নির্জন দ্বীপের দিগন্তে আগুনপাহাড়

নিকারাগুয়ায় বেড়াতে এসে আমি সপ্তাহতিনেক হলো লেওন শহরের একটি গেস্ট হাউসে থিতু হয়েছি। ওখানে আমার সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে উঠেছে সিনিওর ডিগমারের। ডিগমার নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে নিকারাগুয়েনসে, তবে অভিবাসী হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। ফি-বছর গ্রীষ্মকালে তিনি ফিরে আসেন তাঁর শৈশবের পিতৃভূমি­ -­ লেওন শহরে। আমার মতো সিনিয়র ডিগমারও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসেন,  বনানী নিবিড় পাহাড়ে হাইকিং করা তাঁর হবিবিশেষ। সুতরাং, আমাদের মাঝে জানপহচান বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে দেরি হয় না। সপ্তাহখানেক ধরে আমরা পরিকল্পনা করছি, লেওন শহরের কাছাকাছি মমোতোমবো বলে একটি আগ্নেয়গিরিতে হাইকিং করতে যাওয়ার। আমরা সারাদিন হাইক করে আগুনপাহাড়টির চূড়ার নিচে তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং করতে চাই। কিন্তু নানা কারণে মমোতোমবোতে যাওয়ার হরেকরকমের লজিস্টিক্স ঠিক গুছিয়ে আনতে পারছি না।

আমাদের যাত্রারম্ভের ডেট কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছে। এতে আমি অধৈর্য হলে, সিনিওর ডিগমার কাছাকাছি একটি দ্বীপ ইসলা ডে হুয়ান ভেনাডোতে যাওয়ার বিকল্প প্রস্তাব করেন। কথা হয় যে, আমরা হুয়ান ভেনাডোতে যাব কায়াক-জাতীয় নৌকা ভাড়া করে। দ্বীপটি সবুজ রঙের সামুদ্রিক কচ্ছপের ব্রিডিং গ্রাউন্ড হিসেবে সংরক্ষেত হচ্ছে। ওখানে সিস্নপিংব্যাগ ব্যবহার করে এক রাত্রি কাটিয়ে ফিরে আসব লেওনে। তারপর জোরেশোরে লেগে যাব মমোতোমবোতে যাওয়ার জোগাড়যন্ত্রে।

ইসলা হুয়ান ডে ভেনাডোতে যাওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে আমরা আজ লেওন থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে পস্নায়া লাস পেনিটাসে এসেছি দুপুরবেলা। ওখানে পরিচয় হয় বিয়াংকা ও ক্রিসটেলার সঙ্গে। এ মেয়ে দুটিও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে নিকারাগুয়েনসে, তবে অভিবাসীর সন্তান হিসেবে বাস করে ফ্লোরিডায়। এরা পেশায় মেরিন গাইড। গ্রীষ্মকাল কাটাতে এসেছে তাদের মা-বাবার শৈশবের শহর লেওনে। সিনিয়র ডিগমার সৈকতের একটি রেস্তোরাঁয় এদের লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করেন। মেরিন গাইড হিসেবে জলতলে প্রবালের বাগিচা ও দ্বীপের ইকোসিস্টেম সম্পর্কে এরা পর্যটকদের পেশাদারি সার্ভিস প্রদান করে থাকে। খাবার টেবিলে কথাবার্তায় তাদের সঙ্গে আমাদের সামান্য অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। এদের মাঝে বিয়াংকা শে^তকায়া, সামাজিকতায় সে উচ্ছল, হাসলে তার গালে টোল পড়ে ও তাকে কেমন যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন দেখায়। ক্রিসটেলা একটু চুপচাপ প্রকৃতির। তার গায়ের রং শ্যামলা। মনে হয়, মেয়েটি ক্রনিক বিষণ্ণতায় ভুগছে। তার চোখ-মুখের শার্প ডৌলের সঙ্গে শরীরের সামঞ্জস্যপূর্ণ ফিগার আকর্ষণ ছড়ায়। কথাবার্তায় মেয়েটির মুখিয়ে ওঠার ধাত আছে।

বিয়াংকা ও ক্রিসটেলা আমাদের সঙ্গে মেরিন গাইড হিসেবে ইসলা হুয়ান ডে ভেনাডোতে যেতে রাজি হলে আমি উৎসাহের সঙ্গে দ্বীপে রাত কাটানোর জন্য সিস্নপিংব্যাগ ও জলতলে প্রবালের বাগিচা পর্যবেক্ষণের জন্য স্নরক্যালের হেলমেট ইত্যাদি ভাড়া করি। সিনিওর ডিগমার খরিদ করেন খাবার-দাবার ও কুলার ভর্তি পানীয়। পিকআপ ট্রাকে সামানাদি তোলার পর বিয়াংকা ও ক্রিসটেলাকে নিয়ে আমরা রওনা হই।

পস্নায়া লাস পেনিটাস থেকে সামান্য দূরে পনেলোয়া ফিশিং ভিলেজ। পিকআপ ট্রাকে চড়ে আমরা জেলেপলিস্ন অতিক্রম করে চলে আসি বারকা ডে অরো নামে আরেকটি সৈকতে। জায়গাটিতে সমুদ্র শান্ত হয়ে ঢুকে পড়েছে বেশ খানিকটা ইনল্যান্ডে। এবড়োখেবড়ো পাথর ছড়ানো বালুচরে পড়ে আছে কয়েকখানা কায়াক-জাতীয় নৌকা। সিনিওর ডিগমার সাবধানে গাছের তলায় পিকআপ পার্ক করেন। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ে দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো বঙ্কিম হয়ে বেলাভূমি চলে গেছে দূর-দূরান্তে। বেশ খানিকটা দূরে, সমুদ্রজলের কিনারে দাঁড়িয়ে শাবকসহ দুটি অশ^। বালুকাবেলার সুনসান নীরবতা ও পারে আছড়েপড়া নোনাজলের মৃদু ছলাৎ ছালাৎ আওয়াজ মনে হয় ঘোড়া তিনটিকেও আবিষ্ট করে রেখেছে।

অতঃপর ডিগমারের তাড়ায় আমরা হেঁটে চলে আসি একটি গ্রিন হাউসে। তার আঙিনায় ঝুরিওয়ালা অচেনা একটি বৃক্ষ শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে ছড়াচ্ছে তরুবর-শোভন প্রাজ্ঞতা। আমরা গ্রিন হাউসে ঢুকি, ওখান থেকে পারমিশনের টিকিট কিনি জনহীন দ্বীপ ইসলা হুয়ান ডে ভেনাডোতে যাওয়ার জন্য। কাচের ঘরটিতে প্রচুর তরুলতা। এখানে ভেষজ গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে প্রস্ফুটিত পুষ্পের মন ফুরফুরে করে তোলা সৌরভ। চিত্রিত নকশা হয়ে উড়ছে সবুজের কৃত্রিম কারাগারে বন্দি কিছু প্রজাপতি।

