তিনি একজন মৃত্যুঞ্জয় শহিদ

বাদল বরণ বড়ুয়া

তিনি একজন আদম-সন্তান : আশরাফুল মাখলুকাত – সৃষ্টির সেরা জীব -­ মানুষ।

তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, সুদীর্ঘকালের প্রৌঢ় শিক্ষক।

তিনি একজন নিষ্ঠাবান নাগরিক; পাকিস্তানি নাগরিক।

না, সব পরিচয় বাতিল -­তিনি একজন বাঙালি, সর্বোপরি হিন্দু (ব্রাহ্মণ হলেও) -­এই তাঁর বড় অপরাধ।

তাই তাঁকে ট্রেন থেকে নামানো হলো আরো অনেকের সঙ্গে। ঊনত্রিশ নভেম্বর। উনিশশো একাত্তর। সোমবার। দুপুর সোয়া একটা কি দেড়টা। শহরগামী দোহাজারী ট্রেন। কালুরঘাট ব্রিজের পূর্বে গোমদণ্ডীর উত্তরে কর্ণফুলীর তীরে থেমেছে। না থেমে উপায় নেই, চেকপোস্ট। বাঙালি স্বাধীনতা-সংগ্রামী ‘মুক্তি’রা যাবে
কোথায়? তাদের ছেঁকে তুলে ধরতে হবে না? নইলে যে পাকিস্তান রক্ষা হয় না। তাই সারাদেশে সড়কপথে-নৌপথে চেকপোস্টের জাল পাতা হয়েছে।

এরই মধ্যে তিনি কয়েকবার শহরে বাসে-ট্রেনে যাওয়া-আসা করেছেন। কোনো বিপত্তি ঘটেনি। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের ‘ডান্ডি কার্ড’ আছে। ভয় কী?

এমনিতেই নির্বিরোধী সহজ-সরল মানুষ। কারো সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। কেমন করে বুঝবেন স্বতঃস্ফূর্ত স্বদেশপ্রেম একদিন মারাত্মক অপরাধ হয়ে মৃত্যুপরোয়ানা নিয়ে আসবে? একাত্তরের পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতে ইয়াহিয়ার পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে যেমন নিঃশঙ্ক ছিলেন, তেমনি আজো তিনি নিঃশঙ্ক। তাই ডান্ডি কার্ড দেখার পরও যখন জিজ্ঞেস করা হলো -­ তোম্ হিন্দু হ্যায়? অকপটে স্বীকার করলেন, তিনি ‘হিন্দু’। সন্দেহভাজন যাত্রীদের কাউকে বলা হলো কলেমা পড়তে, আবার কাউকে দেখা হলো ন্যাংটো করে। সবাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। কেবল দুজন -­ তিনি আর একজন নাপিতের ছেলে সুশীল -­ এ কঠোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেন না। ওঁদের যেতে দেওয়া হলো না -­ ধুত্তোর, ধুত্তোর করে ট্রেন চলে গেল শহরপথে। শীতের দুপুর রোদ্দুর -­ কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে ঝিম মেরে আছে চোখের সম্মুখে। সম্বিতশূন্য অসহায় চোখে চেয়ে আছেন ওদিকে। হঠাৎ ডাক দিলো ষ-মার্কা এক রাজাকার -­ ‘তোরা দুজন অন্ডে যাইয়েনে ব।’ অঙ্গুলি-নির্দেশে দেখিয়ে দিলো অদূরে ব্রিজের প্রান্তবর্তী ফ্ল্যাগরুমটি।

সেখানে গিয়ে বাইরের ফাঁকা জায়গাটিতে একটি চেয়ার ও খালি টুল দেখতে পেলেন। কিছু না ভেবেই টুলে বসে পড়লেন তিনি। সুশীল ছেলেটি দাঁড়িয়ে রইল নির্বিকারভাবে। আচমকা কানের ভেতর ঢুকল এক বিতিকিচ্ছিরি গর্জন -­ ‘টুলত্ বইত কইয়ে কনে তোরে, মাডিত বয় (টুলে বসতে বলেছে কে তোকে, মাটিতে বোস্)।’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাটির মানুষ মাটিতেই বসে পড়লেন। কয়েক সেকেন্ড পরে চোখে পড়ল ভেতর থেকে প্যান্টশার্ট পরা ভদ্রগোছের এক ব্যক্তি বেরিয়ে এলেন। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন তিনি। আত্মপরিচয় দিয়ে জানাতে চাইলেন -­ তিনি একজন শিক্ষক, বোয়ালখালী থানারই কানুনগোপাড়া কলেজের ইংরেজির প্রবীণ অধ্যাপক। তিনি এখনো কলেজে চাকরি করে যাচ্ছেন, অন্য কোথাও বা ভারতে পালিয়ে যাননি। ভদ্রলোক অসমর্থতা প্রকাশ করলেন -­ আমাকে বলে কী হবে? কোনোই লাভ হবে না।

একটি বাস এসে পড়ল। তড়িঘড়ি একজন রাজাকার তাঁকে ও সুশীলকে বাসে টেনে তুলে নিজেও উঠল। পশ্চিম কূলে গিয়ে নামানো হলো। তারপর সড়কের উত্তর পাশে নিচে লাল ইটের তৈরি তিন-চারটি ছোট ছোট কামরার ঘরের সামনে নিয়ে দাঁড় করানো হলো। একটি কামরায় -­ সম্ভবত রাজাকারদের কর্তা -­ একজন বিহারি খাওয়ায় ব্যস্ত। তাঁকে লক্ষ করে রাজাকারটি বলল, দুজন হিন্দুকে নিয়ে এসেছি -­ উত্তর এলো, বন্ধ করো। তখন পাশের দ্বিতীয় কামরায় নিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকেই প্রথমে নজরে পড়ল ছোট জানালার পাশে বসে এক যুবক করুণ চেহারা নিয়ে বাইরে অপলক চেয়ে আছে। আগন্তুককে দেখেই বলে উঠল -­ আরে, মেসোমশাই যে। চিনতে কষ্ট হলো না -­ চক্রশালায় দ্বিতীয় মেয়ের বিয়েতে দেখেছিলেন। জামাইয়ের আত্মীয়।

তিনটার দিকে কর্তার নির্দেশে এক রাজাকার এসে বেল্ট দিয়ে ওই দুজনকে এলোপাতাড়ি খুব মারল। মারতে মারতে রাজাকারটি হাঁপিয়ে উঠল। মনে হলো এবার তাঁর পালা -­ তবে একটু ইতস্তত ভাব লক্ষ করলেন। এ-সুযোগে তিনি আবেদন রাখলেন -­ আমি তো বুড়ো মানুষ, মার সহ্য করতে পারব না। একেবারে গুলি মেরে মেরে ফেলো। এ-কথা বলে পাঞ্জাবির বোতাম খুলে বুক পেতে দিলেন। আবেদনে কাজ হলো। রাজাকারটি অভয় দিলো -­ না, তোঁয়ারে ন মাইজ্জম (না, তোমাকে মারব না)।

রাতে ওঁদের খেতে দেওয়া হলো। গোশতের সামান্য ঝোল দিয়ে দুমুঠো ভাত।

দুঃসহ বন্দিজীবন শুরু হলো এভাবে। পূর্বের যুবকটিসহ ওঁরা এখন তিনজন।

বিনিদ্র রাত কেটে গেল যেন তাড়াতাড়ি। ছায়াছবির মতো কত কথা মনের ওপর দিয়ে ছায়া ফেলে যায়।

পঁচিশে মার্চ থেকে সাধারণভাবে মুক্তিকামী বাঙালিদের জন্য বিপজ্জনক দিন শুরু হলো। কিন্তু পাকিস্তানি শোষকচক্র বাঙালির স্বাধীনতাস্পৃহাকে ভারতের মদদপুষ্ট ঘোষণা করে এবং হিন্দুদের ঢালাওভাবে ভারতের চর আখ্যা দিয়ে বিশেষভাবে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালাও-পোড়াও এবং হিন্দু-নিধন নীতি গ্রহণ করল। তাই স্বভাবতই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতের পথে ছুটল বিপদগ্রস্ত লাখো মানুষ। সহকর্মী হিন্দু অধ্যাপকরা আগেই চলে গিয়েছিলেন। আত্মীয়স্বজনের অনেকেই চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীরের সঙ্গে কলেজেই রয়ে গেলেন তিনি। উভয়ের বিশ্বাস -­ মেরে ফেলার মতো কোনো কাজ কখনো তাঁরা করেননি। তাই নিজের দেশ ছেড়ে পালাবেন কেন? কিন্তু হায়! এ সরল বিশ্বাসের চরম মূল্য দিলেন অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর। জুলাইয়ের একত্রিশ তারিখ ভোরবেলায় তাঁর বিছানাতেই আধশোয়া অবস্থায় নৃশংসভাবে নিহত হলেন তিনি।

