স্মৃতির ছায়াপাত

শাহীন আখতার

\ ১০ \

দুর্ভিক্ষির সন্তান

পরিবারের সোনালি ইতিহাসের আইডিয়াটা মনে হয় হাওয়াই দ্বীপে সফরের সুবাদে প্রাপ্ত। সপরিবারে ওখানে বেড়াতে গেলে মেজোভাইয়ের ওপর পার্ল হারবারের তাসির পড়ে। নিদেন তাঁর আবেগমাখা বলার ভঙ্গি ও কথনে তো সেই নিশানা। দিনটা ছিল ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১। এখনো নিজের দেশের মৃত সৈনিকের প্রতি আমেরিকানদের যে-ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানানোর কায়দাকানুন, সত্তরতম পার্ল হারবার স্মরণ দিবসে তা চাক্ষুষ করে মেজোভাই আপস্নুত। (নিজের দেশ, নিজের পরিবার – সাবিনা মনে মনে জপে। আর তা থেকেই কি পরিবারের সোনালি ইতিহাস!) যাদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের ভবিষ্যৎ, তাদের ভুলে যাওয়া ঠিক নয় – পার্ল হারবার স্মরণ দিবসের এ এক মহান শিক্ষা। সেদিনের আঠারো বছর বয়সী এক আমেরিকান, যার বয়স এখন আটাশি, সেও যক্ষির ধনের মতো খুঁটিনাটি স্মৃতি ধরে রেখেছে। জাপানি বোমায় ডুবন্ত জাহাজ অ্যারিজোনা আদতেই এখন স্মৃতিস্তম্ভ। পস্ন্যাটফর্মে ফুল আর কয়েনের ছড়াছড়ি। ‘যেভাবে ওরা এটি সংরক্ষণ করেছে’, একজন গর্বিত আমেরিকানের মতোই মেজোভাই চোখে-মুখে খুশির ফোয়ারা-ছিটানো উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেন, ‘তোমরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। এখনো অ্যারিজোনার বিক্ষত বডি থেকে শহিদের খুনের মতো ফোঁটা ফোঁটা তেল চুইয়ে পড়ে।’

এসব কথা হচ্ছিল মোয়াজ্জেম হকের নববইতম জন্মদিনে সদ্য ঝোলা ঝাড়বাতির ঝিকিমিকি আলোর নিচে নরম গদির ওপর ফরাস বিছিয়ে। মহফিলে একাই ওয়াজ করছেন মেজোভাই। মোয়াজ্জেম হক কানে শোনেন না। ততক্ষণে তিনি ঘুমিয়েও পড়েছেন। বিষয়টা মনমতো না হলেও সাবিনা নিষ্ঠাবান শ্রোতা হয়ে বসে থাকে। এবং সবাই চলে যাওয়ার পরও আসরে থেকে যায়। মেজোভাইয়ের কথার মাঝখানে ও একবারই শুধু মুখ খুলেছে। নিজের গলাটা কানে অচেনা ঠেকলেও নিরসভাবে বলে গেছে হলিউডি সিনেমা পার্ল হারবারের বিস্ফোরণের দৃশ্যটার জারিজুরি নিয়ে, যার জন্য সাতশো ডিনামাইট স্টিক, চার হাজার গ্যালন গ্যাসোলিন খরচ হয়েছিল।

‘এমন কিছু আমরা পারি না কেন?’ মেজোভাইয়ের সরল প্রশ্নটা সাবিনা শূন্যে তাকিয়ে বোঝার কোশিশ করে – আমরা পারি না এমন বিস্ফোরণ ঘটাতে? তা বাস্তবে, না সিনেমায়?