টবে সারজলে বেড়ে ওঠা অনেক তরুর আবডালে আমরা সিনিওর হোসে করডোবার সাক্ষাৎ পাই। রুপালি চুল ও ঝোলা গোঁফে বৃদ্ধকে যুদ্ধফেরত অবসরপ্রাপ্ত কর্নেলের মতো দেখায়। একটি রকিংচেয়ারে বসে আনমনে দোল খেতে খেতে সিনিওর করডোবা এসপানিওল অনুবাদে হ্যারি পটারের চিত্রিত বইটি পড়ছেন। ইসলা হুয়ান ডে ভেনাডোর পারমিশনের রসিদ-জাতীয় টিকিট বিক্রির দায়িত্বে আছেন তিনি। মেরিন গাইড হিসেবে বিয়াংকা ও ক্রিসটেলার সঙ্গে তাঁর চেনাজানা আছে। এরা টিকিটের কথা বললে সিনিওর হাইপাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে তাদের সঙ্গে খুনসুটি করে কিছু বলেন। এতে অত্যন্ত আহ্লাদী ভঙ্গিতে মেয়েদুটি তাঁর দিকে গ-দেশ বাড়িয়ে দেয়। সিনিওর ফোকলা মুখে হেসে মেয়েদের দরাজভাবে চুমু খান। এতে অধৈর্য হয়ে সিনিওর ডিগমার আমাকে ‘এসক্রিতর বা রাইটার’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সিনিওর করডোবা উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে ‘বিয়েনবেনিডো মি এরমানো, বা ওয়েলকাম হে আমার ভ্রাতা’, বলে বসার জন্য টুল দেখিয়ে দেন। আমার আন্দাজ হানড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট। বছর বারো আগে সিনিওর করডোবা নিকারাগুয়ার সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। বর্তমানে তিনি পরিবেশ উন্নয়নের উদ্যোক্তা হয়ে ইসলা হুয়ান ডে ভেনাডো দ্বীপকে কচ্ছপের ব্রিডিং গ্রাউন্ড হিসেবে সংরক্ষণের কাজে হাত লাগিয়েছেন। তিনি ঝোলা গোঁফে তা দিয়ে জানতে চান, ‘এসক্রিত লিব্রজ পারা নিনিওস, বা বাচ্চাদের জন্য তুমি বই লিখেছো কি?’ আমি নেতিবাচকভাবে মাথা দুলিয়ে বলি, ‘এখনো লিখে উঠতে পারিনি সিনিওর।’ তিনি একটু হতাশ হয়ে বলেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মের বাচ্চারাই তো আমাদের ভবিষ্যৎ, তা তুমি শিশুদের জন্য লিখতে শুরু করে দাও।’ কথা বলতে বলতে পাশের টেবিল থেকে তুলে আমাকে তাঁর লেখা তিনটি শিশুতোষ বই দেখান।

টেবিলটিতে অযত্নে পড়ে আছে একটি জংধরা টাইপরাইটার, তার পাশে ছোট ছোট টবে রাখা হরেক কিসিমের চিত্রিত পাতার মিনিয়েচার গাছগাছালি। আন্দাজ করি, সিনিওর টিকিট বিক্রির ফাঁকে টেবিলটি ব্যবহার করেন শিশুদের জন্য বই লেখার কাজে। ‘মেসা ডে এসক্রিতর সিমপ্রে মে ইনতেরেসান মুচো, বা একজন লেখকের লেখাজোখার টেবিল আমাকে হামেশা আকর্ষণ করে সিনিওর’, বলে আমি টেবিলটি খুঁটিয়ে দেখতে গেলে, তিনি তাঁর ড্রয়ার টেনে ওখান থেকে বের করেন লণ্ঠনের চিমনির মতো দেখতে একটি বয়াম। তখনই অবাক হয়ে দেখি, গ্রিন হাউসের কোনায় সিমেন্টের দেয়ালের কাছে ফুলের টব রাখার লোহার র‌্যাকে বসে একটি টিয়াপাখি। তার ঠিক তলায় বসে একটি বিড়াল মৃদুস্বরে মিয়াও আওয়াজ দিয়ে পাখিটির দিকে পা তুলে যেন কিছু প্রার্থনা করছে। একপর্যায়ে টিয়াটি সামান্য উড়ে তার দাঁড়ে গিয়ে খাবারের বাটি থেকে টুপ করে নিচে ফেলে দেয় বিড়ালের জন্য দুটি দানা।

সিনিওর করডোবা বয়াম থেকে কফির কাপে ঢেলে আমাকে পরিবেশন করেন এক পাত্র রাম। আমি টিয়া ও বিড়ালের প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন করলে সিনিওর ‘সালুদ বা চিয়ার্স’ বলে সামান্য একটু রাম পান করে বলেন, ‘এদের আমি প্রশিক্ষণ দিচ্ছি পরস্পরের বন্ধু হওয়ার। বাচ্চাদের জন্য আমি যে বই লিখতে যাচ্ছি তার নাম হবে, আমিসটাড ডে উন গাতো ই উন লরো, বা ফ্রেন্ডশিপ অব আ ক্যাট অ্যান্ড আ প্যারোট।’ আমি তাঁর পরবর্তী বইটির শিরোনামের তারিফ করি। তিনি ফোকলা দাঁতে হেসে একটি ক্যাশবাক্স থেকে বের করে আমাদের হুয়ান ডে ভেনাডো দ্বীপের টিকিট দেন। রাইটার হিসেবে আমি পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়ে একটি টিকিট পাই। তিনি টিকিটটি আমার হাতে দিতে দিতে অনুরোধ করেন, সি টার্টোল বা সমুদ্র-কচ্ছপদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি যেন কিছু লিখি।

আমাদের আলাপচারিতাকে ইন্টারাপ্ট করে মেরিন গাইড মেয়েদুটি কলকলিয়ে কলোকোয়েল এসপানিওলে তাঁকে কিছু বলে। সিনিওর করডোবা মজাক করে তাদের ‘স্কিনি ডিপ’ বা দ্বীপের সৈকতে নগ্নস্নান না করার পরামর্শ দেন। ক্রিসটেলা, ‘পরকে নো, বা হোয়াই নট?’ বলে মুখ ঝামটা দিলে সিনিওর কাঁচমাচু হওয়ার কৃত্রিম ভঙ্গি করে মন্তব্য করেন, ‘মেয়েরা শোনো, তোমরা নগ্নস্নানে মাতলে পর্যটকদের খামোকা হৃদয় ভাঙবে, সিম্পোলমেন্টে রমপেরা সুস কোরাজনেস, বা ইট উইল সিম্পলি ব্রেক দেয়ার হার্টস্, এতে কচ্ছপদেরও কোনো উপকার হবে না।’ আমরা দ্বীপে নামার টিকিট হাতে নিয়ে তাঁর আরো কিছু অযাচিত উপদেশ শিরোধার্য করার ভান করে বিদায় নিই।