তবু রাজাকার ক্যাম্পে বর্তমান বন্দি আরেক সরল মানুষের বিশ্বাস বিচলিত হয়নি তখনো। নতুন ব্যবস্থায় নতুন অধ্যক্ষ মাওলানা মীর মোহাম্মদ ইব্রাহিমের অধীনে মাঝেমধ্যে কলেজে গিয়ে হাজিরা দিচ্ছেন। ছাত্রছাত্রী নেই। ফাঁকা কলেজ। তবু আরো অনেকের সঙ্গে তিনি হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। মে মাস পর্যন্ত বেতন পেয়েছেন। তারপর থেকে বেতন বন্ধ। ইয়াহিয়ার ঘোষণাবলে হিন্দুদের বেতন প্রদান নিষিদ্ধ। কলেজের অফিসের কাজকর্ম শহর থেকেই চালানো হতো। তিনি তাই শহরে আসা-যাওয়ার জন্য তাঁর এক প্রাক্তন বৌদ্ধছাত্রের সহায়তায় শহরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের দেওয়া পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে ধরনা দেন বেতনের জন্য। তাঁর পরিবারের অনেকেই বৈলতলীতে এক বৌদ্ধপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি নিজের জন্মপলিস্ন সাতকানিয়ার নলুয়া, বৈলতলী বা শহরে ঘুরে-ঘুরে দিন কাটিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এভাবে আর কদিন চলবে? একদিন সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে কোর্টে গেলেন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে বেতনপ্রাপ্তির জন্য বিশেষ অনুমতি নিতে। বিরাট পরিবারের ভরণ-পোষণে অসমর্থ হয়ে পড়েছেন। কাকুতি-মিনতি করাতে অধ্যক্ষ মাওলানা মীর মোহাম্মদ ইব্রাহিম আবেদনপত্রে লিখে দিয়েছিলেন, ‘হি ইজ দি অনলি হিন্দু টিচার অ্যাটেন্ডিং দি কলেজ।’ কোর্টে সেদিন অধ্যাপক আমীর হোসেন চৌধুরী ও অধ্যক্ষ স্বয়ং কী কাজে গিয়েছিলেন। তাঁরা অতিসহজেই জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে কাজ সেরে চলে গেলেন। কিন্তু ঘণ্টাদুয়েক বাইরে দাঁড়িয়েও তিনি জেলা প্রশাসকের নাগাল পান না। তাঁর পেছনে ছিল এক চাকমা। তাকে ডেকে নিলেন জেলা প্রশাসক। আন্তরিক ব্যবহারে তিনিও আশান্বিত হলেন। কিন্তু হায়! তাঁর সময় আসতেই দেখা গেল উলটো ব্যবহার। বিরক্ত হয়ে শুধু বললেনল -­ রেখে যান, রেখে যান, পরে দেখা যাবে। তিনি ভেবে অবাক হলেন, তিনি কী জন্য গেলেন জেলা প্রশাসক তা জানার গরজও বোধ করলেন না। নাকি তাঁর পরিচয় ও উদ্দেশ্য আগেই তিনি জেনে ফেলেছেন? তবু তিনি দীর্ঘ আরো একটি ঘণ্টা অপেক্ষমাণ থাকলেন। ডাক আর আসে না। পিয়ন লক্ষ করে বলল, সাহেব তো চলে গেছেন। হতাশ হয়ে ব্যর্থতার গস্নানি নিয়ে ফিরে আসতে হলো সেদিন।

কিছুদিন পর কলেজ রমজানের বন্ধ হলো -­ বন্ধে বাড়ি গেলেন পরিবার-পরিজনের ভালোমন্দের খবর নিতে।

ঊনত্রিশে নভেম্বর সোমবার কলেজ খোলার দিন। নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নিলেন। ধুতি আগেই বিসর্জন দিয়েছেন। পকেট হাতড়ে দেখলেন­ -­ ডান্ডি কার্ডটা ঠিক আছে। দোহাজারী থেকে ট্রেনে চেপে বেঙ্গুরা স্টেশনে নামলেন। কলেজের খবর নিতে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র বর্তমান সহকর্মী অধ্যাপক মমতাজের বাড়ি গেলেন। মমতাজ নেই -­ শহরে। ছোট ভাই -­ সেও বর্তমান ছাত্র -­ স্যারকে দেখে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাল। ভালো করে খাইয়ে দিলো। তারপর একটার দিকে ট্রেনে তুলে দিলো। কালুরঘাট ব্রিজের পূর্বপ্রামেত্ম এসে কলেজ খোলার দিন ঘটল এখনকার এই বিপত্তি। তিনি কিছুতেই ভেবে পান না কী তাঁর দোষ। তাকে বন্দি করে কিংবা মেরে ফেলে কার কী লাভ?

দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার সকাল দশটা-এগারোটায় আরো তিন যুবককে ধরে নিয়ে এসে একই কামরায় বন্দি করে লাখল।

তৃতীয় দিন বিকেল পাঁচটার দিকে একই পরিবারের তিনজনকে কোত্থেকে ধরে আনল। তিনজনের দুজন প্রবীণ, একজন যুবক। শেষ পর্যন্ত বন্দির সংখ্যা দাঁড়াল নয়জন।

স্বল্প সময়ের ভেতরেই ওঁদের মধ্যে একটা সৌহার্দ্য-সখ্য গড়ে উঠল। পরস্পর পরস্পরকে কাকা-মামা-মেসো-ভাগিনা ইত্যাদি সম্বোধনসূত্রে আবদ্ধ হলেন তাঁরা। প্রবীণতম হিসেবে মর্যাদার ভাগ পেতেন তিনিই বেশি। মানবদরদি চসারের দ্য ক্যান্টারবেরি টেলসের কথা মনে পড়ে যায়। এঁরা সংখ্যায় নয়জন। আর চসারের তীর্থযাত্রীর সংখ্যা ছিল ঊনত্রিশজন। মনে মনে ভাবেন, আমরা কোন তীর্থযাত্রী?

এরই মধ্যে রাজাকারদের লিডারকে চিনে ফেলল ওই দুই প্রবীণের একজন -­ রাজাকারটি হলো দোহাজারীর হাশেমবলী। প্রবীণ অধ্যাপক হিসেবে আত্মপরিচয় দিলেন তিনি হাশেমবলীর কাছে। কারণ তাঁর শ্বশুরবাড়িও দোহাজারীতে এবং শ্বশুরবাড়ির অনেককে চেনে হাশেমবলী। তাই তিনি হাশেমের সহানুভূতি পেলেন। এই হাশেমবলী বল ওড়াতে এলো নিরীহ বন্দিদের ওপর, বেদম মার চালাল -­ তোরা মুক্তিবাহিনী, ভারতের দালাল ইত্যাদি বলে অশ্রাব্য গালমন্দও চালাল সঙ্গে সঙ্গে। হাত তুলল না কিন্তু প্রবীণ অধ্যাপকের ওপর।

চতুর্থ দিন বৃহস্পতিবার সকালে চা-নাশতা দিলো -­ তাঁকে দিলো পুরো রুটি ও চা, ওঁদের অর্ধেক করে। হাশেম রাজাকারের মুখেই এদিন জানা গেল স্বয়ং ফজলুল কাদের চৌধুরী আসবেন তাঁকে দেখতে। তখন তাঁকে ছেড়ে দিতে সুপারিশ করা হবে। মানসিকভাবে তিনি প্রস্ত্ততই ছিলেন। কিন্তু ওইদিন বিকেলে এলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী নয়, একজন পাকিস্তানি (পাঞ্জাবি) সৈন্য-যুবক, সুন্দর-বলিষ্ঠ চেহারার অধিকারী।

হাশেমবলী তাকে কী বলল কানে কানে এদিকে নির্দেশ করে। সৈন্যটি বলল -­ প্রফেসর আও, তুম্ আজ খতম হো জায়েগা, তুম্ রামনাম করতা হুঁ। তুমকো আজ ইন্ডিয়া মে ভেজ দেনা হোগা। হাম শোনা হায়, তুম্ মুক্তি কো ট্রেনিং দেতা হায়। সৈন্যটির উগ্রমূর্তিতেও ভয় পেলেন না তিনি। তাকে সত্য কথাটি বুঝিয়ে দিলেন তিনি -­ অ্যাই অ্যাম অ্যা প্রফেসর অব ইংলিশ ফর লং টুয়েন্টি থ্রি ইয়ারস -­ অ্যাই অ্যাম লয়েল টু দি গভর্নমেন্ট। আরো জানালেন -­ আমার পরিবারে কেউই ইন্ডিয়ায় নেই। না, মন গলল না। হ্যাঁ-না কিছুই না বলে দৃপ্তভঙ্গিতে চলে গেল সৈন্যটি।

