ফারুক মাহমুদ
-
নাম
(উৎস : জীবনানন্দ দাশ) একবার ভালোবেসে, অন্যবার অবহেলা করে কখনো-বা ঘৃণা করে মেয়েদের দেখেছেন তিনি মেঘের নকশার মতো মুগ্ধকর অনেক দেখায় সেই মেয়ে – স্তন যার প্রবাহিত জলের উচ্ছ্বাস বরফকুচির মতো শীতল ও সাদা, ছড়ায়ে শিশিরশব্দ, আঁচলের চোরকাঁটা বেছে যে-যুবতী হাসিমুখে দ্রুত চেয়ে থাকে, কোনো কোনো মহিলাকে ভালোবেসে পাওয়া যায় জ্ঞান, যদি মেয়েমানুষের দেখা…
-
স্মৃতিসত্য
(উৎস : শেখ মুজিবুর রহমান-রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী) ভূমিকা সময় নির্মাণ করে মানুষের বহুবিধ কাজের সোপান ওরা আমার উর্বর সময়ের বুকে বসিয়ে রাখছে দাহ, জন্মক্রুদ্ধ বিষধর ছোরা ক্লান্ত পথিকের মতো বেঁচে থাকাটুকু বয়ে নিয়ে বাঁচি ‘বসেই তো আছ, লেখ, তোমার জীবনের গল্প আর স্মৃতি-সত্যগুলো’ জেলগেটে যতবার দেখা, সহধর্মিণীর চাপা অনুরোধ একবার, হাতে গুঁজে দিলো…
-
বাণভট্ট
স্থাণ্বীশ্বর নগর । বাণভট্ট দেখছে – শুধু চোখে-ঠোঁটে নয়, নগরের সকল অঙ্গে ছড়িয়ে আছে রেখা-রেখা আলোর হাসি। প্রশস্ত রাস্তা। মনে হয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক মহিষের পিঠ। বড় শোভাযাত্রা বেরিয়েছে। এতে নারীর সংখ্যাই বেশি। রাজবধূরা যাচ্ছেন দামি পালকিতে চড়ে। সঙ্গে পরিচারিকারা যাচ্ছে পায়ে হেঁটে। তাদের নূপুর ক্বণনে চারপাশ মুখর। পথ চলতে, ভুজলতা তোলার সময় মণিময়…
-
দুই হৃদয়ের নদী
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – খ্যাতি হচ্ছ উঁচু কোনো দেয়ালের মতো একপাশে প্রশংসার বহুবিধ ক্লান্ত কোলাহল অন্যপাশে একাকিত্ব ন্যস্ত থাকে জোর পাহারায় বলা যায়, আমি সেই দেশ, যার ভূগর্ভে রয়েছে মূল্যবান কয়লার খনি, আছে – হীরে-সম্ভাবনা লোভাতুর যারা, বনশ্রীকে পরিয়েছে রক্তরজ্জুফাঁস আমার লেখার মূল্য ঈর্ষণীয় চড়া। তবু দেখি ব্যক্তিমূল্য ঢেকে যাচ্ছে প্রশংসার এঁদো আস্তরণে…
-
বৃষ্টি শোনার রাত
এমন একটা ঘটনার মধ্যে পড়তে হবে, আমাদের কল্পনায়ও ছিল না। আমি আর সোনালি চট্টগ্রাম যাছি। রেলভ্রমণ বরাবরই আমার প্রিয়। আর রাতের ট্রেন হলে তো কথাই নেই। দূরের হোক আর কাছের হোক, দুদিনের জন্য বা দু-সপ্তাহের জন্য হোক, বেশি কাপড়চোপড় সঙ্গে নেওয়া আমার পছন্দ নয়। সোনালিরও তা-ই। কোনো রকম চালিয়ে নিতে পারলেই হয়। বাড়তি কাপড়চোপড়ের বোঝা…
-
আম্রপালী
পৃথিবীর সব কোমল মধুর স্বচ্ছ শব্দ যেন এই মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে আছে। মগধের পরাক্রমশালী রাজা বিম্বিসারের আলোকিত জলসাঘরের নূপুরনিক্কণ, চুড়ির রিনিঝিনি, ভূষণধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। বিম্বিসার কদিন আগে একটি রাজ্য জয় করে ফিরেছেন। রাজ্য জয় করে নিজ রাজ্যের পরিধি বিস্তার তাঁর নেশা। প্রাসাদের কক্ষগুলিতে তাঁর কয়েকশো স্ত্রী। তবু বিম্বিসারের স্ত্রী গ্রহণের…
