ইমদাদুল হক মিলন
-
কাল
পাঁচ তখন রতনপুর বাজারটা ছিল পদ্মার কোলঘেঁষে। রিশিপাড়া ছাড়িয়ে দক্ষিণে দশ-পনেরো কানি আবাদি জমি। তার পশ্চিমে বাজার। নদীতীর থেকে একটা রাস্তা বেরিয়ে সোজা চলে গেছে উত্তরে। রিশিপাড়ার মুখে এসে দুদিকে দু-হাত ছড়িয়েছে। ওদিক থেকে হেঁটে এলে বাঁ-হাতের রাস্তা চলে গেছে কুসুমপুরের দিকে, ডান হাত গেছে রতনপুর পোস্ট অফিসের দিকে। পদ্মাপারে গিয়ে শেষ হয়েছে এই রাস্তা।…
-
মুখোশ পরা মানুষ
রিসেপশন থেকে ফোন এলো। ‘স্যার, এক ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’ চায়ে চুমুক দিতে দিতে আসিফ সেদিনকার খবরের কাগজ দেখছিল। এখন খবরের কাগজ আর পড়া হয় না। শুধু চোখ বোলানো। হেডলাইনগুলি দেখা। ওসব হেডলাইন দেখতে দেখতে বলল, ‘কী নাম?’ ‘নাম বলেননি।’ আসিফ তেমন অবাক হলো না। সে যেখানেই যায় এরকম অনেক মহিলাই তার সঙ্গে…
-
কাল
চার আষাঢ় মাসের সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে ঠাকুরের নৌকা নিয়ে বাড়ি এসেছিল বদরু। বরইতলায় নৌকা বেঁধে উঠানে এসে দেখে জমসেদ তখনো ঘরের ছেমায় বসা। বড়ঘরের খোলা দরজায় পিতলের বড় কুপিটা জ্বলছে। ছোট ভাই দুটো, বোন দুটো মেজো বোনের ঘরের ছেমায় বসে কিচ্ছা শুনছে কফিলের কাছে। আধা-প্রতিবন্ধী মানুষটা আবার কিচ্ছার ওস্তাদ। কত কিচ্ছা যে তার ঝোলায়!…
-
কাল
দ্বিতীয় পর্ব তিন সেই রাতে ঠাকুরবাড়ির দিকে একটা নিমপাখি ডাকছিল। কৃষ্ণপক্ষের রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার দেশ গ্রামে। আষাঢ় মাস। আকাশে মেঘের চলাচল ছিল ঠিকই, তবে বৃষ্টি ছিল না। হাওয়ায় ছিল কদমফুলের গন্ধ। নিমপাখির সঙ্গে কুসংস্কার আছে প্রবল। পাখিটা কেউ কখনো চোখে দেখেনি। কোন পাখিটা যে নিমপাখি কেউ বলতে পারবে না। ডাকে রাতের বিভিন্ন প্রহরে। ডাকটা তিন-চারদিন…
-
হাসনাতভাইয়ের জন্য লেখা হলো পর
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘ঢাকা ক্লাবে’। সন্ধ্যাবেলায় সেখানে অনেক লেখক ও টিভি নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রী একত্রিত হয়েছেন। আবুল হাসনাতও ছিলেন। মানে আমাদের সবার প্রিয় হাসনাতভাই। এক ফাঁকে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে তিনি বললেন, ‘কালি ও কলম নামে আমরা একটা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আবুল খায়ের লিটুর ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ থেকে পত্রিকাটি বেরোবে। আমাদের সঙ্গে…
-
কাল
১ দেবকুমার ঠাকুরকে লোকে বলে দেবু ঠাকুর। গেল বর্ষায় সেই দেবু ঠাকুরের সঙ্গে রতনপুর গ্রামটিও খুন হয়ে গেল। খুনের রাতে গ্রামের লোকজন একত্র হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল। চারদিককার বাড়ি থেকে ডিঙিনাও, কোষানাও, হারিকেন, কুপিবাতি আর টর্চলাইট নিয়ে লোকজন ছুটে এসেছিল। গাছপালা-ঝোপজঙ্গল-বাঁশঝাড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠাকুরবাড়ি কিছুটা আলোকিত হয়েছিল। সেই আলোয় দেখা গেল বড় ঘরের দরজায় পড়ে আছেন…