বিয়াংকা ও ক্রিসটেলা প্রায়ই পর্যটকদের সঙ্গী হয়ে ওই দ্বীপে যায়। পথঘাট তাদের ভালো করে চেনা। বারকা ডে আরোর ঘাটে মানুষজন তেমন নেই। কেবল ঘোড়ায় চড়ে এক পর্যটক মহিলাকে আমরা দুলকিচালে সৈকতের বালুকা ছিতরিয়ে ছুটতে দেখি। আমাদের দিকে চোখ পড়তেই – মহিলা কেন জানি ঝুঁকে মাথা নিচু করে দু-হাতে জড়িয়ে ধরেন অশ্বটির কেশর।  বিয়াংকা ও ক্রিসটেলা তাদের চেনা বোটম্যানের তালাশ করে। আমরা দূরে নোঙর করা কয়েকটি নৌকার দিকে রওনা হই। পানিভর্তি একটি নৌকার খোল থেকে বিচিত্র একটি মাছ দু-হাতে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় কিশোর বয়সী এক মাঝি।  আমরা অবাক হয়ে আশ্চর্য মাছটির শিরদাঁড়ায় লাগানো সুদীর্ঘ ফিন দেখি।

বেশ খুঁজে পেতে বিয়াংকা ও ক্রিসটেলা তাদের চেনা বোটম্যানের নাগাল পায়। ইঞ্জিন লাগানো কায়াক নৌকাটি আমরা ভাড়া করি। মাঝি পিকআপ থেকে রসদপত্র, সিস্নপিংব্যাগ, স্নরক্যাল ইত্যাদি ক্যারি করে নৌকায় তোলেন। ফোমের কুশন পেতে আমি বিয়াংকার সঙ্গে বসি। সামনে আমাদের দিকে পেছন ফিরে ক্রিসটেলার সঙ্গে বসেছেন সিনিওর ডিগমার। তিনি সিগারে আগুন দিতেই ফটফটানো আওয়াজে চালু হয় বোটের রিকেটি ইঞ্জিন। আমাদের নৌকার ওপর জলে ডানার ছায়া ফেলে ওড়ে কয়েকটি সিন্ধুসারস। সমুদ্রের খাড়িটি হ্রদের মতো নিস্তরঙ্গ ও সুনসান। আমরা এদিকে নৌচলাচলের তেমন কোনো আলামত দেখি না। তবে থির জলে নোঙর ফেলে ভাসছে ছোট্ট একটি নৌকা। তাতে বসে গুলতানিতে মেতে আছেন স্থানীয় পাঁচ নিকারাগুয়েনসে পুরুষ। এঁরা বড়শি বাইতে বাইতে অলস চোখে আমাদের দিকে তাকান। আমরা হাত নাড়লে এরা ‘তেঙ্গাস উন বুয়েন ভিয়াখে, বা হ্যাভ আ নাইস ট্রিপ’ বলে আমাদের সম্ভাষণ জানান।

শান্ত জলের লেগুনের মতো পরিসর ছাড়িয়ে বারদরিয়ায় পড়তেই বিয়াংকা গ্রীবা বাঁকিয়ে জানতে চায়, ‘আর ইউ থিংকিং অ্যাবাউট ইয়োর রাইটিং সিনিওর?’ জবাবে আমি বলি, ‘ভ্রমণ-লেখক হিসেবে সবসময় লেখার উপকরণ, নানা কিসিমের ডিটেলস ইত্যাদি স্মৃতিতে ধরে রাখার চেষ্টা করতে হয়। সো, টু অ্যানসার ইয়োর কোয়েশ্চন বিয়াংকা, ইয়েস, আমি আজকে সমুদ্রযাত্রা নিয়ে কীভাবে একটি লেখা গোছাব, কার কথা লিখব, এসব নিয়ে ভাবছি।’ লাজুকভাবে শরীর আমার দিকে আরেকটু ঝুঁকিয়ে এবার বিয়াংকা বলে, ‘আমার কথা লিখবে কি? জাস্ট টেল মি ট্রুথফুলি।’ আমি জবাব  দিই, ‘তোমার কথা আমি লেখাতে আনতে চাই, কিন্তু তোমাকে শোভনভাবে উপস্থাপন করতে হলে তোমার বিষয়ে আমার আরো বিশদভাবে জানা দরকার।’ বিয়াংকা কী যেন ভেবে বলে, ‘আমার বিষয়ে বিস্তারিতভাবে না জেনে তুমি লিখতে পারবে না?’ আমি জবাব দিই, ‘সামান্য একটু, আমি যা এ-মুহূর্তে অনুভব করছি, তা হয়তো লেখা যায়, কিন্তু বর্ণনায় জোরালো মাত্রা যোগ করতে চাইলে তোমার জীবনের কিছু ঘটনা জানতে পারাটা জরুরি।’ বিয়াংকা একটু অন্যমনস্ক হয়ে নায়ে ভেঙে পড়া ঢেউয়ের চারদিকে বিস্ফোরিত হয়ে ছিতরানো দেখতে দেখতে বলে, ‘তোমার এ-মুহূর্তের অনুভব আমাকে বলা যায় একটু।’ আমি জবাব দিই, ‘এখনই বলতে চাচ্ছি না, তবে একটি এজামশন বা অনুমান শেয়ার করতে চাই, আমার আন্দাজ ভুলও হতে পারে।’ বিয়াংকা অধৈর্য হয়ে বলে, ‘জাস্ট টেল মি, হোয়াট ইজ ইট, তোমার অনুমানটা কী?’

আমি তার দিকে তাকিয়ে তীব্র কনসেনট্রেশনে মনোসংযোগ করে বলি, ‘তোমার মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হওয়ার একটা ব্যাপার আছে। টেম্পার টেনট্রম হলে তুমি সিরামিকের ডিশ, কাচের গস্নাস প্রভৃতি ভাংচুর করে রাগ প্রশমিত করো।’ ফিক করে হেসে সে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, ‘ইউ আর নট হানড্রেড পার্সেন্ট রাইট। যখন ছোট ছিলাম, তখন খুব টেম্পার টেনট্রম হতো। তোমার এজামশন পুরোপুরি অ্যাকুরেট না হলেও এতে খানিকটা ট্রুথ আছে, ডিশ বা গস্নাস আমি কখনো ভাঙিনি, তবে প্রিয় খেলনা ছুড়ে ফেলে দিয়েছি নদীজলে, যে-টেডি বিয়ারকে খুব ভালোবাসতাম, বুকে জড়িয়ে ঘুমাতাম, খেপে গিয়ে তার কান ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। বাট দিজ উয়ার আ লং টাইম এগো। এখনো রাগ হয়, বাট আই লার্ন হাউ টু ম্যানেজ ইট নাউ।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাই, ‘হাউ ডু ইউ ম্যানেজ ইয়োর অ্যাংগার, কীভাবে নিজেকে সামলাও বিয়াংকা?’ চটজলদি সে জবাব দেয়, ‘আই এক্সারসাইজ, ঘণ্টাদেড়েক স্টেশনারি বাইকের চাকা ক্রমাগত প্যাডেল মেরে ঘোরাই, তাতে রাগ প্রশমিত না হলে… আই জাস্ট রান, দৌড়াতে দৌড়াতে, ঘেমে-নেয়ে উঠে ক্লান্তিতে স্রেফ কলাপস্ করি। আরো নানাভাবে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করি, বাট আই অ্যাম নট গোয়িং টু টেল ইউ অলরাইট নাউ।’ আমি এবার অন্যদিকে আলাপকে ঘোরানোর চেষ্টা করি, বলি, ‘বিয়াংকা, আমাকে সব কিছু বলার কোনো দরকার নেই, তবে একটা বিষয়ে আমার কৌতূহল আছে, নিকারাগুয়াতে তোমার আত্মীয়স্বজন কেউ আছে কী?’ সে কব্জিতে গুডলাক চার্মের বলয় দেখিয়ে জবাব দেয়, ‘না, আত্মীয়স্বজন কেউ আর এ-দেশে নেই, সকলেই অভিবাসী হয়ে পাড়ি জমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। তবে, এখানে একটি পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এরা আমাকে দত্তক কন্যার মতো ভালোবাসে। এ গুডলাক চার্মটি এরা আমাকে দিয়েছে। এদের সন্ধান করে খুঁজে বের করার জন্য আমি প্রথমবার ফ্লোরিডা থেকে নিকারাগুয়াতে আসি।’