পঞ্চম দিন শুক্রবার সকালে আরো তিন যুবককে ধরে আনা হলো। ওরা পাকিস্তানভক্ত মুসলমান বলে দাবি করল। কলেমা পড়ল। এমনকি কাপড় উলটে মুসলমানিত্বের প্রমাণও দিলো। তবেই ছাড়া পেল।

কিছুক্ষণ পর আরো তিনজন রাজাকারসহ হাশেমবলী এলো -­ সবাইকে অন্যত্র নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাই সবার নাম-ঠিকানা নিল। যার যা কিছু আছে দিয়ে দিতে বলা হলো। তিনি মুক্তি পেতে যাচ্ছেন -­ এ-আনন্দে ঘড়ি, কলম, চশমা ও পাঁচটি টাকা এবং কিছু খুচরো পয়সা দিয়ে দিলেন। দয়াপরবশ হয়ে ওরা কলম ও চশমা ফেরত দিলো। বিড়ি-সিগারেট খাবার জন্য খুচরো পয়সাগুলোও ফেরত দিলো।

দুপুরে ভাত দিলো আলুসহ গোশতের ঝোল দিয়ে। সন্ধ্যায় রুটিসহ টিফিন দিলো। অন্যদিনের চেয়ে রাতের আহারও তাড়াতাড়ি দিলো। বাইরের দিক থেকে দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে চলে গেল। ব্যতিক্রমী ব্যবহারে মনের মধ্যে সন্দেহ ঢুকে গেল। তবে কি আজ শেষ দিন? পায়খানায় গেলেও যারা চৌকি দিয়ে রাখে তাদের মনে এত মায়া কেন?

সেদিন অস্বাভাবিকভাবে হিন্দুরীতি অনুযায়ী মনে মনে ভগবানের কাছে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করলেন। ঠাকুরের নাম নিলেন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিথর হয়ে পড়ে রইলেন। জীবনের সব কথা হুড়োহুড়ি করে মনের ভেতর একবার ভিড় করতে চাইল। তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা-আত্মীয়স্বজন কেউ জানে না তিনি এখন কোথায়। চকিতে একবার ফেলে আসা জীবনের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন মনে মনে। এ-মানুষটির জন্ম উনিশশো বিশ সালে। কাঞ্চনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেট উনিশশো ঊনচলিস্নশে; কানুনগোপাড়া কলেজ থেকে আই.এ. উনিশশো একচলিস্নশ সালে; ইংরেজিতে এম.এ. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উনিশশো পঁয়তালিস্নশে। কর্মজীবনের শুরু বরিশাল এ. কে. ফললুল হক কলেজে। বাঁশখালী চাম্বল উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক -­ উনিশশো সাতচলিস্নশ-আটচলিস্নশ; জ্যোৎস্না রায় প্রথম প্রধান শিক্ষক -­ পশ্চিমগাঁও কলেজ -­ উনিশশো ঊনপঞ্চাশ থেকে উনিশশো বায়ান্ন; চৌমুহনী কলেজ উনিশশো তিপ্পান্ন, আর কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে এসেছিলেন উনিশশো চুয়ান্নর বাইশে মার্চ। শেষ কর্মস্থল। মনে হচ্ছে ওই তো সেদিন।

কয়েক সেকেন্ডের ভেতর কর্মজীবনের ছায়াছবি মনের ওপর দিয়ে চলে গেল। এটাই কি শেষ হিসাব-নিকাশ? আশ্চর্য! অন্ধকার ঘরের অন্য বাসিন্দারা বিড়ির জন্য বচসা করছে। ওদের উদ্দেশে বললেন -­ আজ একটু ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। দুবার টিফিন দিলো, সকাল সকাল ভাত দিলো। আজ বোধহয় মেরে ফেলবে। তোমরা অযথা বিড়ির জন্য ঝগড়া করছো? একজন যুবক স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল -­ আপনি তো বিড়ি-সিগারেট খান না, বিড়ি-সিগারেটের মজা আপনি কী বুঝবেন? এর পাঁচ-সাত মিনিট পরই খুট করে আলো জ্বলে উঠল। মনে হলো বিপদসংকেত। দরজা খুলেই প্রথম ডাক পড়ল প্রফেসরের। তখন রাত নটা কি সাড়ে নটা। তিনি নিত্যসঙ্গী চাদরখানি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কে একজন ঢুকে টেনে বাইরে এনে দাঁড় করিয়ে রাখল। হাশেমবলী চশমা ঠিক করে চোখে বসিয়ে দিলো। কলমটা ঠিক করে পকেটে গুঁজে দিলো। গায়ের চাদর খুলে নিয়ে চমশার ওপর দিয়েই শক্ত করে চোখ বেঁধে দিলো। পিছমোড়া করে হাত দুটো বেঁধে দিলো দড়ি দিয়ে। রাজাকারের লিডার হাশেমবলী আরেক রাজাকারকে হুকুম দিলো -­ চায়নিজ রাইফেলটি নাও। সে ছিল চাকমা। এই প্রথম মনে সত্যি ভয় ঢুকল। ‘সভয় হইল আজি ভয়শূন্য হিয়া’ -­ মেঘনাদবধ কাব্যের এই বিখ্যাত উক্তিটির মর্মবাণী যেন উপলব্ধি করতে পারলেন। সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। পা কাঁপছে ঠকঠক করে। শ্রদ্ধেয় মা-বাবার নাম স্মরণ করতে চাইলেন -­  তাও মনে এলো না। তখন বিপরীত চিন্তায় ভয় তাড়াতে চাইলেন, দেশের জন্য অনেকে প্রাণ দিয়েছে। এখানেও নিশ্চয়ই অনেকে প্রাণ দিয়েছে। তাঁরা সবাই আমার ছেলের সমান বয়সী। আমার তো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। দেশের জন্য প্রাণ দিতে ভয় কেন? এই চিন্তার ফলে একটু সাহস সঞ্চার হলো। কে একজন হাত ধরে টেনে নিয়ে কিছুদূরে সম্ভবত কর্ণফুলীর তীরে গিয়ে বলল, ‘ঠেরো’। বুঝলেন এবার গুলি চলবে। তাঁর পকেটে তিন হাজার একশ টাকার একটি ডিপোজিট রিসিট ছিল। কাতরস্বরে বললেন, একটি কথা ছিল। কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। চোখ বাঁধা। সম্মুখে শুধু অতল অন্ধকার। ইচ্ছে ছিল -­ হাশেমবলীর হাতে রিসিটটা দেবেন। তাঁর বাড়ির বা শ্বশুরবাড়ির কাউকে পেলে পৌঁছে দেবে। কিন্তু না, কেউ কোনো কথা বলে না। পরক্ষণে ভাবলেন -­ চিরবিদায় নিচ্ছি এ-পৃথিবী থেকে, টাকার কথা মনে আসে কেন? নীরবে সাহসের সঙ্গে গুলির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। মুহূর্ত যেন অনন্ত হয়ে গেছে। গুলি এসে লাগে না বুকে। কে একজন হঠাৎ হাত ধরে যেন নদীর জলে ফেলে দিলো। কিন্তু মনে হলো জলে না পড়ে মাথাটা পড়ল কাদায় -­ পা দুটো পড়ল জলে। পিছমোড়া অবস্থায় একটু কাত হয়ে উপুড় হয়েই পড়েছিলেন। বড় বড় তিনটা পাথর পরপর ছুড়ে মারা হলো -­ হাতের দিকে দুটো, মাথার দিকে একটা। পাথর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মাথায় লাগল না। কিন্তু পেছনদিকে দড়িবাঁধা হাতের ওপর পাথর দুটো যেন দশমণী বোঝার মতো গিয়ে পড়েছিল -­ মনে হলো হাত দুটো মট করে ভেঙে গেছে। তবু কাতর উক্তি মুখ দিয়ে বেরোল না। পাথর মারার সঙ্গে সঙ্গে হিসাব করে তিনটি গুলিও মারল। প্রথম গুলি বাঁ ঊরু ভেদ করে বেরিয়ে গেল। দ্বিতীয় গুলি ডান হাতের বুড়ো আঙুল ও অনামিকার মধ্যখানটা ভেদ করে চার আঙুলের গোড়া ভেঙে মণিবন্ধের গেরোর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তৃতীয় গুলি ডান বুকের ভেতর দিয়ে ফুসফুসের চুল পরিমাণ ওপর দিয়ে বগলের তলদেশ ভেদ করে বেরিয়ে গেল। মনে হলো একটি চলন্ত জ্বলন্ত অঙ্গার বুক ছিদ্র করে দিয়ে গেল। আশ্চর্য! উঃ আঃ কোনো আওয়াজ দিয়ে যন্ত্রণার বহির্প্রকাশ হতে দিলেন না। মনের মধ্যে তখন আঠারো আনা হুঁশ। আরো অদ্ভুত মেঘনাদবধ কাব্যের কয়েকটি পঙ্ক্তি ঝিলিক দিয়ে ওঠে মনে :

