই সিনেমার সংলাপগুলো বলে খেপাত, সেও রেগে যেত – এই বলে বাবা হাসলেন। ছোটবেলার স্মৃতি, সে-যে অন্যরকম মায়ার বাঁধন, সে-যে অন্তরের কত গহিনের বিষয় তা আমি বুঝেছিলাম তখন, যখন কলকাতা থেকে ফিরে স্টিল ক্যামেরা ও ভিডিও ক্যামেরাতে ধারণকৃত বাবার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো ছোটপর্দায় বাবাকে দেখাই। শুধু ভবানীপুরের বাড়ি নয়, সেই সাথে কলকাতা আর্ট কলেজ, যেখানে বাবার শিক্ষাজীবন ও শিক্ষকতা জীবনের শুরু, এমনকি যে লিথোপ্রেসে বাবা কাজ করেছিলেন এত বছর পর তারও অস্তিত্ব ধারণ করতে সমর্থ হয়েছিলাম আমার ক্যামেরায়। এসব দুর্লভ রেকর্ড ছাড়া বাবার ওপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি হবে কেমন করে! সব দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন বাবা, শাবাশ দিয়েছিলেন আমাকে। কষ্ট পেয়েছিলেন শুধু এই ভেবে, মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মেরামত করেছিলেন বাবা তাঁর বাবার বাড়িটি, যা আজ জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। খুব ছোটবেলায় বাবা যে তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন। সেদিন সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি এত বছর বাদেও বাবা ঘুরেফিরে সেই বাড়িটির দৈন্যদশার কথা বলেছেন এবং একটা বেদনা অনুভব করেছেন। বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ৬২ বছর আগে যে-বাড়িটি আপনাকে ছেড়ে আসতে হয়েছে, সে-বাড়িটির বয়স সেই সময় যদি চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর হয়, তাহলে বর্তমানে এর বয়স একশ’ বছরের ঊর্ধ্বে – এরকমটি হবে এটাই তো স্বাভাবিক। সান্ত্বনার কথা বললেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ফেলে আসা দিনের যে-স্মৃতি বাবার অন্তরের গহিনে ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছে, সেখানটায় পৌঁছানোর ক্ষমতা আমার নেই।
২৩ জুন ২০১১ সাল, বাবার ঊননববইতম জন্মদিন। এক মাস আগে বাবা আমাকে ডেকে বললেন, এবার জন্মদিনে কোনো আয়োজন করো না মা। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ঠিক আছে বাবা, বুঝতে পারলাম এবারের আয়োজন নীরবেই করতে হবে। কয়েক বছর আগে আমার কাছে একটি ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেছিলেন বাবা। মনে মনে ভাবলাম এবারে তা-ই হবে বাবার জন্য সেরা চমক। পরিপূর্ণভাবে আন্তরিক সহযোগিতা দিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের ও বেঙ্গল শিল্পালয়ের পরিচালক সুবীর চৌধুরী। বরাবরের মতো জন্মদিনের কেক কাটলেন বাবা, এর পরপরই গানের আসর। বাবার বিছানার সামনে হারমোনিয়াম, তবলা আর বাঁশিবাদক দেখে বাবা জানতে চাইলেন, গান হবে? ঠিক তখনই বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বললেন, এবারে ফরিদা পারভীন আপনাকে গান শোনাবেন। বাবা চমকে উঠলেন। বাবা আমাকে বললেন, তুমি মনে রেখেছো মা? ফরিদা আপা গুরুভক্ত মানুষ, লালনগীতির প্রকৃত সাধক, তিনি বাবাকে শ্রদ্ধা জানালেন। লালনের গানের হৃদয়স্পর্শী কথায় একদিকে বাবা মুগ্ধ-স্তম্ভিত; অন্যদিকে আবেগে আপ্লুত, অশ্রুসিক্ত শিল্পী ফরিদা পারভীন। এভাবে বাবার প্রায় জন্মদিনে গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন বহু গুণী শিল্পী। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইফ্ফাত আরা দেওয়ান, অদিতি মহসিন, শামা রহমান ও লুভা নাহিদ চৌধুরী।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত বাবার পঁচাত্তরতম জন্মদিন উদযাপন উৎসব বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম ছিল বলে এখনো শিল্পীমহলে উচ্চারিত হয়। আমার সৌভাগ্য যে সে-সময় শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত শিল্পী আমিনুল ইসলাম স্যারের ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের সুবাদে সেই জন্মদিনটির অসাধারণ আয়োজন উপভোগ করার সুযোগ হয়েছিল। তখনো জানা ছিল না আমাদের সকলের শ্রদ্ধার এই শিল্পী মানুষটি আমার ‘বাবা’ হবেন আর আমি তাঁর ‘মা’ হবো।