আমি কথাবার্তায় একটু বিরতি নিয়ে চুপচাপ জলে ভাসমান শ্যাওলাময় জলজ গুল্ম দেখি। তা থেকে কিছু মাছ কেবলই লাফিয়ে ওঠে – খানিকটা পথ উড়ে উড়ে আবার ল্যান্ড করে জলের সবুজাভ সারফেসে। ফ্লাইং ফিশ বা উড়ুক্কু মাছগুলো আমার চোখের সামনে সৃষ্টি করে এক ধরনের রুপালি দৃষ্টিবিভ্রম। আমি এ-দৃশ্যপট বর্ণনার সঠিক ভাষা মনে মনে ভাবি। পাশ থেকে বিয়াংকা গুডউইশ চার্মে রিনঝিন শব্দ তুলে আমার হাত স্পর্শ করে বলে, ‘আই গেস্, ইউ লস্ট ইন্টারেস্ট ইন মি?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিই, ‘দ্যাটস্ নট ট্রু, আমার মনে একটি কৌতূহল তীব্রভাবে তোলপাড় তুলছে বিয়াংকা। অজানা একটি পরিবারের সন্ধানে তুমি নিকারাগুয়াতে কেন এসেছিলে?’ কোনো দ্বিধা না করে সে জবাব দেয়, ‘অনেক বছর পর আমার প্রয়াত বাবার ব্যবহার করা জিনিসপত্র ঘাঁটতে গিয়ে তাঁর ডায়েরিতে এ-পরিবারের কথা জানতে পারি।’ দুটি উড়ুক্কু মাছ উড়তে উড়তে এসে ছিটকে পড়ে আমাদের বোটে। আমি তাদের পাখির ডানার মতো ফিন দেখে বেজায় অবাক হই। বিয়াংকা ছটফটানো মাছদুটি ধরে সমুদ্রজলে ছেড়ে দিয়ে কনটিনিউ করে, ‘আমি যখন মায়ের গর্ভে, তখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পতন হয় নিকারাগুয়ার ডিকটেটর সমোজা চক্রের। বাবা তার সরকারে ম্যাজিট্রেট হিসেবে কাজ করছিলেন। তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছিল না, তিনি সিক-লিভ নিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। বামপন্থি সান্দিনিস্তারা ক্ষমতায় এসেই সমোজা সরকারের অনুগত কর্মচারীদের ধরপাকড় শুরু করে। কারাগারে তাদের ওপর দৈহিক নির্যাতনের খবর শোনা যাচ্ছিল সর্বত্র। বাবার জানাশোনা কয়েকজন সিনিওর অফিসারকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। পরিস্থিতি দ্রম্নত খারাপ হতে থাকলে মাকে নিয়ে তাঁর পালানোর প্রয়োজন পড়ে।’

আমাদের বোটের পাশেই জলে দারুণ তোলপাড় তুলে আধভাসা হয়ে সাঁতার কাটে অনেকগুলো বিশালদেহী তলোয়ার মাছ। এ-মাছগুলো জলের সারফেসে ফ্লাইং ফিশ ল্যান্ড করা মাত্র তা খপ করে গিলে ফেলার চেষ্টা করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তলোয়ার মাছ ফ্লাইং ফিশকে ক্যাচ করতে সমর্থ হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ ফ্লাইং ফিশ তাদের সাক্ষাৎ সমন এড়িয়ে আবার ফ্লাই করে চলে যাচ্ছে বেশ দূরে। খাদ্য ও খাদকের প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে বিয়াংকা নিচুস্বরে কথা বলে যায়, ‘সমোজা সরকারের সাবেক চাকুরে হিসেবে লেওন শহরে বসবাস করা শুধু ঝুঁকিপূর্ণই না, রীতিমতো ডেঞ্জারাস হয়ে পড়েছিল। তাই, বাবা শহর ছেড়ে কোস্টারিকার সীমান্তের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। হাইওয়েতে মাইলপঞ্চাশেক ড্রাইভ করার পর তাঁর গাড়িটি ট্রাবল দিতে শুরু করে। তিনি তখন পথের পাশে থেমে একটি গ্যারেজে গাড়িটি সারাই করতে দেন। গ্যারেজওয়ালা তাঁকে ঘণ্টাচারেক পর এসে গাড়ি ডেলিভারি নিতে বলে। তো, বাবা একটি ট্রাইসিকেল ভাড়া করে খানিক দূরে গিয়ে মাকে নিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় বসেন। তখন গ্যারেজের এক মেকানিক বাইসিকেলে করে ছুটে এসে জানায় যে, এ এলাকা পুরোটাই চলে গেছে সান্দিনিস্তা বিপ্লবীদের দখলে। আর বিপ্লবের সক্রিয় সমর্থক গ্যারেজ মালিক একটু আগে সান্দিনিস্তাদের দফতরে তাঁর স্ত্রীসহ কোস্টারিকার দিকে পালিয়ে যাওয়ার খবর পাঠিয়েছে। বাবার শরীরে সেদিন ছিল হাইফিভার। রেস্তোরাঁ ছেড়ে মাকে নিয়ে তিনি নার্ভাসভাবে বেরিয়ে আসেন সড়কে। প্রেগন্যান্ট স্ত্রীকে নিয়ে তিনি কোথায় পালাবেন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। মেকানিক তাঁদের অভয় দিয়ে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শেল্টার দেয়।’

সিনিয়র ডিগমার কী এক এক্সাইটমেন্টে হইচই করে ওঠেন। বোটম্যান ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, ‘ওহ্, দিয়াস – দস বায়েনাস, বা মাই গড, দেখো – ভাসছে দুটি তিমি মাছ!’ সিনিয়র চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে স্ক্যান করেন দিগন্ত। খালি চোখে আমি দেখতে পাই, শূন্যতায় উৎক্ষেপ্ত হচ্ছে ফোয়ারার মতো জল। বুঝতে পারি, সমুদ্রের এদিকে চরছে জোড়া তিমি। ক্রিসটেলা কণ্ঠস্বরে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে বলে, ‘ইউ গাইজ আর রিয়েলি লাকি। লুক গাইজ, লুক কেয়ারফুলি, একটু দূরেই সাঁতার কাটছে দুটি প্রকা- তিমি। সচরাচর তিমি মাছের ভেসে-বেড়ানো দেখার জন্য যেতে হয় সান হোয়ান ডেল সুরের সৈকতে। দিস ইজ ট্রুলি রেয়ার সাইট, গাইজ।’ সিনিয়র ডিগমার আমার দিকে তাঁর বাইনোকুলার বাড়িয়ে দেন। আমি তাতে চোখ রেখে দেখি, জলের সবুজাভ সারফেসে জেগে উঠেছে যেন ডুবোপাহাড়ের কালচে রঙের টিলার মতো দুটি আকৃতি। আকৃতি দুটো আধাভাসা হয়ে হেলেদুলে, নড়েচড়ে, সরে যায় উত্তর থেকে দক্ষিণে। একটি কালচে টিলা জলতলে চলে গেলে, আমরা দেখতে পাই বিশাল লেজের ঝাপটে ছিটকে উঠছে জলরাশি। বোট বাঁকা হয়ে ঘুরে গতিপথ বদলায়। বোধ করি, হালকাগোছের কায়াক নিয়ে দেড়শো টন ওজনের তিরিশ মিটার লম্বা তিমিমাছের আর কাছাকাছি যাওয়াটা নিরাপদ নয়।