জননী যেমনি খেদান মশকবৃন্দে

সুপ্ত শিশু হতে করপদ্ম সঞ্চালনে…

তেমনি করে গুলি তিনটি কে যেন করপদ্ম সঞ্চালনে খেদিয়ে দিলো। মারাত্মক হয়ে শরীরে ঢুকল না একটিও।

একটি চাপা ও গোপন আনন্দে চুপটি করে পড়ে রইলেন। হুঁশ ছিল, সাহস ছিল; সর্বোপরি ছিল বাঁচার অদম্য বাসনা। সব মিলিয়ে শরীরে সঞ্চারিত যেন এক অফুরন্ত শক্তি। কানে আরো অনেক গুলির আওয়াজ শুনতে পেলেন, সঙ্গে সঙ্গে মর্মভেদী আর্তচিৎকারও -­ বুঝতে অসুবিধে হলো না তাঁর এ-কদিনের জীবন-মরণের সাথি বাকি কয়েকজনকেও গুলি মেরে মেরে খতম করে দেওয়া হয়েছে। তিনি তো বেঁচে গেলেন। আঃ, কী তৃপ্তি। পিছমোড়া বাঁধা, চোখ বাঁধা, একটু কাত হয়ে উপুড় হয়ে আছেন কাদাজলে। তবু চোখে পরিষ্কার দেখতে পেলেন ধবধবে আলোয় তাঁর বাড়িঘর-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা -­ কতদিন তিনি বাড়ি যেতে পারেননি। এবার তো যেতে পারবেন। এবার তো তিনি মুক্ত -­ টনটনে জ্ঞান আছে তখনো। পরদিন শনিবার। দোহাজারী বাজার থেকে একটি তাজা ইলিশ কিনে নেবেন। আরো নেবেন নাবিস্কো বিস্কুট। সবাই তাঁর জন্য চিন্তিত। শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া চালাতেও ভয় লাগছে তখন। নিথর হয়ে রইলেন আরো প্রায় ঘণ্টাখানেক। সেদিন ছিল পূর্ণ পূর্ণিমা। প্রবল জোয়ার নদীতে। দেখতে দেখতে পা ছাপিয়ে সমস্ত শরীর গ্রাস করে ফেলছে কর্ণফুলীর ছলছল জল। বোধহয় আর বাড়ি যাওয়া হলো না। হাত বাঁধা, চোখ বাঁধা -­ শরীর এক্ষুনি স্রোতের টানে ভেসে যাবে। না, তা হয় না। বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। কোনো সাড়াশব্দ নেই কোথাও। মনে হয় ওরা ধারেকাছে নেই। ক্যাম্পেই চলে গেছে হয়তো। বহু কষ্ট করে উঠে উবু হয়ে বসলেন কাদার ওপরই। কপাল কুঁচকে কুঁচকে অনেক চেষ্টা করলেন চাদরের বাঁধন খুলতে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। তারপর দু-হাঁটুর ওপর মাথা নিচু করে চোখবাঁধা চাদর ঘষতে লাগলেন। ঘষতে ঘষতে হঠাৎ করে চাদরের বাঁধন খুলে গেল। মাথা ঝাড়া দিয়ে চাদর ফেলে দিলেন নিচে। চশমা কিন্তু ঠিক এঁটে রইল চোখে। পিছমোড়া হাতের বাঁধনও খোলার জন্য আঙুল দিয়ে চেষ্টা করলেন। হাতে অসহ্য ব্যথা। শুকনো মাটিতে ঘষে দেখলেন। ব্যথার জন্য হাত নাড়ানো যায় না। বিস্ফারিত চোখ মেলে দেখলেন। পূর্ণ জ্যোৎস্নায় ভরা পৃথিবী মরণ-অন্ধকার থেকে যেন উঠে এলেন আলোর পৃথিবীতে। আকাশ দেখে অনুমান করলেন -­  রাত বারোটা সাড়ে বারোটা হবে। জলকাদা থেকে ডাঙায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাশে দেখতে পেলেন নাপিতের ছেলে সুশীলের মৃতদেহ পড়ে আছে। চোখের উজ্জ্বল চাহনি তখনো নিষ্প্রভ হয়ে যায়নি। কী করুণ সে-মুখ! আরো কয়েকজনের মৃতদেহ এখানে-ওখানে। কিন্তু দেখার সময় কই? আবার যদি রাজাকারের খপ্পরে পড়ে যান! ক্যাম্প থেকে দূরে সরে যেতে হবে। কর্ণফুলীর তীর বরাবর উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। কনকনে শীতের রাত। শীত মালুম হয় না তেমন। বাঁচার উদগ্র তাগিদে অদ্ভুত সাহস নিয়ে অবিরাম হাঁটতে লাগলেন। কোনোদিকে ভ্রম্নক্ষেপ নেই। মাইলতিনেক হাঁটার পর সামনে পড়ল ছোট্ট একটি বাজার। একটি ছোট দোকানে মিটমিট আলো জ্বলছে। একজন বৃদ্ধের কাশি শুনে কাতরকণ্ঠে তাকে বাবা সম্বোধন করে সবিস্তারে সব ঘটনা বললেন। বৃদ্ধ দোকানদার ঝাঁপি খুললেন না। বিছানা থেকেও উঠলেন না। তবে কণ্ঠে সহানুভূতি মিশিয়ে বললেন -­ এখানে রাজাকারের খুব ভয়। সামনে কিছুদূর গেলে জেলেপাড়া পাবে -­ ওখানে কোনো ভয় নেই। আস্তে আস্তে হেঁটে জেলেপাড়ার দিকে গেলেন। শরীর অবসন্ন, নিস্তেজ হয়ে আসছে। কাদামাখা শরীর থেকে রক্ত ঝরছে অজস্র। বুক-হাত-পা সবখানে ব্যথা টনটন করছে। দেখতে পেলেন একটি ঘরে আলো জ্বলছে। অদৃশ্য গৃহকর্তাকে লক্ষ করে বারকয়েক ডাকলেন -­  বাবা! বাবা! কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। অনেক ডাকাডাকির পর একজন লোকের সাড়া মিলল -­ কে? তখন তিনি বর্তমান ঘটনার কথা না বলে আত্মপরিচয় দিলেন এভাবে কণ্ঠে কাতরতা মিশিয়ে -­ দেখুন, আমি কানুনগোপাড়া কলেজের মাস্টার। শহরে যাচ্ছিলাম, পথ ভুলে এখানে এসে পড়েছি। রাস্তাটা দেখিয়ে দিন আর একটু পানি খাওয়ান। এভাবে বারকয়েক কাতরকণ্ঠে ডাকা হলো। তবু আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ ঘটাং করে দরজা খুলে গৃহকর্তা বেরিয়ে এলো। বিরক্তিভরা উগ্রমূর্তিতে লক্ষ করে দেখল -­ রক্তাক্ত এক আগন্তুক। সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, কিছুক্ষণ আগেই গুলির শব্দ শুনেছি। নিশ্চয়ই তোকে রাজাকারে গুলি করেছে। যা, যা, এখান থেকে চলে যা। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন -­ না, ডাকাতে ধরেছে আমাকে। পেছনদিকে হাত দুটো বেঁধে দিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে।
কোনোরকমে পালিয়ে এসেছি। গুলি করেছিল বটে, বেঁচে গেছি। হাত দুটো খুলে দাও না একটু! করুণা হলো গৃহস্বামীর। একটি ভোঁতা দা এনে বাঁধন কাটার কসরত করতে লাগল। যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলেন তিনি। একসময় বাঁধন কাটা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো শরীরের জমাটবাঁধা সমস্ত রক্ত ওখানেই ঝরে পড়ে গেল। খুবই দুর্বল বোধ করলেন। বলের পাম্প ছেড়ে দিলে বল যেরকম চুপসে যায়, তাঁর শরীরের অবস্থাও সেরকম হলো। গলা ও জিহবা শুকিয়ে কাঠ। একটু জল খেতে চাই, জল। একটি বাটিতে সামান্য একটু জল ছিল। তাই খেতে দেওয়া হলো তাঁকে। রাজ্যের ক্লান্তি এসে তাঁকে ঘিরে ধরেছে। এবার একটু আশ্রয় চাই, একটু বিশ্রাম চাই। না, তা দেওয়া যায় না। যাও যাও, এখান থেকে যাও। রাজাকার এসে পড়বে। ওইদিকে একটু দূরে একটা ছড়া পাবে, এরপরই কদুরখিল। কদুরখিল! বড় মধুর পরিচিত নাম। তাহলে তো কানুনগোপাড়া বেশি দূরে নয়। কোনোরকমে কি কলেজে পৌঁছে যেতে পারি? আনন্দ ও সাহসের সঞ্চার হলো মনে। যন্ত্রচালিতের মতো হাঁটতে শুরু করলেন নিরুদ্দিষ্ট ছড়ার দিকে। হ্যাঁ, কিছুক্ষণ পর একটি ছড়া পাওয়া গেল। হাঁটু-পরিমাণ কাদা ডিঙিয়ে অপর তীরে উঠতে চেষ্টা করলেন। খুব কষ্টে উঠলেন। কাদাভর্তি পাজামাটা পায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। তা টেনে ধরার বা বহন করার শক্তি নেই শরীরে। বাঁ-হাতে খুলে ফেলে দিয়ে শরীরকে ভারমুক্ত করলেন। কিন্তু এখন যাবেন কোনদিকে? কোথায় সেই কদুরখিল? জনবসতির কোনো চিহ্ন নেই। ফিরে এলেন আবার ওই জেলের বাড়িতে, কাতরস্বরে গৃহকর্তাকে ডাকতে লাগলেন -­ বাবা! বাবা! ভেতরে আধবোজা ল্যাম্পের আলো। দরজার একটি ছিদ্র দিয়ে দেখলেন -­ গৃহকর্তা ও কর্ত্রী ফিসফিস করে কী বলাবলি করছে। এরপর ঝট করে উঠে একটা দা নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। ভয় দেখাল -­ এখান থেকে যাবি কিনা বল! নইলে কেটে দু-টুকরো করে ফেলব। তিনিও তখন রাগের মাথায় উত্তেজিত হয়ে বললেন -­ দেখ্, আমি গুলি খেয়ে এসেছি -­ গুলি খাওয়া মানুষ। তোর ওই খেজুরগাছ-কাটা দাকে আমি ভয় করি না। আর দাঁড়ালেন না। ফিরে গেলেন সেই প্রথম বুড়োর দোকানে। ততক্ষণে শরীর অবশ হয়ে আসছে। তবু ক্ষীণকণ্ঠে ঘুমন্ত বুড়ো দোকানদারকে ডাকলেন -­ বাবা! বাবা! ওঠো একটু। আমি মরে যাব। আমাকে একটু পানি খাওয়াও, ছোয়াব হবে। হাত আমি খুলে এসেছি, পারলে একটা ছেঁড়া লুঙ্গি দাও। আমি বুড়ো মানুষ। ন্যাংটা হয়ে আছি। বুড়ো দোকানদার অবিলম্বে উঠে ল্যাম্প জ্বালাল। বদনা করে পানি ও গস্নাস নিয়ে এলো। পিরিচভর্তি বিস্কুট দিলো। মনে হলো, ওটা চায়ের ঝুপড়ি বা দোকান। তিনি বাঁ হাতে বিস্কুট ও পানি খেলেন। বুড়ো বলল, লুঙ্গি নেই বাবা। একটা চটের ছালা আছে, নিতে পারো। কনকনে শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি সেটা গায়ে জড়িয়ে নিলেন। আশ্রয় চাইলে বুড়ো দোকানদার অদূরে জেলেদের মাছ ধরার একটি শেড দেখিয়ে দিলো। অগত্যা সেখানে গিয়ে বাঁশের মাচায় শীতের কাঁপন নিয়েই নিঃসাড় পড়ে রইলেন। ছালা দিয়ে কি শীত নিবারণ হয়? কিছুক্ষণ পরে বুঝলেন সমস্ত শরীরে টনটনে ব্যথা, সে-সঙ্গে তীব্র জ্বর। একটা ঘোরের মধ্যে যেন কেটে যাচ্ছে সময়। অনন্ত সময়। অনন্ত অন্ধকার। মৃত্যুর এক সীমাহীন জগতের উপামেত্ম যেন তিনি অবস্থান নিয়েছেন। প্রাণের অসিত্মত্ব ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। একসময় ফজরের নামাজের আজান ভেসে এলো। মনে হলো তড়িৎ শিহরণ লাগল শরীরে -­ তা হলে তো বেঁচে আছি! ওই তো ছায়ামূর্তির মতো একজন লোক অজুর পানি নেওয়ার জন্য আসছে। তাকে দুর্বল হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। শহরগামী একটি নৌকায় তুলে দেওয়ার জন্য ক্ষীণকণ্ঠে অনুরোধ করলেন। কিন্তু লোকটি কোনো ভ্রুক্ষেপ করল না…