‘সেটা কি ইচ্ছার অভাব, না গরিব বলে?’ সশব্দে হলেও মেজোভাইয়ের সব প্রশ্নের তীর যেন নিজের দিকে নিশানা করা। তাই জওয়াবের তোয়াক্কা না করে তাঁর বয়ানে চলে আসে বিশ্বযুদ্ধের শেষাবস্থায় হিরোশিমা-নাগাসাকির বুকে অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণ। যেন পার্ল হারবারের শোধ তুলতে আমেরিকার পক্ষে তা জায়েজ হয়ে যায়। সাবিনা বিস্মিত হয় না। এ-যাবৎকালে বহুবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় সাড়ে চার বছরের ব্যবধানের দুটি ঘটনা এক কাতারে পরিবেশিত হতে দেখেছে সে। জাপান পার্ল হারবারে বোমা ফেললে তৎক্ষণাৎ হুইল-চেয়ারবন্দি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মওকা মিলে যায়। আরো মওকা মেলে যুদ্ধ তামাদি হওয়ার মুখে দু-দুটি অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের, যা নিশ্চিতভাবে জানান দিচ্ছিল – আগামী জমানার একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাবিনার মনে হয়, মেজোভাইয়ের পরবর্তী সফর অবশ্যই জাপানের হিরোশিমা দ্বীপ হতে হবে, যেখানে ‘লিটল বয়ে’র তেজস্ক্রিয়ায় দগ্ধানো শরীর, মণিহীন অক্ষিকোটর এখনো দুর্লভ নয়। এবং শহিদের খুনের মতো ফোঁটা ফোঁটা চোয়ানো তেলের চেয়ে তা নিরেট সত্যই বরং।

এতক্ষণ দরজার সিঁড়িতে বসে কাশেম মিয়াও মনে হয় জাহাজের গা বেয়ে তেল চোয়ানোর গল্পটা শুনছিল, যা গল্পের মতোই সাজানো। আর পৃথিবীর বুকে প্রথম নিক্ষিপ্ত দুটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের বিবরণ। সেই যুদ্ধের কারণেই যে ১৯৪৩-এর মন্বন্তর, কাশেম মিয়া কি এর শানে-নজুল জানে – যা তাকে ঠিকানাবিহীন এতিম বানিয়ে দিয়েছে?

কাশেম মিয়া আসলে মেজোভাইয়ের কাছে রোগ-ব্যারামের কথা কয়ে সন্ধ্যারাতে টাকা মাঙতে আসা মিসকিনদেরই একজন। তবে এসেছে এমন সময়, যখন টাকার বাক্সে তালা-চাবি পড়ে গেছে আর ঘরের দরজায়ও ভেতর থেকে খিল তোলা। কী মনে করে কাশেম মিয়া দরজার কড়া নাড়ে না বা গলা চেপে খুকখুক কেশে কারো সমবেদনাও যাঞ্চা করে না। ফিরে যাওয়ার কালে শীতের প্রকোপে বা অভ্যাসবশে হয়তো উঠানের মাঝামাঝি পৌঁছে গেয়ে ওঠে মাইজভা-ার তরিকার জিকিরি গীত। কাশেম মিয়ার গানের সুরের চেয়েও কণ্ঠের জোরে মোহিত মেজোভাই। সত্তর-বাহাত্তরে এমন গলার জোর! আর সাহসও দুর্দান্ত। কাশেম মিয়া বাত্তি ছাড়া জঙ্গলাকীর্ণ পুকুরপাড় দিয়ে আসার কথা বলে তিন যুগের আমেরিকা প্রবাসী মেজোভাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। নিমেষে অ্যাটম বোমা থেকে আড্ডার মোড় ঘুরে যায় মাইজভা-ার তরিকার আলাপ-সালাপে। সাবিনার মনে হয়, মেজোভাই বাহ্যত আগ্রহ দেখালেও কাশেম মিয়া তরিকতের যে মাহাত্ম্য ব্যাখ্যান করছে, তাতে তাঁর মনোযোগ নেই বা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে বলে ঘনঘন হাই তুলছেন। আর কাশেম মিয়ারও কেমন নাকেস-আকেল – মাঝরাতে বাড়ি এসে হেঁয়ালিপূর্ণ বাকতাল্লা জুড়ে দিয়েছে! কানে কম শোনেন বলে মোয়াজ্জেম হককে নিয়ে ভাবনা নেই, ভয়টা নীহার বানুকে নিয়ে, গভীর নিদ্রায়ও যার কান দুটি জেগে থাকে। গাঁজার দমে মজে থাকা কাশেম মিয়াও শেষ অবধি তা অগ্রাহ্য করতে পারে না। ‘ভিখারিরে ভিক্ষাদান করিলে হয় রক্ষা প্রাণ’, মেজোভাই থেকে তার দৃষ্টি সরে যায় ঘরের মাঝখানের দরজার ঝোলা পর্দায়, যার পেছনে নীহার বানুর ঘাপটি মেরে থাকাটা তার বিবেচনায় অসম্ভব নয়। ‘আমি ভিক্ষা চাহি রাঙা দুই চরণ।’ বলে ধূসর পর্দাকেই সালাম ঠোকে কাশেম মিয়া। ভাজের প্রতি রসিক দেওরের আচরণই বটে, যা ছ্যাবলামি ভেবে আরেকবার হাই তোলেন মেজোভাই।