হঠাৎ করে সমুদ্রজলে দারুণ সব তরঙ্গ উঠতে শুরু করে। বোটম্যান শক্তহাতে হাল ধরে পকেট থেকে বের করে কম্পাসের দিকনির্দেশক কাঁটার দিকে তাকায়। ঢেউয়ের তোড়ে বিয়াংকা ছিটকে পড়ে আমার শরীরে। নিজেকে বিযুক্ত করতে করতে ফিক করে হেসে সে বলে, ‘নট টু ওয়ারি মাচ্। কার্গো শিপটি আরেকটু এগিয়ে গেলেই ঢেউ কমে আসবে।’ তার আঙুলের ইশারায় আমি পেছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, আর্জেন্টিনার পতাকা উড়িয়ে জল ছত্রখান করে আগ বাড়ছে বেজায় ভারী একটি মালবাহী জাহাজ। রংচটা জাহাজটির ডেকে কোনো কনটেইনার নেই। মনে হয়, কার্গোবোটটি বন্দরে কনটেইনারগুলো আনলোড করে ফিরে যাচ্ছে তার স্বদেশে।

সিনিয়র ডিগমার তাঁর বাইনোকুলারটি আমার দিকে বাড়িয়ে দেন। আমি তরঙ্গরাজির তুলতবিলের ভেতর কায়ক্লেশে ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে লেন্স অ্যাডজাস্ট করি। জাহাজের ডেকে খালাসিদের হাঁটাচলা করতে দেখা যায়। আমি বাইনোকুলার ঘুরিয়ে কেবিনের কাছে ফোকাস করি। ওখানে মনে হয়, ডেকচেয়ারে বসে সূর্যস্নান করছে কোনো নারী। আমি চোখ ঘুরিয়ে ব্রিজের দিকে নজর দিই। দেখি, দাড়িওয়ালা এক নাবিক, বোধ করি জাহাজের কাপ্তান, গলায় বাইনোকুলার ঝুলিয়ে পায়চারি করছেন। আবার তাকাই, কেবিনের কাছাকাছি ডেকের দিকে। সূর্যস্নানরতা রমণীর হাতে ড্রিংকসের পানপাত্র ইত্যাদি ছোট ছোট ডিটেলস পরিষ্কার হয়ে আসে। তার ডেকচেয়ারের কাছেই কার্পেট পাতা। ওখানে বসে একমনে একটি শিশু পস্নাস্টিকের জিমসেট নিয়ে খেলছে। অল্প দূরে স্ট্যান্ডের ওপর পাতা বার-বি-কিউ গ্রিল। ওখানে দাঁড়িয়ে গলায় গিটার ঝোলানো একটি বালক। তার পাশে বেসবল হ্যাট পরা একটি কিশোরী গ্রিলে আস্ত একটি আধপোড়া মাছ উলটে দেয়। সমস্ত দৃশ্যপট দূরে সরে যেতে থাকে দ্রম্নত। একটা বিষয়ে মনে খটকা লাগে। কার্গোশিপ তো সচরাচর প্যাসিনজার্স ক্যারি করে না। ডেকচেয়ারে শুয়ে থাকা নারী, শিশু ও গিটারগলায় বালক ও কিশোরী – এরা কারা? তাহলে কি এ-যাত্রায় জাহাজি কাপ্তান তাঁর পুরো সংসার নিয়ে নৌভ্রমণ করছেন?

বিয়াংকার ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক, জাহাজখানা খানিক দূরে সরে যেতেই শান্ত হয়ে আসে তরঙ্গকুল। গুডউইশ চার্মে রিনিটিনি বোল তুলে বিয়াংকা চুল থেকে ক্লিপ সরিয়ে তা কাঁধে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘মা-বাবার নিকারাগুয়া থেকে এসকেপ করার বৃত্তান্ত আমি খুব সংক্ষিপ্তভাবে বলছি। মেকানিক তাঁদের নিয়ে তার শ^শুরবাড়ির গোলাঘরে শেল্টার দেয়। ওখানে বসবাসের তৃতীয় দিনে তীব্র স্ট্রেসের ভেতর আমার জন্ম হয়, প্রিম্যাচিওরলি, এক্সপেকটেড ডেটের ছয় সপ্তাহ আগে। গোলাঘরে মা-বাবা লুকিয়ে ছিলেন মোট চবিবশ দিন। তারপর মেকানিকের এক জানাশোনা স্মাগলারের মাধ্যমে তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে কোস্টারিকাতে এসে পৌঁছেন।’

বোটের গতি শস্নথ হয়ে আসে। জলজুড়ে কয়েকটি গাছপালায় শ্যামল একটি চর ভেসে ওঠে। ইসলা ডে হুয়ান ভেনাডোর অনেকগুলো ছবি আমি দেখেছি। এ-চরের সঙ্গে ইসলা ডে হুয়ানের কোনো মিল নেই। ঠিক বুঝতে পারি না, বোট তবে যাচ্ছে কোথায়? মনে ধিকিধিকি শিখার মতো একটি কৌতূহল কেবলই উসকে ওঠে – কোস্টারিকা থেকে বিয়াংকার মা-বাবা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিলেন কীভাবে? ‘দেন হোয়াট? তারপর কী হলো তাদের?’ বলে তার কব্জি ছুঁতেই সে কেমন যেন অনিচ্ছার সঙ্গে বলে, ’কোস্টারিকার এক শরণার্থী শিবিরে মা-বাবা আমাকে নিয়ে মাসদুয়েক কাটান। তারপর তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে পলিটিক্যাল অ্যাজাইলাম পেয়ে ফ্লোরিডায় গিয়ে অভিবাসী হন।’

বিয়াংকা গ্রীবা বাঁকিয়ে জল ফুঁড়ে জেগে ওঠা ছোট্ট চরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারি, সে আর কথাবার্তা বলতে চাচ্ছে না। আমি তার নিজের বিষয়ে কথা বলাতে অনিচ্ছুক হয়ে ওঠার কারণ বুঝতে চেষ্টা করি। মুখে কিছু বলি না, তবে বিষয়টি নিয়ে ভাবি। ঘটনা কী? একটু মনোযোগ দিয়ে নীরবে তর্পণ করতেই অনুভব করি, তার মা-বাবার কাহিনি আমি শুনে যাচ্ছিলাম লেখক হিসেবে আমার নিজস্ব প্রয়োজনে। আমার আচরণে সহমর্মিতার অভাব ছিল, মনোযোগও বারবার বিঘ্নিত হচ্ছিল সমুদ্রযাত্রার ভাসমান দৃশ্যপটের অভিঘাতে, বিষয়টা বোধ করি অনুভব করে বিয়াংকার কথা বলার আগ্রহ মিইয়ে এসেছে। তার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ না দেওয়ার জন্য আমার আফসোস হয়। কিন্তু তৎক্ষণাৎ এ পরিস্থিতি উতরানোর কোনো উপায় দেখি না।