পুব আকাশে সোনালি সূর্য উঁকি দিচ্ছে। জীবনের বার্তাবহ হয়ে উষ্ণ রশ্মি ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। আহ্! কী সুন্দর পৃথিবী! কর্ণফুলীর কলনাদ এসে লাগছে কানে। কান পেতে দিলেন সেদিকে। হঠাৎ দেখলেন এক মধ্যবয়সী লোক তিন-চারজন কিশোর বালককে নিয়ে তাঁর কাছে আসছে। কয়েক সেকেন্ড নিরীক্ষণ করে বললেন -­ ওরে দেখ্ দেখ্, ইনি বেঁচে আছেন, বাঁচবেন। বলেই তাঁকে তোলার জন্য গায়ে হাত দিয়ে ধরলেন, বালকদেরও ধরতে বললেন। তিনিও আনন্দের সঙ্গে বললেন -­ হ্যাঁ ভাই, আমি বাঁচব। আমার বাঁচার দরকার। মধ্যবয়স্ক লোকটি বললেন, ওঠো। তিনি বললেন, ওঠার শক্তি থাকলে তোমাকে পিঠে নিয়ে কর্ণফুলী পার হয়ে শঙ্খের ধারে নিয়ে যেতাম। সারারাত হেঁটেছি -­ এখন তো আমার গায়ে কোনো শক্তি নেই। হঠাৎ মনে হলো -­ ওই পরোপকারী বুড়ো দোকানদারের মুখে হয়তো সবকিছু শুনে ওরা এসেছে। তখন সকাল আটটা। ধরাধরি করে তাঁকে আবার ওই জেলেবাড়ির কাছেই এনে রাখা হলো। পৃথিবী প্রকম্পিত করে আকস্মিক আওয়াজ শোনা গেল -­ গুম-গুম-বুম। বম্বিংয়ের শব্দ। পশ্চিম আকাশের দিকে। আকাশে ঘন ধোঁয়ার মেঘের কু-লী পাকিয়ে উঠেছে। মেঘের ভেতর থেকেই শোনা যাচ্ছে পেস্ননের শব্দ। ওই মধ্যবয়স্ক লোকটি জেলেকে আগুন আনতে বলল। তখন ওই জেলেবাড়ির এক বিধবার মন্তব্য শোনা গেল -­ আঁর চাচায় মরা ইবাতো আবার লই আইসসে (আমার চাচা মড়া এটাকে আবার নিয়ে এসেছে)। জেলেবাড়ি থেকে আগুন এনে কেউ কেউ তাঁকে উত্তাপ দিতে লাগল। কনকনে ঠান্ডায় সবল মানুষও জমে যাওয়ার জোগাড়। ইতোমধ্যে আরো কিছু ছেলে-বুড়ো জড়ো হয়ে গেছে। কয়েকজন দয়ালু ছেলে কোত্থেকে চা ও হালুয়া এনে নিজেদের হাতে পরম যত্নে খাওয়াল। ঘন ঘন কানফাটা বম্বিংয়ে অনেকে আবার ভয়ে চলে গেল। তিনি কিঞ্চিৎ সবল বোধ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন -­ বোম মারছে কারা? একটি ছেলে রুক্ষকণ্ঠে বলে উঠল -­ এই বোমা যারা মারার তারাই মারছে। লোকালয়ের ভেতর এই বুড়ো মড়া আপদবিশেষ। তাই বাকি ছেলেরা আধমরা বুড়োকে ধরাধরি করে লোকালয়ের একেবারে বাইরে নদীর জলের কাছে নিয়ে রেখে দিলো। কৌতূহলী ছেলেদের কেউ কেউ পকেট হাতড়িয়ে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে নিয়ে দেখতে লাগল। একজন বলল -­ বাহ্, বেশ সুন্দর চেহারা তো। আর একজন বলল -­ আরে, তিনি তো কানুনগোপাড়া কলেজের ইংরেজির প্রফেসর মণীন্দ্রলাল ভট্টাচার্য। অন্য একজন বলল -­ এমন লোককেও মারতে আছে! সব শুনে একরকম কৌতূহল বোধ করলেন তিনি। মনে মনে কামনা করলেন -­ এ-প্রজন্মের এমন ছেলেরাই আগামীর কর্ণধার হোক। ওরা আরো এককাপ খালি চা এনে খাওয়াল। তিনি তৃপ্তিভরে বললেন, বাবারা আমাকে গরম পানি এনে খাওয়াও। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা গরম পানি এনে দিলো। এর মধ্যে মৌলবিগোছের এক যুবক এসে ছেলেদের বলতে লাগল -­ এই মড়াকে ওই কূলে নিয়ে গিয়ে ফেলে দে। রাজাকাররা জানলে ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দেবে। ছেলেরা কিন্তু নিরুত্তর রইল -­ প্রস্তাবটা ওদের মনঃপূত হয়নি। কিন্তু সে তাদের বারবার উত্তেজিত করতে লাগল -­ এ মড়া রেখে তোরাও মরবি, আমাদেরও মারবি। যা, তাড়াতাড়ি আপদ দূর কর। এতে অপমানাহত হয়ে তিনি একটি ছেলের মাধ্যমে মৌলভিগোছের যুবকটিকে ডাকলেন এবং বললেন -­ জীবন বাঁচানো ফরজ, পরের জীবন বাঁচানো আরো বড় ফরজ। আমি এখনো বেঁচে আছি। আমাকে ওভাবে ফেলে দিলে তো মরে যাব। যদি পারো কোনো ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দাও। সে বিরক্ত হয়ে বলল -­ ডাক্তার কোথায় পাব? এ-কথা বলেই সে চলে গেল। কিন্তু সে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবির্ভাব ঘটল এক মজবুত চেহারা বুড়ো মাঝির -­ ট্যারা চোখ, গাভর্তি কেশ। দেরি না করে সে তাঁকে কাদার ওপর দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে সাম্পানে তুলে নিল। তাঁর এই কাজে মনে হয় ওই মহৎ মৌলবির নেপথ্য ইঙ্গিত ছিল। নিরুপায় ছেলেদের কয়েকজন দৌড়ে গিয়ে কয়েকটি ট্যাবলেট জোগাড় করে নিয়ে এলো -­ কর্ণফুলীর জল মুখে দিয়ে খাইয়ে দিলো। না, আর দেরি নয়। বেটা বুড়ো মাঝি এক হেঁচকা টানে সাম্পান বেয়ে ওই কূলে নিয়ে চরের ওপর ফেলে দিলো -­ টেনে-হিঁচড়ে সাম্পান থেকে যেন মরা গরু ফেলে দিলো। কাজের বকশিশও নিতে ভোলেনি বুড়ো মাঝিটি। চোখের চশমা ও মাতৃরাইটার কলমটি নিয়ে ফেলল। তিনি কাতরকণ্ঠে বললেন -­ কলমটি নিয়ে যাও, চশমাটি রেখে যাও। চশমা ছাড়া আমি দেখি না। আর এই বাজারে পুরনো চশমা কেউ নেবে না। বুড়ো মাঝি সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলো -­ তোর চশমা তোর পকেটেই আছে। বলেই সাম্পানে উঠে চলে গেল। পরিত্যক্ত শবের মতো পড়ে আছেন চরভূমির ওপর। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। অসহায় শূন্যচোখে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। শীতের রোদ কড়া হয়ে উঠেছে। মনের মধ্যে কতই না কথার উদয়-বিলয় হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। ‘কত কথা পুষ্পপ্রায়, বিকশি উঠিতে চায়, কত অনুরাগে’, জীবনে আমি তো তেমন খারাপ কাজ করিনি। তবু এত দুঃখ পাচ্ছি কেন? যিশু, মোহাম্মদ, শ্রীকৃষ্ণ এঁরা তো লাঞ্ছনা পেয়েছিলেন অনেক। আমি তো সাধারণ মানুষ, আমার তো কথাই নেই। মহাভারতের সেই বিখ্যাত চরণ দুটো মনে পড়ল -­