বাবা শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন হিসেবে জীবদ্দশাতেই সম্মানিত হয়েছেন বারবার। জাতীয় পর্যায়ের সব পদক গ্রহণেরও সুযোগ হয়েছিল বাবার। চল্লিশের দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত পাওয়া বহু পুরস্কার বাবার ঘরের কাচের আলমিরাতে থরে থরে সাজানো রয়েছে, যা বাবার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি হিসেবে প্রতিনিয়ত প্রতীয়মান। এগুলো আমাদের এই শিক্ষাই দেয়, শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেতে হলে শ্রেষ্ঠ মানুষদের আদর্শে নিজেকে চালিত করতে হয়। পরম করুণাময় আল্লাহতালার অসীম কৃপায় সবশেষে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারে পুরস্কৃত হলেন বাবা, যা ভেবে আমি বিস্মিত হই – বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে বাবার সমাহিত হওয়ার বিষয়টি। রাষ্ট্রপতির সম্মতি প্রদান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা যেন এ-কথাই প্রমাণ করে, চিরকালের এই শান্তিপূর্ণ শয়নকক্ষটি যেন বাবা শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের প্রাপ্য ছিল।
২০০৯ সালে কলকাতার ভবানীপুরে অবস্থিত বাবার পৈতৃক বাড়ি আবিষ্কার করে যখন দেশে ফিরে এলাম, তখন খুব মজা করে একটা বিষয় বাবাকে অবগত করলাম, বললাম – আপনার স্বামীবাগের বাড়িটি কর্নার প্লট এবং বাড়ির নাম্বার ৬১। ধানমন্ডির বাড়িটি কর্নার প্লট এবং বাড়ি নাম্বার ২১। এমনকি কলকাতার ফেলে আসা স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক বাড়িটিও কর্নার প্লট এবং বাড়ি নাম্বার ১। এ কীভাবে হলো বাবা, সবই কর্নার প্লট এবং ১-এর সংযোগ, এ যে আশ্চর্যজনক। বাবা আমার চোখে চোখ রেখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, বিষয়টি ভাবলেন এবং খুব সুন্দরভাবে হাসলেন আর বললেন, তাই তো। তারচেয়েও আশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটে গেল সেদিন যেদিন বাবা সমাহিত হলেন। মোনাজাতের পর সমাধি প্রাঙ্গণ ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে শুরু করল। কবরের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এ যেন সাজানো বাগান, মাটিযুক্ত ঘাসগুলো যখন স্থাপন করা হলো মনে হলো, এ যেন সৃজনশীলতায় পূর্ণ এক অন্যরকম শিল্পকর্ম। সবশেষে দুটি সাদা জবা সেই ঘাসের ওপর রেখে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাল দুই ছাত্রছাত্রী জাহিদ ও উর্মি। তৎক্ষণাৎ আমি যেন শিউরে উঠলাম এই ভেবে, বাবার চিরকালের জন্য যে প্লটটি বরাদ্দ হলো এও যে কর্নার প্লট!
দুঃখ বা কষ্ট একটাই। খুব আশা করেছিলাম বাবা শতায়ু হবেন। তা হলো না। কর্মই যাঁর ধর্ম, বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনে যাঁর ভূমিকা অপরিসীম, ছাপচিত্রের জনক যিনি, শিল্পের সাধক, সেই মানুষটির মধ্যে যে শিল্পীসত্তা তাঁর সঙ্গে একটা নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল আমার শিল্পীসত্তার। আমি তা অনুভব করেছি ৩০ জুলাই ১৯৯৯ সালে, যেদিন আমার আকদ্ হয়েছিল সেদিন থেকে বাবার ইহলোক ছেড়ে যাবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত। এ বিশ্বাস বর্তমানে গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে, তা-ই আমাকে নীরবে কাঁদায় বাবার সমস্ত স্মৃতিকথা, বাবার চলে যাওয়া, যাওয়ার সময় শেষ কথা – ‘আমি মরে যাচ্ছি’।