বোটম্যান ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে এবার কায়াকটিকে বৈঠা মেরে নিয়ে যাচ্ছে একচিলতে নির্জন দ্বীপটির দিকে। সবুজ গাছপালায় পড়ে আসা বেলার নরোম আলো লেগে দ্বীপটিকে রূপকথার নির্বাসিত কোনো রাজকুমারের বিজন আবাসভূমির মতো দেখায়। কায়াকটি মৃদু স্রোতে ঘুরে দ্বীপের অন্যদিকে আসলে দেখি, বালুচরে একঝাঁক সাদা সারস-জাতীয় পাখি ধ্যান ধরে বসে আছে। তাদের ঠিক পেছন থেকে কয়েকটি বেজায় বড় কুচকুচে কালো পাখি বোটটি দেখামাত্র আড়মোড়া ভেঙে, ডানা ঝাপটিয়ে, কা-কা-লা-লা শব্দে খানিকটা উড়ে এমন এক কাকাফোনির সৃষ্টি করে যে, মনে হয় – আমাদের ওয়েলকাম করার তাদের কোনো আগ্রহ নেই। মাঝি আরো খানিকটা ঘুরে দ্বীপের উলটো দিকে আমাদের নিয়ে আসেন। জুতা খুলে, প্যান্টের পা গুটিয়ে, বেশ খানিকটা জলে আমি নেমে হাত বাড়িয়ে দিই বিয়াংকার দিকে। সে মস্নান হেসে ‘আই অ্যাম ফাইন’ বলে আমার হাত স্পর্শ না করে নেমে আসে জলে। তার পাশাপাশি দ্বীপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমি বলি, ‘থ্যাংক ইউ সো মাচ ফর টেলিং মি কোয়াইট আ বিট আবাউট ইউ।’ সে শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনেকটা জনান্তিকে, ‘মে ভিদা অ্যাস দুরা, বা আমার জীবন খুবই কঠিন’, বলে নীরবে দ্বীপে এসে ওঠে। বুঝতে পারি, সে আমার সঙ্গে আর কথাবার্তায় এনগেজ হতে চাচ্ছে না।

সিনিয়র ডিগমার মিনিটবিশেক ঘুরেফিরে পুরো দ্বীপটা এক্সপেস্নার করার পরামর্শ দেন। তিনি রহস্যময়ভাবে হেসে বলেন, ‘উসেত্মদ পোয়েদে ডিসকুবির আলগো ইনতেরেসানতে, বা হয়তো তুমি ইন্টারেস্টিং কিছু একটা আবিষ্কার করবে এখানে।’ দ্বীপটি আকারে খুবই ছোট্ট। একাকী হাঁটতে হাঁটতে তার এক প্রান্তে এসে দেখি, বড় একটি বোল্ডারের পাশে দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে ক্রিসটেলা। আমি কাছে এসে দাঁড়ালেই সে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘লুক অ্যাট দ্য হোরাইজন।’ আমি সমুদ্রজলে নেমে আসা নীলিমা ছাড়া দিকচক্রবালে আর তেমন কিছু দেখতে পাই না। সে আবার বলে, ‘ফোকাস ইয়োর আইজ রাইট অন দি স্কাই, অ্যান্ড উইশ সামথিং।’ আমি দিগন্তে ভেসে যাওয়া পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের ভেতর কালচে সবুজ একটি আকৃতি দেখতে পাই। দেখতে দেখতে মেঘ সরে যায়, আর অনেক যুগের সাধনার পরিশেষে প্রাপ্তির মতো ভেসে ওঠে আমার প্রিয় আগুনপাহাড় মমোতোমবো। আমি মুগ্ধ হয়ে নীলিমা ফুঁড়ে আকাশে ছড়িয়ে দেওয়া সামান্য ধোঁয়ার রেখার ভেতর ক্ল্যাসিক কৌণ শেইপের আগ্নেয়গিরিটি দেখি। তার নেকলাইনে প্রকৃতির বন্দনা হয়ে জড়িয়ে আছে সারসের শুভ্র পালকের মতো রাশি রাশি মেঘ।