মাতুলঃ যস্য গোবিন্দঃ পিতা যস্য ধনুর্ধরঃ

অভিমন্যুঃ রণে শেতে নিয়তি কেন বাধ্যতে।

হঠাৎ দেখা গেল এক সাম্পানে দুজন লোক দ্রুত তাঁর দিকে আসছে -­  কর্ণফুলীতে তখন পূর্ণজোয়ারের টান। লোকদুটো সাম্পান নিয়ে কাছে এসে ভিড়লে এই বিরান চরভূমি থেকে উদ্ধার পাওয়ার ব্যাকুল আশায় জিজ্ঞেস করলেন -­ তোমরা কোথায় যাবে? ওরা বলল -­ টাকা পেলে তবে যেতে পারি। তিনি বললেন -­ তোমরা আমাকে সাম্পানে তুলে নাও। আমি কানুনগোপাড়া কলেজে থাকি। আমার কাছে এখন টাকা নেই। আমাকে কলেজে পৌঁছে দিলে ওখানে তোমাদের টাকা দিতে পারব। ওরা বলল, ওরে বাবা! ওদিকে রাজাকারের খুব ভয়। তারপর বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে বলল -­ টাকা-পয়সা, সোনাদানা আছে? ছেলেমেয়ে কজন? বাড়িতে বউ কটা? ইত্যাদি। ওদের দিকে তাকিয়ে তিনি স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন -­ তোমাদের কথার উত্তর দিতে পারি। কিন্তু এখন শক্তি নেই, কথা বলতে পাচ্ছি নে। চেহারায় মনে হলো ওরা দুজন ভাই। তাঁর দিকে দৃষ্টি রেখে সাম্পান থেকেই কথা বলছিল।

কথার ফাঁকে দেখা গেল আরেকটি সাম্পান তীব্রগতিতে যেন তাঁর দিকেই ছুটে আসছে। প্রৌঢ়বয়সী মাঝি, দীর্ঘকায়, দোহারা চেহারা, শ্বেতশুভ্র লম্বা দাড়ি। পরনে লুঙ্গি আরেকটি পুরনো কোট। গলায় মাফলার জড়ানো। আগের মাঝিযুগল তাকে দেখে তাচ্ছিল্য করে বলল -­ তুই কডে যদ্দে (তুই কোথায় যাচ্ছিস)? সে তৎক্ষণাৎ মরণকাতর পরিত্যক্ত লোকটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল -­ ওই মানউষ্যারে নিবারলাই রসুল আঁরে পাডাইয়ে যে (ওই মানুষটাকে নেওয়ার জন্য রাসুল আমাকে পাঠিয়েছেন)।

কথাটা বড় মধুবর্ষণ করল কানে। এতদিন বইয়ে পড়েছেন, কানে শুনেছেন, কিন্তু আজ সশরীরে দেখা পেলেন যেন ফেরেশতার। সাগ্রহে তাঁর দিকে লক্ষ করে বললেন -­ আমাকে! আমার তো টাকা-পয়সা কিছু নেই বাবা! মাঝি বলল -­ আঁই টেয়াপইসার লাই নআই। তোঁয়ারে নিবারলাই আসছি যে (আমি টাকা-পয়সার জন্য আসিনি, তোমাকে নেওয়ার জন্যই এসেছি)। এ-কথা বলেই ফেরেশতার মতো মাঝিটি অন্য দুজন মাঝিকে বলল -­ তোঁয়ারা আঁরে এট্টু সাইয্য কর! মানউষ্যারে ধরি আঁরে সাম্পানত তুলি দ (তোমরা আমাকে একটু সাহায্য করো। মানুষটিকে ধরাধরি করে আমার সাম্পানে তুলে দাও)। মানুষটি তখন বিবস্ত্র। মাঝিকে বললেন -­ আমাকে একটা ছেঁড়া লুঙ্গি দাও বাবা। লজ্জা লাগছে। সে একটি ন্যাকড়া দিলো। কোনোরকমে লজ্জা নিবারণ করা গেল। বলা বাহুল্য, পায়ের কাদা জমাট বেঁধে শুকনো হয়ে গেছিল। বুড়ো মাঝি ভাঙা বর্তনে করে পানি এনে মৃতপ্রায় মানুষটির পা-দুটো পরিষ্কার করতে লাগল। তখন মানুষটি লজ্জায় মরে যেতে লাগলেন। সবিনয়ে বললেন -­ আমার বাবা নেই। তুমিই আমার বাবা। জীবনদাতা বাবা। তোমাকেই বাবা করে রাসুল পাঠিয়েছেন। বুড়ো মাঝি নয়, যেন ফেরেশতাই কথা বলে উঠল -­ লজ্জা কীসের! বাবাও ছেলের পা ধুয়ে দিতে পারে।