১৫ মে সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় অ্যাম্বুলেন্সযোগে বাবাকে নিয়ে স্কয়ার হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে পৌঁছে যাই। সেখান থেকে বাবাকে ১৪ তলায় ১৪০৬ নম্বর কেবিনে নেওয়া এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়। স্যালাইন এবং অক্সিজেন দেওয়ায় বাবা গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হলেন। এর আগে ডাক্তারের সালামের উত্তরে খানিকটা কষ্ট করেই বলেছিলেন – ‘ও… য়া… লাইকুম।’ এরপর ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, আপনি কি সফিউদ্দীন সাহেব? বাবা শুধু সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন। বাবার ঘুম ভাঙলো পরদিন ১৬ মে (২০১২) দুপুর ৩টায়। সামনে দাঁড়াতেই বাবা বললেন, আমাকে পানি দাও। আমি পানি খাবো। ছোট্ট শিশুর মতো একই কথার পুনরাবৃত্তি করছিলেন তিন-চার সেকেন্ড পরপর। তাতে ছন্দের মতো কথাগুলো শোনাচ্ছিল। দুপুর ৩টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত জীবনের শেষ যে কটি কথা বাবা বলেছেন, সবই একই রকম গতিতে, ধীরে ছন্দে। যা তিনি ভেতরে অনুভব করছেন তা-ই তিনি নির্লিপ্তভাবে বলছিলেন। বলার মধ্যে অস্থিরতা ছিল না, মুখমন্ডলে কষ্ট বা যন্ত্রণার ছাপ ছিল না। প্রথমে বাবা পানি চাইলেন। আমার হাতেই শেষ পানিটুকু খেলেন অত্যন্ত তৃপ্তিসহকারে। তারপর বলতে শুরু করলেন, আমাকে তোলো। বেডের রিমোটের সাহায্যে বাবাকে সোজা করে বসিয়ে দিলাম। তারপরেও বাবা একইভাবে বলতে লাগলেন, আমাকে তোলো। প্রশ্ন করলাম, আপনার কি দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে, হাঁটতে ইচ্ছে করছে? বাবা মুখ নেড়ে সম্মতি জানালেন। এ তো সম্ভব নয়। তাই আমি বুদ্ধি করে বাবাকে বললাম, আমি তো একা আপনাকে দাঁড় করাতে পারবো না। বরঞ্চ আপনাকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিই। এই কথা বলতেই একইভাবে বাবা বলতে লাগলেন, আমাকে পাশ ফিরিয়ে দাও… আমাকে পাশ ফিরিয়ে দাও…। সিস্টারদের কাউকে না পেয়ে একা একাই বাবাকে পাশ ফিরিয়ে দিলাম। তারপর বললাম, আপনি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আমার এ-কথার পর বাবা ‘আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও’ এ-বাক্যটি পুরোপুরি বলতে পারছিলেন না। বাবা বলছিলেন, আমাকে ঘুমিয়ে দাও… আমাকে ঘুমিয়ে দাও…। কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে হঠাৎ বললেন, মা, আমি মরে যাচ্ছি। আমাকে জড়িয়ে ধরো। এ-কথা শুনে আমি প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলাম। বাবার ছেলেকে ফোন করে দ্রুত হাসপাতালে আসতে বললাম। বাবার বড় ছেলেকেও খবর দিতে বললাম। এরপর বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবার কপালে আমার গালখানা রেখে বাবাকে বললাম, কোনো ভয় নেই, আমি আছি আপনার কাছে। এরপর আমি অনুভব করলাম বাবার শরীরের গরম ভাবটা কমতে শুরু করেছে। দ্রুত যন্ত্রের মাধ্যমে সিস্টারকে কল দিলাম। সিস্টার আসামাত্র কর্তব্যরত ডাক্তারকে ডাকতে পাঠালাম। সে-সময় আমি চাদর, কম্বল, তোয়ালে সবকিছু দিয়ে বাবাকে মুড়ে দিলাম এবং বাবার ঠান্ডা হাতকে গরম করার প্রাণান্ত চেষ্টা করতে থাকলাম। এরই মধ্যে কর্তব্যরত চিকিৎসক বাবার অবস্থা বুঝে অক্সিজেন ও স্যালাইনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন। বাবা যেন স্বস্তি ফিরে পেলেন স্বল্প সময়ের মধ্যে। ঠিক সে-সময় আমার স্বামী শিল্পী আহমেদ নাজির কেবিনে প্রবেশ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী অবস্থা? ছেলের কণ্ঠস্বর শুনতেই হকচকিয়ে উঠে বাবা ডাকলেন, খোকন! জ্বি বাবা বলতেই বাবা ছেলেকে বললেন, আমি মরে যাচ্ছি…। উত্তরে ছেলে বললেন, না বাবা, তুমি ভালো হয়ে যাবে। তোমার চিকিৎসা চলছে। দুএক মিনিট বাদেই আবার ছেলেকে বললেন, ছোট আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এরই মধ্যে আমার বড় মামাশ্বশুরের ছেলে ইকবাল ভাই ও ভাবি এলেন বাবাকে দেখতে, তারাও শুনলেন একই কথার পুনরাবৃত্তি – আমি মরে যাচ্ছি…, আমি মরে যাচ্ছি…। ওয়ার্ডবয় ও সিস্টার আল্ট্রাসনোগ্রামের জন্য বাবাকে নিচে নেওয়ার প্রস্ত্ততি শেষ করে রওনা হলো, সঙ্গে নাজির আর আমি গেলাম। ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে ছেলেকে দেখে বাবা আবারও বললেন, খোকন… আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ছেলে প্রশ্ন করল, কোথায়? বাবা প্রথমে বললেন বুকে, এরপর বললেন সমস্ত শরীরে। আমরা ফিরে এলাম কেবিনে, তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। ইকবাল ভাই-ভাবি কিছুটা সময় থেকে বিদায় নিলেন। এলেন সৈয়দ আজিজুল হক স্যার (যিনি দীর্ঘ আড়াই বছর বাবার কাছে নিয়মিত আসতেন এবং বাবার শিল্পকর্মের ওপর আলাপ-আলোচনা করতেন, তা লিপিবদ্ধ করতেন। বেঙ্গল শিল্পালয় থেকে তিনি দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন বাবার ওপর বই লেখার বিষয়ে)। সে-সময় বাবা বলতে শুরু করলেন – আমাকে খেতে দাও… আমাকে খেতে দাও… । কিছুক্ষণের মধ্যে বাবার প্রধান চিকিৎসক এলেন। ডাক্তারের উপস্থিতি জানতে পেরে বাবা বললেন, আমাকে খেতে দিন… আমাকে খেতে দিন…। ডাক্তার আশ্বাস দিলেন, আপনাকে খেতে দেওয়া হবে।
৮টা ১০ মিনিটে রাইস টিউবের মাধ্যমে খাবার দেওয়া হলো। কিছুটা সময় বাবা নীরব থাকলেন বা ঘুমিয়ে থাকলেন। এরই মধ্যে মা এলেন সঙ্গে আমার ভাসুর আর সোলেমান (বাবার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল)। আরো কিছুক্ষণ পর এলেন আমার ৯৪ বছর বয়স্ক মেঝ মামাশ্বশুর। তাঁর ছেলের বউ সনিয়া ভাবি। আমাদের কথোপকথনের সময় দেখলাম বাবা কিছুটা সজাগ হয়েছেন। সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, বললেন, মা আমাকে খেতে দাও। বললাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাকে খেতে দেওয়া হবে, সিস্টার রেডি করছে। বাবা বুঝতে পেরে নীরব থাকলেন। বাবা যেন অপেক্ষায় থাকলেন। খানিকক্ষণ পরে আমি বাবার সামনে দাঁড়াতেই আমাকে আবার বললেন, মা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করেন। আমি মাথার এপাশ থেকে ওপাশ আবার ওপাশ থেকে এপাশ এমনভাবে কিছুটা হালকা চাপ দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল বাবার বেশ আরামই লাগছে। বাবার তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ দুটো বন্ধ। মিনিট সাতেক পরে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আবার ডাকলেন – মা।
জ্বি বাবা।
আমার নাকের মধ্যে একটা ওষুধ, বার করে দাও। কথাটির পুনরাবৃত্তি করলেন তিন থেকে চারবার। বুঝতে পারলাম নাকের মধ্যের রাইস টিউবটি বাবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। একটা অস্বস্তিভাব। এরই মধ্যে নতুন এক সিস্টারের আগমন ঘটল। চালচলনে পান্ডিত্যের ভাব; প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে না। সে-সময় বাবার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো বাবার জীবনের শেষ তিনটি শব্দ – আমি… মরে… যাচ্ছি। এর পরপরই আমরা সবাই দেখতে পেলাম অক্সিজেন ক্রমশ নিচের দিকে নামছে, বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল, গলায় ঘড়ঘড় শব্দ। চিৎকার-চেঁচামেচিতে কর্তব্যরত ডাক্তার দৌড়ে এসে চেষ্টা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে তাঁর মনে হলো, এ চেষ্টায় ব্যর্থতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ বাবার দুই ছেলে এবং বাবার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সে-সময় আমার দুটি হাত দিয়ে বাবার হাত ধরে আছি। মুহূর্তের মধ্যে আমি অনুভব করলাম বাবার শরীর থেকে ঠান্ডা ঘাম বেরিয়ে ঘামটি শরীরের সঙ্গেই আবার আঠার মতো আটকে গেল। এরপর বাবার হাতের তালু চেপে ধরেই থাকলাম, হাতের তালু যেন বরফ হয়ে গেল। মন বলল, এই হাত তো আর গরম হবার নয়…।
চিৎকার করতে থাকলাম, বাবার প্রেশার তো ফল করছে। কিছু করার নেই বুঝতে পেরে দ্রুত বাবার পা ধরে তিনবার সালাম করলাম। দু’পা সাড়া দিলো। আমি বুঝতে পারলাম বাবা আমার সালাম গ্রহণ করেছেন। বরাবরের মতো মাথায় হাত রেখে হয়তো আশীর্বাদ করতে পারেননি; কিন্তু আমি অনুভব করতে পেরেছি যা আশীর্বাদ দেওয়ার বাবা অন্তর থেকে দিয়ে গেছেন – এ আমার গভীর বিশ্বাস। 