ক্রিসটেলা মৃদুস্বরে বলে, ‘রাইট দেয়ার, মমোতোমবো ইজ টাওয়ারিং ওয়ান থাউজেন্ড দু হানড্রেড ফিফটি এইট মিটার এভাব দ্য সি লেভেল।’ আমার ভেতরে অনিশ্চয়তা মোচড় দিয়ে ওঠে, যদি কোনো কারণে এ-আগুনপাহাড়ে যাওয়া না হয়। আমি মন থেকে এ নেগেটিভ ভাবনা সরিয়ে প্রার্থনার মতো নীরবে উইশ করে বলি, ‘ক্রিসটেলা, আই ফিল অ্যা স্ট্রং আর্জ টু গো টু মমোতোমবো অ্যান্ড হাইক দেয়ার।’ সে পা দিয়ে বোল্ডারটি ছুঁয়ে বলে, ‘আমারও যেতে ইচ্ছা হয়, যখন সংকটে পড়ি, আমি চোখ মুদে মমোতোমবোর দৃশ্যপট কল্পনা করে তার কাছে প্রার্থনা করি বিপদ তারণের। ওখানেই তো আমার শিকড়, কায়মনোবাক্যে তার কাছে কিছু চাইলে পিতৃসুলভ এ জীয়ন্ত পাহাড় আমাকে খালি হাতে ফেরায় না।’ তার মন্তব্যের মর্মার্থ আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি না, তাই জানতে চাই, ‘এই যে বললে, ওখানে তোমার শিকড়, হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট?’ ডাগর চোখ দুটিকে আরো গভীর করে সে জবাব দেয়, ‘মমোতোমবো পাহাড়ের পাদদেশে আছে লেওন ভিয়াখো বলে একটি শহরের ভগ্নাবশেষ। আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন নিকারাগুয়ার আদিবাসী, তাঁরা এককালে – কয়েকশো বছর আগে বসবাস করতেন লেওন ভিয়াখোতে। কালো গাত্রবর্ণ আমি জন্মসূত্রে তাঁদের কাছ থেকে পেয়েছি। মমোতোমবো পাহাড়টি তাঁদের দিনযাপনে ছিল জীয়ন্ত দেবতার মতো।’ তার কথা শুনতে শুনতে আলাপকে আরো বিস্তারিত করার জন্য বলি, ‘ইটস্ হাইলি ইন্টারেস্টিং দ্যাট… সংকটের সময় ক্রিসটেলা তুমি সৌম্য দর্শন এক আগ্নেয়গিরির কাছে ভারসা করো।’ আমার কথার রেশ ধরে সে কনটিনিউ করে, ‘মমোতোমবো হ্যাজ বিন সো হেল্পফুল টু মি, ইটস্ সো ট্রু, বছরখানেক আগে ফ্লোরিডায় আমাকে একজন টেইল করত, সানগস্নাস পরা অ্যা ডেডলি লুকিং গাই, কলেজ ক্যাম্পাসে, শহরের ক্যাফেতে সর্বত্র, খানিকটা দূর থেকে সে আমাকে ফলো করত, আমার প্রতিটি আচরণ খুঁটিয়ে অবজার্ভ করত। একবার আমি ড্রাইভ করছিলাম, গাড়ির রিয়ারভিউ মিররে দেখতে পাই, তার গাড়িটি নিপুণভাবে আমাকে অনুসরণ করছে। আমি ঢুকে পড়ি ব্যাকরোডের গলিপথে, কিছুতেই তাকে কাটাতে না পেরে শহর ছেড়ে আধঘণ্টা ড্রাইভ করে এসে পড়ি অন্য এক শহরে। ম্যাপ দেখে চলে আসি ভিন্ন এক কলেজ ক্যাম্পাসে। হিয়ার হি ওয়াজ, আমার গাড়ির পাশে সে পার্ক করে তার গাড়ি। তো, আমি একটি গির্জায় ঢুকে চুপচাপ বসি ব্রেঞ্চে। দেখি, সেও গির্জার দেয়ালের কাছে হেঁটে গিয়ে ফ্রেস্কোতে আঁকা বাইবেলের দৃশ্যপট দেখছে। আমি তখন অসহায় হালতে চোখ মুদে মমোতোমবোর ইমেজে মনোসংযোগ করি। প্রার্থনা করি, পবিত্র আগুনের অনন্ত উৎসের কাছে। অনেকক্ষণ পর চোখ খুলতেই দেখি, হাওয়া হয়ে গেছে আমার টরমেন্টার, সে আর কখনো আমাকে ফলো করেনি।’ আমার মুখ থেকে ফস করে বেরিয়ে যায়, ‘ক্রিসটেলা, তুমি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছো কখনো?’ এ-ধরনের ব্যক্তিগত প্রশ্নে সে কিছু মনে করে না, বরং সাবলীলভাবে জবাব দেয়, ‘দেখিয়েছি কয়েকবার, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সাইকিয়াট্রিস্টরা যেসব ড্রাগস দেয়, তাতে আমার করোটি কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। মাথা থেকে উবে যায় মমোতোমবোর ইমেজ। বিষয়টি আমি পছন্দ করি না। ওখানেই তো আমার শিকড়। তাই চলে এসেছি নিকারাগুয়াতে, ড্রাগস না নিয়ে এখানে ভালোই আছি। আই লাইক ইট হিয়ার ভেরি মাচ।’

আমাদের কথাবার্তা আর বিশেষ আগায় না। পাশাপাশি হেঁটে হালকা পদক্ষিপে আমরা ফিরতে শুরু করি নোঙর করা বোটের দিকে। গাছপালার জংলা জায়গা পেরিয়ে একটু উঁচু পাথরের সত্মূপ করা ঠেকের ওপর উঠতেই ক্রিসটেলা কনুই দিয়ে আমার পাঁজরে খোঁচা দেয়। আমি দাঁড়িয়ে পড়লে সে ঠোঁটে তর্জনী রেখে চুপ করতে ইশারা করে। ভাবি, হয়তো এসে পড়েছি এনডেনজার্ড হাওয়া সমুদ্র-কচ্ছপের ডিম পাড়ার থানে। নিরিখ করে তাকাতেই সামনের খোলামেলা ওপেনিং দিয়ে দেখি, জলে হাঁটু অবধি চুবিয়ে একটি আধডোবা পাথরে সুইমিং ট্রাংক পরে বসে আছেন সিনিয়র ডিগমার। তাঁর উদোম গতরের বাহু ও কাঁধ থেকে হরেকরকমের উল্কির আকৃতি ছড়াচ্ছে নানাবিধ বর্ণের ছটা। তিনি একা নন। খানিক দূরে কাঁধ অবধি জলে ডুবিয়ে সমুদ্রস্নান করছে বিয়াংকা। ক্রিসটেলা ফিসফিসিয়ে বলে, ‘সি ইজ ডুয়িং ইট। বিয়াংকা ইজ অ্যা রিয়েল বিচ্, সি ইজ হুকিং আপ ডিগমার।’ নির্জন এ-দ্বীপের সমুদ্রজলে স্নান করে সিগ্ধ হওয়া আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হয়। ঠিক বুঝতে পারি না, তার জলে গা ডোবাতে ক্রিসটেলা কেন বিরক্ত হচ্ছে। তাই গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘হোয়াট ইজ দ্য ম্যাটার ক্রিসটেলা, ইউ সাউন্ডস্ ক্রস?’ সে এসপানিওলে জবাব দেয়, ‘এসতে ইসলা মুই আগ্রেডাবলে আসেরলো কে কিয়ারেস, অর্থাৎ এ দ্বীপ এতই নির্জন যে, এখানে যা খুশি তা করা যায়।’ আমি এবারো বিষয়টি পুরোপুরি ধরতে না পারলে সে লাজুক মুখে বলে, ‘ইয়োর আইকিউ ইজ রিয়েলি লো… স্টুপিড গাই, লুক, বিয়াংকা ইজ স্কিনি ডিপিং।’ ‘ওহ্ রিয়েলি’, বলে আমি অবাক হয়ে জলের দিকে তাকাই। ‘সামথিং ইজ টিকলিং মি, বা কিছু একটা আমার শরীরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে’, বলে দু-পা আগ বাড়িয়ে অগভীর জলে দাঁড়িয়ে পড়ে বিয়াংকা। সে ডিগামারের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করে দু-হাতে চেপে ঢাকে তার নোনাজলে সিক্ত স্তনযুগল। সঙ্গে সঙ্গে শরীর ঝাঁকিয়ে তীরের দিকে আগাতে আগাতে তড়বড় করে বলে, ‘মাই গড, লিটিল ফিশেস আর রিয়েলি বাইটিং মি।’

একঝাঁক ছোট মাছ জলের সারফেস থেকে লাফিয়ে ওঠে। ‘ওহ্, নো’, বলে সে পাড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিরাভরণ শরীর থেকে জল ঝরায়।  তার দেহকে স্প্যানিশ কোনো পেইন্টারের আঁকা ন্যুড চিত্রের মতো দেখায়। আমার অক্ষেগোলক বৃষ্টিস্নাত কেতকীর দিকে উড়ে যাওয়া জোড়া মৌমাছির মতো চঞ্চল হয়ে ওঠে। ক্রিসটেলা শরীর ঘেঁষে তার করতল দিয়ে আমার চোখ ঢেকে দিয়ে বলে, ‘বিয়াংকা ইজ ডুয়িং দিস ডিসপেস্ন অনলি ফর ডিগমার। ডোন্চ ইউ নট আন্ডারস্ট্যান্ড… ইউ স্টুপিড মোরন?’ আমি চোখ থেকে তার করতল সরিয়ে দিয়ে বলি, ‘আই থিংক আই আন্ডারস্ট্যান্ড দিস, আমার আইকিউ অতটা নিচু না ক্রিসটেলা।’ সে ‘ওহ্ , রিয়েলি,’ বলে ঠোঁট বাঁকিয়ে তার আঙুলে আমার চুল এলোমেলো করে দিয়ে ফিসফিসিয়ে আবার বলে, ‘দেন টেল মি… হোয়াট আই ওয়ান্ট রাইট নাউ ফ্রম ইউ।’ তার প্রশ্বাস আমার ত্বকে উষ্ণতা ছড়ালে, আমি তাকে কাছে টেনে নিয়ে ‘আই অ্যাম সার্টেন অ্যা সফ্ট সুইট কিস উইল হেল্প ইউ’, বলে তার গ-দেশে গভীরভাবে ঠোঁট ছোঁয়াই। সে হাতের তেলোতে গালের সিক্ততা মুছতে মুছতে লাজুকভাবে বলে, ‘দ্যাট ওয়াজ সুইট বাট আন-এক্সপেক্টেড।’