মাঝিটি ছোট্ট শিশুটির মতো করে পাঁজাকোলা করে সাম্পানে তুলে আনল মানুষটিকে। আর দুজন মাঝি জানতে চাইল -­ কোথায় নিয়ে যাবে? সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো মাঝির উত্তর -­ আমার আলস্নাহ-রাসুল যেখানে নিতে বলেন সেখানেই নিয়ে যাব। একটুক্ষণ পরে শান্তকণ্ঠে বলল -­ চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালে নিয়ে যাব। বলেই বিসমিলস্নাহ বলে পাল তুলে সাম্পান ছেড়ে দিলো। পূর্ণজোয়ারে সাম্পান ছলাৎ ছলাৎ করে ছুটে চলেছে। আহা! কী শান্তি! এক ফেরেশতা এসে তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। মনে পড়ে যায় কবিতার দুটো চরণ -­

তোমার মধুর বায়, সুখে ভেলা ভেসে যায়

উন্নত তরঙ্গ দলে করি অবহেলা…।

উজানে চলছে সাম্পান। কিন্তু এখন জোয়ারের অনুকূলে স্রোতের টান। কিছুদূর যাওয়ার পর কালু মিয়া নামক এক তরুণ মাঝির সঙ্গে দেখা। মনে হলো ওরা একই গ্রামের লোক। কালুকে মাঝি বলল -­ বাড়িতে কইস্ আঁই উগ্গা রুগী লই চন্দ্রঘোনা যাইর। কালিয়া ফজরত আইসসুম (বাড়িতে বলবি আমি একজন রোগী নিয়ে চন্দ্রঘোনা যাচ্ছি। কাল সকালে আসব)। আরো বলল -­ সামনে চরণদ্বীপে গিয়ে পাড়ায় খবর দিবি -­ ডাক্তার থাকলে রেডি থাকতে বলবি। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর সাম্পানের গতি যেন কিছুটা সিত্মমিত হয়ে গেল। রোগী জিজ্ঞেস করলেন -­ বাবা, কী খবর, সাম্পান চলে না যে। সন্ত্রস্তকণ্ঠে মাঝি বলল -­ সামনে লোকের ভিড় দেখা যাচ্ছে। মনে হয়, রাজাকারের দল। আঁতকে উঠলেন তিনি -­ আমি আর রাজাকারের মুখ দেখতে চাই না। আমাকে জলেই ভাসিয়ে দাও। বুড়ো হেসে বলল -­ ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যই কি এত কষ্ট করছি? তাঁর এই কথা শুনে নজরুলের সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তিটি মনে পড়ল -­  ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

কিছুক্ষণ পর সাম্পান আবার স্বাভাবিক গতিতে চলতে লাগল। বুড়ো নিজেই বলে উঠল -­ রাজাকার নয় ওরা। কালুর মুখে খবর পেয়েই ওরা জড়ো হয়েছে। রাজাকারের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত বলে পরিত্যক্ত অথচ পরে বেঁচে যাওয়া কানুনগোপাড়া কলেজের একজন প্রফেসরকে নিয়ে আসা হচ্ছে -­ খবরটা চরণদ্বীপ বৌদ্ধপলিস্নতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। পুরুষ-মহিলা-ছেলে-বুড়ো মিলে বিশ-পঁচিশজন ঘাটে কৌতূহলী কিন্তু সহমর্মীর বেদনা নিয়ে অপেক্ষমাণ। প্রায় সবার হাতে কিছু কিছু খাবার।

সাম্পান ঘাটে ভিড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দুজন গ্রামীণ ডাক্তার -­ ষাটোর্ধ্ব বয়স, লাফ দিয়েই যেন সাম্পানে উঠলেন। কোমলকণ্ঠে বললেন -­ আপনি বাঁচবেন, ভয়ের কারণ নেই। তিনিও হাসিমুখে বললেন -­  এতক্ষণ যখন বাঁচলাম, নিশ্চয় বাঁচব। আমার বাবাকে পেয়েছি। আপনাদেরও পেয়েছি। ভয় কী?

বলা বাহুল্য, সুদীর্ঘকাল ধরে তিনি কানুনগোপাড়া কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনায় নিযুক্ত আছেন। খ্যাতিমান কৃতী শিক্ষক। মণীন্দ্রলাল ভট্টাচার্য বা এম.এল.বি একটি বহুশ্রুত নাম। তাই সবাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। গ্রামীণ ডাক্তার দুজনের হাতে ওষুধ তৈরি ছিল। পেনিসিলিন ইনজেকশন, ট্যাবলেট, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি। পরম যত্নে প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেন ওঁরা। বুকের ক্ষত ধুয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। হাত ও ঊরুতেও ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। প্রফেসর তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন -­ কোরামিন আছে? দুজনের কাছেই কয়েক ফোঁটা করে কোরামিন ছিল। তাই খাওয়ানো হলো। বিশ-পঁচিশ মিনিট পরে মনে হলো শরীরে কিঞ্চিৎ বলের সঞ্চার হয়েছে।

সবাই কিছু কিছু খাবার দিলো -­ কমলা, লজেন্স, গ্লুকোজের পানি, পেঁপে ইত্যাদি। সাগ্রহে গ্রহণ করলেন তিনি। ছেলেদের মধ্যে একজনকে তিনি চেহারা দেখে শনাক্ত করতে পারলেন, তাঁরই প্রাক্তন ছাত্র। তাকে বললেন -­ তুমি তো আমার ছাত্র বলে মনে হয়। আমার জন্য একটা লুঙ্গি নিয়ে এসো। সে দৌড়ে গিয়ে লুঙ্গি নিয়ে এসে নিজের হাতে পরিয়ে দিলো। মাঝি তাদের কাছ থেকে কয়েকটি টাকা চেয়ে নিল। তিনি মাঝিকে বললেন, দোকানে গিয়ে চা-টা খেয়ে এসো। একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এখন কোথায় যাবেন? বললেন -­ আমি তো জানি না। আমার বাবা যেখানে নিয়ে যান। বাবা বললেন -­ আমরা চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালে যাব। কে একজন বললেন -­ চন্দ্রঘোনায় মিলিটারির ভয় আছে। একজন ডাক্তার শেষ পরামর্শ দিলেন -­ যেখানে যান বেতাগীর বাদলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। তিনি সচকিত হয়ে প্রশ্ন করলেন -­ কোন বাদলবাবু? ডাক্তার বললেন -­ বাদলবাবু আমার আত্মীয়, কানুনগোপাড়া কলেজের বাংলার অধ্যাপক। তখন তিনি যেন অকূলে কূল পেলেন। সানন্দে সগর্বে বললেন, বাদলবাবু তো আমার ছাত্র এবং সহকর্মী। ঠিক আছে, সেখানেই যাই। বাঁচার পথসন্ধানে মাঝির সাম্পান শুরু করল নতুন অভিযাত্রা।