-
ভুলে যাওয়া নাম
‘আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন?’ মেয়েটির প্রশ্নে শুভ একটু থতমত খেল। ‘না, এমনি। কোনো কারণ নেই।’ ‘নিশ্চয় কারণ আছে। কারণ ছাড়া কেউ কারো দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকে না। তাছাড়া ব্যাপারটা যে আমি আজই প্রথম খেয়াল করলাম তা নয়। আগে আরো তিন-চারবার খেয়াল করেছি। আমাকে দেখলেই আপনি কেমন করে যেন তাকান।’ কথা লুকাতে গিয়েও…
-
টিয়া পাখির অভিমান
ওয়াশরুমে ঢোকার আগে মোবাইল দুটো আমি বিছানার ওপর রেখেছিলাম। একটা ফোনে চিটাগাংয়ে কথা বলছিলাম, আরেকটা ফোন ছিল হাতে। কথা শেষ করে দুটোই বিছানায় ছুড়ে ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে গিয়েছিলাম। ফোন দুটো সাইড টেবিলে রাখল কে? একদম গুছিয়ে পাশাপাশি সুন্দর করে রাখা! এই ফ্ল্যাটে তো আমি ছাড়া কেউ নেই। তিনদিন হলো উত্তরার এই ফ্ল্যাটটায় আমি উঠেছি। লেকের…
-
গরিবকাল
মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। একটু এপাশ-ওপাশ করি, তারপর আবার ঘুমিয়ে যাই। চৌকিতে বাবার সঙ্গে ঘুমাই। মেঝেতে মা আর অন্য চার ভাই-বোন। আমি বড় ছেলে। বাবা খুব ভালোবাসেন আমাকে। আমিও বাবা ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না। ক্লাস সেভেনে পড়া ছেলেটি এখনো পারলে বাবার কোলে চড়ে। বাবাও পারলে তাকে কোলে নেন। সকালবেলা অফিসে যাওয়ার সময়…
-
হাসনাতভাই
নবাবপুরের মাঝামাঝি পশ্চিম দিককার এক রাস্তায় মানসী সিনেমা হল। মানসী হলের নাম তখন ছিল ‘নিশাত’। এই হলের ঠিক উলটোদিকে লোহার বিশাল একটা গেট, টিনশেডের দৈনিক সংবাদ অফিস। যতদূর মনে পড়ে তখন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের কাজ কিছুটা শুরু হয়েছে। ১৯৭৫-৭৬ সালের কথা। তখন দুটো দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা অত্যন্ত জমজমাট। একটি দৈনিক বাংলার সাহিত্যপাতা, আরেকটি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য…
-
বটবৃক্ষের ছায়া যেমন
আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে কবে যে পরিচয়, সে-কথা মনে পড়ে না। কবে যে ঘনিষ্ঠতা বা তাঁর স্নেহের ছায়ায় আশ্রয় মিলল, সে-কথা মনে পড়ে না। মনে হয় জন্মের পর থেকেই তিনি আমার মাথার ওপর ছিলেন। আমার দশ দিক জুড়ে ছিলেন। স্যার ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। তাঁর ছায়ায় দাঁড়িয়ে তনুমন জুড়িয়েছে। তাঁর মুখপানে তাকালে যে-আলোর ছটা দেখা যেত সেই…
-
আলোককন্যা
জিল্লু এরকমই। যে-কোনো কথা শুরু করে ‘না’ দিয়ে। এই যেমন এখন। আমাকে ফোন করেই বলল, না না, তোকে ফোন করেছি অন্য একটা কারণে। চা শেষ করে সিগ্রেট ধরিয়েছি। বড় করে টান দিয়ে বললাম, কারণটা বল বাপ! জিল্লু হাসল। না না, ব্যাপারটা হলো তুই তো জানিসই আমি সুইডেনের বাংলাদেশ সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি। সুইডেন নরওয়ের সব বাঙালিই…