সাবিনা খাবারঘরে এসে কাজের মেয়েকে ড্রয়িংরুমে চা পাঠাতে বলে উঠানে নেমে আসে।

উঠানটা ছিল হালকা কুয়াশা-জড়ানো, উত্তরে হাওয়ায় হিম। আর চাঁদের আলোয় গাছের ছায়া পড়ে আলোছায়াজনিত রহস্যময়। মাথায় পশমের শাল তুলে দিয়ে ঘুরে ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে সাবিনা ভাবে – এখন ড্রয়িংরুমে ফিরে না গেলে অভদ্রতা হবে! সত্যি বলতে কী, মেজোভাইয়ের সব কথায় সায় দিতে গিয়ে ওর মাথা ধরে গেছে। সাবিনা পার্ল হারবার নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন, যেখানে ও নিজের বাবার আজাদ হিন্দে যোগদান নিয়েও ভাবতে চায় না! একসময় সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজের গল্পটা স্কুলের সহপাঠীদের শোনানোর সময় ওর চোখের সামনে ডলফিনের ছবি ভেসে উঠত। আর এর পেছনের নীল জলে রুপালি ছটা। আরো পেছনে মাছের পোনার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা অসংখ্য ডলফিন। আজাদ হিন্দ, সুভাষ বোস, আইএনএ, কর্নেল লক্ষ্মী, শাহনেওয়াজ খান, আবিদ হাসান – এ নামগুলি স্কুলের সহপাঠীদের কাছ থেকে ওকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ও যেন ভিনগ্রহের আজব প্রাণী, ওকে এড়িয়ে চলত সবাই। তারপর কখন থেকে মুখে কুলুপ এঁটেছে সাবিনা নিজেও জানে না। আজ বই লেখার মেজোভাইয়ের প্রস্তাব পেয়ে সেই তিক্ততা যেন ফিরে এসেছে। আর তা জোরালোভাবে নাকচ করার মওকা মিলছে না বলে মনে মনে গুমরাচ্ছে সে।

উঠানে ঘুরে ঘুরে কক্ষচ্যুত হয়ে সাবিনা রান্নাঘরের দরজায় চুলার উত্তাপ নিতে দাঁড়ায়। দেখে শ্যামলাকে দু-কাপ চায়ের কথা বলা হলেও ও বড় একটা কাচের মগে ছাঁকনি বসিয়ে চা ঢালছে। মেয়েটার এত অসূয়া কেন কাশেম মিয়ার প্রতি? এ কি নীহার বানুর প্রভাব? হবে হয়তো। সাবিনা শ্যামলাকে কষে ধমক লাগাতে ও হায় হায় করে ওঠে। ‘ছোড আফায় যে কী কয়! হে বেডায় চা খায়নি? বেক্তে জানে বেইন-বিহালে ধুমা খায়!’ বলে খিলখিলিয়ে হেসে হাতে ট্রে নিয়ে দুলতে দুলতে ড্রয়িংরুমের দিকে চলে যায়।