যাওয়ার পথে উত্তর কূলে লাম্বুর হাট। সেখানে হাটুরেদের কাছে খোঁজখবর নিলেন প্রফেসর বাদলবাবুকে চেনে কিনা? বেতাগী আর কদ্দূর? না, আরো তিন-চার মাইল উজানপথে যেতে হবে। যেতে যেতে খেলাঘাট, কাটাখালী, গোলাম ব্যাপারীর হাট থেকে নির্দেশ নিয়ে অবশেষে সাম্পান পৌঁছল বেতাগীখালের মুখে। একটু ভেতরে পুল। পাশে কয়েকটি দোকান। সাম্পান গিয়ে থামল দোকানের পেছনে। পুলের পার্শ্ববর্তী কুলালপাড়ার নুরুচ্ছফাকেই প্রথম দেখলেন তিনি। দেখেই চিনলেন -­ কানুনগোপাড়া কলেজের ছাত্র। কাতরকণ্ঠে ঘটনা জানালেন। ততক্ষণে খবর রটে গেছে মুখে মুখে, একজন বুড়ো মাঝি কালুরঘাট থেকে রাজাকারের গুলিবিদ্ধ আধমরা কানুনগোপাড়া কলেজের এক প্রফেসরকে নিয়ে এসেছে -­ বাদলবাবুকে খুঁজছে। ধনাঢ্য, সুজন, সুধীন্দ্র, চাণক্য, লোটন, শংকর, রতন, বোধিসত্ত্ব, মানিক, যিশু প্রমুখ। ট্রেনিংশেষে গেরিলা গ্রম্নপের সদস্যরা যাওয়া-আসার পথে এখানেই পেত নিরাপদ আশ্রয়। তাদেরই কেউ কেউ কানুনগোপাড়া কলেজের বর্তমান কিংবা প্রাক্তন ছাত্র-সুবাদে স্যারকে দেখে যেত আর প্রতিজ্ঞা করত দেশ স্বাধীন করে এর বদলা তারা নেবেই। রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী ও উদয়ন নাগের নাম এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাই চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য এনে দিত। এভাবে এই ছোট্ট বৌদ্ধপলিস্নটিই হয়ে উঠেছিল এ-মৃত্যুঞ্জয় শহিদের শেষ পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ক্যাপ্টেন শাহ আলম গ্রম্নপের শাহ আলম, মুহম্মদ ইউসুফ, পুলক দাশ, শামসুজ্জামান হিরা, ফজল আহমদসহ ক্যাপ্টেন করিমের গ্রম্নপের অনেক গেরিলা সদস্যের কথা বলা যায়। স্মৃতিতে অনেকের তরুণমুখ ভাসছে; কিন্তু নাম মনে নেই।

পিতৃবন্ধু মুসলিম লীগ নেতা মৌলভি ছৈয়দুল হক মিঞার সঙ্গে বাদলদের পরিবারের ছিল পরম স্নেহময় সম্পর্ক। তাই তিনচৌদিয়ার পাহাড়ের কোলে তাঁর বাড়িটা ছিল বাদলদের অন্যতম আশ্রয়স্থল। সহকর্মী অধ্যাপক অজিতকান্তি দাশকে নিয়ে যুদ্ধ শুরুর ভয়ংকর দিনগুলোর বেশিরভাগ তিনি এখানেই ছিলেন। সে-সময় ছাত্র আবদুল হাকিম, ছৈয়দুল হকের সুবোধ দুই পুত্র – জিলস্নুর ও মাহবুব নিরাপত্তার জন্য তাঁদের ছায়ার মতো অনুসরণ করত। ঘটনার দিনও বাদল এ-আশ্রয় থেকেই সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরেছিল।…

এক-একটা দিন এক-একটি যুগের মতো পার করে অবশেষে এলো বিজয়োলস্নাস নিয়ে ষোলোই ডিসেম্বর। স্বসিত্মর নিশ্বাস নিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সবাই। পরদিন বিকেলে বেতাগীর রামগতি হাটে বিজয়োলস্নাসের জন্য এক বিরাট জনসভা ডাকা হয়েছিল। এর পরদিনই মুক্ত পরিবেশে স্যারকে চট্টগ্রাম হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অধিকতর সুচিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। নৌকাপথে সে-নবজীবনের সন্ধানে সঙ্গে গিয়েছিলেন ডা. এমদাদ, ডা. কিরণ, ডা. কমল, অধ্যাপক জামালউদ্দীন, অধ্যাপক বাদল বড়ুয়া প্রমুখ। সবার মনে তখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠামুক্ত আনন্দময় দ্যুতি।

হাসপাতালে এ-মানুষটিকে ঘিরে এক অভূতপূর্ব ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। এ যেন নতুন করে জীবন শুরুর পালা। যে-সহৃদয় চিকিৎসকরা তাঁর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁদের কয়েকজনের নাম মনে পড়ছে -­ রেসিডেন্ট সার্জন ডা. সামশুল হক, ডা. এফ করিম, ডা. ইয়াকুব, ডা. খোন্দকার প্রমুখ। ১৮/১২/৭১ থেকে ২৩/০৩/৭২ পর্যন্ত একনাগাড়ে তিন মাস হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলেছিল। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন ভারতেও। কিন্তু অষ্টাবক্র ভগ্ন ডান হাত সোজা ও স্বাভাবিক করার কোনো উপায় সেখানেও ছিল না। হাসপাতালে যে-কমাস ছিলেন অসংখ্য দর্শনার্থীর পুণ্যতীর্থে পরিণত হয়েছিল তাঁর কেবিনটি।

তাঁর সতীসাধ্বী স্ত্রী স্বর্ণপ্রভা ভট্টাচার্য তাঁর ভাশুরের ছেলে অধ্যাপক বিভূতিভূষণ ভট্টাচার্যসহ বেতাগীতে বাদলের বাড়িতে গিয়েছিলেন তাঁর সন্ধানে। সেখান থেকে ছুটে এসেছিলেন হাসপাতালে। ইতিপূর্বে খবর পেয়ে একজন সাহসী মুসলিমকে বেতাগীতে বাদলের বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন তাঁরা। ওই মুসলিম পাগলের ছদ্মবেশে এসে স্বচক্ষে সব দেখে গিয়েছিলেন, জেনে গিয়েছিলেন। তিনি যে বেঁচে আছেন, সে-খবর পৌঁছে দিয়েছিলেন।

যে-বেতনের জন্য কোর্টে জেলা প্রশাসক তাঁকে উপেক্ষা করেছিল সে-বকেয়া বেতন হাতে হাসপাতালে কলেজের এক অধ্যাপক উপস্থিত। সে-সময় তাঁর টাকার বড় প্রয়োজন। শুভানুধ্যায়ী অনেকেই সাধ্যমতো তাঁকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছিলেন বাদলের হাত দিয়ে বাড়িতে ও হাসপাতালে।

হ্যাঁ, অবশ্যই বলতে হয় তিনি একজন মৃত্যুঞ্জয় শহিদ -­ আর তাঁর জীবনদাতা পিতা হলেন সেই বুড়ো মাঝি -­ যাঁর নাম বাঁচা মিয়া। মোহরা যাঁর ঠিকানা। সেদিন তাঁর আকুলতার অন্ত ছিল না এ-মানুষটিকে ঘিরে। তিনি খুশি হয়েছিলেন বাদলের হাতে তাঁর ছেলেকে তুলে দিতে পেরে। বাড়ি পর্যন্ত এসে বাদলের হাত ধরে তিনি বলেছিলেন -­ আঁর আর কোনো চিন্তা নেই, অনার হাত্ত আঁর পোয়ারে তুলিদি। আঁর পোয়া নিশ্চয় বাঁচিব (আমার আর কোনো চিন্তা নেই। আপনার হাতে আমার ছেলেকে তুলে দিয়েছি। আমার ছেলে নিশ্চয়ই বাঁচবে)। তাঁকে বলেছিলাম -­ নিশ্চয় বাঁচবে। তুমি নিশ্চিমেত্ম থাকো। সেদিন রাতেই বিদায় নিয়েছিলেন মাঝি। কিন্তু একদিন পর সকালে এসে হাজির। মুখে তৃপ্তির হাসি। ছেলের ছিনতাই হওয়া চশমা-কলম উদ্ধার করে এনেছেন। এরপর
মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতেন। এর মধ্যে স্বার্থের কোনো গন্ধ ছিল না। তাই প্রতিদিন হাসপাতালে আসতেন ছুটে। পরে কানুনগোপাড়া কলেজের কোয়ার্টারেও প্রায়সময় এসে ছেলের খোঁজখবর নিয়ে যেতেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ছেলের মঙ্গল কামনায় তিনি ছিলেন ব্যাগ্র ব্যাকুল।

ত্রিশ লাখ শহিদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ইতিহাসে এ-দুজনের নাম উচ্চারিত কিংবা লিখিত হবে না কোথাও।

অথচ সত্যিকার অর্থেই তিনি একজন শহিদ -­ মৃত্যুঞ্জয় শহিদ…

আর অসংখ্য মানুষ কিংবা অমানুষের ফেরেশতার মতো মাঝিটি?

সব মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে ইতিহাসকে এখানে একবার থমকে দাঁড়াতেই হবে -­ সাজাতে হবে তাকে সঠিক উত্তরের ডালি।