আমি চোখের কোণ দিয়ে দেখি, বিয়াংকা কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে, পিঠে বিকিনি টপের হুক লাগাতে লাগাতে সিনিয়র ডিগমারের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। আমার ভেতরে অপ্রাপ্তির সঙ্গে কী যেন এক তৃষ্ণা জোরালো হয়ে ওঠে। আমি নীরবে ক্রিসটেলার ফেস স্টাডি করে বলি, ‘ক্রিসটেলা, যাবে তুমি আমার সঙ্গে হাইকিং করতে মমোতোমবোতে?’ আমার প্রশ্ন শুনে ফুঁ দেওয়া মোমবাতির শিখার মতো তার চোখ-মুখের পজিটিভ অভিব্যক্তি যেন তছনছ হয়ে যায়। সে রূঢ়ভাবে বলে, ‘আই ডোন্ট থিংক সো। তোমার সঙ্গে মমোতোমবোতে যাওয়া হবে আমার জন্য হিউজ রিস্ক। মাই অ্যানসার ইজ অ্যা ক্লিয়ার নো, আই অ্যাম নট গোয়িং টু টেক সাচ্ রিস্ক।’ আমি রেগে গিয়ে বলি, ‘ক্রিসটেলা, হোয়াই নট? হোয়াট রিস্ক আর ইউ টকিং অ্যাবাউট? এক্সপেস্নইন ইট টু মি।’ সে আমার চোখে চোখ রেখে বলে, ‘আমি জানি তুমি কেন নিকারাগুয়ায় এসেছো, আমার চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না, তোমার ছল-চাতুরীর শিকার হতে আমি যাচ্ছি না, আই অ্যাম টু স্মার্ট ফর দ্যাট।’ বলেই পালিয়ে যাওয়ার মতো আমাকে ছেড়ে দ্রম্নত হেঁটে চলে যায় বেশ দূরে। আমি আহত বোধ করি। ইচ্ছা হয়, চিৎকার করে বলি – মানসিকভাবে অসুস্থ তুমি ক্রিসটেলা, সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে – মনে মনে তর্পণ করে বুঝতে চেষ্টা করি, তার এ ধরনের নির্মম আচরণের কারণটা কী।

হেঁটে চলে আসি – একটু আগে যে একচিলতে সৈকতে নোনাজলে সিক্ত দেহে পড়তি বেলার সূর্যালোক মেখে সিনিয়র ডিগমারের সামনে দাঁড়িয়েছিল বিয়াংকা, ওখানে। দেখি, বালুকাবেলায় পড়ে ছটফট করছে শতশত ছোট মাছ। ঠিক বুঝতে পারি না, ছোট মাছগুলো কেন লাফিয়ে উঠছে বালুচরে। আমি মন থেকে ক্রিসটেলার দুর্ব্যবহারকে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে করতে নোঙর করা বোটের দিকে আগাই। এসে পড়ি, অপেক্ষাকৃতভাবে প্রশস্ত একটি সৈকতে। এদিককার স্বচ্ছজলে কিলবিলিয়ে ভাসছে হাজার হাজার ছোট মাছের স্কুল। ঢেউ আসতেই অনেকগুলো মাছ লাফিয়ে ওঠে সৈকতে। তখন পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই, ছোট মাছের স্কুলে সাঁতার কেটে কেটে হামলে পড়ছে সবুজে ঈষৎ সোনালি আভা ছড়ানো ভারী দেহের কয়েকটি মাহি মাহি মাছ। তারা চোয়াল খুলে একসঙ্গে গিলে নিচ্ছে অনেকগুলো ছোট মাছ। সাদা সরস ও সিগালগুলো উড়ে আসে। তার ডাইভ দিয়ে নেমে বালুকা থেকে চঞ্চুতে তুলে নিচ্ছে ছোট মাছ। জলে এবার মাঝারিমাপের কিছু বুস্নফিশ ভেসে এলে রীতিমতো ধুন্ধুমার বেধে যায়। ভারী দেহের মাহি মাহি ছোট মাছ ছেড়ে জল ছিটকিয়ে তাড়া করে যায় বস্নুফিশের দিকে। জলের সারফেসে ডানার বিশাল ছায়া ফেলে উড়ে আসে কয়েকটি ফিশ-ঈগল। একটি জলে ডাইভ দিয়ে নিখুঁত ছোবলে তুলে নেয় আস্ত একটি বস্নুফিশ। ঈগলটি আকাশে চক্রাকারে উড়ে অবশেষে গিয়ে বসে একটি উঁচু গাছের ডালায়।

দরিয়ার বিবাগী হাওয়ায় কেমন যেন আলুথালু হয়ে ওঠে আমার মন ও মানসিকতা। একা দাঁড়িয়ে থেকে, সৈকতে বারবার জানের তরাসে ছিটকে ওঠা ঝলমলে রুপালি মাছগুলোর দিকে তাকিয়ে, তাদের তাড়া করে আসা মাহি মাহি, বস্নুফিশ ও পাখিদের প্রাকৃতিক পরিসরে পারস্পরিক সম্পর্কের কথা ভাবি। ঘাড় ফেরাতে চোখে পড়ে, জংলা জায়গায় একটি গাছের নিচু ডালায় পা ঝুলিয়ে পাশাপাশি বসে সিনিয়র ডিগমার ও বিয়াংকা। তারা পালা করে বাইনোকুলারে খুঁটিয়ে দেখছে কিছু একটা। পস্নাস্টিকের বালতি হাতে এসে বোটম্যান চর থেকে কুড়িয়ে তুলে তাতে রাখছে আধমরা ছোট মাছ। বেশ দূরের এক গোলাকার বালুকাবেলায় আমি ক্রিসটেলাকে দেখতে পাই। সে একটি ডাল দিয়ে বালুতে কিছু একটা আঁকছে। আমি আবার সমুদ্রজলের দিকে তাকাই। দিকচক্রবালে স্টিম ইঞ্জিনওয়ালা জাহাজের মাস্ত্তলের মতো ভেসে ওঠে মমোতোমবোর কৌণ শেইপের ধোঁয়া ছড়ানো চূড়া। ওদিকে তাকিয়ে মনে হয় – দূরের ওই আগুনপাহাড়টিই আমার পরবর্তী গন্তব্য। r