-
সব শিল্প আত্মপ্রতিকৃতি
(হোর্হে লুইস বোর্হেসের দি মেকার গ্রন্থে পাওয়া একজনের কাহিনি) তার বেঁচে-থাকা ছিল মহাবিশ্ব অংকনের ব্রত এঁকেছেন চিন্তাস্রোত, স্বপ্নরেখা, দর্শনের ধারা স্বর্বংসহা মৃত্তিকার বহুস্তর শরীর ও মন প্রেমের চোখের মতো তারাদের ঠোঁটচাপা হাসি চাঁদের উপুড় বাটি, পাহাড়ের ধ্যানের আলোক এঁকেছেন যুদ্ধজাহাজ, বারুদের জটিল ভাণ্ডার প্রাসাদের হাড়গোড়, মৃত কূপ, শূন্য আস্তাবল পড়ন্ত স্তনের মতো সিঁড়িধাপে থিতু অন্ধকার…
-
ভদ্দা কুণ্ডলকেশা
নগরবাসী এমন নির্দয় দৃশ্য কখনো দেখনি। চৈত্রের আকাশ খুব যেন রাগ করে আছে। সূর্যের তীব্র আলো, উদ্ধত উত্তাপ। পুড়ে যাচ্ছে প্রকৃতির সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গ। নিদাঘের এমন দুপুরে মগধের রাজধানী রাজগৃহের রাজপথের দৃশ্য : পিছমোড়া বাঁধা এক যুবক, চোখে কালো ফেট্টি। চাবুকপেটা করে, টেনেহিঁচড়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে রাজার কয়েকজন সান্ত্রী। আধো কৌতূহল, আধো ভীতি। নিরাপদ দূরত্বে থাকা…
-
কবি লিখলেন মেঘ
যেন অর্ধশান্ত নদীর ঢেউ। কবির মনে পড়ছে কয়েক মাস আগে দেখা যুবকটির কথা। উজ্জয়িনীর পাশঘেঁষে বয়ে চলা শিপ্রা নদীসৈকতের এই এলাকাটি কবির খুব প্রিয়। প্রকৃতির প্রতিটি অঙ্গ এখানে প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ। আর কবি যখন আসেন, রাত্রির শেষ ছায়া আর দিনের প্রথম আলোর সন্ধিক্ষণ। কৃত্রিম কোলাহল নেই, সবুজের নৈঃশব্দ্য, পাখির গান, শিপ্রার ওপারে নেমে থাকা আকশ; যে-কারো…
-
শুভময়ী বনলতা সেন
(উৎস : জীবনানন্দ দাশ) ‘ভ্রমণে আনন্দ ছিল। হেঁটে হেঁটে পথে কেটে গেছে অজস্র সময় মনে রেখেছেন। সবকিছু এতদিনে হয়নি তো এতটুকু ম্লান কবে, কোন অঘ্রানের মাঠে ধানকাটা হয়ে গেলে কতবার কুড়ালেন খড় চুম্বনের পূর্বাহ্নের মতো রাত্রি আসে শিশিরের শব্দছবি ছুঁয়েছেন ঘুমভাঙা হাতে কোনো-এক শঙ্খবালিকার কথা মনে থেকে আছে কার ছিল ধানমাখা চুল শাঁইবাবলার ঝাড়, অর্জুনের…
-
অতিক্রম
শব্দ : উঁচু-নিচু যা-ই হোক জড়িয়ে ছড়িয়ে দেয় নিজ নিজ ঘ্রাণ কোন শব্দে কান্না হাসে, হেসে ওঠে বেদনার গান কোন শব্দ ঊর্ধ্বমুখী, কোন শব্দ ব্যথাভারাতুর খুলে-মেলে দেখাবার নেই প্রয়োজন। এমন মৌলিক জ্ঞানে, বন্দি, সে-ও চিনে নিয়েছিল কবর খোঁড়ার শব্দ – মৃত্যু আর বেশি দূরে নয় … অন্তিম শব্দটি তার ঢেলে দিলো প্রহরীর কানে – ‘ফাঁসিকাষ্ঠে…