এখনো লোকে এ নিয়ে কথা বলে! এটা তো বহুৎ পুরানা মামলা। সাবিনা বড় হয়েছে শুনতে শুনতে যে – কাশেম মিয়া আওয়ারা আদমি। সংসারে তাঁর মন নাই। মাজারে মাজারে ঘোরে। কোনো এক পয়লা মাঘে সে সর্বশেষ বায়েত নেয় গাউসুল আযম মাইজভা-ারির পবিত্র হুজরায়। তবে মাথায় বাবরি চুল রাখার আগে বা মাইজভা-ারির বায়েত নেওয়ারও বহু পূর্বে তার গঞ্জিকা সেবন সারা গাঁয়ে চাউর হয়ে গিয়েছিল। যা একমাত্র সায়মা খাতুনই বুঝতে পারতেন না। মোয়াজ্জেম হকের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন, যখন ছেলেকে বলতে শুনতেন – নেশার জন্যই জিন্দেগিতে কাশেম মিয়ার কিছু হইলো না। না পড়ালেখা, না কাজ-কাম। ও ওষুধের গায়ের দামটাও যদি ঠিকঠাক পড়তে পারতো, কেউ ঘরের লোক বাদ দিয়ে বাইরে কম্পাউন্ডার খোঁজে!

তখনো কাশেম মিয়া সাবিনাদের ঘরের লোক। সায়মা খাতুন নিজের নামের সম্পত্তি থেকে কিছু ধানি জমি লিখে দিয়ে পুকুরপাড়ে ঘর তুলে দিয়েছিলেন। নিজে দেখেশুনে বিয়েও দেন দূরগাঁয়ের আরেক এতিমের সঙ্গে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় হাতের তালুতে তামাক ডললেও তখন পর্যন্ত কাশেম মিয়া বাড়িতেই থাকত। বর্ষায় নিজের ধানক্ষেতের নালা কেটে অতিরিক্ত পানি সরাত, ঘাস বাছত, পুকুরে নেমে মাছ ধরত। লোকে বলত, পুকুরপাড়ে টোনাটুনির বাসা। আর সাবিনা ভাবত রূপকথার চিলকন্যার বাড়ি। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মেয়ের দুঃখে কাতর চিলমাতা ঘরবাড়ি ঝাটপাট দিয়ে হাঁড়ি-পাতিল মেজে-ঘষে ধবধবা করে রেখে যায়। তাই তো ঝকঝকে তকতকে উঠান, ঘরের পেছন, তালপাতায় ছাওয়া রান্নাঘর। আর তামা-কাঁসার ঘটিবাটি সব এমন যে, রোদ পড়ে ঠিকরায়। তাকালে এর সোনালি আভায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এসব কাজ চিলমাতা বা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের দেওয়ের পক্ষেই সম্ভব – রূপকথার কিস্সা শুনে আর নিজেদের ঘরদুয়ারের অগোছালো হালত দর্শনে সাবিনার এ-ধারণা জন্মে। এ অবশ্য ওর খুব ছোটবেলার কথা। তারপর কবে থেকে কাশেম মিয়া হঠাৎ হঠাৎ গায়েব হতে শুরু করে, সাবিনার মনে নেই। সেটা অবশ্যই সায়মা খাতুনের মৃত্যুর পর। লোকে বলত – নকল মা মরছে তো, আসল মায়ের তালাশে যায়। অবশ্য অতিসত্বর তাদের ভুল ভাঙে কাশেম মিয়ার মাথায় বাবরি চুল আর মুখে মারফতি তকরার শুনে। যদিও তখন পর্যন্ত মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ালেও কোথাও নাড়া বাঁধেনি কাশেম মিয়া।

সাবিনার এখন মনে হয় – ঠিক বয়সে খতনা হলেও কাশেম মিয়া নিজেকে হয়তো এ মজহাবের লোক ভাবত না। ভাবত, না ঘরকা, না ঘাটকা। তার পায়ের তলায় মাটি নেই, থিকথিকে শ্যাওলা, যেখানে সে না দাঁড়াতে পারে, না সাঁতরাতে পারে। মাজারের বিকল্প ছিল। মাজারের যৌথজীবন, কবরের শীতল ছায়া, মোমের আলো, আগরবাতি, ক্রন্দনরত দুঃখী মানুষ, পাগলের নৃত্য, মরমি গান, শাঁখা-পলার জোড়হাত করা নারী, টুপি পরিহিতের বিনীত তসলিম। আর গাঁজার মৌতাতে বাস্তবতা ছেড়ে চৌঠা আসমান বরাবর উড্ডয়ন তো অবশ্যই, যাতে সে আগে থেকেই আসক্ত ছিল।

কাশেম মিয়ার এ গায়েবি দশায় চিলকন্যা সাবিনাদের বাড়ির চাকরানি বনে যেত। ছেলে রতন মিয়া ফাইফরমাশ খাটত কোমরের ঘুনসি বাজিয়ে দৌড়ে দৌড়ে। আর অযথাই চড়চাপড় খেত। এ ব্যবস্থাটাই একসময় পাকা হয়ে যায়। কাশেম মিয়া কালেভদ্রে মাঝরাত্রিরে বাড়ি ফিরত এক-দুজন গুরুভাই আশেকান সঙ্গে নিয়ে। ঝোলায় মাজারের সামান্য তবারুক। পুকুরে অজু করার সময় ছাড়া আকাশের চান-সুরুযও তাদের দেখা পেত না। সায়মা খাতুন বেঁচে থাকতে একবার কদমবুচি করতে আসত শুধু, তা-ও বউয়ের পীড়াপীড়িতে। কারণ চিলকন্যার কাপড়ের তলায় বয়ে আনা সায়মা খাতুনের চুরি করা খাবারই ছিল তখন কাশেম মিয়ার দু-বেলার রিজিক। ততদিনে ধানিজমিটা আগাছায় ছেয়ে গেছে। ঘরের বেড়া ভেঙে ভেঙে পড়ে। কে সারাবে আর কার টাকায়। সংসারের রোজগার বলতে বউয়ের গতর-খাটা কামাই, যা দিয়ে মা-ছেলের ভাত-কাপড়ই জুটত না। সায়মা খাতুনের মৃত্যুর পর ঘরে খাবার আসার দুসরা রাস্তাটাও বন্ধ হয়ে যায়। সেসব দিনের এক শীতের সকালে কাশেম মিয়াকে আরেক আশেকানের সঙ্গে চুলার ধারে ঝোলা গুড় দিয়ে চা খেতে দেখেছে সাবিনা। তাদের হাতে ছিল দুটি কালো পাড়ের সাদা টিনের মগ।

‘কি য্যান শীত পড়ছে রে! হাত-পাও সর্দ অওনের জোগাড়!’ শ্যামলা হি-হি করতে করতে ড্রয়িংরুম থেকে ট্রে হাতে ফিরে আসে আর ভাব জমানো গলায় বলে, ‘আমরিকার ভাইজান কইলো – হে বেডায়ও বলে চা খাইব!’

আমেরিকার ভাইজান বলে কথা, সাবিনা ঠোঁট চেপে গোস্সা দমন করে, এখন তুরন্ত হুকুম তামিল হবে।

সাবিনাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা রান্নাঘরে ঢোকে না। ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কাচের মগের চা ছোট দুটি চিনা কাপে ভাগবাটোয়ারা করে ট্রেতে তুলে নেয়। কাজটা সে সাবিনার চোখের সামনে খোলাখুলিভাবেই করে। ট্রে-হাতে শ্যামলার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সাবিনা ভাবে, মেয়েটা একেবারে জংলি আর বেপরোয়া প্রকৃতির। ও নীহার বানুর বয়সকালে এ-বাড়িতে ঢুকলে রোজ একবার গ্রিলড হতো নির্ঘাৎ। এখন শ্যামলাকে শিক্ষাদানের কাজটা সাবিনাকেই করতে হবে, তা আগামীকাল থেকেই। r চলবে